রাহে বেলায়াত পঞ্চম অধ্যায় - মাজলিসে যিকর ও যিকরের মাজলিস ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

উপরের হাদীসগুলি থেকে আমরা কিছু মানুষ একত্রিত বসে আল্লাহর যিকর করলে কী মহান মর্যাদা ও অভাবনীয় পুরস্কারের লাভ করবেন তা জানতে পারছি। এখন প্রশ্ন: একত্রে বসে যিকরের নিয়ম, পদ্ধতি ও কর্মাবলি কী কী? রাসূলুল্লাহ (সা.) কি যিকরের মাজলিসের যিকর ও কর্মের বর্ণনা দিয়েছেন? দিলে আমরা ঠিক সেই কাজগুলিই করব। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণ কি যিকরের মাজলিসে বসতেন? বসলে কিভাবে বসতেন? আমরা ঠিক তাঁদের মতো বসার চেষ্টা করব। কারণ, আমরা জানি যে, যে কোনো ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে তাঁরাই পূর্ণাঙ্গ আদর্শ।


১. কুরআন তিলাওয়াত ও আলোচনা

কুরআনী যিকরের আলোচনার সময় আমরা যিকরের মাজলিসের একটি স্পষ্ট বিবরণ পেয়েছি। আমরা দেখছি, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যখনই কিছু মানুষ আল্লাহর কোনো একটি ঘরে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করতে ও পরস্পরে তা শিক্ষা ও আলোচনা করতে থাকে, তখনই তাঁদের উপর প্রশান্তি নাজিল হতে থাকে, আল্লাহর রহমত তাঁদের আবৃত করে নেয়, ফিরিশতাগণ তাঁদের ঘিরে ধরে এবং আল্লাহ তাঁর নিকটস্থদের নিকট তাঁদের যিকর করেন।


যিকরের মাজলিসের ফযীলতে উপরে উল্লেখিত হাদীসগুলির সাথে এই হাদীস একত্রিত করে আমরা জানতে পারি যে, যিকরের মাজলিসে সমবেত মুমিনগণের অন্যতম একটি যিকর কুরআন তিলাওয়াত ও আলোচনা করা।


২. আল্লাহর নিয়ামত আলোচনা ও হামদ-সানা পাঠ

সাহাবীগণের যিকরের মাজলিসের অন্য একটি বিশেষ দিক ছিল আল্লাহর নিয়ামতের কথা পরস্পরে আলোচনা করা, আল্লাহর প্রশংসা করা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। মু’আবিয়া (রাঃ) বলেনঃ

إن رسول الله صلي الله عليه وسلم خرج علي حلقة من أصحابه فقال ما أجلسكم قالوا جلسنا نذكر الله تعالي ونحمده علي ما هدانا للإسلام ومن به علينا قال آلله (يعني والله) ما أجلسكم إلا ذاك؟ قال أما إني لم استحلفكم تهمة لكم ولكنه أتاني جبريل فأخبرني أن الله عز وجل يباهي بكم الملائكة


“রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘর থেকে বেরিয়ে সাহাবীগণের একটি বৃত্তে (কয়েকজন সাহাবী বৃত্তাকারে বসে ছিলেন সেখানে) উপস্থিত হন। তিনি বলেন, তোমরা কিজন্য বসেছ? তাঁরা বললেন, আমারা বসে বসে আল্লাহর যিকর করছি এবং তাঁর হামদ বা প্রশংসা করছি, কারণ তিনি আমাদেরকে ইসলামের দিকে পথ প্রদর্শন করেছেন এবং ইসলামের মাধ্যমে আমাদের উপর তিনি করুণা করেছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহর নামে প্রশ্ন করছি, সত্যিই কি তোমরা শুধুমাত্র এই উদ্দেশ্যে বসেছ? তাঁরা বললেন, আল্লাহর কসম, আমরা একমাত্র এই উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো কারণে বসিনি। তিনি বলেন: আমি তোমাদের প্রতি সন্দেহবশত তোমাদেরকে শপথ করাইনি। বরং জিবরীল (আ.) এসে আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, আল্লাহ ফিরিশতাগণের কাছে তোমাদের জন্য গৌরব প্রকাশ করছেন। (এই সুসংবাদ প্রদানের জন্যই শপথ করিয়েছি)।”[1]


সুবহানাল্লাহ! কত বড় মর্যাদা। আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে নিয়ে গৌরব প্রকাশ করেন। কারণ তাঁরা জাগতিক বিষয়াদি আলোচনার জন্য নয়, বরং আল্লাহর নিয়ামত আলোচনা, তাঁর প্রশংসা করা ও তাঁরই কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য সমবেত হয়েছে। জাগতিক ব্যস্ততা, প্রয়োজন, লোভ, মোহ বা অন্য কোনো কিছুই তাঁদেরকে প্রভুর স্মরণ ও তাঁর প্রশংসা ও গুণকীর্তন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এভাবে তাঁরা ফিরিশতাগণের ঊর্ধ্বে উঠেছেন।


এই হাদীস থেকে আমরা সাহাবীগণ কিভাবে যিকরের মাজলিস করতেন তা বুঝতে পারি। তাঁরা একত্রে বসে আল্লাহর নিয়ামতের কথা আলোচনা করতেন এবং আলোচনার সাথে সাথে তাঁর হামদ, সানা, ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতেন।


৩. তাসবীহ, তাহলীল, তাকবীর, তাহমীদ, ইস্তিগফার, দু‘আ

অন্যান্য হাদীস থেকে আমরা মাজলিসের যিকরের আরো বিস্তারিত বিবরণ জানতে পারি। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

إِنَّ لِلَّهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى مَلَائِكَةً سَيَّارَةً فُضُلًا يَتَتَبَّعُونَ مَجَالِسَ الذِّكْرِ ، فَإِذَا وَجَدُوا مَجْلِسًا فِيهِ ذِكْرٌ قَعَدُوا مَعَهُمْ ، وَحَفَّ بَعْضُهُمْ بَعْضًا بِأَجْنِحَتِهِمْ حَتَّى يَمْلَئُوا مَا بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ السَّمَاءِ الدُّنْيَا ، فَإِذَا تَفَرَّقُوا عَرَجُوا وَصَعِدُوا إِلَى السَّمَاءِ ، قَالَ : فَيَسْأَلُهُمُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ وَهُوَ أَعْلَمُ بِهِمْ مِنْ أَيْنَ جِئْتُمْ ؟ فَيَقُولُونَ : جِئْنَا مِنْ عِنْدِ عِبَادٍ لَكَ فِي الْأَرْضِ يُسَبِّحُونَكَ ، وَيُكَبِّرُونَكَ ، وَيُهَلِّلُونَكَ ، وَيَحْمَدُونَكَ ، وَيَسْأَلُونَكَ ، قَالَ : وَمَاذَا يَسْأَلُونِي ؟ قَالُوا : يَسْأَلُونَكَ جَنَّتَكَ ، قَالَ : وَهَلْ رَأَوْا جَنَّتِي ؟ قَالُوا : لَا أَيْ رَبِّ ، قَالَ : فَكَيْفَ لَوْ رَأَوْا جَنَّتِي ؟ قَالُوا : وَيَسْتَجِيرُونَكَ ، قَالَ : وَمِمَّ يَسْتَجِيرُونَنِي ؟ قَالُوا : مِنْ نَارِكَ يَا رَبِّ ، قَالَ وَهَلْ رَأَوْا نَارِي ؟ قَالُوا : لَا ، قَالَ : فَكَيْفَ لَوْ رَأَوْا نَارِي ؟ قَالُوا : وَيَسْتَغْفِرُونَكَ ، قَالَ ، فَيَقُولُ : قَدْ غَفَرْتُ لَهُمْ فَأَعْطَيْتُهُمْ مَا سَأَلُوا وَأَجَرْتُهُمْ مِمَّا اسْتَجَارُوا ، قَالَ : فَيَقُولُونَ : رَبِّ فِيهِمْ فُلَانٌ عَبْدٌ خَطَّاءٌ إِنَّمَا مَرَّ فَجَلَسَ مَعَهُمْ ، قَالَ : فَيَقُولُ : وَلَهُ غَفَرْتُ هُمُ الْقَوْمُ لَا يَشْقَى بِهِمْ جَلِيسُهُمْ


“আল্লাহর কিছু অতিরিক্ত পরিভ্রমণকারী ফিরিশতা আছেন (যারা বিশ্বে ঘুরে) যিকরের মাজলিসগুলির খোঁজ করেন। যদি কোনো যিকরের মাজলিস পেয়ে যান, তারা সেখানে তাঁদের সাথে বসে পড়েন এবং তাঁদের একে অপরকে পাখা দিয়ে ঘিরে ধরেন। এভাবে তারা প্রথম আসমান পর্যন্ত পূর্ণ করেন। যখন মাজলিসের মানুষেরা বিচ্ছিন হয়ে যান (মাজলিস শেষে চলে যান) তখন তারা ঊর্ধ্বে উঠেন। মহান আল্লাহ্‌ যিনি সবই জানেন, তিনি তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করেন: তোমরা কোথা থেকে আসছ? তাঁরা বলেন: আমরা দুনিয়ায় আপনার কিছু বান্দার নিকট থেকে এসেছি যাঁরা আপনার ‘তাসবীহ’ (সুব‘হানাল্লাহ) বলেছেন, ‘তাকবীর’ (আল্লাহু আকবার) বলেছেন, ‘তাহলীল’ (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) বলেছেন, ‘তাহমীদ’ (আল ‘হামদু লিল্লাহ) বলেছেন এবং আপনার কাছে প্রার্থনা করেছেন। মহান আল্লাহ জিজ্ঞাসা করেনঃ তাঁরা কী প্রার্থনা করেছে? তাঁরা বলেন, তাঁরা আপনার জান্নাত (বেহেশত) প্রার্থনা করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা বলেন: তারা কি জান্নাত দেখেছে? তারা বলেন: হে প্রভু, না, তাঁরা জান্নাত দেখেনি। তিনি বলেন: যদি তাঁরা জান্নাত দেখত তাহলে কী হতো? ফেরেশতারা বলেন: তাঁরা আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। তিনি বলেন: তারা আমার কাছে কী থেকে আশ্রয় চেয়েছে? তাঁরা বলেন: হে প্রভু, তাঁরা আপনার জাহান্নাম থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চেয়েছে। তিনি বলেন: তারা কি আমার জাহান্নাম দেখেছে? তাঁরা উত্তরে বলবেন: না, হে প্রভু। তিনি বলেন: যদি তাঁরা আমার জাহান্নাম দেখত তাহলে কী অবস্থা হতো? তাঁরা বলেন: এছাড়া তাঁরা আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছে। তিনি বলেন: আমি তাঁদের ক্ষমা করলাম, তাঁদের প্রার্থনা কবুল করলাম, তাঁরা যা থেকে আশ্রয় চায় তা থেকে তাঁদেরকে আশ্রয় প্রদান করলাম। ফিরেশতাগণ বলেন: হে প্রভু, তাঁদের মধ্যে একজন অন্যায়কারী-গোনাহগার বান্দা আছে যে, মাজলিস অতিক্রম করে যাচ্ছিল তাই একটু বসেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমি তাঁকেও ক্ষমা করলাম, তাঁরা এমন সম্প্রদায় যাঁদের সাথে কেউ বসলে সে দুর্ভাগা হবে না।”[2]


৪. সালাত বা দরুদ পাঠ ও দু‘আ

উপরের হাদীসে আমরা দেখছি যে, যিকরের মাজলিসে উপস্থিত মুমিনগণ সাতটি কর্ম করেন: (১). তাসবীহ বা ‘সুব‘হানাল্লাহ’ বলা, (২). তাকবীর বা ‘আল্লাহু আকবার’ বলা, (৩). তাহলীল বা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা, (৪). তাহমীদ বা ‘আল হামদু লিল্লাহ’ বলা, (৫). দু‘আ করা বা জান্নাত প্রার্থনা করা, (৬). জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা, এবং (৭). ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা।

কোনো কোনো অপ্রসিদ্ধ বর্ণনায় ৮ম কাজ হিসাবে সালাত (দরুদ) পাঠের কথা বলা হয়েছে। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

أن لله سيارة من الملائكة إذا مروا بحلق الذكر قال بعضهم لبعض اقعدوا فإذا دعل القوم فأمنوا على دعائهم فإذا صلوا على النبي - صلى الله عليه وسلم - صلوا معهم حتى تفرقوا ثم يقول بعضهم لبعض طوبي لهؤلاء يرجعون مغفور لهم


“মহান আল্লাহ্‌র কিছু পরিভ্রমণকারী ফিরিশতা আছেন যাঁরা যিকরের মাজলিস দেখলে একে অপরকে বলেন: বসে পড়। যখন মাজলিসের মানুষেরা দু‘আ করে তখন তারা তাঁদের দু‘আর সাথে ‘আমীন’ বলেন। আর যখন তাঁরা রাসূলুল্লাহর (সা.) উপর সালাত পাঠ করে তখন তারাও (ফিরিশতাগণ) তাঁদের সাথে সালাত পাঠ করেন। শেষে যখন মজলিস ভেঙ্গে সবাই চলে যায় তখন তারা একে অপরকে বলেন: এই মানুষগুলির জন্য কত বড় সুসংবাদ! কত বড় সৌভাগ্য !! তাঁরা (আল্লাহর পক্ষ থেকে) ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছে।” হাদীসটির সনদে কিছু দুর্বলতা আছে।[3]

অন্য একটি গ্রহণযোগ্য হাদীসে সালাত (দরুদ) পাঠ ছাড়া আরো ৩ টি আমলের কথা বলা হয়েছে : (১). কুরআন তিলাওয়াত, (২). আল্লাহর নিয়ামতের মহত্ত্ব বর্ণনা ও (৩). দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণ প্রার্থনা করা ; - যে বিষয়ে অন্যান্য হাদীস ইতঃপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

إن لله سيارة من الملائكة يطلبون حلق الذكر ... ربنا أتينا على عباد من عبادك يعظمون آلاءك ويتلون كتابك ويصلون على نبيك محمد صلى الله عليه وسلم ويسألونك لآخرتهم ودنياهم فيقول تبارك وتعالى غشوهم رحمتي فيقولون يا رب إن فيهم فلانا الخطاء إنما اعتنقهم اعتناقا فيقول تبارك وتعالى غشوهم رحمتي فهم الجلساء لا يشقى بهم جليسهم


“মহান আল্লাহর কিছু পরিভ্রমণকারী ফিরিশতা আছেন যাঁরা যিকরের মাজলিস অনুসন্ধান করেন। ... তাঁরা যিকরের মাজলিস সম্পর্কে আল্লাহর দরবারে বলেন: হে প্রভু, আমরা আপনার এমন কিছু বান্দার নিকট থেকে এসেছি যাঁরা আপনার নিয়ামতসমূহের মহত্ত্ব বর্ণনা করেছে, আপনার গ্রন্থ কুরআন করীম তিলাওয়াত করেছে, আপনার নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর উপর সালাত পাঠ করেছে এবং তাঁদের দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য আপনার কাছে প্রার্থনা করেছে। আল্লাহ বলেন, তাঁদেরকে আমার রহমত দিয়ে আবৃত করে দাও। তারা বলবেনঃ ইয়া রাব, তাঁদের মধ্যে একজন পাপী মানুষ আছে, যে হঠাৎ করে তাঁদের মাঝে এসে বসেছে। আল্লাহ বলবেনঃ তাঁদেরকে আমার রহমত দিয়ে ঢেকে দাও, কারণ তাঁরা এমন সাথী, তাঁদের সাথে যে বসবে সে আর দুর্ভাগা থাকবে না (সেও রহমত পাবে, যদিও সে অনিচ্ছাকৃতভাবে তাঁদের সাথে বসেছে)।”[4]


৫. সাহাবীগণের যিকরের মাজলিসের আরেকটি উদাহরণ

উপরের হাদীসগুলিতে আমরা যিকরের মাজলিসের ফযীলত ও মাজলিসে কী কী যিকর পালন করতে হবে তার বিবরণ দেখতে পেয়েছি। আমরা দেখেছি যে, সাহাবীগণ সুযোগমতো একত্রিত হয়ে এভাবে পরস্পরে আল্লাহর নিয়ামত আলোচনা করতেন এবং আল্লাহর তাসবীহ, তাহমীদ করতেন। তাবিয়ী আবু সাঈদ মাওলা আবী উসাইদ বলেন, উমর (রাঃ) রাত্রে মসজিদে নববীর মধ্যে ঘুরে ফিরে দেখতেন। সালাতরত ব্যক্তিগণকে ছাড়া সবাইকে মসজিদ থেকে বের করে দিতেন। তিনি একদিন এভাবে মসজিদ ঘুরে দেখার সময় কয়েকজন সাহাবীকে একত্রে বসা অবস্থায় দেখতে পান, যাঁদের মধ্যে উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) ছিলেন। উমর (রাঃ) বলেন, এরা কারা? উবাই (রাঃ) বলেনঃ হে আমীরুল মুমিনীন, এরা আপনারই পরিবারের কয়েকজন। তিনি বলেন: আপনারা সালাতের পরে বসে আছেন কী জন্য? উবাই বলেন: আমরা আল্লাহর যিকর করতে বসেছি। তখন উমর (রাঃ) তাঁদের সাথে বসলেন। এরপর তাঁর সবচেয়ে কাছের ব্যক্তিকে বললেনঃ শুরু কর। তখন সেই ব্যক্তি দু‘আ করলেন। এরপর উমর (রাঃ) একে একে প্রত্যেককে দিয়ে দু‘আ করালেন এবং শেষে আমার পালা এসে গেল। আমি তাঁর পাশেই ছিলাম। তিনি বললেনঃ শুরু কর। কিন্তু (উমরের উপস্থিতিতে) আমি একদম আটকে গেলাম ও কাঁপতে লাগলাম। আমার মুখ দিয়ে একটি কথাও বের হলো না। তিনি আমার কাঁপুনি অনুভব করতে লাগলেন। তখন বললেনঃ কিছু অন্তত বল, নাহলে অন্তত বলঃ (اللهم اغفر لنا اللهم ارحمنا) “হে আল্লাহ, আমাদেরকে ক্ষমা করুন, হে আল্লাহ, আমাদেরকে রহমত করুন।”

আবু সাঈদ বলেন: এরপর উমর শুরু করলেন, তখন সমবেত মানুষদের মধ্যে তাঁর চেয়ে বেশি আর কেউ কাঁদল না। সবার চেয়ে বেশি ক্রন্দন করলেন এবং বেশি অশ্রুপাত করলেন তিনি নিজে। এরপর তিনি সবাইকে বললেন : মাজলিসের শেষ। তখন সবাই যার যার পথে চলে গেলেন।”[5]

এভাবে আমরা জানতে পারছি যে, ইস্তিগফার ও দু‘আ যিকরের মাজলিসের অন্যতম বিষয়। আমরা সাহাবীগণের যিকরের মাজলিসের প্রকৃতিও জানতে পারছি। তাঁরা প্রত্যেকে পালা করে আলোচনা ও দু‘আ করতেন। আল্লাহর কাছে কাঁদাকাটি করতেন।


৬. জান্নাতের বাগানে বিচরণ : তাসবীহ, তাহলীল, ওয়ায ও ইলম

কয়েকটি হাদীসে যিকরের মাজলিসকে জান্নাতের বাগান বলে অভিহিত করা হয়েছে। এসকল হাদীসের সনদে দুর্বলতা আছে। তবে একই অর্থে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, ফলে হাদীসটির গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য এখানে তা উল্লেখ করছি। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

إذا مررتم برياض الجنة فارتعوا قال و ما رياض الجنة قال حلق الذكر


“যখন তোমরা জান্নাতের বাগানে গমন করবে তখন বিচরণ ও ভক্ষণ করবে। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন, জান্নাতের বাগান কি? তিনি বলেনঃ যিকরের বৃত্তসমূহ (মাজলিসসমূহ)।”[6]


কী এই যিকর? এই যিকর কিভাবে করতে হবে? কোথায় এবং কিভাবে জান্নাতের বাগানে বিচরণ করতে হবে? অন্যান্য হাদীসে তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর যিকরের মাজলিসের জন্য সর্বোত্তম স্থান আল্লাহর ঘর মসজিদসমূহ। এজন্য মসজিদকে বিশেষভাবে জান্নাতের বাগান বলে অভিহিত করা হয়েছে। আর অন্যান্য হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, জান্নাতের বাগানে আল্লাহর যিকর বলতে রাসূলুল্লাহ (সা.) বুঝিয়েছেন - মসজিদে বসে তাসবীহ, তাহলীল, তাহমীদ, তাকবীর ও ওয়ায বা ইলমী আলোচনা।[7] আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

إذا مررتم برياض الجنة فارتعوا قلت وما رياض الجنة ؟ قال المساجد قلت وما الرتع يا رسول الله ؟ قال سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر


“যখন তোমরা জান্নাতের বাগানে গমন করবে তখন সেখানে মনভরে বিচরণ ও ভক্ষণ করবে। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল, জান্নাতের বাগান কী? তিনি বলেন: মসজিদগুলি। আমি বললামঃ বিচরণ ও ভক্ষণ করা কী ? তিনি বলেন: ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আল-হামদু লিল্লাহ’, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’।”[8]


ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

اذا مررتم برياض الجنة فارتعوا قالوا يارسول الله ما رياض الجنة قال مجالس العلم


“তোমরা যখন জান্নাতের বাগানে গমন করবে, তখন বিচরণ ও ভক্ষণ করবে। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন: জান্নাতের বাগান কী? তিনি বলেন: ইলমের মাজলিসসমূহ।”[9]


সাহাবীগণ এই ধরনের ঈমান বৃদ্ধিকারক ইলম ও ওয়াজের মাজলিস খুবই পছন্দ করতেন। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন: আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা (রাঃ) কোনো সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ হলে বলতেন, আসুন কিছুক্ষণের জন্য আমরা আমাদের প্রভুর উপর ঈমান আনি (অর্থাৎ, তাঁর প্রতি ঈমান বৃদ্ধি করি)। একদিন তিনি এই কথা বলাতে একব্যক্তি রেগে যান। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে বলেন: “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহার আচরণ দেখছেন না! তিনি আপনার ঈমান ফেলে রেখে কিছু সময়ের ঈমান তালাশ করছেন। তখন নবীউল্লাহ (সা.) বললেনঃ

يرحم الله ابن رواحة إنه يحب المجالس التي تتباهى بهما الملائكة


“আল্লাহ আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহাকে রহমত করেন! সে তো ঐসব মাজলিস পছন্দ করে যে মাজলিস নিয়ে ফিরিশতাগণ গৌরব করেন।”[10]


এ সকল মাজলিসে আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা ঈমান বৃদ্ধিকারক ওয়ায করতেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা (রাঃ) তাঁর সঙ্গীগণকে ওয়ায করছিলেন, এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁদের নিকট গমন করেন। তিনি বলেন, “তোমরাই সেই সম্প্রদায় যাঁদের সাথে ধৈর্য ধরে থাকতে আল্লাহ আমাকে নির্দেশ প্রদান করেছেন ... ।”[11]


ইলম, ওয়ায ও আলোচনাই ছিল সাহাবী ও তাবেয়ীগণের যুগে যিকরের মাজলিসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মু’আয ইবন জাবাল (রাঃ) ইন্তিকালের পূর্বে বলেন যে, “হে আল্লাহ আপনি জানেন যে, আমি পার্থিব কোনো কারণে দুনিয়ার জীবনকে ভালবাসিনি, কিন্তু আমার আনন্দই ছিল সিয়াম পালন করে দিনে পিপাসার্ত থাকা, রাত জেগে তাহাজ্জুদের সালাত আর যিকরের হালাকায় (মাজলিসে) আলিমদের সাথে বসে আলোচনা করা।[12]


প্রখ্যাত তাবেয়ী আতা ইবনু আবী মুসলিম খুরাসানী (৫০-১৩৫ হি) বলেন:

مجالس الذكر هي مجالس الحلال والحرام كيف تشتري وتبيع وتصلي وتصوم وتنكح وتطلق وتحج وأشباه هذا


“যিকরের মাজলিস হালাল হারাম আলোচনার মাজলিস। কিভাবে বেচাকেনা করবে, কিভাবে ব্যবসা করবে, কিভাবে সালাত আদায় করবে, কিভাবে সিয়াম পালন করবে, কিভাবে বিবাহ করবে, কিভাবে তালাক দিবে, কিভাবে হজ্ব পালন করবে এবং অনুরূপ সকল বিষয় আলোচনার মাজলিসই যিকরের মাজলিস।”[13]

[1] সহীহ মুসলিম ৪/২০৭৫, নং ২৭০১।

[2] সহীহ মুসলিম, কিতাবুয যিকর, নং ২৬৮৯।

[3] ইবনুল কাইয়েম, জালাউল আউহাম, পৃ. ২২, ২২৩।

[4] বাজ্জার, সনদ হাসান। মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৩২২, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৭৭।

[5] ইবনু সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ৩/২৯৪।

[6] সুনানুত তিরমিযী ৫/৫৩২, নং ৩৫১০, যয়ীফুল জামিয়িস সাগীর পৃ. ১০০, নং ৬৯৯।

[7] মুল্লা আলী কারী, আল-মিরকাত ৫/৫৬-৫৭।

[8] সুনানুত তিরমিযী ৫/৫৩২, নং ৩৫০৯, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৯১, যয়ীফুল জামিয়িস সাগীর, পৃ. ১০০, নং ৭০১, আত-তারগীব ২/৪২২, নং ২৩২৩।

[9] তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ১১/৯৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১২৬, আত-তারগীব ১/৮৮, যয়ীফুল জামিয়িস সাগীর, পৃ. ১০০, নং ৭০০। ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, এই তিনটি হাদীসের সনদে দুর্বলতা আছে। প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীসকে ইমাম তিরমিযী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাসান বা গ্রহনযোগ্য বলেছেন।

[10] হাদীসটি হাসান। মুসনাদ আহমাদ ১/২৩০, ২/১৩২, ৩/২৬৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৭৬-৭৭।

[11] মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৭৬-৭৭। হাদীসটির সনদ যয়ীফ।

[12] আবু নুআইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ১/২৩৯।

[13] আবু নুআইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৫/১৯৫, নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ৩০, যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/১৪২।