রাহে বেলায়াত পঞ্চম অধ্যায় - মাজলিসে যিকর ও যিকরের মাজলিস ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ৮ টি

মুমিনের জীবনে যিকরের গুরুত্ব ও ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা আমরা শেষ করেছি। আল্লাহর দরবারে আর্জি জানাই, তিনি আমাদেরকে তা পালন করার তাওফীক প্রদান করবেন এবং দয়া করে কবুল করে নেবেন। সবশেষে যিকরের মাজলিস, মুমিনের জীবনে তার গুরুত্ব, ফযীলত ও সাওয়াব সম্পর্কে কিছু আলোচনা করতে চাই। আল্লাহর রহমত ও তাওফীকের আশা করছি এবং তাঁরই উপর নির্ভর করছি।

‘মাজলিস’ শব্দের অর্থ বৈঠক, বসা, council, assembly ইত্যাদি। এক ব্যক্তি একাকী কোথাও সামান্য সময়ের জন্য বসলেও তাকে আরবীতে ‘মাজলিস’ বলা হবে। অনুরূপভাবে দুই বা ততোধিক মানুষ একত্রে কিছুক্ষণের জন্য বসলে তাকেও মাজলিস বলা হবে। সাধারণভাবে ‘মাজলিস’ বলতে অল্প বা বেশি সময়ের জন্য একাধিক ব্যক্তির একত্রে বসাকে বুঝানো হয়।


ক. মাজলিসে আল্লাহর যিকর

মাজলিসে আল্লাহর যিকর দুই প্রকারে হতে পারে। প্রথম প্রকার- মাজলিস, সমাবেশ বা বৈঠকটি জাগতিক কোনো বিষয় কেন্দ্রিক হবে, তবে মাজলিসের মধ্যে মুমিন মাঝে মধ্যে আল্লাহর স্মরণ করবেন। দ্বিতীয় প্রকার - যে মাজলিসটি মূলতই আল্লাহর যিকর- কেন্দ্রিক হবে।

প্রথম প্রকারের মাজলিসে বা সমাবেশে মুমিন দুইভাবে আল্লাহর যিকর করতে পারেন: একাকী নিজের মনে বা সশব্দে আল্লাহর যিকর করা এবং অন্যদেরকে যিকরের কথা স্মরণ করানো। মুমিনের উচিত কোনো অবস্থায় আল্লাহর যিকর থেকে মনকে বিরত না রাখা। বিশেষত যখন কয়েকজন বন্ধুবান্ধব বা কিছু মানুষের সাথে বসে কথাবার্তা বলবেন তখন মাঝে মাঝে আল্লাহর যিকর করা খুবই প্রয়োজনীয়।

মানুষ সামাজিক জীব। কর্মস্থলে, চায়ের দোকানে, বাজারে, বাড়িতে বা অন্য কোথাও আমরা দুই বা ততোধিক মানষু একত্রিত হলে কখনোই চুপ থাকতে পারি না। ‘টক অব দা সিটি’, ‘টক অব দা কান্ট্রি’ , ‘টক অব দা ডে’ বা এই জাতীয় বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় সামাজিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বিভিন্ন কথাবার্তায় আমারা মেতে উঠি। এ সকল কথাবার্তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য খুবই ক্ষতিকারক এবং আখিরাত ধ্বংসকারী হয়, কারণ আমাদের কথাবার্তা অধিকাংশ সময় পরচর্চা, পরনিন্দা, হিংসা, ঘৃণা বা বেদনা উদ্রেককারী হয়ে থাকে।

যদি আমরা এসকল ক্ষতিকারক বিষয়াদি পরিহার করে শুধুমাত্র জাগতিক ‘নির্দোষ’ বিষয়; যেমন, - দ্রব্যমূল্য, নিজনিজ স্বাস্থ্য, পরিবার, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, ইত্যাদি বিষয়ে আলাপ করি তাহলেও তা আমাদের জন্য কিছু ক্ষতি বয়ে আনে। তিনটি কারণে এই প্রকারের ‘নির্দোষ’ কথাবার্তার ‘বৈঠক’ আমাদের ক্ষতি করে:


প্রথমত, এ ধরনের ‘নির্দোষ’ কথাবার্তা সর্বদাই ‘দোষযুক্ত’ পরচর্চা বা হিংসা বিদ্বেষ উদ্রেককারী আলোচনায় পর্যবসিত হয়। অনুপস্থিত বিভিন্ন ব্যক্তির কথা আলোচনার মধ্যে চলে আসবেই এবং কোনো না কোনোভাবে আমরা গীবত ও বান্দার হক্ক নষ্ট করার মত কঠিন কবীরা গোনাহসমূহে লিপ্ত হয়ে পড়ি।

দ্বিতীয়ত, এ সকল ‘নিদোর্ষ’ আলোচনায় যদি মাঝে মাঝে আমরা আল্লাহর যিকর-মূলক কোনো বাক্য না বলি তবে এই মাজলিস, বৈঠক বা আলোচনা কিয়ামতের দিন আমাদের জন্য আফসোস ও ক্ষতির কারণ হবে। ইতঃপূর্বে আমরা এ বিষয়ে একটি হাদীস উল্লেখ করেছি। উক্ত হাদীস থেকে আমরা জেনেছি যে, যদি একাধিক মুসলিম কোথাও একত্রে কিছু সময়ের জন্যও বসেন এবং কিছু কথাবার্তা বলে উঠে যান, কিন্তু তাদের কথার মধ্যে আল্লাহর যিকর ও রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উপর সালাত জ্ঞাপক কোনো কথা না থাকে, তবে কিয়ামতের দিন এই বৈঠকটি তাদের জন্য আফসোস ও ক্ষতির কারণ হবে। অন্য হাদীসে আমরা দেখেছি যে, কোনো ব্যক্তি যদি একাকী বা সমাবেশে কোথাও কিছু সময়ের জন্যও দাঁড়ায়, বসে, হাঁটে বা শয়ন করে, কিন্তু সেই বসা, দাঁড়ানো, হাঁটা বা শোয়া অবস্থায়

সে আল্লাহর যিকর না করে, তবে তা তার জন আফসোস ও ক্ষতির কারণ হবে। অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

مَا مِنْ قَوْمٍ يَقومونَ منْ مَجْلسٍ لاَ يَذكُرُون الله تَعَالَى فِيهِ إِلاَّ قَاموا عَنْ مِثلِ جيفَةِ حِمَارٍ وكانَ لَهُمْ حَسْرَةً


“যদি কিছু মানুষ এমন কোনো বৈঠক শেষ করে উঠে, যে বৈঠকে তারা আল্লাহর যিকর করেনি, তবে তারা যেন একটি গাধার মৃতদেহ (ভক্ষণ করে বা ঘাটাঘাটি করে) রেখে উঠে গেল। আর এই বৈঠক তাদের জন্য আফসোসের কারণ হবে।”[1]

আব্দুল্লাহ ইবনু মুগাফফাল (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

ما من قوم اجتمعوا في مجلس فتفرقوا ولم يذكروا الله عز وجل إلا كان ذلك المجلس حسرة عليهم يوم القيامة


“কিছু মানুষ যদি একটি বৈঠকে বসে এবং এরপর তারা বৈঠক ভেঙ্গে চলে যায়, কিন্তু উক্ত সময়ের মধ্যে তারা আল্লাহর যিকর না করে তাহলে কিয়ামতের দিন ঐ বৈঠক তাদের জন্য আফসোসের কারণ হবে।” হাদীসটির সনদ সহীহ।[2]


তৃতীয়ত, এই প্রকারের ‘নির্দোষ’ গল্পগুজব বা আলোচনার ‘মাজলিস’ আমাদের ক্বলবগুলিকে শক্ত করে দেয়। দীর্ঘসময় এ সকল আলোচনা আমাদের মনকে কঠিন করে তোলে। আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

لَا تُكْثِرُوا الْكَلَامَ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللَّهِ فَإِنَّ كَثْرَةَ الْكَلَامِ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللَّهِ قَسْوَةٌ لِلْقَلْبِ وَإِنَّ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنَ اللَّهِ الْقَلْبُ الْقَاسِي


“তোমরা আল্লাহর যিকর ছাড়া বেশি কথা বলবে না; কারণ আল্লাহর যিকর ছাড়া বেশি কথা হৃদয়কে কঠিক করে তোলে। আর আল্লাহর নিকট থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী মানুষ কঠিন হৃদয়ের মানুষ।”[3]


উপরের হাদীসগুলির আলোকে আমরা বুঝতে পারছি যে, মুমিনের দায়িত্ব, যে কোনো বৈঠক, গল্পগুজব, আলোচনা বা কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর মহান প্রভুর যিকর করবেন। মাজলিসের অন্য কেউ যদি আল্লাহর যিকর না করে, বা গরম গরম আবেগী কথায় মেতেথাকে তাহলেও মুমিন নিজের মনে মাঝে মাঝে আল্লাহর যিকর করবেন। আর জনসমক্ষে, মাজলিসে, গাফিলদের মধ্যে মুমিনের এই প্রকার একাকী যিকর অত্যন্ত ফযীলত, মর্যাদা ও সাওয়াবের বলে বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।

[1] হাদিসটি সহীহ। সুনানে আবী দাউদ ৪/২৬৪, নং ৪৮৫৫, মুসতাদরাক হাকিম ১/৬৬৮, ৬৬৯।

[2] তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ৪/১১২, আত-তারগীব ২/৩৮৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৮০।

[3] সুনানুত তিরমিযী ৪/৬০৭, নং ২৪১১। ইমাম তিরমিযী হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।

আমরা উপরের আলোচনায় দেখেছি যে, দ্বিতীয় প্রকারের মাজলিস আল্লাহর যিকর কেন্দ্রিক। এগুলিকে ‘যিকরের মাজলিস’ বলা হয়। ‘যিকরের মাজলিস’ ঐ মাজলিস যেখানে কয়েকজন মুমিন একত্রিত হয়ে আল্লাহর গুণাবলী, নিয়ামত, বরকত, তাঁর দ্বীন, রাসূল (সা.)-এর বিধান, পুরস্কার, তাঁর সন্তুষ্টির পথে অগ্রসর হওয়ার উপায় ইত্যাদির আলোচনা করেন; আল্লাহর প্রশংসা, মর্যাদা, মহত্ব, পবিত্রতা ও একত্ব উল্লেখ করেন; তাঁর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেন বা তাঁর কাছে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ চেয়ে প্রার্থনা করেন। এক মাজলিসে সকল প্রকারের যিকর একত্রিত হতে পারে বা কিছু কিছু যিকরও হতে পারে।

ইতঃপূর্বে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ফজর ও আসরের পরে কিছু মানুষের সাথে বসে আল্লাহর যিকরে রত থাকার উৎসাহ প্রদান করেছেন। এছাড়া যিকরের মাজলিসের গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রকাশ করে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আমরা এখানে এসকল হাদীস আলোচনা করব। সাথে সাথে এ সকল হাদীস থেকে জানতে চেষ্টা করব যে, যিকরের মাজলিসের মাসনূন পদ্ধতি কি ? কিভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণ যিকরের মাজলিস করতেন ? তাঁরা এ সকল মাজলিসে কী যিকর পালন করতেন এবং কিভাবে? যেন আমরা বিশুদ্ধভাবে অবিকল তাঁদের মতো যিকরের মাজলিসে আল্লাহর যিকর করে অগণিত পুরস্কার লাভ করতে পারি। সাথে সাথে যিকরের মাজলিসের নামে খেলাফে সুন্নাত কর্মে নিপতিত হওয়া থেকে আত্মরক্ষা করতে পারি।

গ. সমাবেশে আল্লাহর যিকরের ফযীলত

আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন:

أَنَا مَعَهُ حِينَ يَذْكُرَنِي إِنْ ذَكَرَنِي في نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ في نَفْسِي وَإِنْ ذَكَرَنِي في مَلإٍ ذَكَرْتُهُ في مَلإٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ


“আমার বান্দা যখন আমাকে স্মরণ করে তখন আমি তাঁর সাথে থাকি। যদি সে আমাকে তাঁর মনের মধ্যে স্মরণ করে, তবে আমিও তাঁকে আমার মধ্যে স্মরণ করি। আর যদি সে আমাকে কোনো সমাবেশে বা কিছু মানুষের মধ্যে স্মরণ করে, আমিও তাঁকে স্মরণ করি তাঁর সমাবেশের চেয়ে উত্তম সমাবেশে।”[1]

“সমাবেশে আল্লাহর যিকরের” - এই ফযীলত বান্দা দুভাবে লাভ করতে পারেন। তিনি দুভাবে সমাবেশে আল্লাহর যিকর করতে পারেন।

প্রথমত, সমাবেশে বা মানুষের মধ্যে বসে মুমিন বান্দা তাঁর মনকে আল্লাহর দিকে নিবদ্ধ রেখে নিজের মনে আল্লাহর যিকরে রত থাকবেন। এ সমাবেশে একাকী যিকর। হাদীস শরীফে এই প্রকারের যিকরের বিশেষ মর্যাদা ঘোষণা করা হয়েছে। এই পর্যায়টি উপরে আলোচিত “মাজলিসে আল্লাহর যিকরের” অন্তর্গত।দ্বিতীয়ত, সমাবেশে অন্যদের সাথে তিনি আল্লাহর যিকর করবেন। এই পর্যায়টি উপরে উল্লেখিত “যিকরের মাজলিস” পর্যায়ের। এই ধরনের সমাবেশ বা মাজলিস “আল্লাহর যিকর” কেন্দ্র করেই সংঘটিত ও আবর্তিত হয়। পরবর্তী আলোচনায় দেখব এই প্রকারের মাজলিস বা সমাবেশে কোন্ কোন্ প্রকারের যিকর কী-ভাবে পালন করা হয়। তার আগে আমরা এই দ্বিতীয় প্রকারের সমাবেশ বা যিকরের মাজলিসের ফযীলত আলোচনা করব।

[1] সহীহ মুসলিম ৪/২০৬১, নং ২৬৭৫, ৪/২০৬৭, নং ২৬৭৫, সহীহ বুখারী ৬/২৬৯৪, নং ৬৯৭০।

সাধারণভাবে যিকরের মাজলিসের ফযীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে আবু হুরাইরা (রাঃ) ও আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

لَا يَقْعُدُ قَوْمٌ يَذْكُرُونَ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ إِلَّا حَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَنَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ


“যখনই কোনো সম্প্রদায় (কিছু মানুষ) বসে মহা মহিমান্বিত আল্লাহর স্মরণ (যিকর) করে, তখনই ফিরিশতাগণ তাদেরকে বেষ্টন করে নেন, রহমত তাদেরকে আবৃত করে, তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল হয় এবং আল্লাহ তাদের স্মরণ (যিকর) করেন তাঁর (আল্লাহর) নিকট যারা আছেন তাদের মধ্যে।”[1]


আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

مَا مِنْ قَوْمٍ اجْتَمَعُوا يَذْكُرُونَ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ (لا يُرِيدُونَ بِذَلِكَ إِلا وَجْهَه) إِلا نَادَاهُمْ مُنَادٍ مِنَ السَّمَاءِ قُومُوا مَغْفُورًا لَكُمْ قَدْ بُدِّلَتْ سَيِّئَاتُكُمْ حَسَنَاتٍ


“যখনই কোনো সম্প্রদায় (কিছু মানুষ) একত্রিত হয়ে আল্লাহর যিকরে রত হয়, এদ্বারা তাঁরা আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া কিছুই চায় না, তখনই আসমান থেকে একজন আহবানকারী তাঁদেরকে ডেকে বলেন, তোমরা পরিপূর্ণ ক্ষমাপ্রাপ্ত-গোনাহমুক্ত হয়ে উঠে যাও,

তোমাদের পাপগুলিকে পুণ্যে রূপামতি রত করা হয়েছে।”[2]

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ কিয়ামতের দিন বলবেন, আজ জমায়েতের দিনে সবাই জানবে কারা সম্মানের অধিকারী। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন: হে আল্লাহর রাসূল, সম্মানের অধিকারী কারা? তিনি বলেন: (مجالس الذكر فى المساجد) “মসজিদের ভিতরের যিকরের মাজলিসগুলি।”[3]


আবু দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

ليبعثن الله أقواما يوم القيامة في وجوههم النور على منابر اللؤلؤ يغبطهم الناس ليسوا بأنبياء ولا شهداء قال فجثى أعرابي على ركبتيه فقال يا رسول الله جلهم لنا نعرفهم قال هم المتحابون في الله من قبائل شتى وبلاد شتى يجتمعون على ذكر الله يذكرونه


“কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ কিছু মানুষকে উঠাবেন যাঁদের চেহারায় নূর উদ্ভাসিত থাকবে। তাঁরা মুক্তাখচিত মিম্বরের উপর থাকবে। সকল মানুষ যাঁদের নিয়ামত দেখে নিজেদের জন্য এই নিয়ামত কামনা করবে। তাঁরা নবী নন বা শহীদও নন।” তখন একজন

বেদুঈন হাঁটু গেড়ে বসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি তাঁদের বৈশিষ্ট্য আমাদের কাছে বর্ণনা করুন, যেন আমরা তাঁদের চিনতে পারি। তিনি বলেন, “তাঁরা ঐসব মানুষ যাঁরা একে অপরকে শুধু আল্লাহর জন্য ভালোবাসবে, বিভিন্ন গোত্র বা গোষ্ঠী ও বিভিন্ন এলাকা বা দেশ থেকে এসে তাঁরা আল্লাহর যিকরের জন্য একত্রিত হয়ে আল্লাহর যিকর করবে।” হাদীসটি হাসান।[4]


আমর ইবনু আনবাসাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত এই অর্থের অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) এসকল মহান সম্মানিত ও মর্যাদাপ্রাপ্ত মানুষদের পরিচয় দিয়ে বলেছেনঃ

هم جماع من نوازع القبائل ، يجتمعون على ذكر الله فينتقون أطايب الكلام كما ينتقي آكل التمر أطايبه

“এরা হলেন বিভিন্ন গোত্র, দেশ বা এলাকা থেকে আগত মানুষ, যাঁরা আল্লাহর যিকরের জন্য সমবেত হন এবং সুন্দর ও পবিত্র বাক্যসমূহ চয়ন করেন, যেমনভাবে খেজুর ভক্ষণকারী ভালো ভালো খেজুর বেছে বেছে নেয়।”[5]


অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, আমি বললামঃ, হে আল্লাহর রাসূল, যিকরের মাজলিসের গনীমত (লাভ) কী ? তিনি বলেনঃ (غنيمة مجالس الذكر الجنة) “যিকরের মাজলিসসমূহের গনীমত বা লাভ জান্নাত।” হাদীসটির সনদ হাসান।[6]

[1] সহীহ মুসলিম ৪/২০৭৪, নং ২৭০০।

[2] ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ৭/২৪৪, মুসনাদ আহমাদ ৩/১৪২, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৭৬, আল-আহাদীসুল মুখতারাহ ৭/২৩৪-২৩৫। হাদিসটি হাসান।

[3] হাদিসটির সনদ হাসান। মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৭৬।

[4] মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৭৭, আত-তারগীব ২/৩৮৩।

[5] আত-তারগীব ২/৩৮৮-৩৮৯, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৭৭। সনদ মোটামুটি গ্রহনযোগ্য।

[6] মুসনাদ আহমাদ ২/১৭৭, ১৯০, আত-তারগীব ২/৩৮১, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৭৮।

উপরের হাদীসগুলি থেকে আমরা কিছু মানুষ একত্রিত বসে আল্লাহর যিকর করলে কী মহান মর্যাদা ও অভাবনীয় পুরস্কারের লাভ করবেন তা জানতে পারছি। এখন প্রশ্ন: একত্রে বসে যিকরের নিয়ম, পদ্ধতি ও কর্মাবলি কী কী? রাসূলুল্লাহ (সা.) কি যিকরের মাজলিসের যিকর ও কর্মের বর্ণনা দিয়েছেন? দিলে আমরা ঠিক সেই কাজগুলিই করব। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণ কি যিকরের মাজলিসে বসতেন? বসলে কিভাবে বসতেন? আমরা ঠিক তাঁদের মতো বসার চেষ্টা করব। কারণ, আমরা জানি যে, যে কোনো ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে তাঁরাই পূর্ণাঙ্গ আদর্শ।


১. কুরআন তিলাওয়াত ও আলোচনা

কুরআনী যিকরের আলোচনার সময় আমরা যিকরের মাজলিসের একটি স্পষ্ট বিবরণ পেয়েছি। আমরা দেখছি, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যখনই কিছু মানুষ আল্লাহর কোনো একটি ঘরে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করতে ও পরস্পরে তা শিক্ষা ও আলোচনা করতে থাকে, তখনই তাঁদের উপর প্রশান্তি নাজিল হতে থাকে, আল্লাহর রহমত তাঁদের আবৃত করে নেয়, ফিরিশতাগণ তাঁদের ঘিরে ধরে এবং আল্লাহ তাঁর নিকটস্থদের নিকট তাঁদের যিকর করেন।


যিকরের মাজলিসের ফযীলতে উপরে উল্লেখিত হাদীসগুলির সাথে এই হাদীস একত্রিত করে আমরা জানতে পারি যে, যিকরের মাজলিসে সমবেত মুমিনগণের অন্যতম একটি যিকর কুরআন তিলাওয়াত ও আলোচনা করা।


২. আল্লাহর নিয়ামত আলোচনা ও হামদ-সানা পাঠ

সাহাবীগণের যিকরের মাজলিসের অন্য একটি বিশেষ দিক ছিল আল্লাহর নিয়ামতের কথা পরস্পরে আলোচনা করা, আল্লাহর প্রশংসা করা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। মু’আবিয়া (রাঃ) বলেনঃ

إن رسول الله صلي الله عليه وسلم خرج علي حلقة من أصحابه فقال ما أجلسكم قالوا جلسنا نذكر الله تعالي ونحمده علي ما هدانا للإسلام ومن به علينا قال آلله (يعني والله) ما أجلسكم إلا ذاك؟ قال أما إني لم استحلفكم تهمة لكم ولكنه أتاني جبريل فأخبرني أن الله عز وجل يباهي بكم الملائكة


“রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘর থেকে বেরিয়ে সাহাবীগণের একটি বৃত্তে (কয়েকজন সাহাবী বৃত্তাকারে বসে ছিলেন সেখানে) উপস্থিত হন। তিনি বলেন, তোমরা কিজন্য বসেছ? তাঁরা বললেন, আমারা বসে বসে আল্লাহর যিকর করছি এবং তাঁর হামদ বা প্রশংসা করছি, কারণ তিনি আমাদেরকে ইসলামের দিকে পথ প্রদর্শন করেছেন এবং ইসলামের মাধ্যমে আমাদের উপর তিনি করুণা করেছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহর নামে প্রশ্ন করছি, সত্যিই কি তোমরা শুধুমাত্র এই উদ্দেশ্যে বসেছ? তাঁরা বললেন, আল্লাহর কসম, আমরা একমাত্র এই উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো কারণে বসিনি। তিনি বলেন: আমি তোমাদের প্রতি সন্দেহবশত তোমাদেরকে শপথ করাইনি। বরং জিবরীল (আ.) এসে আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, আল্লাহ ফিরিশতাগণের কাছে তোমাদের জন্য গৌরব প্রকাশ করছেন। (এই সুসংবাদ প্রদানের জন্যই শপথ করিয়েছি)।”[1]


সুবহানাল্লাহ! কত বড় মর্যাদা। আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে নিয়ে গৌরব প্রকাশ করেন। কারণ তাঁরা জাগতিক বিষয়াদি আলোচনার জন্য নয়, বরং আল্লাহর নিয়ামত আলোচনা, তাঁর প্রশংসা করা ও তাঁরই কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য সমবেত হয়েছে। জাগতিক ব্যস্ততা, প্রয়োজন, লোভ, মোহ বা অন্য কোনো কিছুই তাঁদেরকে প্রভুর স্মরণ ও তাঁর প্রশংসা ও গুণকীর্তন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এভাবে তাঁরা ফিরিশতাগণের ঊর্ধ্বে উঠেছেন।


এই হাদীস থেকে আমরা সাহাবীগণ কিভাবে যিকরের মাজলিস করতেন তা বুঝতে পারি। তাঁরা একত্রে বসে আল্লাহর নিয়ামতের কথা আলোচনা করতেন এবং আলোচনার সাথে সাথে তাঁর হামদ, সানা, ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতেন।


৩. তাসবীহ, তাহলীল, তাকবীর, তাহমীদ, ইস্তিগফার, দু‘আ

অন্যান্য হাদীস থেকে আমরা মাজলিসের যিকরের আরো বিস্তারিত বিবরণ জানতে পারি। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

إِنَّ لِلَّهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى مَلَائِكَةً سَيَّارَةً فُضُلًا يَتَتَبَّعُونَ مَجَالِسَ الذِّكْرِ ، فَإِذَا وَجَدُوا مَجْلِسًا فِيهِ ذِكْرٌ قَعَدُوا مَعَهُمْ ، وَحَفَّ بَعْضُهُمْ بَعْضًا بِأَجْنِحَتِهِمْ حَتَّى يَمْلَئُوا مَا بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ السَّمَاءِ الدُّنْيَا ، فَإِذَا تَفَرَّقُوا عَرَجُوا وَصَعِدُوا إِلَى السَّمَاءِ ، قَالَ : فَيَسْأَلُهُمُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ وَهُوَ أَعْلَمُ بِهِمْ مِنْ أَيْنَ جِئْتُمْ ؟ فَيَقُولُونَ : جِئْنَا مِنْ عِنْدِ عِبَادٍ لَكَ فِي الْأَرْضِ يُسَبِّحُونَكَ ، وَيُكَبِّرُونَكَ ، وَيُهَلِّلُونَكَ ، وَيَحْمَدُونَكَ ، وَيَسْأَلُونَكَ ، قَالَ : وَمَاذَا يَسْأَلُونِي ؟ قَالُوا : يَسْأَلُونَكَ جَنَّتَكَ ، قَالَ : وَهَلْ رَأَوْا جَنَّتِي ؟ قَالُوا : لَا أَيْ رَبِّ ، قَالَ : فَكَيْفَ لَوْ رَأَوْا جَنَّتِي ؟ قَالُوا : وَيَسْتَجِيرُونَكَ ، قَالَ : وَمِمَّ يَسْتَجِيرُونَنِي ؟ قَالُوا : مِنْ نَارِكَ يَا رَبِّ ، قَالَ وَهَلْ رَأَوْا نَارِي ؟ قَالُوا : لَا ، قَالَ : فَكَيْفَ لَوْ رَأَوْا نَارِي ؟ قَالُوا : وَيَسْتَغْفِرُونَكَ ، قَالَ ، فَيَقُولُ : قَدْ غَفَرْتُ لَهُمْ فَأَعْطَيْتُهُمْ مَا سَأَلُوا وَأَجَرْتُهُمْ مِمَّا اسْتَجَارُوا ، قَالَ : فَيَقُولُونَ : رَبِّ فِيهِمْ فُلَانٌ عَبْدٌ خَطَّاءٌ إِنَّمَا مَرَّ فَجَلَسَ مَعَهُمْ ، قَالَ : فَيَقُولُ : وَلَهُ غَفَرْتُ هُمُ الْقَوْمُ لَا يَشْقَى بِهِمْ جَلِيسُهُمْ


“আল্লাহর কিছু অতিরিক্ত পরিভ্রমণকারী ফিরিশতা আছেন (যারা বিশ্বে ঘুরে) যিকরের মাজলিসগুলির খোঁজ করেন। যদি কোনো যিকরের মাজলিস পেয়ে যান, তারা সেখানে তাঁদের সাথে বসে পড়েন এবং তাঁদের একে অপরকে পাখা দিয়ে ঘিরে ধরেন। এভাবে তারা প্রথম আসমান পর্যন্ত পূর্ণ করেন। যখন মাজলিসের মানুষেরা বিচ্ছিন হয়ে যান (মাজলিস শেষে চলে যান) তখন তারা ঊর্ধ্বে উঠেন। মহান আল্লাহ্‌ যিনি সবই জানেন, তিনি তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করেন: তোমরা কোথা থেকে আসছ? তাঁরা বলেন: আমরা দুনিয়ায় আপনার কিছু বান্দার নিকট থেকে এসেছি যাঁরা আপনার ‘তাসবীহ’ (সুব‘হানাল্লাহ) বলেছেন, ‘তাকবীর’ (আল্লাহু আকবার) বলেছেন, ‘তাহলীল’ (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) বলেছেন, ‘তাহমীদ’ (আল ‘হামদু লিল্লাহ) বলেছেন এবং আপনার কাছে প্রার্থনা করেছেন। মহান আল্লাহ জিজ্ঞাসা করেনঃ তাঁরা কী প্রার্থনা করেছে? তাঁরা বলেন, তাঁরা আপনার জান্নাত (বেহেশত) প্রার্থনা করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা বলেন: তারা কি জান্নাত দেখেছে? তারা বলেন: হে প্রভু, না, তাঁরা জান্নাত দেখেনি। তিনি বলেন: যদি তাঁরা জান্নাত দেখত তাহলে কী হতো? ফেরেশতারা বলেন: তাঁরা আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। তিনি বলেন: তারা আমার কাছে কী থেকে আশ্রয় চেয়েছে? তাঁরা বলেন: হে প্রভু, তাঁরা আপনার জাহান্নাম থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চেয়েছে। তিনি বলেন: তারা কি আমার জাহান্নাম দেখেছে? তাঁরা উত্তরে বলবেন: না, হে প্রভু। তিনি বলেন: যদি তাঁরা আমার জাহান্নাম দেখত তাহলে কী অবস্থা হতো? তাঁরা বলেন: এছাড়া তাঁরা আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছে। তিনি বলেন: আমি তাঁদের ক্ষমা করলাম, তাঁদের প্রার্থনা কবুল করলাম, তাঁরা যা থেকে আশ্রয় চায় তা থেকে তাঁদেরকে আশ্রয় প্রদান করলাম। ফিরেশতাগণ বলেন: হে প্রভু, তাঁদের মধ্যে একজন অন্যায়কারী-গোনাহগার বান্দা আছে যে, মাজলিস অতিক্রম করে যাচ্ছিল তাই একটু বসেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমি তাঁকেও ক্ষমা করলাম, তাঁরা এমন সম্প্রদায় যাঁদের সাথে কেউ বসলে সে দুর্ভাগা হবে না।”[2]


৪. সালাত বা দরুদ পাঠ ও দু‘আ

উপরের হাদীসে আমরা দেখছি যে, যিকরের মাজলিসে উপস্থিত মুমিনগণ সাতটি কর্ম করেন: (১). তাসবীহ বা ‘সুব‘হানাল্লাহ’ বলা, (২). তাকবীর বা ‘আল্লাহু আকবার’ বলা, (৩). তাহলীল বা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা, (৪). তাহমীদ বা ‘আল হামদু লিল্লাহ’ বলা, (৫). দু‘আ করা বা জান্নাত প্রার্থনা করা, (৬). জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা, এবং (৭). ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা।

কোনো কোনো অপ্রসিদ্ধ বর্ণনায় ৮ম কাজ হিসাবে সালাত (দরুদ) পাঠের কথা বলা হয়েছে। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

أن لله سيارة من الملائكة إذا مروا بحلق الذكر قال بعضهم لبعض اقعدوا فإذا دعل القوم فأمنوا على دعائهم فإذا صلوا على النبي - صلى الله عليه وسلم - صلوا معهم حتى تفرقوا ثم يقول بعضهم لبعض طوبي لهؤلاء يرجعون مغفور لهم


“মহান আল্লাহ্‌র কিছু পরিভ্রমণকারী ফিরিশতা আছেন যাঁরা যিকরের মাজলিস দেখলে একে অপরকে বলেন: বসে পড়। যখন মাজলিসের মানুষেরা দু‘আ করে তখন তারা তাঁদের দু‘আর সাথে ‘আমীন’ বলেন। আর যখন তাঁরা রাসূলুল্লাহর (সা.) উপর সালাত পাঠ করে তখন তারাও (ফিরিশতাগণ) তাঁদের সাথে সালাত পাঠ করেন। শেষে যখন মজলিস ভেঙ্গে সবাই চলে যায় তখন তারা একে অপরকে বলেন: এই মানুষগুলির জন্য কত বড় সুসংবাদ! কত বড় সৌভাগ্য !! তাঁরা (আল্লাহর পক্ষ থেকে) ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছে।” হাদীসটির সনদে কিছু দুর্বলতা আছে।[3]

অন্য একটি গ্রহণযোগ্য হাদীসে সালাত (দরুদ) পাঠ ছাড়া আরো ৩ টি আমলের কথা বলা হয়েছে : (১). কুরআন তিলাওয়াত, (২). আল্লাহর নিয়ামতের মহত্ত্ব বর্ণনা ও (৩). দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণ প্রার্থনা করা ; - যে বিষয়ে অন্যান্য হাদীস ইতঃপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

إن لله سيارة من الملائكة يطلبون حلق الذكر ... ربنا أتينا على عباد من عبادك يعظمون آلاءك ويتلون كتابك ويصلون على نبيك محمد صلى الله عليه وسلم ويسألونك لآخرتهم ودنياهم فيقول تبارك وتعالى غشوهم رحمتي فيقولون يا رب إن فيهم فلانا الخطاء إنما اعتنقهم اعتناقا فيقول تبارك وتعالى غشوهم رحمتي فهم الجلساء لا يشقى بهم جليسهم


“মহান আল্লাহর কিছু পরিভ্রমণকারী ফিরিশতা আছেন যাঁরা যিকরের মাজলিস অনুসন্ধান করেন। ... তাঁরা যিকরের মাজলিস সম্পর্কে আল্লাহর দরবারে বলেন: হে প্রভু, আমরা আপনার এমন কিছু বান্দার নিকট থেকে এসেছি যাঁরা আপনার নিয়ামতসমূহের মহত্ত্ব বর্ণনা করেছে, আপনার গ্রন্থ কুরআন করীম তিলাওয়াত করেছে, আপনার নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর উপর সালাত পাঠ করেছে এবং তাঁদের দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য আপনার কাছে প্রার্থনা করেছে। আল্লাহ বলেন, তাঁদেরকে আমার রহমত দিয়ে আবৃত করে দাও। তারা বলবেনঃ ইয়া রাব, তাঁদের মধ্যে একজন পাপী মানুষ আছে, যে হঠাৎ করে তাঁদের মাঝে এসে বসেছে। আল্লাহ বলবেনঃ তাঁদেরকে আমার রহমত দিয়ে ঢেকে দাও, কারণ তাঁরা এমন সাথী, তাঁদের সাথে যে বসবে সে আর দুর্ভাগা থাকবে না (সেও রহমত পাবে, যদিও সে অনিচ্ছাকৃতভাবে তাঁদের সাথে বসেছে)।”[4]


৫. সাহাবীগণের যিকরের মাজলিসের আরেকটি উদাহরণ

উপরের হাদীসগুলিতে আমরা যিকরের মাজলিসের ফযীলত ও মাজলিসে কী কী যিকর পালন করতে হবে তার বিবরণ দেখতে পেয়েছি। আমরা দেখেছি যে, সাহাবীগণ সুযোগমতো একত্রিত হয়ে এভাবে পরস্পরে আল্লাহর নিয়ামত আলোচনা করতেন এবং আল্লাহর তাসবীহ, তাহমীদ করতেন। তাবিয়ী আবু সাঈদ মাওলা আবী উসাইদ বলেন, উমর (রাঃ) রাত্রে মসজিদে নববীর মধ্যে ঘুরে ফিরে দেখতেন। সালাতরত ব্যক্তিগণকে ছাড়া সবাইকে মসজিদ থেকে বের করে দিতেন। তিনি একদিন এভাবে মসজিদ ঘুরে দেখার সময় কয়েকজন সাহাবীকে একত্রে বসা অবস্থায় দেখতে পান, যাঁদের মধ্যে উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) ছিলেন। উমর (রাঃ) বলেন, এরা কারা? উবাই (রাঃ) বলেনঃ হে আমীরুল মুমিনীন, এরা আপনারই পরিবারের কয়েকজন। তিনি বলেন: আপনারা সালাতের পরে বসে আছেন কী জন্য? উবাই বলেন: আমরা আল্লাহর যিকর করতে বসেছি। তখন উমর (রাঃ) তাঁদের সাথে বসলেন। এরপর তাঁর সবচেয়ে কাছের ব্যক্তিকে বললেনঃ শুরু কর। তখন সেই ব্যক্তি দু‘আ করলেন। এরপর উমর (রাঃ) একে একে প্রত্যেককে দিয়ে দু‘আ করালেন এবং শেষে আমার পালা এসে গেল। আমি তাঁর পাশেই ছিলাম। তিনি বললেনঃ শুরু কর। কিন্তু (উমরের উপস্থিতিতে) আমি একদম আটকে গেলাম ও কাঁপতে লাগলাম। আমার মুখ দিয়ে একটি কথাও বের হলো না। তিনি আমার কাঁপুনি অনুভব করতে লাগলেন। তখন বললেনঃ কিছু অন্তত বল, নাহলে অন্তত বলঃ (اللهم اغفر لنا اللهم ارحمنا) “হে আল্লাহ, আমাদেরকে ক্ষমা করুন, হে আল্লাহ, আমাদেরকে রহমত করুন।”

আবু সাঈদ বলেন: এরপর উমর শুরু করলেন, তখন সমবেত মানুষদের মধ্যে তাঁর চেয়ে বেশি আর কেউ কাঁদল না। সবার চেয়ে বেশি ক্রন্দন করলেন এবং বেশি অশ্রুপাত করলেন তিনি নিজে। এরপর তিনি সবাইকে বললেন : মাজলিসের শেষ। তখন সবাই যার যার পথে চলে গেলেন।”[5]

এভাবে আমরা জানতে পারছি যে, ইস্তিগফার ও দু‘আ যিকরের মাজলিসের অন্যতম বিষয়। আমরা সাহাবীগণের যিকরের মাজলিসের প্রকৃতিও জানতে পারছি। তাঁরা প্রত্যেকে পালা করে আলোচনা ও দু‘আ করতেন। আল্লাহর কাছে কাঁদাকাটি করতেন।


৬. জান্নাতের বাগানে বিচরণ : তাসবীহ, তাহলীল, ওয়ায ও ইলম

কয়েকটি হাদীসে যিকরের মাজলিসকে জান্নাতের বাগান বলে অভিহিত করা হয়েছে। এসকল হাদীসের সনদে দুর্বলতা আছে। তবে একই অর্থে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, ফলে হাদীসটির গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য এখানে তা উল্লেখ করছি। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

إذا مررتم برياض الجنة فارتعوا قال و ما رياض الجنة قال حلق الذكر


“যখন তোমরা জান্নাতের বাগানে গমন করবে তখন বিচরণ ও ভক্ষণ করবে। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন, জান্নাতের বাগান কি? তিনি বলেনঃ যিকরের বৃত্তসমূহ (মাজলিসসমূহ)।”[6]


কী এই যিকর? এই যিকর কিভাবে করতে হবে? কোথায় এবং কিভাবে জান্নাতের বাগানে বিচরণ করতে হবে? অন্যান্য হাদীসে তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর যিকরের মাজলিসের জন্য সর্বোত্তম স্থান আল্লাহর ঘর মসজিদসমূহ। এজন্য মসজিদকে বিশেষভাবে জান্নাতের বাগান বলে অভিহিত করা হয়েছে। আর অন্যান্য হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, জান্নাতের বাগানে আল্লাহর যিকর বলতে রাসূলুল্লাহ (সা.) বুঝিয়েছেন - মসজিদে বসে তাসবীহ, তাহলীল, তাহমীদ, তাকবীর ও ওয়ায বা ইলমী আলোচনা।[7] আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

إذا مررتم برياض الجنة فارتعوا قلت وما رياض الجنة ؟ قال المساجد قلت وما الرتع يا رسول الله ؟ قال سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر


“যখন তোমরা জান্নাতের বাগানে গমন করবে তখন সেখানে মনভরে বিচরণ ও ভক্ষণ করবে। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল, জান্নাতের বাগান কী? তিনি বলেন: মসজিদগুলি। আমি বললামঃ বিচরণ ও ভক্ষণ করা কী ? তিনি বলেন: ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আল-হামদু লিল্লাহ’, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’।”[8]


ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

اذا مررتم برياض الجنة فارتعوا قالوا يارسول الله ما رياض الجنة قال مجالس العلم


“তোমরা যখন জান্নাতের বাগানে গমন করবে, তখন বিচরণ ও ভক্ষণ করবে। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন: জান্নাতের বাগান কী? তিনি বলেন: ইলমের মাজলিসসমূহ।”[9]


সাহাবীগণ এই ধরনের ঈমান বৃদ্ধিকারক ইলম ও ওয়াজের মাজলিস খুবই পছন্দ করতেন। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন: আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা (রাঃ) কোনো সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ হলে বলতেন, আসুন কিছুক্ষণের জন্য আমরা আমাদের প্রভুর উপর ঈমান আনি (অর্থাৎ, তাঁর প্রতি ঈমান বৃদ্ধি করি)। একদিন তিনি এই কথা বলাতে একব্যক্তি রেগে যান। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে বলেন: “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহার আচরণ দেখছেন না! তিনি আপনার ঈমান ফেলে রেখে কিছু সময়ের ঈমান তালাশ করছেন। তখন নবীউল্লাহ (সা.) বললেনঃ

يرحم الله ابن رواحة إنه يحب المجالس التي تتباهى بهما الملائكة


“আল্লাহ আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহাকে রহমত করেন! সে তো ঐসব মাজলিস পছন্দ করে যে মাজলিস নিয়ে ফিরিশতাগণ গৌরব করেন।”[10]


এ সকল মাজলিসে আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা ঈমান বৃদ্ধিকারক ওয়ায করতেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা (রাঃ) তাঁর সঙ্গীগণকে ওয়ায করছিলেন, এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁদের নিকট গমন করেন। তিনি বলেন, “তোমরাই সেই সম্প্রদায় যাঁদের সাথে ধৈর্য ধরে থাকতে আল্লাহ আমাকে নির্দেশ প্রদান করেছেন ... ।”[11]


ইলম, ওয়ায ও আলোচনাই ছিল সাহাবী ও তাবেয়ীগণের যুগে যিকরের মাজলিসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মু’আয ইবন জাবাল (রাঃ) ইন্তিকালের পূর্বে বলেন যে, “হে আল্লাহ আপনি জানেন যে, আমি পার্থিব কোনো কারণে দুনিয়ার জীবনকে ভালবাসিনি, কিন্তু আমার আনন্দই ছিল সিয়াম পালন করে দিনে পিপাসার্ত থাকা, রাত জেগে তাহাজ্জুদের সালাত আর যিকরের হালাকায় (মাজলিসে) আলিমদের সাথে বসে আলোচনা করা।[12]


প্রখ্যাত তাবেয়ী আতা ইবনু আবী মুসলিম খুরাসানী (৫০-১৩৫ হি) বলেন:

مجالس الذكر هي مجالس الحلال والحرام كيف تشتري وتبيع وتصلي وتصوم وتنكح وتطلق وتحج وأشباه هذا


“যিকরের মাজলিস হালাল হারাম আলোচনার মাজলিস। কিভাবে বেচাকেনা করবে, কিভাবে ব্যবসা করবে, কিভাবে সালাত আদায় করবে, কিভাবে সিয়াম পালন করবে, কিভাবে বিবাহ করবে, কিভাবে তালাক দিবে, কিভাবে হজ্ব পালন করবে এবং অনুরূপ সকল বিষয় আলোচনার মাজলিসই যিকরের মাজলিস।”[13]

[1] সহীহ মুসলিম ৪/২০৭৫, নং ২৭০১।

[2] সহীহ মুসলিম, কিতাবুয যিকর, নং ২৬৮৯।

[3] ইবনুল কাইয়েম, জালাউল আউহাম, পৃ. ২২, ২২৩।

[4] বাজ্জার, সনদ হাসান। মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৩২২, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৭৭।

[5] ইবনু সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ৩/২৯৪।

[6] সুনানুত তিরমিযী ৫/৫৩২, নং ৩৫১০, যয়ীফুল জামিয়িস সাগীর পৃ. ১০০, নং ৬৯৯।

[7] মুল্লা আলী কারী, আল-মিরকাত ৫/৫৬-৫৭।

[8] সুনানুত তিরমিযী ৫/৫৩২, নং ৩৫০৯, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৯১, যয়ীফুল জামিয়িস সাগীর, পৃ. ১০০, নং ৭০১, আত-তারগীব ২/৪২২, নং ২৩২৩।

[9] তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ১১/৯৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১২৬, আত-তারগীব ১/৮৮, যয়ীফুল জামিয়িস সাগীর, পৃ. ১০০, নং ৭০০। ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, এই তিনটি হাদীসের সনদে দুর্বলতা আছে। প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীসকে ইমাম তিরমিযী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাসান বা গ্রহনযোগ্য বলেছেন।

[10] হাদীসটি হাসান। মুসনাদ আহমাদ ১/২৩০, ২/১৩২, ৩/২৬৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৭৬-৭৭।

[11] মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৭৬-৭৭। হাদীসটির সনদ যয়ীফ।

[12] আবু নুআইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ১/২৩৯।

[13] আবু নুআইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৫/১৯৫, নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ৩০, যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/১৪২।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা যিকরের মাজলিসের গুরুত্ব, মর্যাদা, সাওয়াব, প্রভাব, পদ্ধতি ও যিকরের ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছি। ঈমান বৃদ্ধি, ইলম বৃদ্ধি, যিকরের আনন্দ বৃদ্ধি, আন্তরিকতা বৃদ্ধি, মাগফিরাত লাভ, আল্লাহর পথে চলার প্রেরণা ও জ্ঞান লাভের জন্য যিকরের মাজলিস মুমিনের জীবনে অপরিহার্য।

আমাদের দৈনন্দিন সাংসারিক ও জাগতিক কাজকর্ম, সমাজের অন্যান্য মানুষের সাথে আমাদের সংমিশ্রণ, লেনদেন ও কথাবার্তা আমাদের হৃদয়গুলিকে কঠিন করে তোলে। মৃত্যুর চিন্তা, আখিরাতের চিন্তা, তাওবার চিন্তা ইত্যাদি কল্যাণময় অনুভূতি একটু দূরে সরে যায়। নিয়মিত ও সার্বক্ষণিক ব্যক্তিগত যিকরের পাশাপাশি যিকরের মাজলিস আমাদের হৃদয়গুলিকে পবিত্র ও আখিরাতমুখী করার জন্য খুবই উপকারী। হৃদয়ের কাঠিন্য দূর করতে, হৃদয়কে আখিরাতমুখী করতে, আল্লাহ তা’লা ও তাঁর মহান রাসূল (সা.)-এর মহব্বত দিয়ে হৃদয়কে পূর্ণ করতে, আল্লাহর স্মরণের ও তাঁর ভয়ে চোখের পানি দিয়ে হৃদয়কে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করতে যিকরের মাজলিস অতীব প্রয়োজনীয়। যিকরের মাজলিসে একজন পরিচালক বা আলোচক থাকতে পারেন। আবার মাজলিসের প্রত্যেকেই কিছু কিছু আলোচনা করতে পারেন।


‘যিকরের মাজলিসের’ ক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলির লক্ষণীয়:

১. যিকরের মাজলিসের সাথী ও নেতা

(ক) নেককার মানুষদের সাহচার্য দীনের পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়ে অনেক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে বেলায়াতের পথে পীর-মুরিদীর সুন্নাত-সম্মত গুরুত্ব ও পদ্ধতি আলোচনা করেছি। সকল মুমিনেরই প্রয়োজন এমন কিছু মানুষের সাহচার্য গ্রহণ করা যাঁদের মধ্যে কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান ও তাকওয়া আছে। যাঁদের মধ্যে ইলম ও আমলের সমন্বয় আছে। যাঁদেরকে দেখলে ও যাঁদের কাছে বসলে আল্লাহর পথে চলার, আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর পথে চলার এবং তাঁর সুন্নাত অনুসরণের প্রেরণা পাওয়া যায়।


(খ) এ ধরনের সঙ্গী নির্বাচনে সুন্নাতের দিকে খুবই লক্ষ্য দেওয়া প্রয়োজন। পূর্ববর্তী সকল বুজুর্গই ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ বা সুন্নাত প্রেমিক মানুষদের সাহচার্য গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। বর্তমানে সকলেই ‘আহলুস সুন্নাত’ বা সুন্নী বলে দাবি করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) এদের পরিচয় দিয়ে বলেছেন, “আমি ও আমার সাহাবীগণ যার উপরে রয়েছি, তার উপরে যারা থাকবে তারাই’ মুক্তিপ্রাপ্ত দল। কাজেই যারা তাঁদের অন্তরকে মহিমান্বিত আল্লাহ ও তাঁর মহান রাসূল (সা.)-কে প্রদান করেছেন, যাঁরা নিজেদের প্রবৃত্তি ও পছনদ অপছনদকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতের অধীন করে দিয়েছেন, যাঁরা তাঁর সুন্নাতের জন্য অন্য সবকিছু ত্যাগ করতে রাজি, তাঁদেরকে সঙ্গী হিসাবে নির্বাচিত করুন। যারা সুন্নাতে রাসূল (সা.) ও সুন্নাতে সাহাবার বাইরে কর্ম করতে পছনদ করেন, সুন্নাতের মধ্যে থেকে বেলায়াত অর্জন সম্ভব নয় বলে মনে করেন, বিভিন্ন অজুহাতে, ওসীলায়, যুক্তিতে যারা বিদ‘আত বহাল রাখতে আগ্রহী হন, যারা বিদ‘আতে হাসানার নামে সুন্নাত-বিরোধী কাজ করতে চান বা যারা সুন্নাতের চেয়ে বিদ‘আতে হাসানাকে বেশি মহব্বত করেন তাঁরা নিজেদেরকে ‘আহলুস সুন্নাত’ বলে দাবি করলেও তাদের কর্ম তাদের কথা মিথ্যা বলে প্রমাণ করে। এদের সঙ্গ পরিত্যাগ করুন। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, তাঁর উম্মাতের মধ্যে এরূপ মানুষ আসবে, যারা মুখে যা দাবি করবে কর্মে তা করবে না, আর এমন কর্ম করবে যে কর্ম করতে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয় নি। এদের সাথে সম্পর্ক রাখবেন না।


(গ) এভাবে নির্বাচিত আলিম, পথপ্রদর্শক বা সঙ্গীকে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য ভালবাসুন। তাঁদের সাথে নিয়মিত যিকরের মাজলিসে বসার ব্যবস্থা করুন। সপ্তাহে বা মাসে নির্ধারিত বা অনির্ধারিতভাবে মাঝে মাঝে এঁদের সাথে বসে নির্ধারিত বা অনির্ধারিত সময় ইলম ও ঈমান বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর যিকরে রত থাকুন।


২. যিকরের মাজলিসের বিষয় ও যিকর-আযকার

(ক) উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, যিকরের মাজলিস মূলত ঈমান ও ইলম বৃদ্ধির মাজলিস। এই মাজলিসের মূল বিষয় আলোচনা ও ওয়ায। আমরা সাধারণত মনে করি যে, যিকরের মাজলিস অর্থ একাকী পালনীয় যিকর আযকারগুলি একত্রে পালন করার মাজলিস। ধারণাটি ভুল ও সুন্নাতের খেলাফ।


আমরা দেখেছি যে, যিকর মূলত দুই প্রকার - প্রথমত, স্মরণ করা এবং দ্বিতীয়ত, স্মরণ করানো। যিকরের মাজলিসের অন্যতম প্রধান যিকর স্মরণ করানো বা ওয়ায আলোচনা। আমাদের বুঝতে হবে যে, তাসবীহ, তাহলীল ইত্যাদি যিকর মুমিন একাকী পালন করতে পারেন। কিন্তু ইলম, তাকওয়া ও আল্লাহর পথে চলার আগ্রহ বৃদ্ধিমূলক আলোচনা একা করা যায় না বা করতে অসুবিধা। যিকরের মাজলিসে এই বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। যিকরের মাজলিসে ঈমান ও ইলম বৃদ্ধিমূলক আলোচনা করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে তাসবীহ, তাহলীল, সালাত, সালাম ইত্যাদি যিকর পালন করতে হবে।


আলোচক মানুষের জীবনে আল্লাহর অগণিত নিয়ামত, বিশেষ করে হেদায়াতের নিয়ামত আলোচনা করে উপস্থিতির মনের মধ্যে হামদ ও শুকুরের (কৃতজ্ঞতা) অনুভূতি জাগ্রত করলেন। উপস্থিত সকলে আবেগ ও ভালবাসার সাথে কিছুক্ষণ আল্লাহর হামদ ও সানা করবেন ও কিছুক্ষণ প্রত্যেকে নিজে নিজে মনে মনে বা মৃদু স্বরে “আল-‘হামদু লিল্লাহ” ও আল্লাহর প্রশংসা ও মর্যাদা প্রকাশক অন্যান্য মাসনূন বাক্য দ্বারা যিকর করবেন। তিনি মানুষের পরিণতি, মৃত্যু ও আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা করবেন। দুনিয়ার জীবনের অনিশ্চয়তা, ক্ষণস্থায়িত্ব, আখিরাতের স্থায়িত্ব, যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর আগমন, পাপের পরিণতি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে হৃদয়গুলিকে আখিরাতমুখী করবেন।

মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের কিভাবে ভালবাসেন, আর বান্দা তাঁকে ভালবেসে কী মহান নিয়ামত পেতে পারে সে বিষয়ে আলোচনা করবেন। হৃদয়কে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য পার্থিব বিষয়ের লোভ ও ভালবাসায় জড়ানোর পরিণতি আলোচনা করবেন। আল্লাহর দ্বীন জানতে, পালন করতে, প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা ও এর সুমহান পুরস্কার বিষয়ে আলোচনা করবেন। আলোচক ও উপস্থিতি আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে মনের আবেগ অনুসারে “লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ” ও অন্যান্য মাসনূন যিকর পালন করবেন। প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে।

পাপের ক্ষতি ও ভয়াবহতা, তাওবা ও ইস্তেগফারের প্রয়োজনীয়তা, ফযীলত, গুরুত্ব ইত্যাদি আলোচনা করে হৃদয়ের মধ্যে তাওবার প্রেরণা সৃষ্টি করবেন। সবাই নিজের মতো আবেগ সহকারে তাওবা করবেন ও ইস্তেগফারের যিকর করবেন। কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন তাওবার ঘটনা এবং এ বিষয়ক আয়াত ও হাদীস আলোচনা ও চিন্তা করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রেরণের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে কত বড় নিয়ামত দিলেন, তিনি [নবী (সা.)] আমাদের জন্য কত কষ্ট করলেন, আমাদেরকে কত ভালবসাতেন এবং তাঁর প্রতি আমাদের কত বেশি ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতার প্রয়োজন তা আলোচনা করবেন। এ বিষয়ক কুরআন ও হাদীস আলোচনা করবেন। আলোচনার মধ্যে সকলে আবেগ, ভক্তি ও ভালবাসার সাথে প্রত্যেকে নিজের মতো মনে মনে বা মৃদুস্বরে সালাত ও সালাম পাঠ করবেন। আলোচক ও উপস্থিতি কুরআনের বিভিন্ন আয়াত আলোচনা ও তার অর্থ চিন্তা করবেন। এ সকল আয়াতের, ভাব ও মর্মকে হৃদয়ের মধ্যে গেঁথে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। পূর্ববর্তী যুগের নেককার বুজুর্গগণ, বিশেষত সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ ও কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত নবীগণ ও পূর্ববর্তী যুগের বুজুর্গগণের আল্লাহর প্রেম, তাওবা, জিহাদ, যুহদ, তাকওয়া, সবর ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করবেন। এ সকল আলোচনার ফাঁকে মনের আবেগ ও প্রেরণা অনুসারে মাসনূন বাক্যদ্বারা মাসনূনভাবে আল্লাহর যিকর করবেন। সকল মুসলমানের জন্য প্রাণখুলে দু‘আ করবেন। পূর্ববর্তী সকল মুসলিম, বিশেষত নেককার বান্দাদের জন্য মাগফিরাত ও মহব্বত প্রার্থনা করবেন। উম্মতে মুহাম্মাদীর হেদায়াত, বিজয় ও দুনিয়া- আখিরাতের কল্যাণ প্রার্থনা করবেন।


(খ) বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা দরকার যে, এ সকল মাজলিসের আলোচনা যেন মহান আল্লাহর দিকে প্রেরণাদায়ক, আখিরাতমুখী, নিজেদের গোনাহ ও অপরাধের স্মারক ও ক্রন্দন উদ্দীপক হয়। বিতর্ক, উপস্থিত বা অনুপস্থিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সমালোচনা, অহঙ্কার, বিদ্বেষ ইত্যাদি কেন্দ্রিক সকল আলোচনা পরিহার করা প্রয়োজন।


(গ) সকল প্রকার আলোচনা কুরআন কারীম ও শুধুমাত্র সহীহ হাদীস কেন্দ্রিক হতে হবে। মিথ্যা, বানোয়াট, অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা, গল্প, কাহিনী ইত্যাদি সতর্কতার সাথে পরিহার করতে হবে।


(ঘ) সকল আলোচনা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ কেন্দ্রিক হওয়া নিতান্ত প্রয়োজন। বানোয়াট, অনির্ভরযোগ্য ঘটনা বা কাহিনী অথবা পরবর্তী যুগের বুজুর্গগণের জীবনী আলোচনা না করে নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত নির্ভযোগ্য গন্থ থেকে সংগৃহীত সীরাত, সাহাবী-তাবেয়ীগণের জীবনী, তাঁদের বুজুর্গী, কারামত, তাকওয়া, বেলায়াত ইত্যাদি আলোচনা করা উচিত। এতে দ্বিবিধ উপকার হয়।

প্রথমত, আমাদের অন্তরগুলি ক্রমান্বয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণের মহব্বত বেশি বেশি অর্জন করতে থাকে। আর তাঁদের মহব্বত যেমন ঈমানের অংশ ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত, তেমনি সকল বেলায়াত, কামালাত ও বুজুর্গীর অন্যতম মাধ্যম।

দ্বিতীয়ত, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরে তাঁর সাহাবীগণ আমাদের অনুকরণীয় আদর্শ। তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ী যুগের মানুষদের প্রশংসা তিনি নিজে করেছেন। এদের পরবর্তী যুগের বুজুর্গগণের কাহিনী আলোচনা করলে অনেক সময় ভুল বুঝার অবকাশ থাকে। এ সব যুগের অনেক বুজুর্গ তাঁদের বুজুর্গী সত্ত্বেও ভুলবশত বিভিন্ন বিতর্কিত বা সুন্নাত বিরোধী কর্মে নিপতিত হয়েছেন। - কেউ সামা কাওয়ালী করেছেন, কেউ খেলাফে সুন্নাতভাবে নির্জনবাস করেছেন। কেউ কেউ খেলাফে সুন্নাত বিভিন্ন আবেগী কথা বিভিন্ন হালতে বলেছেন। এ সব কথা সাধারণ শ্রোতা বুঝতে নাও পারেন। এজন্য সর্বদা নবীজী (সা.)-এর জীবন কেন্দ্রিক ও সাহাবী-তাবেয়ীগণের জীবন কেন্দ্রিক আলোচনা করা উচিত।


৩. কুরআন কেন্দ্রিক যিকর

আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, কুরআন কারীম তিলাওয়াত ও আলোচনা যিকরের মাজলিসের অন্যতম যিকর। কুরআন কেন্দ্রিক ‘যিকরের মাজলিস’ বা ‘হালকায়ে যিকর’ বিভিন্ন রকম হতে পারে। প্রথম প্রকার যিকর - একজন তিলাওয়াত করবেন আর অন্য যাকিরগণ মহব্বতের সাথে শুনবেন। এ ধরনের ‘হালাকায়ে যিকর’-এ কোনো ভালো নেককার হাফিজকে কুরআন তিলাওয়াতের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। না হলে যাকিরগণের মধ্য থেকে যিনি আলিম বা ভালো ক্বারী তিনি তিলাওয়াত করবেন। কুরআন কারীম তিলাওয়াত ও শোনা উভয়ই অত্যন্ত বড় ইবাদত ও যিকর। তবে যতক্ষণ মহব্বত ও আবেগ থাকবে ততক্ষণ এভাবে যিকর করতে হবে। মাইকে তিলাওয়াত করানো, যাদের কুরআন শোনার মহব্বত ও আবেগ নেই তাদেরকে শোনানো, রাতারাতি খতম করা ইত্যাদি কর্মগুলি সুন্নাতের খেলাফ ও কুরআনের সাথে বেয়াদবীমূলক কর্ম। প্রয়োজনে মাজলিসের উপস্থিত ব্যক্তিগণের জন্য মাইক বা সাউন্ড বক্স ব্যবহার করা যাবে।

কুরআন কেন্দ্রিক যিকরের মাজলিসের দ্বিতীয় প্রকার - অর্থ আলোচনা করা। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত তিলাওয়াত করে তার অর্থ ও শিক্ষা আলোচনা করে ঈমান ও মহব্বত বৃদ্ধি করতে হবে। কুরআন কেন্দ্রিক যিকরের মাজলিসের তৃতীয় প্রকার- হৃদয়ে অর্থ অনুধাবন ও অর্থ অনুসারে হৃদয়কে আলোড়িত করার চেষ্টা। কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াত অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে বারবার পাঠ করে এগুলির অর্থ ‘মুরাকাবা’ বা হৃদয়ের মধ্যে জাগরুক করে অর্থের আলোকে ও অর্থের প্রেরণা অনুসারে আল্লাহর দরবারে সকাতরে প্রার্থনা, ইস্তিগফার ইত্যাদি করা। এ সময়ে প্রত্যেকে নিজের অন্তরের দিকে লক্ষ্য রেখে আদবের সাথে নিজের মতো যিকর করতে হবে।


৪. রাসূলুল্লাহর (সা.) জীবন কেন্দ্রিক যিকর

যিকরের মাজলিসের অন্যতম একটি বিষয় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সহীহ সীরাত, শামায়েল ও তাঁর জীবন ও কর্ম সংক্রান্ত সকল বিষয়। আমরা ইতঃপূর্বে আলোচনা করেছি যে, সাহাবীগণের যিকরের মাজলিসের মূল বিষয়গুলির অন্যতম ছিল ঈমান বৃদ্ধিকারক ও আল্লাহর নিয়ামত সংক্রান্ত আলোচনা করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) কেনিদ্রক যে কোনো আলোচনা তাঁর প্রতি আমাদের মহব্বত বৃদ্ধি করবে, যা আমাদের ঈমানের অন্যতম অংশ। এছাড়া আমাদের জীবনে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত তাঁর মহান নবীর উম্মত হওয়ার সৌভাগ্য। এগুলি সর্বদা আলোচনা করা আমাদের একান্ত প্রয়োজন।


সাহাবী-তাবেয়ীগণের জীবন আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁদের জীবনের অধিকাংশ মাজলিসই ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.) কেন্দ্রিক। বিভিন্ন কাজে তাঁর সুন্নাত, তাঁর রীতি, তাঁর কর্ম, তাঁর জীবনী, তাঁর বাণী, তাঁর শিক্ষা, তাঁর মুবারাক আকৃতি, তাঁর উঠা-বসা, শোওয়া, তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ, তাঁর জন্ম, তাঁর ওফাত, তাঁর পরিবার পরিজন ইত্যাদি তাঁদের সকল মাজলিসের অন্যতম বিষয় ছিল। এগুলি আলোচনা করতে তাঁরা চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছেন, আবেগ ও মহব্বতে হৃদয়কে পূর্ণ করেছেন। আমাদের জীবনের নিয়মিত যিকরের মাহফিলের অন্যতম বিষয় এগুলি হতে হবে। এ সকল আলোচনার সময় স্বভাবতই বারবার তাঁর উপর প্রত্যেক যাকির নিজনিজভাবে মহব্বত ও আবেগসহ সালাত ও সালাম পাঠ করবেন। আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, সালাত-সালাম যিকরের মাহফিলের অন্যতম যিকর।


এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে এই ধরনের যিকরের মাহফিল সাধারণভাবে মীলাদ মাহফিল নামে পালিত ও পরিচিত। মীলাদ মাহফিলের পরিচয়, উদ্ভাবন ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আমি “এহ্ইয়াউস সুনান” গ্রন্থে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করেছি। আমরা দেখেছি

যে, মীলাদ অনুষ্ঠানে অনেকগুলি মাসনূন ইবাদত পালন করা হয়, যেগুলির মধ্যে রয়েছে উপরের মাসনূন যিকর : রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বেলাদাত, ওফাত, জীবনী, কর্ম ইত্যাদি আলোচনা, সালাত, সালাম, তাঁর প্রতি মহব্বত বৃদ্ধি ইত্যাদি। অপরদিকে এগুলি পালনের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগতভাবে আমরা কিছু খেলাফে সুন্নাত কাজ করি।

প্রথমত, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে এবং পরবর্তী যুগে সাহাবী-তাবেয়ীগণ এসকল ইবাদতকে ‘যিকরের মাহফিল’, ‘সুন্নাতের মাহফীল’, ‘হাদীসের মাজলিস’, ‘সীরাতের মাজলিস’ ইত্যাদি নামে করতেন। “মীলাদ” নামে কোনো মাহাফিল, অনুষ্ঠান আচার, উদযাপন তাদের মধ্যে ছিল না। নাম বা পরিভাষার চেয়ে বিষয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবুও নাম ও পরিভাষার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণের মধ্যে প্রচলিত নাম ও পরিভাষা ব্যবহার উত্তম। বাধ্য না হলে কেন আমরা তাঁদের রীতি, নীতি বা সুন্নাতের বাইরে যাব?


দ্বিতীয়ত, শুধুমাত্র মীলাদ বা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম আলোচনা ও উদযাপনের জন্য মাজলিস করা, সালাত বা সালাম পাঠের জন্য উঠে দাঁড়ানো, সমস্বরে ঐক্যতানে সালাত বা সালাম পাঠ করা ইত্যাদি সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সুন্নাতে সাহাবার খেলাফ। এই প্রকারের যিকরের মাজলিসে আলোচক সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করে আদব ও মহব্বতের সাথে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মুবারক আকৃতি, কর্ম ও জীবনীর বিভিন্ন দিক, তাঁর প্রেরণের মাধ্যমে আল্লাহর মহান নিয়ামতের আলোচনা করবেন। আলোচনার মধ্যে তিনি এবং যাকিরগণ যিকরের সকল আদবসহ পরিপূর্ণ মহব্বত, ভয়, ভক্তি ও বিনয়ের সাথে অনুচ্চস্বরে প্রত্যেকে নিজের মতো করে সালাত ও সালাম পাঠ করতে হবে। আর এই ‘মীলাদ’-এর সুন্নাত সম্মত রূপ।


তৃতীয়ত, খেলাফে-সুন্নাত পদ্ধতির সবচেয়ে মারাত্মক দিক দলাদলি ও হানাহানি। বস্তুত, মুসলিম উম্মাহর সকল দলাদলি- হানাহানির অন্যতম কারণ মাসনূন ইবাদতের জন্য ‘খেলাফে সুন্নাত’ পদ্ধতির উদ্ভাবন। সাহাবীগণের যুগ থেকে প্রায় ৬০০ বৎসর মুসলিম উম্মাহ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম, জীবনী, শিক্ষা, মহব্বত ইত্যাদি আলোচনা করেছেন এবং সালাত-সালাম পাঠ করেছেন। কখনোই এ বিষয়ে মতভেদ ঘটেনি। কারণ বিষয়টি উন্মুক্ত ছিল, প্রত্যেকেই তাঁর সুবিধামত তা পালন করেছেন। যখনই এ সকল ইবাদত পালনের জন্য ‘মীলাদ’ নামক পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটল তখনই মতভেদ ও বিচ্ছিন্নতা শুরু হলো। এরপর প্রায় ৪০০ বৎসর পরে যখন ‘কিয়াম’-এর উদ্ভাবন ঘটল তখন আবার ‘মীলাদ’-এর পক্ষের মানুষদের মধ্যে নতুন করে মতভেদ ও বিচ্ছিন্নতা শুরু হলো। ক্রমান্বয়ে ‘পদ্ধতি’ই ইবাদতে পরিণত হলো। এখন যদি কেউ সারাদিন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম, জীবনী, মুজিযা, মহব্বত ইত্যাদি আলোচনা করেন এবং সালাত-সালাম পাঠ করেন, কিন্তু মীলাদের পদ্ধতিতে কিয়াম না করেন, তবে মীলাদ-কিয়ামের পক্ষের মানুষেরা তাকে পছন্দ করবেন না। এই পর্যায় থেকে আমাদের অবশ্যই আত্মরক্ষা করতে হবে।


৫. যিকরের মাজলিসের বিদ‘আত ও পাপ

যিকরের মাজলিসের প্রকার, প্রকৃতি, পদ্ধতি ও শব্দাবলী সবকিছু সুন্নাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সকল প্রকার বিদ‘আত, বিশেষত আমাদের দেশে ‘যিকরের মাজলিস’ নামের অনুষ্ঠানের বিদ‘আতগুলি বর্জন করতে হবে। এ সকল খেলাফে সুন্নাত কর্মের মধ্যে রয়েছে: সমবেতভাবে ঐক্যতানে যিকর, উচ্চৈঃস্বরে যিকর, বিশেষ পদ্ধতিতে শব্দ করে যিকর, যিকরের নিয়্যাত, ‘ইল্লাল্লাহ’ যিকর, ‘ইয়া রাহমাতুল্লিল আলামীন’ ইত্যাদি বাক্যের যিকর, গজল বা গান গেয়ে বা গানের তালে যিকর, শরীর দুলিয়ে, হেলেদুলে, লাফালাফি করে বা নাচানাচি করে যিকর ইত্যাদি অগণিত খেলাফে সুন্নাত, বিদ’আত বা শিরকমূলক শব্দ, বাক্য ও পদ্ধতি আমাদের দেশে যিকর নামে পরিচিত।


আমারা যিকর বলতে এসকল খেলাফে সুন্নাত ও বিদ‘আত কর্মগুলিই বুঝি যে যত বেশি খেলাফে সুন্নাত বা বিদ‘আতভাবে যিকর করছে সেই ততবড় যাকির ও তত বেশি মারেফাতের অধিকারী। আর যে যত সুন্নাত অনুসারে সাহাবীগণের মতো যিকর করছে সে ‘ওহাবী’ অথবা নীরস আলিম; কোনো মারেফাত তার নেই। যত মারেফাতের উৎস মনে হয় বিদ‘আত। দেখে শুনে মনে হয় রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণের কোনো মারেফাতই ছিল না। বিদ‘আত উদ্ভাবনের পরেই মারেফাতের সুভ সূচনা এবং বিদ‘আতেই সকল মারিফাত! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন!


মুহতারাম পাঠক, এ সকল বড় বড় ফাঁকা বুলিতে ধোঁকাগ্রস্ত হবেন না। উপরে একাধিকবার আমরা আলোচনা করেছি যে, ‘ইত্তেবায়ে সুন্নাত’ বা সুন্নাতের অনুসরণ ছাড়া কোনো ইবাদত হয় না, বেলায়েত হয় না, মারেফত হয় না। সুন্নাতের বাইরে ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই নেই, তা যতই চকচক করুক বা চমকদার হোক।

যিকর সংক্রান্ত খেলাফে সুন্নাত কর্ম দুই প্রকারের: যিকরের শব্দের মধ্যে উদ্ভাবন ও যিকরের পদ্ধতিতে উদ্ভাবন। পদ্ধতিগত খেলাফে সুন্নাত কর্মের মধ্যে রয়েছে - বিশেষ পদ্ধতিতে বসে, মাথা বা শরীর ঝাঁকিয়ে, শরীরের বিভিন্ন স্থানে যিকরের শব্দ দ্বারা ধাক্কা বা আঘাতের কল্পনা করে, বিশেষ পদ্ধতিতে উচ্চারণ করে, গান বা গজলের তালে তালে, সমস্বরে ঐক্যতানে, উচ্চৈঃস্বরে বা চিৎকার করে, লাফালাফি করে বা নেচে নেচে যিকর করা।


এগুলি সবই খেলাফে সুন্নাত। কেউ কোনোভাবে একটি হাদীসও খুঁজে পাবেন না যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বা তাঁর সাহাবীগণ এভাবে যিকর করেছেন। বিভিন্ন সাধারণ যুক্তি ও বিশেষভাবে মনোযোগ সৃষ্টির যুক্তিতে এগুলি করা হয়। আমরা ইতঃপূর্বে এ সকল বিষয়ে কিছু আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, শিক্ষা, অনুশীলন বা মনোযোগের জন্য কোনো জায়েয পদ্ধতি ব্যক্তিগতভাবে কিছু সময়, প্রয়োজনমতো বা মাঝে মাঝে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এগুলিকে নিয়মিত রীতিতে পরিণত করলে বা ইবাদতের অংশ হিসাবে গ্রহণ করলে তা সুন্নাতের বিপরীতে বিদ‘আতে পরিণত হয় এবং এর ফলে মূল সুন্নাত পদ্ধতি ‘মৃত্যুবরণ করে’ বা সমাজ থেকে উঠে যায়।

পদ্ধতিগত খেলাফে সুন্নাতের চেয়েও মারাত্মক শব্দগত খেলাফে সুন্নাত যিকর। একজন যাকির মাসনূন শব্দে যিকর করতে করতে আবেগে হয়ত মাথা নাড়াতে পারে বা যিকরের আবেগ তার নড়াচড়ায় প্রকাশ পেতে পারে। ব্যক্তিগত ও সাময়িকভাবে তা অনেক সময় জায়েয, যদিও সুন্নাত নয়। কিন্তু একজন মুমিন কেন এমন শব্দ ব্যবহার করে যিকর করবেন যা রাসূলুল্লাহ (সা.) ব্যবহার করেননি? এ

ক্ষেত্রে ওযর খুঁজে বের করা আরো কষ্টকর। কী প্রয়োজন আমার বিভিন্ন যুক্তি ও ‘অকাট্য দলিল’ দিয়ে কষ্ট করে এমন একটি যিকর পালন করা এবং প্রচলন করা যা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ করেননি এবং যা করলে কী পরিমাণ সাওয়াব হবে তা আমাদের মোটেও জানা নেই?

পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আপনি যে সকল কাজকে বিদ‘আত বা খেলাফে সুন্নাত বলছেন যুগযুগ ধরে আল্লাহর ওলীগণ তো সে কাজই করে আসছেন। এ সকল কাজের মাধ্যমেই তারা বেলায়াত, কারামত, হালাত ও ফয়েযের উচ্চমার্গে আরোহণ করেছেন। এখনো দেশে দেশে এ সকল কর্মের মাধ্যমে অগণিত মানুষ বেলায়াত, কারামত, হালাত, ফয়েয ইত্যাদি লাভ করছেন। আপনার কথা ঠিক হলে তা কিভাবে সম্ভব হলো? এগুলি কি প্রমাণ করে না যে, আপনার কথা ভুল?

নিম্নের বিষগুলি পাঠককে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে সাহায্য করবে:


১. সকল বুজুর্গই মাসনূন ইবাদত পালন ও প্রচার করেছেন

যুগ যুগ ধরে আল্লাহর ওলীগণ কখনোই এ সকল সুন্নাত বিরোধী কাজ করেন নি। সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণের যুগের আবিদ, যাকির ও সূফী-দরবেশগণের জীবনের কর্ম, যিকর ও যিকরের মাজলিসের পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, বেলায়াত ও তাযকিয়ার পথে তাঁদের কর্মগুলি ছিল একান্তই মাসনূন কর্ম। এই গ্রন্থে যা কিছু লিখা হয়েছে তা তাঁদের জীবনী ও কর্মের আলোকেই লিখা হয়েছে। ৫ম হিজরী শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও সূফী আল্লামা আবু নু’আইম ইসপাহানী (৪৩০ হি) “হিলয়্যাতুল আউলিয়া” গ্রন্থে সাহাবীগণের যুগ থেকে তাঁর যুগ পর্যন্ত সূফী, দরবেশ, বুজুর্গ ও যাহিদগণের জীবনী বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাদের যিকর ও যিকরের মাজলিসের আলোচনা করেছেন। এ সকল আলোচনায় আমরা দেখছি যে, তাঁদের যিকরের মাজলিস ছিল ঈমান বৃদ্ধিকারক, দুনিয়ার মোহ, লোভ, লালসা, হিংসা, অহংকার ইত্যাদি থেকে হৃদয়কে মুক্ত -করা বিষয়ক ও হৃদয়ের মধ্যে আল্লাহর ভয়, তাওবা ও ইসতিগফারের প্রেরণা দানকারী আলোচনা ও আলোচনা সাথে ইস্তিগফার, ক্রন্দন ইত্যাদি। পাঠককে অনুরোধ করছি “হিলয়্যাতুল আউলিয়া”, “সিফাতুস সাফওয়া”, “সিয়ারু আ’লামিন নুবালা” ইত্যাদি প্রথম যুগের ও নির্ভরযোগ্য জীবনী গ্রন্থে তাঁদের জীবনী পাঠ করতে।


বস্তুত, ওলী-আল্লাহদের নামে অগণিত মিথ্যা কথা সমাজে প্রচলিত। মুহাদ্দিসগণের অতন্দ্র প্রহরা ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মৃত্যুদন্ডের ন্যায় কঠিন শাস্তি সত্ত্বেও হাদীসের নামে অগণিত মিথ্যা ও জাল কথা প্রচার করেছে জালিয়াতগণ। ওলীদের নামে জাল কথা প্রচারের ক্ষেত্রে কোনো প্রহরা ও শাস্তির ব্যবস্থাই ছিল না। একারণে জালিয়াতগণ এ ক্ষেত্রে বেশি সফল হয়েছে। আমি ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, শাইখ আব্দুল কাদির জীলানী, মঈনুদ্দীন চিশতী, নিযামুদ্দীন আউলিয়া (রহঃ) প্রমখু বুজুর্গের নামে লিখিত গ্রন্থাদির মধ্যে এমন সব তথ্য বিদ্যমান যা নিশ্চিত করে যে, তাঁদের যুগের পরে জালিয়াতগণ তাদের নামে এ সকল পুস্তক রচনা করেছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের রচিত পুস্তকাদির মধ্যে অনেক মিথ্যা কথা ঢুকিয়েছে।


এর পরেও আমরা এ সকল বুজুর্গের লেখা পুস্তকাদির মধ্যে মাসনূন ইবাদত ও যিকরের কথাই দেখতে পাই। শাইখ আব্দুল কাদির জীলানীর (রহঃ) গুনিয়াতুত তালিবীন ও অন্যান্য গ্রন্থ, শাইখ মুঈনুদ্দীন চিশতীর (রহঃ) আনিসুল আরওয়াহ, মুজাদ্দিদে আলফে সানীর মাকতুবাত ও অন্যান্য গ্রন্থ, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবীর হুজ্জাতুল বালিগার ‘ইহসান ও তাসাউফ’ অংশ, তাঁর রচিত কাশফুল খাফা গ্রন্থের উমার (রাঃ)-এর তরীকা ও তাসাউফ বিষয়ক অংশ, সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর ‘সেরাতে মুস্তাকিম’ গ্রন্থ পাঠ করতে পাঠককে অনুরোধ করছি। এই পুস্তকে পাঠক যা কিছু দেখেছেন উপর্যুক্ত পুস্তকগুলিতে প্রায় তাই দেখতে পাবেন।


২. নিয়মিত ইবাদত বনাম সাময়িক অনুশীলন

আমরা দেখেছি যে, খেলাফে সুন্নাত সকল কর্মই বিদ‘আত বলে গণ্য হয় না। বরং খেলাফে সুন্নাত কর্মকে দীনের অংশ মনে করলে, সাওয়াবের মূল উৎস মনে করলে বা সুন্নাতের মত রীতিতে পরিণত করলে তা বিদ‘আতে পরিণত হয়। জায়েয বিষয় কিভাবে বিদ‘আতে পরিণত হতে পারে তার একটি উদাহারণ এই বই থেকে প্রদান করছি। সকাল সন্ধ্যার যিকর আলোচনার সময়ে আমি অনেক প্রকারের যিকর উল্লেখ করেছি। এগুলি সবই মাসনূন যিকর। এগুলিকে লিখার জন্য স্বভাবতই আমাকে একটির পরে একটি লিখতে হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে সাজাতে হয়েছে। এই ক্রমানুসারে সাজানোটা সুন্নাত নয়, আমার নিজের তৈরি। সুন্নাত এই যিকরগুলি পালন করা। যিকর পালন করতে গেলে অবশ্যই একটি ক্রম প্রয়োজন। একটির পর একটি তো করতে হবে। সাজানোর বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের জন্য উন্মুক্ত রেখেছেন। যাকির নিজের সুবিধামতো যিকরগুলি সাজিয়ে নেবেন। আমার ক্রমটিও এই প্রকারের। এই সাজানো নিঃসন্দেহে জায়েয ও প্রয়োজনীয়। কিন্তু যদি কোনো যাকির সুন্নাতের নির্দেশনা ছাড়া মনে করেন যে, এই যিকরটি আগে ও এই যিকরটি পরে দিতেই হবে, বা এই নির্দিষ্ট ক্রমান্বয় মেনে চলাটা একটি ইবাদত, বা এই নিয়মের মধ্যে বিশেষ সাওয়াব আছে তাহলে তা বিদ‘আতে পরিণত হবে।


যিকর বিষয়ক অধিকাংশ বিদ‘আত এইরূপ ভুল ধারণা থেকে এসেছে। পূর্ববর্তী যুগের বিভিন্ন আলিম ও নেককার মানুষ তাঁদের ছাত্র বা মুরীদকে সুন্নাতের আলোকে কিছু যিকর বেছে দিয়েছেন, সংখ্যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, ক্বলবের অমনোযোগিতা বা আলসেমী দূর করতে বা মনোযোগ অর্জনের জন্য কিছু সাময়িক নিয়মকানুন বলে দিয়েছেন। যেমন, কাউকে জোরে যিকর করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কাউকে নির্জনবাসের নির্দেশ দিয়েছেন। কেউ নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে যিকর করার নিয়ম করেছেন। কেউ নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে বসে পায়ের নির্দিষ্ট রগ চেপে ধরে অথবা দেহের নির্দিষ্ট স্থানে আঘাতের কল্পনা করে যিকর করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এগুলি সবই ছিল সাময়িক ও বিশেষ পরিস্থিতির আলোকে তাদের ব্যক্তিগত ইজতিহাদ মাত্র। কিন্তু পরবর্তীকালে অনেকেই সেগুলি দীনের অংশ মনে করেছেন। কেউ ভেবেছেন, এভাবে বসা বা এভাবে যিকর করা একটি বিশেষ ইবাদত। এভাবে না বসলে বা এভাবে যিকর না করলে সাওয়াব বা বরকত কম হবে। কেউ ভেবেছেন, এই পদ্ধতিতে না হলে আজীবন মাসনূন যিকর করলেও বেলায়াত বা তাযকিয়া অর্জন হবে না। এভাবে তাঁরা বিদআতের মধ্যে নিপতিত হয়েছেন।


৩. ক্রমান্বয় অবনতি ও সংশোধন

বুজুর্গদের শেখানো ইবাদত ও রিয়াযতের পদ্ধতিও তাঁদের মৃত্যুর পরে অনুসারীদের হাতে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হয়েছে। মুজাদ্দিদ-ই- আলফ-ই সানী (৯৭১-১০৩৪হি)-র মাকতূবাত শরীফ অধ্যয়ন করলে বিষয়টি ভালভাবে অনুভব করা যায়। তাঁর মাত্র ২০০ বৎসর পূর্বে বাহাউদ্দীন নকশবন্দ (৭৯১ হি) নকশবন্দীয়া তরীকার উদ্ভাবন করেন। এই ২০০ বৎসরের মধ্যে নকশবন্দীয়া তরীকার মধ্যে অনেক বিদ‘আত প্রবেশ করে বলে তিনি তাঁর মাকতূবাতের বিভিন্ন পত্রে আফসোস করেছেন।

আমাদের সমাজের দিকে তাকালেও আমরা তা বুঝতে পারব। কাদিরীয়া , চিশতীয়া, নকশবন্দীয়া, মুজাদ্দিদীয়া ইত্যাদি তরীকার দাবিদার বিভিন্ন দরবারে গেলে আপনি দেখবেন যে, একেক দরবারের যিকর, ওযীফা ও কর্ম পদ্ধতি একেক রকম, অথচ সকলেই একই তরীকা দাবি করছেন। আবার এদের অনেকেই মাত্র দুই বা তিন ধাপ পূর্বে একই পীর বা উস্তাদের শিষ্যত্ব দাবি করছেন, অথচ তাদের কর্ম পদ্ধতি এক নয়।


৪. তোমাদের জন্য রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে

একজন বুজুর্গ বেলায়াত অর্জন করেন তার সামগ্রিক কর্মের ভিত্তিতে। হাজার হাজার নেক আমলের পাশে দু একটি ভুলভ্রান্তির কারণে তাদের বুজুর্গী নষ্ট করে না। বরং কুরআনের বাণী অনুসারে অনেক নেকীর কারণে এ সকল ভুল বা অন্যায় ক্ষমা হয়ে যায়। পরবর্তী যুগের বুজুর্গগণের মধ্যে বিভিন্ন ভুলত্রুটি রয়েছে। কখনো বিশেষ হালতে, কখনো অনুশীলনের জন্য, কখনো ব্যক্তিগত ইজতিহাদে তাঁরা ভুল কর্ম করেছেন। এ সকল কর্মের ফলে যেমন তাদের বুজুর্গী নষ্ট হয় না, তেমনি তাঁরা করেছেন বলে এগুলি আমাদের জন্য করণীয় আদর্শ হতে পারে না। কোনো বুজুর্গ গান-বাজনা করেছেন এবং নেচেছেন, কেউ বা ধুমপান করেছেন, কেউ পীরকে সাজদা করেছেন এরূপ অগণিত বিষয় রয়েছে। এজন্য সুন্নাতে প্রত্যাবর্তন ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ বুজুর্গদের নামে অনেক কিছুই দাবি করা হচ্ছে, কোনটি সঠিক তা বাছাই করার কোনো সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। অনুরূপভাবে কোন্ কর্মটি তাঁরা ইবাদত হিসেবে করেছেন এবং কোন্টি সাময়িক অনুশীলন অথবা ব্যক্তিগত ইজতিহাদের কারণে করেছেন তাও স্পষ্টরূপে জানার কোনো উপাই নেয়। পক্ষান্তরে সুন্নাতের ক্ষেত্রে সহীহ ও বানোয়াট জানার মাপকাঠি রয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সকল কিছুই আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। বুজুর্গগণের বুজুর্গী ও বেলায়াতের জন্য তাঁদেরকে সম্মান করতে হবে এবং ভালবাসতে হবে। কিন্তু অনুকরণীয় পূর্ণাঙ্গ আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে। তাঁর সুন্নাত অনুসরণের পূর্ণাঙ্গ আদর্শ সাহাবীগণ। বুজুর্গগণকে নির্ভুল, নিষ্পাপ ও সর্বোচ্চ আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে তাদের মতের অযুহাতে সহীহ সুন্নাতে নববী বা সুন্নাতে সাহাবী অস্বীকার বা অমান্য করার পরিণতি কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।


বুজুর্গগণের কর্ম অনুসরণ করে আমরা সাওয়াব ও বেলায়াত আশা করি। আর সাহাবীগণের হুবহু অনুসরণ করলে পঞ্চাশ জন সাহাবীর সমান মর্যাদা ও পুরস্কার পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। তিনি বলেন, “তোমাদের সামনে রয়েছে ধৈর্যের সময়, এখন তোমরা যে কর্মের উপর আছ সে সময়ে যে ব্যক্তি অবিকল তোমাদের পদ্ধতি আকড়ে ধরে থাকবে, সে ব্যক্তি তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশ জন ব্যক্তির সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে। সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর নবী, আমাদের মধ্যকার ৫০ জনের সাওয়াব না তাদের মধ্যকার? তিনি বলেন, “না, বরং তোমাদের মধ্যকার ৫০ জনের সমপরিমাণ সাওয়াব।”[1]


৫. কারামত, হালাত, ফয়েয বনাম বেলায়াত ও তাযকিয়া

এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো বুজুর্গ কে? কে কতবড় আল্লাহর ওলী তা কিভাবে আমরা জানতে পারব? ইরানে, আরবে ও অন্যান্য দেশে শিয়াদের মধ্যে অগণিত পীর-দরবেশ বিদ্যমান যাদের কারামত ও কাশফের কথা লক্ষকোটি মানুষের মুখে মুখে। অথচ সুন্নীগণ তাদের মুসলমান বলে মানতেই নারায। এভাবে প্রত্যেক দলই দাবি করছেন যে, তাদের নেতৃবৃন্দ সর্বোচ্চ পর্যায়ের ওলীআল্লাহ। তাদের কাশফ, কারামত ও ফয়েযের অগণিত গল্প তাদের মুখে মুখে। পক্ষান্তরে অন্য দল এদেরকে কাফির, ফাসিক, ওহাবী, বিদ‘আতী ইত্যাদি বলে গালি দিচ্ছে।

বস্তুত, বুজুর্গী চেনার জন্য কাশফ, কারামত ইত্যাদির উপর নির্ভর করাই সকল বিভ্রান্তির মূল। মুসলিম উম্মাহর সকল বুজুর্গই বলেছেন যে, বুজুর্গী চেনার জন্য এগুলির উপর নির্ভর করা যাবে না, বরং সুন্নাতের উপরে নির্ভর করতে হবে। সুন্নাতের অনুসরণের পূর্ণতার উপরেই বুজুর্গীর পূর্ণতা নির্ভর করবে। সাহাবীগণের মত যিনি সকল ইবাদত বন্দেগি পালন করতে চেষ্টা করেন, তাঁদেরই মত হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, গীবত, গালাগালি ইত্যাদি পরিহার করেন, তাঁদেরই মত বিনয় ও সুন্দর আচরণ করেন, তাকে আপনি বুজুর্গ বলে মনে করতে পারেন। সুন্নাতের অনুসরণ যত বেশি হবে বুজুর্গীও তত বেশি হবে।

অলৌকিক কর্ম করা, মনের কথা বলা ইত্যাদি কাশফ-কারামত হতে পারে, আবার শয়তানী ইসতিদরাজ হতে পারে। কোনটি রাব্বানী এবং কোনটি শয়তানী তা চেনার একমাত্র উপায় সুন্নাতের অনুসরণ। মুজাদ্দিদে আলফে সানী, সাইয়িদ আহমদ ব্রেলবী ও অন্যান্য বুজুর্গ উল্লেখ করেছেন যে, কাফির-মুশরিকও রিযয়াত-অনুশীলন করলে কাশফ, কারামত ইত্যাদি অর্জন করতে পারে। এছাড়া শিরক বা বিদ‘আতে লিপ্ত করতে শয়তান মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। স্বপ্নে, কাশফে বা জাগ্রত অবস্থায় সে আল্লাহকে বা ওলীদেরকে বারংবার দেখতে পায়।


রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি স্বপ্নে আমাকে দেখল, সে প্রকৃতই আমাকে দেখল, কারণ শয়তান আমার রূপ পরিগ্রহণ করতে পারে না।”[2] এ জন্য মুসলিম উম্মাহ একমত যে, শয়তান রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আকৃতি গ্রহণ করতে পারে না। তবে অন্য কোনো আকৃতিতে এসে নিজেকে নবীজি বলে দাবি করতে পারে কি না সে বিষয়ে আলিমদের মতভেদ রয়েছে। অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন যে, শয়তান যেমন তাঁর রূপ পরিগ্রহণ করতে পারে না, তেমনি সে অন্য রূপে এসেও নিজেকে নবীজি বলে দাবি করতে পারে না। অন্য অনেকে বলেন যে, শয়তানের জন্য অন্য আকৃতিতে এসে নিজেকে নবীজি বলে দাবি করা অসম্ভব নয়; কারণ কোনো হাদীসে তা অসম্ভব বলা হয় নি। উপরন্তু মানুষ শয়তান যেমন জাল হাদীস বানাতে পারে, তেমনি জিন শয়তানও স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামে জালিয়াতি করতে পারে। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, সাহাবী ইবনু আব্বাস অনুরূপ মত পোষণ করতেন। ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ও স্বপ্ন বিশারদ মুহাম্মাদ ইবনু সিরীনও (১১০হি) অনুরূপ মতামত পোষণ করতেন।[3]


বাস্তব অনেক ঘটনা দ্বিতীয় মতটি সমর্থন করে। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের ভাই ‘মারফতী নাড়ার ফকীর’ দলে যোগ দেন। তিনি তার বাড়িতে রাতভর গানবাজনা করে যিকরের আয়োজন করেন। এতে গ্রামবাসীরা আপত্তি করলে তিনি দাবি করেন যে, তিনি যখন এভাবে গানবাজনাসহ যিকরের মাজলিসে বসেন, তখন তার মৃত পিতামাতা কবর থেকে উঠে তাদের মাজলিসে যোগ দেন। উপরন্তু স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বপ্নে তাকে এভাবে গানবাজনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একজন প্রসিদ্ধ বুজুর্গ পীর সাহেব ধুমপান করতেন। তাঁর নিকটতম একজন খলীফা জানান যে, স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়েই তিনি ধুমপান করতেন। আগের যুগের কোনো কোনো গ্রন্থেও অনুরূপ ঘটনার কথা পাওয়া যায়। এরা ভুল দেখেছেন, মিথ্যা বলেছেন, না বাস্তবেই শয়তান এরূপ স্বপ্ন দেখিয়েছে তা আল্লাহই ভাল জানেন।


সর্বোপরি কাশফ, ফয়েয, হালাত ইত্যাদি ইবাদত কবুল না হওয়ার লক্ষণ হতে পারে। সহীহ সুন্নাত-সম্মত ইবাদতে লিপ্ত হলে শয়তান আবিদের মনে ওয়াসওয়াসা দিয়ে মনোযোগ নষ্ট করতে চেষ্টা করে। যেন মুমিন ইবাদতে মজা না পেয়ে ইবাদত পরিত্যাগ করে বা অন্তত সাওয়াব কম পায়। পক্ষান্তরে ইবাদতের নামে বিদ‘আতে রত থাকলে শয়তান কখনোই মনোযোগ নষ্ট করে না, বরং তার মনোযোগ ও হালত বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়। কারণ উক্ত মুমিন তো সাওয়াব পাচ্ছেই না, বরং গোনাহ অর্জন করছে, কাজেই তাকে যত বেশি উক্ত কর্মে রত রাখা যায় ততই শয়তানের লাভ। এজন্যই অনেকে ধার্মিক মানুষকে দেখবেন, যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ যিকর সালাত আদায়ে তাড়াহুড়ো করছেন। অথচ বিদ‘আত মিশ্রিত যিকর-ওযীফার মধ্যে মহা আনন্দে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিচ্ছেন। তাহাজ্জুদে বা কুরআন তিলাওয়াতে ক্রন্দন আসছে না। কিন্তু বিদ‘আত মিশ্রিত যিকর বা দু‘আয় অঝোরে কাঁদছেন। অনেকে সালাতের মধ্যে কিছু খেলাফে সুন্নাত নিয়ম পদ্ধতি বা যিকর যোগ করে সালাতে মনোযোগ ও মজা পাচ্ছেন। কিন্তু বিশুদ্ধ সুন্নাত-সম্মতভাবে সালাত আদায় করলে সেরূপ মজা পাচ্ছেন না। এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কাশফ, ফয়েয, হালাত, মজা, ক্রন্দন, স্বপ্ন এগুলি কোনোটিই ইবাদত কবুলের আলামত নয়, বেলায়াতের আলামত হওয়া তো দূরের কথা।

৬. বেলায়াত-তাযকিয়ার দাবি-দাওয়া বনাম বাস্তবতা

বেলায়াত ও তাযকিয়ার দাবি সকলেই করছে। কিন্তু বাস্তবে কী দেখতে পাই? হিংসা, ঘৃণা, বিচ্ছিন্নতা, লোভ, অহঙ্কার, ক্রোধ, অসদাচরণ, গালাগালি, বান্দার হক্ক বিনষ্ট করা ইত্যাদি অগণিত কর্মে লিপ্ত দেখতে পাই এ সকল মানুষদের। অথচ তাঁরা তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত, যিকর ও অন্যান্য তাযকিয়ার কর্মে লিপ্ত! এর কারণ ঔষধের বিকৃত প্রয়োগ। তাযকিয়া ও বেলায়াতের নামে ইসলামের আংশিক কিছু শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে এবং তা অর্জনের ক্ষেত্রে কাশফ, কারামত, হালাত ইত্যাদিকে মানদন্ড হিসেবে পেশ করা হচ্ছে। ফলে সত্যিকার তাকওয়ার অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে না। উপরন্তু অগণিত হারামে লিপ্ত থেকেই ‘ওলী’ হয়ে গিয়েছি বলে আত্মতৃপ্তি ও অহঙ্কার হৃদয়কে গ্রাস করছে।


৭. নবীপ্রেম ও ওলীপ্রেমের দাবি-দাওয়া বনাম বাস্তবতা

নবীপ্রেম বা আশেকে রাসূল (সা.) হওয়ার দাবি অনেকেই করছেন। ওলীআল্লাহগণের মহব্বত ও অনুসরণের দাবি করছেন সকলেই। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখতে পাচিছ? এ সকল প্রেমিককে যেয়ে বলুন, আপনার মতামত, পোশাক, যিকর, মীলাদ, দরুদ ইত্যাদির সাথে রাসূলুল্লাহ (সা.) বা সাহাবীগণের পুরো মিল হচ্ছে না, একটু মিলিয়ে নিন। তাঁরা ঠিক এভাবে যিকর করেছেন, এভাবে মীলাদ পড়েছেন, অমুক বিষয়ে ঠিক একথা বলেছেন, কাজেই আপনি ঠিক অবিকল তাঁদের মত চলুন। আপনি দেখবেন যে, সেই প্রেমিক আপনার কথা মানছেন না। আপনার কথাগুলি বাতিল বা হাদীসে নেই সেকথা তিনি দাবি করবেন না। আপনার কথাগুলির বিপরীতে তার মতের পক্ষে কোনো সুস্পষ্ট সহীহ হাদীসও তিনি পেশ করতে পারবেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তা গ্রহণ করবেন না। বিভিন্ন ওযুহাত দেখাবেন। একেবরে অপরাগ হলে বলবেন, এগুলি ওহাবী মত বা বিভ্রান্ত মত! তিনি যে কর্ম বা মতামত পোষণ করছেন সেটিই একমাত্র সঠিক বা সুন্নী মত। কাজেই কোনো দলিল ছাড়াই সকল হাদীস ও সুন্নাত বাতিল হয়ে গেল।

অনেকের কাছেই নবীর (সা.) সুন্নাত এভাবে উড়িয়ে দেওয়া সহজ, তবে ওলী-আল্লাহগণের মতামত উড়িয়ে দেওয়া অনেক কঠিন! রাসূলুল্লাহ (সা.) করেছেন বা বলেছেন বললে তাঁরা সহজেই একটি ব্যাখ্যা দিয়ে বা বিনা ব্যাখ্যাতেই তা উড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু বুজুর্গদের কথা বা কর্ম অত সহজে উড়িয়ে দিতে পারেন না। তা সত্ত্বেও আমরা দেখি যে, অবস্থার পরিবর্তন হয় না। উক্ত ওলী-প্রেমিককে বলুন, আপনি যে, কাজটি করছেন তার বিরুদ্ধে বা যাকে আপনি নিন্দা করছেন তার পক্ষে শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী, মুঈন উদ্দীন চিশতী, মুজাদ্দিদে আলফে সানী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী, সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বা অন্য অমুক বুজুর্গ অমুক গ্রন্থে লিখেছেন, তখন একই ভাবে তিনি বিভিন্ন অযুহাতে তা মানতে অস্বীকার করবেন। কোনো অবস্থাতেই তিনি তাঁর মত বা কর্ম পরিবর্তন করতে রাযি হবেন না! যে বুজুর্গের নামে তিনি চলছেন স্বয়ং সেই বুজুর্গের মতামতও যদি তার মতের বিরুদ্ধে পেশ করা হয় তবুও তিনি তার একটি ব্যাখ্যা করবেন, কিন্তু নিজের মত বা কর্ম পরিবর্তন করবেন না।


অন্তরের সবচেয়ে বড় রোগ এটি। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির নিকট হক্ক এবং বাতিলের একটিই মাপকাঠি রয়েছে, তা হলো তার নিজের পছন্দ। হাদীস-কুরআন বা বুজুর্গদের মতামত তার পছন্দকে প্রমাণ করার জন্য, পছন্দকে উল্টানোর জন্য নয়। যা তার পছন্দ হয় না তা বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে বাতিল করে দেন। আরবীতে এই মাপকাঠিটির নাম (ﻫﻮﻯ)। বাংলায় প্রবৃত্তি বা ‘ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ’ বলা হয়। কুরআন-হাদীসে বারংবার এই ভয়ঙ্কর রোগ সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। এক স্থানে ইরশাদ করা হয়েছে: “আপনি কি তাকে দেখেছেন যে তাঁর নিজের পছনদ অপছনদ বা নিজের নফসের খাহেশাতকে নিজের মা’বুদ বানিয়ে নিয়েছে ? আপনি কি তার উকিল হবেন?”[4] রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: “তিনটি বিষয় মানুষকে ধ্বংস করে: অপ্রতিরোধ্য লোভ-কৃপণতা, নিজ প্রবৃত্তির ভালোলাগা মন্দলাগার আনুগত্য, মানুষের তার নিজ মতামতের প্রতি তৃপ্তি ও আস্থা।”[5]

এই রোগ থেকে মুক্তির একটিই পথ, নিজের পছন্দ-অপছন্দ, ভাললাগা ও মন্দলাগাকে সুন্নাতের অধীন করা। ব্যাখ্যা দিয়ে সুন্নাতকে বাতিল না করে ব্যাখ্যা দিয়ে নিজের মত বা বুজুর্গদের মতকে বাতিল করে সুন্নাতকে হুবহু গ্রহণ করা। এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে অনেক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

[1] মুহাম্মাদ ইবনু নাসর, আল-মাওয়াযী, আস-সুন্নাহ, পৃ. ১৪, তাবারানী, আল-মু’জাম আল-কাবীর ১০/১৮২, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৭/২৮২, আলবানী, সহীহাহ ১/৮৯২-৮৯৩।

[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/৫২, ৫/২২৯০, ৬/২৫৬৭, মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৭৫।

[3] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৫৬৭; ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১২/৩৮৩-৩৮৪।

[4] সূরা ফুরকানঃ ৪৩।

[5] মুনযিরী, আত-তারগীব ১/২৩০, আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৯৭।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতের খেদমতে এই বইটি আমার অতি নগণ্য একটি প্রচেষ্টা। চেষ্টার মধ্যে যদি কিছু মাত্র কল্যাণকর থেকে থাকে তা শুধুমাত্র মহান প্রভু আল্লাহ জাল্লা জালালুহুর দয়া ও তাওফীক। আর এর মধ্যে যা কিছু ভুল, ভ্রান্তি আছে সবই আমার অযোগ্যতার কারণে এবং শয়তানের কারণে। আমি রাব্বুল আলামীনের দরবারে সকল ভুল, অন্যায় ও বিভ্রান্তি থেকে তাওবা করছি এবং ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আল্লাহর দরবারে সকাতর প্রার্থনা যে, তিন দয়া করে এই অযোগ্য প্রচেষ্টাকে কবুল করে নেবেন। আল্লাহর কত প্রিয় বান্দা কতভাবে আল্লাহর দ্বীনের জন্য মহান কাজ করে চলেছেন। আমি তো কিছুই করতে পারলাম না। না পারলাম ব্যক্তিগত জীবনে ভালো ইবাদত করতে। না পারলাম উম্মতের কোনো কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে। এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা আল্লাহ দয়া করে কবুল করে একে আমার, আমার পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তান, যাদেরকে আমি আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসি ও যারা আমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসেন তাঁদের সকলের এবং পাঠক-পাঠিকাগণের নাজাতের ওসীলা বানিয়ে দেবেন এই দু‘আ করেই শেষ করছি। আমিন! আল্লাহর মহান রাসূলের জন্য সালাত ও সালাম এবং প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালন আল্লাহর নিমিত্ত।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৮ পর্যন্ত, সর্বমোট ৮ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে