রাহে বেলায়াত পঞ্চম অধ্যায় - মাজলিসে যিকর ও যিকরের মাজলিস ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

মুমিনের জীবনে যিকরের গুরুত্ব ও ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা আমরা শেষ করেছি। আল্লাহর দরবারে আর্জি জানাই, তিনি আমাদেরকে তা পালন করার তাওফীক প্রদান করবেন এবং দয়া করে কবুল করে নেবেন। সবশেষে যিকরের মাজলিস, মুমিনের জীবনে তার গুরুত্ব, ফযীলত ও সাওয়াব সম্পর্কে কিছু আলোচনা করতে চাই। আল্লাহর রহমত ও তাওফীকের আশা করছি এবং তাঁরই উপর নির্ভর করছি।

‘মাজলিস’ শব্দের অর্থ বৈঠক, বসা, council, assembly ইত্যাদি। এক ব্যক্তি একাকী কোথাও সামান্য সময়ের জন্য বসলেও তাকে আরবীতে ‘মাজলিস’ বলা হবে। অনুরূপভাবে দুই বা ততোধিক মানুষ একত্রে কিছুক্ষণের জন্য বসলে তাকেও মাজলিস বলা হবে। সাধারণভাবে ‘মাজলিস’ বলতে অল্প বা বেশি সময়ের জন্য একাধিক ব্যক্তির একত্রে বসাকে বুঝানো হয়।


ক. মাজলিসে আল্লাহর যিকর

মাজলিসে আল্লাহর যিকর দুই প্রকারে হতে পারে। প্রথম প্রকার- মাজলিস, সমাবেশ বা বৈঠকটি জাগতিক কোনো বিষয় কেন্দ্রিক হবে, তবে মাজলিসের মধ্যে মুমিন মাঝে মধ্যে আল্লাহর স্মরণ করবেন। দ্বিতীয় প্রকার - যে মাজলিসটি মূলতই আল্লাহর যিকর- কেন্দ্রিক হবে।

প্রথম প্রকারের মাজলিসে বা সমাবেশে মুমিন দুইভাবে আল্লাহর যিকর করতে পারেন: একাকী নিজের মনে বা সশব্দে আল্লাহর যিকর করা এবং অন্যদেরকে যিকরের কথা স্মরণ করানো। মুমিনের উচিত কোনো অবস্থায় আল্লাহর যিকর থেকে মনকে বিরত না রাখা। বিশেষত যখন কয়েকজন বন্ধুবান্ধব বা কিছু মানুষের সাথে বসে কথাবার্তা বলবেন তখন মাঝে মাঝে আল্লাহর যিকর করা খুবই প্রয়োজনীয়।

মানুষ সামাজিক জীব। কর্মস্থলে, চায়ের দোকানে, বাজারে, বাড়িতে বা অন্য কোথাও আমরা দুই বা ততোধিক মানষু একত্রিত হলে কখনোই চুপ থাকতে পারি না। ‘টক অব দা সিটি’, ‘টক অব দা কান্ট্রি’ , ‘টক অব দা ডে’ বা এই জাতীয় বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় সামাজিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বিভিন্ন কথাবার্তায় আমারা মেতে উঠি। এ সকল কথাবার্তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য খুবই ক্ষতিকারক এবং আখিরাত ধ্বংসকারী হয়, কারণ আমাদের কথাবার্তা অধিকাংশ সময় পরচর্চা, পরনিন্দা, হিংসা, ঘৃণা বা বেদনা উদ্রেককারী হয়ে থাকে।

যদি আমরা এসকল ক্ষতিকারক বিষয়াদি পরিহার করে শুধুমাত্র জাগতিক ‘নির্দোষ’ বিষয়; যেমন, - দ্রব্যমূল্য, নিজনিজ স্বাস্থ্য, পরিবার, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, ইত্যাদি বিষয়ে আলাপ করি তাহলেও তা আমাদের জন্য কিছু ক্ষতি বয়ে আনে। তিনটি কারণে এই প্রকারের ‘নির্দোষ’ কথাবার্তার ‘বৈঠক’ আমাদের ক্ষতি করে:


প্রথমত, এ ধরনের ‘নির্দোষ’ কথাবার্তা সর্বদাই ‘দোষযুক্ত’ পরচর্চা বা হিংসা বিদ্বেষ উদ্রেককারী আলোচনায় পর্যবসিত হয়। অনুপস্থিত বিভিন্ন ব্যক্তির কথা আলোচনার মধ্যে চলে আসবেই এবং কোনো না কোনোভাবে আমরা গীবত ও বান্দার হক্ক নষ্ট করার মত কঠিন কবীরা গোনাহসমূহে লিপ্ত হয়ে পড়ি।

দ্বিতীয়ত, এ সকল ‘নিদোর্ষ’ আলোচনায় যদি মাঝে মাঝে আমরা আল্লাহর যিকর-মূলক কোনো বাক্য না বলি তবে এই মাজলিস, বৈঠক বা আলোচনা কিয়ামতের দিন আমাদের জন্য আফসোস ও ক্ষতির কারণ হবে। ইতঃপূর্বে আমরা এ বিষয়ে একটি হাদীস উল্লেখ করেছি। উক্ত হাদীস থেকে আমরা জেনেছি যে, যদি একাধিক মুসলিম কোথাও একত্রে কিছু সময়ের জন্যও বসেন এবং কিছু কথাবার্তা বলে উঠে যান, কিন্তু তাদের কথার মধ্যে আল্লাহর যিকর ও রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উপর সালাত জ্ঞাপক কোনো কথা না থাকে, তবে কিয়ামতের দিন এই বৈঠকটি তাদের জন্য আফসোস ও ক্ষতির কারণ হবে। অন্য হাদীসে আমরা দেখেছি যে, কোনো ব্যক্তি যদি একাকী বা সমাবেশে কোথাও কিছু সময়ের জন্যও দাঁড়ায়, বসে, হাঁটে বা শয়ন করে, কিন্তু সেই বসা, দাঁড়ানো, হাঁটা বা শোয়া অবস্থায়

সে আল্লাহর যিকর না করে, তবে তা তার জন আফসোস ও ক্ষতির কারণ হবে। অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

مَا مِنْ قَوْمٍ يَقومونَ منْ مَجْلسٍ لاَ يَذكُرُون الله تَعَالَى فِيهِ إِلاَّ قَاموا عَنْ مِثلِ جيفَةِ حِمَارٍ وكانَ لَهُمْ حَسْرَةً


“যদি কিছু মানুষ এমন কোনো বৈঠক শেষ করে উঠে, যে বৈঠকে তারা আল্লাহর যিকর করেনি, তবে তারা যেন একটি গাধার মৃতদেহ (ভক্ষণ করে বা ঘাটাঘাটি করে) রেখে উঠে গেল। আর এই বৈঠক তাদের জন্য আফসোসের কারণ হবে।”[1]

আব্দুল্লাহ ইবনু মুগাফফাল (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

ما من قوم اجتمعوا في مجلس فتفرقوا ولم يذكروا الله عز وجل إلا كان ذلك المجلس حسرة عليهم يوم القيامة


“কিছু মানুষ যদি একটি বৈঠকে বসে এবং এরপর তারা বৈঠক ভেঙ্গে চলে যায়, কিন্তু উক্ত সময়ের মধ্যে তারা আল্লাহর যিকর না করে তাহলে কিয়ামতের দিন ঐ বৈঠক তাদের জন্য আফসোসের কারণ হবে।” হাদীসটির সনদ সহীহ।[2]


তৃতীয়ত, এই প্রকারের ‘নির্দোষ’ গল্পগুজব বা আলোচনার ‘মাজলিস’ আমাদের ক্বলবগুলিকে শক্ত করে দেয়। দীর্ঘসময় এ সকল আলোচনা আমাদের মনকে কঠিন করে তোলে। আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

لَا تُكْثِرُوا الْكَلَامَ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللَّهِ فَإِنَّ كَثْرَةَ الْكَلَامِ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللَّهِ قَسْوَةٌ لِلْقَلْبِ وَإِنَّ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنَ اللَّهِ الْقَلْبُ الْقَاسِي


“তোমরা আল্লাহর যিকর ছাড়া বেশি কথা বলবে না; কারণ আল্লাহর যিকর ছাড়া বেশি কথা হৃদয়কে কঠিক করে তোলে। আর আল্লাহর নিকট থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী মানুষ কঠিন হৃদয়ের মানুষ।”[3]


উপরের হাদীসগুলির আলোকে আমরা বুঝতে পারছি যে, মুমিনের দায়িত্ব, যে কোনো বৈঠক, গল্পগুজব, আলোচনা বা কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর মহান প্রভুর যিকর করবেন। মাজলিসের অন্য কেউ যদি আল্লাহর যিকর না করে, বা গরম গরম আবেগী কথায় মেতেথাকে তাহলেও মুমিন নিজের মনে মাঝে মাঝে আল্লাহর যিকর করবেন। আর জনসমক্ষে, মাজলিসে, গাফিলদের মধ্যে মুমিনের এই প্রকার একাকী যিকর অত্যন্ত ফযীলত, মর্যাদা ও সাওয়াবের বলে বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।

[1] হাদিসটি সহীহ। সুনানে আবী দাউদ ৪/২৬৪, নং ৪৮৫৫, মুসতাদরাক হাকিম ১/৬৬৮, ৬৬৯।

[2] তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ৪/১১২, আত-তারগীব ২/৩৮৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/৮০।

[3] সুনানুত তিরমিযী ৪/৬০৭, নং ২৪১১। ইমাম তিরমিযী হাদিসটিকে হাসান বলেছেন।