রাহে বেলায়াত তৃতীয় অধ্যায় - দৈনন্দিন যিকর ওযীফা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
তৃতীয় প্রকার যিকর : সকাল-বিকাল বা সকাল-সন্ধ্যার যিকর - এ সময়ের অনির্ধারিত যিকর

তাসবীহ, তাহলীল ও ওয়ায

ফজরের ফরয সালাতের পরে পালনীয় তিন পর্যায়ের নির্ধারিত যিকর- আযকার উপরে আলোচনা করেছি। আমরা ফজরের পরে পালনের জন্য ৩ টি যিকর, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে পালনীয় ২৯ প্রকার যিকর ও সকালে পালনীয় ১৭ প্রকার যিকর, মোট ৪৯ প্রকার যিকর উল্লেখ করেছি। আগ্রহী যাকির এগুলি সব বা আংশিক পালন করবেন। সংখ্যার চেয়ে আবেগ, মনোযোগ ও আন্তরিকতার মূল্য অনেক বেশি। এগুলি পালনের পরে মুমিন মনের আবেগ, আগ্রহ ও সুযোগ অনুসারের অনির্ধারিত যিকর যত বেশি সম্ভব পালন করবেন।

ফজরের পরে অনির্ধারিতভাবে যত বেশি সম্ভব তাসবীব, তাহলীল, তাহমীদ ও তাকবীরের যিকর আদায় করতে উৎসাহ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। এই অধ্যায়ের শুরুতে ফজরের পরে সূর্যোদয় পর্যন্ত যিকরে রত থাকার ফযীলতের আলোচনায় আমরা এ বিষয়ে একটি হাদীস উল্লেখ করেছি। আমরা দেখেছি, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “ফজরের সালাতের পরে সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে বসে মহান আল্লাহর যিকর, তাকবীর (আল্লাহু আকবার), তাহমীদ (আল-‘হামদলিল্লাহ), তাসবীহ (সুব‘হানাল্লাহ) ও তাহলীল (লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ) বলা আমার নিকট ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশের দুইজন বা আরো বেশি ক্রীতদাসকে মুক্ত করার চেয়ে বেশি প্রিয়। অনুরূপভাবে আসরের সালাতের পরে সূর্যাস্ত পযর্ন্ত এভাবে যিকর করা আমার নিকট ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশের চারজন ক্রীতদাসকে মুক্ত করার চেয়ে বেশি প্রিয়।

অন্য হাদীসে আবু উমামাহ (রাঃ) বলেনঃ

خرج رسول الله صلى الله عليه وسلم على قاص يقص فأمسك، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم قص فلأن أقعد (أقعد هذا المقعد) غدوة إلى أن تشرق الشمس (من حين تصلي الغداة الى أن تشرق الشمس) أحب إلي من أعتق أربع رقاب وبعد العصر حتى تغرب الشمس أحب إلى من أن أعتق اربع رقاب


“একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) বেরিয়ে দেখেন একজন ওয়ায়েয ওয়ায করছেন। তাঁকে দেখে ওয়াযকারী থেমে গেলেন। তিনি বললেনঃ

তুমি বয়ান করতে থাক। ফজরের সালাতের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত এইরূপ একটি মাজলিসে বসা আমার নিকট চারজন ক্রীতদাস মুক্ত করার চেয়েও বেশি প্রিয়। এবং আসরের সালাতের পরে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এভাবে বসা আমার নিকট চারজন ক্রীতদাস মুক্ত করার চেয়ে বেশি প্রিয়। হাইসামীর আলোচনা অনুসারে হাদীসটির সনদ গ্রহণযোগ্য।[1]

উপরের হাদীস দু’টি থেকে আমরা ফজরের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত অনির্ধারিত যিকরের বিবরণ পাচিছ। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ সময়ে দুই প্রকারের যিকরে অংশ গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন :

(ক). তাসবীহ-তাহলীল বা চার প্রকার মূল জপমূলক যিকর, এবং
(খ). ওয়ায-আলোচনা।


(ক) যিকরের মূল চারটি বাক্য জপ করা

সুবাহানাল্লাহ, আল-হামদু লিল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে, আল্লাহর নাম জপ মূলক যিকরের মূল চার প্রকার বাক্য, যেগুলি দ্বারা আল্লাহর মহত্ব, মর্যাদা, একত্ব ও প্রশংসা জপ করা হয়। অন্য সকল প্রকার মাসনূন যিকরের বাক্য মূলত এগুলিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এই চরটি বাক্য আল্লাহর নিকট প্রিয়তম বাক্য। পৃথকভাবে বা একত্রে নির্দিষ্ট সংখ্যায় বা অনির্ধারিতভাবে যত বেশি সম্ভব এগুলি জপ করার অফুরন্ত মর্যাদা, সাওয়াব ও ফযীলত আমরা সেখানে জানতে পেরেছি।

ফজরের সালাতের পরে ‘সালাতুদ দোহা’ বা চাশতের নামাযের প্রথম সময় পর্যন্ত প্রায় এক ঘণ্টা সময়। এছাড়া ‘দোহা’ বা চাশতের সালাত দ্বিপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত আদায় করা যায় বলে যাকির সুযোগ থাকলে এই সময় বাড়াতে পারেন।

যাকির প্রথমে উপরের তিন প্রকারের যিকর আদায় করবেন। এরপর চাশত বা দোহার সালাত আদায়ের পূর্ব পর্যন্ত বাকি সময়টুকু তিনি এই পর্যায়ের অনির্ধারিত যিকরে রত থাকবেন। যথাসম্ভব মনোযোগ, আবেগ, বিনয়ের সাথে মনেমনে বা যথাসম্ভব মৃদুস্বরে যতক্ষণ সম্ভব এই চার প্রকার বাক্য দ্বারা একত্রে, বা পৃথকভাবে যিকর করবেন। অন্তরকে সকল পার্থিব আকর্ষণ, জাগতিক চিন্তা ও ব্যস্ততা থেকে এই সময়টুকুর জন্য মুক্ত করে, আল্লাহর দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে, যিকরের অথের্র দিকে লক্ষ্য রেখে হৃদয়কে অর্থের সাথে আলোড়িত করে তিনি বারবার যিকরের শব্দ উচ্চারণ করবেন: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ...। এভাবেই ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’, ‘আল-হামদুলিল্লাহ।


হৃদয়কে অবশ্যই নাড়াতে হবে। ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ যিকরের সময় এর অর্থের দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ রাখতে হবে। হৃদয় থেকে আল্লাহ ছাড়া সকল অনুভূতি দূর করতে হবে। নেই, নেই, কেউ নেই, আমার ইবাদতের, প্রার্থনার, ভক্তির, ভয়ের, চাওয়ার, প্রার্থনার, আশার, ভয়ের জন্য কেউ নেই একমাত্র আল্লাহ ছাড়া।

এভাবে ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ যিকরের সময় মনকে সকল না-বাচক চিন্তা থেকে মুক্ত করে, আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার অনুভূতিতে হৃদয়কে ভরে তুলে অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে বারবার বলতে হবে ‘আল-হামদু লিল্লাহ’। ‘সুবহানাল্লাহ’ যিকরের সময় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহত্বের দিকে হৃদয়কে পরিপূর্ণরূপে ধাবিত করতে হবে। সবকিছুই অসম্পূর্ণ; পরিপূর্ণ পবিত্রতা শুধুমাত্র আল্লাহর। সকল মানবীয় চিন্তার ঊর্ধ্বে তিনি মহান। আমার হৃদয় তাঁরই মহত্ত্বের ঘোষণা দেয়, তাঁরই পবিত্রতার জয়গান গায়। এভাবেই ‘আল্লাহু আকবার’ যিকরের সময় মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠতব হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হবে। আর সবকিছুকে হৃদয় থেকে বের করে দিতে হবে। হৃদয়কে আলোড়িত, কম্পিত ও উদ্বেলিত করতে হবে যিকরের অর্থের সাথে সাথে।


কখনো মনোযোগ পূর্ণ না হলে চিন্তিত না হয়ে যিকরে রত থাকতে হবে। মনোযোগ ও আবেগের কম-বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে সর্বদা চেষ্টা করতে হবে পূর্ণতার জন্য।


(খ) কুরআন তিলাওয়াত, সালাত-সালাম ইত্যাদি

আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, সাধারণ যিকরের মধ্যে অন্যতম কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ-সালাম, দু‘আ-ইস্তিগফার ইত্যাদি। এই সময়ে এ সকল যিকর সময় ও সুবিধা অনুসারে করা যেতে পারে। যাকির নিজের সুবিধা ও অবস্থা অনুসারে এই সময়ের জন্য নির্ধারিত পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ পাঠ, ইস্তিগফার ইত্যাদি ওযীফা নির্ধারিত করে নেবেন বা সুযোগ থাকলে অনির্ধারিতভাবে তা পালন করবেন।

এখানে লক্ষণীয় যে, হাদীস শরীফে এই সময়ে তাসবীহ তাহলীল জাতীয় যিকরের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। তিলাওয়াত, দরুদ ইত্যাদি যিকরের কথা বলা হয়নি। অপরদিকে রাতের ওযীফার মধ্যে বেশি বেশি তিলাওয়াত ও দরুদ সালামের উল্লেখ করা হয়েছে। এজন্য অনেক তাবেয়ী সকাল-বিকালের যিকরের সময়ে তাসবীহ তাহলীল জাতীয় যিকরকে তিলাওয়াতের চেয়ে উত্তম বলে মনে করতেন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস ও ফকীহ তাবে-তাবেয়ী ইমাম আব্দুর রাহমান ইবনু আমর, আবু আমর আল-আউযায়ীকে (মৃ. ১৫৭ হি) প্রশ্ন করা হয় : ফজর ও আসরের পরে যিকরের সময়ে তাসবীহ-তাহলীল ইত্যাদি জপমূলক যিকর উত্তম না কুরআন তিলাওয়াত উত্তম? তিনি বলেনঃ তাঁদের (সাহাবী-তাবেয়ীগণের) রীতি ছিল এ সময়ে যিকরে রত থাকা। তবে তিলাওয়াত করাও ভালো।[2]

প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য প্রতিদিন কিছু পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত করা। অন্তত একমাসে একবার খতম করা অর্থাৎ পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। যদি মুমিন বুঝতে পারেন যে, তিনি রাত্রে কিছু সময় তিলাওয়াতে কাটাতে পারবেন তাহলে সকালের এ সময়ে যিকর করে রাতে তিলাওয়াত করা উচিত। না হলে এই সময়ের ওযীফার মধ্যে কিছু কুরআন তিলাওয়াত রাখা প্রয়োজন।


এখানে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয়: কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে নিয়মিত তিলাওয়াত ও নিয়মিত খতম করার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের দেশে অধিকাংশ মুসলিম কুরআন তিলাওয়াত করতে পারেন না। বেশি সূরা মুখস্থও নেই। যাদের পক্ষে সম্ভব হবে তাঁরা কুরআন তিলাওয়াত শিখে নেবেন। না পারলে মুখস্থ সূরাগুলি বারবার তিলাওয়াত করতে পারেন।

আমাদের দেশে কুরআন কারীমের নির্দিষ্ট কতিপয় সূরার ফযীলতের কথা প্রসিদ্ধ। যেমন, - সূরা ইয়াসীন, সূরা রাহমান, সূরা মুলক, ইত্যাদি। এসকল ফযীলতের মধ্যে অল্প কিছু সহীহ হাদীস পাওয়া যায়, বাকি অধিকাংশই দুর্বল, অথবা বানোয়াট, মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত কথা। সর্বাবস্থায় কুরআন তিলাওয়াতের যে সকল মর্যাদা ও ফযীলত আমরা সহীহ হাদীসের আলোকে আলোচনা করেছি সেসকল ফযীলত ও সাওয়াব এসকল সূরা বা কুরআনের যে কোনো আয়াত পাঠে অর্জিত হবে। যেসকল যাকির এ ধরনের কিছু সূরা মুখস্থ করেছেন তাঁরা এ সময়ে, সকালে অথবা বিকালে অথবা যে কোনো অবসর সময়ে এ সকল মুখস্থ সূরা ওযীফা হিসাবে পাঠ করতে পারেন। তবে এর পাশাপাশি নিয়মিত কিছু পরিমাণ কুরআন দেখে তিলাওয়াত করা ও নিয়মিত কুরআন খতম করার দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে।


(গ) ওয়ায, আলোচনা, ইত্যাদি

উপরের দ্বিতীয় হাদীসে আমরা দেখেছি যে, সকালের এই সময়ে ওয়াজের যিকরকেও রাসূলুল্লাহ (সা.) উৎসাহ দিয়েছেন। যাকিরগণের জন্য সুযোগ থাকলে এই মুবারক সময়ে মাঝে মাঝে আল্লাহ ও তাঁর মহান রাসূলের (সা.) মহব্বত ও ঈমান বৃদ্ধিকারী, কুরআন সুন্নাহ নির্ভর ওয়ায ও আলোচনার ব্যবস্থা করতে পারেন। আল্লাহর জন্য ক্রন্দন, তাওবা ইত্যাদির জন্য এ সকল আলোচনার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যিকরের মাজলিস অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।


‘সালাতুদ দোহা’ বা চাশতের সালাত

‘দোহা’ (ﺍﻟﻀـﺤﻰ) আরবী শব্দ। বাংলায় সাধারণত ‘যোহা’ উচ্চারণ করা হয়। এর অর্থ পূর্বাহ্ন বা দিনের প্রথম অংশ (forenoon)। ফারসী ভাষায় একে চাশত বলা হয়। সূর্যোদয়ের পর থেকে মধ্যাহ্ন বা দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত সময়কে আরবীতে দোহা বা যোহা বলা হয়।


সূর্য উদয়ের সময় সালাত আদায় করা নিষিদ্ধ। সূর্য পরিপূর্ণ রূপে উদিত হওয়ার পরে, অর্থাৎ সূর্যোদয়ের মুহূর্ত থেকে প্রায় ২৫ মিনিট পরে দোহা বা চাশতের সালাতের সময় শুরু। এই সময় থেকে শুরু করে দ্বিপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের মধ্যে যে কোনো সময়ে এই সালাত আদায় করা যায়। ‘দোহা’র সালাত দুই রাক’আত থেকে বার রাক’আত পর্যন্ত আদায় করা যায়। তাহাজ্জুদ সালাতের পরে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাসনূন নফল সালাত দোহার সালাত। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে এই সালাতকে ‘সালাতুল আওয়াবীন’ বা ‘আল্লাহওয়ালাগণের সালাত’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। আমাদের দেশে এই সালাত ‘ইশরাকের সালাত’ বা ‘সূর্যোদয়ের সালাত’ বলে পরিচিত। অনেকে সূর্যোদয়ের পরের সালাতকে ‘ইশরাকের সালাত’ এবং পরবর্তী সময়ের সালাতকে ‘দোহা’ বা ‘চাশতের সালাত’ বলেন। হাদীস শরীফে ‘সালাতুদ দোহা’ বা ‘দোহার সালাত’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে ; “ইশরাকের সালাত” শব্দটি হাদীসে পাওয়া যায় না। এছাড়া হাদীসে ইশরাক ও দোহার মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য করা হয়নি। সূর্যোদয় থেকে দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত যে কোনো সময় নফল সালাত আদায় করলে তা ‘সালাতুদ দোহা’ বা দোহার সালাত বলে গণ্য হবে।


যোহর, আসর, মাগরিব ও ইশা’র সালাতের মধ্যবর্তী সময় সীমিত। এক দুই ঘণ্টার বেশি নয়। কিন্তু ইশা ও ফজর এবং ফজর ও যোহর সালাতের মধ্যবর্তী সময় কিছুটা দীর্ঘ, প্রায় ৭/৮ ঘণ্টার ব্যবধান। এজন্য এই দুই সময়ে বিশেষভাবে নফল সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর যিকরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন মুমিনের হৃদয় বেশি সময় যিকর থেকে দূরে না থাকে। এই দুই সময়ের সালাত- ‘দোহার সালাত’ ও ‘তাহাজ্জুদ বা রাতের সালাত’। এই দুই প্রকার সালাতের বিশেষ গুরুত্ব, মর্যাদা ও সাওয়াবের বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[3]


আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

من صلى الصبح في جماعة ثم قعد يذكر الله حتي تطلع الشمس ثم صلى ركعتين كانت له كأجر حجة وعمرة ... تامة تامة تامة


“যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামা’আতে আদায় করে বসে বসে আল্লাহর যিকর করবে সূর্যোদয় পর্যন্ত, এরপর দুই রাক’আত সালাত আদায় করবে, সে একটি হজ্ব ও একটি ওমরার সাওয়াব অর্জন করবে: পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ (হজ্ব ও ওমরার সাওয়াব অর্জন করবে।)” হাদীসটি হাসান বা গ্রহণযোগ্য।[4]


আবু উমামমাহ ও উতবাহ ইবনু আবদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

من صلى صلاة الصبح في جماعة ثم ثبت حتى يسبح الله سبحة الضحى كان له كأجر حاج ومعتمر تاما له حجة وعمرته


“যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাতে আদায় করে বসে থাকবে দোহার (চাশতের) সালাত আদায় করা পর্যন্ত, সে একটি পূর্ণ হজ্ব ও একটি পূর্ণ ওমরার মতো সাওয়াব পাবে।” হাদীসটিকে মুনযিরী ও আলবানী হাসান বলেছেন।[5]


এভাবে বসতে না পারলেও দোহার সালাত পৃথকভাবে আদায়ের জন্য হাদীসে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে এবং অশেষ সাওয়াবের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে মাঝে মাঝে দোহার (চাশতের) সালাত আদায় করতেন। যে কোনো মুসলিম, ফজরের জামাতের পরে যিকর করুন বা না করুন, সূর্যোদয়ের পর থেকে দ্বি-প্রহরের মধ্যে দু্ই/চার রাক’আত দোহার সালাত আদায় করলেই বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত অশেষ সাওয়াব ও বরকতের আশা করতে পারবেন।

আমরা জানি যে, যাবতীয় সুন্নাত-নফল সালাত ঘরে আদায় করা উত্তম। তবে দোহার সালাতের ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম, তা মসজিদে আদায় করা ভালো বা ঘরে আদায় করার মতো একই ফযীলতের। যিনি ফজরের পরে যিকরে লিপ্ত থাকবেন তিনি মসজিদেই দোহার সালাত পরবেন।

দোহা বা চাশতের সালাতের ফযীলতের বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া অনেক যয়ীফ হাদীসও এ বিষয়ে রয়েছে। এখানে কয়েকটি সহীহ হাদীস উল্লেখ করছি। এক হাদীসে আবূ যার গিফারী (রাঃ) বলেন,

أوصاني خليلي بثلاث لست بتاركهن أن لا أنام إلا على وتر، وأن لا أدع ركعتي الضحى فإنها صلاة الأوابين، وصيام ثلاثة أيام من كل شهر


আমার প্রিয়তম বন্ধু (রাসূলুল্লাহ (সা.)) আমাকে তিনটি বিষয়ের উপদেশ দিয়েছেন যেগুলি আমি কখনোই পরিত্যাগ করি না। (১) ঘুমানোর আগে বিতর-এর সালাত আদায় করতে, (২) দুই রাক‘আত যোহার বা চাশতের সালাত কখনো পরিত্যাগ না করতে; কারণ তা সালাতুল আওয়াবীন (আল্লাহওয়ালা তওবাকারীগণের সালাত) এবং (৩) প্রতি মাসে তিন দিন সিয়াম পালন করতে।[6]

আবু হুরাইরা (রাঃ) এবং আবু দারদা (রাঃ) একইভাবে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁদেরকে উপরের তিনটি কাজের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন এবং তিনি জীবনে তা পরিত্যাগ করবেন না।[7]


আবু যার (রাঃ) বলেন, নবীয়ে আকরাম (সা.) বলেছেন, মানুষের দেহের প্রত্যেক জোড়া ও গিটের জন্য (শুকরিয়াস্বরূপ) প্রতিদিন সকালে দান করা তাঁর জন্য আবশ্যকীয় দায়িত্ব। ... দুই রাক’আত দোহার সালাত আদায় করলে এই দানের দায়িত্ব পালিত হয়ে যাবে।”[8]

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি বাহিনী প্রেরণ করেন, তারা খুব দ্রুত অনেক যুদ্ধলব্ধ মালামাল নিয়ে ফিরে আসে। মানুষেরা এদের অতি অল্প সময়ে এত বেশি সম্পদ লাভের বিষয়ে আলোচনা করতে লাগল। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ

أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى أَقْرَبَ مِنْهُ مَغْزًى ، وَأَكْثَرَ غَنِيمَةً ، وَأَوْشَكَ رَجْعَةً ؟ مَنْ تَوَضَّأَ ، ثُمَّ غَدَا إِلَى الْمَسْجِدِ لِسُبْحَةِ الضُّحَى ، فَهُوَ أَقْرَبُ مَغْزًى ، وَأَكْثَرُ غَنِيمَةً ، وَأَوْشَكُ رَجْعَةً


“আমি কি তোমাদেরকে এর চেয়েও নিকটবর্তী, বেশি সম্পদ লাভের ও দ্রুত প্রত্যাবর্তনের অভিযানের কথা জানিয়ে দেব না? যে ব্যক্তি ওযু করল, এরপর দোহার সালাত আদায় করতে মসজিদে গমণ করল সে ব্যক্তির অভিযান অধিকতর নিকটবর্তী, লব্ধ সম্পদ বেশি এবং ফিরেও আসল তাড়াতাড়ি।” হাদীসটি সহীহ।[9]


অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, অনুরূপ একটি ঘটনায় যখন মানুষেরা এত অল্প সময়ে ও এত সহজে এত বেশি যুদ্ধলব্ধ সম্পদ লাভের বিষয়ে বলাবলি করতে লাগল, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: “এর চেয়েও দ্রুত ও বেশি লাভ ঐ ব্যক্তির যে, সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে ওযু করল, এরপর মসজিদে যেয়ে ফজরের সালাত আদায় করল এবং তারপর দোহার সালাত আদায় করল, - সেই ব্যক্তি এই অভিযানকারীগণের চেয়ে কম সময়ে বেশি সম্পদ লাভ করে ফিরে আসল।২[10]

উকবা ইবনু আমির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেন:

يا ابن آدم اكفني أول النهار بأربع ركعات أكفك بهن آخر يومك


“হে আদম সন্তান, তুমি তোমার দিনের প্রথমভাগে চার রাক’আত সালাত আমাকে প্রদান কর, দিনের শেষভাগ পর্যন্ত তোমার জন্য আমার কাছে তাই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে।” হাদীসটি সহীহ।[11]

এই একই অর্থে আরো তিনটি সহীহ হাদীস আবু দারদা, আবু যার ও মুররা তায়েফী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে।[12]


আবু দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

من صلى الضحى ركعتين لم يكتب من الغافلين ومن صلى أربعا كتب من العابدين ومن صلى ستا كفى ذلك اليوم ومن صلى ثمانيا كتب من القانتين ومن صلى ثنتي عشرة بني الله له بيتا في الجنة وما من يوم ولا ليلة الا لله من يمن به على عباده وصدقة وما من الله على أحد من عباده أفضل من أن يلهمه ذكره


“যে ব্যক্তি দোহার সালাত দুই রাক’আত আদায় করল সে গাফিল বা অমনোযোগী বলে গণ্য হবে না। আর যে চার রাক’আত আদায় করল সে আবিদ বা বেশি বেশি ইবাদতকারী বলে গণ্য হলো। আর যে ছয় রাক’আত আদায় করল তার ঐ দিনের জন্য আর কিছু দরকার হবে না। আর যে ব্যক্তি আট রাক’আত আদায় করল, তাকে আল্লাহ ‘কানিতীন’ (উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ওলী) বান্দাগণের মধ্যে লিখে নিলেন। আর যে ১২ রাকা’আত আদায় করল আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে বাড়ি বানিয়ে রাখলেন। প্রতি দিন প্রতি রাতেই আল্লাহ তাঁর বান্দাগণকে কিছু বিশেষ দয়া এবং বিশেষ অনুদান প্রদান করেন। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাগণকে যতপ্রকার দয়া ও অনুদান প্রদান করেছেন তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ যে, তিনি বান্দাকে তাঁর যিকর করার প্রেরণা ও তাওফীক প্রদান করবেন।” হাদীসটি হাসান বা গ্রহণযোগ্য।[13]


আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

لا يحافظ على صلاة الضحى إلا أواب قال وهي صلاة الأوابين

“একমাত্র ‘আউয়াব’ [আওয়াবীন] বা বেশি বেশি আল্লাহর যিকরকারী ও তাওবাকারী আল্লাহর বিশেষ ওলী ছাড়া কেউ দোহার সালাত নিয়মিত পালন করে না। এই সালাত ‘সালাতুল আউয়াবীন’ বা আউয়াবীনের সালাত।” হাদীসটি হাসান।আল্লাহ তাবারাকা ওতা‘আলা আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টি প্রাপ্ত ‘আওয়াবীন’ বা প্রিয় যাকিরগণের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। আমীন!

[1] মুসনাদ আহমাদ ২/২৬১, তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ৮/২৬০, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১৯০।

[2] ইবনু রাজাব হাম্বালী, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ. ৫৪৭।

[3] ইবনু রাজাব হাম্বালী, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ. ৫৪৬।

[4] তিরমিযী ২/৪৮১, নং ৫৮৬, সহীহুত তারগীব ১/২৬০।

[5] সহীহুত তারগীব ১/২৬১।

[6] সহীহ ইবনু খুযাইমাহ ২/২৩৭। দেখুনঃ সহীহ মুসলিম ১/৪৯৯।

[7] সহীহ বুখারী ১/৩৯৫, নং ১১২৪, ২/৬৯৯, নং ১৮৮০, সহীহ মুসলিম ১/৪৯৯, নং ৭২১, ৭২২, সহীহুত তারগীব ১/৩৪৮।

[8] সহীহ মুসলিম ১/৪৯৮, নং ৭২০।

[9] মুসনাদে আহমাদ ২/১৭৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৩৫, সহীহুত তারগীব ১/৩৪৯।

[10] হাদিসটি সহীহ। সহীহুত তারগীব ১/৩৪৯-৩৫০।

[11] মুসনাদে আহমাদ ৪/১৫৩, সহীহুত তারগীব ১/৩৫০।

[12] সহীহুত তারগীব ১/৩৫০।

[13] মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৩৭, সহীহুত তারগীব ১/৩৫১।