রাহে বেলায়াত তৃতীয় অধ্যায় - দৈনন্দিন যিকর ওযীফা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ৮. সালাতই সর্বশ্রেষ্ঠ যিকর - (ক) সানা বা শুরুর যিকর

৮. সালাতই সর্বশ্রেষ্ঠ যিকর

মুমিন কিভাবে সারাদিন (২৪ ঘণ্টা) তাঁর মহান প্রভুর যিকর করবেন তা আমরা আলোচনা করছি। ওযু, আযান ইত্যাদির পরেই সালাত। সালাতই মুমিনের জীবনের শ্রেষ্ঠতম ও মহোত্তম যিকর। ইতঃপূর্বে আমরা বিভিন্ন স্থানে বিষয়টি আলোচনা করেছি। প্রত্যেক মুমিনের প্রধান দায়িত্ব সালাতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল দু‘আ-মুনাজাত, যিকর ও তিলাওয়াত বিশুদ্ধ উচ্চারণে, অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে যথাসম্ভব বিনিয়, মনোযোগ, আবেগ ও আন্তরিকতার সাথে আদায় করা। আমি এখানে সংক্ষেপে সালাতের মধ্যকার কিছু যিকরের আলোচনা করছিঃ


(ক) সানা বা শুরুর যিকর

সালাতের শুরুতে তাকবীরে তাহরীমার পরেই যে দু‘আ বা যিকর পাঠ করা হয় তাকে আমরা সাধারণত ‘সানা’ বলি। এ সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন আবেগময় মর্মস্পর্শী দু‘আ ও যিকর পাঠ করতেন। এগুলির মধ্য থেকে একটি মাত্র দু‘আ আমরা সানা হিসাবে পাঠ করি। হানাফী মাযহাবের ইমামগণ ফরয সালাতের ক্ষেত্রে এই ‘সানা’ ও দ্বিতীয় আরেকটি দু‘আ পাঠ করতে বলেছেন। সুন্নাত-নফল সালাতের ক্ষেত্রে সকল মাসনূন ‘সানা’ পাঠ করা যায়। এ সকল মাসনূন সানা বা শুরুর দু‘আ অর্থসহ মুখস্ত করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দু’আ পাঠ করলে সালাতের মনোযোগ, বিনয় ও আন্তরিকতা বহাল থাকে। নইলে মুসল্লী অভ্যস্তভাবে খেয়াল না করেই কখন সানা পড়ে শেষ করেন তা টেরও পান না। এখানে সানার তিনটি দু‘আ লিখছিঃ


যিকর নং ৪৬ : সানার যিকর-১

سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ. تَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالَى جَدُّكَ. وَلاَ إِلهَ غَيْرُكَ


উচ্চারণঃ সুব‘হা-নাকাল্লা-হুম্মা, ওয়া বি‘হামদিকা, ওয়া তাবা-রাকাসমুকা, ওয়া তা‘আ-লা- জাদ্দুকা, ওয়া লা- ইলা-হা গাইরুকা।

অর্থঃ “আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, হে আল্লাহ, এবং আপনার প্রশংসাসহ। আর মহাবরকতময় আপনার নাম, মহা-উন্নত আপনার মর্যাদা। আর কোনো মা’বুদ নেই আপনি ছাড়া।”

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাত শুরু করে এই তাসবীহ পাঠ করতেন।[1]

যিকর নং ৪৭ : সানার যিকর-২

আলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাতের শুরুতে বলতেন :

وجهت وجهي للذي فطر السموات والأرض حنيفاً وما أنا من المشركين، إن صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العالمين لا شريك له، وبذلك أمرت وأنا من المسلمين، اللهم أنت الملك لا إله إلا أنت، أنت ربي وأنا عبدك، ظلمت نفسي واعترفت بذنبي فاغفر لي ذنوبي جميعاً إنه لا يغفر الذنوب إلا أنت، واهدني لأحسن الأخلاق لا يهدي لأحسنها إلا أنت، واصرف عني سيئها لا يصرف عني سيئها إلا أنت، لبيك وسعديك والخير كله في يديك، والشر ليس إليك، أنا بك وإليك، تباركت وتعاليت، أستغفرك وأتوب إليك


উচ্চারণঃ ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাযী ফাতবারাস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদা ‘হানীফাও ওয়া মা- আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না স্বালা-তী ওয়া নুসূকী ওয়া মাহইয়া-ইয়া ওয়া মামা-তী লিল্লা-হি রাব্বিল ‘আলামীন। লা- শারীকা লাহু, ওয়া বিযা-লিকা উমিরতু, ওয়া আনা মিনাল মুসলিমীন। আল্লা-হুম্মা, আনতা রাব্বী, ওয়া আনা ‘আবদুকা। যালামতু নাফসী, ওয়া‘অ-তারাফতু বিযানবী, ফাগবফিরলী যুনূবী জামিয়ান; ইন্নাহু লা- ইয়াগবফিরুয যুনূবা ইল্লা-আনতা। ওয়াহদিনী লিআহসানিল আখলা-ক; লা- ইয়াহদী লিআহসানিহা- ইল্লা- আনতা। ওয়াসরিফ ‘আন্নী সাইয়িআহা- লা- ইয়াসরিফু ‘আন্নী সাইয়িআহা- ইল্লা- আনতা। লাব্বাইকা ওয়া সা‘অ্দাইকা। ওয়াল খাইরু কুল্লুহু ফী ইয়াদাইকা। ওয়াশ-শাররু লাইসা ইলাইকা। আনা বিকা ওয়া ইলাইকা। তাবা-রাকতা ওয়া তা‘আ-লাইতা। আস্তাগবফিরুকা ওয়া আতূবু ইলাইকা।

অর্থঃ “আমি সুদৃঢ়ভাবে আমার মুখমণ্ডল নিবদ্ধ করেছি তাঁর দিকে যিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন এবং আমি শিরকে লিপ্ত মানুষদের অন্তর্ভুক্ত নই। নিশ্চয় আমার সালাত, আমার উৎসর্গ উপাসনা, আমার জীবন ও আমার মরণ আল্লাহর জন্যই, তিনি মহাবিশ্বের প্রতিপালক প্রভু। তাঁর কোনো শরীক নেই। এবং এই জন্যই আমাকে আদেশ করা হয়েছে। এবং আমি আত্মসমর্পণকারীগণের অন্তর্ভুক্ত। হে আল্লাহ, আপনিই সম্রাট। আপনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই। আপনি আমার প্রভু এবং আমি আপনার দাস। আমি অত্যাচার করেছি আমার আত্মার উপর এবং আমি আমার পাপ স্বীকার করছি। অতএব আপনি আমার সকল পাপ ক্ষমা করে দিন। নিশ্চয় আপনি ছাড়া কেউ পাপ ক্ষমা করতে পারে না। আর আপনি পরিচালিত করুন আমাকে উত্তম আচরণে পথে, আপনি ছাড়া কেউ উত্তম আচরণের পথে পরিচালিত করতে পারে না। আর আপনি আমাকে খারাপ আচরণ থেকে দূরে রাখুন, আপনি ছাড়া আর কেউ খারাপ আচরণ থেকে দূরে রাখতে পারে না। আপনার ডাকে আমি সাড়া প্রদান করছি, আমি সানন্দে সাড়া প্রদান করছি। সকল কল্যাণ আপনার হাতে এবং অকল্যাণ আপনার দিকে নয়। আমি আপনারই সাহায্যে ও আপনারই দিকে। মহা বরকতময় আপনি এবং সুমহান আপনি। আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনারই দিকে প্রত্যাবর্তন করছি (তাওবা করছি)।”[2]

হানাফী মযহাবের ইমাম ও ফকীহগণ ফরয সালাতের সানা এই দুটির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উত্তম বলে মতপ্রকাশ করেছেন। তবে হানাফী ফিকহের অধিকাংশ গ্রন্থে “আনা মিনাল মুসলিমীন” পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম আবু ইউসূফ (রহঃ) দুটি সানা একত্রে প্রত্যেক সালাতের শুরুতে পাঠ করা উত্তম ও মুসতাহাব বলে উল্লেখ করেছেন।[3]


জায়নামাযের দু‘আ খেলাফে সুন্নাত

আমাদের দেশে দ্বিতীয় সানাটি জায়নামাযের দু‘আ বলে অতি প্রচলিত। সালাত শুরু করার আগে সালাতে বা জায়নামাযে বা সালাতের স্থানে দাঁড়িয়ে এই দু‘আটি পাঠ করার রীতি সুন্নাত বিরোধী। রাসূলুল্লাহ (সা.) সেটা তাকবীরে তাহরীমার পরে পাঠ করেছেন। একদিনও তিনি তাকবীরে তাহরীমার আগে তা পাঠ করেননি। আমাদের ইমামগণও তাকবীরে তাহরীমার পরে পাঠ করা সুন্নাত বলেছেন। অথচ আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত ও ইমামগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে মনগড়াভাবে এই দু‘আটিকে তাকবীরে তাহরীমার আগেই পড়ে নিচ্ছি।


পরবর্তী যুগের কোনো কোনো ফকীহ মনগড়াভাবে এই দু‘আটিকে তাকবীরে তাহরীমার আগে পড়া যাবে বলে মত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, এই দু‘আর অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে পাঠ করলে সালাতের মধ্যে ‘আল্লাহর জন্যই সালাত পড়া’-এর দৃঢ় ইচ্ছা আরো দৃঢ়তর হয়। এইভাবে বানোয়াট যুক্তিতর্ক দিয়ে যদি আমরা সালাতের জন্য খেলাফে সুন্নাত রীতিনীতি তৈরি করতে থাকি তাহলে একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পদ্ধতির সালাত অপরিচিত হয়ে যাবে।


রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাতের মধ্যে শেষ বৈঠকে সালাত বা দরুদ পাঠের রীতি শিক্ষা দিয়েছেন। এখন আমরা কি সালাত কবুল হবে যুক্তি দিয়ে তা বাদ দিয়ে সালাতের তাকবীরে তাহরীমার আগে দরুদ পাঠের রীতি চালু করব? রাসূলুল্লাহ (সা.) চোখ মেলে সালাত পড়ার রীতি চালু করেছেন। আমরা কি মনোযোগ বৃদ্ধির যুক্তিতে চোখবুজে সালাতের রীতি চালু করব?

কখন কোন্ দু‘আ পড়লে সবচেয়ে বেশি ভালো হবে তা তিনিই জানতেন এবং শিখিয়েছেন। আমাদের দায়িত্ব অবিকল তাঁর অনুসরণ করা। আল্লাহ আমাদের সুন্নাতের মধ্যে তৃপ্ত থাকার তাওফীক দান করুন ; আমীন।


যিকর নং ৪৮: সানার যিকর-৩

আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাতে দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমার পরে কেরা’আত (সূরা পাঠ) শুরু করার আগে অল্প সময় চুপ করে থাকতেন। তখন আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবনি হোক, আপনি তাকবীরে তাহরীমা ও সূরা পাঠের মধ্যবর্তী সময়ে নীরব থাকেন, এ সময়ে আপনি কী বলেন? তিনি বললেন, আমি এ সময়ে বলিঃ

اللَّهُمَّ بَاعِدْ بَيْنِي وَبَيْنَ خَطَايَايَ كَمَا بَاعَدْتَ بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ، اللَّهُمَّ نَقِّنِي مِنْ خَطَايَايَ كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الأَبْيَضُ مِنْ الدَّنَسِ، اللَّهُمَّ اغْسِلْنِي مِنْ خَطَايَايَ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ


উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা, বা-‘ইদ বাইনী ওয়া বাইনা খাত্বা-ইয়া-ইয়া কামা- বা-‘আদতা বাইনাল মাশরিক্বি ওয়াল মাগরিব। আল্লা-হুম্মা, নাক্কিনী মিনাল খাতা-ইয়া- কামা- ইউনাক্কাস সাওবুল আব্ইয়াদু মিনাদ দানাস। আল্লা-হুম্মাগসিল খাতা-ইয়া-ইয়া বিলমা-ই ওয়াস সালজি ওয়াল বারাদ।

অর্থঃ “হে আল্লাহ, আপনি দূরত্ব সৃষ্টি করে দিন আমার ও আমার পাপের মধ্যে যেমন দূরত্ব আপনি রেখেছেন পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে (আমাকে সকল প্রকার পাপ থেকে শত যোজন দূরে থাকার তাওফীক প্রদান করুন)। হে আল্লাহ, আপনি আমাকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করুন পাপ থেকে, যেমনভাবে পরিচছনণ করা হয় ধবধবে সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে। হে আল্লাহ আপনি ধৌত করুন আমার পাপরাশী পানি, বরফ এবং শিল দ্বারা (আমার হৃদয়কে পাপমুক্তি ও অনন্ত প্রশান্তি প্রদান করুন)।”[4]

[1] সহীহ ইবনু খুযাইমাহ ১/২৩৯, মুসতাদরাক হাকিম ১/৩৬০, ৩৬১, ৬৪৫, সুনানুত তিরমিযী ২/১০, ১১, ৩৪৭, সুনানু আবী দাউদ ১/২০৬।

[2] সহীহ মুসলিম ১/৫৩৪-৫৩৫, নং ৭৭১।

[3] ইমাম তাহাবী, শারহু মা’নীল আসার ১/১৯৭-১৯৯, সারাখসী, আল-মাবসূত ১/১২-১৩, আল-কাসানী, বাদাইউস সানাই ১/২০২।

[4] সহীহ বুখারী ১/২৫৯, নং ৭১১, সহীহ মুসলিম ১/৪১৯, নং ৫৯৮।