মুমিন তার সকল কর্ম কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করবেন। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে দেখানোর জন্য বা কারো নিকট থেকে প্রশংসা, সম্মান বা পুরস্কার লাভের জন্য কর্ম করাকে ‘রিয়া’ বলা হয়। বাংলায় আমরা একে ‘প্রদর্শনেচ্ছা’ বলতে পারি। মুমিনের সকল ইবাদত ধ্বংস করার ও তাকে জাহান্নামী বানানোর জন্য শয়তানের অন্যতম ফাঁদ এই ‘রিয়া’। কুরআন ও হাদীসে রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে তাদের মধ্যে থাকবে একজন বড় আলিম, একজন প্রসিদ্ধ শহীদ ও একজন বড় দাতা। তারা আজীবন আল্লাহর ইবাদত বন্দেগিতে কাটালেও রিয়ার কারণে তারা ধ্বংসগ্রস্ত হয়।[1]
বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) রিয়াকে ‘শিরক আসগার’ বা ছোট শিরক বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ বান্দা আল্লাহর জন্য ইবাদত করলেও অন্য সৃষ্টি থেকেও সেজন্য কিছু ‘পুরস্কার’ বা প্রশংসা আশা করে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করে। এই শিরকের কারণে মুসলিম কাফির বলে গণ্য না হলেও তার ইবাদত কবুল হবে না। এক হাদীসে আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ
ألا أخبركم بما هو أخوف عليكم عندي من المسيح الدجال فقلنا بلى يا رسول الله قال الشرك الخفي أن يقوم الرجل فيصلي فيزيد صلاته لما يرى من نظر رجل
দাজ্জালের চেয়েও যে বিষয় আমি তোমাদের জন্য বেশি ভয় পাই সে বিষয়টি কি তোমাদেরকে বলব না? আমরা বললামঃ, হ্যাঁ, অবশ্যই বলুন। তিনি বলেন, বিষয়টি গোপন শির্ক। গোপন শির্ক এই যে, একজন সালাতে দাঁড়াবে এরপর যখন দেখবে যে মানুষ তার দিকে তাকাচ্ছে তখন সে সালাত সুন্দর করবে।[2]
রিয়া থেকে আত্মরক্ষার জন্য মুমিনের চেষ্টা করতে হবে যথাসম্ভব সকল নফল ইবাদত গোপনে করা। তবে যে ইবাদত প্রকাশ্যে করাই সুন্নাত-সম্মত তা প্রকাশ্যেই করতে হবে। রিয়ার ভয়ে কোনো নিয়মিত ইবাদত বা প্রকাশ্যে করণীয় ইবাদত বাদ দেওয়া যাবে না। রিয়ার অনুভূতি মন থেকে দূর করতে চেষ্টা করতে হবে। কখনো এসে গেলে বারংবার তাওবা করতে হবে এবং আল্লাহর কাছে তাওফীক প্রার্থনা করতে হবে।
রিয়ার অন্যতম কারণ সমাজের মানুষদের কাছে সম্মান, মর্যাদা বা প্রশংসার আশা। আমাদের খুব ভালভাবে বুঝতে হবে যে, দুনিয়ায় কোনো মানুষই কিছু দিতে পারে না। সকলেই আমার মতই অক্ষম। যে মানুষকে দেখানো জন্য, শোনানোর জন্য, যার প্রশংসা বা পুরস্কার লাভের জন্য আমি লালায়িত হচ্ছি সে আমার মতই অসহায় মানুষ। আমার কর্ম দেখে সে প্রশংসা নাও করতে পারে। হয়ত তার প্রশংসা শোনার আগেই আমার মৃত্যু হবে। অথবা প্রশংসা করার আগেই তার মৃত্যু হবে। আর সে প্রশংসা বা সম্মান করলেও আমার কিছুই লাভ হবে না। আমার মালিক ও পালনকর্তার পুরস্কারই আমার জন্য যথেষ্ট। তিনি অল্পতেই খুশি হন ও বেশি পুরস্কার দেন। তিনি দিলে কেউ ঠেকাতে পারে না। আর তিনি না দিলে কেউ দিতে পারে না। কা’ব ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
مَا ذِئْبَانِ جَائِعَانِ أُرْسِلَا فِي غَنَمٍ، بِأَفْسَدَ لَهَا مِنْ حِرْصِ الْمَرْءِ عَلَى الْمَالِ وَالشَّرَفِ لِدِينِهِ
“দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়েকে একটি মেষপালের মধ্যে ছেড়ে দিলে নেকড়েদুটি মেশপালের যে ক্ষতি করবে, সম্পদ ও সম্মানের লোভ মানুষের দীনের তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করে।” ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান-সহীহ বলেছেন।[3]
সম্মানিত পাঠক, দুনিয়ার সম্মান, মর্যাদা ও প্রতিপত্তি একটি কঠিন বোঝা ও ফিতনা ছাড়া কিছুই নয়। সম্মান ও প্রতিপত্তিহীন মানুষের অন্তুর বিনয় ও সরলতায় ভরা থাকে। ফলে আল্লাহর বেলায়াত অর্জন তাদের জন্য খুবই সহজ হয়। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অধিকাংশই এরূপ সাধারণ মানুষ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ
كم من أشعث أغبر ذي طمرين لا يؤبه به لو أقسم على الله لأبره
“অনেক মানুষ এমন আছেন যার মাথার চুল এলোমেলো, পদযুগল ধুলিধসরিত, পরণের কাপড় অতি-সাধারণ এবং সমাজে তাদেরকে কোনো গুরত্ব দেওয়া হয় না, কিন্তু আল্লাহর নিকট তার মর্যাদা এত বেশি যে, যদি তিনি শপথ করে আল্লাহর কাছে কিছু দাবি করেন তবে আল্লাহ তা পূরণ করেন।”[4]
[2] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১৪০৬, আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৮৯। হাদিসটি হাসান।
[3] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৫৮৮।
[4] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৬৯২। তিরমিযী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।