শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া ৫ - আল্লাহ তাআলার জন্য ইচ্ছা বিশেষণ সাব্যস্ত করা ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী] ৪ টি
আল্লাহ তাআলার জন্য ইচ্ছা বিশেষণ সাব্যস্ত করা

৫- إثبات المشيئة والإرادة لله سبحانه وتعالى

৫- আল্লাহ তাআলার জন্য ইচ্ছা বিশেষণ সাব্যস্ত করা:

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿وَلَوْلَا إِذْ دَخَلْتَ جَنَّتَكَ قُلْتَ مَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ﴾

‘‘তুমি যখন তোমার বাগানে প্রবেশ করলে তখন মাশা-আল্লাহ (আললাহ যা চেয়েছেন তাই হয়েছে) বললে না কেন? আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত কোন শক্তি নেই’’।[1] (সূরা কাহাফঃ ৩৯) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

﴿وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلَ الَّذِينَ مِن بَعْدِهِم مِّن بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَلَٰكِنِ اخْتَلَفُوا فَمِنْهُم مَّنْ آمَنَ وَمِنْهُم مَّن كَفَرَ ۚ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ﴾

‘‘আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন তাহলে রাসূলদের আগমণের পর এবং তাদের কাছে উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ আসার পর তারা কখনো পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হতোনা। কিন্তু তারা পরস্পর মতবিরোধ করলো, তারপর তাদের মধ্য থেকে কেউ ঈমান আনলো আর কেউ কুফরীর পথ অবলম্বন করলো৷ আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা কখনো যুদ্ধে লিপ্ত হতোনা, কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তাই করেন’’। (সূরা বাকারাঃ ২৫৩) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

﴿أُحِلَّتْ لَكُم بَهِيمَةُ الْأَنْعَامِ إِلَّا مَا يُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ غَيْرَ مُحِلِّي الصَّيْدِ وَأَنتُمْ حُرُمٌ ۗ إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ مَا يُرِيدُ﴾

‘‘তোমাদের জন্য চতুষ্পদ গৃহপালিত সব পশুই হালাল করা হয়েছে। তবে সামনে যেগুলো সম্পর্কে তোমাদের জানানো হবে সেগুলো ছাড়া৷ কিন্তু ইহ্রাম অবস্থায় শিকার করা নিজেদের জন্য হালাল করে নিয়োনা৷ নিঃসন্দেহে আল্লাহ যা ইচ্ছা আদেশ করেন’’। (সূরা মায়িদাঃ ১)


ব্যাখ্যাঃ لَوْلاَ শব্দটি এখানে هلا অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ তুমি তোমার বাগানে প্রবেশ করার সময় مَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ বললেনা কেন? অর্থাৎ আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার সামনে তোমার নিজের অক্ষমতা ও অপারগতা প্রকাশ করতঃ আল্লাহর জন্য পূর্ণ ক্ষমতার স্বীকৃতি দিয়ে এই কথা বললেনা কেন যে, আল্লাহ যা চেয়েছেন, তাই হয়েছে।

কোন কোন সালাফ বলেছেন, যার কাছে কোন জিনিষ ভাল লাগে, সে যেন বলেمَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ

وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা পরস্পর যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হতো না: অর্থাৎ আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলা যদি ইচ্ছা করতেন, তারা যুদ্ধ না করুক, তাহলে তারা পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ করতনা। কেননা আল্লাহর রাজ্যে আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কিছু হওয়া অসম্ভব। আল্লাহর হুকুম প্রতিহত করার মত কেউ নেই এবং তাঁর ফয়সালা ঠেকানোরও কেউ নেই।[2]

أُحِلَّتْ لَكُم بَهِيمَةُ الْأَنْعَامِ তোমাদের জন্য চতুষ্পদ গৃহপালিত সব পশুই হালাল করা হয়েছে: এখানে মুমিনদেরকে লক্ষ্য করে এই কথা বলা হয়েছে। চতুষ্পদ গৃহপালিত পশু বলতে এখানে উট, গরু, ছাগল এবং ভেড়া উদ্দেশ্য।

إِلَّا مَا يُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ তবে সামনে যেগুলো সম্পর্কে তোমাদের জানানো হবে সেগুলো ছাড়াঃ এই বাক্যটি بَهِيمَةُ الْأَنْعَامِ থেকে মুস্তাছনা বা স্বতন্ত্র অর্থাৎ যেগুলোর আলোচনা সামনে আসছে, সেগুলোর মাংস খাওয়া তোমাদের জন্য হালাল নয়। ঐ হারাম পশুগুলো উক্ত আয়াতের সামান্য পরেই অর্থাৎ ৩নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَن تَسْتَقْسِمُوا بِالْأَزْلَامِ ۚ ذَٰلِكُمْ فِسْقٌ ۗ الْيَوْمَ يَئِسَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن دِينِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ ۚ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ۚ فَمَنِ اضْطُرَّ فِي مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِّإِثْمٍ ۙ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾

‘‘তোমাদের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছে মৃতজীব, রক্ত, শূকরের গোশ্ত, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর নামে যবেহকৃত প্রাণী এবং কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে, আহত হয়ে, উপর থেকে পড়ে গিয়ে বা ধাক্কা খেয়ে মরা অথবা কোন হিংস্র প্রাণী চিরে ফেলেছে এমন প্রাণী, তবে তোমরা জীবিত পেয়ে যাকে যবেহ করেছ সেটি ছাড়া৷ আর যা কোন বেদীমূলে (পূজার ঘরে, অলী-আওলীয়ার নামে, কবর ও মাজারের উদ্দেশ্যে) যবেহ করা হয়েছে তাও তোমাদের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও শুভ-অশুভ নির্ধারনের তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য নির্ণয় করাও তোমাদের জন্য জায়েয নয়৷ এগুলো ফাসেকী তথা আনুগত্য বহির্ভূত কাজ৷ আজ তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে কাফেররা পুরোপুরি নিরাশ হয়ে পড়েছে৷ কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় করোনা বরং আমাকে ভয় করো৷ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিয়েছি, আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করেছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে পছন্দ করে নিয়েছি (কাজেই তোমাদের উপর হালাল ও হারামের যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তা মেনে চলো৷) তবে যদি কোন ব্যক্তি ক্ষুধার জ্বালায় বাধ্য হয়ে ঐগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি জিনিষ খেয়ে নেয় গুনাহের প্রতি কোন আকর্ষণ ছাড়াই, তাহলে নিঃসন্দেহে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী’’।

غَيْرَ مُحِلِّي الصَّيْدِ وَأَنتُمْ حُرُمٌ কিন্তু ইহ্রাম বাধাঁ অবস্থায় শিকার করা নিজেদের জন্য হালাল করে নিয়োনাঃ এই বাক্যটি بَهِيمَةُ الْأَنْعَامِ থেকে আরেকটি স্বতন্ত্র বিষয়। অর্থাৎ গৃহপালিত চতুষ্পদ সব জন্তুই তোমাদের জন্য হালাল। তবে এগুলো থেকে যেগুলো বন্য, সেগুলো শিকার করে ভক্ষণ করাও হালাল। কিন্তু যখন তোমরা ইহরাম অবস্থায় থাকবে, তখন এগুলো শিকার করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। আল্লাহর বাণীঃ وأنتم حرم হাল (অবস্থা জ্ঞাপক) হিসাবে নসব বা যবরের স্থানে রয়েছে। যারা হজ্জ কিংবা উমরাহ অথবা উভয়টির ইহরাম বেঁধেছে, তাদেরকে حرم বলা হয়। ইহা محرم এর বহুবচন।

إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ مَا يُرِيدُ নিঃসন্দেহে আল্লাহ যা ইচ্ছা আদেশ করেনঃ অর্থাৎ আল্লাহ যা ইচ্ছা হালাল করেন এবং যা ইচ্ছা হারাম করেন।[3] তাঁর ইচ্ছায় ও কর্মে আপত্তি উত্থাপন করার কেউ নেই।

উপরের আয়াতগুলোতে আল্লাহর সিফাত হিসাবে ইচ্ছা, শক্তি এবং আদেশ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এগুলো আল্লাহ তাআলার অন্যতম সিফাত। আল্লাহর বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতেই এগুলো তাঁর জন্য সাব্যস্ত করা জরুরী।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿فَمَن يُرِدِ اللَّهُ أَن يَهْدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ وَمَن يُرِدْ أَن يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي السَّمَاءِ كَذَٰلِكَ يَجْعَلُ اللَّهُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ﴾

‘‘আল্লাহ যাকে সত্যপথ দেখাবার ইচ্ছা করেন তার বক্ষদেশ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন৷ আর যাকে তিনি গোমরাহীতে নিক্ষেপ করার ইচ্ছা করেন, তার বক্ষদেশ খুব সংকীর্ণ করে দেন। যাতে মনে হয় সে কষ্ট করে আকাশের দিকে উঠার চেষ্টা করছে। এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা অবিশ্বাসীদের উপর অপবিত্রতা চাপিয়ে দেন’’। (সূরা আনআমঃ ১২৫) অর্থাৎ জোর খাটিয়ে যেমন আকাশের দিকে উঠা সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি আল্লাহ যার বক্ষকে সংকীর্ণ করে দেন তার মধ্যে ঈমান ও তাওহীদের আলো ঢুকানো সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা তার বক্ষকে ইসলামের জন্য খুলে না দেয়া পর্যন্ত তাতে ঈমান ও তাওহীদ প্রবেশ করেনা।


ব্যাখ্যা: فَمَن يُرِدِ اللَّهُ أَن يَهْدِيَهُ আল্লাহ যাকে সত্যপথ দেখাবার ইচ্ছা করেনঃ অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যাকে ঈমান ও তাওহীদ কবুলের তাওফীক দেন এবং তার অন্তরকে সত্য কবুলের জন্য উপযুক্ত করেন, তার অন্তরকে উহার জন্য প্রশস্ত করে দেন।[4] منْ শব্দটি فعل مضارع কে জযমদাতা এবং ইসমে শর্ত। يُرِدْ -ফেলে মুযারেটি ফেলে শর্ত হিসাবে জযম যুক্ত। আর يشرح صدره للإسلام বাক্যটি শর্তের জবাব হিসাবে مجزوم (জযম যুক্ত)। الشرح অর্থ হচ্ছে الشق (বিদীর্ণ করা, চেরা, ফাটানো ইত্যাদি)। এর মূল অর্থ হচ্ছে التوسعة (প্রশস্ত করা)। বলা হয়ে থাকে شرحت الأمر তথা বিষয়টিকে প্রশস্ত করলাম। এই কথা আপনি ঠিক ঐ সময় বলেন, যখন আপনি তা প্রশস্ত করে বর্ণনা করেন এবং খোলাখুলি বয়ান করেন। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যাকে ঈমান ও তাওহীদ কবুলের তাওফীক দেন এবং তার অন্তরকে সত্য কবুলের জন্য উপযুক্ত করেন, তার অন্তরকে আল্লাহ তাআলা সত্য দ্বীন ইসলামের জন্য উন্মুক্ত ও প্রশস্ত করে দেন। এর ফলে সে উন্মুক্ত হৃদয়ে ইসলাম কবুল করে নেয়।

আর যাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সত্য কবুল করা হতে ফিরিয়ে রাখতে চান, তার অন্তরকে সংকীর্ণ করে দেন। ফলে তা সত্য কবুল করার জন্য উন্মুক্ত হয়না। حرجا অর্থাৎ একদম সংকীর্ণ করে দেন, যার ফলে অন্তরে ঈমান ও হেদায়াত প্রবেশের কোন রাস্তাই থাকেনা। ضيقا শব্দের অর্থকে জোরালো করার জন্য حرجا শব্দটি আনয়ন করা হয়েছে।

كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي السَّمَاءِ মনে হয় সে কষ্ট করে আকাশের দিকে উঠার চেষ্টা করছেঃ يصعد শব্দটি মূলতঃ يتصعد ছিল। تا-কে সোয়াদ দ্বারা পরিবর্তন করে সোয়াদের মধ্যে ইদগাম করা হয়েছে। অর্থাৎ যার অন্তরকে সংকীর্ণ করে দেয়া হয়েছে, তার জন্য হেদায়াত কবুল করে নেয়ার বিষয়টি ঠিক ঐ ব্যক্তির ন্যায় কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে কোন অসম্ভব কাজ সম্পাদন করার জন্য বার বার চেষ্টা করছে, কিন্তু সে তা সম্পাদন করতে পারছেনা। যেমন কেউ আকাশে উঠার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। যেই কাফেরের উপর ঈমান কবুল করে নেয়া খুব ভারী অনুভব হয়, তাকে ঐ ব্যক্তির সাথে তুলনা করা হয়েছে, যে আকাশে উঠার মত সাধ্যাতীত কাজ সম্পাদন করতে চায়।

উপরের আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য ইরাদাহ (ইচ্ছা) সাব্যস্ত হলো। কাউকে হেদায়াত করা আবার কাউকে গোমরাহ করা উভয়টিই আল্লাহর ইচ্ছাধীন। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা হেদায়াতের ইচ্ছা করেন। বিশেষ উদ্দেশ্যে আবার কারো জন্য অমোঘ বিধানগত দিক থেকে গোমরাহীরও ইচ্ছা করেন।[5] অর্থাৎ যার অন্তরে ঈমান ও হেদায়াতের প্রতি কোন আগ্রহ থাকেনা এবং যে ব্যক্তি নবী-রাসূলদের দ্বীনকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ তাআলা তাকে হেদায়াত থেকে মাহরুম করে দেন।


[1] - সূরা কাহাফের ৩২ নং থেকে ৪৩ নং আয়াতের মধ্যে আল্লাহ তাআলা মক্কাবাসী হঠকারী কাফেরদের জন্য একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। যুগে যুগে যে কোন অহংকারী, আল্লাহদ্রোহী এবং পরকালীন জীবনে অবিশ্বাসীর জন্য এটি একটি বিরাট শিক্ষণীয় ঘটনা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা আসেনি। সুতরাং কুরআন যা বলেছে, তার অতিরিক্ত কিছু যুক্ত করার কোন সুযোগ নেই। তাই আমরা ইসরাঈলী কিংবা দুর্বল বর্ণনা পরিত্যাগ করে শুধু কুরআনের আলোকে সেই ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করবো।

কুরআন বলছে, অতীতকালে দু’জন লোক ছিল। তাদের মধ্যে আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কও ছিল। তাদের একজন ছিল মুমিন এবং অন্যজন ছিল কাফের। তবে কুরআন ও হাদীছ তাদের নাম, তারা কোথায় এবং কোন সময় ছিল, তা বলেনি।

মুমিন ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার ধন-সম্পদ থেকে তেমন কিছু না দিলেও তাকে দিয়েছিলেন সর্ববৃহৎ একটি নেয়ামত। তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাসী, তাঁর ফয়সালা ও তকদীরের প্রতি সন্তুষ্ট এবং আখেরাতে আল্লাহর নেয়ামত অর্জনই ছিল তার সকল কাজ-কর্ম ও চিন্তা-চেতনার মূলকেন্দ্র বিন্দু। মূলতঃ এটি এমন সম্পদ, যা দুনিয়ার কোন মূল্য দ্বারাই মূল্যায়ন করা যায়না।

তার সেই কাফের বন্ধুটির জন্য আল্লাহ তাআলা দুনিয়াকে প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন। তার ছিল প্রচুর সম্পদ, বাগ-বাগিচা এবং সন্তান-সন্ততি। কোন মানুষকে এ সবকিছু দেয়ার পিছনে আল্লাহ তাআলার হিকমত ও ইচ্ছা হলো তিনি তাকে পরীক্ষা করতে চান। সে কি এগুলো পেয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে? না কি অকৃতজ্ঞ হয়? সে কি সীমালংঘন করে? না কি আল্লাহর আনুগত্য করে?

আল্লাহ তাআলা সেই অবিশ্বাসী লোকটিকে দু’টি বাগান দিয়েছিলেন। বাগানে ছিল আঙ্গুর, খেজুরসহ বিভিন্ন ফলমূলের বৃক্ষাদি। বাগানের মধ্যে ঝর্ণাও প্রবাহিত ছিল। আল্লাহ তাআলা এই বাগান দু’টির বর্ণনা দিয়ে বলেনঃ

﴿جَعَلْنَا لِأَحَدِهِمَا جَنَّتَيْنِ مِنْ أَعْنَابٍ وَحَفَفْنَاهُمَا بِنَخْلٍ وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمَا زَرْعًا كِلْتَا الْجَنَّتَيْنِ آتَتْ أُكُلَهَا وَلَمْ تَظْلِم مِّنْهُ شَيْئًا ۚ وَفَجَّرْنَا خِلَالَهُمَا نَهَرًا﴾

‘‘তাদের একজনকে আমি দুটি আংগুর বাগান দিয়েছিলাম এবং সেগুলোর চারদিকে খেজুর গাছের বেড়া দিয়েছিলাম আর তার মাঝখানে রেখেছিলাম কৃষি ক্ষেত৷ দুটি বাগানই ভালো ফল দান করতো এবং ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে তারা সামান্যও ত্রুটি করতোনা৷ এ বাগান দুটির মধ্যে আমি একটি নদী প্রবাহিত করেছিলাম’’। (সূরা কাহাফঃ ৩২-৩৩)

এসব কিছু পেয়ে একদিন সে তার দরিদ্র ভাইয়ের সাথে কথা প্রসংগে বললো, ‘‘আমি তোমার চেয়ে বেশী ধনশালী এবং আমার জনশক্তি তোমার চেয়ে বেশী৷ অহংকার ও গর্বের সাথে এ সব কথা বলতে বলতে সে তাকে নিয়ে বাগানে প্রবেশ করল। সে বলতে লাগলঃ এগুলো সবসময়ই আমার কাছে থাকবে, আমি মনে করিনা যে, আমার এই সম্পদগুলো কোন দিন ধ্বংস হবে। তার দাপট ও অহংকার এখানেই শেষ হলোনা; বরং সে অহংকার বশত কিয়ামতকেও অস্বীকার করে বললঃ আমি মনে করিনা যে, কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে। সে আরো বললঃ কিয়ামত যদিও সংঘটিত হয় এবং আমাকে যদি কখনো আমার রবের সামনে ফিরিয়ে নেয়া হয় তাহলে নিশ্চয়ই আমি এর চেয়েও বেশী জমকালো জায়গা পাবো৷ যদি পরকাল থেকেই থাকে তাহলে আমি সেখানে এখানকার চেয়েও বেশী সচ্ছল থাকবো। কারণ এখানে আমার সচ্ছল ও ধনাঢ্য হওয়া একথাই প্রমাণ করে যে, আমি আল্লাহর প্রিয়।

দুনিয়া পূজারী আখেরাতে অবিশ্বাসী লোকদের অবস্থা এ রকমই হয়ে থাকে। তারা দুনিয়ার ভোগসামগ্রী পেয়ে আখেরাতকে ভুলে যায়। সে মনে করে, তার সম্পদ তাকে চিরস্থায়ী করে রাখবে এবং তার ধন-সম্পদ কখনো শেষ হবেনা।

যাই হোক তার দরিদ্র সাথী কথাবার্তার মধ্যে তাকে বললো, ‘‘তুমি কি কুফরী করছো সেই সত্তার সাথে যিনি তোমাকে মাটি থেকে তারপর শুক্র থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাকে একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ বানিয়ে দাঁড় করিয়েছেন? আর আমার ব্যাপারে বলবো, আমার রব তো সেই আল্লাহই এবং আমি তার সাথে কাউকে শরীক করিনা৷

এবার দরীদ্র বন্ধু বাগান ওয়ালাকে নসীহত করতে গিয়ে বললঃ বরং তোমার উচিৎ ছিল যেই আল্লাহ তোমাকে এই সম্পদ দিয়েছেন, তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং অহংকার বর্জন করা। তোমার সম্পদ টিকিয়ে রাখার জন্য এবং তোমার রবকে খুশী করার এটিই একমাত্র উত্তম পন্থা। আর যখন তুমি নিজের বাগানে প্রবেশ করছিলে তখন একথা বলা উচিৎ ছিল, مَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ ‘‘আল্লাহ যা চান তাই হয়, তাঁর প্রদত্ত শক্তি ছাড়া আর কোনো শক্তি নেই।

এরপর মুমিন লোকটি তার সাথীকে অহংকার, সীমালংঘন ও তাকাববরী করার ভয়াবহ পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললঃ আর তুমি যদি সম্পদ ও সন্তানের দিক দিয়ে আমাকে তোমার চেয়ে কম পেয়ে থাকো, তাহলে জেনে রেখো আল্লাহ তাআলা সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান। এটি অসম্ভব নয় যে, আমার রব আমাকে তোমার বাগানের চেয়ে ভালো কিছু দেবেন এবং তোমার বাগানের উপর আকাশ থেকে এমন কোনো আপদ পাঠাবেন, যার ফলে তোমার বাগান দু’টি বৃক্ষলতাহীন প্রান্তরে পরিণত হবে৷ অথবা তোমার বাগানের নদীর পানি ভূগর্ভে নেমে যাবে এবং তুমি তাকে কোনোক্রমেই উঠাতে পারবেনা৷

পরিশেষে তার বাগানের উপর বিরাট এক বিপর্যয় চলে আসল। চতুর্দিক থেকে বিপদ এসে বাগানের সমস্ত ফল ও ফসল বিনষ্ট করল এবং সে নিজের বাগানকে লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে থাকতে দেখে নিজের নিয়োজিত পুঁজির জন্য আফসোস করতে থাকলো এবং বলতে লাগলো, ‘‘হায়! যদি আমি আমার রবের সাথে কাউকে শরীক না করতাম’’৷

এবার সে তার পূর্বোক্ত কথার জন্য অনুতপ্ত হলো। সে সময় আল্লাহ ছাড়া তাকে সাহায্য করার মতো কোনো গোষ্ঠীও ছিলনা, আর সে নিজেও এ বিপদের মুকাবেলা করতে সক্ষম ছিল না৷

[2] - অর্থাৎ রাসূলদের মাধ্যমে তাওহীদ, রেসালাত এবং শরীয়তের জ্ঞান লাভ করার পরও মানুষের মধ্যে যে কুফরী ও পাপাচার, সীমালংঘন দেখা যাচ্ছে, ও মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে এবং মতবিরোধ থেকে আরো এগিয়ে গিয়ে ব্যাপক যুদ্ধ পর্যন্ত গড়িয়েছে, এর কারণ এ ছিলনা যে, (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহ তাদেরকে তা থেকে বিরত রাখতে অক্ষম ছিলেন। পৃথিবীতে যে কুফুরী, সীমালংঘন, আল্লাহর নাফরমানী, যুলুম ও মতবিরোধ যুদ্ধ-বিগ্রহ হচ্ছে তা থেকে মানুষকে বিরত রাখার পরিপূর্ণ শক্তি আল্লাহ তাআলার রয়েছে। তিনি চাইলে নবীদের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার সাধ্য কারো ছিল না। কেউ কুফরী ও বিদ্রোহের পথে চলতে পারতোনা। আল্লাহর দুনিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টি করার ক্ষমতা কারো থাকতোনা। তবে মানুষের কাছ থেকে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি ছিনিয়ে নিয়ে তাকে আনুগত্যের পথ অবলম্বন করতে বাধ্য করা তাঁর ইচ্ছাই ছিলনা। তিনি পরীক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে মানুষকে এ পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন। তাই তাকে বিশ্বাস ও কর্মের ক্ষেত্রে নির্বাচন ও বাছাই করার স্বাধীনতা দান করার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যথায় ঈমান ও আনুগত্যের পরীক্ষা নেয়া সম্ভব নয়। নবী-রাসূলদেরকে তিনি মানুষের উপর দারোগা বানিয়ে পাঠাননি। কিন্তু মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির অপব্যবহার করেছে এবং আল্লাহর আনুগত্যের পথ বর্জন করে কুফরী ও সীমালংঘনকেই বেছে নিচ্ছে। ঐদিকে নবী-রাসূলগণ তাদেরকে জোর জবরদস্তি করে তাদেরকে ঈমান ও আনুগত্যের পথে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেননি। কারণ জোর করে আনুগত্যের পথে এনে তাদেরকে দিয়ে আনুগত্যের কাজ করিয়ে নিয়ে পুরস্কার দেয়ারও কোন অর্থ হয়না। বরং নবীদেরকে তিনি পাঠান যুক্তি প্রমাণের সাহায্যে মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথে আহবান জানাবার জন্য। সুতরাং যারা জেনেবুঝে এবং আল্লাহ প্রদত্ত ইচ্ছা শক্তিকে সঠিকভাবে পরিচালিত করে আল্লাহর পছন্দনীয় কাজে আত্মনিয়োগ করবে, তাদেরকে তিনি অফুরন্ত নেয়ামত দান করবেন। আর যারা নিজেদের ইচ্ছা ও স্বাধীনতাকে বিপথে পরিচালিত করবে, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আল্লাহ তাদেরকে পরকালে শাস্তি দিবেন।

কাজেই পৃথিবীতে যত যুলুম, পাপকাজ, মতবিরোধ ও যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছে, তার পেছনে একটি মাত্র বিষয় কাজ করেছে যে, আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি দান করেছেন। আর মানুষ স্বীয় ইচ্ছা শক্তি, বিবেক-বুদ্ধি ও স্বাধীনতা দিয়ে ভাল-মন্দের যে কোন একটি নির্বাচন করে বলেই কিয়ামতের দিন তাকে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া আল্লাহর জন্য ইনসাফপূর্ণ হবে। তিনি যদি সৎকাজে বাধ্য করে পুরস্কার দেন কিংবা অন্যায় কাজ যদি শুধু আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয় (নাউযুবিল্লাহ) এবং এতে যদি বান্দার কোন ইচ্ছা, স্বাধীনতা ও সংকল্প না থাকে, তাহলে পাপকাজ করার কারণে কাউকে শাস্তি দেয়া আল্লাহর জন্য যুলুম বলে বিবেচিত হত এবং আল্লাহর আদলের ব্যাঘাত ঘটতো। অথচ আল্লাহ তাআলা যুলুম থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।


[3] - যাতে মানুষের জন্য উপকার ও কল্যাণ রয়েছে এবং যা পবিত্র আল্লাহ তাআলা তা হালাল করেন। আর ক্ষতিকর এবং যাতে অকল্যাণ রয়েছে, তা হারাম করেন। যেমন শূকর, মৃত জন্তু ইত্যাদি মানুষের জন্য ক্ষতিকর বলেই হারাম করেছেন।

[4] - অর্থাৎ যে ব্যক্তি ঈমান ও হেদায়াতকে ভালবাসে এবং সেদিকে স্বীয় ইচ্ছাকে ধাবিত করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য ঈমানের পথ সহজ করে দেন ও তাকে সীরাতুল মুস্তাকীমের উপর চলতে সাহায্য করেন। আর যে ব্যক্তি ঈমান ও আনুগত্যের কাজকে পছন্দ করেনা, কুরআন-হাদীছের কথা যার কাছে ভাল লাগেনা এবং জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনার প্রতিও যে কর্ণপাত করেনা, আল্লাহ তাআলা তাকে সৎপথে চলার তাওফীক দেন না এবং তাকে সাহায্যও করেন না।

[5] - অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা মানুষের আগ্রহের অনুরূপ ব্যবহারই করে থাকেন। কেউ যদি কল্যাণের দিকে ঝুকে পড়ে আল্লাহ তাকে কল্যাণের দিকেই নিয়ে যান। আর যদি খারাপ পথে ধাবিত হয়, তাকে শ্বাস্তি স্বরূপ সেদিকেই নিয়ে যান।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন দরিদ্র মুসলিমদের থেকে বিমুখ হয়ে মক্কার নের্তৃস্থানীয় কাফেরদের হেদায়াতের প্রতি গুরুত্ব দিলেন, তখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে ধমক দিয়ে এই আয়াতগুলো নাযিল করেনঃ

﴿عَبَسَ وَتَوَلَّى (১) أَنْ جَاءَهُ الْأَعْمَى (২) وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّى (৩) أَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنْفَعَهُ الذِّكْرَى (৪) أَمَّا مَنِ اسْتَغْنَى (৫) فَأَنْتَ لَهُ تَصَدَّى (৬) وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكَّى (৭) وَأَمَّا مَنْ جَاءَكَ يَسْعَى (৮) وَهُوَ يَخْشَى (৯) فَأَنْتَ عَنْهُ تَلَهَّى (১০) كَلَّا إِنَّهَا تَذْكِرَةٌ (১১) فَمَنْ شَاءَ ذَكَرَهُ﴾

‘‘ভ্রুকুঁঞ্চিত করলো ও মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ সেই অন্ধ লোকটি তার কাছে এসেছে। তুমি কী জানো, হয়তো সে শুধরে যেত। অথবা উপদেশের প্রতি মনোযোগী হতো এবং উপদেশ দেয়া তার জন্য উপকারী হতো।

আর যে ব্যক্তি বেপরোয়া ভাব দেখায়। তুমি তার প্রতি মনোযোগী হও। অথচ সে যদি শুধরে না যায় তাহলে তোমার উপর এর কোন দায়িত্ব থাকেনা। আর যে নিজে তোমার কাছে দৌড়ে আসে এবং সে ভীত হচ্ছে। তার দিক থেকে তুমি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো। কখনো নয়, এটি তো একটি উপদেশ। যার ইচছা এটি গ্রহণ করবে’’। (সূরা আবাসাঃ ১-১২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

﴿إِنَّ سَعْيَكُمْ لَشَتَّىٰ فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى (৫) وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَى (৬) فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى (৭) وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى (৮) وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى (৯) فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى﴾

‘‘আসলে তোমাদের প্রচেষ্টা নানা ধরনের৷ কাজেই যে (আল্লাহর পথে) ধন সম্পদ দান করেছে এবং আল্লাহকে ভয় করেছে ও আল্লাহর নাফরমানি থেকে দূরে থেকেছে। এবং সত্য কথাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। অচিরেই তাকে আমি সহজ পথের সুযোগ-সুবিধা দেবো। অর্থাৎ তাকে আনুগত্যের কাজ করার তাওফীক দিবো এবং তার জন্য উহা সহজ করে দিবো। আর যে কৃপণতা করেছে, আল্লাহ থেকে বেপরোয়া হয়ে গেছে। এবং সত্যকে মিথ্যা গণ্য করেছে। অচিরেই তাকে আমি কঠিন পথের সন্ধান দেবো’’৷ (সূরা লাইলঃ ৫-১০) অর্থাৎ আমি তাকে কুফরী ও নাফরমানীর পথ সহজ করে দেবো। ফলে তার জন্য ঈমান ও আনুগত্যের পথে চলা দুষ্কর হয়ে যায়।

কুরআনের অনেক স্থানেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, যখন কোন ব্যক্তি ভাল ও ন্যায় পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তাআলা তার উপর অনুগ্রহ করেন এবং তাকে সেই পথে চলার তাওফীক দান করেন।

আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কুফরী ও নাফরমানীর পথে চলে, আল্লাহ তাকে তার অবস্থাতেই ছেড়ে দেন এবং এটি সেই তাকদীর অনুযায়ীই হয়ে থাকে, যা আল্লাহ তাআলা স্বীয় ইলম মোতাবেক আগেই লিখে রেখেছেন। (ইবনে কাছীর)

ইরাদাহ (ইচ্ছার) প্রকারভেদ:

আল্লাহ তাআলার إرادة ইরাদাহ (ইচ্ছা) দুই প্রকার। (১) অমোঘ বিধানগত ইচ্ছা। অর্থাৎ ভাল-মন্দ এমনকি পৃথিবীর সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছা অনুপাতেই সৃষ্টি হয়েছে এবং নির্ধারিত হয়েছে। এই প্রকার ইরাদাহ এবং المشيئة একই জিনিষ। উভয়টি পরস্পর সমার্থবোধক। এই প্রকার ইরাদাহর উদাহরণ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার বাণীঃ

﴿وَإِذَا أَرَدْنَا أَن نُّهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُوا فِيهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيرًا﴾

‘‘আমি যখন কোনো জনবসতিকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি তখন তার সমৃদ্ধিশালী লোকদেরকে নির্দেশ[1] দেই, ফলে তারা সেখানে নাফরমানী করতে থাকে। অতঃপর আযাবের ফায়সালা সেই জনবসতির উপর বলবত হয়ে যায় এবং আমি তাকে ধ্বংস করে দেই’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ১৬)

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلَا مَرَدَّ لَهُ ۚ وَمَا لَهُم مِّن دُونِهِ مِن وَالٍ﴾

‘‘আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের গুণাবলী বদলে ফেলে৷ আর আল্লাহ যখন কোন জাতিকে দুর্ভাগ্য কবলিত করার ফায়সালা করেন তখন তা প্রতিহত হয়না এবং আল্লাহর মোকাবিলায় এমন জাতির কোন সাহায্যকারী থাকেনা’’। (সূরা রা’দঃ ১১) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

﴿وَمَن يُرِدْ أَن يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا﴾

‘‘আর যাকে তিনি গোমরাহীতে নিক্ষেপ করার ইচ্ছা করেন, তার বক্ষদেশ খুব সংকীর্ণ করে দেন’’।

আর দ্বিতীয় প্রকার ইরাদাহ হচ্ছে إراداة دينية شرعية ইরাদায়ে দ্বিনীয়া শারঈয়া অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার শরীয়তগত ইচ্ছা। এই প্রকার ইচ্ছার মাধ্যমেই তিনি তাঁর বান্দাদের উপর শরীয়তের সকল হুকুম-আহকাম বিধিবদ্ধ করেছেন। এর উদাহরণ হলো আল্লাহর বাণীঃ

﴿وَاللَّهُ يُرِيدُ أَن يَتُوبَ عَلَيْكُمْ وَيُرِيدُ الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الشَّهَوَاتِ أَن تَمِيلُوا مَيْلًا عَظِيمًا يُرِيدُ اللَّهُ أَن يُخَفِّفَ عَنكُمْ ۚ وَخُلِقَ الْإِنسَانُ ضَعِيفًا﴾

‘‘আল্লাহ তোমাদের তাওবা কবুল করার ইচ্ছা করেন। কিন্তু যারা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করছে তারা চায় তোমরা ন্যায় ও সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে দূরে চলে যাও৷ আল্লাহ তোমাদের উপর হাল্কা করার ইচ্ছা করেন। কারণ মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে’’। (সূরা নিসাঃ ২৭-২৮) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

﴿مَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُم مِّنْ حَرَجٍ وَلَٰكِن يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ﴾

‘‘আল্লাহ তোমাদের উপর সংকীর্ণতা চাপিয়ে দেয়ার ইচ্ছা করেন না। কিন্তু তিনি ইচ্ছা করেন তোমাদেরকে পাক-পবিত্র করতে এবং তাঁর নিয়ামত তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করে দিতে, যাতে তোমরা শোকর গুজার হও’’। (সূরা মায়িদাঃ ৬) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

﴿إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا﴾

‘‘আল্লাহ ইচ্ছা করেন তোমাদের নবী পরিবার থেকে ময়লা দূর করতে এবং তোমাদের পুরোপুরি পাক-পবিত্র করে দিতে’’। (সূরা আহযাবঃ ৩৩)

[1] - এই আয়াতের ব্যাখ্যায় একাধিক মত রয়েছে। (১) আয়াতে 'নির্দেশ' মানে প্রকৃতি, সৃষ্টি ও অমোঘ বিধানগত নির্দেশ উদ্দেশ্য। অর্থাৎ প্রকৃতি ও অমোঘ বিধান হিসাবে সবসময় এমনটিই হয়ে থাকে। যখন কোন জাতির ধ্বংস হবার সময় এসে যায়, তার বিত্তবানরা ফাসেক হয়ে যায়। আর ধ্বংস করার ইচ্ছা করা মানে এ নয় যে আল্লাহ বিনা কারণে কোন নিরপরাধ জনবসতি ধ্বংস করার ইচ্ছা করেন, বরং এর মানে হচ্ছে, যখন কোন জনবসতি অসৎকাজের পথে এগিয়ে যেতে থাকে এবং আল্লাহ তাকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন তখন এ সিদ্ধান্তের প্রকাশ এ পথেই হয়ে থাকে। সম্মানিত শাইখ এই দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।

(২) এই আয়াত বা অনুরূপ আয়াত থেকে এটি বুঝার কোন সুযোগ নেই যে, আল্লাহ তাআলার সমৃদ্ধ ও বিত্তশালীদেরকে পাপ কাজের আদেশ দেন এবং তারা সেই আদেশেই পাপ কাজ করে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ধ্বংস করেন। যেমনটি মনে করে থাকে জাহেলের দলেরা; বরং অধিকাংশ আলেমের মতে আয়াতের সঠিক অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সৎকাজের আদেশ দেন, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ইচ্ছা ও ইখতিয়ারের যেই স্বাধীনতা দিয়েছেন, তারা তার অপব্যবহর করে এবং পাপ কাজে লিপ্ত হয়। আল্লাহর আদেশ লংঘনের ফলে তারা ধ্বংসের হকদার হয় বলেই আল্লাহ তাদেরকে পূর্বের নির্ধারণ ও ফয়সালা অনুযায়ী ধ্বংস করেন; এমনটি নয় যে, আল্লাহর আদেশেই পাপ কাজ হয় এবং আল্লাহর হুকুমেই ধ্বংস হয়। কেননা কুরআনের একাধিক আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে, আল্লাহ তাআলা কেবল আনুগত্যের আদেশ করেন। তিনি অন্যায় ও অশ্লীল কাজের আদেশ করেন না এবং অন্যায়, পাপাচার ও সীমালংঘনকে পছন্দও করেন না।
ইরাদায়ে কাওনীয়া এবং ইরাদায়ে শরঈয়ার মধ্যে পার্থক্য

ইরাদায়ে কাওনীয়া এবং ইরাদায়ে শরঈয়ার মধ্যে পার্থক্য:

(১) ইরাদায়ে কাওনীয়া তথা আল্লাহর সৃষ্টি ও অমোঘ বিধানগত ইচ্ছার মাধ্যমে যা হয়, আল্লাহ কখনো তাকে ভালবাসেন ও তাতে সন্তুষ্ট থাকেন আবার কখনো তা তিনি ভালবাসেন না এবং উহার প্রতি সন্তুষ্টও থাকেন না।

আর ইরাদায়ে শারঈয়ার মাধ্যমে যা সংঘটিত হয়, তাকে তিনি অবশ্যই ভালবাসেন এবং উহার প্রতি সন্তুষ্টও থাকেন। সুতরাং সকল প্রকার পাপকাজ এবং অকল্যাণও আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে শামিল। সে হিসাবে সৃষ্টি ও অমোঘ বিধানগত দিক থেকে তিনি পাপাচার সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছেন, কিন্তু আল্লাহ তাআলা পাপ কাজকে ভালবাসেন না এবং উহার প্রতি সন্তুষ্টও থাকেন না। তিনি তাতে লিপ্ত হওয়ার আদেশও করেন নি; বরং তা থেকে বিরত থাকার জন্য কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।

(২) ইরাদায়ে কাওনীয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা যা সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন, তা সৃষ্টি করা মূল উদ্দেশ্য হয়না; বরং তা অন্য এক বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা ইবলীস এবং সকল প্রকার পাপাচার ও অকল্যাণ সৃষ্টি করেছেন। যাতে করে মুমিন বান্দাগণ নফ্সে আম্মারা ও শয়তানের সাথে সর্বদা জিহাদে লিপ্ত থাকে। শয়তানের প্ররোচনা ও ধোঁকায় নিপতিত হয়ে মানুষ পাপকাজে লিপ্ত হয়ে গেলেও আল্লাহর কাছে তারা তাওবা করে এবং ক্ষমা চায়। এমনি আরো ভালো উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা অন্যায় ও অকল্যাণ সৃষ্টি করেছেন।[1]

ঐদিকে শরঈ ইচ্ছার দ্বারা আল্লাহ তাআলা যা সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন, তা মূলতই উদ্দেশ্য হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি ও শরীয়তগত এই উভয় দিক থেকেই ইচ্ছা করেছেন যে, বান্দারা তাঁর আনুগত্য করুক। কেননা তিনি আনুগত্যের কাজকে ভালবাসেন এবং উহার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন।

(৩) আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি ও অমোঘ বিধানগত ইচ্ছা অবশ্যই সংঘটিত হয়। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তিনি যা সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন, সাথে সাথে তা সৃষ্টি হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ (৮২) فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ﴾

‘‘আল্লাহ তাআলা যখন কোন কিছুর ইচ্ছা করেন তখন তিনি শুধু বলেন যে, হয়ে যাও। সাথে সাথেই তা হয়ে যায়৷ পবিত্র সেই সত্তা, যার হাতে রয়েছে প্রত্যেকটি জিনিষের পূর্ণ কর্তৃত্ব এবং তাঁরই দিকে তোমাদের ফিরে যেতে হবে’’। (সূরা ইয়াসীনঃ ৮২-৮৩)

আর শারঈ ইচ্ছার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা যা ইচ্ছা করেন, তা সকল ক্ষেত্রে সংঘটিত হওয়া আবশ্যক নয়। কখনো তা সংঘটিত হয়, আবার কখনো হয়না।

একটি জ্ঞাতব্য বিষয়:

অনুগত একনিষ্ঠ মুমিন মুখলিস বান্দার মধ্যে ইরাদায়ে কাওনীয়া এবং ইরাদায়ে শারঈয়াহ উভয়টিই একত্রে বাস্তবায়ন হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিগত ও নির্ধারণের দিক থেকে সৎকাজ সংঘটিত হওয়ার ইচ্ছা করেছেন এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য ইরাদায়ে শরঈয়ার মাধ্যমে আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহর যেই বান্দা আল্লাহর এই হুকুম কবুল করে নিয়েছে, তার মধ্যে আল্লাহর দু’টি ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে।

আর অপরাধীর অপরাধের মধ্যে শুধু ইরাদায়ে কাওনীয়াই বাস্তবায়ন হয়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্যের পথ বর্জন করে, তার দ্বারা অপরাধটি হয় শুধু এই হিসাবে যে, আল্লাহ তাআলা উক্ত অপরাধের স্রষ্টা;[2] তাতে আদৌ আল্লাহর আদেশ ও সন্তুষ্টি থাকেনা।

আরেকটি জ্ঞাতব্য বিষয়: যারা আল্লাহ তাআলার উপরোক্ত উভয় প্রকার ইরাদাহ সাব্যস্ত করেনি এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করেনি, তারা পথভ্রষ্ঠ হয়েছে। যেমন জাবরীয়া এবং কাদরীয়া (মুতাযেলা) সম্প্রদায়ের লোকেরা। জাবরীয়ারা শুধু আল্লাহর ইরাদায়ে কাওনীয়া সাব্যস্ত করেছে। কাদরীয়ারা শুধু আল্লাহ তাআলার ইরাদায়ে শারঈয়া সাব্যস্ত করেছে। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের লোকেরা উভয় প্রকার ইরাদাই আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেছে এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্যও করেছে।[3]

[1] - অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা শুধু ক্ষতি ও অকল্যাণের উদ্দেশ্যেই অকল্যাণ সৃষ্টি করেন নি। আল্লাহ তাআলা এ থেকে মুক্ত। প্রত্যেক বস্ত্ত সৃষ্টির পিছনে আল্লাহ তাআলার বিশেষ হিকমত রয়েছে। আমরা কখনো তা থেকে কিছু বুঝতে পারি। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা অকল্যাণ সৃষ্টির পিছনে আল্লাহর হিকমত বুঝতে পারিনা।

বিষয়টি সহজভাবে বুঝানোর জন্য কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করা যেতে পারে। যেমন ধরুন কুরাইশ নেতা ও মক্কার প্রভাবশালী ব্যক্তি আবু তালিবের ঈমান না আনা এবং কিয়ামতের দিন তার শাস্তি ভোগ করার উদাহরণটি পেশ করা যেতে পারে। সম্ভবত তার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার হিকমতটি এমন ছিল যে, আল্লাহ তাআলা তাকে তার বাপ-দাদাদের দ্বীনের উপর রেখেই তার দ্বারা তাঁর প্রিয় বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হেফাজত করবেন এবং মুসলমানদের চরম বিপদের সময় এমন কল্যাণ সাধন করবেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত ইতিহাসে লিখা থাকবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আবু তালেবকে তার পিতৃধর্মে লিপ্ত রেখে মুসলমানদের জন্য প্রচুর কল্যাণ সাধন করেছেন। কিন্তু সে যেহেতু তার ভাতিজার নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনয়ন করেনি, তাই আল্লাহ তাআলার ন্যায় বিচারের কারণেই পরকালের নেয়ামত তার ভাগ্যে জুটবেনা।

বিষয়টিকে আরো খোলাসা করে বুঝানোর জন্য খিযির (আঃ) কর্তৃক মিসকীন লোকদের নৌকা ছিদ্র করে ফেলা ও একজন নিরপরাধ শিশুকে হত্যা করার উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে। এর পিছনে আল্লাহ তাআলার কী হিকমত লুকায়িত ছিল- মুসা (আঃ) প্রথমে বুঝতে পারেন নি বলেই তিনি খিযির (আঃ)এর কাজের জোরালো প্রতিবাদ করেছেন। পরক্ষণেই খিযির (আঃ) স্বীয় কর্ম-কান্ডের হিকমত খোলাসা করে বলে দিয়েছেন। মূলতঃ শুধু শুধু ক্ষতির জন্যই আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় কোন অন্যায় কর্ম সংঘটিত হয়না। আল্লাহর প্রত্যেকটি কাজের পিছনেই কোন না কোন হিকমত ও কল্যাণ থাকে।

নৌকা ছিদ্র করা মিসকীন লোকদের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু তার মধ্যে যেই কল্যাণ রয়েছে, তা সেই ক্ষতির চেয়ে বহুগুণ উপকারী। কারণ ভালো নৌকাগুলো যালেম বাদশাহর লোকেরা ছিনিয়ে নেয়। ত্রুটিপূর্ণ নৌকার উপর তারা হস্তক্ষেপ করেনা। সুতরাং নৌকা একেবারেই না থাকার চেয়ে ছিদ্র অবস্থায় তা থাকা তাদের জন্য কল্যাণকর।

খিযির (আঃ) যেহেতু জানতে পারলেন ছেলেটি বড় হয়ে কাফের হবে এবং পিতামাতাকে কষ্ট দিবে, তাই হত্যা করা বাহ্যিক দৃষ্টিতে অন্যায় হলেও এই হত্যাকান্ডের পিছনেই রয়েছে ছেলেটির জন্য কল্যাণকর এবং তার পিতামাতার জন্যও কল্যাণকর। ছেলেটির জন্য এই বয়সে নিহত হওয়া এই দিক থেকে উপকারী যে, এখনো তার দ্বারা কোন অন্যায় কাজ হয়নি। সে নিহত হওয়ার পর জান্নাতে যাবে। অপর পক্ষে বড় হয়ে কুফুরী ও পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে জাহান্নামে যাওয়া তার জন্য ক্ষতিকর ছিল। ঐ দিকে আল্লাহ তাআলা তার বিনিময়ে পিতামাতাকে এমন সৎ সন্তান দান করবেন, যারা পিতামাতার প্রতি আনুগত্য থাকবে।

এমনি প্রচুর বৃষ্টি অনেক সময় কারো জন্য ক্ষতিকর হলেও তাতে আম মানুষের জন্য প্রচুর কল্যাণ থাকে। অনেক সময় বন্যায় কারো ঘরবাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। বাড়িঘর নষ্ট হওয়া অবশ্যই তাদের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এর মধ্যেও তাদের কল্যাণ থাকতে পারে। যেমন ধরুন ঝড়ে কোন গ্রামের কতিপয় লোকের বাড়িঘর ধ্বংস হলো আবার কারো বাড়িঘর অক্ষত রইল। যাদের বাড়িঘর নষ্ট হলো তারা মনক্ষুন্ন হলো। আর যাদের বাড়িঘর নষ্ট হলোনা, তারা খুশী হলো। পরক্ষণই যখন সরকারী ঘোষণা আসল, যাদের বাড়িঘর নষ্ট হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে উত্তরায় একটি বাড়ি দেয়া হবে, তখন যাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়নি, তারাও কামনা করল যে, তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হলেই ভাল হতো। সুতরাং আল্লাহর প্রত্যেক কাজই ভাল। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোন কোন কাজ ক্ষতিকর দেখা যায়।

আল্লাহ তাআলা মদপানসহ অন্যান্য সকল ক্ষতিকর কাজ সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন। ইচ্ছার স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে সে আল্লাহর এই নিষেধাজ্ঞা লংঘন করে মানুষ মদপানে লিপ্ত হতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই অুনতপ্ত হয়ে তাওবা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন। শুধু তাই নয় এই তাওবাও তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি এবাদতে পরিণত হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে মদ পান করে শুধু আল্লাহর নাফরমানী করা হোক এই জন্যই আল্লাহর ইচ্ছায় মদ সৃষ্টি হয়নি; বরং সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে পরীক্ষার ক্ষেত্র তৈরী হয় কিংবা ভুল করে মদ পান করা হলেও তা থেকে তাওবা করে মদ্যপায়ী আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হতে পারে।

মোট কথা, আল্লাহ তাআলা অযথা কোন কিছুই সৃষ্টি করেন না এবং তার কোন কর্মও হিকমত ছাড়া সংঘটিত হয়না। যা আমরা অনেক ক্ষেত্রেই বুঝতে পারিনা। তাই আমাদের সকল অবস্থাতেই আল্লাহর প্রশংসা করা আবশ্যক।

[2] - আল্লাহ তাআলা মানুষের মধ্যে ভাল বা মন্দের যে কোন একটি বেছে নেয়ার যে স্বাধীনতা সৃষ্টি করেছেন, মানুষ তার সেই স্বাধীনতার অপব্যবহর করে বলেই তার দ্বারা অপরাধ সংঘটিত হয়। আল্লাহ তাআলা তা সৃষ্টি করেছেন; এ জন্য নয়। সেই সাথে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, বান্দার কর্ম সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পূর্ব থেকেই অবগত আছেন। ফলে তিনি তা লিখিয়েছেন। তাই এ কথা বলার আদৌ কোনো অবকাশ নেই যে, আল্লাহ তাআলা লিখিয়ে রেখেছেন বলেই বান্দারা পাপ করে থাকে।

[3] - আল্লাহর ইচ্ছার ক্ষেত্রে জবরীয়া ও কাদরীয়া সম্প্রদায়ের মতবাদ ভালভাবে বুঝার জন্য আরেকটু খোলাসা করার প্রয়োজন রয়েছে। জাবরীয়ারা বলে থাকে ভাল-মন্দ সবকিছুই আল্লাহর একটিমাত্র ইচ্ছা তথা সৃষ্টিগত ইচ্ছাতেই সংঘটিত হয় এবং আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শুধু তাঁর এই একটি ইচ্ছারই বাস্তবায়ন হয়। এমনকি বান্দার কর্মে সে স্বাধীনও নয়। তারা মনে করে এতে বান্দার ইচ্ছা ও স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে খর্ব করা হয়েছে। কুরআন-সুন্নাহর দলীল-প্রমাণ এবং বাস্তবতা তাদের এই মতবাদকে বাতিল প্রমাণিত করেছে।

আর কাদরীয়া তথা মুতাযেলাদের মতে আল্লাহর জন্য শুধু ইরাদায়ে শরঈয়া সাব্যস্ত। অর্থাৎ আল্লাহ শুধু তার বান্দাদেরকে ভাল কাজ করার আদেশ দিয়েছেন। আর বান্দারা তাদের কাজ-কর্মের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন। অন্য কথায় তারাই তাদের কর্মের স্রষ্টা ও ইচ্ছা পোষণকারী। এমনকি বান্দার দ্বারা কাজ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে আল্লাহ সে স্পর্কে জানেনও না। (নাউযুবিল্লাহ) এটিও একটি বাতিল ও তাওহীদ বিরোধী কথা। কারণ (নাউযুবিল্লাহ) এতে একাধিক স্রষ্টা থাকা আবশ্যক হয়।

এ সম্পর্কে এবং অন্যান্য বিষয়ে কাদরীয়া ও জাবরীয়া সম্প্রদায়ের কথা ও তাদের কথার জবাব বিস্তারিতভাবে জানার জন্য আমাদের অন্যতম অনুবাদগ্রন্থ শরহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া পড়ার অনুরোধ করা গেল। (আল্লাহই তাওফীক দাতা)

আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কিত মাসআলাটি আকীদাহর মাসআলাসমূহের অন্যতম একটি গুরুত্বপূণ বিষয় হওয়ার কারণে তা অধিকতর খোলাসা করার জন্য এ বিষয়ে শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উছাইমীন (রঃ)এর বিশ্লেষণটি এখানে যোগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।

তিনি বলেনঃ ইরাদাহ তথা আল্লাহর ইচ্ছা দুই প্রকার। (১) ইরাদায়ে কাওনীয়া। এটি সম্পূর্ণরূপেই المشيئة-এর সমার্থবোধক। সেই হিসাবে أراد الله (আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন) এবং شاء الله (আল্লাহ চেয়েছেন)এর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই প্রকার ইরাদার ব্যাব্যাপারে প্রথম কথা হচ্ছে, যেসব বিষয় ও কাজ আল্লাহ ভালবাসেন এবং যেগুলোকে আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন না, তার সব ক্ষেত্রেই এই প্রকার ইরাদাহ বিদ্যমান থাকে।

শাইখ বলেনঃ এর উপর ভিত্তি করে আপনাকে যদি কেউ যখন প্রশ্ন করে, আল্লাহ তাআলা কি কুফুরীর ইচ্ছা করেন? অন্য কথায় কুফুরীও কি আল্লাহর ইচ্ছায় হয়? উত্তরে আপনি বলুনঃ হ্যাঁ, আল্লাহ্ তাআলার ইরাদায়ে কাওনীয়া তথা সৃষ্টিগত ইচ্ছার অধীনে কুফুরীও সংঘটিত হয়। আল্লাহ তাআলা যদি সৃষ্টিগতভাবে কুফুরী হওয়ার ইচ্ছা না করতেন, তাহলে কখনোই পৃথিবীতে কুফুরী হতোনা।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ইরাদায়ে কাওনীয়ার দ্বারা আল্লাহ তাআলা যার ইচ্ছা করেন, তা অবশ্যই সংঘটিত হয়। অন্য কথায় আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা অবশ্যই হয় এবং তা না হওয়ার প্রশ্নই আসেনা।

(২) দ্বিতীয় প্রকার ইরাদাহ হচ্ছে ইরাদায়ে শরঈয়া। এটি المحبة (ভালাবাসা)এর সমার্থক। এই প্রকার ইরাদায় أراد الله (আল্লাহ ইচ্ছা করেছেন) অর্থ হলো, أحب الله আল্লাহ ভালবেসেছেন ও পছন্দ করেছেন।

এই প্রকার ইরাদার ক্ষেত্রে প্রথম কথা হচ্ছে, এটি আল্লাহর ভালবাসা ও পছন্দের সাথে খাস। সুতরাং তিনি ইরাদায়ে শরঈয়ার মাধ্যমে কুফুরী ও পাপাচার পছন্দ করেন না। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, তাতে উদ্দিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়ন হওয়া জুরুরী নয়। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা কোন জিনিষ হওয়া পছন্দ করেন, কিন্তু কখনো তা হয় আবার কখনো হয়না। আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করেছেন যে, বান্দারা তাঁর এবাদত করুক। কিন্তু জরুরী হিসাবে সকল সৃষ্টির পক্ষ হতে এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়না।[1] দেখা যাচ্ছে কিছু সংখ্যক মানুষ তার এবাদত করে আর অন্যরা তাঁর এবাদত করেনা। কিন্তু ইরাদায়ে কাওনীয়া এর বিপরীত। সেখানে আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তায়ন হবেই হবে।

সুতরাং দুইদিক থেকে দুই প্রকার ইরাদার মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। (১) ইরাদায়ে কাওনীয়ার মাধ্যমে যা ইচ্ছা করা হয়, তা সংঘটিত হওয়া অবধারিত। আর ইরাদায়ে শারঈয়ার মধ্যে তা আবশ্যক নয়।

(২) ইরাদায়ে শারঈয়া কেবল ঐ সব বস্ত্তর মধ্যেই সীমিত, যা হওয়া আল্লাহ তাআলা ভালবাসেন। আর ইরাদায়ে কাওনীয়া হচ্ছে ব্যাপক। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যা পছন্দ করেন আর যা পছন্দ করেন না, উভয়টিই এর মধ্যে শামিল।

এর উপর ভিত্তি করে এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে, আল্লাহ তাআলা কিভাবে এমন জিনিষের ইচ্ছা করেন, যা তিনি ভালবাসেন না? অন্য কথায় আল্লাহ তাআলা কিভাবে কুফুরী, পাপাচার এবং সীমালংঘন হওয়ার ইচ্ছা করেন? অথচ তিনি তা পছন্দ করেন না।

এর উত্তর হচ্ছে অন্যায় ও ক্ষতিকর বস্ত্ত সংঘটিত হওয়া একদিক থেকে আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং অন্যদিক বিচারে উহা অপছন্দনীয়। এর মধ্যে যেই বিরাট কল্যাণ নিহিত থাকে, সেই দিক বিচারে এটি আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং এতে যেহেতু আল্লাহর অবাধ্যতা রয়েছে, সেই হিসাবে এটি তাঁর কাছে অপ্রিয়।[2]

সুতরাং একই জিনিষ দুইদিক বিচারে একই সাথে প্রিয় এবং অপ্রিয় হওয়াতে কোন মানা নেই।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মানুষ তার কলিজার টুকরা শিশু সন্তানকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। যাতে করে ডাক্তার শিশুর পেট ফেড়ে ভিতর থেকে দূষিত জিনিষ বের করে ফেলে। অথচ অন্য কেউ তার শিশুর গায়ে সুইয়ের একটি খোঁচা দিতে চাইলেও সে রাজী হয়না’ বরং সে তার সাথে ঝগড়া করে।

অপরপক্ষে সে নিজেই পেট ফেড়ে ফেলার জন্য শিশুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার শিশুর পেট কাটে ও চিরে ফেলে। পিতা এই দৃশ্য খুশী মনেই দেখে। এতে তার শিশুর কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কি কারণে সে রাজী হয়? রাজী হওয়ার কারণ হলো, এই মূহুর্তে শিশুর কষ্ট হলেও অন্য কারণে অর্থাৎ শিশুর জন্য এমন এক বিরাট স্বার্থ ও কল্যাণ হাসিলের আশায় সে একটি অপছন্দনীয় বিষয় পছন্দ করে, যা ভবিষ্যতে অর্জিত হবে। (সংযুক্তি এখানেই শেষ)

[1] - সুতরাং দেখা যাচ্ছে ইরাদায়ে শরঈয়ার দ্বারা যা হয়, তা আল্লাহর কাছে প্রিয় হলেও তা সকল ক্ষেত্রে কার্যকর ও বাস্তবায়ন হয়না। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য যা কিছু ইসলামী শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত করেছেন এবং যত আদেশ-নিষেধ করেছেন, তা এই প্রকার ইরাদার সাথে খাস। যেমন নামায কায়েম করা, রোযা রাখা, যাকাত প্রদান করাসহ ইত্যাদি আরো অনেক আমল করার আদেশ। এই কাজগুলো বাস্তবায়ন হওয়া আল্লাহর কাছে প্রিয়। সেই সাথে দৃষ্টি নত রাখা, চুরি-ডাকাতি না করা, যেনা-ব্যাভিচার ইত্যাদি আরো অনেক হারাম কাজ থেকে আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন। এ সব কাজ থেকে বান্দার বিরত থাকা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়। কিন্তু কতক বান্দার দ্বারা আল্লাহ এই প্রকার ইরাদাহ বাস্তবায়িত হয়। আবার অনেকের দ্বারা বাস্তবায়িত হয়না। না হওয়ার কারণ হলো আল্লাহ সকল মানুষকে সৎকাজের উপর বাধ্য করেন নি। তিনি ইচ্ছা করলে বাধ্য করতে পারতেন, সেই ক্ষমতা তাঁর অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু তা না করে পরীক্ষা করার জন্য তাদেরকে ভাল-মন্দের যে কোন একটি ইখতিয়ার করার স্বাধীনতা দিয়েছেন। কুরআন, সুন্নাহর দলীল এবং মানুষের বিবেক-বুদ্ধির দ্বারা মানুষের এই স্বাধীনতার বিষয়টি প্রমাণিত ও স্বীকৃত।

[2] - আবু তালেবকে কুরাইশদের দ্বীনে রাখা কোন্ দিক মূল্যায়নে আল্লাহর কাছে প্রিয় ছিল এবং খিযির (আঃ) কর্তৃক নিরপরাধ শিশুকে হত্যা করা ও মিসকীনদের নৌকা ভেঙে ফেলা কোন্ দিক বিবেচনায় আল্লাহর কাছে ভাল ছিল, তা পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এখানে শুধু এতটুকু বলা হচ্ছে যে, অনেক জিনিষ মূলতই ঘৃণিত এবং অপছন্দনীয় হয়। কিন্তু তার দ্বারা আবার ভাল ফলাফলও অর্জিত হয়। তাই আল্লাহ তাআলা কিছু নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত জিনিষ নির্ধারণ করেন এবং তা সংঘটিত করেন। কিছু কিছু জিনিষ প্রিয় হওয়া সত্ত্বে তা সংঘটিত করেন না। কেননা যেই নিকৃষ্ট জিনিষটি তিনি নির্ধারণ করেন, তার পথ ধরে অন্য এমন একটি প্রিয় জিনিষ (ফলাফল) অর্জিত হয়, যা আল্লাহর কাছে ঐ প্রিয় বস্ত্ত হতেও অধিক প্রিয় হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ إِنْ يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِثْلُهُ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَدَاءَ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ وَلِيُمَحِّصَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَمْحَقَ الْكَافِرِينَ﴾

‘‘আর তোমরা নিরাশ হয়োনা এবং দুঃখ করোনা। যদি তোমরা মুমিন হও তবে তোমরাই জয়ী হবে। তোমরা যদি আহত হয়ে থাক, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি। এভাবে আল্লাহ্ জানতে চান, কারা ঈমানদার আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ্ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না। আর এ কারণে আল্লাহ্ ঈমানদারদেরকে পাক-সাফ করার ইচ্ছা করেন এবং কাফেরদেরকে ধ্বংস করে দিতে চান।’’ (সূরা আল-ইমরানঃ ১৩৯-১৪১)

সুতরাং আল্লাহ তাআলা চান যে, মুমিনদের মধ্য হতে এমন কতিপয় মুমিন বিদ্যমান থাকুক, যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে, তাঁর সন্তুষ্টির আশায় তাদের জীবন কোরবানী করবে এবং শহীদ হয়ে তাঁর নৈকট্য হাসিল করবে। এটি আল্লাহর কাছে সমস্ত মানুষের ঈমান আনয়ন থেকেও উত্তম। এই জন্যই তিনি নির্ধারণ করেছেন যে, পৃথিবীতে কাফের থাকুক, কুফুরী থাকুক এবং কাফেরদের মাঝে ও মুসলিমদের মাঝে যুদ্ধ চলতে থাকুক। যাতে করে তার বান্দাদের মধ্য হতে কতিপয়কে শহীদ হিসাবে গ্রহণকরতে পারেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَوْ لَمْ تُذْنِبُوا لَذَهَبَ اللَّهُ بِكُمْ وَلَجَاءَ بِقَوْمٍ يُذْنِبُونَ فَيَسْتَغْفِرُونَ اللَّهَ فَيَغْفِرُ لَهُمْ

ঐ আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা যদি গুনাহ না করো, তাহলে আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে ধ্বংস করে ফেলবেন এবং তোমাদের বদলে অন্য এমন জাতি সৃষ্টি করবেন, যারা গুনাহ করবে। অতঃপর তারা তাওবা করবে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ৭১৪১)

সুতরাং আল্লাহ তাআলা চেয়েছেন যে, বান্দারা পাপ কাজ করবে এবং তা করার পর অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করার মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকবে। অপরাধ হয়ে যাওয়ার পর তাওবা করা আল্লাহর কাছে একাধারে আনুগত্যের উপর বিদ্যমান থাকার চেয়ে অধিক প্রিয়। এই জন্যই আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য পাপকাজ নির্ধারণ করেছেন। ঠিক তেমনি বান্দার দ্বারা পাপ হওয়ার মধ্যে আল্লাহ তাআলার الغفور গাফুর (ক্ষমাকারী), الرحيم (দয়াকারী) ইত্যাদি অতি সুন্দর নাম ও সুমহান সিফাতের প্রভাব প্রকাশিত হয়। সুতরাং আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয় বিষয় তথা পাপ কাজ থাকার কারণেই আল্লাহর অনেক সুমহান গুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাই দেখা গেল আল্লাহ তাআলা যেসব অকল্যাণ সৃষ্টি করেন, তার মধ্যে হিকমতে ইলাহী হচ্ছে, তাতে অন্যান্য প্রিয় ফলাফল অর্জিত হয়। সুতরাং সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা করা আবশ্যক। বলাবহুল্য যে, পূর্বোক্ত হাদীছে আল্লাহ পাক আদৌ পাপের প্রতি উৎসাহ দিচ্ছেন না; বরং পাপ হয়ে গেলে যাতে বান্দা নিরাশ হয়ে ক্ষমা চাওয়া থেকে বিরত না হয়, তা বলা উদ্দেশ্য। তাই তো মূলনীতি হচ্ছে, পাপ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে আল্লাহর ভয়কে প্রাধান্য দেয়া, যাতে পাপ না সংঘটিত হয়। পক্ষান্তরে শত অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পাপ যদি হয়েই যায়, তাহলে এহেন মুহূর্তে আশাকে প্রাধান্য দিতে হবে। যাতে ক্ষমা চাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে না যায়।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৪ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে