শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহর সংক্ষিপ্ত জীবনী ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী] ১৬ টি

আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য সত্য দ্বীনসহ যুগে যুগে অগণিত নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। নির্ভেজাল তাওহীদই ছিল নবী-রাসূলদের দ্বীনের মূল বিষয়। পৃথিবীর মানুষেরা এই তাওহীদকে যখনই ভুলে গেছে, তখনই তা পুনরুদ্ধারের জন্য নতুন নতুন নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আগমণ করেন সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর দাওয়াতের মূল বিষয়ও ছিল এই তাওহীদ। মক্কায় অবস্থান করে একটানা ১৩ বছর তিনি তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন। অতঃপর মদীনায় হিজরত করে তাওহীদের দাওয়াত অব্যাহত রেখেছেন। উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানগণ তাঁর এই দাওয়াত গ্রহণ করলো এবং তারা তাঁর সাহায্য করলো। আল্লাহ তাআলা অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করলেন। আরব উপদ্বীপসহ পৃথিবীর সর্বত্রই এই দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে গেল। তাওহীদের মাধ্যমে তারা সমগ্র জাতির উপর যে গৌরব, সম্মান, শক্তি, প্রতিপত্তি এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে মুসলিমগণ দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলিমদের শক্তির মূলভিত্তি এই নির্ভেজাল তাওহীদের উপর শির্ক ও কুসংস্কারের আবর্জনা পড়ে যাওয়াই মুসলিমদের বিপর্যস্তের প্রধান ও মূল কারণ।

ইসলামের এই মূলভিত্তি নির্ভেজাল তাওহীদ থেকে যখনই মুসলিম জাতি দূরে চলে গেছে, দ্বীনি লেবাসে বিভিন্ন সময় শির্ক, বিদআত, কুসংস্কার ও বিজাতীয় আচার-আচরণ মুসলিমদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে, তখনই নির্ভেজাল তাওহীদের দিকে জাতিকে ফিরিয়ে আনার জন্য এবং সকল প্রকার আবর্জনা থেকে তাওহীদকে পরিস্কার ও পরিশুদ্ধ করার জন্য ইসলামের স্বর্ণযুগের পরে আল্লাহ তাআলা বহু মর্দে মুজাহিদ প্রেরণ করেছেন। তারা পথহারা জাতিকে সুপথে ফিরিয়ে এনেছেন, তাওহীদের দাওয়াতকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন এবং দ্বীনকে সকল প্রকার শির্ক-বিদআত থেকে সংস্কার ও সংশোধন করেছেন। তাদেরই ধারাবাহিকতায় হিজরী সপ্তম ও অষ্টম শতকে আগমণ করেন বিপ্লবী সংস্কারক শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ। বহু প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এবং জেল-যুলুম সহ্য করে তাওহীদ পুনরুদ্ধার ও সংস্কারে তিনি যে অতুলনীয় অবদান ও খেদমত রেখে গেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম জাতির জন্য তা দিশারী হয়ে থাকবে। তাঁর বরকতময় জীবনী, দাওয়াত ও সংস্কারের সকল দিক উল্লেখ করতে গেলে বড় মাপের একটি গ্রন্থ রচনা করা দরকার। তাই আমরা স্বল্প পরিসরে শাইখের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, জীবনী ও সংস্কার আন্দোলনের কিছু দিক এখানে উল্লেখ করেছি।

নাম, জন্ম ও বংশ পরিচয়:

তিনি হলেন আবুল আববাস তকীউদ্দীন শাইখুল ইসলাম ইমাম আহমাদ বিন আব্দুল হালীম বিন আব্দুস সালাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ। ৬৬১ হিজরী সালের ১০ রবীউল আওয়াল মাসে তিনি বর্তমান সিরিয়ার হারান এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আব্দুল হালীম ইবনে তাইমীয়া এবং দাদা আবুল বারাকাত মাজদুদ্দীন আব্দুস্ সালাম বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ ও হাম্বলী ফিকাহবিদ ছিলেন। সে হিসাবে তিনি এমন একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, যার সকল সদস্যই ছিলেন আলেম ও দ্বীনদার। আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণে শিশুকালেই তিনি ইলম অর্জনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। উল্লেখ্য যে, আলেমদের প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী তাইমীয়া ছিলেন শাইখের নানী। তিনি ওয়াজ-নসীহত ও ভাষণ-বক্তৃতা দানে খুবই পারদর্শী ছিলেন।

ইমামের বয়স যখন সাত বছর, তখন মুসলিম অঞ্চলগুলো তাতারীদের আক্রমণের শিকার হয়। শাইখের জন্মস্থান হারান এলাকা তাতারীদের আক্রমণের কবলে পড়লে মানুষ জানের ভয়ে সবকিছু পানির দামে বিক্রি করে পালাচ্ছিল। এই ভীতি ও আতঙ্কের দিনে ইমামের পরিবারবর্গও দেশ ত্যাগের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করলেন। তারা প্রয়োজনীয় সবকিছু ফেলে দিয়ে শুধু পারিবারিক লাইব্রেরীর বই-পুস্তকগুলো গাড়ী বোঝাই করলেন। শুধু কিতাবেই কয়েকটি গাড়ি পরিপূর্ণ হয়ে গেল। গাড়ীগুলো টানার জন্য প্রয়োজনীয় ঘোড়া ও গাধাও ছিলনা। তাই গাধার পাশাপাশি পরিবারের যুবক সদস্যদেরও মাঝে মাঝে কিতাবের গাড়ী টানতে হতো।

দামেস্কে পৌঁছার পর তথাকার লোকেরা শাইখের পরিবারকে অভ্যর্থনা জানালো। দামেস্কবাসীরা শাইখের পিতা ও দাদার জ্ঞান ও পান্ডিত্যের খ্যাতির কথা আগে থেকেই অবহিত ছিল। পিতা আব্দুল হালীম দামেস্কের বড় মসজিদ জামে উমুবীতে দারস দেয়ার দায়িত্ব লাভ করলেন। শীঘ্রই তাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এলো।

কিশোর ইবনে তাইমীয়া অল্প সময়ের মধ্যেই কুরআন মজীদ মুখস্ত করে হাদীছ, ফিক্হ ও আরবী ভাষা চর্চায় মশগুল হলেন। সেই সাথে তিনি পিতার সাথে বিভিন্ন ইলমী মজলিসে শরীক হতে লাগলেন।

ইমামের খান্দানের সবাই মেধাবী ছিলেন। কিন্তু তাদের তুলনায় ইমামের স্মরণ শক্তি ছিল অসাধারণ। শিশুকাল থেকে তাঁর অসাধারণ স্মরণশক্তি শিক্ষকদের অবাক করে দিয়েছিল। দামেস্কের লোকদের মুখে মুখে তাঁর স্মরণশক্তির কথা আলোচনা হতো।

একদা আলেপ্পো নগরীর একজন বিখ্যাত আলেম দামেস্কে আসেন। তিনি কিশোর ইবনে তাইমীয়ার স্মরণশক্তির কথা লোকমুখে আগেই শুনেছিলেন। ইমামের স্মরণশক্তি পরীক্ষা করার জন্য তিনি একটি দর্জির দোকানে বসে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে একদল ছেলেকে আসতে দেখা গেলো। দর্জি ইঙ্গিতের মাধ্যমে ইমামকে দেখিয়ে দিল। তিনি ইমামকে ডাকলেন। ইমামের খাতায় হাদীছের তের-চৌদ্দটি মতন লিখে দিয়ে বললেন, পড়ো। কিশোর ইমাম ইবনে তাইমীয়া গভীর মনোযোগের সাথে হাদীছগুলো একবার পড়লেন। তিনি এবার খাতা উঠিয়ে নিয়ে বললেন, মুখস্ত শুনিয়ে দাও। ইবনে তাইমীয়া তা মুখস্ত শুনিয়ে দিলেন। এবার একগাদা সনদ লিখে দিয়ে পড়তে বললেন। পড়া হলে মুখস্ত বলতে বললেন। ইমাম সনদগুলোও মুখস্ত বললেন। শাইখ এতে অবাক হয়ে বললেন, বড় হয়ে এই ছেলে অসাধ্য সাধন করবে।

ইমাম ইবনে তাইমীয়া মাত্র সাত বছর বয়সে শিক্ষালয়ে প্রবেশ করেন এবং মাত্র বাইশ বছর বয়সে তাঁর জ্ঞানের ভান্ডার পরিপূর্ণ করে তুলেন। কুরআন, হাদীছ, ফিকাহ এবং উসূলের সাথে সাথে তিনি আরবী ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি দুই শতাধিক উস্তাদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন। কুরআনের তাফসীরের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশী। যেসব উস্তাদদের কাছ থেকে তিনি জ্ঞান অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে ইবনে কুদামা, ইবনে আসাকেরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

একটানা সাত থেকে বাইশ বছর পর্যন্ত জ্ঞান লাভের পর শিক্ষকতা ও জ্ঞান বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বাইশ বছর বয়সে উপনীত হলে তার পিতা আব্দুল হালীম ইবনে তাইমীয়া মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন দামেস্কের সর্ববৃহৎ দারুল হাদীছের প্রধান মুহাদ্দিছ। আব্দুল হালীমের মৃত্যুর পর এই পদটি শূন্য হয়ে যায়। সুযোগ্য পুত্র ইমাম ইবনে তাইমীয়া সেই পদ পূরণ করেন। তাঁর দারসে যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ ও আলেমগণ উপস্থিত হতে শুরু করেন। যুবক আলেমের জ্ঞান ও পান্ডিত্য সবাইকে মুগ্ধ ও চমৎকৃত করে। কিছু দিন পরেই দামেস্কের প্রধান মসজিদ জামে উমুবীতে তিনি পিতার স্থানে কুরআনের তাফসীর করার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। তাঁর জন্য বিশেষভাবে মিম্বার তৈরী করা হয়। প্রতি সপ্তাহেই তাঁর তাফসীরের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং ছাত্রের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। কুরআনের তাফসীরের সাথে সাথে সমকালীন সব সমস্যার কুরআনিক সমাধান বর্ণনা করতেন।

তাঁর হাতে তৈরী হয় যুগশ্রেষ্ঠ অসংখ্য আলেম। তাদের মধ্য হতে স্বনামধন্য লেখক ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম, ইমাম ইবনে কাছীর এবং ইমাম যাহাবীর নাম সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।

তিনি যেই পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, তার সকলেই ছিলেন আলেম। তারা ফিক্হের ক্ষেত্রে হাম্বলী মাজহাবের অনুসরণ করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি নির্দিষ্ট কোন মাজহাবের তাকলীদ করতেন না। কুরআন ও সুন্নাহর দলীলের অনুসরণ করতেন, সুন্নাতের সাহায্য করতেন এবং সালাফী নীতি গ্রহণ করতেন। সুন্নাত ও সালাফী নীতির পক্ষে তিনি এমন এমন যুক্তি-প্রমাণ পেশ করতেন, যা তাঁর পূর্বে অন্য কেউ পেশ করার সাহসিকতা প্রদর্শন করতেন না।

তাতারীদের আক্রমণের খবর যখন সিরিয়ায় পৌছল, তখন সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। তাতারীদের ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে মুসলিমগণ আগেই অবহিত ছিল। তাই তাদের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আশপাশের সকল এলাকা ছেড়ে লোকেরা রাজধানী দামেস্কের দিকে চলে আসতে লাগল। দামেস্কের লোকেরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে গেল। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে খবর আসলো যে, মিশরের বাদশাহ প্রচুর সেনাবাহিনীসহ দামেস্কের মুসলিমদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসছেন। এই খবর শুনে নগরীতে প্রাণের সাড়া জাগল। মুসলিমগণ নতুন উদ্যমে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি নিতে লাগল।

৬৯৯ হিজরীর ২৭ রবীউল আওয়াল মাসে তাতারী সম্রাট কাজানের সাথে মিশরের সুলতানের সংঘর্ষ হলো। অনেক চেষ্টা করেও এবং অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করেও মুসলিমরা শেষ রক্ষা করতে পারলোনা। মুসলিমরা হেরে গেল। মিশরের সুলতান পরাজিত সেনাবাহিনী নিয়ে কায়রোর পথে রওয়ানা হলেন।

এবার দামেস্কবাসীরা পড়লো মহাসংকটে। তাতারী সম্রাট সেনাদলসহ এবার বিজয়ী বেশে নগরে প্রবেশ করবে। তাতারী বিভীষিকার কথা চিন্তা করে বড় বড় আলেম ও নেতৃস্থানীয় লোকেরা শহর ত্যাগ করতে লাগল। এর আগেই শহরের বিচারক, পরিচিত আলেম-উলামা, সরকারী অফিসার, বড় বড় ব্যবসায়ী এমনকি দামেস্কের গভর্ণর নিজের শহরের মায়া ত্যাগ করে মিশরের পথে পাড়ি জমালেন। জনগণের এক অংশও তাতারীদের হত্যাকান্ডের ভয়ে দামেস্ক ছেড়ে দিল। এখন কেবল সাধারণ জনগণের একটি অংশই দামেস্কে রয়ে গেল।

এদিকে কাজানের সেনাদল দামেস্কে প্রবেশের সময় ঘনিয়ে আসছিল। এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং শহরের নেতৃস্থানীয় লোকেরা বসে একটা সিদ্বান্ত গ্রহণ করলেন। তারা সিদ্বান্ত নিলেন, ইমাম ইবনে তাইমীয়ার নেতৃত্বে নগরবাসীদের একটি প্রতিনিধি দল কাজানের নিকট যাবে। তারা নগরবাসীদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার একটি ফরমান লিখে আনবে।

এ উদ্দেশ্যে তাতারী সম্রাট কাজানের সামনে দলবল নিয়ে উপস্থিত হলেন ইসলামের অগ্রদূত ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ। কাজানের সম্মুখে ইমাম কুরআন-হাদীছের উদ্ধৃতি দিয়ে ন্যায়-ইনসাফের পক্ষে এবং যুলুম নির্যাতনের বিপক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি নির্ভয়ে কথা বলে যাচ্ছিলেন এবং কাজানের কাছাকাছি হচ্ছিলেন। তাঁর আওয়াজ ধীরে ধীরে উঁচু ও গুরুগম্ভীর হচ্ছিল। কুরআনের আয়াত ও হাদীছ শুনাতে শুনাতে তিনি কাজানের নিকটে, আরো নিকটে চলে যাচ্ছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো পরাক্রমশালী কাজান এতে মোটেই বিরক্তিবোধ করছিলেন না। বরং তিনি কান লাগিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। ইতিমধ্যেই কাজান ইমামের ভাষণে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে গেলেন। ইমামের ভাষণ কাজানকে অনুবাদ করে শুনানো হলে তিনি লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এই আলেমটি কে? আমি এমন সাহসী ও দৃঢ় সংকল্প লোক আজকের পূর্বে আর কখনো দেখিনি। ইতিপূর্বে আমাকে অন্য কেউ এমন প্রভাবিত করতে পারেনি।

লোকেরা ইবনে তাইমীয়া সম্পর্কে কাজানকে জানালো এবং ইমামের ইলম ও কার্যাবলী সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করলো।

ইমাম ইবনে তাইমীয়া কাজানকে সেদিন বলেছিলেন, হে কাজান! আপনি নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করেন। আমি জানতে পেরেছি, আপনার সাথে রয়েছেন কাযী, শাইখ, মুআয্যিন এবং ইমামগণ। এসব সত্ত্বেও আপনি মুসলিমদের উপর আক্রমণ করেছেন, তাদেরকে হত্যা করেছেন, তাদের নারীদেরকে বন্দী করেছেন এবং মুসলিমদের মালামাল লুণ্ঠন করেছেন। অথচ আপনার পিতা ও দাদা কাফের হওয়া সত্ত্বেও এ ধরণের কাজ করতে ইতস্ততঃ করতেন। তারা নিজেদের ওয়াদা-অঙ্গীকার পালন করেছেন। আর আপনি ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আপনি আল্লাহর বান্দাদের উপর মারাত্মক যুলুম করেছেন।

সে সময় ইমামের সাথে ছিলেন প্রধান বিচারপতি নাজমুদ্দীন আবুল আববাস। তিনি লিখেছেন, ইবনে তাইমীয়া যখন কাজানের সাথে কথা শেষ করলেন, তখন তাঁর ও সাথীদের সামনে খাবার রাখা হলো। সবাই খেতে লাগলেন। কিন্তু ইমাম হাত গুটিয়ে নিলেন। কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন, এ খাবার হালাল নয়। কারণ গরীব মুসলিমদের থেকে লুট করা ছাগল ও ভেড়ার মাংস সংগ্রহ করা হয়েছে এবং মযলুম মানুষের কাছ থেকে জোর করে কাঠ সংগ্রহ করে তা পাকানো হয়েছে।

অতঃপর কাজান ইমামকে দুআ করার আবেদন করলেন। ইমাম দু’আ করতে লাগলেন। দু’আতে তিনি বললেন, হে আল্লাহ! এই যুদ্ধের পিছনে কাজানের উদ্দেশ্য যদি হয় তোমার দ্বীনকে সাহায্য করা, তোমার কালেমাকে বুলন্দ করা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা, তাহলে তুমি তাঁকে সাহায্য করো। আর যদি দুনিয়ার রাজত্ব লাভ এবং লোভ-লালসা চরিতার্থ করাই তার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে তুমিই তাকে ধ্বংস করো। আশ্চর্যের বিষয় হলো ইমাম দুআ’ করছিলেন, আর কাযান আমীন আমীন বলে যাচ্ছিলেন।

কাযী আবুল আববাস নাজমুদ্দীন বলেন, ইমাম যখন কাযানের সামনে বক্তৃতা করছিলেন, তখন আমরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং নিজেদের জামা-কাপড় গুটিয়ে নিচ্ছিলাম। কি জানি কখন ইমামের উপর জল্লাদের তরবারী ঝলসে উঠবে এবং তার রক্তে আমাদের বস্ত্র রঞ্জিত হবে। কাযী নিযাম উদ্দীন আরো বলেন, কাযানের দরবার থেকে বের হয়ে এসে আমরা ইমামকে বললাম, আমরা আপনার সাথে যাবোনা। আপনি তো আমাদেরকে প্রায় মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং আপনার কারণে আমাদের উপর বিরাট মসীবত চলে আসার উপক্রম হয়েছিল। ইমাম তখন ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন, বরং আমিই তোমাদের সাথে যাবোনা। অতঃপর আমরা সকলেই তাঁকে রেখে চলে আসলাম। ইমাম একাই রওয়ানা দিলেন। রওয়ানা দেয়ার সময় কাযান আবার দুআ করার আবেদন করলেন। ইমাম পূর্বের দুআর পুনরাবৃত্তি করলেন।

ইমামকে একাকী চলতে দেখে স্বয়ং কাযান একদল সৈন্য পাঠিয়ে ইমামের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন। ইমামের একাকীত্বের খবর শুনে শহরের একদল লোক বের হয়ে এসে ইমামকে সঙ্গ দেয়ার কথাও জানা যায়। কাযী নাজমুদ্দীন আবুল আববাস বলেন, ইমাম নিরাপদে দামেস্কে ফিরে এলেন। ঐদিকে আমাদের অবস্থা এতই শোচনীয় হলো যে, রাস্তায় একদল লুটেরা বাহিনী আমাদের উপর আক্রমণ করলো এবং সর্বস্ব খুইয়ে নিল। আমরা একদম উলঙ্গ হয়ে শহরে ফিরলাম।

অত্যন্ত মর্যাদার সাথে ইমাম তাতারীর দরবার থেকে ফিরে আসলেন এবং নগরবাসীর জন্য নিরাপত্তার পরোয়ানা লিখিয়ে আনলেন। তাতারীরা যাদেরকে বন্দী করেছিল, তাদেরকেও ছাড়িয়ে আনলেন। তাতারীদের বর্বরতার কাহিনী তিনি যেমন শুনেছিলেন, তেমনি নিজ চোখেও তাদের তান্ডব দেখেছিলেন। তারপরও তিনি একটুও বিচলিত হননি। তাতারী সম্রাটের মুখোমুখি হয়ে কথা বলতে এবং তাতারী সেনাদের মধ্যে অবাধে চলাফেরা করতে তিনি একটুও ভীতি অনুভব করেন নি। তিনি বলতেন, যার অন্তরে রোগ আছে সেই কেবল আল্লাহ ছাড়া অন্যকে ভয় করতে পারে।

আল্লাহর দ্বীনকে সকল প্রকার কুসংস্কার-আবর্জনা ও শির্ক-বিদআত হতে পরিস্কার করার জন্য শাইখ যেমন আমরণ কলম ও জবান দ্বারা জিহাদ করেছেন, ঠিক তেমনি শাইখুল ইসলাম তাতারীদের বিরুদ্ধে সসস্ত্র সংগ্রাম করে ময়দানে বিশেষ বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন। মুসলিম উম্মাহর অস্তীত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে তাতারীদের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য মুসলিমদেরকে তিনি যেমন উৎসাহ দিয়েছেন, তেমনি নিজেও ময়দানে নেমে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ইতিপূর্বে সম্রাট কাযানের নিকট প্রবেশ করে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তার সাহসিকতা দেখে উপস্থিত সকলেই মুগ্ধ হয়েছিল। ৭০২ হিজরী সালের রামাযান মাসে তাতারীদের বিরুদ্ধে সিরিয়ার শাকহব নামক অঞ্চলে যেই যুদ্ধ হয়েছিল, তাতে তিনি মুজাহিদদের কাতারের সর্বাগ্রে ছিলেন। আল্লাহ তাআলা এই যুদ্ধে তাতারীদের বিরুদ্ধে মুসলিমদেরকে বিজয় দান করেন। এমনি আরো অনেক যুদ্ধেই তিনি বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন। মিশরের সুলতান যখন তাতারীদের হাতে দেশ সমর্পন করে দিতে চেয়েছিলেন, তখন তিনি সুলতানকে ধমক দিয়েছিলেন। জিহাদের প্রতি মুসলিমদেরকে উৎসাহ প্রদান এবং নিজে ময়দানে অবতীর্ণ হওয়ার ফলে মুসলিমদের অন্তর থেকে তাতারী আতঙ্ক দূরিভূত করে। আল্লাহর দ্বীনের প্রতি মুসলিমদের অবহেলার কারণে তাদের কপালে যেই দুর্দশা নেমে এসেছিল, কুরআন ও সুন্নাহর পথ বর্জন করার ফলে তারা রাজনৈতিকভাবে যে দুর্বলতা ও বিপর্যয়ের কবলে পড়েছিল, ইমাম ইবনে তাইমীয়ার সংস্কার ও জিহাদী আন্দোলনে মুসলিমরা নতুন করে জেগে উঠেছিল। মুসলিমগণ নতুন করে জিহাদী চেতনা ফিরে পায়। তাতারীরা ইসলামী সাম্রাজ্যের মূল কেন্দ্র বাগদাদ দখল করে খলীফাকে যবাই করে এবং লক্ষ লক্ষ মুসলিমের রক্তে রাজপথ রক্তাক্ত করে তাতারীরা যেভাবে একের পর এক অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সিরিয়ার দামেস্ক এবং মিশরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন ইবনে তাইমীয়া মুসলিমদেরকে সুসংগঠিত করে সিরিয়া ও মিশরের দিকে তাতারীদের অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে না দিলে মুসলিমদের ভাগ্যাকাশ কেমন হতো, তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।

অন্যায় ও অপকর্ম নির্মূলে ইবনে তাইমীয়া

তাতারীরা দামেস্ক ছেড়ে চলে যাওয়ার পর শহরে প্রকাশ্যে মদ পানসহ নানা অপকর্ম ব্যাপকতা লাভ করে। কারণ তখন সিরিয়া এক সরকারী নিয়ন্ত্রণহীন ছিল। তাই ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ একদল ছাত্র ও শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে শহরে প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন এবং মদের দোকানগুলোতে ঢুকে পড়েন। মদের পেয়ালা ও কুঁজো ভেঙ্গে ফেলতে লাগলেন এবং দোকানের মদ নালায় ঢেলে দিলেন। অন্যায় ও অপকর্মের আস্তানায় প্রবেশ করে লোকদেরকে উপদেশ দিতেন, ইসলামের নির্দেশ বুঝাতেন এবং তাওবা করাতেন। প্রয়োজনে শাস্তিও দিতেন। ইমামের অভিযানে সারা দামেস্ক শহর পুনরায় দ্বীনি পরিবেশ ফিরে পেল।

ভ্রান্ত তাসাউফের কবল থেকে ইসলামী আকীদাহর সংস্কারে ইবনে তাইমীয়া

সাহাবী ও তাবেঈদের যুগ থেকে খালেস ইসলামী তাসাউফের একটি ধারা চলে আসছিল। এবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনই ছিল এর একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। কিন্তু পরবর্তীতে এর কর্মধারায় নানা আবর্জনা এমনভাবে মিশ্রিত হয়ে গেল যে, মুসলিমদের এক বিরাট গোষ্ঠিও এই আবর্জনা ধোয়া পানি পান করেই আত্মতৃপ্তি লাভ করতে লাগল। হিজরী অষ্টম শতকে এসে সুফীবাদ এক গোমরাহী ও ভ্রান্ত মতবাদে পরিণত হয়। তাসাউফের লেবাস ধরে নির্ভেজাল ইসলামী আকীদাহর বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রীক দর্শন, সর্বেশ্বরবাদ, অদ্বৈত্ববাদ ইত্যাদির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। আবর্জনা মিশ্রিত সুফীবাদের দাবীদাররা ইলমকে যাহেরী-বাতেনীতে বিভক্ত করতে থাকে, একজনের বক্ষদেশ থেকে অন্যজনের বক্ষদেশে জ্ঞানের গোপন বিস্তার হয় বলে প্রচার করতে থাকে এবং কামেল পীর-মুরশিদ ও আল্লাহর প্রেমে পাগল ভক্তের জন্য শরীয়তের বিধি-বিধান মেনে চলার প্রয়োজন নেই ইত্যাদি ভ্রান্ত চিন্তা-বিশ্বাস তাসাউফের নামে মুসলিমদের বিরাট এক অংশের উপর চেপে বসে।
আল্লাহর অলী ও তাঁর নেক বান্দাদের ব্যাপারে অমুসলিমদের ন্যায় মুসলিমরাও বাড়াবাড়ি শুরু করে। তাদের কাছে ফরিয়াদ জানাতে এবং নিজেদের দিলের মাকসুদ পূরা করতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আলেমগণও অলীদের কবরে ধরণা দিত।
ইসলামের নামে এই সব জাহেলীয়াতের অন্ধকারের বিরুদ্ধে জিহাদ করে খালেস তাওহীদের দিকে মুসলিমদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য এমন একজন মর্দে মুজাহিদের প্রয়োজন ছিল, যিনি তাওহীদ ও শির্কের পার্থক্য সম্পর্কে সুস্পষ্টরূপে অবগত, জাহেলীয়াতের সকল চেহারা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে যিনি ওয়াকিফহাল এবং যিনি জাহেলীয়াতের মূলোৎপাটন করে মুসলিমদের জন্য সরাসরি কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবী ও তাবেঈদের আমল থেকে নির্ভেজাল আকীদাহ ও আমল তুলে ধরবেন। এই গুরু দায়িত্বটি পালন করার জন্য হিজরী অষ্টম শতকে আল্লাহ তাআলা ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহকে চয়ন করেন। তিনি মুসলিমদের সামনে ইসলামের পরিচ্ছন্ন আকীদাহ্ বিশ্বাস তুলে ধরেন এবং সকল প্রকার শির্ক-বিদআত থেকে ইসলামকে পরিশুদ্ধ করেন।

ওয়াহদাতুল উজুদ ও সর্বেশ্বরবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

অষ্টম হিজরী শতকে দু’টি দার্শনিক মতবাদ মুসলিম সুফী ও দার্শনিকদের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠে। ইমাম ইবনে তাইমীয়াকে এ ভ্রান্ত মতবাদ দু’টির বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করতে হয়। একটি হলো ওয়াহদাতুল উজুদ এবং অন্যটি হুলুল ও ইত্তেহাদ। আমাদের ভারতবর্ষের দার্শনিক পরিভাষায় এ মতবাদ দু’টিকে বলা হয় অদ্বৈতবাদ ও সর্বেশ্বরবাদ। পরবর্তীকালে ভারতীয় উপমহাদেশের সুফীদের মধ্যেও এ মতবাদ দু’টি প্রবেশ করে। আনন্দের বিষয় হলো, মুজাদ্দেদ আলফেসানী এই মতবাদ দু’টির বিরুদ্ধে প্রচন্ড সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। তবে অতি দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, ভারতবর্ষের সুফীদের মধ্যে আজও এই মতবাদ দু’টির উপস্থিতি প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যায়।

এখন পাঠকগণ প্রশ্ন করতে পারেন, আসলে এই মতবাদ দু’টির ব্যাখ্যা কী? ইমাম ইবনে তাইমীয়া এই মতবাদ দু’টির প্রধান প্রবক্তা মুহীউদ্দীন ইবনে আরাবীর উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, অস্তিত্ব মাত্র একটি। সৃষ্টির অস্তিত্বই স্রষ্টার অস্তিত্ব। (নাউযুবিল্লাহ) তারা স্রষ্টা ও সৃষ্টি, -এ দু'টো পৃথক সত্তা হিসাবে তারা স্বীকার করেনা। বরং তাদের মতে স্রষ্টাই হলো সৃষ্টি আর সৃষ্টিই হলো স্রষ্টা। তাদের মতে বনী ইসরাঈলের যারা বাছুর পূজা করেছিল, তারা আসলে আল্লাহকেই পূজা করেছিল। তারা আরো বলে, ফেরাউনের ‘‘আনা রাববুকুমুল আ’লা’’ অর্থাৎ আমি তোমাদের মহান প্রভু, -এই দাবীতে সত্যবাদী ছিল। ইবনে আরাবী নূহ আলাইহিস সাল্লামের সমালোচনা করে বলে যে, তার কাওমের লোকেরা মূর্তি পূজার মাধ্যমে আসলে আল্লাহকেই পূজা করেছিল। আর তাঁর সময়ের মহাপ্লাবন ছিল মারেফতে ইলাহীর প্লাবন। এ প্লাবনে তারা ডুবে গিয়েছিল।
ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ ওয়াহদাতুল উজুদ ও সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাসী মতবাদের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করাকে তাতারীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন।
সৃষ্টি এবং স্রষ্টা কখনই এক হতে পারে না। আমরা মস্তিস্কের মধ্যে যা কল্পনা করি তার সবগুলোর অস্তিত্ব মস্তিস্কের বাইরে খুঁজে পাওয়া যায়না। আমার মাথায় দশহাত বিশিষ্ট এবং তিন মুখ বিশিষ্ট মানুষের কল্পনা জাগতে পারে। তার অর্থ এই নয় যে, বাস্তবে এই ধরণের মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে। মস্তিস্কের বাইরে যেসব বস্ত্তর অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে, তা মূলতঃ দুই প্রকার। (১) সৃষ্টি ও (২) স্রষ্টা। পৃথিবীতে এমন কোন জিনিষ খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যা এমনিতেই হয়ে গেছে। প্রত্যেক জিনিষের একজন উদ্ভাবক ও কারিগর রয়েছে। তাদের উভয়ের স্বভাব এবং বৈশিষ্ট এক ও অভিন্ন নয়। বরং কম্পিউটারের বৈশিষ্ট এবং যে উহা তৈরী করেছে, তার স্বভাব ও বৈশিষ্ট একরকম নয়। মহান আল্লাহ স্বীয় জ্ঞান, কুদরত এবং ইচ্ছা দ্বারা এই আসমান-যমীন ও এতোদুভয়ের মধ্যকার সকল বস্ত্ত তৈরী করেছেন। সুতরাং তিনি এবং তাঁর তৈরী মাখলুক এক হয় কিভাবে? তাঁর সুউচ্চ সিফাত এবং সৃষ্টির সাধারণ স্বভাব ও বৈশিষ্ট এক রকম হয় কিভাবে?
আল্লাহ্ ব্যতীত বাকী সকল বস্ত্ত হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ مَا لَكُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا شَفِيعٍ أَفَلَا تَتَذَكَّرُونَ﴾


‘‘আল্লাহই আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দুইয়ের মাঝখানে যা কিছু আছে সব সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে এবং এরপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন তিনি ছাড়া তোমাদের কোন সাহায্যকারী নেই এবং নেই তার সামনে সুপারিশকারী, তারপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবেনা?’’ (সূরা সাজদাহ: ৪) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

﴿بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنَّى يَكُونُ لَهُ وَلَدٌ وَلَمْ تَكُنْ لَهُ صَاحِبَةٌ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾


‘‘তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের উদ্ভাবক। কিরূপে আল্লাহর পুত্র হতে পারে, অথচ তাঁর কোন সঙ্গিনী নেই? তিনি যাবতীয় কিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি সব বস্তু সম্পর্কে সুবিজ্ঞ। (সূরা আনআম: ১০১)
বাস্তব কথা হচ্ছে, অস্তিত্ব একটি নয়; বরং দু’টি। একটি স্রষ্টার (আল্লাহর) অস্তিত্ব, আরেকটি সৃষ্টির অস্তিত্ব।
কুরআন ও সহীহ হাদীছে দিবালোকের মত পরিস্কার করে বলা আছে যে, মহান আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা, তিনি আরশের উপরে সমুন্নত, তার সুউচ্চ গুণাবলী সৃষ্টি জীবের গুণাগুণ, স্বভাব ও বৈশিষ্ট থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সাথে মিশ্রিত নন, কোন সৃষ্টির ভিতরে নন; যেমন সুফীরা ধারণা করে থাকে। বরং তিনি সৃষ্টির বহু উপরে, সকল সৃষ্টি তার নীচে, তিনি আসমানের উপরে, আরশের উপর সমুন্নত। উপরে থাকাই আল্লাহর সত্তাগত সিফাত বা বিশেষণ।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৬ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »