হজ ও উমরার ইহরামের ফলে যেসব বৈধ কাজ নিষিদ্ধ হয়ে যায় সেগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।

পুরুষ মহিলা উভয়ের জন্য নিষিদ্ধ।

কেবল পুরুষের জন্য নিষিদ্ধ।

কেবল মহিলার জন্য নিষিদ্ধ।

পুরুষ-মহিলা উভয়ের জন্য নিষিদ্ধ বিষয় সাতটি

প্রথমত. মাথার চুল ছোট করা বা পুরোপুরি মুণ্ডানো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَلَا تَحۡلِقُواْ رُءُوسَكُمۡ حَتَّىٰ يَبۡلُغَ ٱلۡهَدۡيُ مَحِلَّهُۥۚ ﴾ [البقرة: ١٩٦]

‘আর তোমরা তোমাদের মাথা মুণ্ডন করো না, যতক্ষণ না পশু তার যথাস্থানে পৌঁছে।’[1]

তবে অসুস্থতা কিংবা ওযরের কারণে ইহরাম অবস্থায় মাথার চুল ফেলতে বাধ্য হলে কোন পাপ হবে না, তবে তার ওপর ফিদয়া ওয়াজিব হবে। কা‘ব ইবন ‘উজরা রা. বলেন, আমার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গেলাম। তখন আমার মুখে উঁকুন গড়িয়ে পড়ছিল। তা দেখে তিনি বললেন, তুমি এতটা কষ্ট পাচ্ছ এটা আমার ধারণা ছিল না। তুমি কি ছাগল যবেহ করতে পারবে? আমি বললাম, না। অতঃপর নাযিল হল-

﴿فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ بِهِۦٓ أَذٗى مِّن رَّأۡسِهِۦ فَفِدۡيَةٞ مِّن صِيَامٍ أَوۡ صَدَقَةٍ أَوۡ نُسُكٖۚ ﴾ [البقرة: ١٩٦]

‘আর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ কিংবা তার মাথায় যদি কোনো কষ্ট থাকে তবে সিয়াম কিংবা সদকা অথবা পশু যবেহ এর মাধ্যমে ফিদয়া দেবে।’[2] এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তাকে বলেন,

«احْلِقْ رَأْسَكَ وَصُمْ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ ، أَوْ أَطْعِمْ سِتَّةَ مَسَاكِينَ ، أَوِ انْسُكْ بِشَاة».

‘তুমি তোমার মাথা মুণ্ডন কর এবং তিন দিন সিয়াম পালন কর, অথবা ছয়জন মিসকীনকে খাবার দান কর, নতুবা একটি ছাগল যবেহ কর।’[3]

এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অপর এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«صَوْمُ ثَلاَثَةِ أَيَّامٍ أَوْ إِطْعَامُ سِتَّةِ مَسَاكِينَ نِصْفَ صَاعٍ طَعَامًا لِكُلِّ مِسْكِينٍ».

‘তিন দিন সিয়াম পালন করতে হবে, কিংবা ছয়জন মিসকীনকে আহার করাতে হবে। প্রত্যেক মিসকীনের জন্য অর্ধ সা‘ (এক কেজি ২০ গ্রাম) খাবার।’[4]

সুতরাং মাথা মুণ্ডনের ফিদয়া তিনভাবে দেয়া যায় : ছাগল যবেহ করা অথবা তিনটি রোজা রাখা কিংবা ছয়জন মিসকীনকে পেট পুরে খাওয়ানো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘ব ইবন উজরা রা. কে নির্দেশ দিলেন,

«أَنْ يُطْعِمَ فَرَقًا بَيْنَ سِتَّةٍ ، أَوْ يُهْدِيَ شَاةً ، أَوْ يَصُومَ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ».

‘সে যেন ছয়জন মিসকীনকে খাবার দেবে, কিংবা একটি ছাগল যবেহ করবে অথবা তিনদিন সাওম পালন করবে।’[5]

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে স্পষ্ট হয় যে, সিয়ামের সংখ্যা হচ্ছে তিনটি। সদকার পরিমাণ হচ্ছে ছয় জন মিসকীনের জন্য তিন সা‘ (সাত কেজি ৩০ গ্রাম)। প্রতি মিসকীনের জন্য অর্ধ সা’ (এক কেজি ২০ গ্রাম)। আর পশু যবেহের ইচ্ছা করলে ছাগল বা তার চেয়ে বড় যেকোনো পশু যবেহ করতে হবে। এ তিনটির যেকোনো একটি ফিদয়া হিসেবে প্রদানের সুযোগ রয়েছে। শরীয়ত বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তবে পশু যবেহ করার মাধ্যমে ফিদয়ার ক্ষেত্রে এমন ছাগল হওয়া বাঞ্ছনীয়, যা কুরবানীর উপযুক্ত; যার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যাবতীয় ত্রুটি থেকে মুক্ত। আলিমগণ একে ‘ফিদয়াতুল আযা’ তথা কষ্টজনিত কারণে ফিদয়া হিসেবে অভিহিত করেছেন, কারণ আল্লাহ তা‘আলা একে কুরআনুল কারীমে﴿أَوۡ بِهِۦٓ أَذٗى مِّن رَّأۡسِهِۦ فَفِدۡيَةٞ ﴾ [البقرة: ١٩٦] বলে বর্ণনা করেছেন।[6]

বিশুদ্ধ মতানুসারে পরিপূর্ণরূপে মাথা মুণ্ডন করা ছাড়া উল্লেখিত ফিদয়া ওয়াজিব হবে না। কেননা পরিপূর্ণ মাথা মুণ্ডন ছাড়া হলক বলা হয় না। ইবন আব্বাস রা. বলেন,

«احْتَجَمَ وَهُوَ مُحْرِمٌ فِي رَأْسِهِ»

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় নিজের মাথায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন।’[7]

বলা বাহুল্য, মাথায় শিঙ্গা লাগানোর স্থান থেকে অবশ্যই চুল ফেলে দিতে হয়েছে; কিন্তু একারণে তিনি ফিদয়া দিয়েছেন এরকম কোন প্রমাণ নেই।

মাথা ছাড়া দেহের অন্য কোন স্থানের লোম মুণ্ডন করলে অধিকাংশ আলিম তা মাথার চুলের ওপর কিয়াস করে উভয়টিকে একই হুকুমের আওতাভুক্ত করেছেন। কারণ মাথা মুণ্ডন করার ফলে যেমন পরিচ্ছন্নতা ও স্বাচ্ছন্দ্য অনুভূত হয়, তেমনি দেহের লোম ফেললেও এক প্রকার স্বস্তি অনুভূত হয়। তবে তারা কিছু ক্ষেত্রে ফিদয়ার কথা বলেছেন, কিছু ক্ষেত্রে দমের কথা বলেছেন।[8] বস্তুত এ ক্ষেত্রে দম বা ফিদয়া দেয়া আবশ্যক হওয়ার সপক্ষে কোন শক্তিশালী প্রমাণ নেই। কিন্তু হাজীদের উচিত ইহরাম অবস্থায় শরীরের কোন অংশের চুল বা লোম যেন ছেড়া বা কাটা না হয়। তারপরও যদি কোন চুল পড়ে যায়, তবে তাতে দোষের কিছু নেই।

দ্বিতীয়ত. হাত বা পায়ের নখ উপড়ে ফেলা, কর্তন কিংবা ছোট করা।

ইহরাম অবস্থায় মহিলা-পুরুষ উভয়ের জন্য এধরনের কাজ নিষিদ্ধ হওয়ার কথা যারা বলেছেন তারা চুল মুণ্ডন করার হুকুমের ওপর কিয়াস করেই বলেছেন। কুরআন বা হাদীসে এ সম্পর্কে বর্ণনা নেই। ইবন মুনযির বলেন, আলিমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, নখ কাটা মুহরিমের জন্য হারাম। হাত কিংবা পায়ের নখ-উভয়ের ক্ষেত্রে একই হুকুম। তবে যদি নখ ফেটে যায় এবং তাতে যন্ত্রণা হয় তবে যন্ত্রণাদায়ক স্থানটিকে ছেঁটে দেয়ায় কোন ক্ষতি নেই। এ কারণে কোন ফিদয়া ওয়াজিব হবে না।[9]

তৃতীয়ত. ইহরাম বাঁধার পর শরীর, কাপড় কিংবা এ দু’টির সাথে সম্পৃক্ত অন্য কিছুতে সুগন্ধি জাতীয় কিছু ব্যবহার করা।

ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত হাদীস দ্বারা জানা যায়, মুহরিমের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«وَلاَ تَلْبَسُواشَيْئًا مِنَ الثِّيَابِ مَسَّهُ زَعْفَرَانٌ ، وَلاَ وَرْسٌ».

‘তোমরা জাফরান কিংবা ওয়ারস (এক জাতীয় সুগন্ধি) লাগানো কাপড় পরিধান করবে না।’[10] অপর এক হাদীসে তিনি আরাফায় অবস্থানকালে বাহনে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণকারী এক সাহাবী সম্পর্কে বলেন,

«وَلاَ تُقَرِّبُوهُ طِيبًا فَإِنَّهُ يُبْعَثُ يُهِلُّ».

‘তার কাছে তোমরা সুগন্ধি নিও না। কারণ তাকে এমন অবস্থায় উঠানো হবে যে, সে তালবিয়া পাঠ করতে থাকবে।’[11] অপর এক বর্ণনায় এসেছে,

«وَلاَ تُمِسُّوهُ طِيبًا فَإِنَّهُ يُبْعَثُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مُلَبِّيًا».

‘আর তোমরা তাকে সুগন্ধি স্পর্শ করাবে না। কারণ কিয়ামত দিবসে তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় তাকে উঠানো হবে।’[12]

সুতরাং মুহরিমের জন্য সুগন্ধি বা এ জাতীয় কিছুর ব্যবহার বৈধ নয়। যেমন পানি মিশ্রিত জাফরান, যা পানীয়ের স্বাদে ও গন্ধে প্রভাব সৃষ্টি করে, অথবা চায়ের সাথে এতটা গোলাপ জলের মিশ্রণ, যা তার স্বাদে ও গন্ধে পরিবর্তন ঘটায়। তেমনি মুহরিম ব্যক্তি সুগন্ধি মিশ্রিত সাবান ব্যবহার করবেন না।[13] ইহরামের পূর্বে ব্যবহৃত সুগন্ধির কিছু যদি অবশিষ্ট থাকে তবে তাতে কোন সমস্যা নেই। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে,

«كَأَنِّى أَنْظُرُ إِلَى وَبِيصِ الْمِسْكِ فِى مَفْرِقِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ مُحْرِمٌ».

‘ইহরাম অবস্থাতেই আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­ামের মাথার সিঁথিতে যেন মিশকের চকচকে অবস্থার দিকে তাকাচ্ছিলাম।’[14] অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরামের পূর্বে যে মিশক ব্যবহার করেছিলেন তার চিহ্ন ইহরামের পরেও তাঁর সিঁথিতে অবশিষ্ট ছিল।

চতুর্থত. বিবাহ সংক্রান্ত আলোচনা করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«لاَ يَنْكِحُ الْمُحْرِمُ وَلاَ يُنْكَحُ وَلاَ يَخْطُبُ».

‘মুহরিম বিবাহ করবে না, বিবাহ দেবে না এবং বিবাহের প্রস্তাবও পাঠাবে না।’[15]

সুতরাং কোন মুহরিমের জন্য বিয়ে করা, কিংবা অলী ও উকিল হয়ে কারো বিয়ের ব্যবস্থা করা অথবা ইহরাম থেকে মুক্ত হওয়া অবধি কাউকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো বৈধ নয়। মহিলা মুহরিমের জন্যও একই হুকুম।

পঞ্চমত. ইহরাম অবস্থায় সহবাস করা।

আলিমদের ঐকমত্যে ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর মধ্যে কেবল সহবাসই হজকে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَمَن فَرَضَ فِيهِنَّ ٱلۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي ٱلۡحَجِّۗ﴾ [البقرة: ١٩٧]

‘যে ব্যক্তি এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে, তার জন্য হজের সময়ে স্ত্রী সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ বিধেয় নয়।’[16]

আয়াতে উল্লে­খিত الرَّفَثُ (আররাফাসু) শব্দটি একই সাথে সহবাস ও সহবাসজাতীয় যাবতীয় বিষয়কেই সন্নিবেশ করে। সুতরাং ইহরামের অবৈধ বিষয়গুলোর মধ্যে সহবাসই সবচে’ বেশি ক্ষতিকর। এর কয়েকটি অবস্থা হতে পারে :

প্রথম অবস্থা : উকুফে আরাফা বা আরাফায় অবস্থানের পূর্বে মুহরিম ব্যক্তির স্ত্রী-সম্ভোগে লিপ্ত হওয়া। এমতাবস্থায় সমস্ত আলিমের মতেই তার হজ বাতিল হয়ে যাবে। তবে তার কর্তব্য হচ্ছে, হজের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এবং পরবর্তীকালে তা কাজা করা। তাছাড়া তাকে দম (পশু কুরবানী) দিতে হবে। পশুটি কেমন হবে এ ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম আবূ হানীফা রহ. বলেন, তিনি একটি ছাগল যবেহ করবেন।[17] অন্য ইমামগণের মতে, একটি উট যবেহ করবেন।

ইমাম মালেক রহ. বলেন, ‘আমি জানতে পেরেছি যে, উমর, আলী ও আবূ হুরায়রা রা.-কে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, যে মুহরিম থাকা অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সহবাসে লিপ্ত হয়েছে। তাঁরা ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বললেন, সে আপন গতিতে হজ শেষ করবে। তারপর পরবর্তী বছর হজ আদায় করবে এবং হাদী যবেহ করবে।[18] তিনি বলেন, আলী রা. বলেছেন, পরবর্তী বছর যখন তারা হজের ইহরাম বাঁধবে, তখন হজ শেষ করা অবধি স্বামী-স্ত্রী একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে।’[19]

মোটকথা, সর্বসম্মত মত হল, আরাফায় অবস্থানের পূর্বে স্ত্রী সহবাস করলে হজ বাতিল হয়ে যায়। আর বড় জামরায় পাথর মারার পর এবং হজের ফরয তাওয়াফের পূর্বে যদি কেউ স্ত্রী সহবাস করে, তাহলে এ ক্ষেত্রে সকলের মত হল, তার হজ বাতিল হবে না তবে ফিদয়া দিতে হবে। আর যদি আরাফায় অবস্থানের পর এবং বড় জামরায় পাথর মারার পূর্বে সহবাস হয়, তবে ইমাম আবূ হানীফা রহ. ছাড়া অধিকাংশ ইমামের মতে হজ নষ্ট হয়ে যাবে।[20]

দ্বিতীয় অবস্থা : আরাফায় অবস্থানের পরে, বড় জামরায় পাথর মারা এবং হজের ফরয তাওয়াফের পূর্বে যদি সহবাস সংঘটিত হয়, তবে ইমাম আবূ হানীফা রহ. বলেন, তার হজ আদায় হয়ে যাবে, কিন্তু তার ওপর একটি উট যবেহ করা কর্তব্য। এ ব্যাপারে তিনি হাদীসের বাহ্যিক ভাষ্য থেকেই তিনি দলীল গ্রহণ করেছেন। হাদীসে এসেছে الحَجُّ عَرَفَةُ (আল-হাজ্জু আরাফাতু) অর্থাৎ হজ হচ্ছে আরাফা।[21]

পক্ষান্তরে ইমাম মালেক, শাফিঈ ও আহমদসহ অধিকাংশ ফকীহর মতে তার হজ ফাসেদ। এ অবস্থায় তাকে দু’টি কাজ করতে হবে : এক. তার ওপর ফিদয়া ওয়াজিব হবে। আর সে ফিদয়া আদায় করতে হবে একটি উট বা গাভি দ্বারা, যা কুরবানী করার উপযুক্ত এবং তার সব মাংস মিসকীনদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে; নিজে কিছুই গ্রহণ করতে পারবে না। দ্বিতীয়. সহবাসের ফলে হজটি ফাসিদ বলে গণ্য হবে। তবে এ হজটির অবশিষ্ট কার্যক্রম সম্পন্ন করা তার কর্তব্য এবং বিলম্ব না করে পরবর্তী বছরেই ফাসিদ হজটির কাযা করতে হবে।

তৃতীয় অবস্থা : বড় জামরায় পাথর মারা ও মাথা মুণ্ডনের পর এবং হজের ফরয তাওয়াফের পূর্বে সহবাস সংঘটিত হলে, হজটি সহীহ হিসেবে গণ্য হবে। তবে প্রসিদ্ধ মতানুসারে তার ওপর দু’টি বিষয় ওয়াজিব হবে। এক. একটি ছাগল ফিদয়া দেবেন, যার সব মাংস গরীব-মিসকীনদের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে। ফিদয়া দানকারী কিছুই গ্রহণ করবে না। দুই. হারাম এলাকার বাইরে গিয়ে নতুন করে ইহরাম বাঁধবেন এবং মুহরিম অবস্থায় হজের ফরয তাওয়াফের জন্য লুঙ্গি ও চাদর পরে নেবেন।[22]

ষষ্ঠত. ইহরাম অবস্থায় কামোত্তেজনাসহ স্বামী-স্ত্রীর মেলামেশা। যেমন চুম্বন, স্পর্শ ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَمَن فَرَضَ فِيهِنَّ ٱلۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي ٱلۡحَجِّۗ﴾ [البقرة: ١٩٧]

‘যে ব্যক্তি এ মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে, তার জন্য হজের সময়ে স্ত্রী সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ বিধেয় নয়।’[23]

আয়াতে উল্লে­খিত الرَّفَثُ শব্দটি একই সাথে নানা অর্থের সন্নিবেশ করে : ১. সহবাস বা সম্ভোগ ২. সহবাস পূর্ব মেলামেশা-যেমন কামোত্তেজনার সাথে চুম্বন, স্পর্শ ও আমোদ-প্রমোদ ইত্যাদি। সুতরাং মুহরিমের জন্য কামোত্তেজনার সাথে স্বামী-স্ত্রীর চুম্বন, স্পর্শ, আমোদ-প্রমোদ ইত্যাদি কোনটিই বৈধ নয়। এমনিভাবে মুহরিম অবস্থায় স্ত্রীর জন্য তার স্বামীকে সুযোগ করে দেয়াও বৈধ নয়। কামভাব নিয়ে স্ত্রীর প্রতি নজর করাও নিষিদ্ধ। ৩. সহবাস সম্পর্কিত কথপোকথন।[24]

আয়াতে উল্লি­খিত الْفُسُوقُ (আল-ফুসুক) শব্দটি একই সাথে আল্লাহর আনুগত্যের যাবতীয় বিষয় থেকে বের হয়ে যাওয়া বুঝায়।[25]

সপ্তমত. ইহরাম অবস্থায় শিকার করা।

হজ বা উমরা- যেকোনো অবস্থাতেই মুহরিমের জন্য স্থলভাগের প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ-এ ব্যাপারে আলিমগণ একমত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَحُرِّمَ عَلَيۡكُمۡ صَيۡدُ ٱلۡبَرِّ مَا دُمۡتُمۡ حُرُمٗاۗ ﴾ [المائ‍دة: ٩٦]

‘আর স্থলের শিকার তোমাদের ওপর হারাম করা হয়েছে যতক্ষণ তোমরা ইহরাম অবস্থায় থাক।’[26] অন্যত্র উল্লিখিত হয়েছে,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَقۡتُلُواْ ٱلصَّيۡدَ وَأَنتُمۡ حُرُمٞۚ ﴾ [المائ‍دة: ٩٥]

‘হে মুমিনগণ, ইহরামে থাকা অবস্থায় তোমরা শিকারকে হত্যা করো না।’[27]

সুতরাং শিকারকৃত জন্তু ইহরাম অবস্থায় হত্যা করা বৈধ নয়। তবে আলিমগণ প্রাণী শিকার বলতে এমন সব প্রাণী বলে একমত পোষণ করেছেন, যার মাংস মানুষের খাদ্য এবং যা বন্য প্রাণীভুক্ত। তাই ‘শিকার’ বলতে এমন সব প্রাণী বুঝায়, যা স্থলভাগে বাস করে, হালাল ও প্রকৃতিগতভাবেই বন্য। যেমন হরিণ, খরগোশ ও কবুতর ইত্যাদি।

উল্লি­খিত প্রাণীসমূহের শিকার যেমন নিষিদ্ধ তেমনি সেগুলোকে হত্যা করা এবং হত্যার সহায়তা করাও নিষিদ্ধ। যেমন দেখিয়ে দেয়া, ইশারা করা বা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা। আবূ কাতাদা রা. থেকে এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

قَالَ كُنْتُ يَوْمًا جَالِسًا مَعَ رِجَالٍ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فِى مَنْزِلٍ فِى طَرِيقِ مَكَّةَ وَرَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم نَازِلٌ أَمَامَنَا وَالْقَوْمُ مُحْرِمُونَ ، وَأَنَا غَيْرُ مُحْرِمٍ ، فَأَبْصَرُوا حِمَارًا وَحْشِيًّا ، وَأَنَا مَشْغُولٌ أَخْصِفُ نَعْلِى ، فَلَمْ يُؤْذِنُونِى بِهِ ، وَأَحَبُّوا لَوْ أَنِّى أَبْصَرْتُهُ ، وَالْتَفَتُّ فَأَبْصَرْتُهُ ، فَقُمْتُ إِلَى الْفَرَسِ فَأَسْرَجْتُهُ ثُمَّ رَكِبْتُ وَنَسِيتُ السَّوْطَ وَالرُّمْحَ فَقُلْتُ لَهُمْ نَاوِلُونِى السَّوْطَ وَالرُّمْحَ . فَقَالُوا لاَ وَاللَّهِ ، لاَ نُعِينُكَ عَلَيْهِ بِشَىْءٍ . فَغَضِبْتُ فَنَزَلْتُ فَأَخَذْتُهُمَا ، ثُمَّ رَكِبْتُ ، فَشَدَدْتُ عَلَى الْحِمَارِ فَعَقَرْتُهُ ، ثُمَّ جِئْتُ بِهِ وَقَدْ مَاتَ ، فَوَقَعُوا فِيهِ يَأْكُلُونَهُ ، ثُمَّ إِنَّهُمْ شَكُّوا فِى أَكْلِهِمْ إِيَّاهُ ، وَهُمْ حُرُمٌ ، فَرُحْنَا وَخَبَأْتُ الْعَضُدَ مَعِى ، فَأَدْرَكْنَا رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَسَأَلْنَاهُ عَنْ ذَلِكَ فَقَالَ «مَعَكُمْ مِنْهُ شَىْءٌ». فَقُلْتُ نَعَمْ . فَنَاوَلْتُهُ الْعَضُدَ فَأَكَلَهَا ، حَتَّى نَفَّدَهَا وَهْوَ مُحْرِمٌ .

‘আবূ কাতাদা রা. বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একদল সাহাবীর সাথে মক্কার পথে এক জায়গায় বসা ছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আমাদের অগ্রভাগে। সাহাবীগণ ছিলেন মুহরিম আর আমি ছিলাম হালাল। তাঁরা একটি বন্য গাধা দেখতে পেলেন। আমি তখন জুতো সেলাইয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তাঁরা আমাকে বিষয়টি অবহিত করেননি। তবে তাঁরা চাচ্ছিলেন যেন আমি তা দেখতে পাই। অতপর আমি তাকালাম এবং সেটাকে দেখতে পেলাম। অতপর আমি আমার ঘোড়ার দিকে গেলাম এবং তার মুখে লাগাম পরালাম। তারপর আমি ঘোড়ায় চড়লাম; কিন্তু তীর-ধনুক ভুলে গেলাম। আমি তাঁদের বললাম, আমাকে তীর ধনুক দাও। তাঁরা বললেন, না, আল্লাহর কসম! আমরা আপনাকে এ কাজে কোনরূপ সাহায্য করতে পারব না। এতে আমি রাগান্বিত হয়ে নেমে এলাম। অতপর তীর-ধনুক নিয়ে ঘোড়ায় চড়লাম এবং গাধার ওপর আক্রমণ করলাম। এমনকি বন্য গাধাটিকে যবেহ করে নিয়ে এলাম। ইতোমধ্যে সেটি মরে গিয়েছিল। সকলে তা থেকে আহার করতে লেগে গেলেন। যেহেতু তাঁরা ছিলেন মুহরিম সেহেতু পরে তাদের গাধাটি আহারের ব্যাপারে সন্দেহ হল। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে গেলাম। আমি তার সামনের পা লুকিয়ে আমার সাথে নিলাম। অতপর আমরা তাঁকে পেয়ে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। আমরা রাসূলুল্লাহ এ ব্যাপারে তারা রাসূলুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি ইঙ্গিত করেছ বা কোন কিছুর নির্দেশ দিয়েছ? আমি উত্তর দিলাম, না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সামনের পায়াটি দিলাম। তিনি তা খেলেন। এমনকি শেষ করে ফেললেন। অথচ তিনি মুহরিম ছিলেন।’[28]

মুহরিম ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে শিকার হত্যা করে, তবে এর জন্য তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَمَن قَتَلَهُۥ مِنكُم مُّتَعَمِّدٗا فَجَزَآءٞ مِّثۡلُ مَا قَتَلَ مِنَ ٱلنَّعَمِ يَحۡكُمُ بِهِۦ ذَوَا عَدۡلٖ مِّنكُمۡ هَدۡيَۢا بَٰلِغَ ٱلۡكَعۡبَةِ أَوۡ كَفَّٰرَةٞ طَعَامُ مَسَٰكِينَ أَوۡ عَدۡلُ ذَٰلِكَ صِيَامٗا لِّيَذُوقَ وَبَالَ أَمۡرِهِۦۗ عَفَا ٱللَّهُ عَمَّا سَلَفَۚ وَمَنۡ عَادَ فَيَنتَقِمُ ٱللَّهُ مِنۡهُۚ وَٱللَّهُ عَزِيزٞ ذُو ٱنتِقَامٍ ٩٥ ﴾ [المائ‍دة: ٩٥]

‘আর যে তোমাদের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে তা হত্যা করবে তার বিনিময় হল, যা হত্যা করেছে তার অনুরূপ গৃহপালিত পশু, যার ফয়সালা করবে তোমাদের মধ্যে দু’জন ন্যায়পরায়ণ লোক- কুরবানীর জন্তু হিসাবে কা‘বায় পৌঁছতে হবে। অথবা মিসকীনকে খাবার দানের কাফফারা কিংবা সমসংখ্যক সিয়াম পালন, যাতে সে নিজ কর্মের শাস্তি আস্বাদন করে। যা গত হয়েছে তা আল্লাহ ক্ষমা করেছেন। যে পুনরায় করবে আল্লাহ তার থেকে প্রতিশোধ নেবেন। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।’[29]

ইহরামের কারণে বৃক্ষ কর্তন মুহরিমের জন্য নিষিদ্ধ নয়। কারণ, এতে ইহরামে কোন প্রকার প্রভাব সৃষ্টি হয় না। তবে তা যদি হারাম শরীফের নির্দিষ্ট সীমার ভেতরে হয়, তবে মুহরিম হোক কিংবা হালাল-সকলের জন্য হারাম। এই মৌলনীতির ভিত্তিতে আরাফায় মুহরিম কিংবা হালাল, উভয়ের জন্য বৃক্ষ কর্তন বৈধ; মক্কা, মিনা ও মুযদালিফা অবৈধ। কারণ, আরাফা হারাম শরীফের বাইরে, মক্কা, মিনা ও মুযদালিফা হারামের সীমাভুক্ত। উপরোক্ত সাতটি বিষয় মহিলা-পুরুষ উভয়ের জন্য নিষিদ্ধ।

[1]. বাকারা : ১৯৬।

[2]. বাকারা : ২৯১।

[3]. বুখারী : ১৮১৪; মুসলিম : ১২০১।

[4]. মুসলিম : ১২০১; বুখারী : ৪৫১৭ অনুরূপ।

[5]. বুখারী : ১৮১; মুসলিম : ১২০১।

[6]. খালেছুল জুমান : ৭৭।

[7]. বুখারী : ৫৭০১; মুসলিম : ১২০২।

[8]. খালেছুল জুমান : ৮৩।

[9]. মানাসিকুল হজ ওয়াল উমরা : ৪৪।

[10]. বুখারী : ১৮৩৮; মুসলিম : ১১৮০।

[11]. বুখারী : ১৮৩৯; মুসলিম : ১৬০৬।

[12]. মুসলিম : ৪/৩৮৭।

[13]. মানসিকুল হজ ওয়াল উমরা : ৪৭।

[14]. বুখারী : ২৭১; মুসলিম : ১২০৬।

[15]. মুসলিম : ৫/২০৯।

[16]. বাকারা : ১৯৭।

[17]. খালেছুল জুমান : ১১৪।

[18]. মুআত্তা মালেক : ১৩০৭/১।

[19]. প্রাগুক্ত।

[20]. খালেছুল জুমান : ১১৪।

[21]. আবূ দাউদ : ১৯৪৯।

[22]. মানাসিকুল হজ্জি ওয়াল উমরা : ৪৯।

[23]. বাকারা : ১৯৭।

[24]. খালেছুল জুমান : ৭৬।

[25]. খালেছুল জুমান : ৭৬।

[26]. মায়েদা : ৯৬।

[27]. মায়েদা : ৯৫।

[28]. মুসলিম : ১১৯৬; বুখারী : ১৮২৪। জ্ঞাতব্য, মুহরিমের সংশ্লিষ্টতায় শিকারকৃত জন্তুর ব্যাপারে তিন ধরনের বিধান হবে : প্রথম. এমন জন্তু যা মুহরিম ব্যক্তি হত্যা করেছে কিংবা হত্যায় শরীক হয়েছে। এমন জন্তু খাওয়া মুহরিম ও অন্য সকলের জন্য হারাম। দ্বিতীয়. মুহরিমের সাহায্য নিয়ে কোন হালাল ব্যক্তি একটি জন্তুকে হত্যা করেছে, যেমন মুহরিম ব্যক্তি শিকার দেখিয়ে দিয়েছে অথবা শিকারের অস্ত্র এগিয়ে দিয়েছে-এমন জন্তু কেবল মুহরিমের জন্য হারাম; অন্য সবার জন্য হালাল। তৃতীয়. হালাল ব্যক্তি যে জন্তু মুহরিমের জন্য হত্যা করেছে, এমন জন্তুও মুহরিমের জন্য হারাম। অন্য সবার জন্য হালাল। (খালেসুল জুমান : ১২৩-১৩৬) বি. দ্র. এই রেওয়ায়েতের তরজমা বুখারী-মুসলিম মিলিয়ে করা হয়েছে।

[29]. মায়েদা : ৯৫। সুতরাং যদি কোনো ব্যক্তি কবুতর হত্যা করে তবে তার বিনিময় হচ্ছে একটি ছাগল যবেহ করা, যা দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেবে। কিংবা ছাগলর মূল্য নির্ধারণ করে সমপরিমাণ খাদ্য মিসকীনদের দিয়ে দেবে। প্রত্যেক মিসকীনকে অর্ধ সা‘ আহার প্রদান করবে অথবা প্রত্যেক মিসকীনের খাদ্যের পরিবর্তে একদিন রোযা রাখবে। এ তিন পদ্ধতির যেকোনো একটি অবলম্বন করা যাবে। (দ্রষ্টব্য, মানাসিকুল হজ্জি ওয়াল উমরা : ৫১।)