সে সব শ্রেণি যাদের অনুসরণ-অনুকরণ করতে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে

শরী‘আতের বক্তব্যসমূহ যথাযথ পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাধ্যমে আমরা এসব শ্রেণির অধিকাংশ সম্পর্কে জানতে পারব, যদিও এর মাধ্যমে পূর্ণ জ্ঞান অর্জিত হবে না, বরং কাছাকাছি পর্যায়ের জ্ঞান অর্জিত হবে।

প্রথম শ্রেণি: সাধারণভাবে সকল কাফির

সুতরাং কোনো প্রকার বিশিষ্টকরণ ছাড়াই সাধারণভাবে সব ধরনের কাফিরদের অনুসরণ-অনুকরণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এর ওপর ভিত্তি করে এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হবে, সকল মুশরিক, ইয়াহূদী, খ্রিষ্টান, অগ্নিপূজক, সাবেয়ী (তারকা-নক্ষত্র পূজক), নাস্তিক এবং তাদের মতো অন্যান্য ব্যক্তিগণ। সুতরাং ইবাদাত, আচার-আচরণ ও পোষাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে যা কিছু কাফিরদের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত হয়, এমন প্রত্যেক বিষয় থেকে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন, যখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর গায়ে হলুদ বর্ণ বিশিষ্ট কাপড় দেখতে পেলেন, তখন তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন:

«إن هذه من ثياب الكفار فلا تلبسها».

“নিশ্চয় এগুলো কাফিরদের পোষাক-পরিচ্ছদের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তুমি তা পরিধান করো না।”[1] এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, পোষাক-পরিচ্ছদ যখন কাফিরদের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত হবে, তখন মুসলিম ব্যক্তির জন্য তা পরিধান করা বৈধ হবে না।[2]

দ্বিতীয় শ্রেণি: মুশরিকগণ

মুশরিকদের পূজা, উৎসব ও কর্মকাণ্ডসমূহ অনুকরণ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। যেমন, শিস দেওয়া ও হাততালি দেওয়া। অনুরূপভাবে দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলার নিকট সৃষ্টির মাধ্যমে সুপারিশ প্রার্থনা করা এবং সৃষ্টিরাজিকে মাধ্যমরূপে ব্যবহার করা, কবরের নিকট মান্নত করা ও (পশু-পাখি) যবাই করা ইত্যাদি। তদ্রূপ মুশরিকদের যেসব কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে তন্মধ্যে অন্যতম হলো: সূর্যাস্তের পূর্বে ‘আরাফাত’ এর ময়দান থেকে প্রত্যাবর্তন করা।

পূর্ববর্তী সালাফে সালেহীন মুশরিকদের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ও তাদের সকল কর্মকাণ্ডকে অপছন্দ করতেন, যেমনটি আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবনিল ‘আস রাদিয়াল্লাহ ‘আনহুমা এবং অন্যান্য সাহাবীগণ বলেছেন:

«من بنى ببلاد المشركين وصنع نيروزهم ومهرجانهم وتشبه بهم حتى يموت , حشر معهم يوم القيامة».

“যে ব্যক্তি মুশরিকদের দেশে গৃহ নির্মাণ করে, তাদের ‘নওরোজ’ (নববর্ষ) ও ‘মেহেরজান’ (জাতীয় দিবস) এর উৎসব পালন করে এবং এ অবস্থায় মারা যায়, কিয়ামতের দিনে তাদের সাথে তার হাশর হবে”।[3]

আর আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা মসজিদের উপর বিশেষ কক্ষ বানানোকে অপছন্দ করতেন এবং বেশ কয়েকবার তিনি এ ব্যাপারে সরাসরি নিষেধ করেছেন। কারণ, তিনি এটাকে মুশরিকদের প্রতিমা সদৃশ মনে করতেন।[4]

তৃতীয় শ্রেণি: আহলে কিতাব

আহলে কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ইয়াহূদী ও নাসারা সম্প্রদায়। আমাদেরকে এমন প্রত্যেক বিষয় থেকে নিষেধ করা হয়েছে, যা ইয়াহূদী ও নাসারা অথবা তাদের কোনো এক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য। তাদের ইবাদাত, আচার-আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ ও উৎসবসমূহের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, কবরের উপর ঘর নির্মাণ করা, কবরকে মসজিদ বানানো, ছবি উত্তোলন করা, নারীদের দ্বারা ফেতনায় পতিত হওয়া, সাহরী না খাওয়া, শুভ্র চুলে রং না করা, ক্রুশ উত্তোলন করা এবং তাদের উৎসবসমূহ উদযাপন করা অথবা তাতে তাদের সাথে অংশগ্রহণ করা ইত্যাদি।

চতুর্থ শ্রেণি: অগ্নিপূজক

অগ্নিপূজকদের বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্য থেকে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো আগুনের দিকে ফিরে পূজা করা, অগ্নিপূজা করা, রাজা ও বাদশাহদেরকে পবিত্র বলে ঘোষণা করা, মাথার সামনের অংশ বাদ দিয়ে পিছনের অংশের চুল কর্তন করা, দাঁড়ি মুণ্ডন করা, মোচ লম্বা করা, শিস দেওয়া এবং স্বর্ণ ও রৌপ্যের পাত্র ব্যবহার করা।

পঞ্চম শ্রেণি: পারস্য ও রোমের অধিবাসী

এ শ্রেণিটি আহলে কিতাব, অগ্নিপূজক ও অন্যান্যদেরকে শামিল করে। ইবাদাত, আচার-আচরণ ও ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করার ক্ষেত্রে পারস্য ও রোমবাসীর বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুকরণ করা থেকেও আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন, বয়স্ক ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে মহৎ ও পবিত্র জ্ঞান করা। এমন সব পণ্ডিত ও সন্ন্যাসীদের অনুসরণ করা, যারা সে সব বিধিবিধান রচনা করে, যা আল্লাহ তা‘আলা অনুমোদন করেন নি এবং দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও কঠোরতা প্রদর্শন করা।

ষষ্ঠ শ্রেণি: অনারব অমুসলিমগণ

আর এটা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথার ওপর ভিত্তি করেই বলা হচ্ছে। কারণ হাদীসে এসেছে,

«نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ... أَنْ يَجْعَلَ الرَّجُلُ فِى أَسْفَلِ ثِيَابِهِ حَرِيرًا مِثْلَ الأَعَاجِمِ أَوْ يَجْعَلَ عَلَى مَنْكِبَيْهِ حَرِيرًا مِثْلَ الأَعَاجِمِ».

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো পুরুষ ব্যক্তি কর্তৃক অনারবদের মতো তার পোষাকের নিচের অংশে রেশম ব্যবহার করতে অথবা কাঁধের উপরের অংশে অনারবদের মতো রেশম ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন”।[5]

অনুরূপভাবে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকজন কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য দাঁড়াতেও নিষেধ করেছেন; বরং তিনি কোনো সমস্যার কারণে বসা অবস্থায় সালাত আদায়কারী ইমামের মুক্তাদিকে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন এ আশঙ্কায় যে, কেউ এ দাঁড়ানোটিকে ইমামের সম্মানার্থে বলে মনে করবে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, উক্ত হাদীসে আগত এ নিষেধাজ্ঞার কারণ হচ্ছে, এটি অনারবদের কর্মকাণ্ডের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে যায়। কেননা, তারা তাদের নেতৃবৃন্দ ও বয়স্কজনদের নিকট কেবল দাঁড়িয়েই থাকত। বস্তুত এটা নিষিদ্ধ; কারণ তা অনারব কাফিরদের অনুকরণ-অনুসরন বৈ কিছু নয়[6]।

উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে সাব্যস্ত আছে যে, তিনি ভিনদেশী তথা অনারব ও মুশরিকগণের সাজসজ্জা গ্রহণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন আর পূর্ববর্তী আলেমগণের অনেকেই অনুরূপ ইঙ্গিত করেছেন।

সপ্তম শ্রেণি: জাহেলিয়াত ও তার অনুসারীগণ

জাহেলিয়াতের সকল কর্মকাণ্ড, আচার-আচরণ, পূজাপার্বণ, স্বভাব-চরিত্র ও বিশেষ নিদর্শনসমূহের ব্যাপারে ইসলামী শরী‘আতে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। যেমন, বেপর্দা হওয়া, নারীদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করা, হজ ও উমরার ইহরামে প্রবেশ করার পর সূর্যের উত্তাপ থেকে ছায়া গ্রহণ না করা, অথবা এমন কাজ করা যাতে ছায়া গ্রহণ না করতে হয়। যেমনটি আজকের দিনের শিয়া-রাফেযীরা করে থাকে। কারণ, এগুলো জাহেলী যুগের ও মুশরিকগণের কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপভাবে লজ্জাস্থান বা তার অংশবিশেষ প্রকাশ করা, জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক পক্ষপাতিত্ব, বংশ মর্যাদা নিয়ে গর্ব করা, অন্য বংশের প্রতি কটাক্ষ করা, মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা এবং গ্রহ-নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা। কারণ, যখন ইসলাম আগমন করেছে, তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহেলিয়াতের সকল অবস্থা, রীতিনীতি, আচার-আচরণ, প্রথা বা ঐতিহ্য, নিয়ম-কানূন, যাবতীয় মেলা, সৌন্দর্য প্রদর্শন করা, নারী-পুরুষে মেলামেশা এবং সুদ প্রথাকে বাতিল ঘোষণা করেছেন।

অষ্টম শ্রেণি: শয়তান

যাদেরকে অনুসরণ করার ব্যাপারে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম হলো শয়তান। সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শয়তানের কতিপয় কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তার থেকে তিনি নিষেধ করেছেন; যেমন, বাম হাতে খাওয়া ও পান করা। ইমাম মুসলিম রহ. প্রমুখ বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لاَ يَأْكُلَنَّ أَحَدٌ مِنْكُمْ بِشِمَالِهِ، وَلاَ يَشْرَبَنَّ بِهَا، فَإِنَّ الشَّيْطَانَ يَأْكُلُ بِشِمَالِهِ وَيَشْرَبُ بِهَا».

“তোমাদের কেউ যেন কখনও বাম হাতে পানাহার না করে। কারণ, শয়তান তার বাম হাত দ্বারা খায় এবং পান করে”।[7]

অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, মুসলিমগণের অনেকেই খুব সহজেই অথবা হকের (সত্যের) প্রতি অহঙ্কার বশতঃ এবং কাফির ও ফাসিকগণের মধ্য থেকে শয়তানের বন্ধুদের অনুকর করত এ অভ্যাসে জড়িয়ে গেছে।

নবম শ্রেণি: বেদুইন বা যাযাবর শ্রেণি যাদের দীন পূর্ণ হয় নি

তারা হলো জাহিল বা মূর্খ বেদুইন। কারণ, বেদুইন বা যাযাবরগণ অনেক রীতি-নীতি ও ঐতিহ্যের জন্ম দিয়েছে, ইসলামের নিয়মনীতির সাথে যেগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই; তার কিছু এসেছে উত্তরাধিকার সূত্রে জাহেলিয়াত থেকে। অভদ্র বেদুইনগণ তাদের চালচলন, রীতি-নীতি, প্রথা ও পরিভাষার ক্ষেত্রে ছিল শরী‘আত পরিপন্থী। এর দৃষ্টান্ত হলো: জাহেলিয়াতের পক্ষপাতিত্ব করা, বংশ মর্যাদা নিয়ে গর্ব করা, অন্য বংশের প্রতি কটাক্ষ করা, মাগরিবের সালাতকে ‘ইশা’ বলে নামকরণ করা, এশার সালাতকে ‘আতামা’ বলে নামকরণ করা, তালাকের মাধ্যমে শপথ করা, তালাককে কর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা; চাচার কন্যাকে (চাচাতো বোনকে) অন্যের জন্য হারাম করে দেওয়া; যাতে করে সে কন্যা তার চাচাতো ভাই ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে না পারে। ইত্যাদি আরও বিবিধ জাহেলী রীতি-নীতি।

[1] মুসলিম, হাদীস নং ২০৭৭।

[2] পোষাক-পরিচ্ছদ থেকে অন্যতম একটি পোষাক হলো প্যান্ট, যাকে আজকের দিনের কাফিরগণের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হয়, মুসলিমদের দেশে তা পরিধান করা বৈধ হবে না। যদিও আমরা দেখতে পাই যে, এ্যাংলো-ইউরোপীয়ান সভ্যতার ধ্বজাধারীদের মধ্যে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বস্তুত মুসলিম দেশে এ শ্রেণির লোকের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু তাদের এ অবস্থাটি বিবেচনায় আনা হবে না, বিবেচনায় আসবে সঠিক ও দীনের ব্যাপারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অবস্থা, প্যান্ট পরিধান করা সৎ লোকদের চিহ্ন নয়। তাছাড়া প্রচলিত প্যান্ট লজ্জা নিবারণেও পর্যাপ্ত নয়। কারণ, তা লজ্জাস্থানকে প্রকাশ করে দেখায়। আর এটাও জানা আবশ্যক যে, কোনো কোনো নিদর্শন কাফেরদের বিশেষ অবস্থার অন্তর্ভুক্ত। যেমন, ইয়াহূদীদের বিশেষ টুপি এবং খ্রিষ্টানদের ক্রুশ ইত্যাদি।

[3] সুনানুল বায়হাকী, ৯/২৩৪

[4] দেখুন: ইবন আবি শায়বা, আল-মুসান্নাফ: ১/৩০৯; ইবন তাইমিয়্যাহ, ইকতিদাউস সিরাতিল মুসতাকীম: ১/৩৪৪ (তাহকীকসহ)।

[5] আবু দাউদ, হাদীস নং- ৪০৪৯; নাসাঈ, ৮/১৪৩; আহমদ, ৪/১৩৪; দেখুন: ইবন তাইমিয়্যাহ, ইকতিদাউস সিরাতিল মুসতাকীম: ১/৩০৪।

[6] দেখুন: সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ৪১৩; সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং- ৬০২, ৬০৬, ৫২৩০; ইবন মাজাহ, হাদীস নং- ১২৪০; মুসনাদু আহমদ, ৫/২৫৩, ২৫৬।

[7] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ২০১৯।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১ পর্যন্ত, সর্বমোট ১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে