وَمَا بِعِلَّةٍ غُمُوضٍ أَوْ خَفَا | مُعَلَّلٌ عِنْدَهُمُ قَدْ عُرِفَا

“আর যে হাদিসে সূক্ষ্ম ও উহ্য দোষ রয়েছে তাই মুহাদ্দিসদের নিকট মু‘আল্লাল হিসেবে প্রসিদ্ধ”। অত্র কবিতায় বর্ণিত ক্রমানুসারে হাদিসের চতুর্বিংশ প্রকার মু‘আল্লাল। এ প্রকার হাদিসকে মু‘আল্লাল, মু‘আল্ ও মা‘লুল ইত্যাদি নামে অবহিত করা হয়, তবে অভিধানের বিচারে ‘মুয়াল্’ শব্দটি অধিক বিশুদ্ধ।

علة এর আভিধানিক অর্থ রোগ,عَلَّ يَعِلُّ থেকেمُعلَّلٌ অর্থ অসুস্থ ব্যক্তি। এ থেকে দোষণীয় ইল্লতযুক্ত হাদিসকে মু‘আল্লাল বলা হয়, কারণ মু‘আল্লাল হাদিসও অসুস্থ ব্যক্তির ন্যায় অক্ষম, সহি হাদিসের ন্যায় দলিল হতে পারে না।

ইল্লত প্রসঙ্গে লেখক রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “যে হাদিসের সনদ বা মতনে সূক্ষ্ম ও উহ্য দোষ রয়েছে তাই মুহাদ্দিসদের নিকট মু‘আল্লাল হিসেবে প্রসিদ্ধ”।

ইমাম সাখাবি রাহিমাহুল্লাহ্ মু‘আল্লালের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন:

"والمعلول: خبر ظاهر السلامة، اطُّلِعَ فيه بعد التفتيش على قادح".

“মু‘আল্লাল: বাহ্যত দোষমুক্ত হাদিস, অনেক অনুসন্ধানের পর তাতে দোষ সম্পর্কে জানা গেছে”।[1]

ইমাম হাকেম রাহিমাহুল্লাহ্ মু‘আল্লালের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন:

"وإنما يعلل الحديث من أوجه ليس للجرح فيها مدخل، فإن حديث المجروح ساقط واه، وعلة الحديث تكثر في أحاديث الثقات، أن يحدثوا بحديث له علة، فتخفى عليهم علته، فيصير الحديث معلولا".

“এমন কতক কারণে হাদিসকে মু‘আল্লাল ঘোষণা করা হয়, যে কারণে দোষারোপ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, দোষী ব্যক্তিদের হাদিস পরিত্যক্ত। আর সেকাহ রাবিদের হাদিসে ইল্লত অধিক হয়, তারা কোনো হাদিস বর্ণনা করেন, যার ইল্লত রয়েছে, কিন্তু তার ইল্লত তাদের নিকট অজ্ঞাত থাকে, ফলে হাদিসটি মু‘আল্লাল হয়”।[2]

হাফেয ইব্‌ন হাজার রাহিমাহুল্লাহ্ হাকেমের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন: “এ হিসেবে মুনকাতি‘ হাদিসকে মু‘আল্লাল বলা যাবে না এবং যে হাদিসের রাবি অজ্ঞাত কিংবা দুর্বল তাকেও মু‘আল্লাল বলা যাবে না। হাদিসকে তখনি মু‘আল্লাল হবে, যখন তার ইল্লত খুব সূক্ষ্ম হয়, বাহ্যত যার থেকে মুক্ত মনে হয়। এ থেকে তাদের কথার বাতুলতা প্রমাণ হল, যারা বলেন: প্রত্যেক অগ্রহণীয় হাদিস মু‘আল্লাল”।[3]

যারা বলেন: এ হাদিসে ইল্লত রয়েছে, অতঃপর مجالد بن سعيد কিংবা ابن لهيعة রাবিদের ন্যায় দুর্বল রাবি পেশ করেন, তাদের ইল্লতের প্রয়োগ যথাযথ নয়। কারণ, এ জাতীয় রাবির দুর্বলতা সবার নিকট স্পষ্ট। আর আমাদের আলোচনার বস্তু হচ্ছে সূক্ষ্ম ও সুপ্ত ইল্লত। যেমন কোনো মুহাদ্দিস বলেন: “ইল্লত এমন এক বস্তু, যা মুহাদ্দিসের অন্তরে খতের সৃষ্টি করে”। উদাহরণত কোনো বিজ্ঞ মুহাদ্দিস কারো নিকট ‘আ‘মাশে’র হাদিস শ্রবণ করে বললেন: এ হাদিস ‘আ‘মাশে’র হাদিসের মত নয়; কিংবা বললেন: এ হাদিস ইমাম যুহরির হাদিস নয়। তাদের এ কথা হাদিসের ইল্লত প্রমাণ করে। কারণ, তারা হাদিসের সনদ জানেন, ইতিহাস জানেন, রাবিদের অবস্থা জানেন, তারা হাদিস দেখে ইল্লত বলতে পারেন, যেমন স্বর্ণকার স্বর্ণ দেখে খাঁটি-ভেজাল বলতে পারেন, কিন্তু ইল্লত বা কারণ উল্লেখ করেন না। তারা বলেন: ‘এ হাদিস দ্বা‘ঈফ’, কিন্তু যখন তাদের কাউকে জিজ্ঞাসা করা হল, এটা কিভাবে জানব? তখন সে উত্তর দিল: আমি তোমাকে বলেছি এতে ইল্লত আছে। তুমি ইব্‌ন মাহদিকে জ্ঞিজ্ঞাসা কর, সেও বলবে এতে ইল্লত আছে। তুমি আহমদকে জিজ্ঞাসা কর, সেও বলবে এতে ইল্লত আছে। তুমি ইয়াহইয়া ইব্‌ন সায়িদ আল-কাত্তানকে জিজ্ঞাসা কর, সেও বলবে এতে ইল্লত আছে। এভাবে সকল বিজ্ঞ মুহাদ্দিসের কথা ইল্লতের ব্যাপারে এক হয়ে যায়, হাদিসের উপর যারা অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন, আল্লাহ তাদের অন্তরে এ বিষয়গুলো ঢেলে দেন।

কোনো মারফূ‘ হাদিসের মুত্তাসিল সনদ সবার নিকট পরিচিত, অতঃপর একজন হাফেযে হাদিস বলেন, এতে একটি দোষণীয় ইল্লত রয়েছে, অর্থাৎ অমুক সেকাহ রাবি থেকে হাদিসটি মুনকাতি‘ বর্ণিত। আমরা তার মন্তব্য থেকে হাদিসে দ্বা‘ঈফের একটি ইল্লত পেলাম ইনকিতা‘ বা সনদের বিচ্ছেদ, অথচ হাদিসটি সবার নিকট মুত্তাসিল ছিল।

ইব্‌ন হাজার বুলুগুল মারাম গ্রন্থে এরূপ অনেক বলেন: হাদিসটি ইরসালের কারণে মু‘আল্‌, বা ওয়াকফের কারণে মু‘আল্‌ ইত্যাদি। তিনি যখন এ জাতীয় মন্তব্য করেন, আপনি তার রাবিদের খোঁজ নিয়ে দেখেন।

মুদ্দাকথা: মু‘আল্‌ হাদিসের বাহ্যিক দেখে সহি মনে হয়, কারণ তাতে সহির সকল শর্ত বিদ্যমান, কিন্তু ব্যাপক গবেষণার পর স্পষ্ট হয় যে, হাদিসটি দোষণীয় ইল্লতের কারণে মু‘আল্‌।

ইল্লত দু’প্রকার:

১. দোষণীয় ইল্লত ও ২. দোষহীন ইল্লত।

দোষহীন ইল্লতের কারণে হাদিসের বিশুদ্ধতা বিনষ্ট হয় না। এ ইল্লত মতন ও সনদ উভয় স্থানে হতে পারে। সনদে দোষহীন ইল্লত যেমন,

قال الإمام الترمذي –رحمه الله- حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ مَهْدِيٍّ، قَالَ: حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، وَشُعْبَةُ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ دِينَارٍ، عَنْ ابْنِ عُمَرَ، " أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنْ بَيْعِ الْوَلَاءِ وَهِبَتِهِ ".

ইব্‌ন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম [গোলামকে] ‘অলা’[4] বিক্রি ও দান করতে নিষেধ করেছেন”।[5]

এ হাদিস ইব্‌ন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর ছাত্র عبد الله بن دينار সূত্রে বর্ণিত, কোনো রাবি যদি তার পরিবর্তে عمرو بن دينار বলে তাহলে ইল্লত হবে, তবে দোষণীয় নয়, কারণ আব্দুল্লাহ ইব্‌ন দিনার ও আমর ইব্‌ন দিনার উভয়ে সেকাহ।

মতনে দোষহীন ইল্লত যেমন:

قال الإمام مسلم-رحمه الله- حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، حَدَّثَنَا لَيْثٌ، عَنْ أَبِي شُجَاعٍ سَعِيدِ بْنِ يَزِيدَ، عَنْ خَالِدِ بْنِ أَبِي عِمْرَانَ، عَنْ حَنَشٍ الصَّنْعَانِيِّ، عَنْ فَضَالَةَ بْنِ عُبَيْدٍ قَالَ: " اشْتَرَيْتُ يَوْمَ خَيْبَرَ قِلَادَةً بِاثْنَيْ عَشَرَ دِينَارًا فِيهَا ذَهَبٌ وَخَرَزٌ، فَفَصَّلْتُهَا، فَوَجَدْتُ فِيهَا أَكْثَرَ مِنَ اثْنَيْ عَشَرَ دِينَارًا، فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: لَا تُبَاعُ حَتَّى تُفَصَّلَ "

... ... ফুদালা ইব্‌ন উবাইদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমি খায়বরের দিন বারো দিনার দিয়ে একটি হার ক্রয় করেছি, যাতে স্বর্ণ ও পূতি ছিল। দু’টি বস্তু [স্বর্ণ ও পূতি] পৃথক করে তাতে বারো দিনারের অধিক পেলাম। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিষয়টি অবহিত করি, তিনি বললেন: দু’টি বস্তু পৃথক করা ব্যতীত বিক্রি করা যাবে না”।[6]

এ হাদিসের রাবিগণ হারের মূল্য নির্ধারণে দ্বিমত পোষণ করেছেন। কেউ বলেছেন: বারো দিনার। কেউ বলেছেন: নয় দিনার। কেউ বলেছেন: দশ দিনার, ইত্যাদি।

এসব দোষের কারণে হাদিসে ইল্লত হয় ঠিক, তবে এ জাতীয় ইল্লত হাদিসের শুদ্ধতা বিনষ্ট করে না, কারণ সব বর্ণনায় হাদিসের মূল বিষয় এক। এ হাদিস প্রমাণ করে কোনো বস্তুর সাথে মিশ্রিত স্বর্ণ পৃথক করা ব্যতীত স্বর্ণের বিনিময়ে বিক্রি করা যাবে না। স্বর্ণ পৃথক করে সমপরিমাণ স্বর্ণের বিনিময়ে বিক্রি করতে হবে, আর অপর বস্তু যত দামে ইচ্ছা বিক্রি করবে। এটা হাদিসের মূল বক্তব্য। হারের মূল্য যতই বলি এতে প্রভাব পড়ে না, তাই হারের মূল্যের ইখতিলাফ দোষণীয় ইল্লত নয়।

দোষণীয় ইল্লত:

قال الإمام الترمذي -رحمه الله- حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ السَّلَامِ بْنُ حَرْبٍ الْمُلَائِيُّ، عَنْ الْأَعْمَشِ، عَنْ أَنَسٍ، قَالَ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ " إِذَا أَرَادَ الْحَاجَةَ لَمْ يَرْفَعْ ثَوْبَهُ حَتَّى يَدْنُوَ مِنَ الْأَرْضِ ".

এ হাদিসের সনদ বাহ্যত সহি এবং সকল রাবি সেকাহ। ইমাম তিরমিযি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “বলা হয় আ‘মাশ আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বা কোনো সাহাবি থেকে শ্রবণ করেনি। তিনি শুধু আনাসকে দেখেছেন। আ‘মাশ বলেন: আমি তাকে সালাত আদায় করতে দেখেছি। অতঃপর সালাত সম্পর্কে তার একটি ঘটনা বর্ণনা করেন”।[7] ইমাম তিরমিযির মন্তব্য থেকে ‘আ‘মাশ’ ও ‘আনাসে’র মাঝে ইনকেতা‘ প্রমাণিত হয়। এটাই ইল্লত।

ইল্লত জানার গুরুত্ব:

ইব্‌ন মাহদি রাহিমাহুল্লাহ্ বলেছেন: ‘আমার নিকট একটি হাদিসের ইল্লত জানা নতুন বিশটি হাদিস শেখার চেয়ে অধিক উত্তম’।[8]

হাফেয ইব্‌ন হাজার রাহিমাহুল্লাহ্ নুখবার ব্যাখ্যায় বলেন: “হাদিস শাস্ত্রের এ প্রকার সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও দুর্বোধ্য। আল্লাহ যাকে অন্তর্দৃষ্টি, ব্যাপক স্মৃতিশক্তি, রাবিদের স্তর এবং সনদ ও মতন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান দান করেছেন সেই এ দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারেন। তাই দেখি এ বিষয়ে খুব কম লোক মুখ খুলেছেন, যেমন: আলি ইব্‌নু মাদিনি, আহমদ ইব্‌নু হাম্বল, বুখারি, ইয়াকুব ইব্‌নু শাইবাহ, আবু হাতেম, আবু যুরআহ ও দারাকুতনি প্রমুখ। মুহাদ্দিস কতক সময় ইল্লতের কারণ দর্শাতে পারেন না, যেমন মুদ্রা ব্যবসায়ী খাঁটি দিনার ও দিরহামের পক্ষে দলিল দিতে পারেন না, কিন্তু খাঁটি মুদ্রা তিনি ঠিকই চিনেন”।[9]

‘ইলালের উপর লিখিত কিতাব:‘ইলালের উপর লিখিত কিতাবসমূহের মধ্যে ‘ফাতহুল বারি’ অন্যতম, এতে ফিকাহ, হাদিস ও ইল্লতের উপর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। অতঃপর ‘নাসবুর রায়াহ’, ‘তালখিসুল হাবির’, ইব্‌ন আব্দুল হাদি রচিত ‘আল-মুহাররার’ ইত্যাদি গ্রন্থে ইল্লতের উপর আলোচনা রয়েছে। ‘সুবুলুস সালাম’ গ্রন্থেও ইলালের উপর যথেষ্ট আলোচনা রয়েছে। অনুরূপ এ বিষয়ে আরেকটি সুন্দর কিতাব: ‘আল-কুবরা’ লিল বায়হাকি।

[1] ফাতহুল মুগিস: (১/২৭৬)

[2] ‘মা‘রিফাতু উলুমিল হাদিস’: (পৃ.১১২-১১৩)

[3] আন-নুকাত: (২/৭১০)

[4] দাস/দাসীদের মিরাস ও পরিত্যক্ত সম্পদকে ‘অলা’ বলা হয়।

[5] তিরমিযি: (১২৩৬), তিনি বলেন: এ হাদিস হাসান ও সহি।

[6] মুসলিম: (১৫৯২), তিরমিযি: (১২২৫), নাসায়ি: (৪৫৭৩), আবু দাউদ: (৩৩৫২), মুসনাদে আহমদ ইব্‌ন হাম্বল: (৬/১৯)

[7] তিরমিযি: (১৪)

[8] ‘আল-‘ইলাল’: (১/১২৩) লি ইব্‌নি আবি হাতেম।

[9] আন-নুজহা: (১২৩-১২৪)
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১ পর্যন্ত, সর্বমোট ১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে