৭ম হাদীস:
مَنْ حَجَّ فَزَارَ قَبْرِيْ فِيْ مَمَاتِيْ كَانَ كَمَنْ زَارَنِيْ فِيْ حَيَاتِيْ
‘‘যে ব্যক্তি হজ্জ করে আমার মৃত্যুর পরে আমার কবর যিয়ারত করল, সে যেন আমার জীবদ্দশাতেই আমার যিয়ারত করল।’’
হাদীসটি দারাকুতনী, তাবারানী, বাইহাকী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। তাঁরা সকলেই হাদীসটি হাফস ইবনু সুলাইমান নামক রাবীর মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। হাফস বলেন, তাকে লাইস ইবনু আবী সুলাইম বলেছেন, তাকে মুজাহিদ বলেছেন, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন...।[1] বাইহাকী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন, ‘‘একমাত্র হাফসই এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি দুর্বল।’’[2]
এ হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী হাফ্স ইবনু সুলাইমান (১৮০হি) প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কারী ছিলেন। তবে তিনি হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। কুরআনের কিরা‘আত ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে তিনি এত ব্যস্ত থাকতেন যে, হাদীস মুখস্থ, পুনরালোচনা ও বিশুদ্ধ বর্ণনায় তিনি মোটেও সময় দিতেন না। ফলে তার বর্ণিত হাদীসে এত বেশি ভুল পাওয়া যায় যে, ইমাম আহমাদ ছাড়া অন্য সকল মুহাদ্দিস তাকে অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত বলে গণ্য করেছেন। ইমাম আহমাদ তাকে মোটামুটি চলনসই বলে মনে করতেন। যাহাবী, ইবনু হাজার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বলেছেন যে, তিনি নিজে সত্যবাদী ছিলেন, তবে হাদীস বলতে অত্যন্ত বেশি ভুল করতেন, সনদ উল্টে ফেলতেন, রাবীর নাম বদলে দিতেন, মতন পাল্টে দিতেন... এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করতে পারতেন না; এজন্য তিনি পরিত্যক্ত রাবী হিসাবে গণ্য। ইমাম বুখারী তাঁকে পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। আর তিনি মিথ্যায় অভিযুক্তদেরকেই পরিত্যক্ত বলেন। আবূ হাতিম রাযী, ইবনু আদী, ইবনু হিববান ও অন্যান্য মুহাদ্দিসও তাঁকে অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন। ইবনু খিরাশ তাকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন।[3]
এ সনদে হাফসের উস্তাদ লাইস ইবনু আবী সুলাইমও কিছুটা দুর্বল রাবী ছিলেন। তিনি একজন বড় আলিম, আবিদ ও সত্যপরায়ন রাবী ছিলেন। তবে শেষ জীবনে তার স্মৃতি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ইমাম মুসলিম তার বর্ণনা সহায়ক বর্ণনা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। সুনান চতুষ্টয়ের সংকলকগণ: তিরমিযী, নাসাঈ, আবূ দায়ূদ ও ইবনু মাজাহ তার বর্ণনা গ্রহণ করেছেন।[4]
৮ম হাদীস:
مَنْ زَارَ قَبْرِيْ بَعْدَ مَوْتِيْ كَانَ كَمَنْ زَارَنِيْ فِيْ حَيَاتِيْ
‘‘আমার মৃত্যুর পরে আমার কবর যে ব্যক্তি যিয়ারত করল, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার যিয়ারত করল।’’[5]
ইমাম তাবারানী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন, আমাকে আহমাদ ইবনু রিশদীন বলেছেন, আমাদেরকে আলী ইবনুল হাসান ইবনু হারূন আনসারী বলেছেন, আমাকে লাইস ইবনু আবী সুলাইমের মেয়ের পুত্র লাইস বলেছেন, আমাকে লাইস ইবনু আবী সুলাইমের স্ত্রী আয়েশা বিনতু ইউনূস বলেছেন, তাকে মুজাহিদ বলেছেন, ইবনু উমার থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন...।
এ সনদের প্রায় সকল রাবীই অজ্ঞাত পরিচয় বা দুর্বল। তাবারানীর উস্তাদ আহমাদ ইবনু রিশদীন (২৯২হি) দুর্বল ছিলেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন।[6] তাঁর উস্তাদ ‘‘আলী ইবনুল হাসান’’ নামক এ ব্যক্তির কোনোরূপ পরিচয় জানা যায় না। অনুরূপভাবে তার উস্তাদ লাইস নামক এ ব্যক্তি, তার উস্তাদ আয়েশা নামক এ মহিলা এরাও একেবারেই অপরিচিত। এ জন্য সনদটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।[7]
৯ম হাদীস:
مَنْ زَارَنِيْ بَعْدَ مَوْتِيْ فَكَأَنَّمَا زَارَنِيْ فِيْ حَيَاتِيْ
‘‘যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পর আমার যিয়ারত করল, সে যেন আমার জীবদ্দশাতেই আমার যিয়ারত করল।’’
হাদীসটি ইমাম দারাকুতনী, বাইহাকী প্রমুখ মুহাদ্দিস সংকলন করেছেন। এই হাদীসের সনদ বর্ণনায় মুহাদ্দিসগণ বৈপরীত্য ও বিক্ষিপ্ততা দেখতে পেয়েছেন। দুই ভাবে এই হাদীসটির সনদ ও মতন বলা হয়েছে:
প্রথম সনদ: ২য় হিজরী শতকের মুহাদ্দিস ওকী’ ইবনুল জার্রাহ (১৯৭ হি) বলেছেন, আমাদেরক বলেছেন খালিদ ইবনু আবূ খালিদ ও আবূ আউন উভয়ে শা’বী ও আসওয়াদ ইবনু মাইমূন থেকে, তিনি হারূন আবূ কুযা‘আহ থেকে, তিনি হাতিব-এর বংশের জনৈক ব্যক্তি থেকে, তিনি হাতিব (রা) থেকে, হাতিব (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন ....।’’[8]
ইতোপূর্বে ৩ নং হাদীসের সনদ আলোচনার সময় আমরা দেখতে পেয়েছি যে, হারূন আবূ কুযা‘আহ অপরিচিত, অগ্রহণযোগ্য ও পরিত্যক্ত রাবী। এ সনদে হারূন-এর উস্তাদ ‘হাতিব-এর বংশের জনৈক ব্যক্তি’ শুধু অজ্ঞাত পরিচয়ই নন, তিনি অজ্ঞাতনামাও বটে।
দ্বিতীয় সনদ: ৩য় শতকের মুহাদ্দিস ইউসূফ ইবনু মূসা বলেন, আমাদেরকে ওকী’ বলেছেন, আমাদেরকে মাইমূন ইবনু সিওয়ার (সিওয়ার ইবনু মাইমূন) বলেছেন, আমাকে হারূন আবূ কুযা‘আহ বলেছেন...। [9]
এ সনদটি প্রথম সনদের চেয়েও দুর্বল। কারণ উপরে ৩ নং হাদীসের আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, সিওয়ার ইবনু মাইমূন অজ্ঞাত পরিচয়।
উপরের তিনটি হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাতের পরেও যে মুমিন তাঁর কবর যিয়ারত করবে, সে জীবদ্দশায় তাঁর সাথে সাক্ষাতের মর্যাদা লাভ করবে। আমরা দেখেছি যে, তিনটি সনদই অত্যন্ত দুর্বল। প্রথম ও দ্বিতীয় সনদে ‘মিথ্যায় অভিযুক্ত’ রাবী রয়েছেন। তৃতীয় সনদের পরিত্যাক্ত রাবী রয়েছে। এছাড়া সনদগুলোতে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতনামা ও অজ্ঞাত পরিচয় রাবী রয়েছে। এ কারণে ইবনু তাইমিয়া, ইবনু আব্দুল হাদী, আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ হাদীসগুলোকে ‘মাউদূ’ বা জাল বলে গণ্য করেছেন।
সনদগত অগ্রহণযোগ্যতা ছাড়াও অর্থগতভাবেও হাদীসগুলো ইসলামের মূল চেতনার বিরোধী বলে তাঁরা দাবী করেছেন। ইবনু তাইমিয়া বলেন, এ কথা যে মিথ্যা তা স্পষ্ট। এ কথা মুসলিমদের ধর্মের বিরোধী। কারণ যে মুমিন ব্যক্তি জীবদ্দশায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর যিয়ারত বা সাক্ষাত করবেন তিনি তাঁর সাহাবী বলে গণ্য হবেন। .... পরবর্তী যুগের একজন মুমিন বড় বড় ফরয ওয়াজিব আমলগুলি বেশি বেশি পালন করেও কখনোই একজন সাহাবীর সমমর্যাদা-সম্পন্ন হতে পারেন না। তাহলে একটি মুস্তাহাব ইবাদত পালনের মাধ্যমে কিভাবে তিনি একজন সাহাবীর সমমর্যাদা লাভ করবেন?![10]
[2] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/২৪৬; শু‘আবুল ঈমান ৩/৪৮৯।
[3] যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ২/৩১৯-৩২১; ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ১৭২।
[4] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/৫০৯; ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ৪৬৪।
[5] তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ১২/৪০৬; আল-মু’জামুল আউসাত ১/৯৪।
[6] ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ১/২৫৭।
[7] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২৬৬-২৬৭; আলবানী, যায়ীফাহ ১/১২৩-১২৪।
[8] দারাকুতনী, আস-সুনান ২/২৭৮; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/২৪৫; শু‘আবুল ঈমান ৪/৪৮৮; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৬/১৮০।
[9] বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৪/৪৮৮; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৭/৬৩; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৬/১৮০।
[10] আলবানী, যায়ীফাহ ১/১২০-১২৪; ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৩৫-৩৪১।