হাদীসের নামে জালিয়াতি বার চাঁদের সালাত ও ফযীলত ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

 রজব মাসকে নিয়ে যত বেশি মিথ্যা হাদীস তৈরি করা হয়েছে, তত বেশি আর কোনো মাসকে নিয়ে করা হয় নি। সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানী, জমাদিউল আউয়াল ও জমাদিউস সানী এ ৫ মাসের ফযীলত বা খাস ইবাদত বিষয়ক যা কিছু বানোয়াট কথাবার্তা তা মূলত গত কয়েক শত বছর যাবত ভারতীয় উপমহাদেশেই প্রচলিত হয়েছে। ৫ম/৬ষ্ঠ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত মাউযূ হাদীস বা ফযীলতের বইগুলোতেও এ সকল মাসের উল্লেখ পাওয়া যায় না। এ সকল যুগে যে সকল নেককার সরলপ্রাণ বুযুর্গ ফযীলত ও আমলের বিষয়ে সত্য-মিথ্যা সকল কথাই জমা করে লিখতেন তাদের বই-পুস্তকেও এ মাসগুলোর কোনো প্রকারের উল্লেখ নেই। তাঁরা মূলত রজব মাস দিয়েই তাদের আলোচনা শুরু করতেন এবং মুহার্রাম মাস দিয়ে শেষ করতেন।

আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, রজব মাস ইসলামী শরীয়তের ‘হারাম’ অর্থাৎ ‘নিষিদ্ধ’ বা ‘সম্মানিত’ মাসগুলির অন্যতম। জাহিলী যুগ থেকেই আরবরা ‘ইবরাহীম (আঃ)-এর শরীয়ত’ অনুসারে এ মাসগুলোর সম্মান করত। তবে ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে অনেক কুসংস্কার ও রসম-রেওয়াজ প্রবেশ করে। জাহিলী যুগে আরবরা এ মাসকে বিশেষ ভাবে সম্মান করত। এ মাসে তারা ‘আতীরাহ’ নামে এক প্রকারের ‘কুরবানী’ করত এবং উৎসব করত। হাদীস শরীফে তা নিষেধ করা হয়েছে।[1]

‘হারাম’ মাস হিসাবে সাধারণ মর্যাদা ছাড়া ‘রজব’ মাসের মর্যাদায় কোনো সহীহ হাদীসে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয় নি। এ মাসের কোনোরূপ মর্যাদা, এ মাসের কোনা দিনে বা রাতে কোনো বিশেষ সালাত, সিয়াম, যিক্র, দোয়া, তিলাওয়াত বা কোনো বিশেষ ইবাদতের বিশেষ কোনো ফযীলত আছে এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনোরূপ কোনো হাদীস সহীহ বা গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। পরবর্তী যুগের তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ীগণ থেকে সামান্য কিছু কথা পাওয়া যায়। কিন্তু এ বিষয়ে অনেক জাল কথা প্রচলিত। যেহেতু আমাদের দেশে সাধারণভাবে ২৭ রজব ছাড়া অন্য কোনো দিবস বা রাত্রি কেন্দ্রিক জাল হাদীসগুলো তেমন প্রসিদ্ধ নয়, সেহেতু ২৭ রজবের বিষয়ে কিছু বিস্তারিত আলোচনা ও বাকি বিষয়গুলো সংক্ষেপে আলোচনার ইচ্ছা করছি। মহান আল্লাহর দরবারে তাওফীক প্রার্থনা করছি।

(ক) সাধারণভাবে রজব মাসের মর্যাদা

সাধারণভাবে ‘রজব’ মাসের মর্যাদা, এ মাসে কী কী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে এবং এ মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যে কোনো সময়ে বা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকারের সালাত, সিয়াম, দান, দোয়া ইত্যাদি ইবাদত করলে কী অকল্পনীয় পরিমাণে সাওয়াব বা পুরস্কার পাওয়া যাবে তার বর্ণনায় অনেক জাল হাদীস বানানো হয়েছে। আমাদের দেশের প্রচলিত ‘বার চাঁদের ফযীলত’ ও আমল-ওযীফা বিষয়ক বইগুলোতে এগুলোর সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়।

যেমন, অন্য মাসের উপর রজবের মর্যাদা তেমনি, যেমন সাধারণ মানুষের কথার উপরে কুরআনের মর্যাদা...। এ মাসে নূহ (আঃ) ও তাঁর সহযাত্রীগণ নৌকায় আরোহণ করেন...। এ মাসেই নৌকা পানিতে ভেসেছিল ...। এ মাসেই রক্ষা পেয়েছিল। এ মাসেই আদমের তাওবা কবুল হয়। ইউনূস (আঃ)-এর জাতির তাওবা কবুল করা হয়। এ মাসেই ইবরাহীম (আঃ) ও ঈসা (আঃ) এর জন্ম। এ মাসেই মূসার জন্য সমুদ্র দ্বিখন্ডিত হয়। ....

এ মাসের প্রথম তারিখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেন। এ মাসের ২৭ তারিখে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন।... এ মাসের ২৭ তারিখে তিনি মি’রাজে গমন করেন। ... এ মাসে সালাত, সিয়াম, দান-সাদকা, যিক্র, দরুদ, দোয়া ইত্যাদি নেক আমল করলে তার সাওয়াব বৃদ্ধি পায় বা বহুগুণ বেড়ে যায়...। ইত্যাদি সবই ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা ও জাল হাদীস।[2]

পূর্ববর্তী অনেক বুযুর্গের আমল ও ফাযাইল বিষয়ক গ্রন্থে এগুলোর সমাবেশ রয়েছে। তবে আমাদের সমাজের সাধারণ ধার্মিক মুসলিমদের মধ্যে এগুলোর প্রচলন কম। এজন্য এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা বর্জন করছি।

(খ) রজব মাসের সালাত

রজব মাসে সাধারণভাবে এবং রজব মাসের ১ তারিখ, ১ম শুক্রবার, ৩, ৪, ৫ তারিখ, ১৫ তারিখ, ২৭ তারিখ, শেষ দিন ও অন্যান্য বিশেষ দিনে বা রাতে বিশেষ সালাত আদায়ের বিশেষ পদ্ধতি ও সেগুলোর অভাবনীয় পুরস্কারের ফিরিস্তি দিয়ে অনেক জাল হাদীস প্রচারিত হয়েছে। পূর্ববর্তী যুগের আমল, ওযীফা ও ফাযাইল বিষয়ক পুস্তকাদিতে এবং আমাদের দেশের বার চান্দের ফযীলত, আমল-ওযীফা ও অন্যান্য পুস্তকে এগুলোর কিছু কথা পাওয়া যায়। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এগুলোর প্রচলন কম। এজন্য এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করছি না। মুহাদ্দিসগণ এক্ষেত্রে যে মূলনীতি উল্লেখ করেছেন তা বলেই শেষ করছি। আল্লামা ইবনু রাজাব, ইবনু হাজার, সুয়ূতী, মোল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস একবাক্যে বলেছেন, রজব মাসে বিশেষ কোনো সালাত বা রজব মাসের কোনো দিনে বা রাতে কোনো সময়ে কোনো সালাত আদায় করলে বিশেষ সাওয়াব পাওয়া যাবে এ মর্মে একটি হাদীসও গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল ও বানোয়াট।[3]

(গ) রজব মাসের দান, যিকর ইত্যাদি

রজব মাসের দান, যিক্র, দরূদ, দোয়া ইত্যাদি নেক আমলের বিশেষ কোনো সাওয়াব হবে বা সাধারণ সাওয়াব বৃদ্ধি পাবে এ মর্মে যা কিছু বর্ণিত ও প্রচলিত হয়েছে সবই বাতিল ও ভিত্তিহীন।[4]

(ঘ) রজব মাসের সিয়াম

সবচেয়ে বেশি জাল হাদীস প্রচলিত হয়েছে রজব মাসের সিয়াম পালনের বিষয়ে। বিভিন্নভাবে এ মাসে সিয়াম পালনের উৎসাহ দিয়ে জালিয়াতগণ হাদীস জাল করেছে। কোনো কোনো জাল হাদীসে সাধারণভাবে রজব মাসে সিয়াম পালন করলে কত অভাবনীয় সাওয়াব তা বলা হয়েছে। কোনোটিতে রজব মাসের নির্ধারিত কিছু দিনের সিয়াম পালনের বিভিন্ন বানোয়াট সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে। কোনোটিতে রজব মাসে ১ টি সিয়ামের কি সাওয়াব, ২টি সিয়ামের কি সাওয়াব, ৩টির কি সাওয়াব.... ৩০টি সিয়ামের কত সাওয়াব ইত্যাদি কথা বলা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন যে, রজব মাসের সিয়ামের বিশেষ সাওয়াব বা রজব মাসের বিশেষ কোনো দিনে সিয়াম পালনের উৎসাহ জ্ঞাপক সকল হাদীসই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনো কথাই নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি।[5]

(ঙ) লাইলাতুর রাগাইব

রজব মাস বিষয়ক জাল হাদীসের মধ্যে অন্যতম হলো ‘লাইলাতুর রাগাইব’ ও সে রাত্রির বিশেষ সালাত বিষয়ক জাল হাদীস। মুহাদ্দিসগণ একমত যে এ রাত্রির নামকরণ, ফযীলত, এ রাত্রির সালাতের ফযীলত, রাক‘আত সংখ্যা, সূরা কিরাআত, পদ্ধতি সব কিছুই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা। কিন্তু বিষয়টি অনেক মুসলিম দেশে ব্যাপক প্রচার লাভ করেছে।

প্রথমে কিছু জালিয়াত এ রাত্রিটির নামকরণ ও এ বিষয়ক কিছু আজগুবি গল্প বানায়। ক্রমান্বয়ে বিষয়টি আকর্ষণীয় ওয়াযে পরিণত হয়। জাল হাদীসের একটি বৈশিষ্ট্য, তা সাধারণ মানুষের চিত্তাকর্ষক হয় এবং কোনো একটি জাল হাদীস একবার ‘বাজার পেলে’ তখন অন্যান্য জালিয়াতও বিভিন্ন সনদ বানিয়ে তা বলতে থাকে। এভাবে অনেক জাল হাদীস সমাজে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। সালাতুর রাগাইব বিষয়ক হাদীসগুলোও সেরূপ। হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর পরে এই জাল হাদীসগুলো প্রচারিত ও প্রসিদ্ধি লাভ করলে সাধারণ মুসল্লীগণ অনেক দেশে উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে ঘটা করে সালাতুর রাগাইব পালন করতে শুরু করেন। এ সকল সমাজে ‘লাইলাতুর রাগাইব’ আমাদের দেশের ‘লাইলাতুল বারাত’-এর মতই উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়।

এ বানোয়াট সালাতটি আমাদের দেশে তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করে নি। এজন্য এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি না। এর সার সংক্ষেপ হলো, রজব মাসের প্রথম শুক্রবারের রাত্রি হলো ‘লাইলাতুর রাগাইব’ বা ‘আশা-আকাঙক্ষা পূরণের রাত’। রজবের প্রথম বৃহস্পতিবারে সিয়াম পালন করে, বৃহস্পতিবার দিবাগত শুক্রবারের রাত্রিতে মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে ১২ রাক‘আত সালাত নির্ধারিত সূরা, আয়াত ও দোয়া-দরূদ দিয়ে আদায় করবে। .... তাহলে এ ব্যক্তি এত এত.... পুরস্কার লাভ করবে।... এর সাথে আরো অনেক কল্প কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে এ সকল জাল হাদীসে।

এ সকল হাদীসের প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে মুহাদ্দিসগণ সেগুলির সূত্র ও উৎস নিরীক্ষা করে এর জালিয়াতির বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর সকল মুহাদ্দিস একমত যে, ‘লাইলাতুর রাগাইব’ ও ‘সালাতুর রাগাইব’ বিষয়ক সকল কথা মিথ্যা, জাল ও বানোয়াট।[6]

(চ) রজব মাসের ২৭ তারিখ

বর্তমানে আমাদের সমাজে ২৭শে রজব মি’রাজ-এর রাত বলেই প্রসিদ্ধ। সে হিসেবেই্আমাদের দেশের মুসলিমগণ এ দিনটি উদযাপন করে থাকেন। কিন্তু এ প্রসিদ্ধির আগেও রজব মাসের ২৭ তারিখ বিষয়ক আরো অনেক কথা প্রচলিত হয়েছিল এবং এই তারিখের দিবসে ও রাতে ইবাদত বন্দেগির বিষয়ে অনেক জাল কথা প্রচলিত হয়েছিল। প্রথমে আমরা ‘লাইলাতুল মি’রাজ’ সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। এরপর এ দিন সম্পর্কে প্রচলিত বানোয়াট ও জাল হাদীসগুলো আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।

১. লাইলাতুল মি’রাজ

ইসরা ও মি’রাজের ঘটনা বিভিন্নভাবে কুরআন কারীমে ও অনেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে প্রায় অর্ধশত সাহাবী থেকে মি’রাজের ঘটনার বিভিন্ন দিক ছোট বা বড় আকারে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোনো হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে মি’রাজের তারিখ সম্পর্কে একটি কথাও বর্ণিত হয় নি। সাহাবীগণ কখনো তাঁকে তারিখ সম্পর্কে প্রশ্নও করেছেন বলে জানা যায় না। পরবর্তী যুগের তাবিয়ীদেরও একই অবস্থা ; তাঁরা এ সকল হাদীস সাহাবীদের থেকে শিখছেন, কিন্তু তাঁরা তারিখ নিয়ে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করছেন না। কারণ, তাঁদের কাছে তারিখের বিষয়টির কোনো মূল্য ছিল না, এসকল হাদীসের শিক্ষা গ্রহণই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। ফলে তারিখের বিষয়ে পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। মি’রাজ একবার না একাধিকবার সংঘঠিত হয়েছে, কোন্ বছর হয়েছে, কোন্ মাসে হয়েছে, কোন্ তারিখে হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে এবং প্রায় ২০টি মত রয়েছে। মাসের ক্ষেত্রে অনেকেই বলেছেন রবিউল আউয়াল মাসের ২৭ তারিখ। কেউ বলেছেন রবিউস সানী মাসে, কেউ বলেছেন রজব মাসে, কেউ বলেছেন, রমযান মাসে, কেউ বলেছেন শাওয়াল মাসে, কেউ বলেছেন যিলকাদ মাসে এবং কেউ বলেছেন, যুলহাজ্জ মাসে। তারিখের বিষয়ে আরো অনেক মতবিরোধ আছে।

দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে তাবিয়ী ঐতিহাসিকগণ মি’রাজের ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁরা কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করতে পারেন নি। পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ মি’রাজের তারিখ বিষয়ক মতভেদ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইবনু কাসীর (৭৭৪ হি.), ইবনু হাজার আসকালানী (৮৫২ হি.), আহমাদ বিন মুহাম্মাদ কাসতালানী (৯২৩হি.), মুহাম্মাদ বিন ইউসূফ শামী (৯৪২ হি.), আব্দুল হাই লাখনবী (১৩০৪হি) ও অন্যান্যরা এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।[7]

এত মতবিরোধের কারণ হাদীস শরীফে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয় নি এবং সাহাবীগণও কিছু বলেন নি। তাবি-তাবিয়ীদের যুগে তারিখ নিয়ে কথা শুরু হয়, কিন্তু কেউই সঠিক সমাধান না দিতে পারায় তাঁদের যুগ ও পরবর্তী যুগে এত মতবিরোধ হয়। এ মতবিরোধ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, কয়েক শতক আগেও ‘শবে মি’রাজ’ বলতে নির্দিষ্ট কোনো রাত নির্দিষ্ট ছিল না।

এভাবে আমরা দেখছি যে, রজব মাসের ২৭ তারিখে মি’রাজ হয়েছিল, বা এ তারিখটি ‘লাইলাতুল মি’রাজ’, এই কথাটি তাবিয়ী ও পরবর্তী যুগের ঐতিহাসিকগণের অনেক মতের একটি মত মাত্র। এ কথাটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এ তারিখে মি’রাজ হওয়া সম্পর্কে কোনো কিছুই সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই ঐতিহাসিকগণের মতামত অথবা বানোয়াট কথাবার্তা।

আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, কোনো কোনো জাল হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, রজব মাসের ২৭ তারিখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেন, নবুয়ত লাভ করেন ... ইত্যাদি। এগুলোও বাতিল ও মিথ্যা কথা।

২. ২৭ রজবের ইবাদত

মি’রাজের রাত্রিতে ইবাদত বন্দেগি করলে বিশেষ কোনো সাওয়াব হবে এ বিষয়ে একটিও সহীহ বা যয়ীফ হাদীস নেই। মি’রাজের রাত কোন্টি তাই হাদীসে বলা হয়নি, সেখানে রাত পালনের কথা কী-ভাবে আসে। তবে ২৭ রজবের দিনে এবং রাতে ইবাদত বন্দেগির ফযীলতের বিষয়ে কিছু জাল হাদীস প্রচলিত আছে। এ সকল জাল হাদীসে মি’রাজের রাত হিসেবে নয়, বরং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নবুয়ত প্রাপ্তির দিবস হিসেবে বা একটি ফযীলতের দিন হিসেবে ‘২৭ রজব’-কে বিশেষ মর্যাদাময় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এরূপ একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে:

إِنَّ فِيْ رَجَبٍ يَوْماً وَلَيْلَةً مَنْ صَامَ ذَلِكَ الْيَوْمَ وَقَامَ تِلْكَ اللَّيْلَةَ كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ كَمَنْ صَامَ مِائَةَ سَنَةٍ وَقَامَ لَيَالِيَهَا وَهِيَ لِثَلاَثَةٍ بَقِيْنَ مِنْ رَجَبٍ وَهُوَ الْيَوْمُ الَّذِيْ بُعِثَ فِيْهِ مُحَمَّدٌﷺ، وَهُوَ أَوَّلُ يَوْمٍ نَزَلَ فِيْهِ جِبْرِيْلُ عَلَى مُحَمَّدٍﷺ.

‘‘রজব মাসের মধ্যে একটি দিন আছে, কেউ যদি সে দিনে সিয়াম পালন করে এবং সে দিনের রাত দাঁড়িয়ে (সালাতে) থাকে তাহলে সে ১০০ বছর সিয়াম পালন করার ও রাত জেগে সালাত আদায়ের সাওয়াব লাভ করবে। সে দিনটি রজব মাসের ২৭ তারিখ। এ দিনেই মুহাম্মাদ (ﷺ) নবুয়ত লাভ করেন, এ দিনেই সর্বপ্রথম জিবরাঈল মুহাম্মাদ (ﷺ) উপর অবতরণ করেন।’’[8]

অন্য একটি জাল হাদীস নিম্নরূপ:

مَنْ صَلَّى لَيْلَةَ سَبْعٍ وَعِشْرِيْنَ مِنْ رَجَبٍ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً يَقْرَأُ فِيْ كُلِّ رَكْعَةٍ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ وَسُوْرَةٍ، فَإِذَا فَرَغَ مِنْ صَلاَتِهِ قَرَأَ فَاتِحَةَ الْكِتَابِ سَبْعَ مَرَّاتٍ وَهُوَ جَالِسٌ ثُمَّ يَقُوْلُ سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ للهِ وَلاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ الْعَلِيِّ الْعَظِيْمِ أَرْبَعَ مَرَّاتٍ، ثُمَّ أَصْبَحَ صَائِماً حَطَّ اللهُ عَنْهُ ذُنُوْبَ سِتِّيْنَ سَنَةً وَهِيَ اللَّيْلَةُ الَّتِيْ بُعِثَ فِيْهَا مُحَمَّدٌ ﷺ.

‘‘যদি কেউ রজব মাসের ২৭ তারিখে রাত্রিতে ১২ রাক‘আত সালাত আদায় করে, প্রত্যেক রাক‘আতে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পাঠ করে, সালাত শেষ হলে সে বসা অবস্থাতেই ৭ বার সূরা ফাতিহা পাঠ করে এবং এরপর ৪ বার ‘সুবহানাল্লাহ, ওয়ালহামদুলিল্লাহ, ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আযীম’ বলে, অতঃপর সকালে সিয়াম শুরু করে, তবে আল্লাহ তার ৬০ বছরের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। এ রাতেই মুহাম্মাদ (ﷺ) নবুয়ত পেয়েছিলেন।’’[9]

অন্য একটি জাল হাদীসের ভাষা নিম্নরূপ:

بُعِثْتُ نَبِيًّا فِيْ السَّابِعِ وَالْعِشْرِيْنَ مِنْ رَجَبٍ فَمَنْ صَامَ ذَلِكَ الْيَوْمَ كَانَ كَفَّارَةَ سِتِّيْنَ شَهْراً

‘‘রজব মাসের ২৭ তারিখে আমি নবুয়ত পেয়েছি। কাজেই যে ব্যক্তি এই দিনে সিয়াম পালন করবে তার ৬০ মাসের গোনাহের কাফফারা হবে।’’[10]

আরেকটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে, ‘‘ইবনু আববাস (রা) ২৭শে রজবের সকাল থেকে ইতিকাফ শুরু করতেন। যোহর পর্যন্ত সালাতে রত থাকতেন। যোহরের পরে অমুক অমুক সূরা দিয়ে চার রাক‘আত সালাত আদায় করতেন... এবং আসর পর্যন্ত দোয়ায় রত থাকতেন...। তিনি বলতেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরূপ করতেন।’’[11] এগুলো সবই জঘন্য মিথ্যা কথা।

২৭ রজবের ফযীলতে এবং এ দিনে ও রাতে সালাত, সিয়াম, দোয়া ইত্যাদি ইবাদতের ফযীলতে অনুরূপ আরো অনেক মিথ্যা কথা জালিয়াতগণ প্রচার করেছে। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, ২৭ রজব সম্পর্কে হাদীস নামে যা কিছু প্রচলিত সবই ভিত্তিহীন, বাতিল ও জাল। রজব মাস এবং এ মাসের কোনো দিন বা রাতের বিশেষ ফযীলতের বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীসই ভিত্তিহীন। ২৭ রজব বিষয়ক হাদীসগুলোও এ সকল বাতিলের অন্তর্ভুক্ত। ইবনু হাজার আসকালানী, মোল্লা আলী কারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আজলূনী, আব্দুল হাই লাখনবী, দরবেশ হূত প্রমুখ মুহাদ্দিস বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ২৭ রজবের ফযীলত, এ তারিখের রাত্রে ইবাদত বা দিনের সিয়াম পালনের বিষয়ে বর্ণিত সকল কথাই বানোয়াট, জাল ও ভিত্তিহীন।[12]

[1] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২০৮৩; মুসলিম, আস-সহীহ, ৩/১৫৬৪; ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/১৯২-১৯৪।

[2] ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/১৯৯; ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৯-৮০; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ১৬৬; আল-মাসনূ, পৃ. ৯৭; লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮-৯০।

[3] ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/১৯৪; ইবনু হাজার আসকালানী, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৯-৮০; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৩৮; আল-মাসনূ, পৃ. ২০৮; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮-৯০, ১১১-১১৩।

[4] ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/১৯৭; ইবনু হাজার আসকালানী, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৯-৮০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮-৯০।

[5] ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার, পৃ. ৯৬; ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/১৯৫-১৯৭; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ৩৯২-৩৩০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, ৫৮-৭৯; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৫৩৯-৫৪১; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৫৬৭।

[6] ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/৪৬-৪৮; ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/১৯৪-১৯৫; ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৫৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/৫৫-৫৬; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/৩০৩, ৩০৬, ২/৯০-৯১; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ৩২৮; আল-মাসনূ, পৃ. ২০৮; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৫৩৯-৫৪১; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৬২-৭৭।

[7] দেখুন: ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/৪৭০-৪৮০, শামী, সুবুলুল হুদা (সিরাহ শামিয়া), ৩/৬৪-৬৬, কাসতালানী, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ ২/৩৩৯-৩৯৮।

[8] জূযকানী, আল-আবাতীল, ২/৪৮; ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৬৩; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ১১৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৬১; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১১৬; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৫৩৯; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮।

[9] ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৫২; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৫৮।

[10] ইবনু হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৬৪; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৬১।

[11] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৭৮।

[12] ইবন হাজার, তাবয়ীনুল আজাব, পৃ. ৬৪; আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৮৯; আল-মাসনূ, পৃ. ২০৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৫৫৪; লাখনবী, আল-আসার ৭৭-৭৯।