হাদীসের নামে জালিয়াতি আহল বাইত, সাহাবী-তাবিয়ী ও উম্মাত ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

হাসান বসরী (২২-১০৯হি) একজন প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে অনেক মিথ্যা ও বানোয়াট কথা সমাজে প্রচলিত। যেমন, ‘হাসান বসরী’ ও ‘রাবেয়া বসরী’ দুজনের কথাবার্তা, আলোচনা ইত্যাদি আমাদের সমাজে অতি পরিচিত। অথচ দুজন সমবয়সী বা সমসাময়িক ছিলেন না। রাবেয়া বসরী ১০০ হিজরী বা তার কাছাকাছি সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮০/১৮১ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। হাসান বসরী যখন ইন্তেকাল করেন তখন রাবেয়া বসরীর বয়স মাত্র ১০/১১ বছর। এ থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, এ দুজনকে নিয়ে প্রচলিত গল্পকাহিনীগুলো সবই বানোয়াট।

তবে সবচেয়ে মারাত্মক তাঁকে কেন্দ্র করে রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে বানোয়াট কথা। যেমন, প্রচলিত আছে যে, হাসান বসরী আলীর (রা) মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ () থেকে ‘‘তরীকত’’ গ্রহণ করেন বা চিশতিয়া তরীকতের খিরকা, লাঠি ইত্যাদি গ্রহণ করেন। এ কথাটি ভিত্তিহীন।

হাসান বসরী (রাহ) তাবিয়ীগণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুজাহিদ, ওয়ায়িয ও সংসারত্যগী বুযুর্গ ছিলেন। তিনি হাদীস ও ফিক্হ শিক্ষা দানের পাশাপাশি জাগতিক লোভ-লালসার বিরুদ্ধে এবং জীবনকে আল্লাহর ভালবাসা ও আখিরাত কেন্দ্রিক করার জন্য ওয়ায করতেন। সঙ্গীগণের সাথে বসে আখিরাতের কথা স্মরণ করে আল্লহর প্রেমে ও আল্লাহর ভয়ে কাঁদাকাটি করতেন। তাঁর এসকল মাজলিসের বিশেষ প্রভাব ছিল সে যুগের মানুষদের মধ্যে। পরবর্তী যুগের অধিকাংশ সূফী দরবেশ তাঁর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং তাঁর থেকে শিক্ষা নিয়েছেন।

হাসান বসরীর (রাহ) যুগে তাসাউফ, সূফী ইত্যাদি শব্দ অপরিচিত ছিল। এছাড়া প্রচলিত অর্থে তরীকতও অপরিচিত ছিল। তাঁরা মূলত কুরআন ও হাদীসের আলোকে আল্লাহর মহববত ও আখিরাতের আলোচনা করতেন এবং বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগিতে লিপ্ত থাকতেন। তরীকতের জন্য নির্দিষ্ট কোন মানুষের কাছে গমনের রীতিও তখন ছিল না। বিভিন্ন সাহাবী ও তাবিয়ীর সামগ্রিক সাহচর্যে মানুষ হৃদয়ের পূর্ণতা লাভ করত। প্রায় ৫০০ বছর পরে, যখন সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বিচ্ছিন্নতা ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ও তাতারদের ভয়াবহ হামলায় ছিন্নভিন্ন, তখন হিজরী ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতকে প্রচলিত তরীকাগুলো প্রতিষ্ঠা ও প্রসার লাভ করে।

কাদিরীয়া তরীকার সম্পর্ক আব্দুল কাদির জীলানীর (মৃ ৫৬১হি/ ১১৬৬ খৃ) সাথে। তবে তিনি প্রচলিত কাদিরীয়া তরীকা প্রতিষ্ঠিত বা প্রচলিত করেন নি। তাঁর অনেক পরে তা প্রচলিত হয়েছে। রিফায়ী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ ইবনু আলী রিফায়ী (মৃ ৫৭৮ হি)। সোহরাওয়ার্দী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (মৃ. ৬৩২হি)। মুঈনউদ্দীন চিশতী চিশতিয়া তরীকার মূল প্রচারক। তিনি ৬৩৩হি/১২৩৬খৃ ইন্তেকাল করেন। আলী ইবনু আব্দুল্লাহ শাযলী (৬৫৬হি/১২৫৮খৃ) শাযলিয়া তরীকা প্রতিষ্ঠা করেন। মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ বুখারী বাহাউদ্দীন নকশবন্দ (মৃ ৭৯১হি/ ১৩৮৯খৃ) নকশাবন্দিয়া তরীকার প্রতিষ্ঠা করেন। রাহিমাহুমুল্লাহ- আল্লাহ তাঁদেরকে রহমত করুন। তাঁরা কুরআন ও হাদীসের আলোকে মাসনূন ইবাদতগুলো বেছে তার আলোকে মুসলিমগণের আধ্যাত্মিক উন্নতির চেষ্টা করেন। প্রকৃতপক্ষে সে অন্ধকার ও কষ্টকর দিনগুলোতে এঁরাই সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করেন।

পরবর্তী যুগের একটি প্রচলিত কথা হলো, চিশতিয়া তরীকা ও অন্য কিছু তরীকা হাসান বসরী (রাহ) আলীর (রা) মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ থেকে লাভ করেছেন। তিনি আলী (রা) থেকে খিরকা বা খিলাফত লাভ করেছেন ও ‘তরীকতের ‘সাজ্জাদ-নশীন’ হয়েছেন। কথাটি ভিত্তিহীন।

হাসান বসরী (রাহ) ২২ হিজরীতে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স যখন ১৩ বছর তখন ৩৫ হিজরীতে আলী (রা) খলীফা নিযুক্ত হন এবং খিলাফতের রাজধানী মদীনা থেকে কুফায় স্থানান্তর করেন। এরপর আর হাসান বসরী (রাহ) আলীকে (রা) দেখেন নি। তিনি আলী (রা)-এর দরবারে বসে শিক্ষা গ্রহণেরই কোনো সুযোগ পান নি। ৪০ হিজরীতে আলী (রা) শহীদ হন। আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, আলী (রা) তাঁর যোগ্যতম সন্তানগণ, অগণিত নেতৃস্থানীয় ভক্ত, ছাত্র ও সহচরদের বাদ দিয়ে ১৩ বছরের কিশোরকে খিরকা ও খিলাফত দিয়ে যান নি বা সাজ্জাদ-নশীন করেন নি। ইবনু দাহিয়া, ইবনুস সালাহ, যাহাবী, ইবনু হাজার, সাখাবী, মোল্লা আলী কারী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, এগুলো সব ভিত্তিহীন ও বাতিল কথা।[1]

[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৩৩৫; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৮১; আল-মাসনূ, পৃ: ১১১; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/১৮০-১৮১; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৫৬।