হাদীসের নামে জালিয়াতি আহল বাইত, সাহাবী-তাবিয়ী ও উম্মাত ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

তাবিয়ী ও পরবর্তী যুগের বুযুর্গগণের বিষয়ে অগণিত বানোয়াট কথা প্রচলিত। তন্মধ্যে উয়াইস কারনী (রাহ) বিষয়ক গল্পগুলো প্রসিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ তাঁর জীবদ্দশায় ইয়ামানের ‘‘কার্ন’’ গোত্রের উয়াইস ইবনু আমির নামক এক ব্যক্তির কথা সাহাবীগণকে বলেন এবং তাঁর ওফাতের পরে উমারের (রা) সাথে তাঁর সাক্ষাতের কথা সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী যুগে উয়াইস (রাহ)- কে কেন্দ্র করে অনেক আজগুবি মিথ্যা কথা বানানো হয়েছে। অনেক বক্তা শ্রোতাগণকে বিমুগ্ধ করার জন্য আজগুবি কথা বানিয়েছেন। অনেক সরলপ্রাণ দরবেশ যা শুনেছেন তাই বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে কিছু আছে উয়াইস কেন্দ্রিক। আর কিছু কথা বানানো হয়েছে রাসূলুল্লাহর নামে। এগুলো নিঃসন্দেহে বেশি ভয়ঙ্কর ও কঠিনতম গোনাহ।

উয়াইস ইবনু আমির আল-কার্নী (রাহ) সম্পর্কে সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত সহীহ হাদীসে যতটুকু বর্ণিত হয়েছে তার সার সংক্ষেপ হলো: উমার (রা) যখন খলীফা ছিলেন (১৩- ২৩ হি) তখন তাঁর কাছে ইয়ামানের সৈন্যদল আগমন করলে তিনি জিজ্ঞাসা করতেন? আপনাদের মধ্যে কি উয়াইস ইবনু আমির নামে কেউ আছেন? এভাবে একবার তিনি উয়াইসকে পেয়ে যান। তিনি বলেন: আপনি উয়াইস? উয়াইস বলেন: হাঁ, উমার বলেন: আপনি কারন গোত্রের শাখা মুরাদ গোত্রের মানুষ? তিনি বলেন: হাঁ। উমার বলেন: আপনার শরীরে কুষ্ঠ রোগ ছিল এবং শুধুমাত্র নাভীর কাছে একটি দিরহাম পরিমাণ স্থান ছাড়া বাকী সব আল্লাহ ভাল করে দিয়েছেন? তিনি বলেন: হাঁ। তিনি বলেন: আপনার আম্মা আছেন? তিনি বলেন: হাঁ। তখন উমার বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ ()-কে বলতে শুনেছি,

يَأْتِي عَلَيْكُمْ أُوَيْسُ بْنُ عَامِرٍ مَعَ أَمْدَادِ أَهْلِ الْيَمَنِ مِنْ مُرَادٍ ثُمَّ مِنْ قَرَنٍ كَانَ بِهِ بَرَصٌ فَبَرَأَ مِنْهُ إِلاِّ مَوْضِعَ دِرْهَمٍ، لَهُ وَالِدَةٌ هُوَ بِهَا بَرٌّ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللَّهِ لأَبَرَّهُ فَإِنْ اسْتَطَعْتَ أَنْ يَسْتَغْفِرَ لَكَ فَافْعَلْ. وفي رواية: إِنَّ خَيْرَ التَّابِعِينَ رَجُلٌ يُقَالُ لَهُ أُوَيْسٌ ..... فَمُرُوهُ فَلْيَسْتَغْفِرْ لَكُمْ

‘‘ইয়ামানের সৈন্যদলের সাথে উয়াইস ইবনু আমির তোমাদের কাছে আগমন করবে। সে কার্ন গেত্রের শাখা মুরাদ গোত্রের মানুষ। তার শরীরে কুষ্ঠ রোগ ছিল। আল্লাহ এক দিরহাম পরিমাণ স্থান ছাড়া বাকী সব ভাল করে দিয়েছেন। তার আম্মা আছেন। সে তার আম্মার সেবা করে। সে যদি আল্লাহর কাছে কসম করে কিছু বলে তবে আল্লাহ তার কথা রাখবেন। যদি তুমি তার কাছে তোমার গোনাহ মাফের জন্য দুআ চাইতে পার তবে চাইবে।’’ অন্য বর্ণনায়: ‘‘তাবিয়ীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ‘‘উয়াইস’’ নামক এক ব্যক্তি।... তোমরা তাকে বলবে তোমাদের জন্য ক্ষমা চাইতে।’’

একথা বলে উমার (রা) বলেন: আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তখন উয়াইস আল্লাহর কাছে উমারের গোনাহের ক্ষমার জন্য দোয়া করেন। উমার তাঁকে বলেন: আপনি কোথায় যাবেন? তিনি বলেন: আমি কুফায় যাব। উমার বলেন: তাহলে আমি আপনার জন্য কুফার গভর্নরের কাছে চিঠি লিখে দিই? উয়াইস বলেন: অতি সাধারণ মানুষদের মধ্যে মিশে থাকাই আমার বেশি পছন্দ। পরের বছর কুফার একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হজ্জে গমন করেন। তিনি খলীফা উমারের (রা) সাথে দেখা করলে তিনি তাকে উয়াইস সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। ঐ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বলেন: তাকে তো একটি অতি ভগ্ন বাড়ীতে অতি দরিদ্র অবস্থায় দেখে এসেছি। তখন উমর (রা) রাসূলুল্লাহ ()-এর উপরের হাদীসটি তাকে বলেন। তখন ঐ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি কুফায় ফিরে উয়াইসের কাছে গমন করে তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার অনুরোধ করেন। উয়াইস বলেন: আপনি তো হজ্জের নেক সফর থেকে ফিরে আসলেন, আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আপনি কি উমারের (রা) সাথে দেখা করেছিলেন? তিনি বলেন: হাঁ। তখন উয়াইস তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে গোনাহের ক্ষমা চান। এ ঘটনার পরে মানুষেরা উয়াইস সম্পর্কে জেনে যায়। ফলে তাঁর কাছে মানুষ আসা যাওয়া করতে থাকে। তখন উয়াইস লোকচক্ষুর আড়ালে কোথাও চলে যান।

পরবর্তী প্রায় দুই দশক উয়াইস কারনী লোকচক্ষুর আড়ালে সমাজের অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করেন। যে এলাকায় যখন বসবাস করতেন সেখানের মসজিদে সাধারণ মুসল্লী হিসাবে নিয়মিত নামাযে ও ওয়ায আলোচনায় বসতেন। কখনো নিজেও কিছু বলতেন। মসজিদে বসে কয়েকজনে কুরআন তিলাওয়াত করতেন বলেও জানা যায়। এভাবেই তিনি বিভিন্ন জিহাদে শরীক হতেন বলে বুঝা যায়। ৩৭ হিজরীতে আলী (রা) ও মু‘আবিয়ার (রা) মধ্যে সিফফীনের যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। এ যুদ্ধে উয়াইস কারনী (রাহ) আলীর সেনাদলে ছিলেন। তিনি আলী (রা)-এর পক্ষে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় শহীদ হয়ে যান।[1]

এ হলো তাঁর সম্পর্কে সহীহ বর্ণনা। তাঁকে কেন্দ্র করে অনেক বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা আমাদের দেশে প্রচলিত। যেমন তিনি নাকি তাঁর আম্মাকে বহন করতেন, তিনি নাকি উহুদের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ ()-এর পবিত্র দাঁত আহত হওয়ার সংবাদে নিজের সকল দাঁত ভেঙে ফেলেছিলেন, ইত্যাদি। এ সকল কথার কোন ভিত্তি পাওয়া যায় না। বলা হয়, উমার (রা) ও আলী (রা) নাকি তাঁর কাছে যেয়ে দেখা করেন বা দোয়া চান। এগুলো সবই মিথ্যা কথা। উপরের সহীহ হাদীসে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ ()-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে উয়াইসই উমারের (রা) দরবারে এসেছিলেন।

তবে আরো মারাত্মক তাঁকে কেন্দ্র করে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে বানোয়াট কথা। যেমন বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ তাঁর ওফাতের পূর্বে তাঁর মুবারক পিরহান উয়াইস কারনীর (রাহ) জন্য রেখে যান এবং উমার (রা) ও আলী (রা) তাঁকে সে পোশাক পৌঁছে দেন। কথাগুলো সবই বানোয়াট। ইবনু দাহিয়া, ইবনুস সালাহ, ইবনু হাজার, সাখাবী, মোল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস একমত যে, এগুলি সবই বাতিল ও বানোয়াট কথা।[2]

[1] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৬৮-১৯৬৯; আহমাদ, আল-মুসনাদ ৩/৪৮০, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/৪৫৫-৪৬১, আবু নুআইম, হিলয়াতুল আউলিয়া ২/৭৯, যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৪/২০, যিরিকলী, আল-আ’লাম ২/৩২।

[2] ইবনু হিববান, আল-মাজরূহীন ২/২৯৭-২৯৮; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/৩৫০, সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৪৪৯, সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৩৩৫, নং ৮৫২, ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩২-৩৬; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৮১, নং ৭০১, আল-মাসনূ‘য়, পৃ: ১১১, নং ২৩৫, আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/১৮০-১৮১, নং ২০৩৫, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৫৬, নং ৭৮৮।