আমরা দেখেছি যে, অনেক সময় জালিয়াতের উদ্দেশ্য হতো নিজের স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য তারা প্রচলিত ‘মতন’ বা বক্তব্যের জন্য বিশেষ সনদ তৈরি করত। এখানে একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি।
ইমাম মালিক ২য় হিজরী শতকের মুহাদ্দিসগণের অন্যতম ইমাম। তিনি তাঁর উস্তাদ নাফি’ থেকে আব্দুল্লাহ ইবনু উমারের সূত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। এজন্য (مالك عن نافع عن عبد الله بن عمر) ‘‘মালিক, নাফি’ থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে’’ অত্যন্ত সহীহ ও অতি প্রসিদ্ধ সনদ। এ সনদে বর্ণিত সকল হাদীসই মুহাদ্দিসগণের কাছে সংরক্ষিত। তৃতীয় হিজরী শতকের একজন রাবী আব্দুল মুনইম ইবনু বাশীর বলেন, আমাকে মালিক বলেছেন, তিনি নাফি’ থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ থেকে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
اللّهُـمَّ بَارِكْ لأُمَّـتِـيْ فِـيْ بُكُـوْرِهَـا
‘‘হে আল্লাহ, আমার উম্মতের জন্য তাদের সকালের সময়ে বরকত দান করুন।’’[1]
৫ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা খালীল ইবনু আব্দুল্লাহ আল-খালীলী (৪৪৬ হি) বলেন: এটি একটি মাউদূ বা বানোয়াট হাদীস। আব্দুল মুনইম নামক এ ব্যক্তি ছিল একজন মিথ্যাবাদী জালিয়াত। ইমাম আহমদের পুত্র আব্দুল্লাহ বলেন, আমি একদিন আমার পিতাকে বললাম: আমি আব্দুল মুনইম ইবনু বাশীরকে বাজারে দেখলাম। তিনি বলেন: বেটা, সে মিথ্যাবাদী জালিয়াত এখনো বেঁচে আছে? এ হাদীস এ সনদে একেবারেই ভিত্তিহীন ও অস্তিত্বহীন। কখনোই কেউ তা মালিক থেকে বা নাফি’ থেকে বর্ণনা করেনি। এ হাদীস মূলত সাখর আল-গামিদী নামক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন।[2]
এখানে আমরা দেখছি যে, আল্লামা খালীলী হাদীটিকে মাউযূ বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আবার তিনি নিজেই উল্লেখ করছেন যে, হাদীসটি অন্য সাহাবী থেকে বর্ণিত। তাঁর উদ্দেশ্য হলো, এ সনদে এ হাদীসটি মাউদূ। এ সনদ ও মতনের সম্মিলিত রূপটি বানোয়াট। তিনি সংক্ষেপে মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষার ফলাফলও বলে দিয়েছেন। ইমাম মালিকের অগণিত ছাত্রের কেউ এই হাদীসটি তাঁর সূত্রে এ সনদে বর্ণনা করেনি। একমাত্র আব্দুল মুনইম দাবী করছে যে, ইমাম মালিক তাকে হাদীসটি বলেছেন। আর আব্দুল মুনইমের বর্ণিত অন্যান্য সকল হাদীসের আলোকে মুহাদ্দিসগণ তার মিথ্যাচার ধরেছেন এবং তাকে মিথ্যাবাদী বলে চিহ্নিত করেছেন।
লক্ষণীয় যে, সনদটি জাল হলেও হাদীসের মতনটি মিথ্যা নয়। মতনটি অন্য বিভিন্ন সনদে সাখর আল-গামিদী ও অন্যান্য সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষায় তা সহীহ বলে প্রমাণিত হয়েছে।[3]
এভাবে আমরা দেখছি যে, আব্দুল মুনইম একটি প্রচলিত ও সহীহ ‘মতন’ এর জন্য একটি ‘সুপ্রসিদ্ধ সহীহ সনদ’ জাল করেছে। আর সে যুগে প্রসিদ্ধি অর্জনের জন্য এরূপ বানোয়াট সনদের কি গুরুত্ব ছিল তা আমাদের যুগে অনুধাবন করা অসম্ভব। মুহাদ্দিসগণ সাখার আল-গামিদীর সূত্রে হাদীসটি জানতেন। কিন্তু তাঁরা যখনই শুনেছেন যে, অমুক শহরে এক ব্যক্তি মালিকের সূত্রে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে হাদীসটি বর্ণনা করছেন তখন তাঁরা তার কাছে গিয়েছেন, তার হাদীস লিখেছেন ও নিরীক্ষা করেছেন। যখন নিরীক্ষার মাধ্যমে লোকটির জালিয়াতি ধরা পড়েছে তখন তারা তা প্রকাশ করেছেন। আবার অন্যান্য মুহাদ্দিস তার কাছে গিয়েছেন। মোটামুটি লোকটি বেশ মজা অনুভব করেছে যে, কত মানুষ তার কাছে হাদীস শুনতে আসছে! কিভাবে সে সবাইকে বোকা বানাচ্ছে!! কিন্তু তার জালিয়াতি যে ধরা পড়বে তা নিয়ে সে মাথা ঘামায় নি। কোনো জালিয়াতই ধরা পড়ার চিন্তা করে জালিয়াতি করে না।
ইবরাহীম ইবনুল হাকাম ইবনু আবান তৃতীয় হিজরী শতকের একজন হাদীস বর্ণনাকারী। তিনি এভাবে হাদীস বর্ণনায় কিছু জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করতেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বালের মত প্রসিদ্ধ ইমামও তার কাছে হাদীস শিখতে গমন করেন। ইমাম আহমাদ পরবর্তীকালে বলতেন: ‘‘ইবরাহীম ইবনুল হাকামের কাছে হাদীস শিখতে বাগদাদ থেকে ইয়ামানের এডেন পর্যন্ত সফর করলাম। সফরের টাকাগুলো ‘ফী সাবিলিল্লাহ’ চলে গেল!’’[4]
[2] খালীলী, আল-ইরশাদ, পৃ: ৭।
[3] তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৫১৭, ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/৭৫২, আলবানী, সাহীহুল জামিয়িস সাগীর ১/২৭৮।
[4] ইবনুল জাওযী, আদ-দুআফা ওয়াল মাতরূকীন ১/৩০।