সনদ ছাড়া কোনো হাদীস গ্রহণ করা হতো না। কাজেই একটি মিথ্যা কথাকে হাদীস বলে চালাতে হলে তার সাথে একটি সনদ বলতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জালিয়াতগণ নিজেরা মনগড়াভাবে বিভিন্ন সুপরিচিত আলিমদের নামে একটি সনদ বানিয়ে নিত। অথবা তাদের মুখস্থ কোনো সনদ সকল বানোয়াট হাদীসের আগে জুড়ে দিত। আমরা উপরে আলোচিত বিভিন্ন বানোয়াট হাদীসে এর উদাহরণ দেখতে পেয়েছি। এভাবে অধিকাংশ বানোয়াট হাদীসের সনদও মনগড়া। একটি উদাহরণ দেখুন:
ইমাম ইবনু মাজাহ বলেন আমাকে সাহল ইবনু আবী সাহল ও মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল বলেছেন তাদেরকে আব্দুস সালাম ইবনু সালিহ আবুস সালত হারাবী বলেছেন: আমাকে আলী রেযা, তিনি তাঁর পিতা মুসা কাযিম, তিনি তাঁর পিতা জা’ফর সাদিক, তিনি তাঁর পিতা মুহাম্মাদ বাকির, তিনি তার পিতা আলী যাইনুল আবেদীন, তিনি তাঁর পিতা ইমাম হুসাইন (রা), তিনি তাঁর পিতা আলী (রা) থেকে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
اَلإِيْمَانُ مَعْـرِفَـةٌ بِالْقَـلْبِ، وَقَـوْلٌ بِاللِّسَانِ وَعَمَـلٌ بِالأَرْكَانِ
‘‘ঈমান হলো অন্তরের জ্ঞান, মুখের কথা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্ম।’’[1]
তাহলে অন্তরের জ্ঞান, মুখের স্বীকৃতি ও কর্মের বাস্তবায়নের সামষ্টিক নাম হলো ঈমান বা বিশ্বাস। কথাটি খুবই আকর্ষণীয়। অনেক তাবিয়ী ও পরবর্তী আলিম এভাবে ঈমানের পরিচয় প্রদান করেছেন। ইমাম মালিক, শাফেয়ী, আহমাদ ইবনু হাম্বাল প্রমুখ এ মত গ্রহণ করেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানীফা বলেন: ঈমান মূলত মনের বিশ্বাস ও মুখের স্বীকৃতির নাম। কর্ম ঈমানের অংশ নয়, ঈমানের দাবী ও পরিণতি। ঈমান ও কর্মের সমন্বয়ে ইসলাম। এ হাদীসটি সহীহ হলে তা ইমাম আবু হানীফার মতের বিভ্রান্তি প্রমাণ করে। কিন্তু মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষায় হাদীসটি ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে।
পাঠক লক্ষ্য করুন। এ সনদের রাবীগণ রাসূলুল্লাহর (ﷺ) বংশের অন্যতম বুযুর্গ ও শিয়া মযহাবে ১২ ইমামের ৭ জন ইমাম। এ জন্য সহজেই আমরা সরলপ্রাণ মানুষেরা ধোঁকা খেয়ে যাই। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাতের হেফাজতে নিয়োজিত মুহাদ্দিসগণকে এভাবে প্রতারণা করা সম্ভব ছিল না। তাঁরা তাঁদের নিয়মে হাদীসটি পরীক্ষা করেছেন। তাঁরা তাদের নিরীক্ষায় দেখেছেন যে, সনদে উল্লিখিত ৭ প্রসিদ্ধ ইমামের কোনো ছাত্র এ হাদীসটি বর্ননা করেন নি এবং অন্য কোনো সনদেও হাদীসটি বর্ণিত হয় নি।
শুধু আব্দুস সালাম আবুস সাল্ত দাবী করলেন যে, ইমাম আলী রেযা (২০৩হি:) তাকে এ হাদীসটি বলেছেন। এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ইন্তেকালের ২০০ বছর পরে এসে আবুস সাল্ত নামের এ ব্যক্তি হাদীসটি প্রচার করছেন। মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন যে, আবূস সাল্ত আব্দুস সালাম নামক এই ব্যক্তি অনেক হাদীস শিক্ষা করেছেন এবং বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তার বর্ণিত হাদীসের মধ্যে অগণিত ভুল। তিনি এমন সব হাদীস বিভিন্ন মুহাদ্দিস ও আলেমের নামে বলেন যা তাদের অন্য কোন ছাত্র বলেন না। এতে প্রমাণিত হয় যে তিনি হাদীস ঠিকমত মুখস্থ রাখতে পারতেন না। তবে তিনি ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা হাদীস বলতেন কিনা তা নিয়ে তাঁরা কিছুটা দ্বিধা করেছেন। ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন ও কতিপয় ইমাম বলেছেন যে, তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ভাল ছিলেন বলেই দেখা যায়। শিয়া হলেও বাড়াবাড়ি করতেন না। কিন্তু তিনি অগণিত উল্টোপাল্টা ও ভিত্তিহীন (মুনকার) হাদীস বলেছেন, যা আর কোন বর্ণনাকারী কখনো বর্ণনা করেন নি। তবে তিনি ইচ্ছা করে মিথ্যা বলতেন না বলে বুঝা যায়। অপরপক্ষে আল-জুযানী, উকাইলী প্রমুখ ইমাম বলেছেন যে, তিনি মিথ্যাবাদী ছিলেন।[2]
যারা তিনি অনিচ্ছাকৃত ভুল বলেছেন বলে মনে করেছেন তাঁরা হাদীসটিকে ‘‘বাতিল’’, ‘‘ভিত্তিহীন’’ ‘‘খুবই যয়ীফ’’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন। আর যারা তাকে ইচ্ছাকৃত মিথ্যাবাদী বলে দেখেছেন, তাঁরা হাদীসটিকে ‘‘মাওযূ’’, বা বানোয়াট বলে অভিহিত করেছেন।[3]
অষ্টম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইবনুল কাইয়িম মুহাম্মাদ ইবনু আবী বাকর (৭৫১ হি) হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন ও কর্মকে ঈমানের অংশ বলে গণ্য করতেন। তাঁর মতে ঈমান হলো অন্তরের জ্ঞান, মুখের স্বীকৃতি ও বিধিবিধান পালন। তিনি এ মতের পক্ষে দীর্ঘ আলোচনার পরে বলেন, তবে এ বিষয়ে আব্দুস সালাম ইবনু সালিহ বর্ণিত যে হাদীসটি ইবনু মাজাহ সংকলন করেছেন, সে হাদীসটি মাউযূ, তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা নয়।’’[4]
আমরা দেখছি যে, এ সনদের সকল রাবী অত্যন্ত প্রসিদ্ধ সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। এ হলো জাল হাদীসের একটি বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জালিয়াতগণ তাদের জালিয়াতি চালানোর জন্য প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্বদের সমন্বয়ে সনদ তৈরী করতো। তাদের এ জালিয়াতি সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিলেও নিরীক্ষক মুহাদ্দিসদের ধোঁকা দিতে পারত না। কারণ সনদে জালিয়াতের নাম থেকে যেত। জালিয়াত যাকে উস্তাদ বলে দাবী করেছে তার নাম থাকত। উস্তাদের অন্যান্য ছাত্রের বর্ণিত হাদীস এবং এ জালিয়াতের বর্ণিত হাদীসের তুলনা ও নিরীক্ষার মাধ্যমে মুহাদ্দিসগণ জালিয়াতি ধরে ফেলতেন।
জালিয়াতির আরেকটি উদাহরণ দেখুন। ইসমাঈল ইবনু যিয়াদ দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন হাদীস বর্ণনাকারী। তিনি বলেন: আমাকে সাওর ইবনু ইয়াযিদ (১৫৫হি:) বলেছেন, তিনি খালিদ ইবনু মা’দান (মৃ: ১০৩ হি:) থেকে, তিনি মু‘আয ইবনু জাবাল থেকে বর্ণনা করেছেন, আমরা বললাম: ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমরা কি বিনা ওযূতে কুরআন স্পর্শ করতে পারব? তিনি বলেন: হাঁ, তবে যদি গোসল ফরয থাকে তাহলে কুরআন স্পর্শ করবে না। আমরা বললাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ, তাহলে কুরআনের বাণী: (পবিত্রগণ ছাড়া কেউ তা স্পর্শ করে না)[5] এর অর্থ কি? তিনি বলেন: এর অর্থ হলো: কুরআনের সাওয়াব মুমিনগণ ছাড়া কেউ পাবে না।’’
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ হাদীসটি বানোয়াট। হাদীসের ইমামগণ ইসমাঈল ইবনু যিয়াদ (আবী যিয়াদ) নামক এ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীসসমূহ সংগ্রহ করে অন্যান্য সকল বর্ণনার সাথে তার তুলনামূলক নিরীক্ষা করে দেখতে পেয়েছেন যে, এ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীস কোনটিই সঠিক নয়। তিনি একজন ভাল আলিম ছিলেন ও মাওসিল নামক অঞ্চলের বিচারক ছিলেন। কিন্তু তিনি শু’বা (১৬০হি:), ইবনু জুরাইজ (১৫০হি:), সাওর (১৫৫হি:) প্রমুখ তৎকালীন বিভিন্ন সুপরিচিত মুহাদ্দিসের নামে এমন অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন যা তারা কখনো বলেন নি বা তাদের কোন ছাত্র তাদের থেকে বর্ণনা করেন নি।
যেমন এখানে সাওর-এর নামে তিনি হাদীসটি বলেছেন। সাওর দ্বিতীয় হিজরী শতকের সিরিয়ার অন্যতম প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ ছিলেন। তাঁর অগণিত ছাত্র ছিল। অনেকে বছরের পর বছর তাঁর কাছে থেকে হাদীস শিক্ষা করেছেন। কোনো ছাত্রই তার থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করে নি। অথচ ইসমাঈল তার নামে এ হাদীসটি বললেন। অবস্থা দেখে মনে হয় তিনি ইচ্ছাপূর্বক এভাবে বানোয়াট হাদীস বলতেন। ইমাম দারাকুতনী, ইবনু আদী, ইবনু হিববান, ইবনুল জাওযী ও অন্যান্য ইমাম এ সকল বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, তাকে দাজ্জাল ও মিথ্যাবাদী বলেছেন। তার বর্ণিত সকল হাদীস, যা শুধুমাত্র তিনিই বর্ণনা করেছেন, অন্য কেউ বর্ণনা করেনি, এরূপ সকল হাদীসকে তাঁরা মাওযূ বা বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন।
এ ইসমাঈল বর্ণিত আরেকটি বানোয়াট ও মিথ্যা কথা যা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস হিসাবে বর্ণনা করেছেন: তিনি বলেন: আমাকে গালিব আল-কাত্তান, তিনি আবু সাঈদ মাকবুরী থেকে তিনি আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
أَبْغَـضُ الْكَلاَمِ إِلَى اللهِ الْفَارِسِيَّةُ وَكَلاَمُ أَهْلِ الْجَنَّـةِ الْعَرَبِيَّـةُ
‘‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ভাষা হলো ফার্সী ভাষা, আর জান্নাতের অধিবাসীদের ভাষা হলো আরবী ভাষা।’’[6]
[2] বিস্তারিত দেখুন: ইবনু হাজার আসকালানী, তাহযীবুত তাহযীব ৬/২৮৫-২৮৬; তাকরীবুত তাহযীব, পৃ: ৩৫৫; আল-বুসীরী, মিসবাহুয যুজাজাহ ১/১২।
[3] আল-বুসীরী, যাওয়াইদ ইবনু মাজাহ, পৃ ৩৭; আলবানী, যায়ীফ সুনান ইবন মাজাহ পৃ ১০।
[4] ইবনুল কাইয়িম, হাশিয়াত আবী দাউদ ১২/২৯৪।
[5] সূরা (৫৬) ওয়াকিয়া: ৭৯ আয়াত।
[6] ইবনু আদী, আল-কামিল ১/৫১০-৫১১, ইবনু হিববান, মাজরুহীন ১/১২৯, ইবনু হাজার, তাকরীবুত তাহযীব, পৃ: ১০৭, ইবনুল জাওযী, আল-মাউযূ্‘আত ২/১০, যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/৩৮৭-৩৮৮, ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারী‘আহ ২/৭৬, শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ, পৃ: ৮।