আপনি হয়তো বলতে পারেন, আমি তাওবা করতে চাই কিন্তু আমি তাওবার হুকুম আহকাম সম্পর্কে অজ্ঞ। আমার মনে কতিপয় গুনাহের ব্যাপারে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হয় এর সঠিক তাওবার ব্যাপারে, আল্লাহর যে সব হক নষ্ট করেছি তা পূরণ করার ব্যাপারে এবং বান্দাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে যা আমি ইতিপূর্বে অন্যায়ভাবে গ্রহণ করেছি। এসব প্রশ্নের উত্তর কি আছে?
আল্লাহর পানে প্রত্যাবর্তনকারী ব্যক্তি! আপনার জন্য এসব প্রশ্নের উত্তর উল্লেখ করবো ইনশাআল্লাহ।
উত্তর: তাওবা সঠিক হওয়ার জন্য শর্ত হলো পাপ থেকে পূর্ণভাবে মুক্ত হওয়া এবং এজন্য অনুতপ্ত হওয়া, পুনরায় আর তা না করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়া। এরপর যদি আবার কেউ পাপ করে ফেলে তাহলে সে যেন নতুনভাবে পাপ করল, এজন্য তাকে নতুনভাবে তাওবা করতে হবে এবং তার পূর্বের তাওবা ঠিক থাকবে।
উত্তর: কোন একটি গুনাহের জন্য তাওবা করা ঠিক হবে যদিও সে অন্য গুনাহে লিপ্ত থাকে, যদি একই ধরণের গুনাহ না হয়ে থাকে এবং তা প্রথম পাপের সাথে সম্পৃক্ত না হয়। উদাহরণ স্বরূপ যদি কেউ সুদ থেকে তাওবা করে কিন্তু মদ্যপান করা থেকে তাওবা না করে, তাহলে সুদ থেকে তার তাওবা করাটা সঠিক হবে এবং এর উল্টোটিও সঠিক হবে। কিন্তু যদি সে সরল সুদ থেকে তাওবা করে চক্রবৃদ্ধি সুদের উপর অটল থাকে তাহলে তখন তার তাওবা কবুল হবে না। তেমনি ভাবে কেউ গাঁজা বা চরস খাওয়া থেকে তাওবা করল কিন্তু মদপান অব্যাহত রাখল বা এর বিপরীত করলো। তেমনি ভাবে কেউ হয়তো কোন এক বিশেষ মহিলার সাথে ব্যভিচার করা থেকে তাওবা করল কিন্তু অন্য মহিলার সাথে অব্যাহত রাখলো তাহলে এদের তাওবা সঠিক হবে না। তারা এতটুকু করলো যে এক পাপ থেকে ঐ ধরনের আরেকটি পাপের সাথে জড়িয়ে পড়ল। (দেখুন মাদারেজুস সালেকীন)
উত্তর: নামায পরিত্যাগ করার ব্যাপারে প্রসিদ্ধ মত হলো, এর কাজা আদায় করতে হবে না। কেননা এর সময় পার হয়ে গেছে এবং তা ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। এর ঘাটতি পূরণ করতে হবে বেশী বেশী তাওবা, এসতেগফার পাঠ করে, বেশী বেশী নফল নামায আদায় করে, আশা করা যায় যে মহান আল্লাহ তা ক্ষমা করে দিবেন।
কিন্তু রোজা ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে কথা হলো, রোজা ভঙ্গের সময় যদি সে মুসলমান থেকে থাকে তাহলে তার প্রতি প্রত্যেক রোজার জন্য একজন করে মিসকিনকে খাবার দেয়া ওয়াজিব হবে এবং পরবর্তী রমজান আসার পূর্বেই এই কাফ্ফারা প্রদান করতে হবে। এর চেয়ে দেরী করতে পারবে না যদি তার কোন শরয়ী ওজর না থাকে। পূর্বে যত দিনই বাকী আছে সবগুলোরই কাজা আদায় করতে হবে যদিও এর সংখ্যা কয়েক মাস গিয়ে পৌছে।
উদাহরণ: কোন ব্যক্তি ১৪০০ হিজরীতে ৩টি রোজা ভঙ্গ করলো এবং ১৪০১ হিজরীতে ৫টি রোজা ছেড়ে দিলো এরপর সে যদি তাওবা করে, তাহলে তাকে ৮টি রোজার কাজা আদায় করতে হবে। প্রত্যেক রোজার জন্য একজন করে মিসকিনের খানা দিতে হবে।
আরেকটি উদাহরণ: এক মেয়ে ১৪০০ হিজরীতে বালেগা হলো এবং সে লজ্জা করে তার পরিবারের লোকজনকে জানালো না। সে ঐ আট দিন (বা সাতদিন মাসিকের সময়) রোজা রাখল এবং পরে এর কাজা আদায় করলো না। তাহলে তার উপর ঐ আট দিনের রোজার কাজা আদায় করা কর্তব্য হয়ে গেল। এখানে একটি বিষয় অবশ্যই অবগত থাকতে হবে যে, নামায ছাড়া ও রোজা ভঙ্গ করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে যা আহলে ইলমরা উল্লেখ করেছেন। ওলামাদের কেউ কেউ মনে করেন যে, কেউ যদি ইচ্ছা করে রোজা ভঙ্গ করে তবুও কাজা আদায় করতে হবে না।
কিন্তু জাকাত না দেয়া থাকলে অবশ্যই জাকাত প্রদান করতে হবে। কেননা জাকাত এক দিকে আল্লাহর হক এবং অন্য দিকে গরীব মিসকিনের হক। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন মাদারেজুস সালেকীন ১/৩৮৩)
উত্তর: এ ব্যাপারে দলীল হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ বাণী:
"مَنْ كَانَتْ عِنْدَهُ مَظْلَمَةٌ لِأَخِيهِ فَلْيَتَحَلَّلْهُ مِنْهَا؛ فَإِنَّهُ لَيْسَ ثَمَّ دِينَارٌ وَلَا دِرْهَمٌ، مِنْ قَبْلِ أَنْ يُؤْخَذَ لِأَخِيهِ مِنْ حَسَنَاتِهِ؛ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سَيِّئَاتِ أَخِيهِ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ" (رواه البخاري: ৬৫৩৪)
‘‘কারো উপর তার ভাইয়ের কোন প্রকার দাবি থাকলে সে যেন তাতে থেকে মুক্ত হয়ে যায়। কেননা সেখানে (কিয়ামত দিবসে বা পরকালে) কোন দ্বীনার-দিরহাম (টাকা-পয়সা) থাকবে না। তার অন্যায়ের সমপরিমাণ নেকী তার ভাইয়ের জন্য কেটে নেয়ার আগেই। তার যদি নেকী না থাকে তাহলে তার ভাইয়ের গুনাহগুলো নেয়া হবে, অতঃপর তার উপরে চাপিয়ে দেয়া হবে।’’ (বুখারী: ৬৫৩৪)
সুতরাং তাওবাকারীকে এই জুলুম থেকে বের হয়ে আসতে হবে, হয় তা ফিরিয়ে দিবে অথবা তার নিকট থেকে ক্ষমা চেয়ে নিবে। যদি ক্ষমা না করে তাহলে অবশ্যই ফেরত দিতে হবে।
উত্তর: বিষয়টি নির্ভর করছে এর ভাল ও মন্দ দিকটি নির্ণয় করার উপর। যদি তাদেরকে গীবত করার বিষয়টি জানালে ক্রোধান্বিত না হন বা আপনার প্রতি কোন আক্রোশের সৃষ্টি না হয় তাহলে আপনি সরাসরি বলে ক্ষমা চেয়ে নিবেন। কোন রকমের বিস্তারিত বিষয় উল্লেখ না করে। যেমন হয়তো বললেন, আমি আপনার ব্যাপারে অতীতে ভুল করেছি বা আপনাকে কথার দ্বারা কষ্ট দিয়েছি, এখন আমি আল্লাহর নিকট তাওবা করেছি সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। তাহলে কোন অসুবিধা নেই।
আর যদি তাদেরকে জানালে ক্রোধ ও আক্রোশ বেশী হবার আশংকা থাকে, এটিই সাধারণত ঘটে থাকে বা তাদেরকে সাধারণ ভাবে বললে যদি ব্যাখ্যা দাবী করে এবং তা শুনলে আপনার প্রতি তাদের ঘৃণা বৃদ্ধির আশংকা থাকে, তাহলে তাদেরকে জানানো ওয়াজিব নয়। কেননা শরীয়ত ফেতনা ফাসাদের অনুমতি দেয় না। কাউকে কোন বিষয় জানানোর ফলে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে সেটিও শরীয়তের কাম্য নয়। তাছাড়া দ্বীনের উদ্দেশ্য হলো মুসলমানদের মাঝে পারস্পারিক সম্পর্ক ও ভালবাসা বৃদ্ধি করা। তাকে জানানোর ফলে হয়তো শত্রুতা আরো বেড়ে যেতে পারে এবং সে হয়তো আপনার প্রতি খুবই আক্রোশী হয়ে উঠতে পারে। এ অবস্থায় তাওবা করার ক্ষেত্রে আপনার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলির প্রতি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন:
১. অনুতপ্ত হওয়া এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার সাথে সাথে এই অপরাধের কদর্যতা ও জঘন্যতার কথা চিন্তা করা এবং বিশ্বাস রাখা যে তা হারাম।
২. কারো গীবতের কথা শুনে বিশ্বাস করবে না এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নির্দোষ মনে করবে।
৩. যাদের গীবত করেছো তাদের ব্যাপারে বিভিন্ন মজলিসে সুনাম বর্ণনা করবে তাদের ভালো গুনাবলীর কথা উল্লেখ করবে।
৪. যাদের গীবত করেছো তাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলবে এবং কেউ তাদের প্রতি কটাক্ষ করলে বা বদনাম করলে তা প্রতিহত করবে।
৫. তাদের জন্য গোপনে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। (মাদারেজুস সালেকীন ১/২৯১, মুগনী ব্যাখ্যা সহ ১২/৭৮)
হে মুসলমান ভাই! আপনি আর্থিক অধিকার (হক) এবং শারীরিক অপরাধের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করুন, গীবত ও চোগলখোরীর মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করুন। আর্থিক অধিকারের কথা জানালে এর দ্বারা মালিকেরা উপকৃত হবে এবং তাদের নিকট তা ফেরত দিলে তারা খুশী হবে, এজন্য তা গোপন করা জায়েয হবে না। তবে ইজ্জত আবরুর ব্যাপারটি এ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কেননা তা জানালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে।
উত্তর: ইচ্ছাকৃত নর হত্যাকারীর উপর তিনটি হক বর্তায়:
আল্লাহর, নিহত ব্যক্তির ও ওয়ারিসদের হক।
আল্লাহর হক একমাত্র তাওবার দ্বারা আদায় করতে হবে। ওয়ারিসদের হক হলো তাদের নিকট নিজেকে সমর্পণ করতে হবে যেন তারা তার থেকে বদলা নিতে সমর্থ হয় (যদি শরয়ী বিধান কোন দেশে জারি থাকে)। হয় কেসাস নিয়ে অথবা মুক্তিপণ নিয়ে বা ক্ষমা করে দিয়ে। এরপর বাকী থাকে নিহত ব্যক্তির অধিকার যা এ দুনিয়ায় পূরণ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আহলে ইলমরা বলেন, যদি হত্যাকারীর তাওবা উত্তম হয়, তাহলে আল্লাহ তার উপর নিহত ব্যক্তির হক উঠিয়ে নিবেন এবং কিয়ামতের দিন নিজের তরফ থেকে নিহত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিবেন। আর এ অভিমতটিই সর্বোত্তম অভিমত। (মাদারেজুস সালেকীন ১/২৯৯)
উত্তর: যদি চুরি করা জিনিস তার কাছে থাকে তাহলে ফেরত দিবে। আর যদি নষ্ট হয়ে থাকে তাহলে তা ব্যবহার করার জন্য বা সময়ের কারণে মূল্যমান কমে গিয়ে থাকে তাহলে তার ক্ষতিপূরণ দেয়া ওয়াজিব, মালিক যদি না তাকে ক্ষমা করে দিয়ে থাকে। আর মালিক যদি ক্ষমা করে দেয় তাহলে কিছুই লাগবে না। সুতরাং আল্লাহর জন্যই সমস্ত প্রশংসা।
উত্তর: আপনার জন্য এমন কোন পন্থা অন্বেষণ করতে অসুবিধে নেই যার দ্বারা আপনি এই বিব্রতকর অবস্থা থেকে বাঁচতে পারেন, যেমন হয়তো অন্য কোন লোকের মাধ্যমে তাদের কাছে তাদের প্রাপ্য ফেরত পাঠালেন এবং নাম উল্লেখ করতে নিষেধ করলেন অথবা কৌশল অবলম্বন করলেন এবং বললেন, আপনার এসব হক এক ব্যক্তির নিকট ছিল কিন্তু সে তার নাম উল্লেখ করতে চায়নি। মূল কথা হচ্ছে প্রাপকের নিকট তার অধিকার ফেরত দিতে হবে।
উত্তর: আপনি মোটামুটি একটা অনুমান করে নিবেন এবং ধারণা করবেন যে কত হতে পারে। আর আপনি যেমন গোপনে নিয়েছেন তেমনি গোপনে ফেরত দিলে কোন অসুবিধা নেই।