খায়বারের যুদ্ধ থেকে যে সমস্ত মাসআলা জানা যায়
  • প্রয়োজন বশতঃ হারাম মাসেও কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েয আছে। কেননা রসূল (ﷺ) মুহার্রাম মাসে খায়বারের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন।
  • গণীমতের মাল বন্টনের সময় অশ্বারোহী যোদ্ধাকে দিতে হবে তিন অংশ এবং পদাতিক সৈন্যকে দিতে হবে এক অংশ।
  • যুদ্ধ ক্ষেত্রে কোন সৈনিক যদি খাদ্যদ্রব্য পায়, তাহলে সে ঐ খাদ্যদ্রব্য থেকে খেতে পারবে। তা মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টন করার প্রয়োজন নেই। কেননা আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুগাফ্ফাল (রাঃ) রসূল (ﷺ) এর উপস্থিতিতে এক থলে চর্বি একাই নিয়েছিলেন।
  • যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে কেউ যদি উপস্থিত হয়, তাহলে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের অনুমতি ব্যতীত তাকে গণীমতের অংশ দেয়া যাবেনা। কেননা খায়বার বিজয়ের পর হাবশা থেকে জা’ফর বিন আবু তালিব এবং তার সাথীগণ যখন নৌকায় আরোহন করে নাবী (ﷺ) এর কাছে আগমণ করেছিলেন তখন রসূল (ﷺ) তাদেরকে গণীমতের অংশ দেয়ার ব্যাপারে সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন।
  • খায়বারের যুদ্ধে গৃহপালিত গাধার মাংস হারাম ঘোষণা করা হয়। এর কারণ হচ্ছে গৃহ পালিত গাধা অপবিত্র। যারা বলে এটি হচ্ছে বাহনের জন্য এবং বোঝা বহন করার জন্য, তাদের কথা ঠিক নয়। আর যারা বলে গাধা যেহেতু নাপাক বস্ত্ত ভক্ষণ করে, তাই এর মাংস খাওয়া হারাম, তাদের কথাও ঠিক নয়।
  • ইমামের জন্য যুদ্ধ বিরতির চুক্তি করা জায়েয আছে। তিনি ইচ্ছা করলে যে কোন সময় সেই চুক্তির পরিসমাপ্তির ঘোষণা দিতে পারেন।
  • চুক্তি করার সময় শর্ত করা জায়েয আছে। যেমন রসূল (ﷺ) ও খায়বারবাসীদের মাঝে এই মর্মে চুক্তি হয়েছিল যে, তারা কোন কিছু লুকাতে পারবেনা এবং গোপনও করতে পারবেনা। অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার পরও আটকিয়ে রাখা জায়েয আছে। এটি ন্যায়পরায়ন শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত, কোন ক্রমেই তা জুলুমের অন্তর্ভুক্ত নয়।
  • সুস্পষ্ট প্রমাণ না পাওয়া গেলেও আলামত দ্বারা বিচার করা জায়েয আছে। রসূল (ﷺ) খায়বারের যুদ্ধের দিন যখন হুআই বিন আখতাবের সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন তখন বলা হয়েছিল যুদ্ধে এবং অন্যান্য প্রয়োজনে তা ব্যয় হয়ে গেছে। নাবী (ﷺ) তখন বললেন- মাল তো ছিল অনেক, দিনও তেমন বেশী অতিক্রম করেনি। সুতরাং এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল কিভাবে? এতে বুঝা যাচ্ছে সম্পদ লুকিয়ে রেখে মিথ্যা বলা হচ্ছে।
  • যিম্মীরা যদি চুক্তির কোন শর্ত ভঙ্গ করে, তাহলে তাদের নিরাপত্তার কোন গ্যারান্টি থাকেনা। তখন তাদের জান-মাল হালাল হয়ে যাবে।
  • গণীমতের মাল ভাগ হওয়ার পূর্বে কেউ যদি তা থেকে কিছু নিয়ে নেয়, তাহলে সে ঐ বস্ত্তর মালিক হয়ে যায়না। যদিও তার প্রাপ্য অংশের চেয়ে কম হয়। যে ব্যক্তি গণীমতের মাল বন্টনের পূর্বে তা থেকে জুতার একটি ফিতা চুরি করেছিল, তাকে নাবী (ﷺ) বলেছিলেন- সে আগুনের একটি ফিতা নিয়ে নিল।
  • নেকফাল (শুভ লক্ষণ) গ্রহণ করা অর্থাৎ কোন কিছু দেখে ভাল কিছু কামনা করা মুস্তাহাব। খায়বারবাসীদেরকে কোদাল নিয়ে বের হতে দেখে নাবী (ﷺ) বলেছিলেন- খায়বার ধ্বংস হবে।
  • মুসলিমদের সাথে চুক্তি করার পর অমুসলিমরা যদি সেই চুক্তি ভঙ্গ করে এবং ভঙ্গকারী সম্প্রদায় যদি প্রভাবশালী হয়, তাহলে তাদের মহিলাদের ক্ষেত্রেও চুক্তি ভঙ্গ হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। আর চুক্তিবদ্ধ কোন গোষ্ঠির একজন যদি চুক্তিবদ্ধ দলের অন্যদের সমর্থন ছাড়াই চুক্তি ভঙ্গ করে, তাহলে চুক্তি ভঙ্গকারীর নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে চুক্তি ভঙ্গ করার বিধান প্রযোজ্য হবেনা। এমনি নাবী (ﷺ) কে গালি দেয়ার কারণে যাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল, তাদের নারী ও শিশুদেরকে বন্ধী করা হয়নি।
  • নিজের দাসীকে মুক্ত করে বিবাহ করা এবং মুক্ত করাকেই বিবাহের মোহরানা নির্ধারণ করা জায়েয আছে। এ ক্ষেত্রে দাসীর অনুমতি, সাক্ষী, অভিভাবক এবং বিবাহের শব্দ উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই। নাবী (ﷺ) সাফীয়া (রাঃ) কে এভাবেই গ্রহণ করেছিলেন।
  • নিজের হক আদায় করতে গিয়ে নিজের ব্যাপারে বা অন্যের ব্যাপারে মিথ্যা বলা জায়েয আছে। তবে শর্ত হল, যাতে এ রূপ মিথ্যা বলায় অন্যের কোন ক্ষতি না হয় এবং সেই সাথে তার উদ্দেশ্যও হাসিল হয়। যেমন করেছিলেন হাজ্জাজ বিন ইলাত (রাঃ)।
  • অমুসলিমদের হাদীয়া (উপঢৌকন) গ্রহণ করা জায়েয আছে।
  • সফর অবস্থায় বিয়ে করা ও নব বধুর সাথে বাসর করাও জায়েয। নিজের স্ত্রীকে নিয়ে একই বাহনে আরোহন করা এবং সফরসঙ্গীদের সাথে পথ অতিক্রম করাও জায়েয।
  • কেউ যদি কোন মুসলিমকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে, তাহলে হত্যাকারীকেও কিসাস স্বরূপ হত্যা করতে হবে। কেননা খায়বারের সময় বিশর বিন বারা বিষমিশ্রিত খাবার খেয়ে মৃত্যু বরণ করার পর নাবী (ﷺ) খাদ্যে বিষ মিশ্রনকারী ইহুদী মহিলাকে হত্যা করেছিলেন।
  • আহলে কিতাব তথা ইহুদী ও খৃষ্টানদের যবেহ কৃত পশুর মাংস এবং তাদের খাদ্য মুসলিমদের জন্য হালাল।

খায়বার বিজয় করে নাবী (ﷺ) ওয়াদীয়ে কুরায় অবতরণ করলেন। সেখানে একদল ইহুদী বসবাস করত। মুসলিমগণ যখন সেখানে অবতরণ করলেন, তখন ইহুদীরা তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। এ সময় রসূল (ﷺ)-এর কৃতদাস মিদআম নিহত হল। সাহাবীগণ বললেন- তার জন্য সুখবর! তার জান্নাত আবশ্যক হয়ে গেছে। নাবী (ﷺ) তখন বললেন- কখনই নয়, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তাঁর (আল্লাহর) শপথ! কখনই নয়। খায়বারের দিন গণীমতের মাল বন্টনের পূর্বেই সে যেই চাদরটি চুরি করেছিল, তা আগুনে পরিণত হয়ে তাকে জ্বালাচ্ছে।

অতঃপর রসূল (ﷺ) সাহাবীদেরকে জিহাদের প্রতি উৎসাহ দিলেন এবং তাদেরকে জিহাদের জন্য কাতারবন্দী করলেন। ইহুদীদেরকে প্রথমে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিলেন। এ সময় ইহুদীদের একজন মুসলিমদের মুকাবেলা করার জন্য বেরিয়ে আসল। সাহাবীদের মধ্যে হতে যুবাইর ইবনুল আওয়াম তার মুকাবেলা করার জন্য অগ্রসর হলেন। যুবাইর তাকে হত্যা করে ফেললেন। অতঃপর আরেক ব্যক্তি বের হলে আলী (রাঃ) বের হয়ে তাকেও হত্যা করলেন। এভাবে এক এক করে তাদের ১১ জন যোদ্ধা নিহত হল। যখনই তাদের কেউ নিহত হত, নাবী (ﷺ) তখন অবশিষ্টদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। সলাতের সময় হলে তিনি সাহাবীদেরকে নিয়ে সলাত আদায় করতেন। সলাত শেষে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। অতঃপর যুদ্ধের মাঠে তাদের মুকাবেলা করতেন। এভাবে যুদ্ধ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। পরের দিন সকালে সূর্য এক বর্শা পরিমাণ উঁচু হওয়ার পূর্বেই নাবী (ﷺ) ওয়াদীউল কুরাকে কবজা করে ফেললেন। আল্লাহ্ তা‘আলা রসূল (ﷺ) কে প্রচুর গণীমত প্রদান করলেন। তিনি এখানে চার দিন অবস্থান করলেন এবং গণীমতের মাল বণ্টন করলেন। তবে খায়বারবাসীর মতই এখানকার যমীন চাষাবাদ করার জন্য ইহুদীদেরকে নিযুক্ত করলেন। তায়মা নামক স্থানে বসবাসকারী ইহুদীদের কাছে যখন খায়বার এবং ওয়াদীউল কুরার খবর পৌঁছল, তখন তারা ভীত হয়ে গেল। খায়বারবাসীর ন্যায় তারাও সন্ধি চুক্তি করতে চাইল। নাবী (ﷺ) তাদের আবেদন কবুল করলেন এবং যেই শর্তে খায়বারবাসীদেরকে তাদের যমীনে নিয়োগ করেছিলেন, তাদেরকেও সেই শর্তে থাকতে দিলেন। উমার (রাঃ) এর খেলাফতকালেও তারা সেখানে অবস্থান করেছিল। কেননা তায়মা এবং ওয়াদীউল কুরা সেই সময় শামের (সিরিয়ার) অঞ্চল হিসেবেই গণ্য হত।

অতঃপর নাবী (ﷺ) মদ্বীনায় ফেরত আসলেন। রাস্তায় রাত্রি যাপন কালে বিলালকে বললেন- আমাদের জন্য রাতের (ফজরের সলাতের) প্রতি খেয়াল রাখ। বিলাল আল্লাহর ইচ্ছায় কিছু সময় সলাত পড়লেন। রসূল (ﷺ) ঘুমিয়ে পড়লেন এবং সাহাবীগণও ঘুমিয়ে পড়লেন। ফজরের সামান্য পূর্বে বেলাল স্বীয় বাহনে হেলান দিলেন। ইতিমধ্যেই তার চোখে ঘুম চলে আসল। তিনি বাহনে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন। সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বে নাবী (ﷺ) কিংবা বিলাল কিংবা সাহাবীদের কেউ জাগ্রত হতে পারেন নি। অতঃপর রসূল (ﷺ) ই সর্বপ্রথম জাগ্রত হলেন। তিনি পেরেশান হয়ে বিলালকে বললেন- হে বিলাল? তোমার কি হল? বিলাল (রাঃ) বললেন- হে আল্লাহর রসূল! আপনার জন্য আমার বাপ-মা কোরবান হোক! আপনাকে যিনি ঘুম পাড়িয়েছেন, তিনিই আমাকে ঘুমে বিভোর করেছেন।

অতঃপর তারা বাহনগুলো চালিয়ে কিছুদূর অগ্রসর হলেন এবং সেই উপত্যকা পার হলেন। এইবার নাবী (ﷺ) বললেন- এই উপত্যকায় শয়তান রয়েছে। সুতরাং উক্ত স্থান অতিক্রম করার পর তিনি সাহাবীদেরকে বাহন থেকে নেমে ওযূ করে প্রথমে ফজরের সুন্নাত সলাত পড়তে বললেন। সুন্নাত পড়া শেষ হলে বিলালকে সলাতের ইকামত দিতে বললেন। নাবী (ﷺ) সকলকে নিয়ে সলাত পড়লেন। সালাম ফিরিয়ে মানুষদের দিকে তাকিয়ে তিনি তাদেরকে পেরেশান অবস্থায় দেখে বললেন- হে লোক সকল! আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের রূহসমূহ কবজ করে নিয়েছিলেন। তিনি ইচ্ছা করলে এই সময়ের আগেও আমাদের কাছে তা ফেরত দিতে পারতেন। সুতরাং ঘুমের কারণে তোমাদের কারও যদি সলাত ছুটে যায় অথবা কেউ সলাত পড়তে ভুলে যায় অতঃপর এর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে সে যেন যথা সময়ে সলাত আদায়ের ন্যায়ই তা আদায় করে নেয়।

বলা হয় যে, হুদায়বিয়া থেকে ফেরার পথে উপরোক্ত ঘটনা ঘটেছিল। কেউ বলেছেন- তাবুক থেকে ফেরার পথে এমন হয়েছিল।