মদীনায় রসূল (সাঃ) এর হিজরত এবং জিহাদের সূচনা

 নাবী (ﷺ) যখন মদ্বীনায় এসে বসবাস শুরু করলেন, তখন আল্লাহ্ তা‘আলা নিজের পক্ষ হতে সাহায্যের মাধ্যমে এবং একদল মুমিন দ্বারা তাঁকে শক্তিশালী করেছেন। পারস্পরিক শত্রুতা থাকার পরও তিনি তাদের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন রচনা করেছেন। আল্লাহর সাহায্যকারীগণ এবং ইসলামের সিপাহীরা তাঁকে হেফাজত করেছেন। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে তারা নিজেদের জান কোরবানী করেছেন এবং রসূল (ﷺ) এর মুহাববতকে পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং স্ত্রী-পরিবারের মুহাববাতের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। তারা তাঁকে নিজেদের চেয়ে অধিক নিকটবর্তী মনে করতেন। আরব এবং ইহুদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুশমনী শুরু করল। চতুর্দিক থেকে তারা মুসলমানদের উপর ঝাপিয়ে পড়ল এবং যুদ্ধ ঘোষণা করল। অথচ এতদিন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সবর করতে এবং কাফেরদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার আদেশ দিয়েছিলেন। অতঃপর যখন মুসলমানদের শক্তি অর্জিত হল এবং তাদের ভিত্তি মজবুত হল, তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দিলেন। কিন্তু তা তাদের উপর ফরয করে দেন নি। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لقَدِيرٌ

‘‘যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে, কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম’’। (সূরা হাজ্জ-২২:৩৯) কেউ কেউ বলেছেন- মুসলমানগণ মক্কায় থাকাবস্থায় এই হুকুম ছিল। কেননা এই সূরাটি মক্কায় নাযিল হয়েছে। এই মতটি কয়েকটি কারণে ভুল।

১) মক্কায় থাকাবস্থায় আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদেরকে কিতাল তথা যুদ্ধ করার অনুমতি দেন নি।

২) আয়াতের পূর্বাপর বর্ণনা প্রমাণ করে যে, অন্যায়ভাবে মুসলমানদেরকে তাদের মক্কার বাড়িঘর থেকে বের করে দেয়ার পরই যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছে।

৩) আল্লাহ্ তা‘আলার বাণী- هَذَانِ خَصْمَانِ اخْتَصَمُوا فِي رَبِّهِم‘‘এই দুই বাদী বিবাদী, তারা তাদের প্রতিপালক সম্পর্কে বিতর্ক করে’’- এটি ঐ সমস্ত লোকদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে, যারা বদরের যুদ্ধের দিন সর্বপ্রথম সম্মুখ যুদ্ধের জন্য বের হয়েছিল।

৪) এই সূরাতে আল্লাহ্ তা‘আলা يَأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا ‘‘হে ঈমানদারগণ’’ বলে সম্বোধন করেছেন। এইভাবে যত সম্বোধন করা হয়েছে তার সবই মদ্বীনায় নাযিল হয়েছে।

৫) এই সূরাতে অস্ত্রের মাধ্যমে এবং অন্যান্য মাধ্যমে জিহাদ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, সাধারণ জিহাদের হুকুম হিজরতের পরেই নাযিল হয়েছে।

৬) হাকেম স্বীয় মুস্তাদরাকে বুখারী-মুসলিমের শর্তে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, নাবী (ﷺ) মক্কা হতে বের হলেন। আবু বকর (রাঃ) তখন বললেন- তারা তাদের নাবীকে মক্কা থেকে তাড়িয়ে দিল। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তারা অবশ্যই ধ্বংস হবে। তখন আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনের এই আয়াত নাযিল করেন-

أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لقَدِيرٌ

‘‘যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে, কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম’’। (সূরা হাজ্জঃ ৩৯) সসস্ত্র যুদ্ধের ব্যাপারে অবতীর্ণ এটিই সর্বপ্রথম আয়াত। সূরা হজ্জের আয়াতগুলো গভীরভাবে পাঠ করলে বুঝা যায় যে, তাতে রয়েছে মক্কী ও মাদানী আয়াত। শয়তান কর্তৃক নাবীদের কল্পনায় কিছু মিশ্রণ করে দেয়ার ঘটনা মক্কায় নাযিল হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ وَلا نَبِيٍّ إِلا إِذَا تَمَنَّى أَلْقَى الشَّيْطَانُ فِي أُمْنِيَّتِهِ فَيَنْسَخُ اللهُ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ ثُمَّ يُحْكِمُ اللهُ آيَاتِهِ وَاللهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ

‘‘আমি তোমার পূর্বে যে সমস্ত রসূল ও নাবী প্রেরণ করেছি তারা যখনই কিছু কল্পনা করেছে তখনই শয়তান তাদের কল্পনায় কিছু মিশ্রণ করে দিয়েছে। অতঃপর আল্লাহ্ দূর করে দেন শয়তান যা মিশ্রণ করে। এরপর আল্লাহ্ তার আয়াতসমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং আল্লাহ্ জ্ঞানময়, প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা হাজ্জঃ ৫২)

অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা ঐ সমস্ত কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার আদেশ দিয়েছেন, যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلا تَعْتَدُوا إِنَّ اللهَ لا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ

‘‘আর লড়াই কর আল্লাহর ওয়াসেত্ম তাদের সাথে, যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করোনা। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সীমা লঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না’’। (সূরা বাকারা-২:১৯০)

অতঃপর সমস্ত কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরয করে দেয়া হয়। আসল কথা হচ্ছে মক্কায় জিহাদ নিষিদ্ধ ছিল। হিজরতের পর জিহাদের অনুমতি দেয়া হয়। অতঃপর যে সমস্ত মুশরিক মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রথমে যুদ্ধ শুরু করবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হয়। পরিশেষে সকল মুশরিকদের বিরুদ্ধেই জিহাদ করা ফরয করে দেয়া হয়। কেউ বলেছেন- জিহাদ ফরযে আইন করা হয়েছে। আবার কেউ বলেছেন- ফরযে কিফায়া। এটিই প্রসিদ্ধ মত।

এ ব্যাপারে সঠিক কথা হল জিহাদ মূলত ফরযে আইন। তথা উম্মতের সকলের উপর তা ফরয। তবে তা কখনও হবে অন্তরের দ্বারা, কখনও জবানের দ্বারা, কখনও হাতের দ্বারা আবার কখনও হবে মালের দ্বারা। প্রত্যেক মুসলিমকে উপরোক্ত চারটি জিহাদের কোন একটি অবশ্যই করতে হবে। আর আল্লাহর রাস্তায় জান দিয়ে জিহাদ করা ফরযে কিফায়া। উম্মাতের কোন একটি দল এই প্রকারের জিহাদ করলে অন্যদের পক্ষ হতে ফরযিয়াত উঠে যাবে। কেউ না করলে সকলেই গুনাগার হবে।

মালের দ্বারা জিহাদ করার ব্যাপারে আলেমদের পক্ষ হতে দু’টি মত পাওয়া যায়। একটি ওয়াজিবের পক্ষে অন্যটি এর বিপক্ষে। তবে সঠিক কথা হচ্ছে মালদার মুসলিমের উপর আল্লাহর রাস্তায় মাল খরচ করে জিহাদ করা আবশ্যক। কেননা কুরআনে জিহাদ বিন্ নাফস এবং জিহাদ বিল মালের হুকুম এক সাথেই করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

انْفِرُواْ خِفَافاً وَثِقَالاً وَجَاهِدُواْ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِى سَبِيلِ اللهِ، ذَلِكُم خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنتُمْ تَعْلَمُونَ

‘‘তোমরা বের হয়ে পড় স্বল্প বা প্রচুর সরঞ্জামের সাথে এবং জিহাদ কর আল্লাহর পথে নিজেদের মাল ও জান দিয়ে, এটি তোমাদের জন্যে অতি উত্তম, যদি তোমরা বুঝতে পার’’। (সূরা তাওবা-৯:৪১) শুধু তাই নয় আল্লাহ্ তা‘আলা জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ পাওয়া, আল্লাহর ক্ষমা পাওয়া এবং জান্নাতে প্রবেশের জন্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার শর্তারোপ করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ - تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ - يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الأنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ -وَأُخْرَى تُحِبُّونَهَا نَصْرٌ مِنَ اللهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ

‘‘হে মুমিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসার (বাণিজ্যের) সন্ধান দিব যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দিবে? তা এই যে, তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্যে অতি উত্তম; যদি তোমরা তা জান। তিনি তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন এবং এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার নীচে দিয়ে ঝর্ণাধারা বয়ে চলবে। আর চিরস্থায়ী বসবাসের জায়গা জান্নাতের মধ্যে তোমাদেরকে সর্বোত্তম ঘর দান করবেন। এটা মহাসাফল্য এবং আরও একটি অনুগ্রহ দিবেন, যা তোমরা পছন্দ করো। আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য এবং আসন্ন বিজয়। হে নাবী! মুমিনদেরকে এর সুসংবাদ দান করো’’। (সূরা সাফ্ফ-৬১:১০-১৩) আল্লাহ্ তা‘আলা আরও সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি মুমিনদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন। এর বিনিময়ে তিনি তাদেরকে জান্নাত প্রদান করবেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالإنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللهِ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

‘‘আল্লাহ্ ক্রয় করে নিয়েছেন মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল এই মূল্যে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহে, অতঃপর মারে ও মরে। তাওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআনে তিনি এ সত্য প্রতিশ্রম্নতিতে অবিচল। আর আল্লাহর চেয়ে অধিক প্রতিশ্রম্নতি রক্ষাকারী আর কেউ আছে কি? সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেন-দেনের উপর, যা তোমরা করছ তাঁর সাথে। আর এ হল মহান সাফল্য। (সূরা তাওবা-৯:১১১) সুতরাং দেখা যাচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলা এই চুক্তি ও অঙ্গিকারকে উত্তম কিতাবসমূহে উল্লেখ করেছেন। এর পর তিনি তাদেরকে জোর দিয়ে বলেছেন যে, তাঁর চেয়ে অধিক প্রতিশ্রম্নতি রক্ষাকারী আর কেউ নেই। মুসলিমদেরকে তিনি এই ওয়াদা পেয়ে খুশী হওয়ার আদেশ দিয়েছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, এটিই হচ্ছে মহান সাফল্য।

সুতরাং জ্ঞানীদের চিন্তা করা উচিৎ। এই চুক্তি ও ক্রয়-বিক্রয় কত বিরাট! এখানে ক্রেতা হচ্ছেন আল্লাহ্ তা‘আলা। পণ্য হচ্ছে মুমিনদের জান ও মাল। মূল্য হচ্ছে জান্নাতুন নাঈম, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর দিদারের স্বাদ। যার মাধ্যমে এই ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তিনি হচ্ছেন আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ রসূল এবং বনী আদম ও ফিরিস্তাকুলের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাবান। সুতরাং যেই পণ্যের প্রকৃত অবস্থা হল এই, তাকে অবশ্যই একটি বিরাট কাজের জন্যই তৈরী করা হয়েছে।

সুতরাং হে আদম সন্তান! তোমাকে এক মহান উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই তুমি পশুর মত জীবন যাপন করা হতে বিরত হও।

জান্নাত পাওয়ার মোহরানা (মূল্য) হচ্ছে উহার মালিকের রাস্তায় জান ও মাল খরচ করা, যা তিনি ক্রয় করে নিয়েছেন তাঁর মুমিন বান্দাদের থেকে। মূলতঃ জান্নাত হচ্ছে এমন একটি পণ্য, যা বিক্রি করতে ক্রেতাদের জন্য বিশেষ একটি বাজারে পেশ করা হয়েছে। কাপুরুষদের জন্য এই পণ্যটির কাছে এসে দামাদামি করার কোন সুযোগ রাখা হয়নি। পণ্যটি এমনও নয় যে, বাজার মন্দা হওয়ার কারণে তাকে তাচ্ছিল্য করা হবে বা কম মূল্যে বিক্রি করা হবে কিংবা ক্রেতা কম হওয়ার কারণে অভাবী ক্রেতাদের কাছে তা বাকীতেই বিক্রি করা হবে। পণ্যটির মালিক শুধু এটিকে জানের বিনিময়েই বিক্রি করতে চান। এ ছাড়া অন্য কোন মূল্য তিনি গ্রহণ করতে রাজী নন। সুতরাং এটি ক্রয় করার অযোগ্য লোকেরা কেটে পড়ল। এরপর জান্নাতের প্রেমিকরা সামনে আসল। তারা অপেক্ষা করতে লাগল, তাদের মধ্যে কে জানের বিনিময়ে এটি অর্জন করতে চায়। পণ্যটি তাদের সামনে ঘুরতে লাগল। পরিশেষে তাদের হাতে এসে ধরা দিল, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন-

أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَلا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

‘‘তারা মুমিনদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি হবে কঠোর। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবেনা। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ্ প্রাচুর্য দানকারী, মহাজ্ঞানী’’। (সূরা মায়েদা-৫:৫৪)

যখন জান্নাত ও মুহাববাতের দাবীদারের সংখ্যা বেড়ে গেল তখন কার দাবীটি সঠিক তা যাচাই করার জন্য উপযুক্ত প্রমাণ চাওয়া হল। কেননা শুধু দাবী করলেই যদি মানুষকে সবকিছু দেয়া হত তাহলে বিনা প্রমাণে একজন অন্যজনের রক্ত ও সম্পদ দাবী করত। সুতরাং মানুষের মধ্যে দাবীদারের সংখ্যা প্রচুর। তাই বলা হল, সাক্ষী ছাড়া দাবী গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ

‘‘হে রসূল! বল, যদি তোমরা আল্লাহ্কে ভালবাস তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ্ও তোমাদেরকে ভালবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ্ হলেন ক্ষমাকারী, দয়ালু’’। (সূরা আল-ইমরান-৩:৩১) এই আয়াত শুনে সকলেই পিছিয়ে পড়ল। যারা কথায়, কাজে ও আচার-আচরণে রসূল (ﷺ) এর অনুসরণ করে শুধু তারাই রয়ে গেল। এবার তাদের সত্যতা যাচাই করার প্রয়োজন হল। যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন তিরস্কার কারীর তিরস্কারে ভীত হবেনা প্রকৃতপক্ষে তারাই আল্লাহকে এবং তাঁর রসূলকে ভালবাসে। সুতরাং যারা কথায় ও কাজে রসূল (ﷺ) এর সুন্নাতের অনুরণের দাবী করে; কিন্তু আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে প্রস্ত্তত নয় তাদের অধিকাংশই কেটে পড়ল। প্রকৃত মুজাহিদগণ সামনে আসল। তাদেরকে বলা হল, আল্লাহর প্রতি এবং রসূলের প্রতি ভালবাসা পোষণকারীদের জান ও মাল তাদের নিজেদের নয়। কেননা আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের জান-মাল জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। সুতরাং তোমাদের সাথে যেই বিষয়ে চুক্তি হয়েছে, তা সোপর্দ করে দাও। কেননা ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তিতে উভয় পক্ষের উপরই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করা জরুরী। ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করবে আর বিক্রেতা পণ্য সোপর্দ করে দিবে।

ব্যবসায়ীগণ (ঈমানদারগণ) যখন ক্রেতার সুমহান মর্যাদা, মূল্যের বিশালতা, চুক্তি সম্পাদনে মধ্যস্থতাকারীর মহাত্ম এবং যেই কিতাবে চুক্তিটি লিখিত আছে তার মর্যাদা সম্পর্কে জানতে পারল তখন পণ্যটির মর্যাদা ও শান-শওকত সম্পর্কে অবগত হল। তারা বুঝতে সক্ষম হল যে এটি (মুমিনের জান) এমন একটি পণ্য, যা পৃথিবীর অন্যান্য পণ্যের মত নয়। সুতরাং তারা দেখল যে, সস্তা মূল্যে এবং সীমিত কয়েকটি দিরহামের বিনিময়ে এটিকে বিক্রি করে দেয়া মারাত্মক ক্ষতিকর ও ভুল হবে। কারণ দুনিয়ার স্বাদ ও সম্পদ ক্ষণস্থায়ী; কিন্তু পার্থিব জীবনের কৃতকর্মের ফলাফল সুদূর প্রসারী। যারা সামান্য স্বাদ ও স্বার্থের বিনিময়ে স্থায়ী সুখ-শান্তিকে বিক্রি করে দেয় তাদেরকে মূর্খদের কাতারেই গণ্য করা হয়।

সুতরাং মুজাহিদরা স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্ট চিত্তে ক্রেতার (আল্লাহর) সাথে বায়আতুর রিযওয়ানের চুক্তি সম্পাদন করল এবং বলল- আল্লাহর শপথ! আমরা কখনই এই বায়আত (চুক্তি) ভঙ্গ করব না।

সুতরাং যখন চুক্তিটি সম্পাদিত ও পূর্ণ হল এবং মুজাহিদগণ পণ্য সোপর্দ করল তখন তাদেরকে বলা হল এখন তোমাদের জান ও মাল আল্লাহর মালিকানায় চলে গেছে ।

তবে এখন তা পূর্বের চেয়ে অধিক পরিপূর্ণ ও সবল অবস্থায় এবং বৃদ্ধিসহকারে তোমাদের নিকটই ফেরত দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُواْ فِى سَبِيلِ اللهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ

‘‘আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করোনা। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত’’। (সূরা আল-ইমরান-৩:১৬৯) তাদেরকে আরও বলা হল, লাভ করার জন্য তোমাদের কাছ থেকে তোমাদের জান ও মাল ক্রয় করা হয় নি; বরং এই ক্রয়-বিক্রয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে তোমাদের থেকে সাহসিকতা ও দানশীলতা প্রকাশ পায় এবং মূল্য ও পণ্য উভয়টিই তোমাদের কাছে ফেরত দেয়া যায়।

প্রিয় পাঠক! আপনি জাবের (রাঃ) এর ঘটনাটি নিয়ে চিন্তা করুন। রসূল (ﷺ) তাঁর কাছ থেকে একটি উট ক্রয় করেছিলেন। তিনি জাবেরকে উটের পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করলেন, তার সাথে আরও বাড়িয়ে দিলেন এবং পরিশেষে তাঁর উট তাঁকেই ফেরত দিলেন। প্রিয় পাঠক! আপনি সেই সাথে জাবের (রাঃ) এর পিতা আব্দুল্লাহএর ঘটনাও স্মরণ করুন। আল্লাহ্ তাঁর সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন, তাও স্মরণ করুন। জাবের (রাঃ) এর পিতা আব্দুল্লাহ্ উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। রসূল (ﷺ) জাবেরকে বললেন- হে জাবের! আল্লাহ্ তা‘আলা তোমার পিতাকে জীবিত করেছেন। তাঁর সাথে সরসূরি এবং খোলাখুলি কথা বলেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে বলেছেন- তুমি চাও। যা চাইবে তাই তোমাকে দেয়া হবে। সুতরাং তিনি বলেছিলেন, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে পুনরায় জীবিত করে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিন। আমি দ্বিতীয়বার আপনার রাস্তায় জিহাদ করে শহীদ হব।

সেই মহান আল্লাহ্ অতীব পবিত্র, যার দয়ার সাগর এত বিশাল যে, সৃষ্টির জ্ঞান দ্বারা তা উপলদ্ধি করা অসম্ভব। তিনি মুমিন মুজাহিদ বান্দার পণ্য তাকেই ফেরত দেন, মূল্যও ফেরত দেন, চুক্তি পরিপূর্ণ করার তাওফীকও দেন, পণ্যের দোষ থাকলে কিনে নেন এবং ভালভাবে মূল্য পরিশোধ করেন। বান্দার নফসকে নিজের মালের বিনিময়ে ক্রয় করেন। অতঃপর পণ্য ও মূল্য উভয়টিই ফেরত দিয়ে বান্দার এবং চুক্তিপত্রের প্রশংসা করেন। অথচ তাঁর তাওফীক ও ইচ্ছাতেই চুক্তি অনুযায়ী বান্দার আমল সংঘটিত হয়।

আল্লাহ্ তা‘আলা এবং দারুস্ সালাম তথা জান্নাতের দিকে আহবানকারী মুহাম্মাদ (ﷺ) গর্বিত আত্মাসমূহ এবং উচ্চ আকাঙ্খা পোষণকারীদেরকে সজাগ করেছেন। ঈমানের আহবানকারী (মুহাম্মাদ) উন্মুক্ত কর্ণের এবং জীবন্ত প্রাণের অধিকারীদেরকে শুনিয়ে দিয়েছেন। এই শ্রবণ থেকেই আবরারদের (সৎকর্মশীলদের) মঞ্জিলের দিকে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে। দারুল কারার তথা জান্নাত তাদের একমাত্র ঠিকানা। সেখানে না পৌঁছা পর্যন্ত তাদের সফর চলতেই থাকবে। রসূল (ﷺ) বলেন-

انْتَدَبَ اللهُ لِمَنْ خَرَجَ فِي سَبِيلِهِ لا يُخْرِجُهُ إِلاَّ إِيمَانٌ بِي وَتَصْدِيقٌ بِرُسُلِي أَنْ أُرْجِعَهُ بِمَا نَالَ مِنْ أَجْرٍ أَوْ غَنِيمَةٍ، أَوْ أُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ. وَلَوْلا أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي مَا قَعَدْتُ خَلْفَ سَرِيَّةٍ، وَلَوَدِدْتُ أَنِّي أُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللهِ، ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ، ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ

‘‘আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তির যিম্মাদার হবেন, যে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার উদ্দেশ্যে বের হয়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- তার বের হওয়া কেবল আমার প্রতি ঈমান ও আমার রসূলদেরকে সত্যায়নের কারণেই। তার সাথে আমার এই অঙ্গীকার রয়েছে যে, হয়ত আমি তাকে বিনিময় প্রদান করব অথবা গনীমতের মালামালসহ ঘরে ফিরিয়ে আনব অথবা শাহাদাতের মাধ্যমে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো। রসূল (ﷺ) বলেন- আমার উম্মাতের উপর যদি কষ্ট না মনে করতাম, তাহলে কোন যুদ্ধ হতেই আমি পিছিয়ে থাকতামনা। আমার ভাল লাগে যে, আমি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হই। অতঃপর জীবিত হয়ে আবার শহীদ হই। অতঃপর জীবিত হয়ে আবার শহীদ হই’’।[1] তিনি আরও বলেন-

مَثَلُ الْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللهِ وَاللهُ أَعْلَمُ بِمَنْ يُجَاهِدُ فِي سَبِيلِهِ كَمَثَلِ الصَّائِمِ الْقَائِمِ. وَتَوَكَّلَ اللهُ لِلْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِهِ بِأَنْ يَتَوَفَّاهُ أَنْ يُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ أَوْ يَرْجِعَهُ سَالِمًا مَعَ أَجْرٍ أَوْ غَنِيمَةٍ

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে, আল্লাহই ভাল জানেন কে তাঁর পথে জিহাদ করে, সে এমন এক সিয়ামদারের ন্যায় যে অবিরাম রোজা রাখে ও সলাত আদায় করে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পথে জিহাদকারীর ব্যাপারে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন যে, সে মৃত্যু বরণ করলে তাকে জান্নাত দান করবেন অথবা নিরাপদে পুরস্কার ও গণীমতসহ ঘরে ফিরিয়ে আনবেন’’।[2] রসূল (ﷺ) আরও বলেন-

لَغَدْوَةٌ فِي سَبِيلِ اللهِ أَوْ رَوْحَةٌ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا

‘‘আল্লাহর রাস্তায় একটা সকাল অথবা একটা বিকাল ব্যয় করা দুনিয়া এবং এর মধ্যস্থিত সকল কিছু থেকে উত্তম’’।[3] তিনি আরও বলেন- তোমরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কর। কেননা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা বেহেশতের অন্যতম একটি দরজা। এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দাকে দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী হতে মুক্ত করেন।

রসূল (ﷺ) আরও বলেন- আমি ঐ ব্যক্তির যিম্মাদার, যে আমার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে, আনুগত্য করেছে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে। তার জন্য রয়েছে জান্নাতের এক পার্শ্বে একটি ঘর, জান্নাতের মাঝখানে একটি ঘর এবং জান্নাতের উপরে একটি ঘর। যে উপরোক্ত আমল করবে তথা রসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করবে, আনুগত্য করবে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে, কোন কল্যাণই তার হাত ছাড়া হবেনা এবং কোন অকল্যাণেরই তার ভয় থাকবেনা। সে যেখানে ইচ্ছা সেখানেই মৃত্যু বরণ করুক। রসূল (ﷺ) আরও বলেন-

مَنْ قَاتَلَ فِى سَبِيلِ اللهِ فُوَاقَ نَاقَةٍ فَقَدْ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ

‘‘একটি উটনী দোহন করতে যতটুকু সময় লাগে যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় ঠিক ততটুকু সময় জিহাদ করবে, তার জন্য জান্নাত আবশ্যক হয়ে যাবে’’।[4] রসূল (ﷺ) বলেন-

إِنَّ فِي الْجَنَّةِ مِائَةَ دَرَجَةٍ أَعَدَّهَا اللهُ لِلْمُجَاهِدِينَ فِي سَبِيلِ اللهِ، مَا بَيْنَ الدَّرَجَتَيْنِ كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ، فَإِذَا سَأَلْتُمُ اللهَ فَاسْأَلُوهُ الْفِرْدَوْسَ، فَإِنَّهُ أَوْسَطُ الْجَنَّةِ، وَأَعْلَى الْجَنَّةِ، أُرَاهُ فَوْقَهُ عَرْشُ الرَّحْمَنِ، وَمِنْهُ تَفَجَّرُ أَنْهَارُ الْجَنَّةِ

‘‘জান্নাতের একশটি স্তর রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তা মুজাহিদদের জন্য প্রস্ত্তত করে রেখেছেন। প্রত্যেক দু’ স্তরের মধ্যকার ব্যবধান হচ্ছে আসমান ও যমীনের ব্যবধানের সমান। সুতরাং যখন তোমরা আল্লাহর কাছে জান্নাত চাইবে তখন তোমরা জান্নাতুল ফিরদাউস চাও। কেননা এটি হচ্ছে জান্নাতের সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম জান্নাত। বর্ণনাকারীর ধারণাঃ রসূল (ﷺ) তারপর বলেছেন- উহার উপর আল্লাহর আরশ এবং তা থেকে জান্নাতের নদীসমূহ প্রবাহিত হয়েছে’’।[5]

রসূল (ﷺ) আরও বলেন- যে ব্যক্তি কোন মুজাহিদকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে, ঋণদারকে ঋণ পরিশোধ করতে এবং চুক্তিবদ্ধ কোন দাসকে দাসত্বের বন্ধন মুক্ত হতে সাহায্য করবে, আল্লাহ্ তাঁকে সেই দিন স্বীয় ছায়া দান করবেন, যেই দিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবেনা।[6]

রসূল (ﷺ) আরও বলেন-

مَنِ اغْبَرَّتْ قَدَمَاهُ فِي سَبِيلِ اللهِ حَرَّمَهُ اللهُ عَلَى النَّارِ

‘‘যে ব্যক্তির দু’পা আল্লাহর রাস্তায় ধূলিমাখা হবে তাকে আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিবেন’’।[7] রসূল (ﷺ) আরও বলেন-

لاَ يَجْتَمِعُ شُحٌ وَإِيمَانٌ فى قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ، وَلاَ يَجْتَمِعُ غُبَارٌ فى سَبِيلِ اللهِ وَدُخَانُ جَهنَّمَ فِى وَجْهِ عَبْدٍ

‘‘কৃপণতা ও ঈমান একই ব্যক্তির অন্তরে একত্রিত হতে পারেনা এবং আল্লাহর রাস্তার ধুলোবালি ও জাহান্নামের ধোঁয়া একই ব্যক্তির চেহারায় একত্রিত হতে পারেনা’’।[8] রসূল (ﷺ) আরও বলেন-

رِبَاطُ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ خَيْرٌ مِنْ صِيَامِ شَهْرٍ وَقِيَامِهِ، وَإِنْ مَاتَ، جَرَى عَلَيْهِ عَمَلُهُ الَّذِى كان يَعْمَلُهُ، وَأُجْرىَ عَلَيْهِ رِزْقُه وَأَمِنَ الفَتَّان

‘‘আল্লাহর রাস্তায় একদিন এবং এক রাত পাহারা দেয়া একমাস দিনের বেলায় সিয়াম রাখা এবং রাতের বেলায় কিয়াম করা হতেও উত্তম। পাহারা দেয়া অবস্থায় সে যদি মারা যায়, তাহলে সে জীবিত থাকতে যে আমল করত তার জন্য সেই আমলের ছাওয়াব লেখা হতে থাকবে, তাঁকে রিযিক দেয়া হতে থাকবে এবং সে ফিতনা হতে নিরাপদ থাকবে’’।[9]

কোন একজন লোক ভ্রমণকালে সারা রাত ঘোড়ায় আরোহন করে মুসলমানদেরকে সন্ধ্যা হতে সকাল পর্যন্ত পাহারা দিল। শুধু সলাত আদায়ের জন্য কিংবা পেশাব-পায়খানার প্রয়োজন ছাড়া সারা রাত সে ঘোড়া থেকে অবতরণ করেনি। তাকে লক্ষ্য করে নাবী (ﷺ) বলেছেন- তোমার জন্য জান্নাত আবশ্যক হয়ে গেছে। আজকের পরে যদি তুমি আর কোন আমল নাও কর, তাহলে তোমার কোন অসুবিধা হবেনা।[10] ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) নাবী (ﷺ) থেকে আরও বর্ণনা করেন যে,

مَنْ لَمْ يَغْزُ، أَوْ يُجَهِّزْ غَازِيَاً، أَوْ يُخَلِّفْ غَازِيَاً فى أَهْلِهِ بِخَيْرٍ، أَصَابَهُ اللهُ بِقَارِعَةٍ قَبْلَ يَوْمِ القِيَامَةِ

‘‘যে ব্যক্তি জিহাদ করবেনা অথবা কোন মুজাহিদের হাতিয়ার প্রস্ত্তত করে দিবেনা কিংবা কোন মুজাহিদের পরিবার-পরিজনকে ভালভাবে দেখা-শুনা করবেনা, কিয়ামতের পূর্বে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে অবশ্যই কোন না কোন মসিবতে আক্রান্ত করবেন।’’[11] আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

وَلاَ تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إلَى التَّهْلُكَةِ

‘‘নিজের জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিওনা’’। (সূরা বাকারা-২:১৯৫)

আবু আইয়্যুব আনসারী (রহঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন- তোমরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ছেড়ে দিয়ে নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিওনা।

নাবী (ﷺ) থেকে সহীহ সূত্রে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তির মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন প্রজ্বলিত করা হবে। (১) রিয়াকারী আলেম। অর্থাৎ যে ব্যক্তি মানুষের সুনাম ও প্রশংসা অর্জনের আশায় ইলম অর্জন করবে। (২) যে ব্যক্তি মানুষকে শুনানোর জন্য দান করবে এবং (৩) যে ব্যক্তি শুধু মানুষকে বীরত্ব প্রদর্শনের নিয়তে জিহাদ করে শহীদ হবে।[12]

[1]. বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান, তাও. হা/৩৬

[2]. বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল জিহাদ, তাও. হা/২৭৮৭

[3]. বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল জিহাদ।২৭৮৭তাও. হা/২৭৯২, সহীহ আত-তিরমিযী, মাপ্র. হা/১৬৫১, মিশকাত, হাএ. হা/৩৭৯২

[4]. মিশকাত, হাএ. হা/৩৮২৫

[5]. বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল জিহাদ, তাও. হা/২৭৯০

[6]. মুসনাদে আহমাদ। ইমাম আলবানী রহঃ) হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন। সিলসিলায়ে যঈফা, হা/৪৫৫৫।

[7]. বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল জুমআ, তাও. হা/৯০৭

[8]. নাসাঈ, অধ্যায়ঃ কিতাবুল জিহাদ, নাসাঈ, মাপ্র. হা/৩১১১

[9]. মুসলিম ও আবু দাউদ, মিশকাত, হাএ. হা/৩৭৯৩

[10]. আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ কিতাবুল জিহাদ। ইমাম আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। সহীহ আবু দাউদ, হা/২১৮৩

[11] . আবু দাউদ, আলএ. হা/২৫০৩, সুনান ইবনে মাজাহ, তাও. হা/২৭৬২, মিশকাত, হাএ. হা/৩৮২০, সহীহ হাসান।

[12]. সহীহ মুসলিম ও তিরমিযী।