মি’রাজের রাত্রে নাবী (সাঃ) কি আল্লাহকে দেখেছেন?

মিরাজের রাতে নাবী (ﷺ) তাঁর প্রভুকে দেখেছেন কি না, এই ব্যাপারে সাহাবীগণ মতভেদ করেছেন। আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তাঁর প্রভুকে দেখেছেন। ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে সহীহ সনদে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তাঁর প্রভুকে অন্তর দিয়ে দেখেছেন। আয়িশা এবং আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ দেখার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তারা উভয়েই বলেন- وَلَقَدْ رَآهُ نزلَةً أُخْرَى ‘‘নিশ্চয়ই তিনি তাকে আরেকবার দেখেছেন’’-এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে জিবরীল। আবু যার (রাঃ) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি রসূল (ﷺ) কে জিজ্ঞেস করেছেনঃ আপনি কি আপনার প্রভুকে দেখেছেন? উত্তরে তিনি বলেছেন- আমি তো নূর দেখেছি। তাঁকে কিভাবে দেখব? অর্থাৎ রসূল (ﷺ) এর মাঝে এবং তাঁর রবের মাঝে নূরের একটি পর্দা অন্তরায় হয়েছিল। অন্য শব্দে বর্ণিত হয়েছে, রসূল (ﷺ) বলেন- আমি একটি নূর দেখেছি। ইমাম দারামী না দেখার ব্যাপারে সাহাবীদের ইজমা বর্ণনা করেছেন।

শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রহঃ) বলেন- ইবনে আববাস (রাঃ) এর কথা, তিনি তাঁর প্রভুকে দেখেছেন এবং তিনি তাঁকে তাঁর অন্তর দিয়ে দেখেছেন- এই কথা দু’টি পরস্পর বিরোধী নয়। কেননা রসূল (ﷺ) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন- আমি আমার সুমহান ও বরকতময় প্রভুকে দেখেছি। এটি মিরাজের রাতের ঘটনা নয়; এটি মদ্বীনায় হিজরতের পর স্বপ্নযোগে সংঘটিত হয়েছে।

এর উপর ভিত্তি করেই ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ) বলেন- নাবী (ﷺ) সত্যিই তাঁর প্রভুকে দেখেছেন। কেননা নাবীদের স্বপ্নও সত্য হয় এবং অবশ্যই তা বাস্তবে পরিণত হয়। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ) এটি বলেন নি যে, তিনি জাগ্রত অবস্থায় চর্মচক্ষু দিয়ে দেখেছেন। যারা তাঁর থেকে এটি বর্ণনা করেছেন, তারা ভুল করেছেন। কিন্তু তিনি একবার বলেছেন- মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর প্রভুকে দেখেছেন। আরেকবার বলেছেন- অন্তর দিয়ে দেখেছেন। সুতরাং তাঁর থেকে দু’টি বর্ণনা এসেছে। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল থেকে তৃতীয় আরেকটি বর্ণনা এসেছে যে, তিনি তাঁর প্রভুকে কপালের চোখ দিয়ে দেখেছেন। এটি তাঁর কতিপয় ছাত্রের অতিরঞ্জিত বর্ণনা। এ ব্যাপারে ইমাম আহমাদ (রহঃ) এর সুষ্পষ্ট উক্তি রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে তৃতীয় বর্ণনাটি পাওয়া যায়না।

আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন- তিনি তাঁর প্রভুকে অন্তর দিয়ে দুইবার দেখেছেন। তিনি আল্লাহর এই বাণী দিয়ে দলীল গ্রহণ করেছেনঃ

كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى - أَفَتُمَارُونَهُ عَلَى مَا يَرَى - وَلَقَدْ رَآهُ نزلَةً أُخْرَى

‘‘রসূলের অন্তর মিথ্যা বলেনি যা সে দেখেছে। তোমরা কি সে বিষয়ে বিতর্ক করবে যা সে দেখেছে? নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল’’। (সূরা নাজম-৫৩:১১-১৩) প্রকাশ্য কথা এই যে, তিনি এই আয়াতগুলো দিয়েই দলীল গ্রহণ করেছেন। নাবী (ﷺ) থেকে এ বিষয়ে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, এই আয়াতে যাকে দেখার কথা বলা হয়েছে তিনি হচ্ছেন জিবরীল। নাবী (ﷺ) তাঁকে আসল আকৃতিতে দুইবার দেখেছেন। ইবনে আববাসের এ কথাই অর্থাৎ তিনি তার প্রভুকে অন্তর দিয়ে দুইবার দেখেছেন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বালের দলীল। তিনি বলেন- মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর প্রভুকে অন্তরের চোখ দিয়ে দেখেছেন; কপালের চোখ (চর্মচোখ) দিয়ে নয়।

আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীঃ ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى ‘‘অতঃপর নিকটবর্তী হল ও ঝুলে গেল’’। এখানে যেই নিকটবর্তী হওয়ার কথা বলা হয়েছে তার সম্পর্ক সূরা ইসরাতে বর্ণিত মিরাজের ঘটনার সাথে নয়। সুতরাং কুরআনে বর্ণিত নিকটবর্তী হওয়া দ্বারা জিবরীলের নিকটবর্তী হওয়া উদ্দেশ্য। আয়িশা  ও ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে এরূপই বর্ণিত হয়েছে। আয়াতের পূর্বাপর বিবরণ থেকেও তাই বুঝা যায়। কেননা আল্লাহ্ তা‘আলা এর আগে বলেন-

عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى - ذُو مِرَّةٍ فَاسْتَوَى - وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَى

‘‘তাঁকে শিক্ষা দান করে এক শক্তিশালী ফিরিস্তা। সহজাত শক্তিসম্পন্ন, সে নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেল। তখন সে ছিল উর্ধ্ব দিগমেত্ম’’। (সূরা নাজম-৫৩: ৫-৭)

আর হাদীছে যেই নিকটবর্তী হওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতে সুস্পষ্ট যে, তিনি তাঁর মহান প্রভুর নিকটবর্তী হয়েছিলেন। সুতরাং সূরা নাজমের ঘটনার সাথে হাদীছে বর্ণিত মিরাজের ঘটনার কোন দ্বন্দ নেই। সূরা নাজমে বর্ণিত হয়েছে যে, নাবী (ﷺ) জিবরীলকে দুইবার আসল আকৃতিতে দেখেছেন। একবার আকাশে সিদরাতুল মুনতাহায়। আরেকবার যমীনে।

মিরাজের রাতে আল্লাহর যে সকল বড় বড় নিদর্শন দেখেছেন সকাল বেলা তিনি তা লোকদেরকে বলতে লাগলেন। তারা এই ঘটনাকে কঠোরভাবে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিল এবং তাঁকে কষ্ট দিল। কুরাইশরা তাকে বাইতুল মাকদিসের বর্ণনা দিতে বলল। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সামনে বাইতুল মাকদিস উন্মুক্ত করলেন। তিনি তাতে দৃষ্টি দিয়ে সব বলে দিলেন। তারা তাঁর একটি কথাও অস্বীকার করতে পারলনা। তিনি কুরাইশদের বাণিজ্যিক কাফেলার ভ্রমণ ও প্রত্যাবর্তন সম্পর্কেও খবর দিলেন, যেই কাফেলাকে তিনি মিরাজের রাতে যাত্রা পথে দেখে এসেছিলেন। তিনি কুরাইশদেরকে এ কথাও বলে দিলেন যে, উমুক দিন তারা ফেরত আসবে। এমন কি তিনি কাফেলার উটের বহরের সামনে যে উটটি ছিল সে সম্পর্কেও খবর দিলেন। দেখা গেল তিনি যেভাবে খবর দিয়েছিলেন সেভাবেই সত্যে পরিণত হল। কিন্তু তাতেও তারা মুহাম্মাদ (ﷺ) এর প্রতি ঈমান আনয়ন করে নি। বরং তাদের সীমালংঘন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইবনে ইসহাক আয়িশা এবং মুআবিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণনা করে বলেন- মিরাজ হয়েছিল রূহানীভাবে। তবে রূহ তাঁর শরীর থেকে আলাদা হয়নি। হাসান বসরী (রহঃ) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। মিরাজ ‘স্বপ্নে হয়েছিল’ এবং ‘রূহের মাধ্যমে হয়েছিল’; সশরীরে নয়-এই কথা দু’টির মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা অবগত হওয়া জরুরী। উভয় কথার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। আয়িশা এবং মুআবিয়া (রাঃ) এ কথা বলেন নি যে, স্বপ্নের মাধ্যমে মিরাজ হয়েছে। বরং তারা বলেছেন- ‘রূহের মাধ্যমে মিরাজ হয়েছে, কিন্তু রূহ শরীরকে হারায়নি। সুতরাং উভয়টির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কেননা ঘুমন্ত ব্যক্তি স্বপ্নে যা দেখে, তা কখনও জানা ও পরিচিত বিষয়ই দেখে। ঘুমন্ত ব্যক্তি কখনও দেখে যে, সে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে অথবা দেখে যে, তাকে মক্কার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অথচ তার রূহ আকাশের দিকেও উঠেনি এবং মক্কার দিকেও যায়নি। বরং স্বপ্নের ফিরিস্তা তার জন্য একটি উদাহরণ পেশ করে মাত্র।

যারা বলে রূহের মাধ্যমের মিরাজ হয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য এটি নয় যে, তা ছিল স্বপ্নে। বরং তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রকৃতপক্ষেই ‘রূহের মাধ্যমে মিরাজ হয়েছে এবং মৃত্যুর মাধ্যমে দেহ থেকে রূহ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর যে রকম অবস্থার সম্মুখীন হবে নাবী (ﷺ) এর রূহ মুবারকও মিরাজের রাত্রিতে সে রকম অবস্থারই সম্মুখীন হয়েছিল। আর এটি অবশ্যই ঘুমন্ত ব্যক্তি স্বপ্নে যা দেখে তার অনেক উর্ধ্বে। কিন্তু নাবী (ﷺ) এর অবস্থা ছিল সাধারণ ও চিরাচরিত নিয়ম ও অভ্যাসের বাইরে। এ জন্য জীবিত অবস্থায়ই তাঁর পেট ফাড়া হয়েছে। অথচ তিনি ব্যথা অনুভব করেন নি। মৃত্যু ছাড়াই তাঁর রূহকে আসলেই উপরে উঠানো হয়েছে। তিনি ছাড়া অন্য কারও রূহ মৃত্যু ব্যতীত এ রকম অবস্থায় পৌঁছতে পারবেনা। কেননা নাবীদের মৃত্যুর পর তাদের রূহগুলো দেহ থেকে আলাদা হয়ে আসমানে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যায় এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে অবস্থান করে। মিরাজের রাতে নাবী (ﷺ) এর রূহ মুবারক উপরে উঠেছিল। অতঃপর ফেরত এসেছে। মৃত্যুর পর নাবীদের ‘রূহের সাথে এবং তাঁর মহান বন্ধুর সাথে স্থায়ীভাবে অবস্থান করছে। তারপরও তাঁর রূহ মুবারকের রয়েছে তার পবিত্র দেহের সাথে বিশেষ এক প্রকার সম্পর্ক। কেউ তাঁর উপর সালাম দিলে এর মাধ্যমেই তিনি তার উত্তর দেন। এই সম্পর্কের কারণেই তিনি মুসা (আঃ)কে কবরে সলাতরত দেখেছেন এবং আকাশেও তাঁকে দেখেছেন।

এটি জানা কথা যে, মিরাজের রাতে মুসা (আঃ) কে কবর থেকে উঠিয়ে নিয়ে পরে তাতে ফেরত দেয়া হয়নি; বরং আসমান হচ্ছে তাঁর ‘রূহের স্থায়ী বসবাসের জায়গা। আর কবর হচ্ছে কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর দেহের অবস্থানের জায়গা। সুতরাং তিনি তাঁকে কবরে সলাতরত দেখেছেন। আকাশেও দেখেছেন। এমনি প্রিয় নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ) আসমানে সর্বোচ্চ আসনে আছেন। তাঁর দেহ রয়েছে তাঁর কবরে। কোন মুসলিম তাঁকে সালাম দিলে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর পবিত্র দেহে তাঁর রূহ মুবারক ফেরত দেন। তিনি সেই সালামের জবাব দেন। কিন্তু রূহ আসমান থেকে চলে আসেনা। কেউ যদি এই কথা বুঝতে অক্ষম হয় তাহলে সে যেন সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখে। সূর্য অনেক উপরে থেকেও কিভাবে সে যমীনকে আলোকিত করছে এবং সকল জীব-জন্তু ও উদ্ভিদকে আলো দিয়ে তাদেরকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করছে। নাবী (ﷺ) এর ‘রূহের অবস্থা ও মর্যাদা এর চেয়েও অনেক বেশী। সুতরাং ‘রূহের এক অবস্থা। শরীরের আরেক অবস্থা।

ইমাম ইবনু আব্দুল বার (রহঃ) বলেন- হিজরতের এক বছর একমাস পূর্বে মিরাজ ও ইসরা সংঘটিত হয়েছিল।[1] আর মিরাজ হয়েছিল মাত্র একবার। কেউ কেউ বলেছেন- দুইবার। একবার সশরীরে জাগ্রত অবস্থায়। আরেকবার স্বপ্নে। যারা দুইবারের কথা বলেছেন- সম্ভবতঃ তারা শারীকের হাদীস এবং নাবী (ﷺ) এর বাণী- অতঃপর আমি জাগ্রত হলাম। তখন আমি মসজিদে ছিলাম এবং অন্যান্য সকল বর্ণনার মাঝে সমন্বয় করতে চেয়েছেন।

আবার কেউ বলেছেন- মিরাজ হয়েছিল দুইবার। একবার নবুওয়াতের পূর্বে। যেমন শারীকের হাদীছে এসেছে, وذلك قبل أن يُوحَى إليه অর্থাৎ এটি ছিল তাঁর নিকট অহী নাযিল হওয়ার পূর্বের ঘটনা। আরেকবার হয়েছিল নবুওয়াত প্রাপ্তির পরে। যেমনটি প্রমাণ করে অন্যসব হাদীস।

আবার কেউ বলেছেন মিরাজ হয়েছে তিনবার। একবার অহী নাযিল শুরু হওয়ার পূর্বে। দুইবার নবুওয়াত পাওয়ার পরে। এ সব কথা শুধু অনুমান ভিত্তিক। এগুলো যাহেরী মাজহাবের দুর্বল বর্ণনাকারীদের কাজ। তারা যখন কোন ঘটনায় বর্ধিত কোন শব্দ পেয়েছে সেটিকেই আলাদা একটি বর্ণনা মনে করেছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে পরস্পর বিরোধপূর্ণ বর্ণনাগুলোর প্রত্যেকটিকে তারা আলাদা আলাদা ঘটনা বলে বর্ণনা করেছে।

সঠিক কথা হচ্ছে মক্কাতে নবুওয়াতের পর মাত্র একবার মিরাজ হয়েছে। এটিই মুহাদ্দেছীন ও গ্রহণযোগ্য ইমামদের মত। সুতরাং যারা বলে একাধিকবার মিরাজ হয়েছে, তাদের জন্য আফসোস। তারা কিভাবে ধারণা করতে পারে যে, নাবী (ﷺ) এর উপর প্রত্যেকবার পঞ্চাশ ওয়াক্ত সলাত ফরয করা হয়েছে? অতঃপর তিনি তাঁর রব ও মুসার মাঝে যাওয়া-আসা করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত হয়েছে। মিরাজের হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে হাদীছের হাফিয ও বিশেষজ্ঞগণ শারীককে ভুলকারী হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।

ইমাম মুসলিম সেই হাদীসকে সনদ সহকারে বর্ণনা করে বলেন- শারীক এই হাদীছের শব্দসমূহের একটিকে অন্যটির পূর্বে বা পরে এবং বাড়িয়ে ও কমিয়ে বর্ণনা করেছেন। তিনি পূর্ণ হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। ইমাম মুসলিম (রহঃ) সঠিক এবং অত্যন্ত উত্তম কথা বলেছেন।[2]

[1]. মক্কা থেকে বাইতুল মাকদিস পর্যন্ত ভ্রমণকে ইসরা বলা হয়। এটি হয়েছিল বুরাকের উপর আরোহন অবস্থায়। আর বাইতুল মাকদিস থেকে সাত আসমান পর্যন্ত ভ্রমণকে বলা হয় মিরাজ। এটি হয়েছিল সিড়ির মাধ্যমে। (আল্লাহই ভাল জানেন)

[2]. মি’রাজের রাত্রিতে নাবী সাঃ) যে সমস্ত নিদর্শন দেখেছেন

মেরাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا (মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল) তাঁকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্যে। (সূরা বাণী ইসরাঈল-১৭:১) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই রাত্রিতে অসংখ্য বড় বড় নিদর্শন দেখেছেন। তম্মধ্যেঃ

১. মানব জাতির পিতা আদম আঃ) কে দেখেছেন। তার ডান পাশে ছিল শহীদদের (জান্নাতীদের) রূহ এবং বাম পাশে ছিল জাহান্নামীদের রূহ।

২. রসূল সাঃ) বলেনঃ অতঃপর আমার সামনে বায়তুল মামূর উম্মুক্ত করা হলো। বায়তুল মামূর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে জিবরীল বললেন- এটি হলো বায়তুল মামূর। এতে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা সলাত আদায় করে। এক বার যে সেখান থেকে বের হয়ে আসে কিয়ামতের পূর্বে সে আর তাতে প্রবেশের সুযোগ পাবেনা।

৩. রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- অতঃপর আমার জন্যে সিদরাতুল মুনতাহা তথা সিমামেত্মর কূল বৃক্ষ উম্মুক্ত করা হল। এই বৃক্ষের ফলগুলো ছিল কলসীর ন্যায় বড়। গাছের পাতাগুলো ছিল হাতীর কানের মত বৃহদাকার।

৪. তিনি গাছের গোড়াতে চারটি নদী দেখতে পেলেন। দু'টি চলে গেছে ভিতরের দিকে এবং দুটি চলে গেছে বাহিরের দিকে। জিবরীলকে আমি এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন- ভিতরের দিকে প্রবাহিত নদী দুটি জান্নাতে চলে গেছে এবং বাহিরের নদী দুটি হলো ফোরাত ও নীল। ফোরাত ও নীল দেখার অর্থ হল নাবী সাঃ) এর মিশন অচিরেই ঐ নদী দুটির অঞ্চলে পৌঁছে যাবে এবং ঐ সমস্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা যুগে যুগে ইসলামের পতাকা বহন করবে। অর্থ এই নয় যে এদু’টি নদী জান্নাত থেকে বের হয়ে এসেছে।

৫. মিরাজের রাত্রিতে তিনি সিদরাতুল মুনতাহায় জিবরীল ফেরেশতাকে আসল আকৃতিতে দেখলেন। অথচ ইতিপূর্বে তিনি আরেকবার দুনিয়াতে তাঁকে দেখেছিলেন।

৬. তিনি বে-সলাতীর শাস্তি দেখেছেন। সহীহ বুখারীতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দীর্ঘ হাদীছে এসেছে, ্র

وَإِنَّا أَتَيْنَا عَلَى رَجُلٍ مُضْطَجِعٍ وَإِذَا آخَرُ قَائِمٌ عَلَيْهِ بِصَخْرَةٍ وَإِذَا هُوَ يَهْوِي بِالصَّخْرَةِ لِرَأْسِهِ فَيَثْلَغُ رَأْسَهُ فَيَتَهَدْهَدُ الْحَجَرُ هَا هُنَا فَيَتْبَعُ الْحَجَرَ فَيَأْخُذُهُ فَلَا يَرْجِعُ إِلَيْهِ حَتَّى يَصِحَّ رَأْسُهُ كَمَا كَانَ ثُمَّ يَعُودُ عَلَيْهِ فَيَفْعَلُ بِهِ مِثْلَ مَا فَعَلَ الْمَرَّةَ الْأُولَىগ্ধ

‘‘আমরা এক শায়িত ব্যক্তির কাছে আসলাম। তার মাথার কাছে পাথর হাতে নিয়ে অন্য একজন লোক দাড়িয়ে ছিল। দাঁড়ানো ব্যক্তি শায়িত ব্যক্তির মাথায় সেই পাথর নিক্ষেপ করছে। পাথরের আঘাতে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে এবং পাথরটি বলের মত গড়িয়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। লোকটি পাথর কুড়িয়ে আনতে আনতে আবার তার মাথা ভাল হয়ে যাচ্ছে। দাঁড়ানো ব্যক্তি প্রথমবারের মত আবার আঘাত করছে এবং তার মাথাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সফরসঙ্গী ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ কি অপরাধের কারণে তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছে? উত্তরে তারা বললেনঃ এব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করেছিল। কিন্তু কুরআন অনুযায়ী আমল করেনি এবং সে ফরজ সলাতের সময় ঘুমিয়ে থাকত। কিয়ামত পর্যন্ত তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী তাও হা/৭০৪৭)

৭. তিনি সুদখোরের শাস্তি দেখেছেন। সহীহ বুখারীতে সামুরা বিন জুনদুব  হতে বর্ণিত হয়েছে রসূল সাঃ) এর দীর্ঘ হাদীছে এসেছে, ্র

فَأَتَيْنَا عَلَى نَهَرٍ حَسِبْتُ أَنَّهُ كَانَ يَقُولُ أَحْمَرَ مِثْلِ الدَّمِ وَإِذَا فِي النَّهَرِ رَجُلٌ سَابِحٌ يَسْبَحُ وَإِذَا عَلَى شَطِّ النَّهَرِ رَجُل قَدْ جَمَعَ عِنْدَهُ حِجَارَةً كَثِيرَةً وَإِذَا ذَلِكَ السَّابِحُ يَسْبَحُ مَا يَسْبَحُ ثُمَّ يَأْتِي ذَلِكَ الَّذِي قَدْ جَمَعَ عِنْدَهُ الْحِجَارَةَ فَيَفْغَرُ لَهُ فَاهُ فَيُلْقِمُهُ حَجَرًا فَيَنْطَلِقُ يَسْبَحُ ثُمَّ يَرْجِعُ إِلَيْهِ كُلَّمَا رَجَعَ إِلَيْهِ فَغَرَ لَهُ فَاهُ فَأَلْقَمَهُ حَجَرًاগ্ধ

‘‘আমরা একটি রক্তের নদীর কাছে আসলাম। দেখলাম নদীতে একটি লোক সাঁতার কাটছে। নদীর তীরে অন্য একটি লোক কতগুলো পাথর একত্রিত করে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সাঁতার কাটতে কাটতে লোকটি যখন নদীর কিনারায় পাথরের কাছে দাড়ানো ব্যক্তির নিকটে আসে তখন দাড়ানো ব্যক্তি তার মুখে একটি পাথর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। পাথর মুখে নিয়ে লোকটি আবার সাঁতরাতে শুরু করে। যখনই লোকটি নদীর তীরে আসতে চায় তখনই তার মুখে পাথর ঢুকিয়ে দেয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কারণ জানতে চাইলে ফেরেশতাদ্বয় বললেনঃ এরা হলো আপনার উম্মতের সুদখোর’’। (সহীহ বুখারী মাশা হা/৬৬৪০)

৮. তিনি ইয়াতীমের মাল আত্মসাৎকারীকেও দেখেছেন। তাদের ঠোঁটের আকার আকৃতি ছিল উটের ঠোঁটের মত। তারা পাথরের টুকরোর মত আগুনের ফুলকী মুখের মধ্যে পুরতেছিল এবং সেগুলো পায়খানার রাস্তা দিয়ে বের হচ্ছিল।

৯. তিনি ব্যভিচারী নারী পুরুষের শাস্তি দেখেছেন। সহীহ বুখারীতে সামুরা বিন জুনদুব  হতে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর দীর্ঘ হাদীছে কবরে ব্যভিচারীর ভয়াবহ শাস্তির বর্ণনা এসেছে। তিনি বলেনঃ ্র

فَأَتَيْنَا عَلَى مِثْلِ التَّنُّورِ قَالَ فَأَحْسِبُ أَنَّهُ كَانَ يَقُولُ فَإِذَا فِيهِ لَغَطٌ وَأَصْوَاتٌ قَالَ فَاطَّلَعْنَا فِيهِ فَإِذَا فِيهِ رِجَالٌ وَنِسَاءٌ عُرَاةٌ وَإِذَا هُمْ يَأْتِيهِمْ لَهَبٌ مِنْ أَسْفَلَ مِنْهُمْ فَإِذَا أَتَاهُمْ ذَلِكَ اللهَبُ ضَوْضَوْاগ্ধ

‘‘আমরা একটি তন্দুর চুলার নিকট আসলাম। যার উপরিভাগ ছিল সংকীর্ণ এবং ভিতরের অংশ ছিল প্রশস্ত। তার ভিতরে আমরা কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। দেখতে পেলাম তাতে রয়েছে কতগুলো উলঙ্গ নারী-পুরুষ। তাদের নিচের দিক থেকে আগুনের শিখা প্রজ্বলিত করা হচ্ছে। অগ্নিশিখা প্রজ্ববলিত হওয়ার সাথে সাথে তারা উচ্চঃস্বরে চিৎকার করছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কারণ জানতে চাইলে ফেরেশতাদ্বয় বললেনঃ এরা হলো আপনার উম্মতের ব্যভিচারী নারী-পুরুষ’’। (বুখারী)

ব্যভিচারীর শাস্তির অন্য একটি চিত্র

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিরাজের রাত্রিতে একদল লোকের কাছে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন তাদের সামনে একটি পাত্রে গোশত রান্না করে রাখা হয়েছে। অদূরেই অন্য একটি পাত্রে রয়েছে পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত কাঁচা গোশত। লোকদেরকে রান্না করে রাখা গোশত থেকে বিরত রেখে পঁচা এবং দুর্গন্ধযুক্ত, কাঁচা গোশত খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। তারা চিৎকার করছে এবং একান্ত অনিচ্ছা সত্বেও তা থেকে ভক্ষণ করছে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরীল ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ এরা কোন শ্রেণীর লোক? জিবরীল বললেনঃ এরা আপনার উম্মতের ঐ সমস্ত পুরুষ লোক যারা নিজেদের ঘরে পবিত্র এবং হালাল স্ত্রী থাকা সত্বেও অপবিত্র এবং খারাপ মহিলাদের সাথে রাত্রি যাপন করত। (আল-খুতাবুল মিম্বারিয়াহ, ডঃ সালেহ ফাওযান) এই হাদীসের মূল বিষয় বস্ত্ত অন্য এক বিশুদ্ধ হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত। তবে উল্লেখিত হাদীসটি দুর্বল।

৯) তিনি জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেছেন

১০) তিনি সেই রাত্রে জাহান্নামের প্রহরী মালেক ফেরেশতাকে দেখেছেন। তাঁর দিকে ফিরে তাকাতেই তিনি আমাকে প্রথমেই সালাম দিলেন। (বুখারী, কিতাবু আহাদীছুল আম্বীয়া, হা/৩১৮২, মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান, হা/২৫১)

১১) বায়তুল মাকদিসে নাবীদের ইমাম হয়ে সলাত পড়েছেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকালে ঘুম থেকে উঠে সে রাত্রিতে দেখে আসা নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে যখন কুরাইশদেরকে সংবাদ দিলেন, তখন তারা এই ঘটনাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিল। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উপর তারা অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল। তারা তাঁর নিকট বায়তুল মাকদিসের বর্ণনা পেশ করার দাবী জানালো। আল্লাহ বায়তুল মাকদিসের দৃশ্য তার চোখের সামনে উম্মুক্ত করলেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখে দেখে সেখানকার সকল নিদর্শন বলে দিলেন। তারা একটি কথাও অস্বীকার করতে পারলনা।

আবূ হুরায়রা  হতে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আমি একদা কাবার প্রাঙ্গনে ছিলাম। কুরাইশরা আমাকে বায়তুল মাকদিসের এমন জিনিষ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল যা আমার স্মরণ ছিলনা। এতে আমি সংকটে পড়ে গেলাম। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ আমার জন্যে বায়তুল মাকদিসকে চোঁখের সামনে উঠিয়ে ধরলেন। দেখে দেখে আমি তাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলাম।



মি’রাজের শিক্ষাঃ

১) ঈমানী পরীক্ষাঃ

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বায়তুল মাকদিস ভ্রমণ করে এসে সকালে মানুষের কাছে তা বলতে শুরু করলেন। এ ঘটনা শুনে কতিপয় দুর্বল ঈমানদার মুরতাদ হয়ে গেল। মুশরিকদের কিছু লোক দৌড়িয়ে আবূ বকর (রাঃ) এর নিকট গিয়ে বললঃ তোমার বন্ধুর খবর শুনবে কি? সে বলছে, আজ রাতের ভিতরেই সে নাকি বায়তুল মাকদিস ভ্রমণ করে চলে এসেছে। তিনি বললেনঃ আসলেই কি মুহাম্মাদ তা বলছে? তারা এক বাক্যে বললঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ যদি বলেই থাকে, তাহলে সত্য বলেছেন। তারা আবার বললঃ তুমি কি বিশ্বাস কর যে, সে এক রাতের ভিতরে বায়তুল মাকদিস ভ্রমণ করে সকাল হওয়ার পূর্বেই আবার মক্কায় চলে এসেছে? উত্তরে তিনি বললেনঃ আমি এর চেয়েও দূরের সংবাদকে বিশ্বাস করি। তাঁর কাছে সকাল-বিকাল আকাশ থেকে সংবাদ আসে। আমি তা বিশ্বাস করি। সে দিনই আবূ বকর (রাঃ) কে পরম সত্যবাদী তথা সিদ্দীক উপাধীতে ভূষিত করা হয়। (হাকেম, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ৮১, হা/ ৩১৮২, ইমাম আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)

২) দাঈদের জন্য শিক্ষাঃ

মিরাজের ঘটনায় দ্বীনের দাঈদের জন্য এক বিশেষ শিক্ষা রয়েছে। তিনি প্রচারক মিরাজ থেকে ফেরত এসে মানুষের কাছে ঘটনা খুলে বলতে ইচ্ছা প্রকাশ করলে উম্মে হানী বিনতে আবু তালেব (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ আমার আশঙ্কা হচ্ছে, লোকেরা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলবে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ আল্লাহর শপথ! আমি অবশ্যই তাদের কাছে ঘটনা খুলে বলবো। আমাকে তারা মিথ্যাবাদী বললেও। সুতরাং দ্বীনের দাঈগণের উচিত, সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে তারা কোন প্রকার দ্বিধাবোধ করবে না এবং মানুষ সেটাকে গ্রহণ করবে কি করবে না- এ ধরণের কোন চিন্তা-ভাবনা করবে না; বরং বলিষ্ঠ কন্ঠে মানুষের সামনে সত্যকে তুলে ধরবে।

৩) পাঁচ ওয়াক্ত সলাত ফরয হয়ঃ

মেরাজের রাতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সলাত ফরজ করা হয়েছে। মিরাজ থেকে ফেরত আসার সময় ৬ষ্ঠ আসমানে মূসা আঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ হল। মূসা আঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি আপনার প্রভুর পক্ষ হতে কি নিয়ে আসলেন? নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আমার উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সলাত ফরজ করা হয়েছে। মূসা আঃ) বলেনঃ আমি মানুষের অবস্থা তোমার চেয়ে অনেক বেশী অবগত। বানী ইসরাঈলকে আমি ভালভাবেই পরীক্ষা করে দেখেছি। তোমার উম্মাত পঞ্চাশ ওয়াক্ত সলাত পড়তে পারবে না। তুমি ফেরত যাও এবং কমাতে বল। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আমি মূসা আঃ) এর পরামর্শ মোতাবেক ফেরত গিয়ে কমাতে বললাম। চল্লিশ করা হলো। আবার মূসা আলাইহিস সালামের পরামর্শ মোতাবেক ২য় বার আবদারের প্রেক্ষিতে ত্রিশ করা হলো। পুনরায় যাওয়ার প্রেক্ষিতে বিশ ওয়াক্ত করে দেয়া হলো। অতঃপর দশে পরিণত হলো। মূসা আঃ) এর কাছে দশ ওয়াক্ত নিয়ে ফেরত আসলে তিনি আবার যেতে বললেন। এবার পাঁচ ওয়াক্ত করা হলো। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ পাঁচ ওয়াক্ত সলাত নিয়ে মূসা আঃ) এর কাছে আগমণ করলাম। তিনি আমাকে আবার যেতে বললেন। আমি তাঁকে বললামঃ আমি গ্রহণ করে নিয়েছি। তখন আল্লাহর পক্ষ হতে ঘোষণা করা হলোঃ আমার ফরজ ঠিক রাখলাম। কিন্তু বান্দাদের উপর থেকে সংখ্যা কমিয়ে দিলাম। আর আমি প্রতিটি সৎআমলের বিনিময় দশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিব। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত সলাত সঠিকভাবে আদায় করলে তাকে পঞ্চাশ ওয়াক্তের ছওয়াব দেয়া হবে। (বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবু বাদইল খাল্ক, হা/ ৪৪৫৮, মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান, হা/ ২৩৮)

৪) আল্লাহ্ তা‘আলা যে আরশে আযীমে সমুন্নত মিরাজের ঘটনা তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। কারণ আল্লাহ্ তা‘আলা আরশে এবং আসমানে না হলে উপরের দিকে মিরাজ হওয়ার কোন অর্থ হয় না।

৫) সকল ইবাদতের মধ্যে সলাত হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কারণ আল্লাহ্ তা‘আলা অন্যান্য ইবাদত যমীনে ফরয করেছেন। আর সলাত ফরজ করেছেন তাঁর প্রিয় বন্ধুকে কাছে ডেকে নিয়ে সাত আসমানের উপরে। এতে সলাতের গুরুত্বের কথাটি সহজেই অনুধাবন করা যায়।

৬) সলাত পরিত্যাগ করা কঠিন অপরাধ। তাই বেসলাতীর শাস্তিও অত্যন্ত কঠোর।

৭) ব্যভিচার একটি ঘৃণিত কাজ। এর শাস্তিও অত্যন্ত নিকৃষ্ট।

৮) সুদখোরের ভয়াবহ পরিণতি।

মিরাজ সম্পর্কে কতিপয় ভ্রান্ত বিশ্বাস ও তার প্রতিবাদঃ

ক) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীর্ঘ ২৭ বছর পর্যন্ত মিরাজে থাকার গল্প কাল্পনিক।

খ) বড় পীরের ঘাড়ে চরে সিদরাতুল মুন্তাহা পার হয়ে আল্লাহর দরবারে পৌঁছার কিচ্ছা বানোয়াট।

গ) ২৭ রজবে বিশেষ ইবাদত পালন করা বা রজব দিবস পালন করা বিদআত। কারণ রসূল সাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণ শবে মিরাজ উপলক্ষে কোন ইবাদত করেন নি বা করতে বলেন নি। সুতরাং দ্বীনের ক্ষেত্রে সকল নব আবিস্কৃত বিষয়ই বিদআত, যা থেকে দূরে থাকা সকল মুসলিমের উপর আবশ্যক। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ্রمَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّগ্ধ


‘‘যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে নতুন বিষয় তৈরী করবে যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে। (বুখারী ও মুসলিম) তিনি আরও বলেনঃ ্রمَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّগ্ধ

‘‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করবে, যে বিষয়ে আমাদের অনুমোদন নেই, তা আমলকারীর উপর প্রত্যাখ্যাত হবে। (সহীহ মুসলিম)

ঘ) আল্লাহ্কে স্বচক্ষে দেখার কথাটি সঠিক নয়। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ) আল্লাহকে দেখার ব্যাপারে আলেমদের মতবিরোধ বর্ণনা করেছেন। তবে বিশুদ্ধ কথা হলো, তিনি আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখেন নি। কারণ কোন সাহাবী স্বচক্ষে দেখার পক্ষে কোন বর্ণনা উল্লেখ করেন নি। ইবনে আববাস  থেকে যে বর্ণনা এসেছে, আল্লাহকে দেখার অর্থ হলো অন্তর চক্ষু দিয়ে দেখা। কপালের চক্ষু (চর্মচক্ষু) দিয়ে দেখা উদ্দেশ্য নয়। (যাদুল মাআদ, (৩/৩০) আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখার ব্যাপারে আয়েশা ˆ এর হাদীস: ্র

عن عَائِشَةَ فَقَالَتْ ثَلَاثٌ مَنْ تَكَلَّمَ بِوَاحِدَةٍ مِنْهُنَّ فَقَدْ أَعْظَمَ عَلَى اللهِ الْفِرْيَةَ قُلْتُ مَا هُنَّ قَالَتْ مَنْ زَعَمَ أَنَّ مُحَمَّدًا صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى رَبَّهُ فَقَدْ أَعْظَمَ عَلَى اللهِ الْفِرْيَة قَالَ قَالَتْ وَمَنْ زَعَمَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَتَمَ شَيْئًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَقَدْ أَعْظَمَ عَلَى اللهِ الْفِرْيَةَ وَاللهُ يَقُولُ ( يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ قَالَتْ وَمَنْ زَعَمَ أَنَّهُ يُخْبِرُ بِمَا يَكُونُ فِي غَدٍ فَقَدْ أَعْظَمَ عَلَى اللهِ الْفِرْيَةَ وَاللهُ يَقُولُ قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللهُগ্ধ

আয়েশা রহঃ) বলেনঃ যে ব্যক্তি বলবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রবকে স্বচক্ষে দেখেছেন সে আল্লাহর উপর বিরাট মিথ্যারোপ করল। যে ব্যক্তি বলবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশ গোপন করেছেন, সে আল্লাহর উপর বিরাট মিথ্যা রটনা করল। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ হে রসূল! পৌঁছে দাও তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি তুমি এরূপ না করো, তবে তুমি তার পয়গাম কিছুই পৌঁছালেনা। (সূরা মায়িদাঃ ৬৭) আর যে ব্যক্তি বিশ্বাস করবে যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (গায়েবের) আগাম খবর দিতে পারতেন সেও আল্লাহর উপর চরম মিথ্যা রটনা করল।’’ (তিরমিযী-সহীহ) তিনি আল্লাহর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং অন্তর দিয়ে তা অনুভব করেছেন। কিন্তু স্বচক্ষে দেখার কোন দলীল পাওয়া যায় না।

ঙ) মিরাজের রাতে খাজা বাবা রূহানী বেশে আগমণ করে বুরাকে হাত দিয়ে বুরাককে শান্ত করার কাহিনী বানোয়াট। সুতরাং মিরাজ সম্পর্কে এ সকল কাল্পনিক ও মিথ্যা ঘটনা পরিহার করে তা থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করা আমাদের সকলের জন্য জরুরী।