অল্প সময়ের ব্যবধানে খাদীজা (রাঃ) ও আবু তালেবের মৃত্যুর পর মূর্খ কুরাইশরা রসূল (ﷺ) এর উপর প্রকাশ্যে নির্যাতন শুরু করল। তাই তিনি এই আশায় তায়েফ গমণ করলেন যে, তায়েফবাসী হয়ত তাঁকে আশ্রয় দিবে এবং সাহায্য করবে। তায়েফ গিয়ে তিনি সেখানকার অধিবাসীদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করলেন। কিন্তু তিনি সেখানে কোন সাহায্যকারী পেলেন না এবং তাকে কেউ আশ্রয়ও দিল না। এমনকি একজন লোকও তাঁর দাওয়াত কবুল করল না। বরং তারা তাঁকে আরও বেশী কষ্ট দিল। এত কষ্ট তিনি ইতিপূর্বে তাঁর জাতির লোকদের থেকেও ভোগ করেন নি। তাঁর সাথে ছিলেন তাঁরই মুক্ত করা ক্রীতদাস যায়েদ ইবনে হারেসা। রসূল (ﷺ) তায়েফে দশ দিন অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি তায়েফের সকল গোত্রীয় সর্দারদের কাছে গমণ করেন এবং প্রত্যেককে দ্বীনের দাওয়াত দেন। কিন্তু সবাই একই কথা বলল যে, তুমি আমাদের শহর থেকে বেরিয়ে যাও। শুধু এ কথা বলেই ক্ষান্ত হয় নি; বরং তারা দুষ্ট বালকদের তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। ফেরার পথে তায়েফের মূর্খ ও দুষ্টরা তাঁর পিছে লাগল। তারা আল্লাহর রসূলকে গালি দিচ্ছিল, তাঁর পিছনে হৈ চৈ করছিল এবং পাথর নিক্ষেপ করছিল। পাথরের আঘাতে তাঁর শরীর থেকে রক্ত ঝরে পায়ের জুতা দু’টি লাল হয়ে গেল। যায়েদ ইবনে হারেছা (রাঃ) প্রিয় নাবীকে রক্ষা করছিলেন। একটি পাথর এসে তাঁর মাথায় লেগে গেল। এতে তাঁর মাথা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল।
নাবী (ﷺ) তায়েফ থেকে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মক্কায় ফেরত আসলেন। ফেরার পথে তিনি আল্লাহর দরবারে এই প্রসিদ্ধ দু’আটি করলেন-

اللّٰهُمَّ إِلَيْكَ أَشْكُو ضَعْفَ قُوَّتِى، وَقِلَّةَ حِيلَتِى وهَوَانى عَلَى النَّاس يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِينَ، أَنْتَ رَبُّ المُسْتَضْعَفِينَ، وأَنْتَ رَبَّى إلَى مَنْ تَكِلَنِى إِلَى بَعِيدٍ يَتَجَهَّمُنِى؟ أوْ إلى عَدوٍّ مَلَّكْتَهُ أَمْرِى، إنْ لَمْ يَكُنْ بِكَ غَضَبٌ عَلَىَّ فَلاَ أُبَالِى، غَيْرَ أَنَّ عَافِيتَكَ هِى أَوْسَعُ لى، أَعُوذُ بِنُورِ وَجْهِكَ الَّذِى أَشْرَقَتْ لَهُ الظُّلُمَاتُ، وَصَلُحَ عَلَيْهِ أَمْرُ الدُّنيا وَالآخِرَةِ أَنْ يَحِلَّ عَلَىَّ غَضَبُكَ أوْ أَنْ يَنْزِلَ بى سَخَطُك، لك العُتبى حَتَّى تَرْضَى وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلا بِكَ

‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে স্বীয় দুর্বলতা, (মানুষকে বুঝাতে) আমার কলা-কৌশলের স্বল্পতা এবং মানুষের কাছে আমার মূল্যহীনতার অভিযোগ করছি। হে সর্বাধিক দয়ালু! তুমি দুর্বলদের প্রভু, আমারও প্রভু। তুমি আমাকে কার কাছে ন্যস্ত করছ? তুমি কি আমাকে দূরের এমন অচেনা কারও হাতে ন্যস্ত করছ, যে আমার সাথে কঠোর ব্যবহার করবে? নাকি কোন শত্রুর হাতে সোপর্দ করছ, যাকে তুমি আমার বিষয়ের মালিক করে দিয়েছ? তুমি যদি আমার উপর রসূান্বিত না হও তাহলে আমি কোন কিছুই পরওয়া করিনা। তবে নিঃসন্দেহে তোমার ক্ষমা আমার জন্য সর্বাধিক প্রশস্ত ও প্রসারিত। আমি তোমার সেই চেহারার আলোর আশ্রয় চাই, যা দ্বারা অন্ধকার দূরিভূত হয়ে যায় এবং যা দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাতের সকল বিষয় সংশোধন হয়। এই কথার মাধ্যমে আমার উপর তেমার ক্রোধা নেমে আসা হতে অথবা আমার উপর তোমার অসন্তুষ্টি নাযিল হওয়া থেকে তোমার আশ্রয় চাই। তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই আমার সকল প্রচেষ্টা। তোমার সাহায্য ব্যতীত অন্যায় কাজ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব নয় এবং তোমার তাওফীক ও শক্তি ছাড়া তোমার আনুগত্য করা অসম্ভব’’।[1]

ফেরার পথে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কাছে পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিস্তা প্রেরণ করলেন। ফিরিস্তা তাঁর কাছে তায়েফবাসীদের উপর মক্কার বড় দু’টি পাহাড় নিক্ষেপ করে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়ার অনুমতি চাইলেন। উত্তরে নাবী (ﷺ) বললেন বরং আমি চাই আল্লাহ তাদের বংশধর হতে এমন মানুষ সৃষ্টি করবেন যারা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবেনা।
‘ওয়াদীয়ে নাখলা’ নামক জায়গায় এসে কয়েক দিন অতিবাহিত করলেন। তিনি রাত্রে সেখানে দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করছিলেন। তখন আল্লাহ রাববুল আলামীন জিনদের একটি দল তাঁর নিকট প্রেরণ করেন। তারা নাবী (ﷺ) এর কুরআন তিলাওয়াত শুনল। কুরআনের এই আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে তিনি তাদের আগমণ সম্পর্কে অবগত হতে পারেন নি। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

وَإِذْ صَرَفْنَا إِلَيْكَ نَفَرًا مِنْ الْجِنِّ يَسْتَمِعُونَ الْقُرْآنَ فَلَمَّا حَضَرُوهُ قَالُوا أَنْصِتُوا فَلَمَّا قُضِيَ وَلَّوْا إِلَى قَوْمِهِمْ مُنْذِرِينَ

‘‘স্মরণ কর সেই সময়ের কথা যখন আমি তোমার প্রতি প্রেরণ করেছিলাম একদল জিনকে। যারা কুরআন পাঠ শুনছিল। যখন ওরা তার নিকট উপস্থিত হলো, ওরা একে অপরকে বলতে লাগল- চুপ করে শ্রবণ কর। যখন কুরআন পাঠ সমাপ্ত হল ওরা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গেল, এক একজন সতর্ককারীরূপে’’। (সূরা আহকাফ-৪৬:২৯-৩১) আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-

قُلْ أُوحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِنْ الْجِنِّ فَقَالُوا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا

‘‘বলোঃ আমার প্রতি এই মর্মে অহী প্রেরিত হয়েছে, জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেছে এবং বলেছে, আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি’’।[2] ‘নাখলা’ নামক জায়গায় কয়েকদিন অতিবাহিত করার পর যায়েদ তাঁকে বললেন- মক্কার কুরাইশরা আপনাকে মক্কা থেকে বের করে দিয়েছে। এখন আপনি কিভাবে সেখানে প্রবেশ করবেন? তিনি বললেন- হে যায়েদ! তুমি যেই মসীবত প্রত্যক্ষ করছ, আল্লাহ্ তা‘আলা তা অবশ্যই বিদূরিত করবেন, তিনি তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন এবং তাঁর নাবীকে সাহায্য করবেন।

মক্কার নিকটবর্তী হয়ে তিনি খোযা’আ গোত্রের একজন লোকের মাধ্যমে মুতইম বিন আদীর কাছে আশ্রয় চাইলেন। তিনি মুতইমকে বললেন- আমি তোমার আশ্রয়ে মক্কায় প্রবেশ করতে চাই। সে রাজী হল এবং ঘোষণা দিল যে, আমি মুহাম্মাদকে আশ্রয় দিচ্ছি। সে তার ছেলেদেরকে ডেকে বলল- তোমরা অস্ত্র হাতে নাও এবং কাবার চারপাশে দাঁড়িয়ে যাও। আমি মুহাম্মাদকে আশ্রয় দিচ্ছি। যায়েদকে সাথে নিয়ে তিনি মুতইম বিন আদীর আশ্রয়ে কাবায় প্রবেশ করলেন। মুতইম বিন আদী স্বীয় বাহনের উপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিল যে, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি মুহাম্মাদকে আশ্রয় দিয়েছি। সুতরাং কেউ যেন তাঁর উপর আক্রমন না করে।

অতঃপর নাবী (ﷺ) হাজরে আসওয়াদের কাছে গিয়ে তাতে চুম্বন করলেন এবং দু’রাকাত সলাত আদায় করলেন। মুতইম বিন আদী এবং তার ছেলেরা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নাবী (ﷺ) কে বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিলেন।[3]

[1]. সীরাতে ইবনে হিশাম, ইমাম আলবানী রহঃ) এই বর্ণনাটিকে যঈফ বলেছেন। ফিকহুস্ সীরাতঃ (১/১২৫)।

[2] . সূরা জিন-৭২:১

[3]. নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুতইমের এই উপকার কখনও ভুলতে পারেন নি। বদর যুদ্ধের দিন বন্দীদের ব্যাপারে আলোচনা চলার সময় তিনি বললেনঃ মুতইম বিন আদী যদি আজ জীবিত থাকতো এবং এই পঁচা লোকদের (কাফেরদের) ব্যাপারে শাফায়া’ত করতো তাহলে তাদেরকে ছেড়ে দিতাম। (বুখারী)