প্রথম মাসআলা : শরয়ি দৃষ্টিকোণে কাগুজে মুদ্রা এবং তার বিধান

এ মাসআলা সম্পর্কে সৌদি মুফতি বোর্ডের লিখিত ফতোয়া প্রকাশ করা হয়েছে। নিম্নে হুবহু তার অনুবাদ তুলে ধরা হলো-

হামদ ও সালাতের পর, সৌদি মুফতি বোর্ড বরাবর উপস্থাপিত ‘শরয়ি দৃষ্টিকোণে কাগজের টাকা ও তার বিধান’ শীর্ষক গবেষণাকর্মটি বোর্ডের সদস্যবৃন্দ যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে অধ্যয়ন করেছেন। তারা পরস্পর আলোচনা-পর্যালোচনা এবং বিচার-বিশ্লেষণ করে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোয় সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।

প্রথমত. যেহেতু সোনা-রুপাই টাকার মূল এবং আলেমদের বিশুদ্ধ মতানুসারে সোনা-রুপায় তাদের মূল্যমানই সুদের ইল্লত আর ফকিহদের মতানুসারে উৎস এক হওয়া সত্ত্বেও সোনা-রুপাতেই মূল্যমানতা সীমাবদ্ধ নয় তাই। এবং যেহেতু টাকাই বর্তমানে মূল্য হিসেবে প্রচলন পেয়েছে, লেনদেনের বেলায় স্থান দখল করেছে সোনা-রুপার, এমনকি এ দিয়ে লেনদেন চলে, মানুষ এটা অর্জন ও সঞ্চয় করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে অথচ নিছক কাগজ হিসেবে তার কোনো মূল্য নেই; মূল্য তার অতিরিক্ত কারণে সেটা হলো, এর দ্বারা আস্থা অর্জন করা এবং লেনদেনের সময় বিনিময় মাধ্যম স্থির হওয়া আর এটাই মূল্যযোগ্য হওয়ার উদ্দেশ্য- এতসব কারণে মুফতি বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, কাগজের টাকা একধরনের স্বতন্ত্র মুদ্রা যার বিধান সোনা-রুপার বিধানের অনুরূপ। সুতরাং এতে জাকাত ওয়াজিব হবে এবং এর ওপর সোনা-রুপার মতো সুদের উভয় প্রকার তথা ফযল ও নাসিয়া খাটবে। এককথায় কাগজের টাকা শরিয়তের সকল লেনদেনের ক্ষেত্রে সোনা-রুপার অনুরূপ হবে।

দ্বিতীয়ত. সোনা-রুপা ও অন্যান্য মুদ্রার মতো কাগজকেও স্বতন্ত্র মুদ্রা হিসেবে ধরা হবে। তেমনি কাগজের নোটকেও বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হবে। এটা হবে দেশ ও প্রকাশ-প্রচলন স্থানের ভিন্নতা বিচার করে। অর্থাৎ সৌদি টাকা এক শ্রেণী আর মার্কিনি টাকা আরেক শ্রেণী। এভাবে প্রত্যেক দেশের টাকা মুদ্রার একেক স্বতন্ত্র শ্রেণী হিসেবে গণ্য হবে। আর সে অনুযায়ী সোনা-রুপা ও অন্যান্য মূল্যের মতো কাগজের মুদ্রা বা নোটের ওপরও সুদের বিধান খাটানো হবে।

আর এসবই নিম্নোক্ত বিষয়গুলো দাবি করে :

(ক) কেবল নগদ ছাড়া বাকিতে কোনোভাবে কাগজের নোট একটার বদলে একটা কিংবা মুদ্রার অন্য কোনো প্রকার যেমন- সোনা,রুপা ইত্যাদির মোকাবেলায় বিক্রি করা বৈধ নয়। অতএব উদারণত, সৌদি রিয়াল অন্য কোনো দেশের কাগজের টাকার মোকাবেলায় কমবেশি করে হস্তগত না করে বাকিতে বিক্রি করা বৈধ নয়।

(খ) একই (দেশের) ধরনের কাগজের মুদ্রার একটার মোকাবেলায় অন্যটা কমবেশি করে বিক্রি করা বৈধ নয়; চাই তা নগদে হোক বা বাকিতে। সুতরাং কাগজের সৌদি দশ রিয়াল কাগুজের এগারো রিয়ালের বিনিময়ে বিক্রি করা বাকিতে বা নগদে কোনোটাই বৈধ নয়।

(গ) দুই ধরনের দুই কাগজের মুদ্রা একটার বিনিময়ে আরেকটা বিক্রি করা বৈধ। যদি তা হয় হাতে হাতে। সুতরাং পাকিস্তানি রুপি দিয়ে সৌদি রিয়াল ক্রয় করা জায়িয। চাই তা সোনার হোক বা রুপার, কম হোক বা বেশি। তেমনি এক মার্কিন ডলার সৌদি তিন রিয়াল কিংবা তার কম বা বেশি দিয়ে বিক্রি করা এবং সৌদি রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে সৌদি কাগুজে মুদ্রা কমবেশি করে বিক্রি করা জায়িয। যদি তা হয় নগদে। কারণ এটাকে এক জাতীয় মুদ্রার বিনিময়ে আরেক জাতীয় মুদ্রা বিক্রি হিসেবে গণ্য করা হবে। আর বাস্তবতা এবং মূল্য ভিন্ন হলে শুধু নাম এক হওয়ায় কোনো সমস্যা নেই।

তৃতীয়ত. সোনা-রুপার মতো কাগুজে মুদ্রার ওপরও জাকাত ফরজ হবে যখন স্বর্ণ বা রৌপ্য কোনোটার নেসাব পরিমাণ টাকা হবে। অথবা নেসাব পূর্ণ হবে অন্য কোনো মূল্য বা ব্যবসায়িক পণ্যের সঙ্গে মিলিয়ে।

চতুর্থত. কাগজের মুদ্রাকে বাইয়ে সলম এবং অংশীদারি কারবারগুলোতে মূলধন বানানো যাবে।[1]

[1]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৭৯-৩৮০, সৌদি শীর্ষ আলেমদের গবেষণা অভিসন্দর্ভ : ১/৩০-৫৮

প্রশ্ন: আমার কয়েক বস্তা চাল আছে সেটাকে আমরা গুদাম হিসেবে ধরি। আমার কাছে লোক এসে বাজার মূল্যে তা কিনল। তারপর সে আবার অন্য একজনের কাছে বাকিতে বিক্রি করল। চাল যখন ঋণগ্রহীতার হাতে পৌঁছল আমি তার কাছে গিয়ে আমার থেকে কেনা মূল্যের চেয়ে এক রিয়াল কমে কিনলাম। এবার আমার হাতে চাল আসার পর লোক এলো এবং আমার কাছ থেকে কিনল। এভাবে পণ্য একই স্থানে থাকল কিন্তু তা একেরপর এক বিক্রি হতে থাকল। এমন করলে কি গুনাহ হবে? জানিয়ে কৃতার্থ করবেন।

উত্তর: এটি মূলত সুদের ওপর হিলা। এমন রিবা যার মধ্যে নাসিয়া এবং ফযল উভয়ই বিদ্যমান। এটা এভাবে যে ঋণদাতা এর মাধ্যমে উদাহরণ স্বরূপ দশ টাকা দিয়ে বারো টাকা উপার্জন করতে চাচ্ছে।

তৃতীয় মাসআলা : পণ্য সস্থানে রেখে বাকিতে ক্রয়-বিক্রয়

প্রশ্ন: পণ্য সস্থানে রেখে বাকিতে তার কেনা-বেচা অব্যাহত রাখার বিধান কী? বর্তমানকালে এ ধরনের বাকি লেনদেন ব্যাপক প্রচলন পেয়েছে।

উত্তর: মুমিনের জন্য কোনো পণ্য নগদে বা বাকিতে বিক্রি করা ততক্ষণ বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে এর মালিক হয় এবং পণ্য তার হাতে আসে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাকিম বিন হাযাম রা. কে বলেছেন- ‘যা তোমার কাছে নেই তা বিক্রি করতে পার না।’[1] অন্যত্র বলেছেন- ‘যা তোমার হাতে নেই তা তুমি ঋণ হিসেবে কাউকে দিতে পারে না কিংবা বেচতেও পার না কারো কাছে।’[2] ঠিক তেমনি যে জিনিস কেনা হলো তাও সে বিক্রি করতে পারবে না, যতক্ষণ জিনিসটি তার হস্তগত হয়। কেননা ইমাম আহমদ ও আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন যে, যায়েদ বিন সাবেত রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সদ্য কেনা পণ্য নিজ বাহনে ব্যক্তিগত হেফাজতে না নেয়া পর্যন্ত বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন।[3]

তেমনি ইমাম বুখারি তাঁর সহিহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. বলেন, আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর যুগে মানুষকে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করতে দেখেছি। দেখেছি তাদের শাস্তি দেয়া হতো যদি পণ্য নিজ বাহনে (সংরক্ষণে) না নিয়ে বিক্রি করত।[4] এ দু’টি ছাড়াও এ ব্যাপারে আরও অনেক হাদিস রয়েছে।[5]

[1]. আবু দাউদ : ৩৫০৩, তিরমিযি : ১২৩২, নাসায়ি : ২৮৯

[2] আবু দাউদ : ৩৫০৪, তিরমিযি : ১২৩৪, নাসায়ি : ৪৬১১

[3]. আবু দাউদ : ৩৪৯৯

[4]. বৃখারি : ২১৩১

[5]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৮৩-৩৮৪

প্রশ্ন: আমি এক নির্দিষ্ট ব্যক্তি থেকে চল্লিশ হাজার সৌদি রিয়ালের বিনিময়ে দশ হাজার আমেরিকান ডলার কিনেছি। এ চল্লিশ হাজার রিয়াল শোধ করব মাসিক কিস্তিতে। প্রতি কিস্তি এক হাজার রিয়াল। এখন আমি সে ডলারগুলো বাজারে নিয়ে সাইত্রিশ হাজার পাঁচশ রিয়াল দিয়ে বেচতে চাচ্ছি। এটা কি আমার জন্য বৈধ হবে? উল্লেখ্য যে, আমার এ টাকার খুব প্রয়োজন।

উত্তর: আপনার প্রশ্নের উত্তর, না। এমনটি করা হারাম। কেননা নোট বদলের সময় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের বিনিময় হস্তগত না করা পর্যন্ত আলাদা হওয়া হারাম। আর প্রশ্নে বর্ণিত সুরতে দ্বিতীয় বিনিময় তথা ডলারের মূল্য পরিশোধ করা হয়নি। সুতরাং এ সুরত বাতিল ও প্রত্যাহারযোগ্য। এখন যা হবার তা যেহেতু হয়েই গেছে তাই যে ডলার নিয়েছে তার জন্য অত্যাবশ্যক হলো, ডলার ফেরত দেয়া এবং প্রথম চুক্তির ওপর নির্ভর না করা। কারণ তা অবশ্য বাতিলযোগ্য। আর এটা প্রমাণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- প্রত্যেক শর্ত যা আল্লাহর কিতাবে নেই তা অবশ্য প্রত্যাহারযোগ্য যদিও তা একশ বার করা হোক না কেন। আল্লাহর ফয়সালাই সঠিক এবং আল্লাহর শর্তই অধিক মজবুত।[1]

[1]. বুখারি : ৪৫৬ , ফতোয়া : সৌদি শীর্ষ আলেমদের ফতোয়া সংকলন : ২/৩৮৬
পঞ্চম মাসআলা : ব্যবহৃত স্বর্ণ দিয়ে (অব্যবহৃত) নতুন স্বর্ণ ক্রয়

প্রশ্ন: এক লোক অলঙ্কারাদি ক্রয়-বিক্রয় করে। একজন তার কাছে এলো কিছু ব্যবহৃত স্বর্ণ নিয়ে। সে ওই স্বর্ণ তার থেকে কিনে নিল। মূল্য নির্ধারণ করল রিয়াল দিয়ে। তারপর সে সময় ও সে স্থানে মূল্য পরিশোধের আগেই পুরাতন স্বর্ণ বিক্রেতার কাছে নতুন স্বর্ণ বিক্রি করল। এর দামও নির্ধারণ করল রিয়াল দিয়ে। এরপর যতটুকু বাকি থাকল তা পরিশোধ করবে টাকা দিয়ে। জানতে চাই- এটা কি জায়িয নাকি আগে প্রথম ক্রয়-চুক্তির টাকা বিক্রেতার কাছে পুরোটা দিয়ে দিতে হবে তারপর বিক্রেতা যে নতুন স্বর্ণ কিনেছে তার মূল্য ওই টাকা বা অন্য কোনো টাকা থেকে পরিশোধ করতে হবে?

উত্তর: এসব ক্ষেত্রে ওয়াজিব হলো প্রথমে ব্যবহৃত স্বর্ণ হস্তান্তর করা। তারপর বিক্রেতা যখন মূল্য হাতে পাবে তখন তার ইচ্ছা। চাইলে যার কাছে পুরাতন স্বর্ণ বিক্রি করেছে তার কাছ থেকে অথবা চাইলে অন্যের কাছ থেকে নতুন স্বর্ণ কিনবে। এখন সে যদি তার কাছ থেকেই নতুন স্বর্ণ কেনে তাহলে তার জন্য উভয় সুযোগ রয়েছে। চাইলে নতুন স্বর্ণের মূল্য হিসেবে তার টাকাই তাকে ফেরত দিবে অথবা অন্য টাকা দিবে। এমন করার উদ্দেশ্য যাতে মুসলমান সুদী দ্রব্যের ভালোর বদলে কমবেশি করে মন্দটা বিক্রি করার মতো হারাম কাজে লিপ্ত না হয়।

ইমাম বুখারি রহ. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে খায়বরের গভর্নর বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। একবার তিনি তাঁর দরবারে জানিব নামক উৎকৃষ্ট জাতের খেজুর নিয়ে আসেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করেন খায়বরের সব খেজুরই এমন কি-না। তিনি উত্তর দেন, না। আমরা এ খেজুরের এক সা’ কিনি সাধারণ খেজুর দুই সা’ দিয়ে আর এর দুই সা’ নেই সাধারণ খেজুরের তিন সা’ দিয়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এমন করো না; বরং সাধারণ (জানিব) খেজুর কেনো দিরহাম দিয়ে তারপর সে দিরহামের বিনিময়ে জানিব কেনো।[1]

কারণ এ ধরনের ক্রয়-চুক্তিতে লেন-দেন ক্লিয়ার করণ যদিও একই সময়ে একই স্থানে হয় কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত ‘সোনার বদলে কমবেশি করে সোনা বিক্রি’রই রূপ পরিগ্রহ করে। যা সুস্পষ্ট হারাম।

ইমাম মুসলিম রহ. উবাদা বিন সাবেত রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- সোনার বদলে সোনা, রুপার বদলে রুপা, গমের বদলে গম, যবের বদলে যব, খেজুরের বদলে খেজুর এবং লবণের বদলে লবণ বিক্রি করো নগদ নগদ এবং সমান সমান। তবে যখন এসব জিনিসের প্রকার পরিবর্তন করা হবে তো যেভাবে ইচ্ছে বিক্রি করো অবশ্য যখন সেটা হতে হবে নগদ নগদ। আবু সাইদ খুদরির এক রেওয়াতে আছে, যে বেশি দিবে অথবা বেশি নিবে সেটা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। দাতা -গ্রহীতা এক্ষেত্রে সমান অপরাধী।[2]

প্রশ্ন: আমি স্বর্ণ-বিক্রেতার কাছে কিছু পুরাতন স্বর্ণ নিয়ে গেলাম। স্বর্ণ-বিক্রেতা সেসব ওজন করে বললেন, এর দাম হবে ১৫০০ রিয়াল। তার কাছে ১৫০০ রিয়াল মূল্যে স্বর্ণগুলো বিক্রি করে আমি একই ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু নুতন স্বর্ণ কিনলাম- যার দাম ১৮০০ রিয়াল। এখন জানতে চাচ্ছি, আমার জন্য কি জায়িয হবে যে আমি তাকে শুধু ৩০০ রিয়াল দিয়ে দিব? নাকি প্রথমে ১৫০০ রিয়াল হস্তগত করব তারপর একসাথে ১৮০০ রিয়াল তাকে দিব?

উত্তর: নগদ মূল্যে হাতে হাতে সমান দামে ছাড়া স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রি করা জায়িয নেই যদিও ভালো-মন্দ হিসেবে তার প্রকার বদলানো হোক না কেন- এ কথা হাদিসে বারবার বলা হয়েছে দ্ব্যর্থহীনভাবে। বৈধ উপায় হলো- যে স্বর্ণ দিয়ে স্বর্ণ কিনতে ইচ্ছুক সে প্রথমে তার কাছে যে স্বর্ণ আছে তা রুপা বা কাগজের মুদ্রা দিয়ে সে বিক্রি করবে তারপর সে মুদ্রা বা রুপা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত স্বর্ণ কিনবে। তবে যদি সোনা-রুপা বিক্রি করা হয় কাগজের মুদ্রা বৈ অন্য কিছু দিয়ে যেমন- পরিবহন সামগ্রী কিংবা চিনি ইত্যাদির বিনিময়ে তবে চুক্তির উভয় মাধ্যম তথা পণ্য ও মূল্য হস্তগত করার আগেই ক্রেতা-বিক্রেতা মজলিস ত্যাগ করায় কোনো সমস্যা নেই। কারণ স্বর্ণ, রৌপ্য ও কাগজের মুদ্রা এবং এসব এবং এ ধরনের বস্ত্তর মাঝে রিবা বা সুদের বিধান প্রযোজ্য নয়। উল্লেখ্য যে, বিক্রি চুক্তি যখন বাকিতে হবে তখন পরিশোধের তারিখ নির্ধারণ করা জরুরি। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরস্পর ঋণের লেনদেন করবে, তখন তা লিখে রাখবে।’[3]

[1]. বুখারি : ২২০১, মুসলিম : ১৫৯৪

[2]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৮৯ আর হাদিসদ্বয়ের প্রাগুক্ত।

[3]. বাকারা : ২৮২, ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৫২
ষষ্ঠ মাসআলা : বাকিতে স্বর্ণ বা রৌপ্য বিক্রি

প্রশ্ন: এক ব্যক্তি আমার কাছ থেকে একটি সোনার গহনা নিয়েছে। অলঙ্কারটির দাম এক হাজার রিয়াল। আমি তাকে বললাম, এটা নগদ ছাড়া বিক্রি করা বৈধ হবে না। সে বলল, তুমি আমাকে এক হাজার রিয়াল কর্জ দাও। আমি তাকে কর্জ দিলাম আর সে ওই রিয়ালই আমাকে গহনার মূল্য হিসেবে দিল। এমন করা বৈধ হবে কি?

উত্তর: না বৈধ হবে না। কারণ এটিও সুকৌশলে সুদী কারবার। উপরন্তু এতে দুই আকদ একত্রিত হচ্ছে। একটি বাকির আকদ অপরটি বিক্রির আকদ। আর এমনটিও নিষিদ্ধ।[1]

প্রশ্ন: আমার কাছে এক ব্যক্তি স্বর্ণালঙ্কার কিনতে আসল। তার পছন্দকৃত অলঙ্কারটি ওজন করে দেখা গেল তার কাছে যত টাকা আছে তা এর মূল্য হিসেবে যথেষ্ট নয়। এখন জানা কথা যে, তার কাছে স্বর্ণালঙ্কারটি বিক্রি করা এবং সেটা তার হাতে তুলে দেয়া বৈধ হবে না। কিন্তু সে যদি ধরুন প্রভাতে আমার কাছে এসে থাকে এবং বলে, অলঙ্কারটি আপনার কাছেই রাখুন আমি আসরের সময় এসে পুরা টাকা নিয়ে উপস্থিত হয়ে তবেই আপনার কাছ থেকে নিব।

জিজ্ঞাস্য হলো, এমতাবস্থায় আমার জন্য কি বিকালে তার টাকা পাবার এমন নিশ্চয়তার ওপর ভিত্তি করে এ অলঙ্কার তার ব্যাগে দিয়ে দেয়া বৈধ হবে? নাকি আমার কর্তব্য তার এ চুক্তিকে নিরর্থক মনে করা। তারপর সে যদি উপস্থিত হয় তখন সে অন্যান্য ক্রেতার মতো তার সঙ্গে নতুন ক্রয় চুক্তি কার্যকর করা? নয়তো আমাদের মাঝে কোনো চুক্তি নেই বলে মনে করব।

উত্তর: তার কথা মতো এ বিক্রয় চুক্তি কার্যকর করার সুযোগ নেই। যাবৎ না সে সম্পূর্ণ মূল্য নিয়ে উপস্থিত হয়। এভাবেই আপরি রিবায়ে নাসিয়া বা বাকি বিক্রির সুদ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। সুতরাং আপনি স্বর্ণালঙ্কারটি নিজের কাছেই রাখবেন। অতপর সে যখন সম্পূর্ণ মূল্য নিয়ে আপনার কাছে আসবে তখন আপনার উভয়ে নতুন এক ক্রয় চুক্তি করবেন যে চুক্তিতে উভয় মাধ্যম উপস্থিত বৈঠকেই সম্পন্ন হবে।[2]

[1]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৯০

[2]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৫৩
সপ্তম মাসআলা : ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে অংশগ্রহণ

প্রশ্ন: আমি একজন কুয়েতি নাগরিক। আমাদের দেশে বিভিন্ন কৃষি ও বাণিজ্যিক কোম্পানি রয়েছে। রয়েছে ব্যাংক, বীমা ও পেট্রোল কোম্পানি। এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য এসব কোম্পানির পার্টনার হওয়ার অনুমতি রয়েছে। জানতে ইচ্ছুক এসব কোম্পানিতে শেয়ার হোল্ডার হওয়া যাবে কি-না।

উত্তর: সবার জন্য এসব কোম্পানিতে অংশগ্রহণ করা বৈধ যদি সে কোম্পানি সুদী কারবার না করে। যদি সুদী লেনদেন করে তাহলে জায়িয হবে না। কারণ কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার মাধ্যমে সুদের হারাম হওয়া প্রমাণিত। তেমনিভাবে মানুষের জন্য বাণিজ্যিক বীমা কোম্পানিতে অংশগ্রহণ করাও বৈধ নয়। কারণ বীমা চুক্তিগুলো প্রতারণা, অজ্ঞতা এবং সুদে পরিপূর্ণ। আর যেসব চুক্তি প্রতারণা, অজ্ঞতা এবং সুদে ভরা ইসলামের দৃষ্টিতে তার সবই হারাম।[1]

[1]. ইসলামি ফাতাওয়া সংকলন : ২/৩৯০

এ ব্যাপারে ইসলামি ফিকাহ বোর্ডের সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হয়েছে নিম্নে যা হুবহু তুলে দেয়া হলো- ইসলামি ফিকাহ বোর্ড পবিত্র মক্কাস্থ রাবেতা আলমে ইসলামি’র বিল্ডিংয়ে সাত দিনব্যাপী (১২-২৯ রজব ১৪০৬ হিঃ) অনুষ্ঠিত তার নবম বৈঠকে ভেবে দেখেছে যে, সুদী ব্যাংক ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে এসব ব্যাংকে মানুষের লেনদেন। অথচ তাদের কাছে এসব ব্যাংকের বিকল্প নেই বললেই চলে।

বৈঠকে এই ভয়ঙ্কর সমস্যা নিয়ে সম্মানিত সদস্যবৃন্দের সারগর্ভ আলোচনা যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে শোনা হয়। তাদের বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, আধুনিক অর্থনীতির গবেষণা এ কথা সপ্রমাণ করেছে যে, সুদই বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি এবং শান্তি-সমৃদ্ধির পথে সবচে’ বড় হুমকি। বিশ্বের অনেক সমস্যার আড়ালেই রয়েছে এর প্রত্যক্ষ ভূমিকা। চৌদ্দশ বছর আগেই ইসলামে হারাম ঘোষিত এই বিষাক্ত জীবাণু সমাজ থেকে নির্মূল করা ছাড়া বিশ্বশান্তি অধরাই থেকে যাবে চিরদিন। আর সুদ নির্মূলে সবচে’ কার্যকর পদক্ষেপ হলো, সুদ ও শরিয়ত অননুমোদিত লেনদেন মুক্ত ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা। নিম্নে বৈঠকের উলে­খযোগ্য কয়েকটি সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হলো।

প্রথমত. প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত সুদী লেনদেন সর্বোতভাবে পরিহার করা। এবং সুদী কারবারে যে কোনো রকম সহযোগিতা থেকে বিরত থাকা।

দ্বিতীয়ত. সুদী ব্যাংকগুলোর উত্তম বিকল্প হিসেবে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিটি মুসলিম দেশ এবং বিশ্বের সকল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এলাকায় ইসলামি ব্যাংকের প্রসার ঘটাতে হবে। এভাবে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি অর্থনীতির বাস্তব রূপায়নে এসব ব্যাংক এক শক্তিশালী নেটওয়ার্কে পরিণত হবে।

তৃতীয়ত. প্রতিটি মুসলমানের জন্য দেশে-বিদেশে যেখানেই ইসলামি ব্যাংক বিদ্যমান সেখানে সুদী ব্যাংকে লেনদেন করা হারাম। কারণ ইসলামি ব্যাংকের মতো বিকল্পের বর্তমানে তার জন্য সুদী ব্যাংকে কারবার করার কোনো অজুহাত বাকি থাকে না। তার ওপর ওয়াজিব অপবিত্র পথ বর্জন করে পবিত্র পথে আসা এবং হারামের স্থলে হালাল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা।

চতুর্থত. এ বৈঠক মুসলিম রাষ্ট্র প্রধান ও সুদী ব্যাংকসমূহের কর্ণধারদের প্রতি সুদের মতো পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদাত্ত আহবান জানাচ্ছে।

পঞ্চমত. সুদের লাভের পথে আহরিত সকল সম্পদই শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম। কোনো মুসলিমের (আমানতকারী) জন্যই তা নিজের বা পরিবারস্থ লোকদের প্রতি এ টাকা ব্যয় করা বৈধ নয়। বরং উটিৎ হলো, এ টাকা সাধারণ জনকল্যাণ মূলক কাজে যেমন- মাদরাসা, হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণে ব্যয় করা। তবে এ টাকা খরচ করার সময় দান-সদকার নিয়ত করা যাবে না। বরং নাপাকি থেকে পবিত্র হওয়ার নিয়ত করতে হবে।

আবার কোনো অবস্থাতেই সুদী ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত লভ্যাংশ বিদেশি ব্যাংকগুলোর জন্য ফেলে রাখা যাবে না। এতে গুনাহ বা অপরাধ বাড়বে বৈ কমবে না। কারণ বিদেশি ব্যাংকগুলো এ টাকা খৃস্টান মিশনারি বা ইহুদি প্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যয় করে। এবং শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের এসব টাকা মুসলমানদেরই বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং তাদের সন্তানদের ঈমান হরণের পেছনে ব্যয় হয়।

নবম মাসআলা : সুদী ব্যাংকে লেনদেন বা চাকুরি

নিচের প্রশ্নগুলোর ইসলামি জবাব প্রত্যাশা করছি।

  1. যে ব্যক্তি ব্যাংকে টাকা রেখেছে বছরান্তে সে কি এর লভ্যাংশ গ্রহণ করতে পারবে ?
  2. অতিরিক্ত লাভ দিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদের ওপর ঋণগ্রহীতার লভ্যাংশ ভোগ করে না ?
  3. যে ওইসব ব্যাংকে টাকা আমানত রাখে কিন্তু লভ্যাংশ ভোগ করে না ?
  4. ওই সব ব্যাংকে চাকুরীরত কর্মকর্তা চাই সে পরিচালক বা অন্য কেউ ?
  5. ওই ভূ-স্বামী যে এসব ব্যাংকে তার ভূমি লিজ দেয় ?

উত্তর: লাভের ওপর ব্যাংককে লাভের ওপর ঋণ বা আমানত দেয়া কোনোটাই জায়িয নেই। কারণ এ দুটোই সুস্পষ্ট সুদ। ব্যাংক ছাড়া অন্য কোথাও লাভের ওপর অর্থ আমানত রাখা জায়িয নেই। এভাবে লাভের ওপর কাউকে কর্জ দেয়াও জায়িয নেই। কারণ এর সবই উলামায়ে কেরামের সর্ব সম্মতিক্রমে হারাম। ইরশাদ হয়েছে-‘আল্লাহ বেচাকেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।[1]

আরও ইরশাদ হয়েছে- আল্লাহ সুদকে মিটিয়ে দেন এবং সদাকাকে বাড়িয়ে দেন।[2] অন্যত্র ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও, আর যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে। তোমরা যুলম করবে না এবং তোমাদের যুলম করা হবে না।’[3] এসবের পর আল্লাহ তাআলা বলেন, আর যদি সে অসচ্ছল হয়, তাহলে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত তার অবকাশ রয়েছে।[4] এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাকে সতর্ক করে বলছেন, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে ঋণের বিনিময়ে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা বৈধ নয়। বরং কর্তব্য হলো বেচারাকে তার সুবিধামত ঋণ পরিশোধের অবকাশ দেয়া। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার ওপর বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহ যাতে সে জুলুম ও নিপীড়ন থেকে বাচতে পারে।

তবে লভ্যাংশ ভোগ না করে শুধু আমানত রাখায় কোনো অসুবিধা নেই যতক্ষণ সুদী ব্যাংকের বিকল্প না পাওয়া যায়। আর সুদী ব্যাংকে চাকুরি করা চাই পরিচালক হিসেবে হোক আর হিসাব রক্ষক, রেজিস্ট্রার বা অন্য যে পদেই হোক বৈধ নয়। কারণ ইরশাদ হয়েছে- সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না।[5]

[1]. বাকারা : ২৭৫

[2]. বাকারা : ২৭৬

[3]. বাকারা : ২৭৮

[4]. বাকারা : ২৮০

[5]. মায়িদা : ০২

প্রশ্ন: যার কাছে টাকা আছে এবং সে তা কোনো ব্যাংকে জমা রাখে আমানত হিসেবে যাতে সে অর্থ সুরক্ষিত থাকে আবার বছরান্তে তার লাভও পাওয়া যায়। এটা কি বৈধ?

উত্তর: সুদী ব্যাংকে বীমা করা জায়িয নেই যদিও তাতে লভ্যাংশ ভোগ না করে। কারণ এর দ্বারা পাপ এবং অন্যায় কাজে সাহায্য করা হয়। আর আল্লাহ তাআলা অন্যায় কাজে সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ করেছেন। তবে যদি টাকা রাখার মতো অন্য কোনো ব্যাংক না পাওয়া যায় তাহলে অপারগতা বশত এমন ব্যাংকে টাকা রাখলে কোনো সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ। ইরশাদ হয়েছে- অথচ তিনি তোমাদের জন্য বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, যা তোমাদের উপর হারাম করেছেন। তবে যার প্রতি তোমরা বাধ্য হয়েছে।[1] অতএব টাকা রাখার জন্য যখন কোনো ইসলামি কায়দায় পরিচালিত ব্যাংক অথবা নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যাবে- যেখানে অন্যায়ে সহযোগিতা দানের অপরাধ হবে না তখন সুদী ব্যাংকে টাকা রাখা জায়িয হবে না।[2]

[1]. আনআম: ১১৯

[2]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৯৭
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৭ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »