অলীমাহ বা বউভোজ করা ওয়াজেব।[1] যদিও বা একটি মাত্র ছাগল যবেহ করা হয়।[2] এই ভোজ অনুষ্ঠান তিন দিন পর্যন্ত করা চলে।[3]
এই ভোজের অধিক হকদার দ্বীনদার পরহেযগার মুসলিমরা। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন,
لاَ تُصَاحِبْ إِلاَّ مُؤْمِنًا وَلاَ يَأْكُلْ طَعَامَكَ إِلاَّ تَقِىٌّ.
‘‘মুমিন ছাড়া কারো সঙ্গী হয়ো না এবং পরহেযগার ব্যক্তি ছাড়া তোমার খাদ্য যেন অন্য কেউ না খেতে পায়।’’[4]
অলীমার জন্য মাংস হওয়া জরুরী নয়। যে কোন খাদ্য দ্বারা এই মিলনোৎসব পালন করা যায়।[5]
গরীব মানুষদের অলীমা-ভোজে অর্থ বা খাদ্যাদি দিয়ে অংশ গ্রহণ করা ধনী মানুষদের জন্য মুস্তাহাব।[6]
এই ভোজে বেছে বেছে ধনীদেরকে নিমন্ত্রণ করা এবং গরীব মানুষদের (যারা অপরকে খাওয়াতে পারে না তাদের)কে বাদ দেওয়া হলে এর খাদ্য নিকৃষ্টতম খাদ্যে পরিগণিত হয়।[7]
অলীমার জন্য আমন্ত্রিত হলে উপস্থিত হওয়া ওয়াজেব। যে ব্যক্তি বিনা ওজরে এমন ভোজে উপস্থিত হয় না, সে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্য।[8]
এমন কি রোযা রেখে থাকলেও উপস্থিত হয়ে তাদের জন্য দুআ করতে হবে।[9]
রোযা নফল হলে এবং নিমন্ত্রণকারী খেতে জোর করলে রোযা ভেঙ্গেও খেতে পারে।[10]
আর এই ভাঙ্গা রোযা কাযা করতে হবে না। (আদাবুয যিফাফ ১৫৯পৃঃ)
কিন্তু যে অলীমা অনুষ্ঠানে অশ্লীল বা অবৈধ কর্মকীর্তি (গান-বাজনা, ভিডিও, মদ প্রভৃতি) চলে সে অলীমায় উপস্থিত হয়ে যদি উপদেশের মাধ্যমে তা বন্ধ করতে পারে, তবে ঐ ভোজ খাওয়া বৈধ। নচেৎ না খেয়ে ফিরে যাওয়া ওয়াজেব। এ ব্যাপারে বহু হাদীস রয়েছে। তার দু-একটি নিম্নরূপঃ-
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন,
وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلَا يَجلس عَلَى مَائِدَةٍ يُدَارُ عَلَيْهَا الْخَمْرُ.
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে সে যেন কখনই সেই ভোজ-মজলিসে না বসে যাতে মদ্য পরিবেশিত হয়।’’[11]
একদা হযরত আলী (রাঃ) নবী (ﷺ) কে নিমন্ত্রণ করলে তিনি তাঁর গৃহে ছবি দেখে ফিরে গেলেন। আলী < বললেন, ‘কি কারণে ফিরে এলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমার মা-বাপ আপনার জন্য কুরবান হোক।’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘‘গৃহের এক পর্দায় (প্রাণীর) ছবি রয়েছে। আর ফিরিশ্তাবর্গ সে গৃহে প্রবেশ করেন না যে গৃহে ছবি থাকে।’’[12]
ইবনে মাসঊদ <-কে এক ব্যক্তি দাওয়াত দিল। তিনি লোকটিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঘরে মূর্তি (বা টাঙ্গানো ফটো) আছে নাকি?’ লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ আছে।’
অতঃপর সেই মূর্তি (বা ফটো) নষ্ট না করা পর্যন্ত তিনি প্রবেশ করলেন না। দূর করা হলে তবেই প্রবেশ করলেন।[13]
ইমাম আওযাঈ বলেন, ‘যে অলীমায় ঢোল-ত্বলা ও বাদ্যযন্ত্র থাকে সে অলীমায় আমরা হাজির হই না।’[14]
জিজ্ঞাস্য যে, পণ নেওয়া যদি ঘুষ ও হারাম মাল নেওয়া হয়, তাহলে সেই মাল থেকে কৃত অলীমা-ভোজ খাওয়া বৈধ কি? অবশ্য যার মাল হারাম ও হালালে সংমিশ্রিত তার নিমন্ত্রণ খাওয়ার বিষয়টিও বিতর্কিত। হারাম খাদ্য ভক্ষণ থেকে বাঁচতে না পারলে দুআ গ্রহণযোগ্য হবে কোত্থেকে?
যারা বৈধ অলীমা খাবে তাদের জন্য উচিৎ, খাওয়ার পর নিমন্ত্রণ খাওয়ার সাধারণ দুআ পড়া এবং বর্কতের জন্য বিশেষ দুআ করা।[15]
‘যে দু’টি কুসুম ফুটিয়াছে আজি প্রেমের কুসুম বাগে,
নির্মল তাদের করগো প্রভু আপনার অনুরাগে।’
অলীমা বা অন্য দাওয়াত যে খাওয়াবে তার মনে মনে এই নিয়ত হওয়া উচিৎ নয় যে, আজ যাদেরকে আমি খাওয়াচ্ছি, কাল তারা আমাকে অবশ্যই খাওয়াবে। যেমন, যে খায় তাকেও ঋণ বা বোঝা মনে করা উচিৎ নয়। অবশ্য খাওয়ানোর বদলে খাওয়ানো, উপহার বা উপকারের বিনিময়ে উপহার ও উপকার করা কর্তব্য। তবে তা প্রত্যেকের নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী। না পারলে শুকরিয়া জ্ঞাপন ও দুআ করা কর্তব্য। খাওয়ানোর পর শুকরিয়া-দুআ নিয়ে তারপর খোঁচা বা তুলনা মারার অভ্যাস নিশ্চয় মুসলিমের নয়।
বিয়ে পড়িয়ে রেখে (আকদের পর) আসা-যাওয়া মিলনাদি হওয়ার পর বিনা অনুষ্ঠানে বউ ঘরে আনা যদি শ্বশুরের খরচ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে হয়, তাহলে তা এক মহৎ কাজ। কিন্তু এতে নিজেরও খরচ বাঁচানোর উদ্দেশ্য সঠিক নয়। কারণ, অলীমা-ভোজ (অল্প খরচে হলেও) করতেই হবে। তা হল ওয়াজেব।
অবশ্য এখানেও অপচয় বৈধ নয়। কেননা, অপচয়কারী শয়তানের ভাই। তাছাড়া নাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে লোককে দেখিয়ে অর্থ না থাকলে ঋণ করেও বিশাল ধুমধাম করা বৈধ নয়।[16]
পরন্তু প্রতিদন্ধিতা করে গর্বের সাথে যে ভোজ-অনুষ্ঠান করা হয়, সে ভোজ খাওয়া নিষিদ্ধ।[17]
[2] (বুখারী, মুসলিম, প্রভৃতি, আদাবুয যিফাফ ১৪৯ পৃঃ)
[3] (আবু ইয়া’লা প্রভৃতি, আদাবুয যিফাফ ১৪৬ পৃঃ)
[4] (আবু দাঊদ, তিরমিযী, হাকেম , মুসনাদে আহমদ, আদাবুয যিফাফ ১৬৪ পৃঃ)
[5] (আদাবুয যিফাফ ১৫১ পৃঃ)
[6] (বুখারী, মুসলিম ইত্যাদি, আদাবুয যিফাফ ১৫২ পৃঃ)
[7] (মুসলিম, বাইহাকী, প্রভৃতি, আদাবুয যিফাফ ১৫৩পৃঃ)
[8] (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ, বাইহাকী, প্রভৃতি, আদাবুয যিফাফ ১৫৪পৃঃ)
[9] (মুসলিম, নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ, বাইহাকী, প্রভৃতি, আদাবুয যিফাফ ১৫৫পৃঃ)
[10] (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ, প্রভৃতি, আদাবুয যিফাফ ১৫৫পৃঃ)
[11] (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী, হাকেম , আদাবুয যিফাফ ১৬৩-১৬৪ পৃঃ)
[12] (ইবনে মাজাহ প্রভৃতি, আদাবুয যিফাফ ১৬১পৃঃ)
[13] (বাইহাকী, আদাবুয যিফাফ ১৬৫ পৃঃ)
[14] (আদাবুয যিফাফ ১৬৫-১৬৬পৃঃ)
[15] (আদাবুয যিফাফ ১৬৬-১৭৫ পৃঃ)
[16] (তুহফাতুল আরূস,১১৯পৃঃ)
[17] (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ৬২৬ নং)