কিয়ামতের সর্বপ্রথম আলামত হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর আগমণ। কেননা তিনি হলেন সর্বশেষ নবী। তাঁর পর কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবীর আগমণ হবেনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর দুনিয়াতে আগমণের অর্থ হলো, দুনিয়ার বয়স শেষ হয়ে আসছে, কিয়ামত অতি নিকটবর্তী হয়ে গেছে। তিনি বলেনঃ
بُعِثْتُ أَنَا وَالسَّاعَةُ كَهَاتَيْنِ قَالَ وَضَمَّ السَّبَّابَةَ وَالْوُسْطَى
‘‘আমি এবং কিয়ামত এক সাথে প্রেরিত হয়েছি। একথা বলে নবী (ﷺ) হাতের শাহাদাত আঙ্গুল এবং মধ্যমা আঙ্গুলকে একত্রিত করে দেখালেন’’।[1]
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ اقْتَرَبَتْ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ‘‘কিয়ামত নিকটবর্তী হয়ে গেছে এবং চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়েছে’’। (সূরা কামারঃ ১)
হাফেয ইবনে রজব বলেনঃ ‘‘আল্লাহ তাআলা চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়াকে কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার অন্যতম আলামত হিসাবে নির্ধারণ করেছেন।[1]
আলেমদের সর্বসম্মত অভিমত হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর যামানায় চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়ার ঘটনা সংঘটিত হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে একাধিক সহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। আনাস (রাঃ) বলেনঃ মক্কাবাসীরা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কাছে নবুওয়াতের প্রমাণ চাইল তখন তিনি চন্দ্রকে দ্বিখন্ডিত করে দেখালেন’’।[2]
[1] - الحكم الجديرة بالإذاعة: ص ১৯
[2] - মুসলিম, অধ্যায়ঃ সিফাতুল মুনাফিকীন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ কিয়ামতের পূর্বে ছয়টি বস্ত্ত গণনা করো। তার মধ্যে বায়তুল মাকদিস বিজয় অন্যতম।[1]
উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)এর শাসনামলে হিজরী ১৬ সালে বায়তুল মাকদিছ বিজয়ের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ভবিষ্যৎ বাণী বাস্তবায়িত হয়েছে।
কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে মানুষের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। ফকীর-মিসকীন খুঁজে পাওয়া যাবেনা। সাদকা ও যাকাতের টাকা নিয়ে খুঁজা-খুঁজি করেও নেয়ার মত কোন লোক পাওয়া যাবেনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَكْثُرَ فِيكُمُ الْمَالُ فَيَفِيضَ حَتَّى يُهِمَّ رَبَّ الْمَالِ مَنْ يَقْبَلُ صَدَقَتَهُ وَحَتَّى يَعْرِضَهُ فَيَقُولَ الَّذِي يَعْرِضُهُ عَلَيْهِ لَا أَرَبَ لِي
‘‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা যতক্ষণ না মানুষের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। মানুষ যাকাতের মাল নিয়ে সংকটে পড়বে। যাকাতের মাল মানুষের কাছে পেশ করা হলে সে বলবেঃ এতে আমার কোন প্রয়োজন নেই’’।[1]
কিয়ামতের এই আলামতটি একাধিক সময়ে প্রকাশিত হবে। উমার ইবনে আব্দুল আযীযের শাসন আমলে তা প্রকাশিত হয়েছিল।
ইয়াকূব ইবনে সুফিয়ান বলেনঃ ‘‘উমার ইবনে আব্দুল আযীযের শাসন আমলে লোকেরা প্রচুর সম্পদ নিয়ে আমাদের কাছে আগমণ করতো। তারা আমাদেরকে বলতঃ তোমরা যেখানে প্রয়োজন মনে কর সেখানে এগুলো বিতরণ করে দাও। গ্রহণ করার মত লোক না পাওয়া যাওয়ার কারণে তাদের কাছ থেকে কেউ মাল গ্রহণ করতে রাজী হতোনা। পরিশেষে মাল ফেরত নিতে বাধ্য হত। মোট কথা তাঁর শাসন আমলে যাকাত নেয়ার মত লোক ছিলনা’’।[2] কিয়ামতের এই আলামতটি ইমাম মাহদীর আমলে পুনরায় প্রকাশিত হবে।
[2] - ফাতহুল বারী, (১৩/৮৩)
ফিতনা শব্দটি বিপদাপদ, বিশৃংখলা, পরীক্ষা করা ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। অতঃপর শব্দটি প্রত্যেক অপছন্দনীয় বস্তু ও বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ‘‘এই উম্মতের প্রথম যুগের মুমিনদেরকে ফিতনা থেকে হেফাজতে রাখা হয়েছে। আখেরী যামানায় এই উম্মতকে বিভিন্ন ধরণের ফিতনায় ও বিপদে ফেলে পরীক্ষা করা হবে। প্রবৃত্তির অনুসরণ ফির্কাবন্দী এবং দলাদলির কারণে ফিতনার সূচনা হবে। এতে সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে যাবে এবং ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকা কষ্টকর হবে। একে অপরের উপর তলোয়ার উঠাবে। ব্যাপক রক্তপাত ও প্রাণহানি ঘটবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল ফিতনা সম্পর্কে উম্মতকে সাবধান করেছেন এবং তা থেকে বাঁচার উপায়ও বলে দিয়েছেন।
আমর বিন আখতাব (রাঃ) বলেনঃ একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে ফজর নামায পড়লেন। অতঃপর মিম্বারে উঠে যোহর নামায পর্যন্ত ভাষণ দিলেন। যোহর নামায আদায় করে পুনরায় ভাষণ শুরু করে আসর নামায পর্যন্ত ভাষণ দান করলেন। অতঃপর আসর নামায শেষে ভাষণ শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ভাষণ দিলেন। এই দীর্ঘ ভাষণে তিনি কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত যা হবে সবই বলে দিয়েছেন। আমাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে জ্ঞানী তারাই এগুলো মুখস্থ রেখেছেন’’।[1]
ফিতনাগুলো একটি অপরটির চেয়ে ভয়াবহ হবে। এমনকি ফিতনায় পড়ে মানুষ দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إِنَّ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ فِتَنًا كَأَنَّهَا قِطَعُ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ فِيهَا مُؤْمِنًا وَيُمْسِي كَافِرًا وَيَبِيعُ فِيهَا أَقْوَامٌ خَلَاقَهُمْ بِعَرَضٍ مِنَ الدُّنْيَا
‘‘নিশ্চয়ই কিয়ামতের পূর্বে অন্ধকার রাত্রির মত ঘন কালো অনেক ফিতনার আবির্ভাব হবে। সকালে একজন লোক মুমিন অবস্থায় ঘুম থেকে জাগ্রত হবে। বিকালে সে কাফেরে পরিণত হবে। বহু সংখ্যক লোক ফিতনায় পড়ে দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে তাদের চরিত্র ও আদর্শ বিক্রি করে দিবে।[2] অপর বর্ণনায় এসেছে, তোমাদের একজন দুনিয়ার সামান্য সম্পদের বিনিময়ে তার দ্বীন বিক্রি করে দিবে’’।[3]
ফিতনার কতিপয় দৃষ্টান্ত
ক) উছমান (রাঃ)এর হত্যাকান্ডঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সমস্ত ফিতনার সংবাদ দিয়েছেন তার মধ্যে উছমান (রাঃ)এর হত্যাকান্ড একটি অন্যতম ভয়াবহ ফিতনা। এখান থেকেই মুসলিম উম্মার ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি হয়। একদল অপর দলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। প্রচুর রক্তপাত ঘটানো হয় এবং উভয় পক্ষের অনেক লোক নিহত হয়। হুজায়ফা (রাঃ)এর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তিনি একদা উমার বিন খাত্তাব (রাঃ)এর কাছে বসা ছিলেন। উমার (রাঃ) বললেনঃ ‘‘তোমাদের মধ্যে কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত ফিতনার হাদীছ মুখস্থ রেখেছে? হুজায়ফা (রাঃ) বললেনঃ মানুষ ধন-সম্পদ, স্ত্রী-পরিবার ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে ফিতনায় পড়ে যে গুনাহর কাজে লিপ্ত হবে নামায, সাদকাহ, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ এবং অন্যান্য সৎকাজ তা মিটিয়ে দিবে। উমার (রাঃ) বললেনঃ আমি আপনাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করছিনা। আপনাকে সেই ফিতনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছি, যা সাগরের ঢেউয়ের মত আসতে থাকবে। হুজায়ফা (রাঃ) বললেনঃ হে আমীরুল মুমিনীন! এ ফিতনায় আপনি পতিত হবেন না। কারণ আপনার মাঝে এবং ফিতনার মাঝে একটি বন্ধ দরজা রয়েছে। উমার (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ সেই দরজাটি খুলে দেয়া হবে? না কি বল প্রয়োগ করে ভেঙ্গে ফেলা হবে? হুজায়ফা (রাঃ) বললেন; বরং তা ভেঙ্গে ফেলা হবে। উমার (রাঃ) বললেনঃ তাই যদি হয়, তাহলে কোন দিন তা বন্ধ করা সম্ভব হবেনা। হুজায়ফা (রাঃ) বলেনঃ আমি বললামঃ হ্যাঁ, তাই।
সাহাবীগণ বলেনঃ আমরা হুজায়ফাকে জিজ্ঞেস করলামঃ উমার (রাঃ) কি জানতেন সেই বন্ধ দরজা কোনটি? তিনি বললেনঃ দিনের পর রাত্রির আগমণ যেমন নিশ্চিত, তেমনি নিশ্চিতভাবেই তিনি তা জানতেন। হাদীছের শেষাংশে এসেছে সেই বন্ধ দরজাটি ছিলেন উমার (রাঃ) স্বয়ং নিজেই।[4]
উপরের হাদীছের সারমর্ম এই যে, উমার (রাঃ)এর শাহাদতের পরই ফিতনা শুরু হবে। কিয়ামতের পূর্বে তা আর কখনো বন্ধ হবেনা। ফিতনার কবলে পড়ে উছমান (রাঃ) নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। এই হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করেই আলী (রাঃ) এবং মুআবীয়ার মাঝে অনেক সংঘর্ষ হয়েছে এবং অসংখ্য প্রাণহানি ঘটেছে।
খ) উষ্ট্রের যুদ্ধঃ
উছমান বিন আফফান (রাঃ) শহীদ হওয়ার পর উষ্ট্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। উছমান (রাঃ)এর হত্যাকে কেন্দ্র করে ভুল বুঝাবুঝিই এই যুদ্ধের মূল কারণ। এই যুদ্ধের এক পক্ষে ছিলেন আলী (রাঃ) এবং অপর পক্ষে ছিলেন আয়েশা, তালহা এবং যুবায়ের (রাঃ)। যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া এই বইয়ের উদ্দেশ্য নয়। এখানে যে কথাটি আমি বলতে চাই তা হলো কোন পক্ষেরই যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য ছিলনা।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বলেনঃ আয়েশা (রাঃ) যুদ্ধের জন্য বের হন নি। তিনি উভয় পক্ষের মধ্যে মীমাংসার জন্য বের হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর বের হওয়ার মধ্যেই মুসলিম উম্মতের জন্য কল্যাণ রয়েছে। অতঃপর তিনি বুঝতে সক্ষম হলেন যে, বের না হওয়াটাই তাঁর জন্য ভাল ছিল। তাই তিনি যখনই বের হওয়ার কথা স্মরণ করতেন তখন কেঁদে ওড়না ভিজিয়ে ফেলতেন। এমনিভাবে যারাই আলী (রাঃ) এবং মুআবিয়ার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের সবাই পরবর্তীতে অনুতপ্ত হয়েছেন। আয়েশা (রাঃ)এর বের হওয়া সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভবিষ্যৎ বাণী করে গিয়েছিলেন। বিস্তারিত বিবরণ এই যে, আয়েশা (রাঃ) বনী আমেরের বাড়ি-ঘরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন তখন তাঁকে দেখে কতগুলো কুকুর ঘেউ ঘেউ করা শুরু করল। তিনি বললেনঃ এই জলাশয়টির (পুকুরটির) নাম কি? লোকেরা বললোঃ এটির নাম ‘হাও-আব’। একথা শুনে আয়েশা (রাঃ) বললেনঃ আমার ফেরত যেতে ইচ্ছে করছে। যুবায়ের (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ অগ্রসর হোন! যাতে মানুষেরা আপনাকে দেখতে পায় এবং হতে পারে আল্লাহ তাআলা আপনার মাধ্যমে তাদের মাঝে মীমাংসা করে দিবেন। তিনি পুনরায় বললেনঃ মনে হচ্ছে আমার ফেরত যাওয়া উচিৎ। কেননা আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি আমাদেরকে (নবী পত্নীদেরকে) লক্ষ্য করে বলেছেনঃ ‘‘কেমন হবে তখনকার অবস্থা যখন তোমাদের কাউকে দেখে হাও-আবের কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করবে?’’।[5]
হাদীছের সরল ব্যাখ্যা এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা (রাঃ)কে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ ‘‘হে আয়েশা! সেদিন তোমার অবস্থা কেমন হবে? যেদিন তোমাকে দেখে ‘হাও-আব’ নামক জলাশয়ের নিকটস্থ কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করতে থাকবে। আয়েশা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণীটি মুখস্থ রেখেছিলেন। তিনি যখন ইরাকের বসরা শহরের নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছলেন তখন কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ভবিষ্যৎ বাণীটি স্মরণ করে জিজ্ঞেস করলেন এটি কোন জলাশয়? লোকেরা বললঃ এটি হাও-আবের জলাশয়। এই কথা শুনে তিনি নিশ্চিতভাবে বুঝতে সক্ষম হলেন যে তিনি ফিতনায় পড়ে গেছেন এবং বার বার ফেরত আসার চেষ্টা করেছিলেন। অবশেষে তিনি নিরাপদে মদ্বীনায় ফেরত আসলেন। তিনি নিজেও যুদ্ধ করেন নি এবং কাউকে যুদ্ধের আদেশও দেন নি।
গ) সিফ্ফীনের ফিতনাঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَقْتَتِلَ فِئَتَانِ عَظِيمَتَانِ يَكُونُ بَيْنَهُمَا مَقْتَلَةٌ عَظِيمَةٌ دَعْوَتُهُمَا وَاحِدَةٌ
‘‘আমার উম্মতের দু’টি বিশাল দল পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা। তাদের মাঝে ভয়াবহ যুদ্ধ হবে। কিন্তু উভয়ের দাবী হবে একটাই’’।[6]
এখানে দুইটি দল বলতে আলী (রাঃ) ও মুআবিয়া (রাঃ) এর দলকে বুঝানো হয়েছে। হিজরী ৩৬ সালে ইরাকের ফুরাত নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত সিফ্ফীন নামক স্থানে এই দল দু’টি পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এতে উভয় পক্ষের প্রায় ৭০ হাজার লোক নিহত হয়’’।[7]
আলী ও মুআবিয়া (রাঃ)এর মাঝে যে সমস্ত যুদ্ধ হয়েছে তার কোন একটিও তাদের ইচ্ছায় হয়নি; বরং উভয় দলের মধ্যে কিছু পথভ্রষ্ট, কুপ্রবৃত্তির অনুসারী এবং কুচক্রী লোক ছিল। তারা সর্বদাই মানুষকে যুদ্ধের প্রতি উস্কানি দিতে থাকে। এতে করে বিষয়টি উভয়ের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বলেনঃ ‘‘আলী ও মুআবিয়া (রাঃ)এর দলের মধ্যে থেকে যারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল তাদের অধিকাংশই আলী বা মুয়াবীয়া (রাঃ)এর কারো আনুগত্য করতোনা। আলী বা মুআবিয়া কখনই মুসলমানদের রক্তপাত কামনা করেন নি। কিন্তু যা কাম্য ছিলনা অনিচছা সত্ত্বেও তা হয়েই গেল। কথায় আছে ফিতনা যখন শুরু হয়ে যায় জ্ঞানীরাও তার আগুন নিভাতে অক্ষম হয়ে যায়’’।[8]
ফিতনার সময় মুমিনের করণীয়ঃ
উছমান (রাঃ)এর হত্যা থেকেই উম্মাতে মুহাম্মাদীর ভিতরে ফিতনার সূচনা হয়েছে। কিয়ামতের পূর্বে তা আর বন্ধ হবেনা। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিতনার সময় মুমিনদের করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়ে গেছেন। ফিতনার সময় যেহেতু যুদ্ধরত ও বিবাদমান দলগুলোর কোন্টির দাবী সত্য তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে যায়। তাই তিনি এহেন জটিল পরিস্থিতে কোন দলের পক্ষে যোগদিয়ে যুদ্ধে নামতে নিষেধ করেছেন। সে সময় যার ছাগলের পাল থাকবে তাকে ছাগলের পাল নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় চলে যেতে বলেছেন কিংবা ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্তে প্রহরায় নিযুক্ত থাকতে বলেছেন। মুসলমানদের যুদ্ধরত দলগুলো সেখানে পৌঁছে গেলে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যেও যুদ্ধে শরীক হতে নিষেধ করেছেন। কারণ এটাই হবে তার ঈমানের জন্যে নিরাপদ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إِنَّهَا سَتَكُونُ فِتَنٌ أَلَا ثُمَّ تَكُونُ فِتْنَةٌ الْقَاعِدُ فِيهَا خَيْرٌ مِنَ الْمَاشِي فِيهَا وَالْمَاشِي فِيهَا خَيْرٌ مِنَ السَّاعِي إِلَيْهَا أَلَا فَإِذَا نَزَلَتْ أَوْ وَقَعَتْ فَمَنْ كَانَ لَهُ إِبِلٌ فَلْيَلْحَقْ بِإِبِلِهِ وَمَنْ كَانَتْ لَهُ غَنَمٌ فَلْيَلْحَقْ بِغَنَمِهِ وَمَنْ كَانَتْ لَهُ أَرْضٌ فَلْيَلْحَقْ بِأَرْضِهِ قَالَ فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ مَنْ لَمْ يَكُنْ لَهُ إِبِلٌ وَلَا غَنَمٌ وَلَا أَرْضٌ قَالَ يَعْمِدُ إِلَى سَيْفِهِ فَيَدُقُّ عَلَى حَدِّهِ بِحَجَرٍ ثُمَّ لِيَنْجُ إِنِ اسْتَطَاعَ النَّجَاءَ اللَّهُمَّ هَلْ بَلَّغْتُ اللَّهُمَّ هَلْ بَلَّغْتُ اللَّهُمَّ هَلْ بَلَّغْتُ قَالَ فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ أُكْرِهْتُ حَتَّى يُنْطَلَقَ بِي إِلَى أَحَدِ الصَّفَّيْنِ أَوْ إِحْدَى الْفِئَتَيْنِ فَضَرَبَنِي رَجُلٌ بِسَيْفِهِ أَوْ يَجِيءُ سَهْمٌ فَيَقْتُلُنِي قَالَ يَبُوءُ بِإِثْمِهِ وَإِثْمِكَ وَيَكُونُ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
‘‘অচিরেই বিভিন্ন রকম ফিতনার আবির্ভাব ঘটবে। ফিতনার সময় বসে থাকা ব্যক্তি ফিতনার দিকে পায়ে হেঁটে অগ্রসরমান ব্যক্তির চেয়ে এবং পায়ে হেঁটে চলমান ব্যক্তি আরোহী ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক নিরাপদ ও উত্তম হবে। ফিতনা শুরু হয়ে গেলে যার উট থাকবে সে যেন উটের রাখালি নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং যার ছাগল থাকবে, সে যেন ছাগলের রাখালি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর যার চাষাবাদের যমীন আছে, সে যেন চাষাবাদের কাজে ব্যস্ত থাকে। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলোঃ হে আল্লাহর নবী! যার কোন কিছুই নেই সে কি করবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ পাথর দিয়ে তার তলোয়ারকে ভোঁতা করে নিরস্ত্র হয়ে যাবে এবং ফিতনা থেকে বাঁচতে চেষ্টা করবে।
অতঃপর তিনি বলেনঃ হে আল্লাহ! আমি কি আমার দায়িত্ব পৌঁছে দিয়েছি? হে আল্লাহ! আমি কি আমার দায়িত্ব পৌঁছে দিয়েছি? হে আল্লাহ! আমি কি আমার দায়িত্ব পৌঁছে দিয়েছি? অতঃপর অন্য এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলোঃ হে আল্লাহর রাসূল! কেউ যদি আমাকে জোর করে কোন দলে নিয়ে যায় এবং সেখানে গিয়ে কারো তলোয়ার বা তীরের আঘাতে আমি নিহত হই, তাহলে আমার অবস্থা কী হবে? উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ ‘‘সে তার পাপ এবং তোমার পাপের বোঝা নিয়ে জাহান্নামের অধিবাসী হবে’’।[9] ফিতনার সময় একজন মুমিনের করণীয় হলোঃ
১) যাবতীয় গুনাহ থেকে তাওবা করাঃ
মানব জাতির জন্য আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালা এই যে গুনাহ ও পাপাচার ব্যতীত বিপদ আসেনা এবং বিপদ এসে গেলে তাওবা ব্যতীত তা দূর হয়না। তাই ফিতনা ও বিপদাপদের সময় যাবতীয় গুনাহ ও পাপের কাজ থেকে আল্লাহর কাছে তাওবা করা আবশ্যক।
২) আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকাঃ
মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে এবং বিশ্বাস করবে যে পৃথিবীতে যা কিছু হচ্ছে ও হবে তা সবই মহান আল্লাহর ইচ্ছাতেই। আললাহ এমন কোন জিনিষ সৃষ্টি করেন নি যাতে শুধুমাত্র অকল্যাণ বিদ্যমান; বরং কখনও মুমিনের জন্য আল্লাহ তাআলা এমন কিছু বিষয় নির্ধারণ করেন, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে অকল্যাণকর মনে হয়, অথচ তাতে রয়েছে অপরিমিত কল্যাণ। মহান আল্লাহ মুমিন জননী আয়েশা (রাঃ)এর প্রতি আরোপিত মিথ্যা অপবাদের ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেনঃ
لَا تَحْسَبُوهُ شَرًّا لَكُمْ بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَكُمْ
‘‘তোমরা এ ঘটনাকে অকল্যাণকর বলে মনে করোনা; বরং এটি তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক।’’ (সূরা নূরঃ ১০) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا
‘‘হয়তো তোমরা কখনে এমন কোন বিষয়কে অপছন্দ করবে যাতে আল্লাহ অপরিমিত কল্যাণ নিহিত রেখেছেন’’। (সূরা নিসাঃ ১৯)
৩) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ভবিষ্যৎ বাণীর বাস্তবায়নঃ
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, এই উম্মাতের উপর দিয়ে বিভিন্ন বিপদাপদ ও ফিতনার ঝড় বয়ে যাবে এবং তিনি এই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথও বলে দিয়েছেন। তিনি বলেনঃ
تَرَكْتُ فِيكُمْ اَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا: كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ رَسُوْلِهِ
‘‘আমি তোমাদের জন্যে এমন দু’টি বস্ত্ত রেখে যাচ্ছি যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবেনা। তা হলো আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত’’।[10] তিনি আরও বলেনঃ
فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَ سُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا عَضُّوْا عَلَيْهَا بِالَّنَواجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْاُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٍ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٍ
‘‘তোমরা আমার সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদ্বীনের সুন্নাতের অনুসরণ করবে। তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে এবং উহার উপর অটল থাকবে। আর তোমরা নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করা হতে বিরত থাকবে। কেননা প্রতিটি নব আবিষ্কৃত বিষয়ই বিদআত এবং প্রতিটি বিদআতের পরিণামই ভ্রষ্টতা’’।[11] আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাতের অনুসরণের আদেশ দিয়ে বলেনঃ
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُوْلِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য কর। আরো আনুগত্য করো তোমাদের নেতাদের। তোমাদের মাঝে যখন কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিবে তখন তোমরা তার সমাধানের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের দিকে ফিরে আসবে যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। ইহাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর ও পরিণামের দিক দিয়ে উত্তম।’’ (সূরা নিসাঃ ৫৯)
৪) ফিতনা থেকে দূরে থাকাঃ
মুমিন ব্যক্তি ফিতনা থেকে দূরে থাকবে এবং এ ব্যাপারে কথা বলা থেকেও বিরত থাকবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিতনার নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ‘‘অচিরেই বিভিন্ন রকম ফিতনার আবির্ভাব ঘটবে। ফিতনার সময় বসে থাকা ব্যক্তি দাঁড়ানো বক্তির চেয়ে এবং দাঁড়ানো ব্যক্তি পায়ে হেঁটে চলমান ব্যক্তির চেয়ে এবং পায়ে হেঁটে চলমান ব্যক্তি আরোহী ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি ফিতনার দিকে এগিয়ে যাবে সে ফিতনায় জড়িত হয়ে পড়বে এবং ধ্বংস হবে। আর যে ব্যক্তি ফিতনা থেকে বাঁচার কোন আশ্রয় পাবে সে যেন তথায় আশ্রয় গ্রহণ করে’’।[12]
৫) ফিতনার সময় বিভ্রান্তিকর প্রচারণা থেকে সাবধান থাকাঃ
মিথ্যা সংবাদ প্রচারকারীরাই অনেক সময় নানা সমস্যা, ফিতনা ও বিপর্যয়ের কারণ হয়ে থাকে। তারা এমন সংবাদ প্রচার করে যা বাস্তবের সাথে কোন সম্পর্ক রাখেনা। বিশেষ করে যখন অধিকাংশ প্রচার মাধ্যম ইসলামের শত্রুদের হাতে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সকল সংবাদ যাচাই করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কাছে যদি ফাসিক ব্যক্তি কোন খবর নিয়ে আসে তোমরা তা যাচাই করে দেখ।’’ (সূরা হুজুরাতঃ ৬) আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِنَ الْأَمْنِ أَوْ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى أُوْلِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُونَهُ مِنْهُمْ
‘‘তাদের কাছে যখন নিরাপদ বা ভীতি সংক্রান্ত কোন সংবাদ আসে তখন তারা তা প্রচার করে বেড়ায় তারা যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং জ্ঞানীদের কাছে আসতো তাহলে তাদের আলেমগণ অবশ্যই প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে পারতেন’’। (সূরা নিসাঃ ৮৩)
৬) ফিতনার সময় ঐক্যবদ্ধ থাকাঃ
ফিতনার সময় মুসলমানদের জামাআত ও তাদের ইমামকে অাঁকড়িয়ে ধরতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুযায়ফাকে এই উপদেশই দিয়েছেন। হুযায়ফা (রাঃ) ফিতনার সময় করণীয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ ‘‘তুমি মুসলমানদের জামাআত ও তাদের ইমামের অনুসরণ করবে। হুযায়ফা বলেনঃ আমি বললামঃ তখন যদি মুসলমানদের কোন জামাআ’ত ও ইমাম না থাকে? তিনি বললেনঃ তাহলে তুমি ফিতনা সৃষ্টিকারী সকল ফির্কা পরিত্যাগ করবে। মৃত্যু পর্যন্ত তুমি এ অবস্থায় থাকবে ’’।[13]
৭) ফিতনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করাঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযের মধ্যে আল্লাহর কাছে ফিতনা থেকে আশ্রয় চেয়েছেন। তিনি এভাবে বলতেনঃ
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَفِتْنَةِ الْمَمَاتِ
‘‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আযাব থেকে আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে মিথ্যুক দাজ্জালের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে জীবন ও মরণের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাই’’।[14]
৮) ফিতনার সময় ধীরস্থীরতা অবলম্বন করাঃ
তাড়াহুড়া করা যদি আনন্দের সময় দোষণীয় হয়ে থাকে তাহলে বিপদের সময় কেমন হবে? হাদীছে এসেছে যে আখেরাতের কাজ ব্যতীত প্রতিটি কাজেই ধীরস্থীরতা অবলম্বন করা ভাল। অর্থাৎ আখেরাতের কাজে প্রতিযোগিতার সাথে অগ্রসর হতে হবে। আর ফিতনার সময় সব সময় পিছিয়ে থাকতে হবে।
৯) ফিতনার সময় ইবাদতে লিপ্ত থাকাঃ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘ফিতনার সময় আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকা আমার নিকট হিজরত করে আসার মত’’।[15]
১০) মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব রাখাঃ
ফিতনার সময় মুমিনদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং কাফেরদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করা, তাদেরকে ঘৃণা করা এবং তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা। শির্কের অবসান না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ আমাদেরকে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ
‘‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যদ্ধ কর ফিতনার (শির্ক) অবসান না হওয়া পর্যন্ত এবং দ্বীন পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত’’। (সূরা আনফালঃ ৩৯)
১১) ফিতনার সময় বেশী বেশী দু’আ করাঃ
বিপদাপদ ও ফিতনা থেকে বেঁচে থাকার জন্যে দু’আ একটি উত্তম মাধ্যম। দু’আর ফজীলত এই যে, আকাশ থেকে মুসীবত আসার সময় দু‘আর সাথে সাক্ষাৎ হয়। দু’আ ও মুসীবত আকাশে পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। আকাশ থেকে মুসীবত নাযিল হতে চায়। আর দু’আ তাকে বাঁধা দেয়। মুসীবতের সময় এই দু’আ পড়তে হবেঃ
اللَّهُمَّ أَجِرْنِىْ فِىْ مُصِيْبَتِى وَاخْلُفْلِى خَيْرًا مِنْهَا
‘‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে এই বিপদে বিনিময় প্রদান করুন এবং এর পরিবর্তে উত্তম বস্ত্ত দান করুন’’। যে কেউ এই দু’আ পাঠ করবে আল্লাহ তাকে বিনিময় প্রদান করবেন এবং মুসীবতের স্থলে উত্তম বস্ত্ত দান করবেন। দু’আ করার অন্যতম আদব হলো দু’আ কবূল হওয়ার সময় ও মাধ্যম অনুসন্ধান করা এবং দু’আ কবূল না হওয়ার কারণসমূহ থেকে বিরত থাকা। যেমন হারাম খাওয়া, দ্বীনের কাজে গাফেল থাকা ইত্যাদি।
১২) ফিতনার সময় ধৈর্য্য ধারণ করাঃ
মু’মিন ব্যক্তির সকল কাজই ভাল। কল্যাণ অর্জিত হওয়ার সময় যদি শুকরিয়া আদায় করে তবে তার জন্য ইহাই ভাল। আর বিপদাপদের সময় যদি ধৈর্য্য ধারণ করে তাও তার জন্য ভাল। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ
‘‘নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের প্রতিদান পরিপূর্ণরূপে প্রদান করা হবে।’’ (সূরা যুমারঃ ১০) হাদীছে এসেছে মুমিন ব্যক্তি সব সময় মুসিবতের মধ্যে থাকে। পরিণামে সে আল্লাহর সাথে নিস্পাপ অবস্থায় সাক্ষাৎ করে।
১৩) ফিতনার সময় দ্বীনের জ্ঞানার্জনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করাঃ
দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জনই ফিতনা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন’’।[16] দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে শত্রুদের চক্রান্ত, পরিকল্পনা, ও তাদের অবস্থা সম্পর্কেও সম্যক ধারণা রাখতে হবে, যাতে তাদের অনিষ্টতা থেকে বাঁচার জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা যায়।
১৪) স্বস্তি ও আশার বাণী প্রচার করাঃ
মুমিনদের দু’টি কল্যাণের একটি অবশ্যই অর্জিত হবে। একটি শাহাদাত ও অপরটি বিজয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
قُلْ هَلْ تَتَربَّصُونَ بِنَا إِلَّا إِحْدَى الْحُسْنَيَيْنِ وَنَحْنُ نَتَرَبَّصُ بِكُمْ أَنْ يُصِيبَكُمْ اللَّهُ بِعَذَابٍ مِنْ عِنْدِهِ أَوْ بِأَيْدِينَا فَتَرَبَّصُوا إِنَّا مَعَكُمْ مُتَرَبِّصُونَ
‘‘হে নবী! আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন! তোমরা কি আমাদের ব্যাপারে দু’টি কল্যাণের একটির অপেক্ষায় আছো? আমরাও তোমাদের ব্যাপারে অপেক্ষায় আছি যে, হয়ত আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের পক্ষ থেকে অথবা আমাদের হাতে শাস্তি প্রদান করবেন। সুতরাং তোমরা অপেক্ষায় থাক আমরাও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করতে থাকবো’’। (সূরা তাওবাঃ ৫২) মু’মিনদের পরিণাম হবে জান্নাত। আর কাফেরদের পরিণাম হবে জাহান্নাম। এ জন্যেই তারা তাদের কৃতকর্মের কারণে মৃত্যুকে ভয় করে এবং তা থেকে পলায়ন করতে চায়।
১৫) আল্লাহর চিরন্তন রীতির বাস্তবায়নঃ
মুমিন ব্যক্তি এ বিশ্বাস পোষণ করবে যে, বিশ্ব সৃষ্টি ও পরিচালনায় মহান আল্লাহর কতিপয় নীতিমালা রয়েছে যা কখনও পরিবর্তন হবেনা। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
فَهَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا سُنَّةَ الْأَوَّلِينَ فَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَحْوِيلًا
‘‘তারা কেবল পূর্ববর্তীদের দশারই অপেক্ষা করছে। অতএব আপনি আল্লাহর বিধানে কোন পরিবর্তন পাবেন না এবং আল্লাহর রীতি-নীতিতে কোন রকম বিচ্যুতিও পাবেন না’’। (সূরাা ফাতিরঃ ৪৩) আল্লাহ তাআলার এ সকল রীতি-নীতির মধ্যে থেকে অন্যতম নীতি হলো
(১) সত্য ও মিথ্যার মাঝে কিয়ামত পর্যন্ত লড়াই চলতে থাকবে। আমাদের পিতা আদম (আঃ) জান্নাত থেকে বের হয়ে আসার পর থেকে এলড়াই শুরু হয়েছে। আদম ও তার মুমিন সন্তানগণ পুনরায় জান্নাতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত থাকবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَلَوْ يَشَاءُ اللَّهُ لَانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَكِنْ لِيَبْلُوَ بَعْضَكُمْ بِبَعْضٍ
‘‘ইহা এই জন্য যে, আল্লাহ তাআলা যদি চাইতেন তাহলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতেন। কিন্তু আল্লাহ তা না করে একজনকে অন্যজনের মাধ্যমে পরীক্ষায় ফেলে থাকেন’’। (সূরা মুহাম্মাদঃ ৪)
(২) আমাদের পূর্বে অনেক নবী-রাসূল ও নেককার লোকদেরকে ফিতনায় ফেলে পরীক্ষা করা হয়েছে। ইয়াহয়া ও যাকারিয়া (আঃ)কে হত্যা করা হয়েছে। মূসা, ঈসা ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয়া হয়েছে। বেলাল (রাঃ)কে শাস্তি দেয়া হয়েছে। হামযা (রাঃ)কে হত্যা করা হয়েছে এবং তার কলিজা বের করে চিবিয়ে খাওয়া হয়েছে। অথচ তিনি ছিলেন শহীদদের নেতা। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ (২) وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ
‘‘মানুষেরা কি ধারণা করে যে, তাদেরকে এ কথা বলাতেই ছেড়ে দেয়া হবে যে, আমরা ঈমান এনেছি এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবেনা? আমি তাদের পূর্ববর্তীদেরকে পরীক্ষা করেছি, যাতে আল্লাহ সত্যবাদীদেরকে জানতে পারেন এবং ইহাও জানতে পারেন যে, কারা মিথ্যাবাদী।’’ (সূরা আনকাবূতঃ ২-৩) মুমিনকে তার ঈমান অনুযায়ী পরীক্ষা করা হয়। অর্থাৎ যার ঈমান যত মজবুত, তার পরীক্ষাও তত বড় ও কঠিন হয়ে থাকে। মানুষের মাঝে নবীদের পরীক্ষা সবচেয়ে কঠিন হয়ে থাকে। অতঃপর পর্যায়ক্রমে অন্যদের পরীক্ষা নেওয়া হয়।
(৩) আল্লাহর রীতি-নীতির মধ্যে হতে অন্যতম নীতি হলোঃ
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِم
‘‘আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে’’। (সূরা রা’দঃ ১১) মানুষের আভ্যন্তরীণ অবস্থা পরিবর্তনের সাথে সাথে আল্লাহ তাদের বাহ্যিক অবস্থা পরিবর্তন করে দেন। মানুষ যখন আভ্যন্তরীণ অবস্থা ভাল করে নেয় তখন আল্লাহ তাদের বাহিরের অবস্থাও ভাল করে দেন।
পরিশেষে আল্লাহর কাছে সকল প্রকার ফিতনা থেকে আশ্রয় চাই। আমীন।
[2] - মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
[3] - তিরমিজী, ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেনঃ সহীহুল জামে আস্ সাগীর হাদীছ নং- ৫১২৫।
[4] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
[5] - মুস্তাদরাকুল হাকীম। ইমাম ইবনে হাজার (রঃ) বলেনঃ হাদীছের সনদটি বুখারীর শর্ত অনুযায়ী, ফাতহুল বারী, (১২/৫৫)
[6] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
[7] - মু’জামুল বুলদান, (৩/ ৪১৪)
[8] - মিনহাজুস্ সুন্নাহ, (২/২২৪)
[9] - মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান।
[10] - মুআত্তা ইমাম মালেক। ইমাম আলবানী বলেনঃ হাদীছটি হাসান, মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীছ নং- ১৮৬।
[11] - আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ কিতাবুস্ সুন্নাহ। ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেন, সিলসিলায়ে সাহীহা, হাদীছ নং- ১৭৬১।
[12] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
[13] - মুসলিম, অধ্যায়ঃ মুসলমানদের জামা’আতকে আঁকড়িয়ে ধরা ওয়াজিব।
[14] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল আযান।
[15] - মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
[16] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ইল্ম।
আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী ও রাসূল। কিয়ামতের পূর্বে আর কোন নবীর আগমণ ঘটবেনা। এটি ইসলামী আকীদার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। কিন্তু কিয়ামতের পূর্বে অনেক মিথ্যুক মিথ্যা নবুওয়াতের দাবী করে মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করার চেষ্টা করবে। তাই এ সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মাতকে যথাসময়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُبْعَثَ دَجَّالُونَ كَذَّابُونَ قَرِيبٌ مِنْ ثَلَاثِينَ كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ رَسُولُ اللَّهِ
‘‘ত্রিশজন মিথ্যুক আগমণের পূর্বে কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা। তারা সকলেই দাবী করবে যে, সে আল্লাহর রাসূল’’।[1] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَلْحَقَ قَبَائِلُ مِنْ أُمَّتِي بِالْمُشْرِكِينَ وَحَتَّى يَعْبُدُوا الْأَوْثَانَ وَإِنَّهُ سَيَكُونُ فِي أُمَّتِي ثَلَاثُونَ كَذَّابُونَ كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ نَبِيٌّ وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
‘‘আমার উম্মতের একদল লোক মুশরিকদের সাথে মিলিত হওয়ার পূর্বে এবং মূর্তি পূজায় লিপ্ত হওয়ার পূর্বে কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা। আর আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন মিথ্যুকের আগমণ ঘটবে। তারা সকলেই নবুওয়াতের দাবী করবে। অথচ আমি সর্বশেষ নবী। আমার পর কিয়ামতের পূর্বে আর কোন নবী আসবেনা’’।[2]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ভবিষ্যৎবাণী সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর শেষ বয়সের দিকে মুসায়লামা কায্যাব নবুওয়াতের দাবী করেছিল। তার অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ইয়ামামার যুদ্ধে আবু বকর (রাঃ)এর খেলাফতকালে সাহাবীগণ এই ফিতনার অবসান ঘটান। এমনিভাবে যুগে যুগে আরো অনেকেই নবুওয়াতের দাবী করেছে। তাদের মধ্যে আসওয়াদ আনাসী, সাজা নামক জনৈক মহিলা, মুখতার আছ-ছাকাফী, হারিছ আল-কায্যাব অন্যতম।
নিকটবর্তী অতিতে ভারতে মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী নবুওয়াতের দাবী করেছিল। তার অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ভারত বর্ষের অনেক আলেম তার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন এবং মুসলমানদেরকে পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সমস্ত ভন্ড এবং মিথ্যুক নবী থেকে উম্মাতকে সতর্ক করেছেন সে তাদেরই একজন। আল্লামা ছানাউল্লাহ অম্রিতসরী অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তার প্রতিবাদ করেন। এতে মিথ্যুক কাদিয়ানী শায়খ ছানাউল্লাহর সাথে চ্যালেঞ্জ করলে উভয় পক্ষের মাঝে ১৩২৬ হিজরী সালে এক মুনাযারা (বিতর্ক) অনুষ্ঠিত হয়। তাতে এই মর্মে মুবাহালা হয় যে, দু’জনের মধ্যে যে মিথ্যুক সে যেন অল্প সময়ের মধ্যে এবং সত্যবাদীর জীবদ্দশাতেই কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে হালাক হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা শায়খ ছানাউল্লাহর দু’আ কবূল করলেন। এই ঘটনার এক বছর এক মাস দশদিন পর মিথ্যুক কাদীয়ানী ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।[3]
এমনিভাবে কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত একের পর এক মিথ্যুকের আগমণ ঘটে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক ঘোষিত ত্রিশ সংখ্যা পূর্ণ হবে।
[2] - আবু দাউদ, তিরমিযী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান। ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেন, মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীছ নং- ৫৪০৬।
[3] - ইহসান ইলাহী যহীর, আল কাদীয়ানীয়া, পৃষ্ঠা নং- ১৫৫-১৫৯।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, কিয়ামতের পূর্বে হেজাযের (আরব উপদ্বীপের) যমিন থেকে বড় একটি আগুন বের হবে। এই আগুনের আলোতে সিরিয়ার বুসরা নামক স্থানের উটের গলা পর্যন্ত আলোকিত হয়ে যাবে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَخْرُجَ نَارٌ مِنْ أَرْضِ الْحِجَازِ تُضِيءُ أَعْنَاقَ الْإِبِلِ بِبُصْرَى
‘‘হেজাযের ভূমি থেকে একটি অগ্নি প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত কায়েম হবেনা। উক্ত অগ্নির আলোতে বুসরায় অবস্থানরত উটের গলা পর্যন্ত আলোকিত হবে’’।[1]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ভবিষ্যৎবাণী সত্যে পরিণত হয়েছে। ইমাম নববী (রঃ) বলেনঃ ৬৫৪ হিজরীতে আমাদের যামানায় উল্লেখিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এটি ছিল বিরাট একটি আগুন। পবিত্র মদ্বীনার পূর্ব দিক থেকে তা প্রকাশিত হয়েছিল। একমাস পর্যন্ত আগুনটি স্থায়ী ছিল।
আমানত শব্দটি খেয়ানত শব্দের বিপরীত। আমানতের হেফাযত করা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমানতের খেয়ানত করা মুনাফেকের লক্ষণ। আখেরী যামানায় আমানতের খেয়ানত ব্যাপাকভাবে দেখা দিবে। অযোগ্য লোককে কোন কাজের দায়িত্ব দেয়াও আমানতের খেয়ানতের অন্তর্ভূক্ত। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন এক মজলিসে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় একজন গ্রাম্য লোক এসে নবীজীকে এই বলে প্রশ্ন করলো যে, কিয়ামত কখন হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কথা চালিয়ে যেতে থাকলেন। কিছু লোক মন্তব্য করলোঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকটির এই প্রশ্নকে অপছন্দ করেছেন। আবার কিছু লোক বললোঃ তিনি তাঁর কথা শুনতেই পান নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলোচনা শেষে বললেনঃ প্রশ্নকারী লোকটি কোথায়? সে বললোঃ এই তো আমি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ
إِذَا ضُيِّعَتِ الْأَمَانَةُ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ قَالَ كَيْفَ إِضَاعَتُهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ إِذَا أُسْنِدَ الْأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ
‘‘যখন আমানতের খেয়ানত হবে তখন কিয়ামত নিকটবর্তী হয়ে গেছে বলে মনে করবে। লোকটি আবার প্রশ্ন করলোঃ কিভাবে আমানতের খেয়ানত করা হবে? নবীজী বললেনঃ যখন অযোগ্য লোকদেরকে দায়িত্ব দেয়া হবে তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করতে থাকো’’।[1]
আখেরী যামানায় যখন আমানতদারের সংখ্যা কমে যাবে তখন বলা হবে অমুক গোত্রে একজন আমানতদার লোক আছে। লোকেরা একথা শুনে তার প্রশংসা করবে এবং বলবেঃ সে কতই না বুদ্ধিমান! সে কতই না মজবুত ঈমানের অধিকারী! অথচ তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও নেই।[2]
[2] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দ্বীনী ইলমের শিক্ষা ও চর্চা কমে যাবে এবং মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে দ্বীনী বিষয়ে মূর্খতা বিরাজ করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يُرْفَعَ الْعِلْمُ وَيَثْبُتَ الْجَهْلُ
‘‘কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে এবং মানুষের মাঝে অজ্ঞতা বিস্তার লাভ করবে’’।[1] এখানে ইল্ম বলতে ইলমে দ্বীন তথা কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান উদ্দেশ্য। তিনি আরো বলেনঃ
إِنَّ اللَّهَ لَا يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالًا فَسُئِلُوا فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا
‘‘আল্লাহ তাআলা মানুষের অন্তর থেকে ইল্মকে টেনে বের করে নিবেন না; বরং আলেমদের মৃত্যুর মাধ্যমে ইল্ম উঠিয়ে নিবেন। এমনকি যখন কোন আলেম অবশিষ্ট থাকবেনা তখন লোকেরা মূর্খদেরকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করবে। তাদেরকে কোন মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে বিনা ইলমেই ফতোয়া দিবে। ফলে তারা নিজেরা গোমরাহ হবে এবং মানুষদেরকেও গোমরাহ করবে’’।[2]
ইমাম যাহাবী (রঃ) বলেনঃ বর্তমানে দ্বীনী ইল্ম কমে গেছে। অল্প সংখ্যক মানুষের মাঝেই ইলম চর্চা সীমিত হয়ে গেছে। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে ইলমের আরো কমতি হবে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণী সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হবে।
ইমাম যাহাবীর যামানায় যদি এই অবস্থা হয়ে থাকে তাহলে বর্তমানকালের অবস্থা কেমন হতে পারে তা আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। বর্তমানে ইলমে দ্বীনের চর্চা কমে গেছে। কুরআন-সুন্নার আলেমের সংখ্যা খুবই নগণ্য। যার ফলে শির্ক-বিদআতে অধিকাংশ মুসলিম সমাজ পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। মোটকথা কিয়ামতের এই আলামতটি অনেক আগেই প্রকাশিত হয়েছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণী সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
[2] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ইলম।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘আখেরী যামানায় এই উম্মতের মধ্যে একদল লোক আসবে, যাদের হাতে গরুর লেজের মত লাঠি থাকবে। তারা আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিয়ে সকাল বেলা ঘর থেকে বের হবে এবং আল্লাহর ক্রোধ নিয়েই বিকাল বেলা ঘরে ফিরবে’’।[1]
বর্তমানে আমরা যদি ইসলামী অঞ্চলগুলোর দিকে দৃষ্টি দেই তবে দেখতে পাবো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণীটি বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখতে পাওয়া যায় যে, সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অন্যায়ভাবে জনগণের উপর যুলুম-নির্যাতন করে থাকে। প্রায়ই সংবাদপত্র ও প্রচার মাধ্যমে জনগণের উপর পুলিশের বেধড়ক লাঠি চার্জের সংবাদ পাওয়া যায়।