নামায পড়তে পড়তে এমন কিছু কাজ আছে যা করা বৈধ, অথচ সাধারণত: তা অবৈধ মনে হয় বা বড় ভুল ভাবা হয়। এ রকম কিছু কাজ নিম্নরুপ :-
১। কাঁদা;
নামায পড়তে পড়তে চোখ দিয়ে অশ্র ঝরা অথবা ডুকরে বা গুমরে কেঁদে ওঠা দূষণীয় নয়। আল্লাহর ভয়ে এমন কান্না কাঁদা তাঁর নেক ও বিনম্র বান্দার বৈশিষ্ট্য। মহান আল্লাহ বলেন, “--- তাদের নিকট করুণাময় (আল্লাহর) আয়াত পাঠ করা হলে তারা লুটিয়ে পড়ে সিজদা ও ক্রন্দন করত।” (কুরআন মাজীদ ১৯/৫৮)
আব্দুল্লাহ বিন শিখখীর বলেন, ‘একদা আমি নবী (ﷺ) এর নিকটে এলাম। তখন তিনি নামায পড়ছিলেন। আর তাঁর ভিতর থেকে চুলোর উপর হাঁড়িতে পানি ফোটার মত কান্নার শব্দ বের হ্চ্ছিল।’
অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘যাঁতার শব্দের মত কান্নার শব্দ বের হ্চ্ছিল।’ (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১০০০ নং)
আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর অসুখ যখন খুব বেড়ে গিয়েছিল, তখন তাঁকে নামাযের সময় হয়েছে বললে তিনি বললেন, “তোমরা আবূ বাকারকে নামায পড়াতে বল।” আয়েশা رضي الله عنها বললেন, ‘আবূ বাকার তো নরম-দেলের মানুষ। উনি যখন কুরআন পড়েন, তখন কান্না রুখতে পারেন না।’ মহানবী (ﷺ) বললেন, “তোমরা ওকে বল, ওই নামায পড়াবে।” আয়েশা رضي الله عنها পুনরায় ঐ একই কথা বললে মহানবী (ﷺ) ও পুন: বললেন, “ওকে বল, ওই নামায পড়াবে ---।” (বুখারী, মিশকাত ১১৪০ নং)
এ কান্না দীর্ঘ হলেও তাতে নামায নষ্ট হয় না। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬১)
২। হাঁচি ও তার জন্য দুআ;
নামাযের মধ্যে হাঁচি এলে হাঁচির পর নির্দিষ্ট দুআ পাঠ বৈধ। আর সেই দুআর বড় ফযীলতও রয়েছে। কওমার ৫নং দুআ দেখুন।
৩। হাই তোলা;
নামাযে যদিও হাই তোলা বৈধ, তবুও যেহেতু হাই আলস্য জনিত বা নিদ্রা জনিত কারণে মুখ ব্যাদানোর নাম, তাই তা যথাসম্ভব দমন করা কর্তব্য। কারণ, নামাযে নামাযী আলস্য প্রদর্শন করলে শয়তান খোশ হয়।
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কারো যখন নামাযে হাই আসে, তখন তার উচিৎ, তা যথাসাধ্য দমন করা এবং ‘হা-হা’ না বলা। কেন না, হাই শয়তানের তরফ থেকে আসে। আর সে তা দেখে হাসে।” (বুখারী, মিশকাত ৯৮৬ নং)
“তোমাদের কেউ হাই তুললে সে যেন তার মুখে হাত রেখে নেয়। কারণ, শয়তান হাই-এর সাথে (মুখে) প্রবেশ করে যায়!” (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, জামে ৪২৬ নং)
৪। থুথু ফেলা;
মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ নামাযে দাঁড়ালে সে যেন তার সম্মুখ দিকে থুথু না ফেলে। কারণ, সে যতক্ষণ নামাযের জায়গায় থাকে ততক্ষণ আল্লাহর সাথে মুনাজাত (নিরালায় আলাপ) করে। আর তার ডান দিকেও যেন থুথু না ফেলে। কারণ, তার ডানে থাকে (বামদিকের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সম্মানিত নেকী-লেখক) ফিরিশ্তা। বরং সে যেন (মসজিদের মেঝে কাঁচা মাটির হলে অথবা মাঠে-ময়দানে নামায পড়লে) তার বাম দিকে অথবা (সেদিকে কেউ থাকলে) তার (বাম) পায়ের নিচে ফেলে। যা পরে সে দাফন করে দেবে।” (বুখারী, মুসলিম, ৭১০, ৭১১নং)
একদা তিনি মসজিদের কিবলার দিকে দেওয়ালে কফ লেগে থাকতে দেখে মর্মাহত হলেন এবং তা তাঁর চেহারাতেও ফুটে উঠল। তিনি উঠলেন এবং নিজ হাত দ্বারা তা পরিষ্কার করলেন। অতঃপর বললেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন সে তার প্রতিপালকের সাথে নিরালায় আলাপ করে। তার প্রতিপালক থাকেন তার ও তার কিবলার মাঝে। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন তার সামনের দিকে অবশ্যই থুথু না ফেলে। বরং সে যেন তার বাম দিকে অথবা পায়ের নিচে থুথু ফেলে।” অতঃপর তিনি তাঁর চাদরের এক প্রান্ত ধরে তার উপর থুথু ফেললেন এবং পাশাপাশি কাপড় ধরে কচলে দিলেন, আর বললেন, “অথবা সে যেন এইরুপ করে।” (বুখারী, মিশকাত ৭৪৬নং)
নাক ঝাড়লেও অনুরুপ করা উচিৎ। অবশ্য পৃথক রুমাল বা টিসু-পেপার ব্যবহার উত্তম।
৫। অনিষ্টকর জীব-জন্তু মারা:-
নামায পড়তে পড়তে সাপ, বিছা, বোলতা প্রভৃতি বিষধর ও অনিষ্টকর জন্তু মারা বৈধ। আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “নামাযে দুই কালো জন্তু; সাপ ও বিছা মেরে ফেলো।” (আহমাদ, মুসনাদ ২/২৩৩, আবূদাঊদ, সুনান ৯২১, তিরমিযী, সুনান ৩৯০, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান ১২৪৫, ত্বায়ালিসী ২৫৩৮, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ১৭৫৪, দারেমী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৮৯৬, ইবনে হিব্বান, সহীহ ২৩৫১,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৫৬, বায়হাকী ২/২৬৬, প্রমুখ)
অনুরুপ উকুন বা উকুন-জাতীয় পোকাও নামাযে মারা বৈধ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৫০)
৬। চুলকানো:-
দেহে অস্বস্তিকর চুলকানি শুরু হলে নামায পড়া অবস্থাতেও চুলকানো বৈধ। কারণ, চুলকানিতে নামাযীর একাগ্রতা নষ্ট হয়। আর চুলকে দিলে অস্বস্তিবোধ দূর হয়ে যায়। সুতরাং এখানে ধৈর্য ধরা উত্তম নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৫০-৩৫১)
৭। প্রয়োজনবোধে চলা:-
শত্রুর ভয় হলে (জিহাদের ময়দানে) চলা অবস্থায় নামায বৈধ। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা নামায সমূহের প্রতি -বিশেষ করে মধ্যবর্তী (আসরের) নামাযের প্রতি- যত্নবান হও এবং আল্লাহর সম্মুখে বিনীতভাবে দাঁড়াও। কিন্তু যদি (শত্রুর) ভয় কর, তাহলে চলা অথবা সওয়ার অবস্থায় (নামায পড়)।” (কুরআন মাজীদ ২/২৩৮-২৩৯)
একদা মহানবী (ﷺ) স্বগৃহে দরজার খিল বন্ধ করে নফল নামায পড়ছিলেন। মা আয়েশা رضي الله عنها এসে দরজা খুলতে বললে তিনি চলে গিয়ে তাঁর জন্য দরজা খুলে দিলেন। অতঃপর পুনরায় নিজের মুসাল্লায় ফিরে গেলেন। অবশ্য দরজা ছিল কিবলার দিকেই। (আহমাদ, মুসনাদ ৬/২৩৪, আবূদাঊদ, সুনান ৯২২, তিরমিযী, সুনান ৬০১, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, আবূ য়্যা’লা ৪৪০৬, দারাক্বুত্বনী, সুনান, বায়হাকী ২/২৬৫, মিশকাত ১০০৫ নং)
একদা তিনি সূর্যগ্রহণের নামাযে বেহেশ্ত দেখে অগ্রসর এবং দোযখ দেখে পশ্চাদপদ হয়েছিলেন। (বুখারী ১০৫২, মুসলিম, সহীহ ৫২৫ নং)
সাহাবাগণকে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে তিনি মিম্বরে চড়ে নামায পড়েছেন। মিম্বরের উপর রুকূ করে পিছ-পায়ে নেমে নিচে সিজদাহ করেছেন। (বুখারী ৯১৭, মুসলিম, সহীহ ৫৪৪ নং) একদা আবূ বাকার (ﷺ) এর ইমামতি কালে মহানবী (ﷺ) এসে উপস্থিত হলে তিনি (আবূ বাকার) পিছ-পায়ে সরে এসেছিলেন। (বুখারী ৬৮০, ১২০৫ নং) আবূ বারযাহ্ আসলামী (রাঃ) ফরয নামায পড়তে পড়তে তাঁর ঘোড়া পালাতে শুরু করলে তিনি তার পিছনে পিছনে গিয়েছিলেন। (বুখারী ১২১১ নং, আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী)
৮। ছেলে তোলা:-
নবী মুবাশ্শির (ﷺ) ইমামতি করতেন, আর আবুল আসের শিশু কন্যা তাঁর কাঁধে থাকত। অতঃপর যখন তিনি রুকূ করতেন, তখন তাকে নিচে নামিয়ে দিতেন। পুনরায় যখন সিজদাহ থেকে উঠতেন, তখন আবার কাঁধে তুলে নিতেন। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ মিশকাত ৯৮৪ নং) এ ব্যাপারে ‘দীর্ঘ সিজদাহ’ শিরোনামে শাদ্দাদ (রাঃ) এর হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে।
৯। শিশুদের ঝগড়া থামানো:-
একদা বানী মুত্তালিবের দু’টি ছোট মেয়ে মারামারি করতে করতে মহানবী (ﷺ) এর সামনে এসে তাঁর হাঁটু ধরে ফেলল। তিনি নামায পড়ছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি উভয়কে দু’দিকে সরিয়ে দিলেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭১৬, ৭১৭, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ৭২৭ নং)
১০। খোঁচা দিয়ে সরে যেতে ইঙ্গিত করা:-
মা আয়েশা رضي الله عنها মহানবী (ﷺ) এর নামায পড়া কালে তাঁর সামনে কিবলার দিকে পা মেলে শুয়ে থাকতেন। তিনি (অন্ধকারে) যখন সিজদাহ করতেন, তখনহাতের খোঁচা দিয়ে তাঁকে (স্ত্রীকে) পা সরিয়ে নিতে ইঙ্গিত করতেন। (বুখারী ৩৮২, ১২০৯ নং)
১১। ইশারায় সালামের জওয়াব দেওয়া:-
নামাযী নামাযে রত থাকলেও তাকে সালাম দেওয়া বিধেয় এবং নামাযীর নামায পড়া অবস্থাতেই সালামের জওয়াব দেওয়া কর্তব্য। তবে মুখে নয়, হাত বা আঙ্গুলের ইশারায়। (মুসলিম, সহীহ ৫৩৮, আদা, মিশকাত ৯৮৯ নং)
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, আমি বিলাল (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, নবী (ﷺ) এর নামাযে রত থাকা অবস্থায় ওঁরা (সাহাবীগণ) যখন সালাম দিতেন, তখন তিনি কিভাবে উত্তর দিতেন? বিলাল (রাঃ) বললেন, ‘হাত দ্বারা ইশারা করে।’ (তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, শাফেয়ী, মিশকাত ৯৯১নং)
একদা তিনি উটের উপর নামায পড়ছিলেন। জাবের (রাঃ) তাঁকে সালাম দিলে তিনি হাতের ইশারায় উত্তর দিয়েছিলেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৪০নং, আহমাদ, মুসনাদ)
একদা সুহাইব (রাঃ) তাঁকে নামায পড়া অবস্থায় সালাম দিলে তিনি আঙ্গুলের ইশারায় জওয়াব দিয়েছিলেন। (তিরমিযী, সুনান ৩৬৭নং, আহমাদ, মুসনাদ)
একদা আবূ হুরাইরা (রাঃ) তাঁকে নামায পড়া অবস্থায় সালাম দিলে তিনি ইশারায় উত্তর দিয়েছিলেন। (ত্বাবারানী, মু’জাম, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/৯৯৮)
একদা ইবনে উমার (রাঃ) এক ব্যক্তির নিকট গেলেন, তখন সে নামায পড়ছিল। তিনি তাকে সালাম দিলে সে মুখে উত্তর দিল। পরে ইবনে উমার (রাঃ) তাকে বললেন, ‘নামায পড়া অবস্থায় তোমাদের মধ্যে কাউকে সালাম দেওয়া হলে সে যেন মুখে উত্তর না দেয়। বরং সে যেন হাত দ্বারা ইশারা করে উত্তর দেয়।’ (মালেক, মুঅত্তা, মিশকাত ১০১৩ নং)
সালামের জওয়াব ছাড়া নামাযে প্রয়োজনে অন্য জরুরী কথাও ইঙ্গিত ও ইশারার মাধ্যমে বুঝানো যায়। একদা মহানবী (ﷺ) নামায পড়ছিলেন। তিনি সিজদাহ করলে হাসান (রাঃ) ও হুসাইন (রাঃ) তাঁর পিঠে চড়ে বসলে সাহাবীগণ বারণ করলেন। কিন্তু তিনি ইশারা করে বললেন, “ওদেরকে নিজের অবস্থায় ছেড়ে দাও।” অতঃপর নামায শেষ করলে তিনি উভয়কে কোলে রেখে বললেন, “যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, সে যেন এই দু’জনকেও ভালোবাসে।” (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭৭৮ নং, বায়হাকী ২/২৬৩)
১২। নামাযে কাউকে কোন জরুরী ব্যাপারে সতর্কীকরণ
নামাযী নামাযে রত আছে এ কথা জানাতে অথবা ইমাম নামাযে কিছু ভুল করলে তার উপর তাঁকে সতর্ক করতে পুরুষদের জন্য ‘সুবহা-নাল্লাহ্’ বলা এবং মহিলাদের জন্য হাততালি দেওয়া বিধেয়।
প্রিয় রসূল (ﷺ) বলেন, “তোমাদের নামাযের মধ্যে (অস্বাভাবিক) কিছু ঘটে গেলে পুরুষেরা যেন ‘তাসবীহ’ পড়ে এবং মহিলারা যেন হাততালি দেয়।” (বুখারী ৬৮৪, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৯৮৮ নং)
নারী এমন এক সৃষ্টি, যার রুপ, সৌরভ ও শব্দে পুরুষের মন প্রকৃতিগতভাবে চকিত হয়ে ওঠে। ফলে, যাতে নামাযের সময় তাদের মোহ্নীয় কণ্ঠস্বরে পুরুষরা সংকটে না পড়ে তার জন্য শরীয়তের এই বিধান। পক্ষান্তরে শয়তান মানুষের শিরায় শিরায় ফিরে বেড়ায়। (বুখারী ৩২৮১, মুসলিম, সহীহ ২১৭৫ নং) এবং পুরুষদের জন্য নারী হল সবচেয়ে বড় ফিতনার জিনিস। (বুখারী ৫০৯৬, মুসলিম, সহীহ ২৭৪০ নং)
এখান থেকে বুঝা যায় যে, মহিলাদের পৃথক জামাআত হলে এবং সেখানে কোন বেগানা পুরুষ না থাকলে হাততালি না দিয়ে তাসবীহ পড়ে মহিলারা (মহিলা) ইমামকে সতর্ক করতে পারে। কারণ, তাসবীহ হল নামাযের এক অংশ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৬২-৩৬৩)
মুক্তাদীদের মধ্যেও কেউ কিছু ভুল করলে, (যেমন সিজদায় বা বৈঠকে ঘুমিয়ে পড়লে) তাকেও সতর্ক করার জন্য তাসবীহ ব্যবহার চলবে। (ঐ ৩/৩৬৭-৩৬৮)
১৩। ইমামের ক্বিরাআত সংশোধন:-
নামাযে কুরআন পাঠ করতে করতে যদি ইমাম সাহেব কোন আয়াত ভুলে যান, থেমে যান অথবা ভুল পড়েন, তাহলে ‘লুকমাহ্’ দিয়ে তা মনে পড়ানো, ধরিয়ে দেওয়া বা সংশোধন করা বিধেয়।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমি তোমাদেরই মত একজন মানুষ। আমিও ভুলে যাই, যেমন তোমরা ভুলে যাও। সুতরাং আমি ভুলে গেলে তোমরা আমাকে মনে পড়িয়ে দিও।” (বুখারী ৪০১, মুসলিম, সহীহ ৫৭২নং)
একদা তিনি নামাযে কুরআন পড়তে পড়তে ভুলে কিছু অংশ ছেড়ে দিলেন। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! অমুক অমুক আয়াত আপনি ছেড়ে দিয়েছেন, (পড়েন নি)। তিনি বললেন, “তুমি আমাকে মনে পড়িয়ে দিলে না কেন?” (আবূদাঊদ, সুনান ৯০৭ নং, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
একদা নামাযে ক্বিরাআত পড়তে পড়তে তাঁর কিছু গোলমাল হল। সালাম ফেরার পর উবাই (রাঃ) এর উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, “তুমি আমাদের সাথে নামায পড়লে?” উবাই (রাঃ) বললেন, ‘জী হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “তবে ভুল ধরিয়ে দিলে না কেন?” (আবূদাঊদ, সুনান ৯০৭, ইহি, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, বায়হাকী ৩/২১২)
উল্লেখ্য যে, সূরা ফাতিহা নামাযের একটি রুক্ন অথবা ফরয। সুতরাং তা পড়তে ইমাম কোন প্রকারের ভুল করলে (যাতে অর্থ বদলে যায় তা) মুক্তাদীদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া ওয়াজেব। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৪৬)
১৪। প্রয়োজনে কাপড় বা পাগড়ীর উপর সিজদাহ করা:-
অতি গ্রীষ্ম বা শীতের সময় সিজদার স্থানে কপাল রাখা কষ্টকর হলে চাদর, আস্তীন বা পাগড়ীর বাড়তি অংশ ঐ স্থানে রেখে সিজদাহ করা বৈধ।
মহানবী (ﷺ) এর যামানায় সাহাবাগণ এরুপ করতেন। (বুখারী ৩৮৫, ৫৪২ নং, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, দারেমী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৩/১০০)
জাবের (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর সাথে যোহরের নামায পড়তাম। আমার হাতের মুঠেfয় কিছু কাঁকর রেখে ঠান্ডা করে নিতাম এবং প্রখর তাপ থেকে বাঁচার জন্য তা কপালের স্থানে (সিজদার জায়গায়) রেখে নিতাম। (আবূদাঊদ, সুনান ৩৯৯, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১০১১ নং)
১৫। জুতা পরে নামায-
জুতা পাক-সাফ হলেও অনেকে বুযুর্গদের সাথে সাক্ষাতের সময় তা পায়ে রাখে না। যা শ্রদ্ধার অতিরঞ্জন এবং বিদআত। বলাই বাহুল্য, এমন লোকদের নিকট জুতা পায়ে নামায পড়া তাদের কল্পনার বাইরে।
কিন্তু হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) জুতা পায়ে নামায পড়তেন। (বুখারী ৩৮৬, মুসলিম, সহীহ)
আব্দুল্লাহ বিন আম্র বলেন, আমি নবী (ﷺ) কে খালি পায়ে ও জুতা পায়ে উভয় অবস্থাতেই নামায পড়তে দেখেছি। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫৩ নং, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
রসূল (ﷺ) বলেন, “যখন তোমাদের মধ্যে কেউ নামায পড়বে, তখন সে যেন তার জুতা পরে নেয় অথবা খুলে তার দু’ পায়ের মাঝে রাখে। আর সে যেন তার জুতা দ্বারা অপরকে কষ্ট না দেয়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫৫ নং, বাযযার,হাকেম, মুস্তাদরাক)
তিনি আরো বলেন, “তোমরা ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধাচরণ কর (এবং জুতা পরে নামায পড়)। কারণ, ওরা ওদের জুতো ও চামড়ার মোজায় নামায পড়ে না। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫২ নং, বাযযার,হাকেম, মুস্তাদরাক)
জুতা খুলে নামায পড়লে এবং মসজিদে জুতা রাখার কোন নির্দিষ্ট জায়গা না থাকলে যদি বাম পাশে কেউনা থাকে তাহলে বাম পাশে, নচেৎ দুই পায়ের মাঝে রাখতে হবে। ডান দিকে রাখা যাবে না। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫৪, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক)
অবশ্য জুতায় ময়লা বা নাপাকী লেগে থাকলে তা পরে নামায হয় না। নাপাকী বা ময়লা মাটিতে বা ঘাসে রগড়ে মুছে দূর করে নিয়ে তাতে নামায পড়া যায়। নামাযের মাঝে জুতায় ময়লা লেগে আছে দেখলে বা জানতে পারলে তা সাথে সাথে খুলে ফেলা জরুরী। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৫০, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২৮৪ নং)
খেয়াল রাখার বিষয় যে, মসজিদ পাকা ও গালিচা-বিছানো হলে তার ভিতরে জুতা পরে গিয়ে নোংরা করা বৈধ নয়। মসজিদের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার খেয়াল অবশ্যই জরুরী।
১৬। মনে অন্য চিন্তা এসে পড়া:-
অনিচ্ছা সত্ত্বেও নামাযে অন্য চিন্তা এসে পড়লে নামায বাতিল হয়ে যায় না। অবশ্য অন্য চিন্তা এনে দেওয়ার কাজ শয়তানই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে করে থাকে। আর এ কথা আমরা ‘নামায কিভাবে কায়েম হবে’ শিরোনামে পড়েছি এবং শয়তান ও তার কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়ও সেখানে জেনেছি।
হযরত উমার (রাঃ) স্বীকার করেন যে, তিনি কোন কোন নামাযে সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত ও প্রেরণ করার কথা চিন্তা করতেন। (বুখারী বিনা সনদে ২৩৯পৃ:)
একদা আসরের নামাযে মহানবী (ﷺ) এর মনে পড়ল যে, তাঁর ঘরে কিছু সোনা বা চাঁদির টুকরা থেকে গেছে। তাই সালাম ফিরেই সত্বর তিনি কোন পত্নীর গৃহে প্রবেশ করে রাত্রি আসার পূর্বেই দান করতে আদেশ করে এলেন! (বুখারী ৮৫১, ১২২১ নং)
সাহাবাগণের মধ্যে এমন অনেক সাহাবা ছিলেন, যাঁরা আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর সাথে নামায পড়তেন। কিন্তু গত রাত্রে এশার নামাযে তিনি (ﷺ) কোন্ সূরা পড়েছেন তা খেয়াল রাখতে পারতেন না। (বুখারী ১২২৩ নং)
অবশ্য প্রত্যেকের উচিৎ, যথাসম্ভব অন্য চিন্তা এবং অন্যমনস্কতা দূর করা। নচেৎ অন্য খেয়াল বা চিন্তা যত বেশী হবে, নামাযের সওয়াব তত কম হয়ে যাবে।
১৭। সিজদার জায়গা সাফ করা:-
সিজদার জায়গা পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে নামাযের মাঝে (সিজদার সময়) ফুঁক দেওয়া বৈধ। আল্লাহর নবী (ﷺ) সূর্য-গ্রহণের নামাযের সিজদায় ফুঁক দিয়েছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ১১৯৪, নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ২/১৮৮, বুখারী বিনা সনদে ২৩৮পৃ:)
পক্ষান্তরে ফুঁক দেওয়া নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে হাদীস সহীহ নয়। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ৩১৩পৃ:) অনুরুপ কাঁকর সরানো নিষিদ্ধ হওয়ার হাদীসও যয়ীফ। (ঐ) পরন্তু সহীহ হাদীসে একবার মাত্র সরানোর অনুমতি আছে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৯৮০ নং) তবে না সরানো ১০০টি উৎকৃষ্ট উটনী অপেক্ষা উত্তম। (ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, সহিহ তারগিব ৫৫৫ নং)
১৮। নামাযীর লেবাসের বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, এক কাপড়ে এবং খালি মাথায় নামায পড়া বৈধ।
১৯। মুসহাফ হাতে দেখে দেখে কুরআন পাঠ:-
তারাবীহ্ প্রভৃতি লম্বা নামাযে (লম্বা ক্বিরাআতের) হাফেয ইমাম না থাকলে ‘কুল-খানী’ করে ঠকাঠক কয়েক রাকআত পড়ে নেওয়ার চেয়ে মুসহাফ (কুরআন মাজীদ) দেখে দেখে পাঠ করে দীর্ঘ ক্বিরাআত করা উত্তম। (অবশ্য কুরআন খতমের উদ্দেশ্যে নয়।) অনুরুপ (জামাআতে অন্য হাফেয মুক্তাদী না থাকলে) হাফেয ইমামের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কোন মুক্তাদীর কুরআন দেখে যাওয়া বৈধ। এ সব কিছু প্রয়োজনে বৈধ; ফলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না।
মা আয়েশা رضي الله عنها এর আযাদকৃত গোলাম যাকওয়ান রমযানে (তারাবীতে) দেখে দেখে কুরআন পাঠ করে তাঁর ইমামতি করতেন। (মালেক, মুঅত্তা, ইবনে আবী শাইবা ৭২১৫, ৭২১৬, ৭২১৭ নং)
ইমাম হাসান, মুহাম্মদ, আত্বা প্রমুখ সলফগণ এরুপ (প্রয়োজনে) বৈধ মনে করতেন। (ইবনে আবী শাইবা ৭২১৪, ৭২১৮, ৭২১৯, ৭২২০, ৭২২১ নং)
বর্তমান বিশ্ব তথা সঊদী আরবের উলামা ও মুফতী কমিটির সিদ্ধান্ত মতেও প্রয়োজনে মুসহাফ দেখে তারাবীহ্ পড়ানো বৈধ। (ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৩৪, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১৯/১৫৪, ২১/৫৬) সঊদিয়ার প্রায় অধিকাংশ মসজিদে আমলও তাই।
হযরত আনাস (রাঃ) নামাযে ক্বিরাআত পড়তেন আর তাঁর গোলাম তাঁর পশ্চাতে মুসহাফ ধরে দাঁড়াতেন। তিনি কিছু ভুলে গেলে গোলাম ভুল ধরিয়ে দিতেন। (ইবনে আবী শাইবা ৭২২২ নং)
নামাযের ভিতরে কুরআন খতম করলে খতমের পরে দুআ করার কোন দলীল নেই। তাই কুরআন খতমের দুআ নামাযের ভিতরে না করাই উচিৎ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৪/৫৭-৫৮) অবশ্য নামাযের বাইরে হযরত আনাস (রাঃ) কুরআন খতম করলে তাঁর পরিবার-পরিজনকে সমবেত করে দুআ করতেন। (ইবনুল মুবারাক, যুহ্দ ৮০৯ পৃ:, ইবনে আবী শাইবা ১০৮৭ নং, দারেমী, সুনান, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, মাজমাউয যাওয়াইদ,হাইষামী ৭/১৭২)
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, কুরআনের খতমের কোন নির্দিষ্ট দুআও নেই। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ২০/১৬৫, ১৮৬) অতএব কুরআন মাজীদের শেষ পৃষ্ঠার পর ‘দুআ-এ খতমিল কুরআন’ নামে যে দুআ প্রায় মুসহাফে ছাপা থাকে তা মনগড়া।
১। নামাযে যে সমস্ত কার্যাবলী করা সুন্নত (যেমন রফ্য়ে ইয়াদাইন, ইস্তিরাহার বৈঠক, বুকেহাত বাঁধা ইত্যাদি) তার কোন একটিও ত্যাগ করা মাকরুহ। (ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ১২৫পৃ:)
২। মুখ ঘুরিয়ে বা আড় চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখা, ঘড়ি বা অন্য কিছু দেখা বৈধ নয়।
পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, চোরা দৃষ্টিতে বা ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করার মাধ্যমে শয়তান নামাযীর নামায চুরি করে থাকে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৯৮২নং) যেমন অন্য দিকে দৃষ্টিপাত করে মুখ ফিরিয়ে নিলে আল্লাহও মুখ ফিরিয়ে নেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৯৯৫ নং)
নফল নামাযেও এদিক-ওদিক দেখা বৈধ নয়। বৈধ হওয়ার ব্যাপারে হাদীসগুলি সহীহ নয়। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ৩০৮-৩০৯পৃ:)
অবশ্য চোখের কোণে ডাইনে-বামের জিনিস দেখা বা নজরে পড়া নামাযের জন্য ক্ষতিকর নয়। কারণ, ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (ﷺ) নামায পড়া অবস্থায় ডাইনে ও বামে লক্ষ্য করতেন। আর পিঠের দিকে ঘাড় ঘুরাতেন না।’ (তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৯৯৮ নং)
অনুরুপ ভয় ও প্রয়োজনের সময় দৃষ্টি নিক্ষেপ দূষণীয় নয়। একদা মহানবী (ﷺ) এক উপত্যকার দিকে জাসূস পাঠালেন। অতঃপর ফজরের নামায পড়তে পড়তে তার অপেক্ষায় সেই উপত্যকার দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৯১৬ নং,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৩৭)
আল্লাহর রসূল (ﷺ) যোহ্র ও আসরের নামাযে কুরআন পড়তেন তা সাহাবাগণ তাঁর দাড়ি হিলার ফলে বুঝতে পারতেন। (বুখারী ৭৪৬, আবূদাঊদ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ) অনুরুপ তাঁরা তাঁকে সিজদায় মাথা রাখতে না দেখার পূর্বে কেউ কওমা থেকে সিজদায় যেতেন না। (বুখারী ৭৪৭ নং)
অতএব শিশুর মা নামায পড়তে পড়তে যদি তার শিশুর গতিবিধি লক্ষ্য রাখতে আড় নয়নে তাকায়, তাহলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩১২)
৩। আকাশের (বা উপর) দিকে তাকানো:-
নবী মুবাশ্শির (ﷺ) বলেন, “লোকেরা যেন অবশ্য অবশ্যই নামাযের মধ্যে আকাশের দিকে তাকানো হতে বিরত হয়, নচেৎ তাদের চক্ষু ছিনিয়ে নেওয়া হবে!” (বুখারী ৭৫০, মুসলিম, মিশকাত ৯৮৩ নং) অতএব নামায পড়তে পড়তে উপর বা আকাশ দিকে দৃষ্টিপাত করা হারাম। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩১৫)
৪। চোখ বুজা-
মহানবী (ﷺ) যখন নামায পড়তেন, তখন তিনি তাঁর চোখ দু’টিকে খুলে রাখতেন। তাঁর দৃষ্টি থাকত সিজদার জায়গায়। তাশাহ্হুদে বসার সময় তিনি তাঁর তর্জনী আঙ্গুলের উপর নজর রাখতেন। এ ছাড়া তিনি চোখ খুলে রাখতেন বলেই মা আয়েশা رضي الله عنها এর দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবিযুক্ত পর্দা তাঁর সম্মুখ থেকে সরিয়ে নিতে বলেছিলেন। সুতরাং সুন্নত হল, চোখ খোলা রেখে নামায পড়া।
তবে হ্যাঁ, যদি প্রয়োজন পড়ে; যেমন সামনে কারুকার্য, নক্সা, ফুল বা এমন কোন জিনিস থাকে, যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে অথবা মনোযোগ কেড়ে নেয় অথবা ক্বিরাআত ভুলিয়ে দেয় এবং তা দূর করা সম্ভব না হয়, তাহলে চোখ বন্ধ করে নামায পড়ায় কোন দোষ নেই। বরং এই ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করেই নামায পড়া উত্তম হওয়া শরীয়ত এবং তার উদ্দেশ্য ও নীতির অধিক নিকটবর্তী। (যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়েম ১/২৯৩-২৯৪, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৪৮, ৫২, ৩১৬, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৮৯-২৯০, মুত্বাসা ১৩০-১৩১পৃ:)
৫। এমন জিনিস (যেমন নক্সাদার মুসাল্লা, সৌন্দর্য ও কারুকার্যময় দেওয়াল বা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্যপূর্ণ কাপড় ইত্যাদি) সামনে রেখে নামায পড়া, যাতে নামাযীর মনোযোগ ও একাগ্রতা নষ্ট হয়। এ ব্যাপারে ‘যে সব স্থানে নামায পড়া মাকরুহ’ শিরোনাম দেখুন।
৬। কোন প্রাণীর বা মানুষের ছবি, মূর্তি বা আগুন সামনে করে নামায পড়া। কারণ, এতে থাকে শির্কের গন্ধ এবং অমুসলিমদের সদৃশতা। (মাজমূউস স্বালাওয়াতি ফিল-ইসলাম, ড: শওকত উলাইয়ান ২৫০-২৫১পৃ:)
৭। কোন প্রাণী বা মানুষের ছবি চিত্রিত কাপড় পরে নামায পড়া। (ঐ ২৫১পৃ:)
৮। নিজের বা আর কারো ছবি পকেটে রেখেও নামায মাকরুহ। অবশ্য কোথাও রেখে নামায পড়লে চুরি হয়ে বা হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে নিরুপায় অবস্থায় ছবিযুক্ত টাকা-পয়সা, পাশপোর্ট, পরিচয়-পত্র প্রভৃতি সঙ্গে নিয়ে নামায পড়ায় দোষ নেই। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ১২/৯৮, ১৯/১৬১)
৯। দুই হাতের আঙ্গুলসমূহকে পরস্পর খাঁজাখাঁজি করা:-
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন সুন্দরভাবে ওযু করে মসজিদের উদ্দেশে বের হয়, তখন সে যেন অবশ্যই তার (দুইহাতের) আঙ্গুলসমূহকে খাঁজাখাঁজি না করে। কারণ, সে নামায অবস্থায় থাকে।” (আহমাদ, মুসনাদ ৪/২৪২, ২৪৩, আবূদাঊদ, সুনান ৫৬২, তিরমিযী, সুনান ৩৮৬, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ৩৩৩৪, দারেমী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৪৪১নং, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম, বায়হাকী ৩/২৩০,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২০৬, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২/১০২) অর্থাৎ নামায পড়া অবস্থায় ঐরুপ নিষিদ্ধ।
নামাযের জন্য ওযূ করার পর থেকে নামায শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঐরুপ করা নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে আরো হাদীস দেখুন। (সহিহ তারগিব ২৯২, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১২৯৪, জামে ৪৪৫, ৪৪৬ নং)
১০। আঙ্গুল ফুটানো:-
নামাযের মধ্যে আঙ্গুল ফুটানো মাকরুহ। কারণ, এটি একটি বাজে ও নিরর্থক কর্ম এবং অপর নামাযীদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩২৪)
১১। কোমরে হাত রাখা:-
আল্লাহর নবী (ﷺ) নামায পড়ার সময় কোমরে হাত রাখতে নিষেধ করেছেন। (বুখারী ১২১৯, ১২২০, মুসলিম, সহীহ ৫৪৫, মিশকাত ৯৮১ নং) এর কারণ বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, এমন কাজ ইয়াহুদীদের। (বুখারী ৩৪৫৮, ইবনে আবী শাইবা ৪৫৯১, ৪৬০০ নং) অথবা জাহান্নামীরা জাহান্নামে এরুপ কোমরে হাত রেখে আরাম নেবে। (ইবনে আবী শাইবা ৪৫৯২, ৪৫৯৫ নং) সুতরাং তাদের সদৃশতা অবলম্বন মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। অনেকে বলেন, নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ, এরুপ কাজ অহংকারী, বিপদগ্রস্ত অথবা ভাবনা ও দুশ্চিন্তাগ্রস্তদের। তাই নামাযে এরুপ প্রদর্শন অবৈধ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩২৩, মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ১৫৫পৃ:)
১২। কুকুরের মত বসা:-
দুই পায়ের রলা খাড়া রেখে,হাত দু’টিকে মাটিতে রেখে এবং দুই পাছার উপর ভর করে কুকুরের মত বৈঠক নিষিদ্ধ। কারণ এমন বৈঠক শয়তানের। (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩১৬নং) এ ব্যাপারে অধিক জানতে তাশাহহুদের বৈঠকের বর্ণনা দ্রষ্টব্য।
১৩। বামহাত দ্বারা ভর করে বসা:-
নামাযের বৈঠকে বামহাতকে মাটি বা মুসাল্লার উপর রেখে ঠেস দিয়ে বসা নিষিদ্ধ। কারণ এমন বৈঠক আল্লাহর ক্রোধভাজন ইয়াহুদীদের। (বায়হাকী,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৮০ নং) অতিরিক্ত তাশাহহুদের বৈঠকের বর্ণনা দ্রষ্টব্য।
১৪। কাপড় গাঁটের নিচে ঝুলানো:-
পুরুষদের জন্য তাদের কাপড়; লুঙ্গি, পায়জামা, প্যান্ট, চোগা প্রভৃতি গাঁটের নিচে ঝুলিয়ে পরা সব সময়ের জন্য নিষিদ্ধ। পরন্তু মহান বাদশার সামনে নামাযে দাঁড়িয়ে অহংকারীদের মত এমনভাবে কাপড় ঝুলিয়ে রাখা অধিকভাবে নিষিদ্ধ। (নামাযীর লেবাস দ্রষ্টব্য)
১৫। কাপড় (শাল বা চাদর) না জড়িয়ে দুই কাঁধে দু’ দিকে ঝুলিয়ে রাখা অথবা চাদরে জড়িয়ে থাকা অবস্থায়হাত দু’টিকেও তার ভিতরে রেখেই রুকূ-সিজদা করা:-
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) নামাযে এইভাবে কাপড় পরতে নিষেধ করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৪৩, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৭৬৪ নং) এর কারণ বর্ণনায় বলা হয়েছে, এরুপ অভ্যাস ইয়াহুদীদের।
১৬। চাদর, শাল, কম্ফর্টার প্রভৃতির মাধ্যমে মুখ ঢাকা:-
নামায পড়া অবস্থায় মুখ ঢাকতে মহানবী (ﷺ) নিষেধ করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৪৩, ইবনে মাজাহ্, সুনান, মিশকাত ৭৬৪ নং)
মদ্বীনার ফকীহ্ সালেম বিন আব্দুল্লাহ বিন উমার কাউকে নামাযে মুখ ঢেকে থাকতে দেখলে তার মুখ থেকে তার কাপড়কে সজোরে টেনে সরিয়ে দিতেন। (মালেক, মুঅত্তা ৩০নং)
১৭। পুরুষের লম্বা চুল পেছন দিকে বেঁধে নামায পড়া:-
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি তার (লম্বা) চুলকে পেছন দিকে বেঁধে নামায পড়ে, সে সেই ব্যক্তির মত যে তার দুইহাত বাঁধা অবস্থায় নামায পড়ে।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে হিব্বান, সহীহ) তিনি আরো বলেন, “ঐ বাঁধা চুল হল শয়তান বসার জায়গা!” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সিজদার বিবরণ দ্রষ্টব্য)
ইবনুল আষীর বলেন, লম্বা চুল খোলা অবস্থায় থাকলে সিজদাহ অবস্থায় সেগুলিও মাটিতে পড়ে যাবে। ফলে সিজদাহকারীকে ঐ চুলের সিজদাহ করার সওয়াব দেওয়া হবে। পক্ষান্তরে বাঁধা বা গাঁথা থাকলে সেগুলো সিজদায় পড়তে পারবে না। তাই বাঁধতে নিষেধ করা হয়েছে। (নাইলুল আউতার, শাওকানী ২/৩৪০)
আল্লামা আলবানী (রহঃ) বলেন, মনে হয় এ বিধান কেবল পুরুষদের জন্যই, মহিলাদের জন্য নয়। ইবনুল আরাবী থেকে এ কথা উদ্ধৃত করে শওকানী তাই বলেন। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ১৪৩পৃ:) কারণ, মেয়েদের চুল থাকবে বাঁধা ও কাপড়ের পর্দার ভিতরে। যা বের হলে মহিলার নামাযই বাতিল হয়ে যাবে। (নাইলুল আউতার, শাওকানী ২/৩৪০)
১৮। কাপড় গুটানো:-
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “আমি আদিষ্ট হয়েছি যে, আমি ৭ অঙ্গ দ্বারা সিজদাহ করি --- এবং কাপড় ও চুল না গুটাই।” (বুখারী, মুসলিম, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৭৮২, জামে ১৩৬৯ নং)
মুহাদ্দিস আলবানী (রহঃ) বলেন, ‘এই নিষেধ কেবল নামায অবস্থাতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং নামাযের পূর্বেও যদি কেউ তার চুল বা কাপড় গুটায় অতঃপর নামাযে প্রবেশ করে, তাহলে অধিকাংশ উলামাগণের মতে সে ঐ নিষেধে শামিল হবে। আর চুল বেঁধে নামায পড়া নিষিদ্ধ হওয়ার হাদীস উক্ত মতকে সমর্থন করে। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ১৪৩পৃ:)
এখান থেকেই বহু উলামা বলেছেন যে, জামার আস্তীন বা হাতা গুটিয়ে নামায পড়া মাকরুহ। কারণ মহানবী (ﷺ) ও তাঁর উম্মত নামাযে কাপড় না গুটাতে আদিষ্ট হয়েছেন। আর জামারহাতা গুটানো কাপড় গুটানোরই শামিল।
ইমাম নওবী বলেন, উলামাগণ এ বিষয়ে একমত যে, কাপড় বা জামার আস্তীন গুটিয়ে, চুল বেঁধে বা পাগড়ীর নিচে গুটিয়ে রেখে নামায পড়া নিষিদ্ধ। অবশ্য এই নিষেধের মান হল মাকরুহ। অর্থাৎ, এতে নামায নষ্ট হয় না। (শারহু মুসলিম ৪/২০৯, আউনুল মা’বূদ ২/২৪৭)
উক্ত নিষেধের কারণ বর্ণনায় অনেকে বলেন যে, কাপড় গুটানো বা তোলা অহংকারীদের লক্ষণ। তাই তাদের সাদৃশ্য অবলম্বন নিষিদ্ধ। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩৪৬)
অবশ্য কাপড় খুলে গেলে তা পরা উক্ত নিষেধের আওতাভুক্ত নয়। বরং লজ্জাস্থান খুলে যাওয়ার আশঙ্কা হলে তো নামায অবস্থাতেও পরা ওয়াজেব। অনুরুপ উলঙ্গ নামাযী নামাযের মাঝে যদি কাপড় পায়, তাহলে সেই অবস্থাতেই তার জন্যও তা পরা ওয়াজেব। কারণ, কাপড় বর্তমান থাকতে লজ্জাস্থান বের করে নামায পড়লে নামায বাতিল। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৪৭-৩৪৮)
নামায পড়তে পড়তে খুব শীত লাগলে এবং পাশে কাপড় থাকলে নামাযী নামাযের মধ্যেই তা পরতে বা গায়ে নিতে পারে। কারণ না পরলে তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটবে। (ঐ ৩/৩৪৮) অনুরুপ খুব গরম লাগলেও অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় কাপড় নামায অবস্থাতেই সরিয়ে ফেলতে পারে।
১৯। কাঁধ খোলা রেখে নামায-
কাঁধ খোলা রেখে নামায নিষিদ্ধ। (এ ব্যাপারে ‘নামাযীর লেবাস’ প্রসঙ্গে আলোচনা দেখুন।) সুতরাং বহু হাজীদের ইহ্রাম পরে এক কাঁধ খোলা অবস্থায় নামায পড়া বৈধ নয়। (মাজমূউস স্বালাওয়াতি ফিল-ইসলাম, ড: শওকত উলাইয়ান ২৫১পৃ:)
২০। সশব্দে কুরআন পাঠ:-
অনেকে ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা ইত্যাদি পড়ার সময় মাঝে মাঝে গুন্গুন্ করে বা ফিসফিসিয়ে ওঠে। যাতে পাশের নামাযীর বড় ডিষ্টার্ব হয়। এমন করাও হাদীস থেকে নিষিদ্ধ। মহানবী (ﷺ) বলেন, “অবশ্যই নামাযী তার প্রতিপালকের সাথে নিরালায় আলাপ করে। সুতরাং কি নিয়ে আলাপ করছে, তা যেন সে লক্ষ্য করে। আর তোমাদের কেউ যেন অপরের পাশে কুরআন সশব্দে না পড়ে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মালেক, মুঅত্তা, প্রমুখ মিশকাত ৮৫৬ নং)
২১। খাবার সামনে রেখে নামায-
খাবার জিনিস সামনে হাজির থাকলে এবং খাওয়ার ইচ্ছা ও আকাঙ্খা থাকলে তা না খেয়ে নামায পড়া মাকরুহ। কারণ, সে সময় খাবারের দিকে মন পড়ে থাকে এবং নামাযে যথার্থ মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “যখন তোমাদের রাতের খাবার প্রস্তুত থাকে এবং সেই সময়ে নামাযের ইকামতও হয়, তখন তোমরা প্রথমে খাবার খাও। আর খাওয়া শেষ না করা পর্যন্ত কেউ যেন তাড়াহুড়ো না করে।” ইবনে উমার (রাঃ) এর জন্য খাবার বাড়া হলে সেই সময় যদি নামাযের ইকামত হত, তাহলে তা খেয়ে শেষ না করা পর্যন্ত নামাযে আসতেন না। সেই সময় তিনি ইমামের ক্বিরাআতও শুনতে পেতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১০৫৬ নং)
২২। প্রস্রাব-পায়খানা আটকে রেখে নামায পড়া:-
প্রস্রাব-পায়খানার চাপ থাকলে সেই অবস্থায় নামায পড়া বৈধ নয়। সময় বা জামাআত ছুঠে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও প্রস্রাব-পায়খানার কাজ না সেরে নামাযে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ। মহানবী (ﷺ) বলেন, “খাবার সামনে রেখে নামায নেই। আর তারও নামায নেই, যাকে প্রস্রাব-পায়খানার বেগ পেয়েছে।” (মুসলিম, সহীহ ৫৬০, মিশকাত ১০৫৭ নং, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩২৫-৩২৮)
তিনি আরো বলেন, “তোমাদের কারো পায়খানার তলব হলে এবং অন্য দিকে নামাযের ইকামত হলে প্রথমে সে যেন পায়খানাই করে।” (তিরমিযী, সুনান, আবূদাঊদ, সুনান ৮৮, নাসাঈ, সুনান, মালেক, মুঅত্তা, মিশকাত ১০৬৯ নং)
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে তার জন্য প্রস্রাব-পায়খানার বেগ চেপে রেখে এবং (প্রয়োজন সেরে) হাল্কা হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত নামায পড়া বৈধ নয়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৯১নং, প্রমুখ)
২৩। ঢুল বা তন্দ্রা অবস্থায় নামায-
ঘুমের ঘোর থাকলে বা ঢুল এলে (নফল) নামায পড়া উচিৎ নয়। বরং একটু ঘুমিয়ে নিয়ে পড়া উচিৎ। অবশ্য ফরয নামাযের ক্ষেত্রে জামাআত ও নির্দিষ্ট সময় খেয়াল রাখা একান্ত জরুরী। (এ ব্যাপারে ‘নামায কিভাবে কায়েম হবে’ শিরোনামের আলোচনা দ্রষ্টব্য)
২৪। মাদকদ্রব্য বা কোন হারাম বস্তু বহন করা:-
হ্কপ্রিয় ও সত্যানুসন্ধানী উলামাগণের নিকট কুরআন, সুন্নাহ্, বিবেক ও জ্ঞান-বিজ্ঞান ভিত্তিক বহু দলীল বর্তমান থাকার কারণে বিড়ি, সিগারেট, গালি, তামাক, গুল-জর্দা প্রভৃতি মাদকদ্রব্য মাকরুহে তাহ্রীমী অর্থাৎ হারাম। তাই এ সব জিনিস পকেটে রেখে মসজিদে যাওয়া ও নামায পড়া মাকরুহ। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/১৯৯-২০০)
২৫। হেলা-দোলা:-
নামায পড়তে পড়তে আগে-পিছে বা ডানে-বামে হেলা-দোলা বৈধ নয়। কেন না, এ কাজ নামাযে একাগ্রতা ও স্থিরতার প্রতিকূল। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ২২০পৃ:)
অনেকে কেবল ডান অথবা বাম পায়ের উপর ভরনা দিয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়ায়; যাতে কাতারের পাশের নামাযীরও ডিষ্টার্ব হয়। পক্ষান্তরে প্রিয় নবী (ﷺ) নামায শুরু করার পূর্বে সাহাবাগণের কাঁধ স্পর্শ করে বলতেন, “তোমরা সোজা হয়ে দাঁড়াও। বিভিন্নরুপে দাঁড়ায়ো না। নচেৎ তোমাদের হৃদয়ও বিভিন্ন হয়ে যাবে।” (মুসলিম, মিশকাত ১০৮৮ নং)
অবশ্য নামায লম্বা হলে পা ধরার ফলে দু-একবার পা বদলে আরাম নেওয়া দূষণীয় নয়। তবে শর্ত হল, যেন এক পা অপর পায়ের চেয়ে বেশী আগা-পিছা না হয়ে যায়। বরং উভয় পা যেন বরাবর থাকে এবং এ কাজ বারবারও না হয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩২৩-৩২৪) তাছাড়া যেন পাশের মুসল্লীর ডিষ্টার্ব না হয়।
২৬। নামাযের প্রতিকূল কিছু আচরণ:-
নামায পড়তে পড়তে মাথা বা দাড়ি চুলকানো, বারবার মাথার টুপী, পাগড়ী বা রুমাল সোজা করা, ঘড়ি হিলানো ও দেখা, নখ, দাঁত, নাক ও ব্রণ খোঁটা প্রভৃতি অপ্রয়োজনীয় কর্ম বৈধ নয়। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্ ১৭২-১৭৫পৃ:) একটি কথা খুবই সত্য যে, হৃদয় চাঞ্চল্যময় থাকলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চঞ্চল থাকে। আর হৃদয়কে যদি শান্ত ও স্থির রাখা যায়, তাহলে বাহিরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও সেই মহান বাদশার জন্য শান্ত ও স্থির থাকবে।
২৭। সালাম ফেরার সময়হাতের ইশারা মাকরুহ। (সালামের বিবরণ দ্রষ্টব্য)
এমন বহু কর্ম আছে, যা নামাযের ভিতরে করলে নামায বাতিল হয়ে যায়। সে সব কর্মের কিছু নিম্নরুপ:-
১। অপ্রয়োজনে নামাযের ভিতর এত বেশী নড়া-সরা বা চলা-ফেরা করা যাতে অন্য কেউ দেখলে এই মনে করে যে, সে নামায পড়ে নি। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৫২-৩৫৩) কারণ, কথা বলার মত নামাযের বহির্ভূত অন্যান্য কর্ম করলে নামায বাতিল হয়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, “--- আর তোমরা আল্লাহর সামনে বিনীত ভাবে দাঁড়াও।” (কুরআন মাজীদ ২/২৩৮)
২। নামাযের কোন রুক্ন বা শর্ত ত্যাগ করা:-
ধীর-স্থিরভাবে নামায না পড়ার কারণে মহানবী (ﷺ) নামায ভুলকারী সাহাবাকে তিন-তিনবার ফিরিয়ে নামায পড়তে আদেশ করেছিলেন। (বুখারী, মুসলিম, প্রমুখ, মিশকাত ৭৯০ নং) কারণ, ধীর-স্থির ও শান্তভাবে নামায পড়া নামাযের এক রুক্ন ও ফরয। যা ত্যাগ করার পর সহু সিজদাহ করলেও সংশোধন হয় না।
অনুরুপ সূরা ফাতিহা, রুকূ, কোন সিজদাহ, সালাম বা অন্য কোন রুক্ন ত্যাগ করলে নামাযই হয় না। অবশ্য প্রয়োজনের চাপে কিছু অবস্থা ব্যতিক্রমও আছে, যাতে দু-একটি রুক্ন (যেমন কিয়াম, সূরা ফাতিহা) বাদ গেলেও নামায হয়ে যায়। সে কথা যথাস্থানে আলোচিত হবে ইনশাআল্লাহ।
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি নাপাক হয়ে যায়, সে ব্যক্তি পুনরায় ওযূ না করা পর্যন্ত তার নামায কবুল হয় না।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৩০০নং) “পবিত্রতা বিনা নামাযই কবুল হয় না।” (মুসলিম, মিশকাত ৩০১নং)
সুতরাং নামায পড়তে পড়তে কারো ওযু ভেঙ্গে গেলে তার নামায বাতিল। নামায ত্যাগ করে পুনরায় ওযূ করে এসে নতুনভাবে নামায পড়তে হবে। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১০০৭ নং)
অবশ্য ওযূ ভাঙ্গার নিছক সন্দেহের কারণে নামায বাতিল হয় না। নিশ্চিতরুপে ওযূ নষ্ট হওয়ার কথা না জানা গেলে নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। প্রিয় রসূল (ﷺ) বলেন, “ (নামাযে হাওয়া বের হওয়ার সন্দেহ্ হলে) শব্দ না শোনা অথবা দুর্গন্ধ না পাওয়া পর্যন্ত কেউ যেন নামায ত্যাগ না করে।” (বুখারী ১৩৭নং, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, নাসাঈ, সুনান)
নামায পড়তে পড়তে শরমগাহ্ বের হয়ে পড়লে, মহিলাদের পেট, পিঠ, হাতের বাজু, চুল ইত্যাদি প্রকাশ হয়ে পড়লে (তা কোন বেগানা পুরুষ দেখতে পাক অথবা না পাক) নামায বাতিল হয়ে যায়।
নামায পড়তে থাকা কালে কাপড়ে বীর্য (স্বপ্নদোষের) চিহ্ন অথবা (মহিলা) মাসিকের দাগ দেখলে নামায ত্যাগ করা জরুরী।
নামায অবস্থায় দেহ্ বা লেবাসের কোন স্থানে নাপাকী লেগে থাকতে নজর পড়লে যদি তা সত্বর দূর করা সম্ভব হয়, তাহলে তা দূর করে নামায হয়ে যাবে। যেমন অতিরিক্ত লেবাসে; অর্থাৎ টুপী, রুমাল, গামছা বা পাগড়ী অথবা জুতায় নাপাকী দেখলে এবং সত্বর তা খুলে ফেলে দিলে নামায শুদ্ধ।
একদা নামায পড়তে পড়তে জিবরীল (আঃ) মারফৎ মহানবী (ﷺ) তাঁর জুতায় নাপাকী লেগে থাকার সংবাদ পেলে তিনি তা খুলে ফেলে নামায সম্পন্ন করেছিলেন। (আবূদাঊদ, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৭৬৬ নং)
সত্বর খোলা সম্ভব না হলে অথবা পূর্ণ লেবাস পরিবর্তন করা দরকার হলে নামায ত্যাগ করে পবিত্র লেবাস পরে পুনরায় নামায পড়তে হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৮৯)
কারো নামায পড়ার পর যদি মনে পড়ে যে সে বিনা ওযূতে নামায পড়েছে, অথবা কাপড়ে (নিজের) বীর্য (স্বপ্নদোষ) বা (মহিলা) মাসিকের চিহ্ন দেখে, তাহলে নামায শুদ্ধ হয় নি। যথা নিয়মে পবিত্র হওয়ার পর সে নামায পুনরায় পড়তে হবে। কারণ, দেহ্ নাপাক রেখে নামাযই হয় না।
পক্ষান্তরে নামায পড়ার পর যদি দেখে, কাপড়ে প্রস্রাব, পায়খানা বা অন্য কোন নাপাকী লেগে আছে; অর্থাৎ সে তা নিয়েই নামায পড়েছে, তাহলে না জানার কারণে তার নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। আর ফিরিয়ে পড়তে হবে না। কারণ, বাইরের কাপড়ে (অনুরুপ কোন অঙ্গে) নাপাকী লেগে থাকলেও তার দেহ্ আসলে পাক ছিল। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/১৯৮, ২৯৮)
৩। জেনেশুনে ইচ্ছাকৃত কথা বলা:-
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) এর নামায পড়া অবস্থায় আমরা তাঁকে সালাম দিতাম এবং তিনি সালামের উত্তরও দিতেন। অতঃপর যখন নাজাশীর নিকট থেকে ফিরে এলাম, তখন সালাম দিলে তিনি উত্তর দিলেন না। পরে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, “নামাযে মগ্নতা আছে।” (বুখারী ১১৯৯ নং, মুসলিম, সহীহ প্রমুখ)
যায়দ বিন আরকাম (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) এর যুগে আমরা নামাযে কথা বলতাম; আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তার সঙ্গীকে নিজের প্রয়োজনের কথা বলত। অতঃপর যখন আল্লাহর এই নির্দেশ অবতীর্ণ হল, “তোমরা নামাযসমূহ এবং বিশেষ করে মধ্যবর্তী (আসরের) নামাযের প্রতি যত্নবান হও। আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দাঁড়াও।” তখন আমরা চুপ থাকতে (নামাযের সূরা, দুআ, দরুদ ছাড়া অন্য কথা না বলতে) আদিষ্ট হ্লাম। (বুখারী ১২০০ নং, মুসলিম, সহীহ প্রমুখ)
অবশ্য নামাযে কথা বলা হারাম তা না জেনে যদি কেউ কথা বলেই ফেলে, তাহলে তার নামায বাতিল নয়। এক ব্যক্তি নামাযে হাঁচলে (ছিকি মারলে) মুআবিয়া বিনহাকাম নামাযের অবস্থাতেই ঐ ব্যক্তির জন্য ‘য়্যারহামুকাল্লাহ্’ বলে দুআ করলে সাহাবাগণ নিজেদের জানুতে আঘাত করে তাঁকে চুপ করাতে চাইলেন। নামায শেষ হলে আদর্শ শিক্ষক প্রিয় রসূল (ﷺ) তাঁকে নরমভাবে বুঝিয়ে বললেন, “এই নামাযে লোক-সমাজের কোন কথা বলা বৈধ (সঙ্গত) নয়। এতে যা বলতে হয় তা হল; তাসবীহ, তকবীর ও কুরআন পাঠ।” (মুসলিম, মিশকাত ৯৭৮ নং)
উক্ত হাদীসে এ কথা উল্লেখ নেই যে, তিনি তাঁকে নামায ফিরিয়ে পড়তে বলেছিলেন। সুতরাং বুঝা গেল, অজান্তে কেউ কথা বলে ফেললে তার নামায নষ্ট হয়ে যাবে না। (ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৩৯)
উল্লেখ্য যে, নামাযের সূরা, দুআ-দরুদ ইত্যাদির অনুবাদও যদি নামাযে বলা হয়, তাহলেও নামায বাতিল হয়ে যাবে। কারণ, অনুবাদও মানুষের সাধারণ কথার শামিল।
প্রকাশ থাকে যে, কথা যদি নামায সংশোধন করার মানসেও বলা প্রয়োজন হয়, তবুও বলা বৈধ নয়। যেমন যদি ইমাম আসরের সময় জোরে ক্বিরাআত পড়তে শুরু করে এবং কোন মুক্তাদী তা সংশোধনের উদ্দেশ্যে বলে, ‘এটা আসরের নামায’ অথবা যদি ইমাম এক সিজদার পর বসে যায় এবং কোন মুক্তাদী ‘তাসবীহ’ বলার পরও বুঝতে না পারে যে, দ্বিতীয় সিজদাহ করতে হবে; ফলে সে উঠতে যায়। এ ক্ষেত্রে কোন মুক্তাদীর ‘সিজদাহ’ বা ‘সিজদাহ করুন’ বলাও বৈধ নয়। এরুপ বললে নামায বাতিল। কারণ, পূর্বেই আমরা জেনেছি যে, নামাযে কিছু ঘটলে মহানবী (ﷺ) আমাদেরকে (পুরুষের জন্য) তাসবীহ এবং (মহিলার জন্য) হাততালি বিধেয় করেছেন। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৬৪-৩৬৫)
এ বিষয়ে একটি ব্যতিক্রম ব্যাপার এই যে, কোন জামাআতের লোক ভুল করে চার রাকআতের জায়গায় তিন রাকআত পড়ে সালাম ফিরার পর মুক্তাদীদের কেউ এই ভুল সম্বন্ধে স্মরণ দিলে এবং ইমামও নিশ্চিত হওয়ার জন্য অন্যান্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সংশোধনের উদ্দেশ্যে আরো এক রাকআত নামায অবশ্যই পড়বে এবং সহু সিজদাহ করবে। আর এর মাঝে ইমাম-মুক্তাদীর ঐ কথোপকথন নামাযের জন্য ক্ষতিকর হবে না। যেহেতু এ কথা তখনই বলা হয়, যখন সালাম ফিরে দেওয়া হয়। আর তখন কথা বলা বৈধ। পক্ষান্তরে নিশ্চিত জানা যায় না যে, সত্যই নামায কম পড়া হয়েছে কি না। এ রকমই হয়েছিল মহানবী (ﷺ) ও সাহাবাগণের। (দেখুন, বুখারী ৭১৪, মুসলিম, সহীহ ৫৭৩ নং)
৪। পানাহার করা:-
নামায পড়তে পড়তে খেলে অথবা পান করলে নামায বাতিল হয়ে যায়। মুখের ভিতর পান, গালি (?), চুইংগাম প্রভৃতি রেখে নামায হয় না। কারণ এ কাজ নামাযের পরিপন্থী। (ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৪০, ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ১৩০ পৃ:)
৫। হাসা:-
হাসলেও অনুরুপ কারণে নামায বাতিল পরিগণিত হয়। (ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/২৪০, ফিকহুস সুন্নাহ্ উর্দু ১৩০পৃ:) অবশ্য কোন হাস্যকর জিনিস দেখে অথবা হাস্যকর কথা শুনে হাসি চেপে রাখতে না পেরে যদি কেউ মুচকি হাসি (শব্দ না করে) হেসে ফেলে, তাহলে তার নামায বাতিল হবে না।
প্রকাশ থাকে যে, নামাযী কে হাসাবার চেষ্টা করা তথা তার নামায নষ্ট করার কাজ শয়তানের। কোন মুসলিম মানুষের এ কাজ হওয়া উচিৎ নয়।
৬। পিতার হারাম উপায়ে উপর্জিত অর্থ খেলে ও ব্যয় করলে পুত্রের নামায বাতিল নয়। তবে সেই অর্থ ব্যবহার না করতে যথাসাধ্য প্রয়াস থাকতে হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে পরহেযগারী অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য চলার পথ সহ্জ করে দেন। আর তিনি তাকে এমন জায়গা থেকে রুযী দান করে থাকেন, যা সে বুঝতে ও কল্পনাই করতে পারে না। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬৪)
৭। ‘যাতে ওযূ নষ্ট হয় না’ শিরোনামে আলোচিত হয়েছে যে, গাঁটের নিচে কাপড় ঝুলিয়ে নামায পড়লে ওযূ ও নামায কিছুই বাতিল হয় না। অবশ্য এমন কাজ করলে তার উপর থেকে মহান আল্লাহর সুনজর ও দায়িত্ব উঠে যায়। আর ওযূ ও নামায বাতিল হওয়ার ব্যাপারে দলীলের হাদীস সহীহ নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩০১)
৮। কোন কারণে ইমামের নামায বাতিল হলে পশ্চাতে মুক্তাদীদের নামায বাতিল নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/৩১৫-৩১৭) এ বিষয়ে ইমামতির বিবরণ দ্রষ্টব্য।
১০। নামাযী যদি জানে যে তার সামনে দিয়ে কোন মহিলা, গাধা বা কালো কুকুর অতিক্রম করবে এবং এ জানা সত্ত্বেও বিনা সুতরায় নামায পড়ে, তাহলে ঐ তিনটের একটাও তার সামনে বেয়ে পার হয়ে গেলে তার নামায বাতিল। কারণ, সুতরার বিবরণে আমরা জেনেছি যে, ঐ তিনটি জিনিস নামায নষ্ট করে দেয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৪৩, ৩৯২)
অনুরুপ মুক্তাদীর সুতরাহ্ ইমামের সুতরাই। অতএব ইমাম সুতরাহ্ রেখে নামায না পড়লে এবং ঐ তিনটের একটা সামনে বেয়ে অতিক্রম করলে ইমাম-মুক্তাদী সকলের নামায বাতিল।
প্রকাশ যে, নামায পড়তে পড়তে নামায বাতিল হওয়া জানা গেলে অথবা ওযূ নষ্ট হওয়া বুঝতে পারলে সাথে সাথে নামায ছেড়ে বেরিয়ে আসা ওয়াজেব। লজ্জায় বা অন্য কারণে নামায শেষ করা হারাম এবং তা এক প্রকার আল্লাহর সাথে ব্যঙ্গ করা! কারণ, যা তিনি গ্রহণ করবেন না, তা জেনেশুনেও নিবেদন করতে থাকা উপহাস বৈকি? (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৯২-৩৯৩)
অবশ্য জামাআতে থাকলে লজ্জা হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষ করে হাওয়া বের হওয়ার ফলে ওযূ নষ্ট হলে অনেকে নামায বা জামাআত ত্যাগ করে কাতার ভেঙ্গে আসতে লজ্জা ও সংকোচবোধ করে। কিন্তু মহানবী (ﷺ) এই লজ্জা ঢাকার জন্য এক কৃত্রিম উপায়ের কথা বলে দিয়েছেন; তিনি বলেন, “যখন তোমাদের মধ্যে কেউ তার নামাযে নাপাক হয়ে যাবে তখন সে যেন তার নাক ধরে নেয়। অতঃপর বের হয়ে আসে।” (আবূদাঊদ, সুনান ১১১৪,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/১৮৪, মিশকাত ১০০৭ নং)
ত্বীবী বলেন, এই নির্দেশ এই জন্য যে, যাতে লোকেরা মনে করে তার নাকে রক্ত আসছে (তাই বের হয়ে যাচ্ছে)। আর এরুপ করা মিথ্যা নয়, বরং তা ‘তাওরিয়াহ্’ বা বৈধ অভিনয়। শয়তান যাতে তার মনে লোকদেরকে শরম করার কথা সুশোভিত না করে ফেলে (এবং নামায পড়তেই থেকে যায়)। তাই তার জন্য এ কাজের অনুমতি ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (আউনুল মা’বূদ, মিরকাত, মিশকাতের টীকা ১নং, ১/৩১৮)
কিছু নামাযী আছে, যারা নামায তো পড়ে; কিন্তু তাদের নামায আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দরবারে কবুল ও গৃহীত হয় না। নামাযী অথবা নামাযের অবস্থা দেখে মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হন না। এমন কতকগুলি নামাযী নিম্নরুপ:-
১। পলাতক ক্রীতদাস-
২। এমন স্ত্রী, যার স্বামী তার উপর রাগ করে আছে। স্ত্রী স্বামীকে সর্বদা খোশ রাখবে, তার (ভালো কথা ও কাজে) আনুগত্য করবে, তার সব কথা মেনে চলবে, যৌনসুখ দিয়ে তাকে সর্বদা তৃপ্ত রাখবে, কোন বিষয়ে রাগ হলে তা সত্বর মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সব কিছুতে তাকে সন্তুষ্ট রাখবে -এটাই হল স্ত্রীর ধর্ম। মহানবী (ﷺ) বলেন, তোমাদের (সেই) স্ত্রীরাও জান্নাতী হবে, যে স্ত্রী অধিক প্রণয়িণী, সন্তানদাত্রী, বারবার ভুল করে বারবার স্বামীর নিকট আত্মসমর্পণকারিণী, যার স্বামী রাগ করলে সে তার নিকট এসে তার হাতে হাত রেখে বলে, আপনি রাজী (ঠান্ডা) না হওয়া পর্যন্ত আমি ঘুমাব না।” (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৮৭ নং)
কিন্তু এমন বহু মহিলা আছে, যারা তাদের স্বামীর খেয়ে-পরেও এমন রাগ-রোষকে পরোয়া করে না। নারী-স্বাধীনতার পক্ষপাতিনী স্বামীর সংসারেও পরম স্বাধীনতা-সুখ ভোগ করতে গিয়ে স্বামীকে নারাজ রাখে। ফলে বিশ্বস্বামীও নারাজ হন এবং সেই স্ত্রীর শয্যাসঙ্গী স্বামীকে খোশ করার আগে নামায পড়লেও সে নামাযে তিনি খোশ হন না। কারণ, ‘হুকূকুল ইবাদ’ আদায় না করা পর্যন্ত মহান আল্লাহ বান্দার তাওবাতে সন্তুষ্ট হন না। যার প্রতি অন্যায় করা হয়, তার নিকট আগে ক্ষমা পেলে তবেই মহান আল্লাহ ক্ষমা করেন। নচেৎ না।
৩। এমন লোক যে কারো বিনা অনুমতি ও আদেশেই কারো জানাযা পড়ায় (ইমামতি করে)। এমন ইমাম, যার ইমামতি অধিকাংশ মুক্তাদীরা পছন্দ করে না। তার পিছনে নামায পড়তে তাদের রুচি হয় না। ইমামতিতে ভুল আচরণ অথবা চরিত্রগত কোন কারণে অধিকাংশ লোকে তাকে ইমামতি করতে দিতে চায় না। এমন ইমামের নামায তার কান অতিক্রম করে না, মাথার উপরে যায় না, আকাশের দিকে ওঠে না, সাত আসমান পার হয়ে আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়া তো বহু দূরের কথা।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “তিন ব্যক্তির নামায তাদের কান অতিক্রম করে না; পলাতক ক্রীতদাস, যতক্ষণ না সে ফিরে এসেছে, এমন স্ত্রী যার স্বামী তার উপর রাগান্বিত অবস্থায় রাত্রিযাপন করেছে, (যতক্ষণ না সে রাজী হয়েছে), (অথবা যে স্ত্রী তার স্বামীর অবাধ্য চরণ করেছে, সে তার বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত) এবং সেই সম্প্রদায়ের ইমাম, যাকে লোকে অপছন্দ করে।” (তিরমিযী, সুনান, ত্বাবারানী,হাকেম, মুস্তাদরাক, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৮৮, ৬৫০নং)
৪।এমন লোক, যে কোন গণকের কাছে ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ জানার আশায় গণককে ‘ইলমে গায়বের মালিক’ মনে করে হাত দেখায়। এমন ব্যক্তির -কেবল গণকের কাছে যাওয়ার কারণেই- তার ৪০ দিনের (২০০ ওয়াক্তের) নামায কবুল হয় না! তার উপর গণক যা বলে তা বিশ্বাস করলে তো অন্য কথা। বিশ্বাস করলে তো সে মূলেই ‘কাফের’-এ পরিণত হয়ে যায়। আর কাফেরের নামায-রোযা অবশ্যই মকবূল নয়।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন গণকের নিকট উপস্থিত হয়ে কোন (ভূত-ভবিষ্যৎ বা গায়বী) বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, সে ব্যক্তির ৪০ দিনের নামায কবুল হয় না।” (মুসলিম, সহীহ ২২৩০নং)
মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন গণক বা জ্যোতিষীর নিকট উপস্থিত হয়ে সে যা বলে তা সত্য মনে (বিশ্বাস) করল, সে ব্যক্তি মুহাম্মদ (ﷺ) এর উপর অবতীর্ণ (কুরআনের) প্রতি কুফরী করল।” (আহ্মদ,হাকেম, সহীহুল জামে’ ৫৯৩৯নং)
৫। শারাবী, মদ্যপায়ী:-
মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমার উম্মতের যে ব্যক্তি মদ পান করবে, আল্লাহ তার ৪০ দিন নামায কবুল করবেন না।” (নাসাঈ, সুনান, জামে ৭৭১৭ নং)
৬। এমন নামাযী, যে নামায পড়ে কিন্তু নামায চুরি করে। দায় সারা করে পড়ে। ঠিকমত রুকূ-সিজদাহ করে না। রুকূতে স্থির হয় না, সিজদায় স্থির থাকে না। কোমর বাঁকানো মাত্র তুলে নেয়। ‘সু-সু-সু’ করে দুআ পড়ে চটপট উঠে যায়! কারো কোমর ঠিকমত বাঁকে না। মাথা উঁচু করেই রুকূ করে। কারো সিজদার সময় নাক মুসাল্লায় স্পর্শ করে না। কারো পা দু’টি উপর দিকে পাল্লায়হাল্কা হওয়ার মত উঠে যায়। কেউ রুকূ ও সিজদার মাঝে স্থির হয়ে দাঁড়ায় না।হাফ দাঁড়িয়ে সিজদায় যায়।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “হে মুসলিম দল! সে ব্যক্তির নামায হয় না, যে ব্যক্তি রুকূ ও সিজদাতে নিজ পিঠ সোজা করে না।” (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ তারগিব ৫২৪ নং)
“আল্লাহ সেই বান্দার নামাযের দিকে তাকিয়েও দেখেন না, যে রুকূ ও সিজদার মাঝে নিজ পিঠকে সোজা করে (দাঁড়ায়) না।” (আহমাদ, মুসনাদ ৪/২২, ত্বাবারানী, সহিহ তারগিব ৫২৫, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৩৬ নং)
“মানুষ ৬০ বছর ধরে নামায পড়ে, অথচ তার একটি নামাযও কবুল হয় না! কারণ, হয়তো বা সে রুকূ পূর্ণরুপে করে, কিন্তু সিজদাহ পূর্ণরুপে করে না। অথবা সিজদাহ পূর্ণরুপে করে, কিন্তু রুকূ ঠিকমত করে না।” (আসবাহানী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৩৫ নং)
“নামায ৩ ভাগে বিভক্ত; এক তৃতীয়াংশ পবিত্রতা, এক তৃতীয়াংশ রুকূ এবং আর এক তৃতীয়াংশ হল সিজদাহ। সুতরাং যে ব্যক্তি তা যথার্থরুপে আদায় করবে, তার নিকট থেকে তা কবুল করা হবে এবং তার অন্যান্য সমস্ত আমলও কবুল করা হবে। আর যার নামায রদ করা হবে, তার অন্য সকল আমলকে রদ্দ্ করে দেওয়া হবে।” (বাযযার, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৩৭ নং)
৭। আযান শুনেও যে নামাযী বিনা ওজরে মসজিদের জামাআতে নামায পড়ে না-
জামাআতে নামায পড়া ওয়াজেব। এই ওয়াজেব ত্যাগ করলে তার নামায কবুল নাও হতে পারে। মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি আযান শোনা সত্ত্বেও মসজিদে জামাআতে এসে নামায আদায় করে না, কোন ওজর না থাকলে সে ব্যক্তির নামায কবুল হয় না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৫৫১, ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৬৩০০ নং)
৮। এমন মহিলা, যে আতর বা সেন্ট মেখে মসজিদের জন্য বের হয়:-
এমন মহিলা যতক্ষণ পর্যন্ত না নাপাকীর গোসল করার মত গোসল করেছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার নামায কবুল হবে না। (ইবনে মাজাহ্, সুনান, জামে ২৭০৩ নং)
৯। পিতামাতার অবাধ্য সন্তান।
১০। দান করে যে দানের কথায় গর্ব ভরে প্রচার করে বেড়ায়।
১১। তকদীর অস্বীকারকারী ব্যক্তি। (ত্বাবারানী, জামে ৩০৬৫ নং)
১২। পরের বাপকে যে নিজের বাপ বলে দাবী করে। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)
১৩। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমকে হ্ত্যা করে এবং তাতে সে গর্ববোধ করে ও খুশী হয়। (বায়হাকী ৮/২১, জামে ৬৪৫৪ নং)
১৪। খুনের বদলে খুনের বদলা নিতে যে ব্যক্তি (শাসন কর্তৃপক্ষকে) বাধা দেয়। (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, জামে ৬৪৫১ নং)
১৫। যে ব্যক্তি মদ্বীনায় কোন বিদআত কাজ করে অথবা কোন বিদআতীকে আশ্রয় দেয়। অথবা কোন দুষ্কর্ম করে বা দুষ্কৃতিকে আশ্রয় দেয়।
১৬। যে ব্যক্তি মুসলিমদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ ১৩৭০ নং)
উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গের কোন ফরয-নফল নামায ও ইবাদতই (অথবা তওবা ও মুক্তিপণ কিয়ামতে) কবুল করা হবে না।