এমন বহু কর্ম আছে, যা নামাযের ভিতরে করলে নামায বাতিল হয়ে যায়। সে সব কর্মের কিছু নিম্নরুপ:-

১। অপ্রয়োজনে নামাযের ভিতর এত বেশী নড়া-সরা বা চলা-ফেরা করা যাতে অন্য কেউ দেখলে এই মনে করে যে, সে নামায পড়ে নি। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৫২-৩৫৩) কারণ, কথা বলার মত নামাযের বহির্ভূত অন্যান্য কর্ম করলে নামায বাতিল হয়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, “--- আর তোমরা আল্লাহর সামনে বিনীত ভাবে দাঁড়াও।” (কুরআন মাজীদ ২/২৩৮)

২। নামাযের কোন রুক্‌ন বা শর্ত ত্যাগ করা:-

ধীর-স্থিরভাবে নামায না পড়ার কারণে মহানবী (ﷺ) নামায ভুলকারী সাহাবাকে তিন-তিনবার ফিরিয়ে নামায পড়তে আদেশ করেছিলেন। (বুখারী, মুসলিম, প্রমুখ, মিশকাত ৭৯০ নং) কারণ, ধীর-স্থির ও শান্তভাবে নামায পড়া নামাযের এক রুক্‌ন ও ফরয। যা ত্যাগ করার পর সহু সিজদাহ করলেও সংশোধন হয় না।

অনুরুপ সূরা ফাতিহা, রুকূ, কোন সিজদাহ, সালাম বা অন্য কোন রুক্‌ন ত্যাগ করলে নামাযই হয় না। অবশ্য প্রয়োজনের চাপে কিছু অবস্থা ব্যতিক্রমও আছে, যাতে দু-একটি রুক্‌ন (যেমন কিয়াম, সূরা ফাতিহা) বাদ গেলেও নামায হয়ে যায়। সে কথা যথাস্থানে আলোচিত হবে ইনশাআল্লাহ।

প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি নাপাক হয়ে যায়, সে ব্যক্তি পুনরায় ওযূ না করা পর্যন্ত তার নামায কবুল হয় না।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৩০০নং) “পবিত্রতা বিনা নামাযই কবুল হয় না।” (মুসলিম, মিশকাত ৩০১নং)

সুতরাং নামায পড়তে পড়তে কারো ওযু ভেঙ্গে গেলে তার নামায বাতিল। নামায ত্যাগ করে পুনরায় ওযূ করে এসে নতুনভাবে নামায পড়তে হবে। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১০০৭ নং)

অবশ্য ওযূ ভাঙ্গার নিছক সন্দেহের কারণে নামায বাতিল হয় না। নিশ্চিতরুপে ওযূ নষ্ট হওয়ার কথা না জানা গেলে নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। প্রিয় রসূল (ﷺ) বলেন, “ (নামাযে হাওয়া বের হওয়ার সন্দেহ্‌ হলে) শব্দ না শোনা অথবা দুর্গন্ধ না পাওয়া পর্যন্ত কেউ যেন নামায ত্যাগ না করে।” (বুখারী ১৩৭নং, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, নাসাঈ, সুনান)

নামায পড়তে পড়তে শরমগাহ্‌ বের হয়ে পড়লে, মহিলাদের পেট, পিঠ, হাতের বাজু, চুল ইত্যাদি প্রকাশ হয়ে পড়লে (তা কোন বেগানা পুরুষ দেখতে পাক অথবা না পাক) নামায বাতিল হয়ে যায়।

নামায পড়তে থাকা কালে কাপড়ে বীর্য (স্বপ্নদোষের) চিহ্ন অথবা (মহিলা) মাসিকের দাগ দেখলে নামায ত্যাগ করা জরুরী।

নামায অবস্থায় দেহ্‌ বা লেবাসের কোন স্থানে নাপাকী লেগে থাকতে নজর পড়লে যদি তা সত্বর দূর করা সম্ভব হয়, তাহলে তা দূর করে নামায হয়ে যাবে। যেমন অতিরিক্ত লেবাসে; অর্থাৎ টুপী, রুমাল, গামছা বা পাগড়ী অথবা জুতায় নাপাকী দেখলে এবং সত্বর তা খুলে ফেলে দিলে নামায শুদ্ধ।

একদা নামায পড়তে পড়তে জিবরীল (আঃ) মারফৎ মহানবী (ﷺ) তাঁর জুতায় নাপাকী লেগে থাকার সংবাদ পেলে তিনি তা খুলে ফেলে নামায সম্পন্ন করেছিলেন। (আবূদাঊদ, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৭৬৬ নং)

সত্বর খোলা সম্ভব না হলে অথবা পূর্ণ লেবাস পরিবর্তন করা দরকার হলে নামায ত্যাগ করে পবিত্র লেবাস পরে পুনরায় নামায পড়তে হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৮৯)

কারো নামায পড়ার পর যদি মনে পড়ে যে সে বিনা ওযূতে নামায পড়েছে, অথবা কাপড়ে (নিজের) বীর্য (স্বপ্নদোষ) বা (মহিলা) মাসিকের চিহ্ন দেখে, তাহলে নামায শুদ্ধ হয় নি। যথা নিয়মে পবিত্র হওয়ার পর সে নামায পুনরায় পড়তে হবে। কারণ, দেহ্‌ নাপাক রেখে নামাযই হয় না।

পক্ষান্তরে নামায পড়ার পর যদি দেখে, কাপড়ে প্রস্রাব, পায়খানা বা অন্য কোন নাপাকী লেগে আছে; অর্থাৎ সে তা নিয়েই নামায পড়েছে, তাহলে না জানার কারণে তার নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। আর ফিরিয়ে পড়তে হবে না। কারণ, বাইরের কাপড়ে (অনুরুপ কোন অঙ্গে) নাপাকী লেগে থাকলেও তার দেহ্‌ আসলে পাক ছিল। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/১৯৮, ২৯৮)

৩। জেনেশুনে ইচ্ছাকৃত কথা বলা:-

আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) এর নামায পড়া অবস্থায় আমরা তাঁকে সালাম দিতাম এবং তিনি সালামের উত্তরও দিতেন। অতঃপর যখন নাজাশীর নিকট থেকে ফিরে এলাম, তখন সালাম দিলে তিনি উত্তর দিলেন না। পরে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, “নামাযে মগ্নতা আছে।” (বুখারী ১১৯৯ নং, মুসলিম, সহীহ প্রমুখ)

যায়দ বিন আরকাম (রাঃ) বলেন, নবী (ﷺ) এর যুগে আমরা নামাযে কথা বলতাম; আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তার সঙ্গীকে নিজের প্রয়োজনের কথা বলত। অতঃপর যখন আল্লাহর এই নির্দেশ অবতীর্ণ হল, “তোমরা নামাযসমূহ এবং বিশেষ করে মধ্যবর্তী (আসরের) নামাযের প্রতি যত্নবান হও। আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দাঁড়াও।” তখন আমরা চুপ থাকতে (নামাযের সূরা, দুআ, দরুদ ছাড়া অন্য কথা না বলতে) আদিষ্ট হ্‌লাম। (বুখারী ১২০০ নং, মুসলিম, সহীহ প্রমুখ)

অবশ্য নামাযে কথা বলা হারাম তা না জেনে যদি কেউ কথা বলেই ফেলে, তাহলে তার নামায বাতিল নয়। এক ব্যক্তি নামাযে হাঁচলে (ছিকি মারলে) মুআবিয়া বিনহাকাম নামাযের অবস্থাতেই ঐ ব্যক্তির জন্য ‘য়্যারহামুকাল্লাহ্‌’ বলে দুআ করলে সাহাবাগণ নিজেদের জানুতে আঘাত করে তাঁকে চুপ করাতে চাইলেন। নামায শেষ হলে আদর্শ শিক্ষক প্রিয় রসূল (ﷺ) তাঁকে নরমভাবে বুঝিয়ে বললেন, “এই নামাযে লোক-সমাজের কোন কথা বলা বৈধ (সঙ্গত) নয়। এতে যা বলতে হয় তা হল; তাসবীহ, তকবীর ও কুরআন পাঠ।” (মুসলিম, মিশকাত ৯৭৮ নং)

উক্ত হাদীসে এ কথা উল্লেখ নেই যে, তিনি তাঁকে নামায ফিরিয়ে পড়তে বলেছিলেন। সুতরাং বুঝা গেল, অজান্তে কেউ কথা বলে ফেললে তার নামায নষ্ট হয়ে যাবে না। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/২৩৯)

উল্লেখ্য যে, নামাযের সূরা, দুআ-দরুদ ইত্যাদির অনুবাদও যদি নামাযে বলা হয়, তাহলেও নামায বাতিল হয়ে যাবে। কারণ, অনুবাদও মানুষের সাধারণ কথার শামিল।

প্রকাশ থাকে যে, কথা যদি নামায সংশোধন করার মানসেও বলা প্রয়োজন হয়, তবুও বলা বৈধ নয়। যেমন যদি ইমাম আসরের সময় জোরে ক্বিরাআত পড়তে শুরু করে এবং কোন মুক্তাদী তা সংশোধনের উদ্দেশ্যে বলে, ‘এটা আসরের নামায’ অথবা যদি ইমাম এক সিজদার পর বসে যায় এবং কোন মুক্তাদী ‘তাসবীহ’ বলার পরও বুঝতে না পারে যে, দ্বিতীয় সিজদাহ করতে হবে; ফলে সে উঠতে যায়। এ ক্ষেত্রে কোন মুক্তাদীর ‘সিজদাহ’ বা ‘সিজদাহ করুন’ বলাও বৈধ নয়। এরুপ বললে নামায বাতিল। কারণ, পূর্বেই আমরা জেনেছি যে, নামাযে কিছু ঘটলে মহানবী (ﷺ) আমাদেরকে (পুরুষের জন্য) তাসবীহ এবং (মহিলার জন্য) হাততালি বিধেয় করেছেন। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৬৪-৩৬৫)

এ বিষয়ে একটি ব্যতিক্রম ব্যাপার এই যে, কোন জামাআতের লোক ভুল করে চার রাকআতের জায়গায় তিন রাকআত পড়ে সালাম ফিরার পর মুক্তাদীদের কেউ এই ভুল সম্বন্ধে স্মরণ দিলে এবং ইমামও নিশ্চিত হওয়ার জন্য অন্যান্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সংশোধনের উদ্দেশ্যে আরো এক রাকআত নামায অবশ্যই পড়বে এবং সহু সিজদাহ করবে। আর এর মাঝে ইমাম-মুক্তাদীর ঐ কথোপকথন নামাযের জন্য ক্ষতিকর হবে না। যেহেতু এ কথা তখনই বলা হয়, যখন সালাম ফিরে দেওয়া হয়। আর তখন কথা বলা বৈধ। পক্ষান্তরে নিশ্চিত জানা যায় না যে, সত্যই নামায কম পড়া হয়েছে কি না। এ রকমই হয়েছিল মহানবী (ﷺ) ও সাহাবাগণের। (দেখুন, বুখারী ৭১৪, মুসলিম, সহীহ ৫৭৩ নং)

৪। পানাহার করা:-

নামায পড়তে পড়তে খেলে অথবা পান করলে নামায বাতিল হয়ে যায়। মুখের ভিতর পান, গালি (?), চুইংগাম প্রভৃতি রেখে নামায হয় না। কারণ এ কাজ নামাযের পরিপন্থী। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/২৪০, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ১৩০ পৃ:)

৫। হাসা:-

হাসলেও অনুরুপ কারণে নামায বাতিল পরিগণিত হয়। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/২৪০, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ১৩০পৃ:) অবশ্য কোন হাস্যকর জিনিস দেখে অথবা হাস্যকর কথা শুনে হাসি চেপে রাখতে না পেরে যদি কেউ মুচকি হাসি (শব্দ না করে) হেসে ফেলে, তাহলে তার নামায বাতিল হবে না।

প্রকাশ থাকে যে, নামাযী কে হাসাবার চেষ্টা করা তথা তার নামায নষ্ট করার কাজ শয়তানের। কোন মুসলিম মানুষের এ কাজ হওয়া উচিৎ নয়।

৬। পিতার হারাম উপায়ে উপর্জিত অর্থ খেলে ও ব্যয় করলে পুত্রের নামায বাতিল নয়। তবে সেই অর্থ ব্যবহার না করতে যথাসাধ্য প্রয়াস থাকতে হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে পরহেযগারী অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য চলার পথ সহ্‌জ করে দেন। আর তিনি তাকে এমন জায়গা থেকে রুযী দান করে থাকেন, যা সে বুঝতে ও কল্পনাই করতে পারে না। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬৪)

৭। ‘যাতে ওযূ নষ্ট হয় না’ শিরোনামে আলোচিত হয়েছে যে, গাঁটের নিচে কাপড় ঝুলিয়ে নামায পড়লে ওযূ ও নামায কিছুই বাতিল হয় না। অবশ্য এমন কাজ করলে তার উপর থেকে মহান আল্লাহর সুনজর ও দায়িত্ব উঠে যায়। আর ওযূ ও নামায বাতিল হওয়ার ব্যাপারে দলীলের হাদীস সহীহ নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩০১)

৮। কোন কারণে ইমামের নামায বাতিল হলে পশ্চাতে মুক্তাদীদের নামায বাতিল নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/৩১৫-৩১৭) এ বিষয়ে ইমামতির বিবরণ দ্রষ্টব্য।

১০। নামাযী যদি জানে যে তার সামনে দিয়ে কোন মহিলা, গাধা বা কালো কুকুর অতিক্রম করবে এবং এ জানা সত্ত্বেও বিনা সুতরায় নামায পড়ে, তাহলে ঐ তিনটের একটাও তার সামনে বেয়ে পার হয়ে গেলে তার নামায বাতিল। কারণ, সুতরার বিবরণে আমরা জেনেছি যে, ঐ তিনটি জিনিস নামায নষ্ট করে দেয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৪৩, ৩৯২)

অনুরুপ মুক্তাদীর সুতরাহ্‌ ইমামের সুতরাই। অতএব ইমাম সুতরাহ্‌ রেখে নামায না পড়লে এবং ঐ তিনটের একটা সামনে বেয়ে অতিক্রম করলে ইমাম-মুক্তাদী সকলের নামায বাতিল।

প্রকাশ যে, নামায পড়তে পড়তে নামায বাতিল হওয়া জানা গেলে অথবা ওযূ নষ্ট হওয়া বুঝতে পারলে সাথে সাথে নামায ছেড়ে বেরিয়ে আসা ওয়াজেব। লজ্জায় বা অন্য কারণে নামায শেষ করা হারাম এবং তা এক প্রকার আল্লাহর সাথে ব্যঙ্গ করা! কারণ, যা তিনি গ্রহণ করবেন না, তা জেনেশুনেও নিবেদন করতে থাকা উপহাস বৈকি? (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৯২-৩৯৩)

অবশ্য জামাআতে থাকলে লজ্জা হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষ করে হাওয়া বের হওয়ার ফলে ওযূ নষ্ট হলে অনেকে নামায বা জামাআত ত্যাগ করে কাতার ভেঙ্গে আসতে লজ্জা ও সংকোচবোধ করে। কিন্তু মহানবী (ﷺ) এই লজ্জা ঢাকার জন্য এক কৃত্রিম উপায়ের কথা বলে দিয়েছেন; তিনি বলেন, “যখন তোমাদের মধ্যে কেউ তার নামাযে নাপাক হয়ে যাবে তখন সে যেন তার নাক ধরে নেয়। অতঃপর বের হয়ে আসে।” (আবূদাঊদ, সুনান ১১১৪,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/১৮৪, মিশকাত ১০০৭ নং)

ত্বীবী বলেন, এই নির্দেশ এই জন্য যে, যাতে লোকেরা মনে করে তার নাকে রক্ত আসছে (তাই বের হয়ে যাচ্ছে)। আর এরুপ করা মিথ্যা নয়, বরং তা ‘তাওরিয়াহ্‌’ বা বৈধ অভিনয়। শয়তান যাতে তার মনে লোকদেরকে শরম করার কথা সুশোভিত না করে ফেলে (এবং নামায পড়তেই থেকে যায়)। তাই তার জন্য এ কাজের অনুমতি ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (আউনুল মা’বূদ, মিরকাত, মিশকাতের টীকা ১নং, ১/৩১৮)