সকল বিষয়ে যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য নিবেদিত। যিনি জীবন ও মৃত্যুর আবর্তন ঘটান, যাতে তিনি পরীক্ষা করতে পারেন, কে ভালো কাজ করে আর কে করে মন্দ কাজ। তাঁর আরো প্রশংসা করি এ জন্য যে, তিনি যুগে যুগে নবী ও গ্রন্থ পাঠিয়ে মানবসন্তানদেরকে জান্নাতের দিকে আহবান করেছেন আর জাহান্নাম থেকে সতর্ক করেছেন।

কিয়ামত পর্যন্ত আমাদের পক্ষ থেকে সালাত ও সালাম নিবেদিত হোক আমাদের রাসূল, আল্লাহর বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। যিনি আজীবন মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসতে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। তাঁর পরিবার পরিজন, সাহাবীদের প্রতিও সালাত ও বরকত নাযিল হোক মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে।

কিয়ামতের আলামত, কবরের আযাব, মরনের পরে ইত্যাদি নামে অনেক বই-পুস্তক বাজারে পাওয়া যায়; কিন্তু কোনোটিই যেন কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর মানদণ্ডে একশত ভাগ উন্নীত বলে দাবী করতে পারছি না। সেখানে যেমন আছে দূর্বল হাদীসের ছড়াছড়ি, তেমনি আছে সনদ-সুত্রবিহীন কথার ফুলঝুড়ি আর সপ্নের বর্ণনা ও অলীক কল্প-কাহিনী। আহওয়ালুল কিয়ামাহ নামক আরবী বইটি বেশ অনেক আগেই হাতে এসেছে। পাঠ শেষে নিয়ত করলাম অনুবাদ করে ফেলবো। চেষ্টা করলাম মাত্র। আল্লাহ যদি স্বীয় অনুগ্রহ ও দয়ায় এ শ্রমটুকু কবুল করেন তাহলে তার দীন প্রচারে অংশ নেওয়ার সওয়াব পাবো। আর যারা বইটি পড়বেন ও অন্যকে উপকৃত করবেন তারা কি মাহরূম হবেন? না, কখনো নয়। কেননা আল্লাহর অনুগ্রহ ব্যাপক।
বইটির আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে কয়েকটি কথা:

এক. বইটি শুরু করা হয়েছে কিয়ামত দিয়ে। তাই কিয়ামতের আলামতের বিষয়গুলো আলোচনা করা হয় নি।

দুই. কোনো একটি বিষয়ে একাধিক আয়াত ও হাদীস থাকা সত্বেও একটি আয়াত বা একটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে পাঠক যেন এ কথা বুঝে না নেন যে, এ বিষয়ে এর বাহিরে কোনো আয়াত বা হাদীস নেই।

তিন. অনুবাদের ক্ষেত্রে সকল আয়াত ও হাদীসের আরবী টেক্সট দেওয়া হয়েছে। যাতে সম্মানিত, ইমাম, খতীব, ওয়ায়েজীনে কেরাম, দাওয়াত-কর্মী ভাইয়েরা সাধারণ পাঠকের চেয়ে বেশি উপকৃত হতে পারেন। এবং এ বিষয়ে এ বইটি যেন তাদের জন্য একটি সংগ্রহ হিসেবে গণ্য হয়।

চার. অনুবাদ করার সাথে সাথে কুরআনের আয়াত ও হাদীসের ব্যাখ্যা আমি নিজে সংযোজন করেছি। এটি মুল গ্রন্থাকারের নয়। গ্রন্থকার শুধু শিরোনামের অধীনে আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করেছেন। কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করেন নি। যেহেতু তিনি বইটি আরবীভাষীদের জন্য লিখেছেন তাই ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন মনে করেন নি।


আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
২০ জিলহজ, ১৪৩০ হিজরী

হে আল্লাহর বান্দাগণ! কিয়ামত আসবেই। স্পষ্টভাবেই আসবে। আসবে সময় মত; কিন্তু মানুষ কি এ জন্য উপদেশ গ্রহণ করছে? নিচ্ছ কি কোনো প্রস্তুতি? আচ্ছা কিয়ামত না হয় আমরা দেখতে পাচ্ছি না এখন, কিন্তু প্রতিদিন আমাদের আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী, প্রতিবেশীর মৃত্যু তো আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এটাতো অস্বীকার করতে পারি না কিংবা এতে সন্দেহ করতে পারি না। তা সত্বেও এর জন্য আমরা কী প্রস্তুতি নিচ্ছি? কী উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ করছি?

আসলে আপনার সত্যিকার বন্ধু সে, যে আপনাকে এগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আর আপনার সত্যিকার শত্রু সে, যে আপনাকে দুনিয়ার লোভ লালসার পথ দেখায়। আখিরাত সম্পর্কে আপনাকে করে বিভ্রান্ত ও সন্দেহপ্রবণ।

আমাদের ভুলে গেল চলবে না এ পৃথিবী একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের সকলের উপস্থিত হতে হবে মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহর কাছে। এরপর হয়ত আমরা যাবো জান্নাতে অথবা জাহান্নামে, যেখানের বসবাস হবে স্থায়ী। যেখানে নেই কোনো জীবনাবসান।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّ وَعۡدَ ٱللَّهِ حَقّٞۖ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُم بِٱللَّهِ ٱلۡغَرُورُ ٥ إِنَّ ٱلشَّيۡطَٰنَ لَكُمۡ عَدُوّٞ فَٱتَّخِذُوهُ عَدُوًّاۚ إِنَّمَا يَدۡعُواْ حِزۡبَهُۥ لِيَكُونُواْ مِنۡ أَصۡحَٰبِ ٱلسَّعِيرِ ٦﴾ [فاطر: ٥، ٦]

“হে মানুষ, নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। অতএব দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে; আর বড় প্রতারক(শয়তান) যেন তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারণা না করে। নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু, অতএব তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য কর। সে তার দলকে কেবল এজন্যই ডাকে যাতে তারা জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসী হয়”। [সূরা আল-ফাতির, আয়াত: ৫-৬]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَا لَكُمۡ إِذَا قِيلَ لَكُمُ ٱنفِرُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ ٱثَّاقَلۡتُمۡ إِلَى ٱلۡأَرۡضِۚ أَرَضِيتُم بِٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا مِنَ ٱلۡأٓخِرَةِۚ فَمَا مَتَٰعُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا فِي ٱلۡأٓخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ ٣٨﴾ [التوبة: ٣٨]

“হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কী হলো, যখন তোমাদের বলা হয়, আল্লাহর রাস্তায় (যুদ্ধে) বের হ, তখন তোমরা যমীনের প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়? তবে কি তোমরা আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে সন্তুষ্ট হলে? অথচ দুনিয়ার জীবনের ভোগ-সামগ্রী আখিরাতের তুলনায় একেবারেই নগণ্য”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩৮]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَفَرِحُواْ بِٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَمَا ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَا فِي ٱلۡأٓخِرَةِ إِلَّا مَتَٰعٞ ٢٦ ﴾ [الرعد: ٢٦]

“আর তারা দুনিয়ার জীবন নিয়ে উৎফুল্লতায় আছে, অথচ আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন খুবই নগণ্য”। [সূরা আর-রাদ, আয়াত: ২৬]।

আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ، وَعَبْدُ الدِّرْهَمِ، وَعَبْدُ الخَمِيصَةِ، إِنْ أُعْطِيَ رَضِيَ، وَإِنْ لَمْ يُعْطَ سَخِطَ، تَعِسَ وَانْتَكَسَ، وَإِذَا شِيكَ فَلاَ انْتَقَشَ، طُوبَى لِعَبْدٍ آخِذٍ بِعِنَانِ فَرَسِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، أَشْعَثَ رَأْسُهُ، مُغْبَرَّةٍ قَدَمَاهُ، إِنْ كَانَ فِي الحِرَاسَةِ، كَانَ فِي الحِرَاسَةِ، وَإِنْ كَانَ فِي السَّاقَةِ كَانَ فِي السَّاقَةِ، إِنِ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ، وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّعْ»

“টাকা-পয়সার দাস ধ্বংস হোক, রেশম কাপড়ের দাস ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক পোশাকের দাস। এদের অবস্থা হলো, তাদেরকে প্রদান করা হলে খুশী হয় আর না দিলে অসন্তুষ্ট হয়। ধ্বংস হোক! অবনত হোক! (তাদের পায়ে) কাঁটা বিদ্ধ হলে তা কেউ তুলে দিবে না, তবে সৌভাগ্যবান আল্লাহর ঐ বান্দা যে আল্লাহর পথে ঘোড়ার লাগাম ধরেছে, মাথার চুল এলোমেলো করেছে ও পদদ্বয় ধুলায় ধূসরিত করেছে। যদি তাকে পাহারার দায়িত্ব দেওয়া তবে সে পাহারার দায়িত্ব পালন করে। যদি তাকে বাহিনীর পিছনে দায়িত্ব দেওয়া হয় তবে তা পালন করে। যদি সে নেতার সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি চায় তবে তাকে অনুমতি দেওয়া হয় না। যদি সে কারো জন্য সুপারিশ করে তবে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না।”[1]

আমার কত বন্ধু-ইচ্ছে করলে আমি তাদের নাম বলতে পারি- কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করায় লিপ্ত রয়েছে, পাপাচারের জেলখানায় বন্দি হয়ে আছে, কিন্তু তারা মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে একেবারে বে-খবর।

আর আল্লাহ যখন আমাকে হিদায়াত দিয়েছেন, তাঁর আনুগত্য করার তাওফীক দিয়েছেন তখন আমার কাজ হলো তাদের নসীহত করা এবং সত্য-সঠিক পথে যেতে সাহায্য করা।

চিন্তা করে দেখি আজ যদি আমার মৃত্যু এসে যেত তাহলে আমি কিছুক্ষণ পর মাটির নিচে চলে যাবো। আমার পাপগুলো লিখিত থাকতো, সেগুলোই আমার সঙ্গী হতো। এ কথা চিন্তা করলে নিজের কুপ্রবৃত্তি দমন হয়ে যেত। পাপাচারের উপকরণগুলো আমার থেকে দূরে চলে যেত।

হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় করুন। পৃথিবীর এ সুখ-শান্তি চলে যাচ্ছে, আর আখিরাত ক্রমেই এগিয়ে আসছে।

মৃত্যুর সময়ের কথা একটু চিন্তা করুন। তখন যদি আমার পাপের বোঝা ভারী হয় সৎকর্মের চেয়ে তাহলে কত বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে।

এক কবি চমৎকার বলেছেন,

فَلَوْ أنَّ إذَا مِتْنَا تُرِكْنَا   +  لَكَانَ المَوْتُ رَاحَةَ كُلِّ حيٍّ

وَ لَكِنَّا إذَا مِتْنَا بُعِثْنَا  +  وَنُسْأَلُ بَعْدَهُ عَنْ كُلِّ شَيءٍ

“যদি এমন হত আমরা মরে যাবো আর আমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে, তাহলে মৃত্যু হত সকল প্রাণীর জন্য শান্তির বার্তা। কিন্তু কথা হলো আমরা যখন মরে যাবো তখন আমাদের হাজির করা হবে, আর এরপর প্রশ্ন করা হবে সকল বিষয় সম্পর্কে”।

হে আল্লাহর বান্দা! আমি এ গ্রন্থে বরযখের অবস্থা, প্রাণ বের হয়ে যাওয়ার পরের অবস্থা, জান্নাত ও জাহান্নামের ইত্যাদির বর্ণনা আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। জীবনের প্রতি দীর্ঘ লোভ ও ভোগ-বিলাসিতার আশা পরিত্যাগ করুন, আর মৃত্যু পরবর্তী সময়ের জন্য প্রস্তুতি নিন।

মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন এ পুস্তকটি দিয়ে পাঠকদের, সর্বোপরি সকলকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দিন। জান্নাত লাভে আগ্রহীদের জন্য এটাকে সাহায্যকারী হিসাবে কবুল করুন।

আল্লাহ তা‘আলার কাছেই আমার সব বিষয় উপস্থাপিত। সব বিষয়ে আমি তার উপর তাওয়াক্কুল করি। আল্লাহ তা‘আলা আমার জন্য যথেষ্ট। তিনি সর্বোত্তম কর্ম-বিধায়ক। মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহর সামর্থ ছাড়া কেউ খারাপ কাজ থেকে ফিরে থাকতে পারে না। আর তার তাওফীক ব্যতীত কেউ নেক আমল করতে পারে না।

আব্দুল মালেক আল কুলাইব, কুয়েত
৪ জমাদিউস সানী ১৩৯৯ হিজরী

[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৮৮৭।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে