যুগে যুগে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণ বিদআতীদের বিদআতী কার্য-কলাপের সামনে কখনই চুপ থাকেননি। বরং সব সময়ই তারা প্রতিবাদ করেছেন এবং তাদের কর্মকান্ডে বাঁধা দিয়ে এসেছেন। সাহাবীদের যুগ থেকেই বিদআতীদের প্রতিবাদের সূচনা হয়েছে। পাঠক সমীপে এসম্পর্কে কতিপয় দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো:
১. উম্মে দারদা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আবু দারদা রাগান্বিত অবস্থায় একদা আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি বললাম, ব্যাপার কি? তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! জামা‘আতে সালাত আদায় করা ব্যতীত মুসলমানদের মধ্যে আমি নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।[1]
২. আমর ইবনে ইয়াহইয়া হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমার পিতাকে আমার দাদা হতে বর্ণনা করতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমরা একবার ফজরের সালাতের পূর্বে আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) এর ঘরের দরজার সামনে বসা ছিলাম। উদ্দেশ্য হলো, তিনি যখন বের হবেন, আমরা তার সাথে পায়ে হেঁটে মসজিদের দিকে যাত্রা করবো। এমন সময় আমাদের কাছে আবু মূসা আশআরী (রা.) আগমন করে বললেন, আবু আব্দুর রাহমান (ইবনে মাসউদের উপনাম) কি বের হয়েছেন? আমরা বললাম, এখনও বের হননি। তিনিও আমাদের সাথে বসে গেলেন। তিনি যখন বের হলেন, আমরা সকলেই তার কাছে গেলাম। আবু মূসা আশআরী (রা.) বললেন, হে আবু আব্দুর রাহমান! আমি মসজিদে এখনই একটি নতুন বিষয় দেখে আসলাম। আলহামদুলিল্লাহ্, এতে খারাপ কিছু দেখিনি। ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন সেটি কী? আবু মূসা (রা.) বললেন, আপনার হায়াত দীর্ঘ হলে আপনিও তা দেখতে পাবেন। আবু মূসা আশআরী (রা.) বললেন, আমি দেখলাম, মসজিদে একদল লোক গোলাকারে বসে সালাতের অপেক্ষা করছে। প্রত্যেক দলের মাঝখানে একজন লোক রয়েছে। আর সবার হাতে রয়েছে ছোট ছোট পাথর। মাঝখানের লোকটি বলছে, একশত বার আল্লাহু আকবার পাঠ করো। এতে সবাই একশতবার আল্লাহ আকবার পাঠ করছে। তারপর বলে, একশতবার আল-হাম্দুলিল্লাহ পাঠ করো। এ কথা শুনে সবাই একশতবার আল-হাম্দুলিল্লাহ পাঠ করছে। তারপর লোকটি বলে, এবার একশতবার সুবহানাল্লাহ্ পাঠ করো। সবাই একশতবার সুবহানাল্লাহ্ পাঠ করে। এ কথা শুনে ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তুমি তাদেরকে তাদের পাপের কাজগুলো গণনা করে রাখতে বললে না কেন? আর দায়িত্ব নিলে না কেন যে, তাদের নেকীর কাজগুলো থেকে একটি নেকীও নষ্ট হবে না। কাজেই এগুলো হিসাব করে রাখার কোন দরকার নেই।
অতঃপর ইবনে মাসউদ (রা.) চলতে থাকলেন। আমরাও তার সাথে চললাম এবং একটি হালাকার কাছে এসে উপস্থিত হলাম। তিনি তাদের কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, একি করছো তোমরা? তারা সকলেই বলল, পাথরের মাধ্যমে গণনা করে আমরা তাকবীর, তাসবীহ্ ইত্যাদি পাঠ করছি। ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন, তাহলে তোমরা তোমাদের পাপের কাজগুলোর হিসাব করো। কারণ পাপের কাজগুলো হিসাব করে তা থেকে তাওবা করা দরকার। আমি এ ব্যাপারে জিম্মাদার হলাম যে তোমাদের ভালো কাজগুলোর একটিও নষ্ট হবে না। এ কথা বলার কারণ এই যে আল্লাহর কাছে কারও আমল বিনষ্ট হয় না। বরং একটি আমলের বিনিময়ে দশটি ছাওয়াব দেয়া হয় এবং দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়।[2]
তারপর তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উম্মত! অমঙ্গল হোক তোমাদের! কিসে তোমাদেরকে এত তাড়াতাড়ি ধ্বংস করলো? এখনও নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অসংখ্য সাহাবী জীবিত আছেন। এই তো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাপড়-চোপড় এখনও পুরাতন হয়নি। তার ব্যবহৃত থালা-বাসনগুলো এখনও ভেঙ্গে যায়নি। ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা যে দীন তৈরী করেছ তা কি মুহাম্মাদের দীন হতে উত্তম? না কি তোমরা গোমরাহীর দ্বার উম্মুক্ত করেছো? তারা বলল, হে আবু আব্দুর রাহমান! আমরা এর মাধ্যমে কল্যাণ ছাড়া অন্য কোনো ইচ্ছা করিনি। তিনি বললেন অনেক কল্যাণকামী আছে, সে তার কল্যাণ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না।
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, একটি দল কুরআন তেলাওয়াত করবে, কিন্তু কুরআন তাদের গলদেশে প্রবেশ করবে না। আল্লাহর শপথ করে বলছি, মনে হয় তাদের অধিকাংশই তোমাদের মধ্য থেকে বের হবে। অতঃপর ইবনে মাসউদ (রা.) তাদেরকে ছেড়ে চলে আসলেন। আমর ইবনু সালামা (রা.) বলেন, আমরা তাদের অধিকাংশকেই দেখলাম, নাহ্রাওয়ানের যুদ্ধে খারেজীদের সাথে আমাদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে।[3]
৩. একজন লোক ইমাম মালেক (রহি.) এর নিকট আগমন করে বলল, আমি কোথা হতে ইহরাম বাঁধব? তিনি বললেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহরাম বাঁধার জন্য যে সমস্ত স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেখান থেকে ইহরাম বাঁধো। লোকটি বলল, আমি যদি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্ধারিত স্থান থেকে আরেকটু দূর হতে ইহরাম বাঁধি, তাহলে কি বৈধ হবে না? ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ বললেন, আমি ইহাকে বৈধ মনে করি না। সে বলল, আপনি ইহার মধ্যে অপছন্দের কি দেখলেন? তিনি বললেন, আমি তোমার উপর ফিত্নার আশঙ্কা করছি। সে বলল, ভালো কাজ বেশি করে করার ভিতর ফিত্নার কি আছে? ইমাম মালেক লোকটির এ কথা শুনে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
‘‘অতএব, যারা তার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, ফিতনা তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি তাদেরকে আক্রমণ করবে’’। (সূরা আন নূর: ৬৩)
এর চেয়ে বড় মুছীবত আর কি হতে পারে যে, তুমি এমন একটি ফযীলতের মাধ্যমে নিজেকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করতে চাচ্ছ, যার মাধ্যমে স্বয়ং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেননি।[4]
[1]. সহীহ বুখারী, হা/৬৫০
[2]. অনুবাদক।
[3]. তিরমিযী।
[4]. ইমাম মালেক থেকে আরেকটি প্রসিদ্ধ কথা বর্ণিত: একদা এক বিদআতী লোক তার মজলিসে প্রবেশ করে বলল,
﴿الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى﴾
‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপর সমুন্নত’’। (সূরা ত্বহা: ৫) সে বললো আল্লাহ কিভাবে আরশে সমুন্নত হলেন? জবাবে ইমাম মালেক (রহি.) বললেন,
الاستواء معلوم والكيف مجهول والإيمان واجب والسوال عنه بدعة
অর্থাৎ ইস্তিওয়া তথা সমুন্নত হওয়া একটি জানা বিষয়, পদ্ধতি অজানা, এর উপর ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব এবং এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদআত। প্রশ্নকারী এই জবাবে সন্তুষ্ট না হওয়ায় তাকে ইমাম মালেক (রহি.) এর মজলিস থেকে বের করে দেয়া হল।
বিদআতের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে সালাফদের থেকে এমনি আরো অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ কয়েকটি উদাহরণই পাঠক সমাজের জন্য পেশ করা হল। আশা করি এতেই যথেষ্ট হবে।