আমাদের দেশের কিছু কিছু আলেম বিদআতকে হাসানা এবং সাইয়্যেআ, এ দুই শ্রেণীতে ভাগ করে থাকে। বিদআতকে এভাবে ভাগ করা সম্পূর্ণ ভুল এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীছের সম্পূর্ণ বিপরীত। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী বা ভ্রষ্টতা। আর এই শ্রেণীর আলেমগণ বলে থাকে, প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী নয়। বরং এমন কিছু বিদআত রয়েছে, যা হাসানা বা উত্তম বিদআত।
হাফেয ইবনে রজব (রহি.) বলেন, ‘‘প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী’’ এটি খুব সংক্ষিপ্ত একটি বাক্য হলেও তার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক ও পরিপূর্ণ। এখানে প্রতিটি বিদআতকেই গোমরাহী বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদআতের কোন প্রকারকেই হাসানা বলেননি। এই হাদীছটি দীনের অন্যতম মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর রসূলের বাণী ‘‘যে ব্যক্তি আমাদের দীনের মধ্যে নতুন কিছু আবিষ্কার করল, যা আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত। অতএব যে ব্যক্তি কোন নতুন বিধান রচনা করে দীনের মাঝে প্রবেশ করিয়ে দিবে, তা গোমরাহী বলে বিবেচিত হবে। তা থেকে দীন সম্পূর্ণ মুক্ত। চাই সে বিষয়টি বিশ্বাসগত বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হোক অথবা প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য আমলগত বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হোক। সুতরাং বিদআতে হাসানার পক্ষে মত প্রকাশকারীদের কোন দলীল নেই। কিছু লোক তারাবীর নামাযের ব্যাপারে উমার (রা.)এর উক্তি, এটি কত উত্তম বিদআত! এ কথাটিকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। তারা আরও বলেন, এমন অনেক বিদআত আবিষ্কৃত হয়েছে, যা সালাফে সালেহীনগণ সমর্থন করেছেন। যেমন গ্রন্থাকারে কুরআন একত্রিত করণ, হাদীছ সঙ্কলন করণ ইত্যাদি।
উপরোক্ত যুক্তির উত্তর এ যে, শরী‘আতের ভিতরে এ বিষয়গুলোর মূলভিত্তি রয়েছে। এ গুলো নতুন কোন বিষয় নয়। উমার (রা.) এর কথা, ‘‘এটি একটি উত্তম বিদআত’’ এর দ্বারা তিনি বিদআতের শাব্দিক অর্থ গ্রহণ করেছেন। ইসলামের পরিভাষায় যাকে বিদআত বলা হয়, সে অর্থ গ্রহণ করেননি। মৌলিকভাবে ইসলামী শরী‘আতে যে বিষয়ের অস্তিত্ব রয়েছে, তাকে বিদআত বলা হয়নি। এমন বিষয়কে যদি বিদআত বলা হয়, তার অর্থ দাড়ায় জিনিসটি শাব্দিক অর্থে বিদআত, পারিভাষিক অর্থে বিদআত নয়। সুতরাং শরী‘আতের পরিভাষায় এমন বিষয়কে বিদআত বলা হয়, যার পক্ষে কোনো দলীল-প্রমাণ নেই।
আর গ্রন্থাকারে কুরআন সংকলনের পক্ষে দলীল রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের আয়াতসমূহ লেখার আদেশ দিয়েছেন। তবে এই লেখাগুলো এক স্থানে একত্রিত অবস্থায় ছিল না। তা ছিল বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। সাহাবীগণ তা এক গ্রন্থে একত্রিত করেছেন। যাতে কুরআনের যথাযথ হেফাযত করা সম্ভব হয়।
তারাবীর নামাযের ব্যাপারে সঠিক কথা হল, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাহাবীদেরকে নিয়ে জামা‘আত বদ্ধভাবে কয়েক রাত পর্যন্ত তারাবীর সালাত আদায় করেছেন। ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় পরবর্তীতে তা ছেড়ে দিয়েছেন। আর সাহাবীগণের প্রত্যেকেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবিত থাকা কালে ও মৃত্যুর পর একাকী এ সালাত আদায় করেছেন। পরবর্তীতে উমার (রা.) সবাইকে এক ইমামের পিছনে একত্রিত করেছেন, যেমনিভাবে তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পিছনে তার ইমামতিতে এ সালাত আদায় করতেন। তাই ইহা বিদআত নয়।
হাদীছ লিখিতভাবে সংরক্ষণের ব্যাপারেও দলীল রয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতিপয় সাহাবীর জন্য তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাদীছ লিখে দেয়ার আদেশ দিয়েছেন। বিদায় হজ্জের ভাষণ দেয়ার পর আবু শাহ নামক জনৈক সাহাবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে ভাষণটি লিখে দেয়ার আবেদন করলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, «اكتبوا لأبى شاه» অর্থাৎ আবু শাহের জন্য আমার আজকের ভাষণটি লিখে দাও। তবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে সুনির্দিষ্ট কারণে ব্যাপকভাবে হাদীছ লেখা নিষেধ ছিল। যাতে করে কুরআনের সাথে হাদীছ মিশ্রিত না হয়ে যায়। পরবর্তীতে যখন তিনি ইমেত্মকাল করলেন এবং কুরআনের সাথে হাদীছ মিশ্রিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দূরিভুত হলো, তখন মুসলমানগণ হাদীছ সংরক্ষণ করে রাখার জন্য তা লেখা র কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। যারা এ মহান কাজে আঞ্জাম দিয়েছেন, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা উত্তম বিনিময় দান করুন। কারণ তারা আল্লাহর কিতাব এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাতকে বিলুপ্তির আশঙ্কা থেকে হেফাজত করেছেন।