ইয়াজুজ-মা’জুজের দৈহিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য

তাদের দৈহিক গঠন ও বৈশিষ্ট সম্পর্কে ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, তারা তাদের অনারব স্বজাতীয় তুর্কী মোগল সন্তানদের মতই কঠিন প্রকৃতির হবে। তাদের চোখ হবে ছোট, নাক হবে খাটো এবং মাথার চুল হবে লাল। তাদের আকৃতি ও রং হবে তুর্কীদের মতোই। যারা মনে করে ইয়াজুজ-মা’জুজের কতক লোক লম্বা খেজুর গাজের মতো অথবা তার চেয়ে বেশি লম্বা, যারা মনে করে তাদের কেউ কেউ নিকৃষ্ট আকৃতির একদম খাটো এবং যারা মনে করে তাদের কারো কারো রয়েছে বৃহদাকার দু’টি কান, একটি দিয়ে গা ঢেকে রাখে ও অন্যটিকে বালিশ হিসাবে ব্যবহার করে, তারা কেবল বিনা ইলম ও বিনা দলীলে বানিয়ে কথা বলে।

পৃথিবীতে তাদের কারণে মানুষ যে কষ্ট পাবে, তারা যে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং যেভাবে তাদের শেষ পরিণতি হবে সে ব্যাপারে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ইয়াজুজ-মা’জুজ মানব সমাজে বের হবে।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ يَنسِلُونَ﴾ ‘‘তারা প্রত্যেক উঁচু ভূমি থেকে দলে দলে ছুটে আসবে’’। (সূরা আন্বীয়া: ৯৬)

তারা মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়বে। তাদের ভয়ে লোকেরা পশুপাল নিয়ে শহর ও দুর্গে আশ্রয় নিবে। তারা যমীনের সমস্ত পানি পান করে শেষ করে ফেলবে। তাদের কেউ কেউ নদীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় সেটার সমস্ত পানি পান করে একদম শুকিয়ে ফেলবে। পরবর্তীরা তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলবে, এ নদীতে তো এক সময় পানি ছিল। তারা যখন পৃথিবীর সব মানুষ হত্যা করে শেষ করে ফেলবে এবং কোনো কোনো দুর্গে কিংবা শহরে পালিয়ে মাত্র দু’একজন মানুষ অবশিষ্ট থাকবে, তখন তাদের কেউ বলবে, যমীন বাসীকে হত্যা করে শেষ করে ফেলেছি। এখন কেবল আসমানের বাসিন্দারাই বাকি আছে। অতঃপর তাদের একজন বর্শা নাড়া দিয়ে আসমানের দিকে সেটা নিক্ষেপ করবে। বর্শাটি ফিতনা স্বরূপ তাদের নিকট রক্তাক্ত অবস্থায় ফেরত আসবে।

তখন আল্লাহ তা‘আলা ইয়াজুয-মা’জুজের ঘাড়ে উটের নাকের পোকার মতো ছোট ছোট এক ধরণের পোঁকা প্রেরণ করবেন। পোঁকাগুলোর আক্রমণে এ বাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর তাদের আর কোনো আওয়াজ পাওয়া যাবে না। মুসলিমরা তখন বলবে, এমন কেউ আছে কি যে তার নিজেকে আমাদের জন্য উৎসর্গ করবে এবং দেখার চেষ্টা করবে এ দুশমনদের কী অবস্থা হয়েছে? এতে তাদের একজন ছাওয়াবের আশায় অগ্রসর হবে। সে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও দুর্গ হতে বের হবে। সে তাদের একজনের উপর অন্যজনকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখবে। সে এই বলে আহবান করবে যে, হে মুসলিমগণ! তোমরা সুখবর গ্রহণ করো, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের শত্রুকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এ কথা শুনে তারা তাদের দুর্গ ও শহর থেকে বের হয়ে আসবে। তারা তাদের পশুপাল ছাড়বে। পশুপালের জন্য ইয়াজুজ-মা’জুজের মরা দেহ ছাড়া আর কোনো খাবার থাকবে না। ঘাস ও তৃণলতা খেয়ে পশুগুলো যত মোটা-তাজা হয়নি, তার চেয়ে বেশি মোটা-তাজা হবে ইয়াজুজ-মা’জুজের মতৃদেহ ভক্ষণ করে।

ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইউনুস ইবনে বুকাইর মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক থেকে এভাবেই বর্ণনা করেছেন। এ সনদটি ভালো। বর্তমান কালের কিছু লেখক ইয়াজু-মা’জুজ বিদ্যমান থাকা এবং তাদের প্রাচীর থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, শিল্পোন্নত কাফের রাষ্ট্রসমূহের নাগরিকরাই ইয়াজুজ-মা’জুজ। নিঃসন্দেহে এটি কুরআনের আয়াতকে অস্বীকার করা কিংবা এর আসল অর্থ বাদ দিয়ে অন্য অর্থে ব্যাখ্যা করার শামিল। যে ব্যক্তি কুরআনের কোনো বিষয় অথবা নবী করীম সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত কোনো বিষয়কে অস্বীকার করবে, সে কাফের হয়ে যাবে। তবে যে ব্যক্তি কুরআন ও হাদীছের কোনো বিষয়কে অসম্ভাব্য কোনো অর্থে ব্যাখ্যা করবে, সে গোমরাহ বলে বিবেচিত হবে এবং তার কুফুরীতে নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

যারা ইয়াজুজ-মা’জুজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তাদের কাছে এ ছাড়া অন্য কোনো দলীল নেই যে, তারা বলে থাকে, পৃথিবীতে যত শুকনো জায়গা আছে তা সবই আবিস্কৃত হয়েছে; কিন্তু কোথাও ইয়াজুজ-মা’জুজ কিংবা তাদের প্রাচীর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

উপরোক্ত কথার জবাব হলো, আবিষ্কারকরা অনুসন্ধান করে ইয়াজুজ-মা’জুজ ও তাদের প্রাচীর না পাওয়া তাদের অস্তিত্বহীনতার কথা প্রমাণ করে না। বরং আল্লাহ তা‘আলার রাজত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান অর্জন করতে মানুষের অক্ষমতা প্রমাণিত হয়। সম্ভবত আল্লাহ তা‘আলা তাদের দৃষ্টিকে ইয়াজুজ-মা’জুজ ও তাদের প্রাচীর থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন অথবা এমন কিছু জিনিসকে প্রতিবন্ধক করে দিয়েছেন, যার কারণে তারা তাদের পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক জিনিসের উপর ক্ষমতাবান এবং প্রত্যেক জিনিষের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَكَذَّبَ بِهِ قَوْمُكَ وَهُوَ الْحَقُّ ۚ قُل لَّسْتُ عَلَيْكُم بِوَكِيلٍ لِّكُلِّ نَبَإٍ مُّسْتَقَرٌّ ۚ وَسَوْفَ تَعْلَمُونَ﴾

‘‘তোমার জাতি তো ওটাকে মিথ্যা বলেছে। অথচ তা সত্য। বলো, আমি তোমাদের কার্যনির্বাহক নই। প্রত্যেক খবর প্রকাশিত হবার একটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে এবং শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে’’। (সূরা আনআম: ৬৬-৬৭)

বর্তমান সময়ের গবেষকগণ পেট্রোলসহ অন্যান্য যেসব খণিজ সম্পদ আবিষ্কার করেছে প্রথম যুগের মুসলিমগণ তা খুঁজে না পাওয়া এবং তা আবিষ্কার করতে না পারার কারণ হলো, আল্লাহ তা‘আলা তা বের হওয়ার জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে রেখেছেন। নির্ধারিত সময় না হওয়ায় সাহাবী, তাবেঈ কিংবা তাদের কাছাকাছি যুগে তা বের হয়নি।