আল ইরশাদ-সহীহ আকীদার দিশারী الشرك الأصغر - বা ছোট শিরক শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান ১ টি

নিয়ত ও উদ্দেশ্যের মধ্যে যে শিরক হয়, সেটাকে গোপন শিরক বলা হয়। যেমন الرياء বা লোক দেখানো আমল। গোপন শিরক দুই প্রকার।

ক) الرياء বা লোক দেখানো আমল: الرياء শব্দটি الرؤية শব্দ থেকে বের হয়েছে। মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে ইবাদত প্রকাশ করাকে রিয়া বলা হয়। যাতে করে লোকেরা ইবাদতকারী লোকটির প্রশংসা করে। الرياء এবং السمعة এর মধ্যে পার্থক্য হলো মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে যে আমল করা হয় এবং যা চোখ দিয়ে দেখা যায় তাকে الرياء বলা হয় যেমন সালাত দান-খয়রাত ইত্যাদি এবং যে আমল মানুষকে শুনানোর উদ্দেশ্যে করা হয় এবং যা কান দিয়ে শুনা যায়, তাকে السمعة বলা হয় যেমন কুরআন পাঠ করা, ওয়ায করা যিকির-আযকার করা ইত্যাদি। যেসব আমল মানুষ তাদের কথা-বার্তায় উল্লেখ করে এবং অন্যদেরকে জানায় তাও السمعة-এর মধ্যে গণ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا﴾

‘‘হে নবী! বলোঃ আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার নিকট অহী পাঠানো হয় এই মর্মে যে, তোমাদের ইলাহ মাত্র এক। অতএব যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে সে যেন সৎ আমল করে এবং তার পালনকর্তার এবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে’’। (সূরা কাহাফ: ১১০)

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহ তা‘আলা যেমন এক, তিনি ছাড়া অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই, ঠিক তেমনি ইবাদত একমাত্র তার জন্যই হওয়া চাই, তিনি এক এবং তার কোনো শরীক নেই। সুতরাং তিনিই যেহেতু একমাত্র ইলাহ তাই একমাত্র তারই ইবাদত করা উচিত। রিয়া থেকে যে আমল মুক্ত হয় এবং যা সুন্নাত মোতাবেক হয়, সেটাকেই সৎ আমল হিসাবে গণ্য করা হয়। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ।

যারা লোকদেরকে দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে শাস্তির ভয় দেখিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ (৬) وَيَمْنَعُونَ الْمَاعُونَ﴾

‘‘ধ্বংস ঐ সমস্ত সালাত আদায়কারীদের জন্য যারা সালাতের ব্যাপারে উদাসীন। যারা লোকদেরকে দেখানোর উদ্দেশ্যে সালাত পড়ে এবং যারা গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় ছোটখাটো জিনিস সাহায্য দেয়া থেকে বিরত থাকে’’। (সূরা আল মাউন: ৪-৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো সংবাদ দিয়েছেন যে, রিয়া হলো মুনাফেকদের লক্ষণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ الْمُنَافِقِينَ يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ وَإِذَا قَامُوا إِلَى الصَّلَاةِ قَامُوا كُسَالَى يُرَاءُونَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ اللَّهَ إِلَّا قَلِيلًا﴾

‘‘অবশ্যই মুনাফেকরা ধোঁকাবাজি করছে আল্লাহর সাথে, অথচ আল্লাহই তাদেরকে ধোঁকার মধ্যে ফেলে রেখেছেন। তারা যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন একান্ত শিথিলভাবে লোক দেখানোর জন্যই দাঁড়ায়। আর তারা আল্লাহ্কে অল্পই স্মরণ করে’’। (সূরা আন নিসা: ১৪২)

 আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ‘মারফু’ হাদীসে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلاً أَشْرَكَ فِيهِ مَعِى غَيْرِى تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ

‘‘যেসব মাবুদকে আমার সাথে শরীক ধারণা করা হয়, আমি তাদের সকলের শিরক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যে ব্যক্তি কোনো আমল করে এবং ঐ আমলে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করে, আমি ঐ ব্যক্তিকে এবং তার শিরককে প্রত্যাখ্যান করি’’।[1]

অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার আমলের মাধ্যমে আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো সৃষ্টির সন্তুষ্টি তালাশ করবে, আমি তাকে বর্জন করি এবং শিরককেও বর্জন করি। ইবনে মাজার অন্য বর্ণনায় এসেছে, সে আমলের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। যাকে সে আমার সাথে শরীক করেছে, সেটা তার জন্যই।

ইমাম ইবনে রজব রহিমাহুল্লাহ বলেন, জেনে রাখুন যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যের উদ্দেশ্যে কৃত আমলগুলো কয়েক প্রকার। কখনো কখনো আমলের মধ্যে শুধু রিয়াই থাকে। এ রকমই হলো মুনাফেকদের অবস্থা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِذَا قَامُوا إِلَى الصَّلَاةِ قَامُوا كُسَالَى يُرَاءُونَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ اللَّهَ إِلَّا قَلِيلًا﴾

‘‘তারা যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন একান্ত শিথিলভাবে লোক দেখানোর জন্যই দাঁড়ায়। আর তারা আল্লাহ্কে অল্পই স্মরণ করে’’। (সূরা আন নিসা: ১৪২)

এ ধরণের রিয়া মুমিনদের থেকে প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিশেষ করে ফরয সালাত  ও ফরয রোযার মধ্যে এ ধরণের রিয়া মুমিনদের থেকে হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে সাদকা, ফরয হজ্জ ইত্যাদি প্রকাশ্য আমলের মধ্যে কিংবা যেসব আমল দ্বারা অন্য লোক উপকৃত হয়, তাতে কখনো কখনো মুমিনদের থেকে এ ধরণের আমলের মধ্যে রিয়া আসতে পারে। এতে ইখলাস ধরে রাখা কঠিন। এ জাতিয় আমল বাতিল হওয়ার ব্যাপারে কোনো মুসলিম সন্দেহ পোষণ করতে পারে না। রিয়াকারীগণ আল্লাহর অসন্তুষ্টি এবং শাস্তি পাওয়ার হকদার।

কখনো কখনো আল্লাহর জন্যই আমল শুরু করা হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তার মধ্যে রিয়া প্রবেশ করে। আমলের শুরুতেই যদি রিয়া প্রবেশ করে, তাহলে কুরআন-সুন্নাহর দলীলসমূহ প্রমাণ করে যে, সে আমলটি সম্পূর্ণরূপে বাতিল হবে। আর যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আমল শুরু করা হয়, অতঃপর তাতে রিয়া প্রবেশ করে, তাহলে রিয়াটি যদি মনের কল্পনার মধ্যেই সীমিত থাকে এবং আমলকারী সেটাকে প্রতিহত করে ফেলে, তাহলে আলেমদের ঐক্যমতে এ রিয়া ক্ষতিকর নয়। আর আমলের সাথে সাথে যদি রিয়া অব্যাহত থাকে, তাহলে তার আমলটি বাতিল হয়ে যাবে কি না এবং বাতিল না হলে শুরুতে নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়ার কারণে বিনিময় দেয়া হবে কি না, সে ব্যাপারে সালাফদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং ইবনে জারীর রাহিমাহুমাল্লাহ আলেমদের মতভেদ উল্লেখ করার পর প্রাধান্য দিয়েছেন যে, তার আমল বাতিল হবে না। শুরুতে নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়ার কারণে সে আমলের ছাওয়াবও প্রাপ্ত হবে। হাসান বসরী এবং অন্যান্য আলেম থেকে এটি বর্ণিত হয়েছে। ইবনে রজব রাহিমাহুল্লাহর বক্তব্য এখানেই শেষ।

প্রিয় দীনি ভাইগণ! শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদের জান হেফাযত করা এবং চোরদের কবল থেকে নিজেদের মাল হেফাযত করার চেয়ে শিরক থেকে আমল হেফাযত করার গুরুত্ব অনেক বেশী। কেননা শিরকের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। আমরা আমাদের নিজেদের জন্য এবং আপনাদের সকলের জন্য আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা এবং কথায় ও কাজে এখলাস প্রার্থনা করছি।

খ) মানুষের নেক আমল দ্বারা নিছক পার্থিব স্বার্থ হাসিলের নিয়ত করা ছোট শিরক:

নেক আমলের মাধ্যমে পার্থিব উদ্দেশ্য হাসিলের নিয়ত করা এক প্রকার শিরক। নিয়ত ও উদ্দেশ্যের মধ্যে এ প্রকার শিরক হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে এবং নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সুন্নাতে এ প্রকার শিরক থেকে সতর্ক করেছেন। যেমন কেউ দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের লোভে এমন নেক আমল করলো, যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি কামনা করা হয়। এটি এমন শিরক, যা তাওহীদের পূর্ণতার পরিপন্থী। সেই সঙ্গে ইহা মানুষের সৎ আমলগুলোকেও বরবাদ করে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾

‘‘যারা শুধু দুনিয়ার জীবন এবং এর চাকচিক্য কামনা করে, আমি তাদের সব কাজের প্রতিদান দুনিয়াতেই দিয়ে থাকি এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয় না। এরাই হলো সেসব লোক আখিরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া অন্য কিছু নেই। তারা এখানে যা কিছু করেছিল সবই বরবাদ হয়েছে; আর যা কিছু উপার্জন করেছিল, সবই বিনষ্ট হল’’। (সূরা হুদ: ১৫-১৬)

আল্লাহ তা‘আলা উপরোক্ত আয়াত দু’টিতে সংবাদ দিয়েছেন, যে ব্যক্তি তার আমলের মাধ্যমে শুধু পার্থিব উদ্দেশ্য হাসিলের নিয়ত করবে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতেই তার আমলের ছাওয়াব পরিপূর্ণরূপে দান করবেন। তাকে সুস্বাস্থ্য এবং ধন-সম্পদ, পরিবার-পরিজন ও সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে প্রচুর সুখ-শান্তি দান করবেন। আর এটিও আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা দুনিয়ার নিয়ামত দান করেন। যেমন তিনি অন্য আয়াতে বলেন,

﴿مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَدْحُورًا﴾

 ‘‘যে কেউ ইহকাল কামনা করে, আমি সেসব লোককে যা ইচ্ছা সত্তর দিয়ে দেই। অতঃপর তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করি। ওরা তাতে নিন্দিত-বিতাড়িত অবস্থায় প্রবেশ করবে’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ১৮)

যারা দুনিয়ার নিয়ামত হাসিলের উদ্দেশ্যে সৎ আমল করবে, তারা জাহান্নামের আগুন ছাড়া আর কিছুই পাবে না। কেননা তারা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে সৎ আমল করেনি। সুতরাং আখিরাতে তাদের আমলগুলো বাতিল হবে এবং এর কোনো ছাওয়াব পাবে না। কেননা তারা আখিরাতের উদ্দেশ্যে আমল করেনি।

প্রখ্যাত তাবেঈ কাতাদাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এখানে বলেছেন, দুনিয়া হাসিল করা যার উদ্দেশ্য হয় এবং দুনিয়া কামাই করার জন্য যে আমল করে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে দুনিয়াতেই তার সৎ আমলের বিনিময় প্রদান করবেন। অতঃপর সে আখিরাতে গিয়ে এমন কোনো সৎ আমল খুঁজে পাবেনা, যার বিনিময় দেয়া যেতে পারে। আর মুমিন ব্যক্তির ব্যাপারে কথা হলো, আল্লাহ তা‘আলা তাকে দুনিয়াতে সৎ আমলের ছাওয়াব প্রদান করবেন এবং আখিরাতেও তাকে উত্তম বিনিময় প্রদান করবেন।

শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, সালাফদের থেকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় অনেক আমলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আজকাল মানুষ এগুলো করে থাকে, কিন্তু তারা এগুলোর অর্থ বুঝে না। তার মধ্যে,

(ক) অনেক মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সৎ কাজ করে থাকে। যেমন তারা দান-সাদকা করে, সালাত কায়েম করে, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সদাচরণ করে, মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করে, যুলুম-অত্যাচার পরিহার করে এবং অনুরূপ অন্যান্য যেসব সৎ আমল মানুষ করে থাকে কিংবা যেসব অন্যায় কাজ আল্লাহর জন্য পরিহার করে থাকে তাতে যদি তারা আখিরাতে ছাওয়াবের নিয়ত না করে; বরং এ নিয়ত করে যে, আল্লাহ তা‘আলা যেন এর বিনিময়ে তাদের ধন-সম্পদ হেফাযত করেন, সেটা আরো বাড়িয়ে দেন, তাদের পরিবার-পরিজনের হেফাযত করেন অথবা তাদের পার্থিব নিয়ামত দীর্ঘস্থায়ী করেন, তাহলে তারা দুনিয়াতেই মিনিময় পেয়ে যাবে। আখিরাতে জান্নাত লাভ কিংবা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার কোনো চিন্তাই যেহেতু তাদের মাথায় থাকেনা, তাই এ শ্রেণীর লোকদের সৎ আমলের ছাওয়াব দুনিয়াতেই প্রদান করা হয়। আখিরাতের নিয়ামত ও সুখ-শান্তিতে তাদের কোনো হিস্সা থাকবে না। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা এ শ্রেণীর মানুষ থাকার কথা উল্লেখ করেছেন।

(খ) এটি প্রথমটির চেয়ে গুরুতর এবং ভয়ানক। ইমাম মুজাহিদ উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন যে, একে কেন্দ্র করেই আয়াতটি নাযিল হয়েছে। তা হলো কিছু মানুষ এমন সৎ আমল করে থাকে, যাতে তার নিয়ত হলো মানুষকে দেখানো; আখিরাতে ছাওয়াব অর্জন করার নিয়ত তার মধ্যে মোটেই থাকে না।

(গ) কিছুলোক রয়েছে, যারা ধন-সম্পদ অর্জনের উদ্দেশ্যে সৎ আমল করে। যেমন সম্পদ কামানোর উদ্দেশ্যে হজ্জে যায়, দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে অথবা বিবাহ করার জন্য হিজরত করে কিংবা গণীমতের মাল লাভ করার জন্য জিহাদ করে। উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় এ শ্রেণীর আমলের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। অনুরূপ মানুষ নিজের পরিবারকে শিক্ষা দেয়ার জন্য অথবা তাদের জন্য জীবিকা উপার্জন করার উদ্দেশ্যে কিংবা নেতৃত্ব হাসিল করার জন্য ইলম অর্জন করে থাকে। এমনি কোনো কোনো মানুষ ইমামতি করার জন্য কুরআন শিক্ষা করে এবং যথাসময়ে মসজিদে গিয়ে সালাত  কায়েম করে। এ রকম উদাহরণ অনেক রয়েছে।

(ঘ) এমন লোকও রয়েছে, যারা নিষ্ঠাবান হয়ে একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য করে যে, তার কোনো শরীক নেই। কিন্তু আল্লাহর আনুগত্য করার সাথে সাথে এমন আমলও করে, যা তাদেরকে কাফের বানিয়ে ফেলে এবং ইসলাম থেকে সম্পূর্ণরূপে বের করে দেয়। যেমন ইয়াহূদী-নাসারাগণ যখন আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি  লাভের আশা এবং আখিরাতের কল্যাণের আশায় তার ইবাদত করে, দান-সাদকা করে এবং রোযা রাখে তেমনি এ উম্মতের মধ্যেও অনেক লোক রয়েছে, যারা খালেসভাবে আল্লাহর আনুগত্য করে, তারা এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আখিরাতে ছাওয়াব কামনা করে, কিন্তু তাদের মধ্যে শিরক ও কুফুরী রয়েছে, যা তাদেরকে ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ বের করে দেয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, তারা একদিকে যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সৎ আমল করে অন্যদিকে তারা এমন আমলও করে যা তাদেরকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় এবং তাদের সৎ আমলগুলো কবুলের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আনাস ইবনে মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং অন্যান্য সাহাবী থেকে এ শ্রেণীর লোক ও তাদের আমলের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সালাফগণ এ শ্রেনীর আমলের ভয় করতেন। শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রাহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ।

উপরোক্ত আয়াত দু’টি এ চার শ্রেণীর মানুষ ও তাদের আচরণকে শামিল করেছে। কেননা তাতে উল্লেখিত শব্দগুলো ব্যাপকার্থবোধক। বিষয়টি অত্যন্ত ভয়াবহ। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের উচিত আখিরাতের আমলের মাধ্যমে দুনিয়ার লোভ-লালসা বাস্তবায়ন করা থেকে সতর্ক হওয়া।

সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি শুধু দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে আমল করবে, সে তার সকল প্রচেষ্টাসহ দুনিয়ার পিছনেই ছুটবে। এমনকি সে দুনিয়ার গোলামে পরিণত হবে।

সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ تَعِسَ عَبْدُ الدِّرْهَمِ تَعِسَ عَبْدُ الْخَمِيصَةِ تَعِسَ عَبْدُ الْخَمِيْلَةِ إِنْ أُعْطِيَ رَضِيَ وَإِنْ لَمْ يُعْطَ سَخِطَ تَعِسَ وَانْتَكَسَ وَإِذَا شِيكَ فَلا انْتَقَشَ طُوبَى لِعَبْدٍ آخِذٍ بِعِنَانِ فَرَسِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَشْعَثَ رَأْسُهُ مُغْبَرَّةٍ قَدَمَاهُ إِنْ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ وَإِنْ كَانَ فِي السَّاقَةِ كَانَ فِي السَّاقَةِ إِنِ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّع

‘‘ধ্বংস হোক দীনারের গোলাম, ধ্বংস হোক দিরহামের গোলাম, ধ্বংস হোক উত্তম চাদরের দাস, ধ্বংস হোক নরম পোষাকের গোলাম! তাকে কিছু দেয়া হলে সন্তুষ্ট হয়। আর না দেয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়। সে ধ্বংস হোক, উল্টে পড়ুক। সে যখন কাঁটাবিদ্ধ হবে তখন তা খুলতে না পারুক। সুখবর ঐ ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য ঘোড়ার লাগাম ধরে আছে। তার মাথা ধুলোমলিন এবং পা দু’টি ধূলোয় ধুসরিত। তাকে সেনাবাহিনীর পাহারায় নিয়োজিত করা হলে সেখানেই নিয়োজিত থাকে। আর তাকে সেনাবাহিনীর পশ্চাতে রাখা হলে সে তাতেই সন্তুষ্ট থাকে। সে অনুমতি প্রার্থনা করলে তাকে অনুমতি দেয়া হয় না। কারো জন্য সুপারিশ করলে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না’’।[2]

تعِس শব্দের অর্থ সে হুচট খেয়ে পড়ে গেল। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, সে ধ্বংস হলো। এখানে সৎ কাজের মাধ্যমে দুনিয়ার সম্পদ উপার্জনে আগ্রহীকে দিনার ও দিরহামের গোলাম বলার কারণ হচ্ছে, পার্থিব স্বার্থ হাসিল করা ছাড়া সে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে আমল করে না। তাই সে অর্থের গোলামে পরিণত হয়েছে। কেননা সে আমলের মাধ্যমে অর্থেরই ইবাদত করেছে। সুতরাং যে ব্যক্তি ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ ছাড়া অন্যকে উদ্দেশ্য করবে, সে আল্লাহর এবাদতে অন্যকে শরীক সাব্যস্ত করলো। অধিকাংশ মানুষের অবস্থা ঠিক এরকমই। যে ব্যক্তি তার চিন্তা-চেতনা ও প্রচেষ্টাকে দুনিয়া উপার্জন করার পথে ব্যয় করবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপরোক্ত হাদীছে তার উপর বদ দু‘আ করেছেন সে যেন দুর্ভাগ্যবান হয়, দুর্দশাগ্রস্থ হয়, পতনমুখী হয় এবং সে যেন কাঁটাবিদ্ধ হওয়ার পর সেটা বের করতে অক্ষম হয় অর্থাৎ দুনিয়ার ফিতনায় আক্রান্ত হলে সে যেন তা থেকে পরিত্রাণ না পায়। মোটকথা হাদীছে বর্ণিত নিকৃষ্ট স্বভাবগুলো যার মধ্যে থাকবে তার উপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বদ দু’আর প্রভাব অবশ্যই পড়বে। ফলে সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে দুনিয়া লিপ্সু ব্যক্তিকে দীনার, দিরহাম ও পোশাক পরিচ্ছদের গোলাম বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং সংবাদ প্রদানের শব্দ ব্যবহার করে বদ দু‘আর উদ্দেশ্য করেছেন। শব্দগুলো হলো, تَعِسَ وَانْتَكَسَ وَإِذَا شِيكَ فَلا انْتَقَشَ। যারা নিজস্ব উদ্যোগে অকল্যাণ ও ফিতনার দিকে অগ্রসর হয়, তারা তাতে আক্রান্ত হয়। তাদের অবস্থা ঠিক এ রকমই। তারা তাতে আক্রান্ত হলে তা থেকে বের হতে পারে না। কেননা সে ব্যর্থ হয় এবং ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মূলতঃ সে উদ্দেশ্য হাসিল তো করতে পারেই না; বরং তা হাসিল করতে গিয়ে যে বিপদে পড়ে, তা থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ পায় না। যারা ধন-সম্পদের মোহে পড়ে তাদের অবস্থা ঠিক এ রকমই। দুনিয়া পূজারীর অবস্থা হলো, তাকে যখন দেয়া হয় তখন খুশি হয় এবং দেয়া না হলে অসন্তুষ্ট হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمِنْهُمْ مَنْ يَلْمِزُكَ فِي الصَّدَقَاتِ فَإِنْ أُعْطُوا مِنْهَا رَضُوا وَإِنْ لَمْ يُعْطَوْا مِنْهَا إِذَا هُمْ يَسْخَطُونَ﴾

‘‘হে নবী! তাদের কেউ কেউ সাদকাহ বণ্টনের ব্যাপারে তোমার বিরুদ্ধে আপত্তি জানাচ্ছে। এ সম্পদ থেকে যদি তাদের কিছু দেয়া হয় তাহলে তারা খুশি হয়, আর না দেয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়’’। (সূরা আত তাওবা: ৫৮)

সুতরাং তারা আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য সন্তুষ্ট হয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য অসন্তুষ্ট হয়। এমনি যারা কোনো পদমর্যাদা কিংবা প্রশংসা অর্জনের পিছনে লেগে থাকে অথবা অনুরূপ প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণে ব্যস্ত থাকে, তাদের অবস্থা হলো তারা যদি উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে, তাহলে তারা সন্তুষ্ট হয় এবং উদ্দেশ্য হাসিল না হলে অসন্তুষ্ট হয়। উপরোক্ত জিনিসগুলো থেকে এদের নফ্স যা চায়, তারা তার গোলামী করে এবং তারই ক্রীতদাসে পরিণত হয়। কেননা অন্তর-মন দিয়ে গোলামী করা এবং ইবাদত করাই প্রকৃত গোলামী ও ইবাদত। যে জিনিস কারো অন্তরকে গোলাম ও দাস বানিয়ে ফেলে অন্তর ওয়ালা তারই বান্দায় রূপান্তরিত হয়।

দুনিয়ার সম্পদ অন্বেষণকারীরা ঠিক এ রকমই। যে সবসময় মাল উপার্জনের পিছনে লেগে থাকে, মাল তাকে দাসে পরিণত করে এবং গোলাম বানিয়ে ফেলে। ধন-সম্পদ মূলত দুই প্রকার।

(ক) এমন সম্পদ, যার প্রতি বান্দার প্রয়োজন রয়েছে। পানাহার, বিবাহ-সাদি, বসতবাড়ী ইত্যাদির জন্য বান্দা মালের প্রতি মুখাপেক্ষী। এ জাতিয় প্রয়োজন মিটাতে বান্দার মালের প্রয়োজন হয়। সুতরাং সে আল্লাহর কাছে প্রয়োজন মোতাবেক মাল চাইবে এবং সেটা পাওয়ার জন্য আগ্রহী হবে। নিজের প্রয়োজন মোতাবেক মাল সংগ্রহ করার পর বান্দা সেটাকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। মালকে ঠিক সেভাবেই ব্যবহার করবে, যেভাবে সে নিজের গাধাকে বশীভূত করে তার উপর আরোহন করে এবং সেটাকে স্বীয় বিছানার মতো মনে করবে, যার উপর সে বসে। তবে মাল যেন তাকেই দাসে পরিণত না করে এবং মাল উপার্জনের জন্য সে যেন অস্থির না হয়।

(খ) আরেক প্রকার মাল হলো, যার প্রতি বান্দার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। এ শ্রেণীর মালের প্রতি যেন বান্দার অন্তর ঝুকে না পড়ে। তার মন যখন এর প্রতি ঝুকে পড়ে, তখন সে মালের বান্দা হয়ে যায় এবং আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এতে করে আল্লাহর ইবাদতের হাকীকত এবং তার উপর ভরসা করার হাকীকত তার সাথে বিদ্যমান থাকে না। বরং আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদতের একটি শাখা তার মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপর ভরসা করার একটি প্রবণতা তার মধ্যে এসে যায়।

এ শ্রেণীর লোকের উপরই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিম্নের বাণীটি প্রযোজ্য হয়। তিনি বলেছেন,

تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ تَعِسَ عَبْدُ الدِّرْهَمِ تَعِسَ عَبْدُ الْخَمِيصَةِ تَعِسَ عَبْدُ الْخَمِيْلَةِ

‘‘ধ্বংস হোক দীনারের গোলাম, ধ্বংস হোক দিরহামের গোলাম, ধ্বংস হোক উত্তম চাদরের দাস, ধ্বংস হোক নরম পোষাকের গোলাম!’’

দুনিয়া লোভী লোকেরা উপরোক্ত জিনিসগুলোর বান্দায় পরিণত হয়। যদিও তারা এগুলো আল্লাহর কাছেই চায়, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা যখন এগুলো তাদেরকে দান করেন, তখন খুশি হয় আর না দিলে অসন্তুষ্ট হয়। অপর দিকে আল্লাহ তা‘আলা যা পছন্দ করেন, তা পেয়েই যারা সন্তুষ্ট থাকে, তিনি যা অপছন্দ করেন, তারা তা অপছন্দ করে, তিনি ও তার রসূল যা ভালোবাসেন, যারা তা ভালোবাসে, তিনি ও তার রসূল যা ঘৃণা করেন, যারা তা ঘৃণা করে এবং তার বন্ধুদেরকে যারা বন্ধু বানায় তারাই আল্লাহর খাঁটি বান্দা। তারাই পরিপূর্ণ ঈমানদার। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়ার কথা এখানেই শেষ।

গ্রন্থকার বলেন, আমি বলছি, বর্তমান সময়ে যারা ধন-সম্পদের মোহে পড়ে হারাম লেন-দেন করে এবং অবৈধ ইনকামের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, তারা অর্থের গোলাম। যেমন সুদী ব্যাংক এবং সুদ ভিত্তিক অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যারা লেন-দেন করে, যারা ঘুষ, জুয়া খেলা, লেনদেনে প্রতারণা করে এবং মামলা-মুকাদ্দমায় মিথ্যা শপথ করার মাধ্যমে যারা অর্থ উপার্জন করে, তারাও অর্থের গোলাম। কেননা তারা জানে যে, এসব উপার্জন হারাম। কিন্তু অর্থের লোভ তাদেরকে অন্ধ করে রেখেছে এবং সেটা তাদেরকে দাসে পরিণত করেছে। এর ফলে তারা যে কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জন করার চেষ্টা করে।

আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে আমাদের জন্য এবং আমাদের মুসলিম ভাইদের জন্য পার্থিব স্বার্থান্বেষণ, প্রবৃত্তির অনুসরণ এবং নিজস্ব মতকেই প্রাধান্য দেয়ার ফিতনা থেকে নিরাপত্তা কামনা করছি।


[1]. সহীহ মুসলিম ২৯৮৫, অধ্যায়: যে ব্যক্তি আমলে শিরক করলো।

[2]. সহীহ বুখারী ২৮৮৭।