تاسعا: نسبة النعم إلى غير الله - নবম: আল্লাহ ব্যতীত অন্যের দিকে নিয়ামতের সম্বন্ধ করা

ইতিপূর্বে তারকার প্রতি বৃষ্টির সম্বন্ধ করা এবং সেটার মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করার হুকুম আলোচিত হয়েছে। এখন অন্যান্য নিয়ামত আল্লাহ ব্যতীত অন্যের দিকে সম্বন্ধ করার হুকুম সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। জেনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহর অনুগ্রহ ও নিয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান করা এবং সেটার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আকীদার গভীরতম বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা নিয়ামত প্রদানকারী। তাকে বাদ দিয়ে যে ব্যক্তি অন্য কারো দিকে নিয়ামতের সম্বন্ধ করলো, সে কুফুরী করলো অথবা নিয়ামতকে গাইরুল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করার কারণে আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করলো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَعْرِفُونَ نِعْمَةَ اللَّهِ ثُمَّ يُنْكِرُونَهَا وَأَكْثَرُهُمُ الْكَافِرُونَ﴾

‘‘তারা আল্লাহর নিয়ামত চিনে, অতঃপর তা অস্বীকার করে তাদের অধিকাংশই অকৃতজ্ঞ’’। (সূরা নাহল: ৮৩)

কতিপয় মুফাস্সির এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, তারা জানে যে, সমস্ত নিয়ামত আল্লাহর পক্ষ হতে। আল্লাহ তা‘আলাই তা দিয়ে তাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন। তারপরও তারা এটি অস্বীকার করে। তারা ধারণা করে যে, তারা তাদের বাপ-দাদাদের কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে এসব পেয়েছে। তাদের কেউ কেউ বলে, অমুক না থাকলে এমন হতো না। কেউ কেউ বলে, এটি আমরা আমাদের মাবুদসমূহের সুপারিশের কারণে পেয়েছি। এভাবে যে যাকে সম্মান করে, সে তার দিকেই নিয়ামতের সম্বন্ধ করে। কেউ করে বাপ-দাদার দিকে, কেউ করে তাদের বাতিল মাবুদগুলোর দিকে এবং কেউ করে থাকে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের দিকে। তারা ভুলে যায় নিয়ামতের প্রকৃত উৎস এবং সেটার প্রকৃত দাতা আল্লাহ তা‘আলার কথা।

কিছু মানুষ আছে, যারা সাগর পথে ভ্রমণকালে নানা ঝুকি ও বিপদাপদ মুক্ত নিরাপদ ভ্রমণের নিয়ামতকে অনুকূল বাতাস এবং মাঝি-মাল্লার দক্ষতার দিকে সম্বন্ধ করে। তারা বলে বাতাস ছিল খুব ভালো এবং মাঝি-মাল্লারা ছিল খুব সুদক্ষ-অভিজ্ঞ। বর্তমানেও অনেক লোকের মুখে শুনা যায় যে, রাষ্ট্রীয় শান্তি-শৃঙ্খলা, সুখ-শান্তি ও জান-মালের নিরাপত্তাজনিত নিয়ামত বজায় থাকা এবং দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন-দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি দূরিভুত হওয়াকে তারা সরকারের প্রচেষ্টা ও ব্যক্তি বিশেষের অবদান অথবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি-উন্নতি ইত্যাদির প্রতি সম্বন্ধ করে। যেমন তারা বলে থাকে, মেডিকেল সাইন্স অনেক উন্নতি লাভ করার কারণেই রোগ-ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে কিংবা তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে। সরকারের অমুক অমুক উন্নয়নমূলক কর্মসূচী দারিদ্র ও মূর্খতা দূর করেছে। অনুরূপ অন্যান্য বাক্য উচ্চারণ করা থেকে মুসলিমদের দূরে থাকা আবশ্যক এবং তা থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা চাই। সমস্ত নিয়ামতকে একমাত্র আল্লাহর দিকেই সম্বন্ধ করা উচিত এবং তার প্রশংসা করা চাই। কিছু কিছু সৃষ্টি যেমন ব্যক্তি বিশেষ, সংগঠন বা সরকারের প্রচেষ্টায় যেসব নিয়ামত আসে, তা ঐসব উপায়-উপকরণের অন্তর্ভুক্ত যা কখনো ফল দান করে আবার কখনো নিষ্ফল ও ব্যর্থ হয়। তাদের প্রচেষ্টা মাধ্যমে ভালো কিছু অর্জিত হলে তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যাবে। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টার কারণে যে ফলাফল অর্জিত হয়, তার সম্বন্ধ আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো দিকে করা যাবে না।

আল্লাহ তা‘আলা তার সম্মানিত কিতাবে এমন অনেক গোত্রের কথা উল্লেখ করেছেন, যারা তাদের উপর আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করেছিল এবং তারা ধন-সম্পদ এবং অন্যান্য যেসব নিয়ামত লাভ করেছিল, তা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের প্রতি সম্বন্ধ করেছিল। তারা বলেছিল যে, তারা এগুলোর হকদার ছিল বলেই পেয়েছে অথবা তারা তাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও যোগ্যতার বদৌলতেই অর্জন করেছে। আল্লাহ তা‘আলার বলেন,

﴿وَلَئِنْ أَذَقْنَاهُ رَحْمَةً مِنَّا مِنْ بَعْدِ ضَرَّاءَ مَسَّتْهُ لَيَقُولَنَّ هَذَا لِي وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُجِعْتُ إِلَى رَبِّي إِنَّ لِي عِنْدَهُ لَلْحُسْنَى فَلَنُنَبِّئَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِمَا عَمِلُوا وَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنْ عَذَابٍ غَلِيظٍ (৫০) وَإِذَا أَنْعَمْنَا عَلَى الْإِنْسَانِ أَعْرَضَ وَنَأَى بِجَانِبِهِ وَإِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ فَذُو دُعَاءٍ عَرِيضٍ﴾

‘‘কিন্তু কঠিন সময় কেটে যাওয়ার পর যেই মাত্র আমি তাকে আমার রহমতের স্বাদ আস্বাদন করাই, সে বলতে থাকে, এটা তো আমার যোগ্য প্রাপ্য; আমি মনে করি না যে, কিয়ামত সংঘটিত হবে। তবে সত্যিই যদি আমাকে আমার পালনকর্তার কাছে হাজির করা হয়, তবে অবশ্যই তার কাছে আমার জন্য কল্যাণ রয়েছে। অতএব আমি কাফেরদেরকে তাদের কর্ম সম্পর্কে অবশ্যই অবহিত করবো এবং তাদেরকে অবশ্যই আস্বাদন করাবো কঠিন শাস্তি’’। (সূরা ফুস্সিলাত: ৫০)

এটা তো আমার যোগ্য প্রাপ্য; এর অর্থ হলো আমি এটি আমার জ্ঞান দ্বারা অর্জন করেছি এবং আমি এর ন্যায্য হকদার। আসল কথা হলো, এটি আল্লাহর অনুগ্রহ থেকেই, এ নেয়ামত মানুষের প্রচেষ্টার ফলাফল নয় এবং তা মানুষ স্বীয় ক্ষমতা বলেও কামাই করেনি।

যে কারুনকে আল্লাহ তা‘আলা বিরাট ধনভা-ার দিয়েছিলেন, সে তার গোত্রীয় লোকদের উপর সীমাহীন যুলুম করেছিল। উপদেশ দানকারীগণ তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন এবং আল্লাহর নেয়মাতের স্বীকৃতি প্রদান করার এবং সেটার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার আদেশ করেছিলেন। কিন্তু সে অহংকার করেছিল। আল্লাহ তা‘আলার তার সম্পর্কে কুরআনে বলেন যে, সে তখন বলেছিল,  إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي ‘‘নিশ্চয় এ নেয়ামত জ্ঞানের জন্য আমাকে দেয়া হয়েছে’’। (কাসাস: ৭৮)

অর্থাৎ আমার পারদর্শিতা ও উপার্জনের বিভিন্ন পন্থা সম্পর্কিত জ্ঞান থাকার কারণেই আমি এ ধন-ভা-ার প্রাপ্ত হয়েছি। এটি নয় যে আল্লাহর অনুগ্রহে আমি ইহা প্রাপ্ত হয়েছি। এ জন্যই সে ভয়াবহ ও নিকৃষ্ট পরিণতির সম্মুখীন হয়েছিল। তার শাস্তি হয়েছিল খুব কঠোর। আল্লাহ তা‘আলা তাকে তার বাড়ি-ঘরসহ যমীনে দাবিয়ে দিয়েছেন। কেননা সে আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করেছিল এবং সেটাকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের দিকে সম্বন্ধ করে বলেছিল যে, সে নিজস্ব কলাকৌশল ও শক্তির বলে সেটা অর্জন করেছিল।

বর্তমান কালের অনেক লোক নতুন নতুন বস্তু আবিস্কার করতে পেরে অহমিকা প্রদর্শন করছে এবং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য যেসব বিষয়ের ক্ষমতা দিয়েছেন, তা পেয়ে আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে নিজেদের বড়ত্ব প্রকাশ করছে, তাদের কলাকৌশল ও শক্তি-সামর্থ নিয়ে গর্ব করছে। সেই সঙ্গে তারা আল্লাহর যমীনে অন্যায়ভাবে সীমালংঘন করছে এবং আল্লাহর বান্দাদের উপর যুলুম করছে। কারুনের মতোই এরা শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত। এদের পূর্বে আদ জাতিও নিজেদের শক্তির বড়াই করে ধোঁকায় পড়েছিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَأَمَّا عَادٌ فَاسْتَكْبَرُوا فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَقَالُوا مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَهُمْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُمْ قُوَّةً وَكَانُوا بِآيَاتِنَا يَجْحَدُونَ (১৫) فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا صَرْصَرًا فِي أَيَّامٍ نَحِسَاتٍ لِنُذِيقَهُمْ عَذَابَ الْخِزْيِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَخْزَى وَهُمْ لَا يُنْصَرُونَ﴾

‘‘তাদের অবস্থা ছিল এই যে, পৃথিবীতে তারা অন্যায়ভাবে নিজেদেরকে বড় মনে করেছিলো এবং বলতে শুরু করেছিল, আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী আর কে আছে? তারা কি বুঝলো না, যে আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। তারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছিল। অবশেষে আমি কতিপয় অমঙ্গলকর দিনে তাদের উপর প্রবল ঝড়ো হাওয়া পাঠালাম যেন পার্থিব জীবনেই তাদেরকে অপমান ও লাঞ্ছনাকর আযাবের মজা আস্বাদন করাতে পারি। আখিরাতের আযাব তো এর চেয়েও অধিক অপমানকর। সেখানে কেউ তাদের সাহায্যকারী থাকবে না’’। (সূরা ফুস&&সলাত: ১৫-১৬)

প্রিয় পাঠক বৃন্দ! রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পূর্বকালের একদল লোকের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ঘটনাটি শুনুন। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে নিয়ামত প্রদান করে পরীক্ষা করেছেন। তাদের কেউ আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করেছে এবং প্রাপ্ত নিয়ামতকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। এতে আল্লাহ তা‘আলা তার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আর তাদের কেউ কেউ আল্লাহ তা‘আলার নিয়ামত ও অনুগ্রহের স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। এতে আল্লাহ তা‘আলা তার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। এবার মূল ঘটনাটি শুনুন।

‘‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বনী ইসরাঈলের মধ্যে তিনজন লোক ছিল। যাদের একজন ছিল কুষ্ঠরোগী, আরেক জনের ছিল মাথায় টাক, অপরজন ছিল অন্ধ। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। তাদের কাছে তিনি একজন ফেরেশতা পাঠালেন।

সর্বপ্রথম কুষ্ঠরোগীর কাছে ফেরেশতা এসে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কী? সে বললো সুন্দর রং এবং ভালো চামড়া। আর যে রোগের কারণে মানুষ আমাকে ঘৃণা করে তা থেকে মুক্তি আমার কাম্য। তখন ফেরেস্তা তার শরীরে হাত বুলিয়ে দিলেন। এতে তার রোগ দূর হয়ে গেলো তাকে সুন্দর রং আর ভালো চামড়া দেয়া হলো। তারপর ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার প্রিয় সম্পদ কী? সে বললো, উট অথবা গরু। হাদীছ বর্ণনাকারী ইসহাক উট কিংবা গরু এ দু'য়ের মধ্যে সন্দেহ করেছেন। তখন তাকে একটি গর্ভবতী উট দেয়া হলো। ফেরেশতা তার জন্য এই বলে দু‘আ করলেন, আল্লাহ তোমাকে এ সম্পদে বরকত দান করুন।

অতঃপর ফেরেশতা টাক ওয়ালা লোকটির কাছে গিয়ে বললেন, তোমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কী? লোকটি বলল, আমার প্রিয় জিনিস হচ্ছে সুন্দর চুল। লোকজন আমাকে যে কারণে ঘৃণা করে তা থেকে মুক্ত হতে চাই। ফেরেশতা তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এতে করে তার মাথার টাক দূর হয়ে গেল। তাকে সুন্দর চুল দেয়া হলো। অতঃপর ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো সম্পদ তোমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়? সে বললো উট অথবা গরু। তখন তাকে গর্ভবতী একটি গাভী দেয়া হলো। ফেরেশতা তার জন্য এই বলে দু‘আ করলেন আল্লাহ এ সম্পদে তোমাকে বরকত দান করুন।

তারপর ফেরেশতা অন্ধ লোকটির কাছে গিয়ে বললেন, তোমার কাছে সবচেয় প্রিয় সম্পদ কী? লোকটি বলল, আল্লাহ যেন আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। যার ফলে আমি লোকজনকে দেখতে পাবো। ফেরেশতা তখন তার চোখে হাত বুলিয়ে দিলেন। এতে আল্লাহ তা‘আলা লোকটির দৃষ্টিশক্তি ফিরেয়ে দিলেন। এবার ফেরেশতা তাকে বললেন, কী সম্পদ তোমার কাছে সব চেয়ে বেশি প্রিয়? সে বলল, ছাগল আমার বেশি প্রিয়। তখন তাকে একটি গর্ভবতী ছাগল দেয়া হলো। আল্লাহর অনুগ্রহে উট ও গরু বংশ বৃদ্ধি করতে লাগলো এবং ছাগলও বংশ বৃদ্ধি করতে লাগলো। অবশেষে অবস্থা এ দাঁড়ালো যে, একজনের উটে মাঠ ভরে গেলো, আরেকজনের গরুতে মাঠ পূর্ণ হয়ে গেলো এবং আরেক জনের ছাগলে মাঠ ভর্তি হয়ে গেলো।

অতঃপর নির্দিষ্ট একটি সময় পার হওয়ার পর একদিন ফেরেশতা তার পূর্ব আকৃতিতেই কুষ্ঠ রোগীর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, আমি একজন মিসকীন। আমার পথের সম্বল শেষ হয়ে গেছে। আমার গন্তব্যস্থলে পেঁŠছার জন্য আল্লাহর সাহায্য অতঃপর আপনার সাহায্য দরকার। যে আল্লাহ আপনাকে এত সুন্দর রং এবং ভালো চামড়া দান করেছেন, তার নামে আমি আপনার কাছে একটা উট সাহায্য চাই, যাতে আমি নিজ দেশে পেঁŠছাতে পারি। তখন লোকটি বললো, দেখুন: আমার অনেক দায়-দায়িত্ব আছে, হকদার আছে। ফেরেশতা বললেন, আমার মনে হয়, আপনাকে চিনি। আপনি কি কুষ্ঠ রোগী ছিলেন না? মানুষ কি আপনাকে ঘৃণা করতো না? আপনি খুব গরীব ছিলেন না? অতঃপর আল্লাহ আপনাকে এ সম্পদ দান করেছেন? তখন লোকটি বললো এ সম্পদ আমার পূর্ব পুরুষ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। ফেরেশতা তখন বললো, তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকো তাহলে আল্লাহ যেন তোমাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেন।

অতঃপর ফেরেশতা মাথায় টাক ওয়ালা লোকটির কাছে গেলেন এবং ইতিপূর্বে কুষ্ঠরোগীর সাথে যে ধরনের কথা বলেছিল টাক ওয়ালা লোকটির সাথেও অনুরূপ কথা বললেন। উত্তরে কুষ্ঠরোগী যে জবাব দিয়েছিল, এ লোকটিও একই জবাব দিলো। ফেরেশতাও আগের মতই বললো যদি তুমি মিথ্যাবাদী হও তাহলে আল্লাহ তা‘আলা যেন তোমাকে তোমার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেন।

অতঃপর ফেরেশতা একই আকৃতিতে অন্ধ লোকটির কাছে গিয়ে বললেন, আমি এক গরীব মুসাফির। আমার পথের সম্বল নিঃশেষ হয়ে গেছে। আমি আল্লাহর সাহায্য অতঃপর আপনার সাহায্য কামনা করছি। যিনি আপনার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন, তার নামে একটি ছাগল আপনার কাছে সাহায্য চাই, যাতে আমার সফরে নিজ গন্তব্যস্থানে পেঁŠছাতে পারি। লোকটি তখন বললো আমি অন্ধ ছিলাম। আল্লাহ তা‘আলা আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনার যা খুশি নিয়ে যান। আর যা খুশি রেখে যান। আল্লাহর কসম, আল্লাহর নামে আপনি আজ যা নিয়ে যাবেন, তাতে আমি মোটেই বাধা দেবোনা। তখন ফেরেশতা বললেন, আপনার মাল আপনি রাখুন। আপনাদেরকে শুধুমাত্র পরীক্ষা করা হলো। আপনার আচরণে আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন। আপনার সঙ্গীদ্বয়ের আচরণে অসন্তুষ্ট হয়েছেন’’।[1]

এটি একটি বিরাট হাদীছ। তাতে রয়েছে বিরাট শিক্ষা। এ ঘটনাতে উল্লেখিত প্রথম দু’জন লোক আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করেছিল। নিয়ামতের সম্বন্ধ তারা আল্লাহর দিকে করেনি এবং তাদের সম্পদের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার যে হক ছিল তাও আদায় করেনি। ফলে তাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ নেমে আসলো এবং তাদের থেকে নিয়ামত ছিনিয়ে নেয়া হলো।

সর্বশেষ ব্যক্তি আল্লাহর নিয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান করলো, নিয়ামতের সম্বন্ধ তার দিকেই করলো এবং তাতে আল্লাহ তা‘আলার যে হক রয়েছে তাও প্রদান করলো। এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে নিলো। নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার কারণে আল্লাহ তা‘আলা তার সম্পদ আরো বাড়িয়ে দিলেন।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, الشكر শব্দের মূল অর্থ হচ্ছে বিনয়, নম্রতা ও ভালোবাসার সাথে নিয়ামত প্রদানকারীর নিয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান করা। সুতরাং যে ব্যক্তি নিয়ামতের কদর জানে না; বরং সেটা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ সে নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতেও জানে না। আর যে ব্যক্তি নিয়ামতের কদর জানে, কিন্তু নেয়ামত প্রদানকারীকে চিনতে পারে না, সেও নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে জানে না। আর যে ব্যক্তি নিয়ামতের কদর জানতে পারলো এবং নিয়ামত প্রদানকারীকেও চিনতে পারলো, কিন্তু নিয়ামত এবং নিয়ামত প্রদানকারীর প্রতি অবিশ্বাসীর মতোই নেয়ামতকে অস্বীকার করলো সে মূলত নিয়ামতের প্রতি কুফুরী করলো।

আর যে ব্যক্তি নিয়ামত এবং নিয়ামত প্রদানকারীকে চিনতে পারলো, নিয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান করলো, অস্বীকৃতি প্রদান করলোনা, কিন্তু নিয়ামত প্রদানকারীর জন্য বিনীত হলো না, তাকে ভালোবাসলো না, তার প্রতি সন্তুষ্ট হলো না সেও নিয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো না।

আর যে ব্যক্তি নিয়ামতকে চিনতে পারলো, নিয়ামত প্রদানকারীকেও চিনতে পারলো, নিয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান করলো, নিয়ামত প্রদানকারীর জন্য বিনীত হলো, তাকে ভালোবাসলো, তার প্রতি সন্তুষ্ট হলো, নিয়ামতকে আল্লাহর প্রিয় ও তার আনুগত্যের কাজে ব্যবহার করলো, সেই নিয়ামতের প্রকৃত শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো। সুতরাং নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার জন্য বান্দার অন্তরে নিয়ামত সম্পর্কে ইলম থাকা জরুরী এবং সেই ইলম অনুযায়ী অন্তরের আমলও থাকা আবশ্যক। অন্তরের আমল হলো নিয়ামত প্রদানকারীর প্রতি ঝুকে পড়া, তাকে ভালোবাসা এবং তার জন্য বিনীত হওয়া। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের বক্তব্য এখানেই শেষ।


[1]. বুখারী, অধ্যায়: বনী ইসরাঈলের খবর থেকে যা বর্ণিত হয়েছে।