শির্ক কী ও কেন? তৃতীয় পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ৯ টি
পার্থিব ও পরকালীন বিষয়ে অলিগণের শাফা‘আত

 শয়তান মুসলিমদেরকে পথভ্রষ্ট করে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য কৌশল হিসেবে দ্বিতীয় যে বিষয়টিকে বেছে নিয়েছে তা হচেছ-পার্থিব ও পরকালীন বিষয়ে অলিগণের শাফা‘আত সম্পর্কিত বিষয়টি। মানুষ জীবিত থাকলে কারো পার্থিব কোনো বিষয়ে অপর কোনো মানুষের কাছে সুপারিশ করতে পারে। অনুরূপভাবে কারো কোনো বিষয়ে আল্লাহর কাছে দো‘আও করতে পারে। কিন্তু কোনো মানুষ মরে যাওয়ার পরেও কি জীবিত থাকার ন্যায় তার কাছে অপর কোনো মানুষ বা আল্লাহর কাছে কোনো বিষয়ে শাফা‘আতের জন্য তার নিকট আবেদন করা যায়? শয়তান এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ আর ওলিদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে দিয়েছে। ইসলাম পূর্ব যুগে খ্রিষ্টানদের মধ্যে তাদের সৎ মানুষদের ব্যাপারে এবং আরবের মুশরিকদের মধ্যেও সৎ মানুষ ও ফেরেশতাদের নামে নির্মিত দেব-দেবীদের ব্যাপারে শাফা‘আত সম্পর্কে শয়তান যে ধারণা দিয়েছিল, সাধারণ মুসলিমদের মাঝে ওলিদের ব্যাপারেও সে অনুরূপ ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে।

শাফা‘আত সম্পর্কে আরবের মুশরিক ও খ্রিস্টানদেরকে শয়তানের দেয়া ধারণা

ইসলাম পূর্ব যুগে খ্রিষ্টান এবং আরবের মুশরিকদের মাঝে শয়তান সৎ মানুষ ও ফেরেশ্তাদের নামে নির্মিত পাথর ও গাছের মূর্তি ও প্রতিমাসমূহের ব্যাপারে এ ধারণা দিয়েছিল যে, মানুষেরা যেমন একে অপরের নিকট তাদের মর্যাদা বলে সাধারণত পরস্পরের পূর্বানুমতি ছাড়াই সুপারিশ করতে পারে, তেমনি তাদের এ-সব মূর্তি ও দেব-দেবীসমূহ আল্লাহর কাছে তাদের মর্যাদা বলে আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই মানুষের কল্যাণে সুপারিশ করতে পারে।[1] এ ধারণার ভিত্তিতেই বিশেষ করে আরবের মুশরিকরা তাদের দেব-দেবীদেরকে সাহায্য ও সুপারিশের জন্য আহ্বান করতো। আল্লাহ তাদের এ-জাতীয় ধারণা ও আহবানের সমালোচনা করে বলেন:

﴿ وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡ وَيَقُولُونَ هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِۚ ﴾ [يونس: ١٨]

‘‘আর তারা আল্লাহকে ব্যতীত এমন কিছুর উপাসনা করে যারা তাদের কোনো লাভ ও ক্ষতি করতে পারে না, আর তারা বলে এরা আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য শাফা‘আতকারী’’।[2] প্রথম অধ্যায়ে আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের ক্ষেত্রে শির্কের বর্ণনা প্রসঙ্গে আমরা এ বিষয়টি আলোচনা করে প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে, আল্লাহর এ জগতে তাঁর পূর্বানুমতি ব্যতীত নিজ মর্যাদার ওসীলায় কেউ তাঁর কাছে কারো ব্যাপারে শাফা‘আত করতে পারে-এমন ধারণা করা পরিচালনাগত শির্কের একটি প্রকার। আল্লাহর এ-জগতে কেউ এ-ভাবে শাফা‘আত করতে পারে বলে যারা ধারণা করে, তাদের প্রশ্ন করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ﴾ [البقرة: ٢٥٥]

‘‘এমন মর্যাদার অধিকারী কে আছে যে তাঁর (আল্লাহর) পূর্বানুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে (কারো জন্যে) শাফা‘আত করতে পারে?’’[3] ইসলামে মৃত মানুষের এ-জাতীয় শাফা‘আতের কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও শয়তান পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে সাধারণ মুসলিম জনমনে তাদের ওলীদের ব্যাপারে অনুরূপ বা এর কাছাকাছি ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে।

অলিগণের শাফা‘আত সম্পর্কে সাধারণ মুসলিমদের মাঝে শয়তানের দেয়া ধারণা:

শয়তান সাধারণ মুসলিম জনমনে অলিগণের শাফা‘আতের ব্যাপারে নিম্নরূপ ধারণা দিয়েছে:

(ক) ওলিগণ আল্লাহ তা‘আলা ও সাধারণ মানুষের মাঝে মধ্যস্থতাকারী হওয়ায় মৃত্যুর পরেও তাঁরা নিজ নিজ মর্যাদা বলে মানুষের পার্থিব সমস্যাদি সমাধানের ক্ষেত্রে আল্লাহর নিকট শাফা‘আত করে থাকেন।

(খ) আখেরাতে তাঁদের কোনো ভয়-ভীতি না থাকায় সে-দিন তাঁরা কেবল তাঁদের ভক্তদের মুক্তির চিন্তায় ব্যস্ত থাকবেন।

(গ) তাঁদের অনুসারী বা ভক্তদের মাঝে যারা জাহান্নামে যাওয়ার ফয়সালা প্রাপ্ত হবে, তাদেরকে তাঁরা নিজ নিজ মর্যাদা বলে শাফা‘আত করে জাহান্নামে প্রবেশ করা থেকে রেহাই দিয়ে জান্নাতে নিয়ে যাবেন।

ওলিদের শাফা‘আতের ব্যাপারে এ-জাতীয় ধারণা সাধারণ মুসলিম জনমনে অত্যন্ত প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। যার কারণে পার্থিব সমস্যাদি সমাধানের জন্য যেমন তাদেরকে জীবিত ও মৃত ওলি ও পীরদের দরবার ও কবরে যেতে দেখা যায়, তেমনি ওলিদের পরকালীন শাফা‘আত প্রাপ্তির আশায় তাদেরকে দেশের বাইরের বড় বড় ওলিদের কবরে গমন করা ছাড়াও দেশের মধ্যকার মৃত ওলিদের কবর এবং জীবিত তথাকথিত ওলি সাঈদাবাদী ও দেওয়ানবাগী ...ইত্যাদি পীরের দরবারেও ভীড় জমাতে দেখা যায় এবং সেখানে যেয়ে নানাভাবে তাঁদের তা‘যীম ও সম্মান করে তাদের ইহ-পরকালীন সমস্যাদির ক্ষেত্রে তাঁদের নিকট সুপারিশ কামনা করতে দেখা যায়। হাজীগণ যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কা‘বা শরীফের উদ্দেশ্যে হজ্জের সময় কুরবানীর জন্তু সাথে নিয়ে মিনা উপত্যকায় গমন করেন, তেমনিভাবে অনেক মুসলিমদেরকে ওলিদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে বার্ষিক ওরস উপলক্ষে ওরসের স্থলে বা দরবারে গরু, ছাগল, ভেড়া ও টাকা-কড়ি মানত ও হাদিয়া হিসেবে নিয়ে যেয়ে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কুরবানী করতে দেখা যায়। এ-ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরো কিছু ভণ্ড পীর রয়েছে, যাদেরকে শরী‘আতের চেয়ে মা‘রিফাত নিয়েই অধিক ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। আখেরাতে বড়পীর আব্দুল কাদির জীলানী ও খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তীর শাফা‘আতে মুক্তির আশায় তাঁদের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে তাদেরকে ওরস পালন করতেও দেখা যায়। মাঝে-মধ্যে তাঁদের কবর যিয়ারতে যাওয়ার সময় তা পত্রিকান্তরে প্রচার করেও যেতে দেখা যায়।

শয়তানের দেয়া এ তিনটি ধারণার অসারতা:

শয়তানের দেয়া এ তিনটি ধারণার মধ্যকার প্রথমটির অসারতা আমরা এ অধ্যায়েরই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বর্ণনা করেছি। বাকী দু’টি ধারণার অসারতা ইন-শাআল্লাহ শাফা‘আত সম্পর্কে ইসলামের মূলকথা কী, তা বর্ণনার সময় প্রমাণ করবো।

কোন কোনো শরী‘আতী পীরদের দৃষ্টিতে শাফা‘আত

শরী‘আত পালন করেন এমন এক শ্রেণীর পীরগণকেও শয়তান তাঁদের নিজেদের এবং তাদের শাফা‘আতের ব্যাপারে তাদেরকে মারাত্মক বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে রেখেছে। তাদের নিজেদের ব্যাপারে তাদেরকে এমন ধারণা দিয়েছে যে, তারা আল্লাহর উপাসনা ও তাকওয়ার পথ অবলম্বন করার ফলে আল্লাহর ওলিতে পরিণত হয়েছেন। যার ফলে আখেরাতে তাদের নিজেদের মুক্তির বিষয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। সে দিন তারা শুধু নিজেদের মুরীদদের মুক্তির ব্যাপার নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকবেন। হাশরের ময়দানে হিসাব-নিকাশ চলাকালে তাদের কোনো ভক্তের পা পিছলে গেলে তাঁরা তাকে হাত ধরে টেনে জান্নাতে নিয়ে যাবেন। উদাহরণস্বরূপ চরমোনাইর পীর মাওলানা মুহাম্মদ এছহাক মরহুমের কথাই বলা যায়, তিনি একাধিক পীরের হাতে বায়‘আত করা বৈধ হওয়া ও এর উপকারিতা বর্ণনা প্রসঙ্গে স্বীয় পীর মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রহ.) সাহেবের একটি বক্তব্য উপস্থাপন করেন। মাওলানা কারামত আলী বলেন:

‘‘একদা আমার পীর মাওলানা সৈয়দ আহমদ সাহেব-এর কাছে কোনো এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিলেন যে, হুজুর যেসব লোক দুই তিন পীরের কাছে মুরীদ হন, কেয়ামতের দিন পীরগণ ঐ মুরীদকে আপন আপন দিকে টানাটানি করিয়া ছিড়িয়া ফেলিবে নাকি ? তখন উত্তর করিলেন, কেয়ামতের দিন পা পিছলাইয়া যাওয়ার দিন; টানাটানি করিয়া ছিঁড়িয়া ফাড়িয়া ফেলিবার দিন নহে। যখন কোনো ব্যক্তির পা পিছলাইয়া যায়, তখন একা এক ব্যক্তি হাত ধরিয়া তাহাকে সাহায্য করিলে তাহার খুব শক্তি হয়, কিন্তু যখন দুই-তিন ব্যক্তি তাহার হাত ধরে, তখন তাহার শক্তি আরও বাড়িয়া যায়। মাওলানা কারামত আলী মরহুম সাহেব এই কথার উত্তরে বলেন, ছোবহানাল্লাহ ! কি সুন্দর দেল আকর্ষণীয় উত্তর দিয়াছেন। সত্যই কেয়ামতের অবস্থা এইরূপ হইবে এবং আল্লাহর হুকুমে সেই দিন নিঃসন্দেহে পীরগণ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা করা যায় এবং তিনি দো‘আ করিয়া বলেন, আল্লাহ পাক হক্কানী পীরদের উপর মুরীদদের এ‘তেকাদ ঠিক রাখুন’’।[4]

হাশরের ময়দানে পীরদের কর্তৃক মুরীদদের সাহায্য ও সহযোগিতা সংক্রান্ত.কোন কোনো পীরগণের উক্ত বিশ্বাসের প্রতি লক্ষ্য করলে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হয়। যেমন:

    ওলি ও পীরগণ নিজেদেরকে একেকজন কামিল মানুষ বলে মনে করেন। অথচ কুরআনের শিক্ষানুযায়ী কারো পক্ষে নিজের ব্যাপারে এমন ধারণা করা সঠিক নয়।
    হাশরের ময়দানের ভয়াবহ অবস্থা দৃশ্যে তাদের মনে নিজেদের মুক্তির ব্যাপারে কোনো ভয়-ভীতির উদ্রেক হবে না। অথচ কুরআন শরীফে হাশরের ময়দানে সকল মানুষের যে অবস্থার কথা বর্ণিত হয়েছে, তা সে বর্ণনার পরিপন্থী।
    তারা হাশরের ময়দানে বিচার চলাকালীন সময়ে তাদের বিপদগ্রস্ত মুরীদদের ব্যাপারে সুপারিশ করার অনুমতি পাবার ব্যাপারে নিশ্চিত। অথচ হাদীসের বর্ণনানুযায়ী হাশরের ময়দানে কোনো ওলির এ-জাতীয় শাফা‘আত স্বীকৃত নয়। বরং তাঁদের শাফা‘আত স্বীকৃত হয়েছে কেবল জাহান্নামীদের জাহান্নাম থেকে বের করে আনার ব্যাপারে। যা আমরা পরবর্তী আলোচনার দ্বারা জানতে পারবো।

কোন মানুষই নিজেকে সৎ মানুষ হওয়ার সনদ দিতে পারে না:

মানুষ যতই আল্লাহর উপাসনা ও তাকওয়ার পথ অবলম্বন করুক না কেন, বেশী হলে সে তার ‘আমল আল্লাহর কাছে গৃহীত হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারে। কোনো অবস্থাতেই তা গৃহীত হয়েছে বলে নিশ্চিত হতে পারেনা। তার ‘আমলের অবস্থা যা-ই হোক না কেন, তিনি এ নিয়ে কোনো প্রকার আত্মতৃপ্তিও বোধ করতে পারেন না। নিজেকে আল্লাহর কাছে অতি সম্মানী ও মর্যাদাবান বলেও মনে করতে পারেন না। কেননা, কে প্রকৃত মুত্তাকী ও পরহেজগার তা কেবল আল্লাহই ভাল করে জানেন। কেউই নিজেকে পরিশুদ্ধ মানুষ হওয়ার সনদ দিতে পারে না। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:

﴿فَلَا تُزَكُّوٓاْ أَنفُسَكُمۡۖ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَنِ ٱتَّقَىٰٓ ٣٢ ﴾ [النجم: ٣٢]

অতএব তোমরা নিজেকে পরিশুদ্ধ মানুষ হওয়ার সনদ দান করো না, তোমাদের মধ্যে কে মুত্তাকী তা তিনিই ভাল করে জানেন’’।[5] একজন মু’মিন যখন এ-কথা বলতে পারে না যে, আমি একজন মুত্তাকী ও পরহেজগার হয়ে গেছি, তখন সে তো কখনও নিজেকে আল্লাহর কাছে বড় মর্যাদার অধিকারী বলেও ভাবতে পারে না। সে নিজের মর্যাদার ওসীলায় আখেরাতে মানুষের মুক্তির জন্য শাফা‘আত করা নিয়ে ভাবা তো দুরের কথা, এ দুনিয়াতেও সে তার নিজের মর্যাদা ও সম্মানের দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে তার নিজের বা পরের জন্য কিছু চাওয়াকেও বৈধ মনে করতে পারে না। বরং এ-জাতীয় চাওয়াকে সে আল্লাহর সমীপে বেআদবী ও অনধিকার চর্চা করা বলেই গণ্য করবে। এ-সব চিন্তা-ভাবনা করার বদলে একজন মু’মিনের অন্তর সর্বদা আল্লাহর কাছে বিনয়ী হয়ে থাকবে। আল্লাহর শাস্তির ভয়ে তার অন্তর সর্বদা আতঙ্কিত থাববে। কখনও নিজেকে আল্লাহর শাস্তি থেকে নিরাপদ ভাবতে পারবে না।

যেমন এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَٱلَّذِينَ يُصَدِّقُونَ بِيَوۡمِ ٱلدِّينِ ٢٦ وَٱلَّذِينَ هُم مِّنۡ عَذَابِ رَبِّهِم مُّشۡفِقُونَ ٢٧ إِنَّ عَذَابَ رَبِّهِمۡ غَيۡرُ مَأۡمُونٖ ٢٨ ﴾ [المعارج: ٢٦، ٢٨]

‘‘এবং যারা প্রতিফল দিবসকে সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং যারা তাদের পালনকর্তার শাস্তি সম্পর্কে ভীত-সন্ত্রস্ত, নিশ্চয় তাদের পালনকর্তার শাস্তি থেকে শঙ্কাহীন থাকা যায় না’’।[6] এই যদি হয় একজন প্রকৃত মু’মিনের বৈশিষ্ট্য তখন একজন পীর আখেরাতে কীভাবে নিজেদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে এতো নিরাপদ ভাবতে পারেন। সত্যিই তা আশ্চর্যের বিষয় !

[1].এ সম্পর্কে আল্লামা ইবনু আবিল ‌ইয্‌য আল- হানাফী বলেন:

" ثم إن الناس في الشفاعة على ثلاثة أقوال : فالمشركون و النصارى و المبتدعون من الغلاة في المشايخ وغيرهم يجعلون شفاعة من يعظمونه عند الله كالشفاعة المعروفة في الدنيا . و المعتزلة و الخوارج أنكروا شفاعة نبينا صلى الله عليه وسلم وغيره في أهل الكبائر . و أما أهل السنة و الجماعة فيقرون بشفاعة نبينا صلى الله عليه وسلم في أهل الكبائر و شفاعة غيره ، لكن لا يشفع أحد حتى يأذن الله له ويحد له حدا."

- ইবনু আবিল ‌ইয্‌য আল-হানাফী, প্রাগুক্ত; পৃ.২৬০।

[2]. আল-কুরআন, সূরা ইউনুস:১৮।

[3]. আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাঃ : ২৫৫।

[4]. মাওলানা মুহাম্মদ এছহাক, ভেদে মা‘রেফত; পৃ.২৫-২৬।

[5]. আল-কুরআন, সূরা: নাজম:৩২।

[6]. আলকুরআন, সূরা: মা’আরিজ:২৭-২৯।
কুরআন ও হাদীসের আলোকে শাফা‘আতের মূলকথা

কুরআন ও হাদীস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ইসলাম শাফা‘আত বা সুপারিশকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছে:

এক.দুনিয়াবী বিষয়ে শাফা‘আত।

দুই. পরকালীন বিষয়ে শাফা‘আত।

দুনিয়াবী বিষয়ে পরস্পরের নিকট শাফা‘আত করা বৈধ হওয়ার শর্তসমূহ:

শাফা‘আত যদি পার্থিব কোনো বিষয়ে কোনো জীবিত মানুষের কাছে চাওয়া হয়, তবে নিম্নে বর্ণিত শর্ত সাপেক্ষে তা চাওয়া ও করার বৈধতা রয়েছে:

প্রথম শর্ত: এ শাফা‘আতটি কোনো উপকারী বিষয়ে এবং কারো এমন কোনো অধিকারের ক্ষেত্রে হতে হবে যা নষ্ট হয়ে গেছে অথবা নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দ্বিতীয় শর্ত: তা যেন কোনো অপরাধমূলক কাজে বা শরী‘আতের কোনো হদ (শাস্তি) রহিতকরণের ক্ষেত্রে না হয়।

তৃতীয় শর্ত:যার নিকট শাফা‘আত চাওয়া হবে তিনি স্বাভাবিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শাফা‘আত করবেন এমন ধারণার ভিত্তিতে তার নিকট শাফা‘আত কামনা করতে হবে। কোনো প্রকার কারামত বা অলৌকিক পন্থা অবলম্বনের ধারণায় নয়।

কারো শাফা‘আত যদি উক্ত শর্তসমূহ পূর্ণ করে তা হলে তা যেমন একটি কৃতজ্ঞতা পাওয়ার যোগ্য কাজ হবে, তেমনি এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার নিকট থেকে পুণ্য পাওয়ারও আশা করা যাবে। অন্যথায় তা পাপের কাজ হিসেবে গণ্য হবে। এ-জাতীয় শাফা‘আত প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:

﴿ مَّن يَشۡفَعۡ شَفَٰعَةً حَسَنَةٗ يَكُن لَّهُۥ نَصِيبٞ مِّنۡهَاۖ وَمَن يَشۡفَعۡ شَفَٰعَةٗ سَيِّئَةٗ يَكُن لَّهُۥ كِفۡلٞ مِّنۡهَاۗ ﴾ [النساء: ٨٥]

‘‘যে লোক সৎ কাজের জন্য কোনো শাফা‘আত করবে, তা থেকে সেও একটি অংশ পাবে। আর যে লোক কোনো মন্দ কাজের জন্য শাফা‘আত করবে, সে তার বোঝারও একটি অংশ পাবে’’।[1]

উল্লেখ্য যে, এ-জাতীয় শাফা‘আত কোনো জীবিত অনুপস্থিত অথবা মৃত মানুষের নিকট চাওয়া যায় না। কেননা, তা তাদের নিকট কামনা করা তাদেরকে গায়েবের জ্ঞানী বলে বিশ্বাস করার নামান্তর। আর কারো ব্যাপারে এমন ধারণা করা জ্ঞানগত শির্কের অন্তর্গত।

দুনিয়াবী বিষয়ে আল্লাহর কাছে শাফা‘আত:

কোন জীবিত মানুষের নিকট যেয়ে দুনিয়াবী কোনো বিষয়ে আল্লাহর কাছে সুপারিশ বা শাফা‘আত করার জন্য তাকে বলা যেতে পারে। তিনিও দু’টি কথা বলে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তির জন্য শাফা‘আত করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শাফা‘আতকারীর সবচেয়ে পরহেজগার হওয়া কোনো জরুরী ব্যাপার নয়। বরং অপেক্ষাকৃত কম পরহেজগার লোকের কাছেও এ-জাতীয় শাফা‘আত চাওয়া যেতে পারে। কেননা, আল্লাহর কাছে শাফা‘আতের ক্ষেত্রে মূল ওসীলা হচ্ছে ব্যক্তির মুখের দুটি কথা, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, তার মর্যাদা ও সম্মান নয়। কোনো দুনিয়াবী বিষয়ে শাফা‘আত করার জন্য কোনো অনুপস্থিত বা মৃত মানুষের কাছে কোনো আবদার করা যায়না। কেননা, জীবিতরা কোনো গায়েবের আওয়াজ শুনতে পারেন না। আর মৃতদের কবরের পার্শ্বে যেয়ে তাদের কাছে সুপারিশের জন্য কোনো আবেদন করলে কুরআনের কথানুযায়ী তারা কারো কোনো আবেদন শুনতে পান না, পেলেও তারা কারো আবেদনে সাড়া দিতে পারেন না।[2]

সকল মানুষই মরে যাওয়ার পর বরযখী জীবনে তারা নিজের বা পরের উপকারে আসতে পারে এমন কোনো কর্ম করতে পারেন না। তাদের রূহ স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে আমাদের জন্যে কোনো কল্যাণ কামনা করে দো‘আ করলেও আল্লাহর নিকট এর কোনো কার্যকারিতা নেই। কেননা, কবরের জীবন সে রকম কোনো ‘আমলের জীবন নয়। এ-জন্যই রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বা কোনো ওলির কবরে গিয়ে বা দূর থেকে তাঁদের কাছে নিজের জন্য কোনো দো‘আ করার আবেদন করা যায় না। সাহাবা ও তাবেঈগণের যুগে মুসলিমরা বহুবিধ সমস্যায় পতিত হয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা কখনও রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবর মুবারকে যেয়ে তাঁর নিকট সমস্যা সমাধানের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করার ব্যাপারে কোনো আবেদন করেছেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।

আখেরাতে আল্লাহর কাছে শাফা‘আত:

জীবিত থাকাবস্থায় কোনো দুনিয়াবী বিষয়ে শাফা‘আতের ক্ষেত্রে বিষয়টি যদি উপরে বর্ণিত শর্ত পূর্ণ করে, তা হলে এমন বিষয়ে আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করার ব্যাপারে তাঁর আগাম অনুমতি রয়েছে। আমরা ইচ্ছা করলেই পরস্পরের জন্য এমন কোনো বিষয়ে আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করতে পারি। কিন্তু আখেরাতে আল্লাহর কাছে শাফা‘আতের বিষয়টি দুনিয়াবী শাফা‘আত থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। কেননা, এ দিনে শাফা‘আতের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে আল্লাহ তা‘আলার হাতে। এ দিকে ইঙ্গিত করেই তিনি বলেছেন:

﴿ قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗاۖ ﴾ [الزمر: ٤٤]

‘‘আপনি বলে দিন- শাফা‘আতের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন’’।[3]এ দিনে কেউ তার নিজের মর্যাদা ও সম্মানের দিক বিবেচনা করে আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে তার নিজের বা পরের জন্য কোনো সুপারিশ করাতো দুরের কথা, এ দিনে কেউ তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোনো কথাই বলতে পারবে না। এ দিবসের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:

﴿ يَوۡمَ يَأۡتِ لَا تَكَلَّمُ نَفۡسٌ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ﴾ [هود: ١٠٥]

‘‘যখন সেই দিন আসবে, তখন আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না।’’[4] আল্লাহর ভাষায় :

﴿ لِكُلِّ ٱمۡرِيٕٖ مِّنۡهُمۡ يَوۡمَئِذٖ شَأۡنٞ يُغۡنِيهِ ٣٧ ﴾ [عبس: ٣٧]

‘‘সে দিন সকল মানুষেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে’’।[5] সে দিন কাফির ও মু’মিন নির্বিশেষে কারো জন্যে কারো শাফা‘আত থাকবে না। সে-জন্য সে দিনে কারো শাফা‘আতের আশায় না থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরক নির্দেশ করে বলেছেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَنفِقُواْ مِمَّا رَزَقۡنَٰكُم مِّن قَبۡلِ أَن يَأۡتِيَ يَوۡمٞ لَّا بَيۡعٞ فِيهِ وَلَا خُلَّةٞ وَلَا شَفَٰعَةٞۗ ﴾ [البقرة: ٢٥٤]

‘‘হে মু’মিনগণ! তোমাদেরকে আমি যে জীবিকা দান করেছি তাত্থেকে তোমরা ব্যয় কর সে-দিন আগমনের পূর্বে যেদিন থাকবে না কোনো (পুণ্যের)ক্রয়-বিক্রয়, কোনো বন্ধুত্ব ও শাফা‘আত’’।[6] সে-দিনটি এমন যে, সে-দিনে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত মানুষের জন্য কোনো বন্ধু ও শাফা‘আতকারী থাকবে না। যেমন আল্লাহ বলেন:

﴿ وَأَنذِرۡ بِهِ ٱلَّذِينَ يَخَافُونَ أَن يُحۡشَرُوٓاْ إِلَىٰ رَبِّهِمۡ لَيۡسَ لَهُم مِّن دُونِهِۦ وَلِيّٞ وَلَا شَفِيعٞ لَّعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ ٥١ ﴾ [الانعام: ٥١]

‘‘এ কুরআনের দ্বারা আপনি তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করুন যারা তাদের প্রতিপালকের কাছে এমন অবস্থায় একত্রিত হওয়াকে ভয় করে যখন তাদের কোনো বন্ধু ও শাফা‘আতকারী থাকবে না, হতে পারে এতে তারা ভীত হবে’’।[7]

সে দিন এমন যে, জান্নাতীদের জান্নাতে চলে যাওয়ার পর যখন তারা তাদের জাহান্নামবাসী আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের জন্য শাফা‘আত করার অনুমতি পাবেন, তখন তারা তাদের স্বজনদের অপরাধের খবর না জেনে কোনো দেবতা, প্রতিমা, কবর ও কবর পূজারী আত্নীয়ের জন্য আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করলে তাদের সে শাফা‘আত আল্লাহ তা‘আলার নিকট গৃহীত হবে না। যেমন আল্লাহ বলেন:

﴿ فَمَا تَنفَعُهُمۡ شَفَٰعَةُ ٱلشَّٰفِعِينَ ٤٨ ﴾ [المدثر: ٤٨]

‘‘অতএব (মুশরিকদের জন্য) কোনো সুপারিশকারীদের সুপারিশ কাজে আসবে না’’।[8] মুশরিকরা আজ যাদেরকে আল্লাহর শরীক করে নিয়েছে এবং যাদেরকে আজ তাদের মর্যাদার ওসীলায় তাদের দুনিয়াবী উদ্দেশ্য পূরণের জন্য আল্লাহর কাছে শাফা‘আতকারী বলে ভাবছে, কাল আখেরাতের ভয়াবহ দিনে তারা তাদের কথা স্মরণ করলেও তারা তাদেরকে শাফা‘আতকারী হিসেবে পাবে না। বরং সে দিন সবকিছু তাদের ধারণার বাইরে দেখে মুশরিকরা তাদের শরীকদের অস্বীকার করবে। আত্মরক্ষার জন্য তারা বলবে:আমরা তাদেরকে আল্লাহর সাথে কখনও শরীক করিনি। যেমন আল্লাহ বলেন:

﴿ وَيَوۡمَ نَحۡشُرُهُمۡ جَمِيعٗا ثُمَّ نَقُولُ لِلَّذِينَ أَشۡرَكُوٓاْ أَيۡنَ شُرَكَآؤُكُمُ ٱلَّذِينَ كُنتُمۡ تَزۡعُمُونَ ٢٢ ثُمَّ لَمۡ تَكُن فِتۡنَتُهُمۡ إِلَّآ أَن قَالُواْ وَٱللَّهِ رَبِّنَا مَا كُنَّا مُشۡرِكِينَ ٢٣ ٱنظُرۡ كَيۡفَ كَذَبُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡۚ وَضَلَّ عَنۡهُم مَّا كَانُواْ يَفۡتَرُونَ ٢٤ ﴾ [الانعام: ٢٢، ٢٤]

‘‘আর যেদিন আমি তাদের সবাইকে একত্রিত করব, অতঃপর যারা শির্ক করেছিল, তাদেরকে বলব: যাদেরকে তোমরা অংশীদার বলে ধারণা করতে, তারা (এখন) কোথায়? অতঃপর তাদের শির্কের পরিণাম এ-কথা ব্যতীত আর কিছুই হবে না যে, তারা বলবে: হে আমাদের প্রতিপালক ! আল্লাহর শপথ, আমরা মুশরিক ছিলাম না। লক্ষ্য করে দেখ, কিভাবে তারা নিজেদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলবে। আর তারা তাদের দেবতাদের শাফা‘আতের ব্যাপারে যে মিথ্যা কথা রচনা করেছিল, তা (এখন) তাদের থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে’’।[9] অর্থাৎ তা মিথ্যায় প্রতিফলিত হলো।

অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন:

﴿ وَيَوۡمَ تَقُومُ ٱلسَّاعَةُ يُبۡلِسُ ٱلۡمُجۡرِمُونَ ١٢ وَلَمۡ يَكُن لَّهُم مِّن شُرَكَآئِهِمۡ شُفَعَٰٓؤُاْ وَكَانُواْ بِشُرَكَآئِهِمۡ كَٰفِرِينَ ١٣ ﴾ [الروم: ١٢، ١٣]

‘‘যেদিন কেয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন অপরাধীরা হতাশ হয়ে যাবে। তারা যাদেরকে আল্লাহর শরীক করে নিয়েছিল তাদের মধ্যকার কেউ তাদের সুপারিশকারী হবে না, (অবস্থা বেগতিক দেখে) তারা তাদের শরীকদের অস্বীকার করবে’’।[10] অর্থাৎ তখন তারা মিছেমিছি বলবে: আমরা তাদেরকে আল্লাহর সাথে কখনও শরীক করিনি।

যারা ওলিদেরকে আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী মনে ক’রে তাঁদেরকে সাহায্যের জন্য আহ্বান করে, আখেরাতে ওলিগণ সে-সব লোকদের শত্রুতে পরিণত হবেন।

এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:

﴿ وَمَنۡ أَضَلُّ مِمَّن يَدۡعُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَن لَّا يَسۡتَجِيبُ لَهُۥٓ إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَهُمۡ عَن دُعَآئِهِمۡ غَٰفِلُونَ ٥ ﴾ [الاحقاف: ٥]

‘‘সে ব্যক্তির চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে যে আল্লাহকে ব্যতীত এমন কাউকে আহ্বান করে যে কেয়ামত পর্যন্ত তার আহবানে সাড়া দেবে না? তাঁরা তো তাদের আহ্বান সম্পর্কে সম্পূর্ণ বে-খবর। যখন মানুষদেরকে হাশরের দিন একত্রিত করা হবে, তখন তাঁরা তাদের শত্রু হবে এবং তাঁরা তাদের উপাসনাকে অস্বীকার করবে’’।[11]

সাধারণ মুশরিক ও মুসলিম মুশরিকরা আখেরাতে যে অবস্থায় হাজির হবে

সেদিন ইসলাম পূর্ব যুগের মুশরিক এবং ইসলাম পরবর্তী যুগের মুসলিম মুশরিক সকলেই আল্লাহর সমীপে তাদের সুপারিশকারীগণ ছাড়াই একাকী হাজির হবে, তাদের সাথে তাদের সম্পর্ক পরিপূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তাদের এ অবস্থা দৃশ্যে মহান আল্লাহ্‌ বলবেন:

﴿ وَلَقَدۡ جِئۡتُمُونَا فُرَٰدَىٰ كَمَا خَلَقۡنَٰكُمۡ أَوَّلَ مَرَّةٖ وَتَرَكۡتُم مَّا خَوَّلۡنَٰكُمۡ وَرَآءَ ظُهُورِكُمۡۖ وَمَا نَرَىٰ مَعَكُمۡ شُفَعَآءَكُمُ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُمۡ أَنَّهُمۡ فِيكُمۡ شُرَكَٰٓؤُاْۚ لَقَد تَّقَطَّعَ بَيۡنَكُمۡ وَضَلَّ عَنكُم مَّا كُنتُمۡ تَزۡعُمُونَ ٩٤ ﴾ [الانعام: ٩٤]

‘‘তোমরা আমার কাছে এমনভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে এসেছ যেমনভাবে আমি প্রথমবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম। আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছিলাম তা তোমরা পশ্চাতেই রেখে এসেছ। আমি তো তোমাদের সাথে তোমাদের সুপারিশকারীদেরকে দেখছি না, যাদের সম্পর্কে তোমাদের দাবী ছিল যে, তারা তোমাদের ব্যাপারে (আমার) অংশীদার। বাস্তবিকই তোমাদের পরস্পরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তোমাদের দাবী উধাও হয়ে গেছে’’।[12]

সে দিন এমন যে, তাতে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কারো জন্যে অন্য কোনো সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী থাকবে না।

যেমন আল্লাহ বলেন:

﴿ مَا لَكُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَلِيّٖ وَلَا شَفِيعٍۚ ﴾ [السجدة: ٤]

‘‘তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী নেই’’।[13]

এ-সব আয়াতসমূহ দ্বারা যে-সব বিষয়াদি প্রমাণিত হয় তা হলো নিম্নরূপ:

১. আখেরাতে শাফা‘আতের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাপার। সে দিন কেবল তিনি ব্যতীত মানুষের জন্য স্বেচ্ছা প্রনোদিত অপর কোনো বন্ধু বা সুপারিশকারী থাকবে না।

২. সে দিন একমাত্র রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ব্যতীত অন্যান্য সকল নবী ও ওলিগণ সাধারণ মানুষের ন্যায় নিজের পরিণতি নিয়েই উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্যে সময় অতিবাহিত করবেন। তাঁরা আল্লাহর শাস্তির ভয়ে আতঙ্কিত থাকবেন। আখেরাতে সৎমানুষ বা অলিগণের জন্য আল্লাহর অভয়বাণী থাকলেও তাদের জন্য জান্নাতের ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত তারা এ উৎকন্ঠার মধ্যেই সময় অতিবাহিত করবেন। সে-জন্য এ সময়ে তাঁদের পক্ষে অন্যের মুক্তির ব্যাপারে চিন্তা করারও কোনো অবকাশ থাকবে না।

২. সেদিন মুশরিক ও মু’মিন নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য তাদের ঈমান ও ‘আমল ব্যতীত অপর কোনো সাহায্যকারী, শাফা‘আতকারী ও বন্ধু থাকবে না।

৩. সে দিন কেউই আল্লাহর কাছে তার নিজের মর্যাদা ও সম্মানের দিক বিবেচনা করে আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তার নিজের বা অপর কারো কোনো বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারবে না।

৪. সেদিন প্রত্যেক মানুষ নিজের কর্মের হিসেব প্রদানের জন্য আল্লাহর সম্মুখে একাকী হাজির হবে। কারো সাথে কোনো সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী থাকবে না।

৫. মুশরিকরা যে-সব মৃত সৎ মানুষ ও ফেরেশ্তাদের দেব-দেবী এবং জিনদেরকে তাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী ব’লে মনে করে তাদেরকে সাহায্যের জন্য আহ্বান করতো, আখেরাতে তারা তাঁদেরকে সুপারিশকারী হিসেবে পাবে না। এমনকি সে দিন তাদের পরস্পরের মধ্যে কোনো সম্পর্কও থাকবে না। অনুরূপভাবে ইসলাম পরবর্তী যুগে তথাকথিত অলি, গউছ ও কুতুব নামের যাদেরকে ইহকাল ও আখেরাতে সাধারণ মানুষের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশাকরী বলে মনে করে তাঁদেরকে সুপারিশের জন্য আহ্বান করা হচ্ছে, আখেরাতে তাঁদেরকেও সুপারিশকারী হিসেবে পাওয়া যাবে না। বরং যারা তাঁদেরকে উক্ত ধারণার ভিত্তিতে সাহায্য ও সুপারিশের জন্য আহ্বান করছে, আখেরাতে তারা তাঁদের সুপারিশ পাওয়া তো দুরের কথা, তখন তাঁরা তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করবেন।

৬. যারা জান্নাতে যাওয়ার পর অন্যের জন্য সুপারিশের অনুমতি পাবেন, তাঁরা না জেনে কোনো মুশরিকদের জন্য সুপারিশ করলে তাদের সে সুপারিশ কারো কোনো উপকারে আসবে না।

কারা আখেরাতে শাফা‘আতের অনুমতি পাবেন:

আখেরাতে কেবল তারাই শাফা‘আতের অনুমতি পাবেন যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা শাফা‘আতের অনুমতি প্রদান করবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন:

﴿ وَلَا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ عِندَهُۥٓ إِلَّا لِمَنۡ أَذِنَ لَهُ﴾ [سبا: ٢٣]

‘‘তাঁর কাছে কেবল তাদের সুপারিশই উপকারী হবে, যাদেরকে তিনি সুপারিশ করার জন্য অনুমতি দেবেন’’।[14] অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন:

﴿ يَوۡمَئِذٖ لَّا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَرَضِيَ لَهُۥ قَوۡلٗا ١٠٩ ﴾ [طه: ١٠٩]

‘‘দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার কথায় তিনি সন্তুষ্ট হবেন, কেবল সে ব্যতীত সে দিন কারো সুপারিশ সেদিন কারো উপকারে আসবে না’’।[15]

আখেরাতে যারা শাফা‘আতের অনুমতি পাবেন কুরআন ও হাদীসের বর্ণনানুযায়ী তাঁরা হলেন: রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-, মু’মিন, মু’মিনদের মৃত নাবালক শিশু, কুরআন, রোযা, জান্নাত, জাহান্নাম ও শহীদগণ। তবে সকলের শাফা‘আতের সময় এক নয়। বরং তাদের শাফা‘আত দু’টি পর্যায়ে বিভক্ত।

শাফা‘আতের প্রথম পর্যায়: হাশরের ময়দানে যারা শাফা‘আতের অনুমতি পাবেন:যারা হাশরের ময়দানে হিসাব-নিকাশ চলা কালীন সময়ে শাফা‘আত করবেন, বিভিন্ন হাদীসের বর্ণানানুযায়ী তারা হলেন নিম্নরূপ:

>
[1]. আল-কুরআন, সূরা নিসা : ৮৫।

[2].এ সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে:

﴿ إِن تَدۡعُوهُمۡ لَا يَسۡمَعُواْ دُعَآءَكُمۡ وَلَوۡ سَمِعُواْ مَا ٱسۡتَجَابُواْ لَكُمۡۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يَكۡفُرُونَ

بِشِرۡكِكُمۡۚ﴾ [فاطر: ١٤]

মৃত মানুষেরা উপকার করতে পারে এ ধারণার ভিত্তিতে তাদের নামে নির্মিত মূর্তিকে লক্ষ্য করে ‘‘তোমরা যদি তাদেরকে উপকারের জন্য আহবান কর, তা হলে তারা তোমাদের আহবান শ্র্রবণ করবে না, শুনলেও তারা তোমাদের আহবানে সাড়া দেবে না। (তাদেরকে আহবানজনিত কারণে তোমরা যে শির্ক করেছ) কেয়ামতের দিন তারা তোমাদের সে শির্ককে অস্বীকার করবে’’। অর্থাৎ বলবে: আমরা তোমাদেরকে আমাদেরকে আহবানের কথা শিক্ষা দেই নি। এটি তোমাদের মনগড়া কাজ বৈ আর কিছুই নয়। আল-কুরআন, সূরা ফাত্বির :১৪।

[3]. আল-কুরআন, সূরা দুখান: ৩৯।

[4]. আল-কুরআন, সূরা হুদ: ১০৫।

[5]. আল-কুরআন, সূরা আবাসা: ৩৭।

[6]. আল-কুরআন, সূরা বাকারা: ২৫৪।

[7]. আল-কুরআন, সূরা আন‘আম: ৫১।

[8] .আল-কুরআন, সূরা মুদ্দাসি্সর: ৪৮।

[9]. আল-কুরআন, সুরা আন’আম: ২২-২৫।

[10]. আল-কুরআন, সূরা রুম :১২।

[11]. আল-কুরআন, সূরা আহক্বাফ: ৫-৬।

[12]. আল-কুরআন, সূরা আনআম: ৯৪।

[13] . আল-কুরআন, সূরা সেজদা: ৪।

[14]. আল-কুরআন, সূরা সাবা: ২৩।

[15]. আল-কুরআন, সূরা ত্বা-হা: ১০৯।
শাফা‘আতের প্রথম পর্যায়: হাশরের ময়দানে যারা শাফা‘আতের অনুমতি পাবেন

যারা হাশরের ময়দানে হিসাব-নিকাশ চলা কালীন সময়ে শাফা‘আত করবেন, বিভিন্ন হাদীসের বর্ণানানুযায়ী তারা হলেন নিম্নরূপ:

রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফা‘আত:

বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাশরের ময়দানে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একাধিক শাফা‘আত রয়েছে। সে-গুলো হলো:

১. শাফা‘আতে কুবরা বা বড় শাফা‘আত: তাঁর প্রথম এ শাফা‘আতটি হবে হাশরের মাঠের ভয়াবহ অবস্থা থেকে সমগ্র হাশরবাসীদের মুক্তির জন্যে। হাশরবাসীরা যখন আদম আলাইহিসি সালাম থেকে আরম্ভ করে একে একে নূহ, ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসা আলাইহিমুস সালাম-এর কাছে গিয়ে তাদের এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করার জন্য আবেদন করবেন, তখন তাঁরা সবাই নিজেদের ত্রুটি বিচ্যুতির কথা স্মরণ করে সুপারিশ করতে অপারগতা প্রকাশ করবেন। অবশেষে যখন হাশরবাসীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট যেয়ে সুপারিশ করার জন্য আবেদন করবে, তখন তিনি বলবেন: আমি এ-কাজের উপযুক্ত।[1]

তবে যেহেতু আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত সেখানে কোনো কথা বলা যাবে না, সে-জন্য তিনি মাকামে মাহমূদে আরোহণ করে সেজদা রত হয়ে এমন মনোরম ও মনোমুগ্ধকর ভাষায় আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করবেন যেমনটি তিনি অতীতে কখনও করেন নি। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাঁকে সুপারিশ করার অনুমতি দেবেন। তিনি বিচারকার্য আরম্ভ করার জন্য আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করলে আল্লাহ তা মঞ্জুর করবেন এবং বিচার কার্য শুরু করবেন।

২. দ্বিতীয় শাফা‘আত হবে তাঁর উম্মতের মধ্যকার কিছু লোকদেরকে বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করাবার জন্যে। শাফা‘আতের ব্যাপারে যে দীর্ঘ হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাতে এ-জাতীয় শাফা‘আতের কথা এ মর্মে রয়েছে যে, আল্লাহ বলবেন:

«...أَدْخِلْ مِنْ أُمَّتِكَ مَنْ لاَ حِسَابَ عَلَيْهِمْ مِنَ الْبَابِ الأَيْمَنِ»

‘‘তোমার উম্মতের মধ্যকার যাদের কোনো হিসাব নেই তাদেরকে জান্নাতের ডানের দরজা দিয়ে প্রবেশ করাও’’।[2]

৩. তৃতীয় শাফা‘আত হবে তাঁর উম্মতের মধ্যকার এমন সব লোকদের জন্যে যাদের পাপ ও পূণ্য সমান হয়ে যাবে। এরাও ইন-শাআল্লাহ তাঁর শাফা‘আতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ বিষয়ে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,

«السَّابِقُ يَدْخُلُ الجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ و الْمُقْتَصِدُ بِرَحْمَةِ اللهِ، وَالظَّالِمُ لِنَفْسِه وَأَصْحَابُ الأَعْرَافِ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ بِشَفَاعَةِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم»

‘‘অগ্রগামীরা বিনা হিসেবে আর মধ্যম পন্থা অবলম্বনকারীরা আল্লাহর রহমতে জান্নাতে প্রবেশ করবে, যারা নিজেদের নফসের উপর জুলুম করেছে এবং যাদের পাপ ও পূণ্য সমান হয়ে গেছে তারাও রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফা‘আতে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’।[3]

১. চতুর্থ শাফা‘আত হবে তাঁর উম্মতের মধ্যকার এমন সব লোকদের জন্য যাদের পুণ্যের চেয়ে পাপের সংখ্যা অল্প পরিমাণে বেশী হবে। আক্বীদা বিষয়ক কিতাবাদিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ-জাতীয় শাফা‘আতের কথা পাওয়া গেলেও কোনো কিতাবে এর সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণের বর্ণনা পাওয়া যায় না। সম্ভবত শাফা‘আত সংক্রান্ত সাধারণ হাদীসসমূহ বিবেচনা করেই এ শাফা‘আতের কথা বলা হয়ে থাকে। যেমন রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বলেছেন:

«شَفَاعَتِيْ لأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِيْ»

‘‘আমার উম্মতের মধ্যকার কবীরা গুনাহকারীদের জন্য আমার শাফা‘আত হবে’’।[4] অপর হাদীসে বলেন:

«لِكُلِّ نَبِيٍ دَعْوَةٌ يَدْعُوا بِهَا وَأُرِيْدُ أَنْ أَخْتَبِأَ دَعْوَتِيْ شَفَاعَةً لِأُمَّتِيْ فِيْ الآَخِرَةِ»

‘‘প্রত্যেক নবীর জন্য আল্লাহর নিকট একটি আহ্বান রয়েছে যা তাঁরা করবেন। আর আমি আমার সে শাফা‘আত আখেরাতে আমার উম্মতদের শাফা‘আত করার জন্য জমা রাখতে চাই’’।[5]

উক্ত ধরনের হাদীসসমূহ দ্বারা এ শাফা‘আতের কথা প্রমাণিত হলেও তা সকল অপরাধীদের জন্য সমানে পাইকারীভাবে হবে না। বরং তা হবে এমন সব অপরাধীদের জন্যে যাদের পাপের সংখ্যা পুণ্যের চেয়ে অল্প পরিমাণে বেশী হয়েছে। তাদের অবস্থা এমন যে, একজন পরীক্ষার্থীকে যেমন অল্প নম্বর যোগ দিলে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যেতে পারে, তেমনি তাদেরকেও অল্প পুণ্য যোগ দিলে তারাও জান্নাতে চলে যেতে পারে। এমনি ধরনের পাপীদেরকে পূণ্য গ্রেস দেয়া স্বরূপ আল্লাহর অনুমতিক্রমে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-তাদের জন্য শাফা‘আত করবেন। পরীক্ষায় যারা আদৌ গ্রেস পাবার যোগ্য নয়, তাদের যেমন কোনো গ্রেস দেয়া হয় না, তেমনি যারা পুণ্য গ্রেস পাওয়ার যোগ্য নয়, তাদের জন্যেও হাশরের মাঠে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো শাফা‘আত হবে না।

বরং এ ধরনের লোকেরা তাদের অপরাধের মাত্রানুযায়ী অল্প-বেশী সময়ের জন্য জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অল্প ও বেশী অপরাধী সকলেই যদি তাঁর শাফা‘আত পেয়ে হাশরের মাঠেই জাহান্নামে যাওয়া থেকে মুক্তি পেয়ে যায়, তা হলে অপরাধীদের ব্যাপারে শাস্তির ভয় প্রদর্শন করে যে-সব আয়াত ও হাদীস বর্ণিত হয়েছে, সে-সবের কী অর্থ দাঁড়াবে? সকল অপরাধীরা যদি সেদিন তাঁর শাফা‘আত পেয়ে মু’মিন ও সৎকর্মশীলদের সাথেই জান্নাতে চলে যায়, তা হলে দুনিয়ায় মু’মিনদের এত কষ্ট করারই-বা কী হেতু থাকতে পারে? তা ছাড়া ফাছিক ও নাফরমান মু’মিনদের জাহান্নামে যাওয়া সংক্রান্ত বর্ণনাসমূহেরই-বা কী অর্থ থাকতে পারে ?

২. পঞ্চম শাফা‘আত হবে সকল জান্নাতীদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবার জন্যে। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«أَنَا أَوَّلُ شَفِيْعٍ فِيْ الْجَنَّةِ»

‘‘জান্নাতে প্রবেশ করার ব্যাপারে আমি হবো প্রথম শাফা‘আতকারী...’’।[6]হাশরের ময়দানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ-কয়টি শাফা‘আতের কথাই কিতাবাদিতে পাওয়া যায়। তবে এ-ছাড়াও অপরাধী মু’মিনদের জাহান্নামে প্রবেশের পর সেখান থেকে তাদেরকে পুনরায় বের করে নিয়ে আসার জন্যেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আরো কিছু শাফা‘আত রয়েছে, যা আমরা পরে বর্ণনা করবো।

>


[1]. হাশরের মাঠে রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর এ শাফা‘আত সংক্রান্ত হাদীসটি হাদীস গ্রন্থসমূহে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। দেখুন: মুসলিম, প্রাগুক্ত; (ঈমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: সর্বনিম্ন জান্নাতবাসীর স্থান), ১/১৮৩।

[2]. আহমদ, প্রাগুক্ত; ২/৪৩৫।

[3]. শিববীর আহমদ উছমানী, ফতহুল মুলহিম বি শরহে সহীহ মুসলিম; (করাচী: মাকতাবাতুল হেজায, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), ১/৩৬১; ফতহুল বারী বি শরহিল বুখারী;১১/৪২৮।

[4]. তিরমিযী, প্রাগুক্ত; (অধ্যায়: সিফতিল কিয়ামাঃ, পরিচ্ছেদ নং: ১১), ৪/৬২৫।

[5]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; (কিতাবুল ঈমান, বাব: ইখতেবাউন নাবীয়্যি দাওয়াতাশ শাফা’আতি লি উম্মাতিহি), ১/১৮৮।

[6].মুসলিম, প্রাগুক্ত;১/১৮৮; আহমদ, প্রাগুক্ত; ৩/১৪০; ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আজীম ৪/৬৬।

যারা বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করেন এবং ফরয রোযা পালন ছাড়াও প্রতি মাসে নফল রোযা পালন করেন, হাশরের ময়দানে কুরআন ও রোযা তাদের জন্য শাফা‘আত করবে। আবু উমামাঃ আলবাহিলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন:

«اِقْرَءُوْا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِيْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيْعًا لأَصْحَابِهِ»

তোমরা কুরআন পাঠ কর। কেননা, তা কেয়ামতের দিন এর পাঠকারীদের জন্য শাফা‘আতকারী হিসেবে আগমন করবে’’।[1]

অপর হাদীসে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বলেন:

«إنَّ الصِّيَامَ وَالْقُرْآنَ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ»

‘‘নিশ্চয় রোযা ও কুরআন কেয়ামতের দিন বান্দার জন্য শাফা‘আত করবে’’।[2]

>
[1].মুসলিম, প্রাগুক্ত; (কিতাবু সালাতিল মুসাফিরীন.., বাব:ফাজাইলু তিলাওয়াতিল কুরআন...), ১/৫৫৩।

[2]. আহমদ, প্রাগুক্ত; ২/১৭৪।

যারা দুনিয়ায় থাকাকালে আল্লাহর নিকট অধিকহারে জান্নাত কামনা করবে এবং জাহান্নাম থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইবে, কেয়ামতের দিন জান্নাত ও জাহান্নাম তাদের জন্য শাফা‘আত করবে। জান্নাত বলবে: হে আল্লাহ! এ লোকটি দুনিয়ায় থাকাকালে তোমার কাছে আমাকে অধিকহারে কামনা করেছে, তাই তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। আর জাহান্নাম বলবে: হে আল্লাহ! এ লোকটি আমার শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য তোমার কাছে অধিক হারে আশ্রয় চেয়েছে, সুতরাং তাকে আমার কাছে দেবেন না। জান্নাত ও জাহান্নামের শাফা‘আত প্রসঙ্গে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«أَكْثِرُوْا مَسْأَلَةَ اللهِ الْجَنَّةَ وَالاِسْتِعَاذَةَ بِه مِنَ النَّارِ، فَإِنَّهُمَا شَافِعَتَانِ ومُشَفِّعَتَانِ»

‘‘আল্লাহর কাছে অধিকহারে জান্নাত কামনা কর এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাও। কেননা, জান্নাত ও জাহান্নাম শাফা‘আতকারী হবে এবং তাদের শাফা‘আত গৃহীত হবে’’।[1]

>
[1]. এ হাদীসটি আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম তাঁর ‘হাদিউল আরওয়াহ’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বর্ণনা করেছেন। দেখুন:পৃ. ১৪৮। আবু শুজা’ শেরওয়াই ইবন শহরদার ইবন শেরওয়াই আদ-দাইলমী, মুনাদুল ফেরদাউস;সম্পাদনা: সাঈদ ইবন বাসইয়ূনী যাগলুল, (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাঃ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৬ খ্রি.), ১/৭২।

আখেরাতে হাশরের ময়দানে শাফা‘আতকারীদের মাঝে রয়েছে মু’মিনদের সেই সব সন্তানাদি যারা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছে। আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«مَا مِنْكُنَّ امْرَأَةٌ قَدَّمَ ثَلاَثَةً مِنْ وَلَدِهَا إِلاَّ كَانَ لَهَا حِجَابًا مِنَ النَّارِ. فَقَالَتْ امْرَأَةٌ : وَ اثْنَيْنِ ، قَال: واثْنَيْنِ»

‘‘তোমাদের মধ্যকার যে মহিলার তিনটি সন্তান মারা যাবে, তার সে সন্তানরা তার জন্য জাহান্নামের আগুনের সামনে পর্দা স্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে। উপস্থিত এক মহিলা বললো: দু’টি সন্তান মারা গেলে কী হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:দু’টি সন্তান মারা গেলেও একই অবস্থা হবে’’।[1] ইবনে মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত অপর হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বলেন:

«مَنْ قَدَّمَ ثَلاَثَةً لَمْ يَبْلُغُوْا الحُلْمَ كَانُوْا لَهُ حِصْنًا حَصِيْنًا مِنَ النَّارِ . قَالَ أَبُو ذَرٍّ : قَدَّمْتُ اثْنَيْنِ؟ قَالَ: وَاثْنَيْنِ. فَقَالَ أُبَيُّ بْنُ كَعْبٍ :قَدَّمْتُ وَاحِدًا ؟ قَالَ : وَوَاحِدًا، وَلٰكِنْ إِنَّمَا ذَلِكَ عِنْدَ الصَّدْمَةِ الأُوْلٰى»

‘‘যে ব্যক্তির তিনটি নাবালক সন্তান মারা যাবে, তারা সে ব্যক্তির জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে নিরাপদ দূর্গে পরিণত হবে। (একথা শুনে) আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন: আমার দু’টি সন্তান মারা গেছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: দু’টি সন্তান মারা গেলেও তাই হবে। (উপস্থিত জনগণের মধ্য থেকে) উবাই ইবনে কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন:আমার একটি সন্তান মারা গেছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: একটি সন্তান মারা গেলেও তাই হবে, তবে এ সুযোগ কেবল তারাই পাবে যারা সন্তান মারা যাওয়ার প্রাক্কালে ধৈর্য ধারণ করেছে’’।[2]

>



[1]. বুখারী, প্রাগুক্ত; (কিতাবুল ইলম, পরিচ্ছেদ: জ্ঞান চর্চার উদ্দেশ্যে মহিলাদের জন্য কি পিৃথক কোন দিন নির্দ্দিষ্ট করা হবে?), ১/১/ ৬০-৬১।

[2].তিরমিযী, প্রাগুক্ত; (জানাইয অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: যার এক সন্তান মারা গেছে তার কী ছাওয়াব রয়েছে?), ৩/৩৬৬।

বিশুদ্ধ হাদীসে হাশরের ময়দানে শহীদদের পক্ষ থেকে তাঁদের নিকটাত্মীয়দের মধ্যকার সত্তর জনের ব্যাপারে শাফা‘আত করার কথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন বিশিষ্ট সাহাবী মিকদাম ইবন মা‘দিই কারিব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে শহীদের ফযীলত সম্পর্কে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ বলেন: ‘‘আল্লাহর নিকট শহীদের জন্য মোট ছয়টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে’’। এ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে- ‘‘শহীদ তাঁর পরিবারের মধ্য থেকে সত্তর ব্যক্তির ব্যাপারে শাফা‘আত করবে’’।[1]

উল্লেখ্য যে, হাশরের ময়দানে উক্ত এ-সব শাফা‘আত ব্যতীত সাধারণভাবে অন্যান্য নবী, ওলি ও মু’মিনদের শাফা‘আতের কোনো সুনির্দিষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় না। বরং তাঁদের শাফা‘আত পরবর্তী পর্যায়ে হবে বলে হাদীস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।

>
[1]. হাদীসের শব্দ হচ্ছে,

عن المقدام بن معد يكرب سنان رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم إن للشهيد ثم الله ست خصال. و ذكر منها:" ويشفع في سبعين إنسانا من أقاربه

বুখারী, প্রাগুক্ত; (কিতাবুল ইলম, পরিচ্ছেদ: জ্ঞান চর্চার উদ্দেশ্যে মহিলাদের জন্য কি পৃথক কোন দিন নির্দ্দিষ্ট করা হবে?), ১/১/ ৬০-৬১।

[1].তিরমিযী, প্রাগুক্ত; (জানাইয অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: যার এক সন্তান মারা গেছে তার কি ছাওয়াব রয়েছে?), ৩/৩৬৬। দেখুন:মুসলিম, প্রাগুক্ত; হাদীস নং-১৮৮৫ আব্দুল্লাহ ইবনে আমর থেকে, তিরমিযী, প্রাগুক্ত; হাদীস নং-১৬৬৩ ইবনে কাছীর, তাফছীরুল কুরআনিল ‘আজীম; ৪/১৭৫; আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; (কিতাবুল জিহাদ, বাব: ফদলিশ শহীদ), ৩/১৫।
শাফা‘আতের দ্বিতীয় পর্যায়: জাহান্নামীদের জাহান্নামে প্রবেশের পর যারা শাফা‘আতের অনুমতি পাবেন

হাশরের ময়দানে মহান আল্লাহ যখন তাঁর বান্দাদের মাঝে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে ফয়সালা করবেন, তখন তাঁর অনুমতিক্রমে জান্নাতবাসীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর জাহান্নামবাসীরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এ পর্যায়ে আল্লাহ তা‘আলা পুনরায় শাফা‘আতের অনুমতি প্রদান করবেন।

দ্বিতীয় পর্যায়ে জান্নাতবাসীদের জন্য রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফা‘আত:

এ পর্যায়ে জান্নাতবাসীদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি শাফা‘আত থাকার বর্ণনা আক্বীদা বিষয়ক কিতাবাদিতে পাওয়া যায়। তবে কোনো কিতাবেই এর পিছনে কী দলীল রয়েছে, অনেক চেষ্টা করেও আমি এর কোনো দলীল খোঁজে পাই নি[1]।

জাহান্নামবাসীদের জন্য শাফা‘আত:

হাশরের ময়দানে যারা শির্কের অপরাধে দন্ডিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ না করে অন্যান্য অপরাধজনিত কারণে জাহান্নামে প্রবেশ করবে, তাদের জন্য এ পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তিন থেকে চারটি শাফা‘আতের কথা আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত শাফা‘আত সংক্রান্ত সুদীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-তাঁর জাহান্নামী উম্মতদের জন্য আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি ও অনুনয় বিনয় করে বলবেন:

«... رَبِّيْ أُمَّتِيْ أُمَّتِيْ، فَيُحِدُّ لَهُ حَدًّا فَيُدْخِلُهُمُ الْجَنَّةَ»

‘‘...প্রভু আমার উম্মত! আমার উম্মত! তখন আল্লাহ তাঁকে (কিছু লোকদের) শাফা‘আতের জন্য একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে দেবেন, ফলে তিনি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’’।[2] আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস অনুযায়ী এ-ভাবে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-পরপর তিনবার আমার উম্মত আমার উম্মত এ-কথা বলে আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকতে থাকবেন এবং প্রতিবারেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে নির্দিষ্ট কিছু লোকদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে এনে জান্নাতে প্রবেশ করানোর অনুমতি দেবেন। তবে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এ ধরনের শাফা‘আত চার বার হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে।[3] হাদীস দু’টি খুবই দীর্ঘ হওয়ার কারণে এখানে তা বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকলাম।

জাহান্নামীদের জন্য ফেরেশ্তা, নবী ও মু’মিনদের শাফা‘আত:

রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর পর তিন থেকে চার বার শাফা‘আতে তাঁর উম্মতের মধ্যকার শির্ক ব্যতীত অন্যান্য অপরাধে জাহান্নামবাসী অসংখ্য মু’মিন নর-নারী মুক্তি পাওয়ার পরেও তাঁর উম্মতের মধ্যকার কিছু লোক জাহান্নামে থেকে যাবে। তখন জান্নাতবাসী মু’মিনরা তাদের পরিচিত অনেককে শেষ পর্যন্ত জান্নাতে দেখতে না পেয়ে তারা সে-সব লোকদের জন্যে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানাবে। তখন আল্লাহ তাদেরকে সে-সব লোকদের জন্য শাফা‘আতের অনুমতি প্রদান করবেন। আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এ কথাগুলো এভাবে বর্ণিত হয়েছে:

«...حَتَّى إِذَا خَلُصَ الْمُؤْمِنُوْنَ مِنَ النَّارِ فَوَ الَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ ! مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ بِأَشَدَّ مُنَاشَدَةً لِلَّهِ فِيْ اسْتِقْصَاءِ الْحَقِّ، مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ يَومَ الْقِيَامَةِ لِإِخْوَانِهِمُ الَّذِيْنَ فِيْ النَّارِ. يَقُوْلُوْنَ : رَبَّنَا ! كَانُوْا يَصُوْمُوْنَ مَعَنَا ، وَ يُصَلُّوْنَ وَ يَحُجُّوْنَ. فَيُقَالُ لَهُمْ :أَخْرِجُوْا مَنْ عَرَفْتُمْ . فَتُحْرَمُ صُوَرُهُمْ عَلَى النَّارِ فَيُخْرِجُوْنَ خَلْقًا كَثِيْرًا قَدْ أَخَذَتِ النَّارُ إِلى نِصْفِ سَاقَيْهِ وَإِلى رُكْبَتِهِ. ثُمَّ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا ! مَا بَقِيَ فِيْهَا أَحَدٌ مِمَّنْ أَمَرْتَنَا بِهِ. فَيَقُوْلُ :ارْجِعُوْا فَمَنْ وَجَدتُّمْ فِيْ قَلْبِهِ مِثْقَالُ دِيْنَارٍ مِنْ خَيْرٍ فَأَخْرِجُوْهُ. فَيُخْرِجُوْنَ خَلْقًا كَثِيْرًا. ثُمَّ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا ! لَمْ نَذّرْ فِيْهَا أَحَدًا مِمَّنْ أَمَرْتَنَا. ثُمَّ يَقُوْلُ اللهً :ارْجِعُوْا فَمَنْ وَجَدْتُمْ فِيْ قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ فَأَخْرِجُوْهُ. فَيُخْرِجُوْنَ خَلْقًا كَثِيْرًا. ثُمَّ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا! لَمْ نّذّرْ فِيْهَا خَيْرًا. فَيَقُوْلُ اللهُ تَعَالَى : شَفَعَتِ الْمَلاَئِكَةُ و شَفَعَ النِّبِيُّوْنَ وَ الْمُؤْمِنُوْنَ وَ لَمْ يَبْقَ إِلاَّ أَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ ، فَيَقْبِضُ اللهُ قَبْضَةً مِنَ النَّارِ فَيُخْرِجُ مِنْهَا قَوْمًا لَمْ يَعْمَلُوْا خَيْرًا قَطٌّ»

‘‘...অবশেষে যখন (নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য জাহান্নামে প্রবেশকারী) মু’মিনরা (রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফা‘আতে) নাযাত পাবে, তখন আল্লাহর শপথ যার হাতের মধ্যে আমার আত্মা! তোমাদের প্রত্যেকেই কেয়ামতের দিন তার অধিকার পরিপূর্ণভাবে আদায়ের লক্ষ্যে তাদের জাহান্নামবাসী ভাইদের মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে অধিকভাবে অনুনয়-বিনয় করতে থাকবে। তারা বলবে:প্রভু হে! তারা আমাদের সাথে রোযা পালন করতো, নামায আদায় করতো ও হজ্জ করতো। তখন তাদেরকে বলা হবে:তোমরা যাদের চিনতে পারো, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে নিয়ে এসো। এ-সময়ে তাদের পরিচিত জনদের মুখমণ্ডল জাহান্নামের উপর হারাম করা হবে, তখন তারা তাদের চিনতে পেরে অসংখ্য লোকদের বের করে নিয়ে আসবে এমতাবস্থায় যে, তাদের কারো উভয় পায়ের জঙ্ঘার অর্ধ পর্যন্ত, কারো হাঁটু পর্যন্ত আগুনে পুড়ে গেছে। এরপর তারা বলবে:প্রভু হে! যাদের আপনি বের করে নিয়ে আসার জন্য আমাদেরকে আদেশ করেছিলেন, তাদের কাউকেই আমরা রেখে আসিনি।

তখন আল্লাহ তা‘আলা পুনরায় বলবেন: ফিরে যাও, যাদের অন্তরে এক দীনার পরিমাণ ওজনের কল্যাণ পাও তাদেরকে বের করে নিয়ে এসো। এবারও তারা অনেক লোককদেরকে বের করে নিয়ে আসবে। অতঃপর বলবে: আল্লাহ আপনি যাদেরকে বের করে নিয়ে আসতে আদেশ করেছিলেন, তাদের একজনকেও আমরা সেখানে রেখে আসিনি। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে আবার বলবেন: ফিরে যাও, যাদের অন্তরে অণু পরিমাণ কল্যাণ পাও, তাদেরকেও বের করে নিয়ে এসো। এবারও তারা অনেক লোককে বের করে নিয়ে এসে বলবে: প্রভু হে! কল্যাণ আছে এমন কাউকে আমরা জাহান্নামে রেখে আসিনি। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন:ফেরেশ্তা, নবীগণ ও মু’মিনরা শাফা‘আত করলো, শুধুমাত্র রহমানুর রাহীম ব্যতীত আর কারো শাফা‘আত অবশিষ্ট থাকেনি। এ-কথা বলে আল্লাহ একমুষ্টি আগুন তাঁর হাতে নেবেন এবং সেখান থেকে এমন কিছু লোকদের বের করে আনবেন যারা কখনও কোনো ভাল কাজ করেনি’’।[4]

আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীসের এ অংশ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ফেরেশ্তা, নবী, ওলি ও সালেহীনদের শাফা‘আত হবে সে সকল অপরাধীদের জাহান্নাম থেকে বের করে আনার ক্ষেত্রে, যারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জাহান্নামে প্রবেশ করেছে। কাউকে জাহান্নামে প্রবেশ করতে না দেয়ার জন্য তাঁদের কোনো শাফা‘আত হবে-এ জাতীয় কোনো কথার প্রমাণ নেই। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, পীর ও মাশায়েখগণ আখেরাতে কারো জন্যে শাফা‘আতের অনুমতি পাবেন কি না, তা নিশ্চিতভাবে না জানা সত্ত্বেও তারা তাদের ভক্তদেরকে তাদের শাফা‘আতের ব্যাপারে আশ্বস্ত করে থাকেন।

মু’মিন ও অলিগণের শাফা‘আত জাহান্নামবাসীদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে আনার ক্ষেত্রে হয়ে থাকলেও তারা হাশরের ময়দানেই তাদের মুরীদদেরকে জাহান্নামে যেতে না দেবার জন্যে শাফা‘আত করবেন বলে প্রচার করেন। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, আখেরাতের ব্যাপারে কুরআনের বক্তব্য হচ্ছে- এ দিনে কারো রক্তের সম্পর্ক কারো কোনো উপকারে আসবে না।[5] সে দিন কোনো পিতা তার সন্তানের এবং কোনো সন্তান তার পিতার কোনো কাজে আসবে না।[6] যেখানে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-তাঁর নিকটাত্মীদেরকে এই বলে সাবধান করে দিয়েছিলেন:

«لاَ أُغْنِيْ عَنْكُمْ مِنَ اللهِ شَيْئًا»

‘আমি (আখেরাতে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষার জন্য) তোমাদের কোনই উপকার করতে পারবো না’’,[7] সেখানে পীর ও মাশায়েখগণ তাঁদের নিকটাত্মীয় ও ভক্তদের জন্য কিভাবে শাফা‘আত করার আশ্বাস দিতে পারেন, সত্যিই তা হতবাক করার মত বিষয়।

আখেরাতে ওলিগণকে অভয় প্রদানের তাৎপর্য:

কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ অলিগণের সংজ্ঞা প্রদান পূর্বক তাঁদেরকে একটি অভয় বাণী এ মর্মে দান করেছেন যে,

﴿ أَلَآ إِنَّ أَوۡلِيَآءَ ٱللَّهِ لَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٦٢ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَكَانُواْ يَتَّقُونَ ٦٣ ﴾ [يونس: ٦٢، ٦٣]

‘‘জেনে রেখো! নিশ্চয় আল্লাহর অলিগণের কোনো ভয় নেই, তাঁরা চিন্তিতও হবেনা। ওলিগণ তাঁরাই যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে’’।[8] অনেক সাধারণ লোকেরা এ আয়াতের বাহ্যিক অর্থের প্রতি লক্ষ্য করে মনে করেন যে, যেহেতু অলিগণের আখেরাতে কোনো ভয় ও ভীতি নেই, সুতরাং আখেরাতে তারা শুধু তাঁদের ভক্তদের মুক্তির জন্য সুপারিশ নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন। এমনকি এ আয়াতের ভিত্তিতে একদিন আমি নিজেই একজনের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলাম।

আসলে আখেরাতের ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে তাদের যথার্থ জ্ঞান না থাকার কারণেই তারা মূলত এ ধরনের উক্তি করে থাকেন। এ আয়াতের সারকথা হচ্ছে: যারা মু’মিন ও মুত্তাক্বী, তারাই হলো আল্লাহর ওলি। আর তাঁদের জন্যেই রয়েছে আখেরাতে এ অভয়বাণী। এ জন্যে কারো আব্দুল কাদির জীলানী ও মঈনুদ্দীন চিশ্তীর মত সর্বজনের নিকট ওলি হিসেবে পরিচিত হওয়া কোনো জরুরী ব্যাপার নয়। বরং আল্লাহ তা‘আলার দৃষ্টিতে যারাই মু’মিন ও মুত্তাক্বী বলে বিবেচিত হবে, তারাই হবে আল্লাহর ওলি এবং এ অভয়বাণী পাওয়ার যোগ্য। এ অভয়বাণী মূলত সে রকমেরই একটি অভয়বাণী যেমনটি কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন আয়াতে অন্যান্য সৎকর্মশীলদেরকেও দান করা হয়েছে।[9]যেমন আল্লাহ তা‘আলা অপর আয়াতে বলেন:

﴿ يَٰبَنِيٓ ءَادَمَ إِمَّا يَأۡتِيَنَّكُمۡ رُسُلٞ مِّنكُمۡ يَقُصُّونَ عَلَيۡكُمۡ ءَايَٰتِي فَمَنِ ٱتَّقَىٰ وَأَصۡلَحَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٣٥ ﴾ [الاعراف: ٣٥]

‘‘হে আদম সন্তানরা! যদি তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্য থেকে রাসূলগণ আগমন করে তোমাদেরকে আমার আয়াতসমূহ বর্ণনা করে, তবে যে ব্যক্তি তাক্বওয়ার পথ অবলম্বন করে এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, তাদের কোনো আশঙ্কা নেই এবং তারা দুঃখিত হবেনা’’।[10]এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, যারা তাক্বওয়ার পথ অবলম্বন করবে এবং নিজেকে সংশোধন করে নিবে তাদের জন্যেও ওলিদের ন্যায় সমান অভয়বাণী প্রদান করা হয়েছে। এতে বুঝা যাচ্ছে যে, যারাই এ আয়াতে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে তাঁরাই আল্লাহর ওলি হিসেবে গণ্য হবে। যদিও সাধারণ মানুষের নিকট তাঁরা ওলি হিসেবে পরিচিত নাও হতে পারেন।

এ জাতীয় আয়াতসমূহে এ অভয়বাণী প্রদানের অর্থ হচ্ছে-মু’মিন, মুত্তাক্বী তথা সৎকর্মশীলদেরকে এ মর্মে আশ্বস্ত করা যে, আখেরাতে তাঁদের ভয়ের কোনো কারণ নেই, তাঁদেরকে অবশ্যই সে-দিন তাঁদের কর্মের বিনিময় স্বরূপ সম্মানজনক স্থানে পৌঁছে দেয়া হবে। এর অর্থ এ-নয় যে, তাঁরা আল্লাহর ওলি হয়েছেন বলে আখেরাতে হিসাব-নিকাশের পূর্বে তাঁরা যেমন খুশী তেমন করে ঘুরে বেড়াবেন। নিজের পরিণতির ব্যাপারে কোনো চিন্তা না করে কেবল পরের চিন্তায় ব্যস্ত থাকবেন। আখেরাতে যেখানে রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- ব্যতীত অন্যান্য সকল নবীগণ নিজের চিন্তায় মগ্ন থাকবেন, সেখানে কী করে ওলিগণ পরের চিন্তায় ব্যস্ত থাকবেন? তা ছাড়া কে সত্যিকারের অলি, তা তো প্রমাণিত হবে হিসাব-নিকাশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। তাই হিসাবের পূর্বে সাধারণ মানুষের ন্যায় তাঁরাও নিজের কী হয়, তা নিয়ে কম-বেশী উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্যে থাকবেন। তাঁদের অন্তরে অন্যের চিন্তা আসলেও সে-দিনে আল্লাহর ক্রোধ ও প্রচণ্ড প্রতাপ দেখে জান্নাতে না যাওয়া পর্যন্ত মনের কথা মনের মধ্যেই থেকে যাবে। তা বের করার মত কারো সাহস হবে না।

এ অভয়বাণীকে একজন ভাল পরীক্ষা দানকারীর ভাল ফলাফল লাভের আশার সাথে তুলনা করা যায়। ভাল পরীক্ষা দানকারীর অন্তরে ভাল ফলাফল লাভের আশা থাকলেও ফলাফল প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত তার অন্তরে সে আশার পাশাপাশি তার নিজের অজান্তে কোনো ভুল হয়ে যাওয়ার কারণে নম্বর কমে যায় কী না, তা নিয়ে অনেক উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা থাকে, তেমনি ওলিগণ এ সুসংবাদ প্রাপ্ত হয়ে থাকলেও মানুষ হিসেবে তাঁদের ভুল-ভ্রান্তি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় হিসেব নিকাশের মাধ্যমে নিজেদের জান্নাতবাসী হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের অন্তর আল্লাহর শাস্তির ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাকবে এবং সে ভয়ই তাঁদেরকে অন্যের মুক্তির ব্যাপারে চিন্তা করা থেকে বিরত রাখবে। নবীগণ যেখানে আল্লাহর ভয়ে নফসী নফসী করবেন, সেখানে অলীগণ অন্যের চিন্তা করবেন, এটা কী করে সম্ভব হতে পারে!? তবে হ্যাঁ, নিজের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে জান্নাতে যাওয়ার পর তাঁরা অন্যের ব্যাপারে চিন্তা করবেন এবং শাফা‘আতের সুযোগ আসলেই তাঁরা তাঁদের সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেন, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কেননা, এটিই কুরআন, সুন্নাহ ও যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত।

সাধারণ মু’মিনরগণও শাফা‘আত করবে:

হিসাব-নিকাশের পর জান্নাতীগণ জান্নাতে চলে যাওয়ার পর জাহান্নামীদের জাহান্নাম থেকে বের করে আনার জন্য রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরপর তিন থেকে চারটি শাফা‘আতের পর যখন মু’মিনদের শাফা‘আতের সুযোগ আসবে, উপর্যুক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সে শাফা‘আতের সুযোগ কেবল আমাদের কাছে পরিচিত ওলিদের জন্যেই হবে না, বরং তখন বেহেশ্তবাসী যে কোনো সাধারণ মু’মিনরাও তাদের পরিচিতজনদের জন্য শাফা‘আত করার সুযোগ পাবে। ولله الحمد والمنة

যারা কারো শাফা‘আত পাবে না:

মূলত শাফা‘আত হচ্ছে জাহান্নামীদের উপর আল্লাহ তা‘আলার করুণা নাযিলের একটি বিশেষ মাধ্যম। তবে এ করুণা লাভের সৌভাগ্য কেবল তাদেরই নসীব হবে যারা শির্কের মত মহা অপরাধে আল্লাহর বিচারে দন্ডিত না হয়ে অন্যান্য কবীরা গুনাহের অপরাধে দন্ডিত হয়ে জাহান্নামী হবে। আর যারা শির্কে আকবারের অপরাধে দন্ডিত হয়ে জাহান্নামী হবে তাদের জন্য সে দিন আল্লাহর কোনো করুণা নেই। কেননা, জান্নাত তাদের জন্য চিরতরে হারাম করে দেয়া হয়েছে। তাই তাদের যেমন রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফা‘আত পাওয়ার সৌভাগ্য হবেনা, তেমনি তাদের অপর কোনো মু‘মিনদেরও শাফা‘আত প্রাপ্ত হওয়ার সৌভাগ্য হবেনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِيْ مَنْ قَالَ لاَ إِلٰه إِلاَ اللهُ خَالِصًا مِنْ قِبَلِ نَفْسِهِ».

‘‘আমার শাফা‘আত লাভে সে লোকই ধন্য হবে যে নিজ থেকে একনিষ্ঠভাবে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু এর স্বীকৃতি দান করেছে’’।[11] এ কালিমার স্বীকৃতি একনিষ্ঠভাবে তারাই দিয়ে থাকবে, যারা শির্ক না করে মৃত্যুবরণ করবে। অপর হাদীসে রাসলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«أَتَانِيْ آتٍ مِن عِنْدِ رَبِّيْ فَخَيَّرَنِيْ بَيْنَ أَنْ يُدْخَلَ نِصْفُ أُمَّتِيْ الْجَنَّةَ وبَيْنَ الشَّفَاعَةِ، فَاخْتَرْتُ الشَّفَاعَةَ، وَ هِيَ لِمَنْ لاَ يُشْرِكْ بِاللهِ شَيْئًا»

‘‘আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে একজন আগন্তুক আগমন করলেন এবং আমাকে আমার অর্ধেক উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করা আর শাফা‘আত করার মধ্য থেকে যে কোনো একটিকে গ্রহণ করার জন্য এখতিয়ার দিলেন, তখন আমি শাফা‘আতকেই বেছে নিলাম। এ শাফা‘আত হবে কেবল তাদের জন্যেই যারা আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করেনি’’।[12] যারা শির্কের অপরাধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শাফা‘আত থেকে বঞ্চিত হবে, তারা যে অন্যান্য সকল শাফা‘আতকারীদের শাফা‘আত পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

এমন ব্যক্তিদের জাহান্নামে যাওয়ার কারণ না জেনে কেউ তাদের জন্য সুপারিশ করলেও সে সুপারিশ তাদের জন্য কোনো কাজে আসবে না। তারা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের অধিবাসী হিসেবে সেখানে অনন্তকাল পর্যন্ত শাস্তির পর শাস্তি ভোগ করতেই থাকবে। نعوذ بالله من الشرك ومن عذابه. উল্লেখ্য যে, হাশরের ময়দানে কোনো ওলি ও মু’মিনদের শাফা‘আত করার সুযোগ না থাকা এবং জাহান্নামে প্রবেশকারীদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে নিয়ে আসার ব্যাপারে তাদের শাফা‘আত হওয়া প্রসঙ্গে আমি উপরে যা বললাম, এটি আমার নিজস্ব কোনো ইজতেহাদী কথা নয়। এটি যেমন উপর্যুক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, তেমনি তা মুসলিম মনীষীদের লেখনী দ্বারাও প্রমাণিত। আল্লামা ইবনু আবিল ‘ইয্‌য আল-হানাফী (রহ.)ও তাঁর কিতাবে মু’মিনদের শাফা‘আত প্রসঙ্গে উক্ত ধরনের কথাই বলেছেন।[13]

>
[1] শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-উসাইমীন বলেন, এগুলো মুমিনদের পক্ষ থেকে পরস্পরের দো‘আ থেকে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বুখারীতে (হাদীস নং ৪০৬৭; মুসলিম, ২৪৯৮) এসেছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উবাইদ আবি আমেরের জন্য জান্নাতে উঁচু মর্যাদার দো‘আ করেছিলেন। অনুরূপভাবে আবদুল্লাহ ইবন কাইস আবু মূসার জন্যও রাসূল সে রকম দো‘আ করেছিলেন। তদ্রূপ আবু সালামার জন্য রাসূলের অনুরূপ দো‘আ ছিল। (মুসলিম, হাদীস নং ৯২০) [সম্পাদক]

[2]. বুখারী, প্রাগুক্ত; (ঈমান অধ্যায়), ৩/৬/৪৩।

[3].মুসলিম, প্রাগুক্ত; (কিতাবুল ঈমান, বাব:সবচেয়ে নিম্ন স্তরের জান্নাতির মর্যাদা), ১/১৮০-১৮১।

[4].বুখারী, প্রাগুক্ত; (কিতাবুত তাওহীদ, বাব নং ২০, হাদীস নং ৭০০১), ৬/২৭০৭; মুসলিম, প্রগুক্ত; (কিতাবুল ঈমান, বাব নং ৮০, হাদীস নং ১৮২), ১/১৬৯; ক্বুরত্ববী; প্রাগুক্ত; ৩/২৭৪।

[5].আল্লাহ বলেন:

لَنْ تَنْفَعَكُمْ أَرْحَامُكُمْ وَ أَوْلاَدُكُمْ يَوْمَ الْقَيَامَةِ.

কেয়ামতের দিন তোমাদের বংশের সম্পর্ক ও সন্তানাদি কোনই কাজে আসবে না’’। আল-কুরআন, সূরা মুমতাহিনাঃ: ২।

[6].আল্লাহ বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱتَّقُواْ رَبَّكُمۡ وَٱخۡشَوۡاْ يَوۡمٗا لَّا يَجۡزِي وَالِدٌ عَن وَلَدِهِۦ وَلَا مَوۡلُودٌ هُوَ جَازٍ عَن وَالِدِهِۦ شَيۡ‍ًٔاۚ ﴾ [لقمان: ٣٣]

‘হে লোক সকল ! তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, এবং এমন এক দিনকে ভয় কর যেদিন কোন পিতা তার সন্তান এবং কোন সন্তান তার পিতার কোন উপকারে আসবে না’’। আল-কুরআন, সূরা লুক্বমান: ৩৩।

[7].বুখারী, প্রাগুক্ত; (কিতাবুল ওয়াসায়া, বাব: নং ১১, হাল ইয়াদখুলুন নিসা-উ ওয়াল ওয়ালাদু ফিল আকারিব), ৩/১০১২; মুসলিম, প্রাগুক্ত; (কিতাবুল ঈমান, বাব:৮৯, হাদীস নং ২০৪), ১/১৯২।

[8].আল-কুরআন, সূরা: ইউনুস: ৬২।

[9].আমরা যে-সব সৎকর্মশীলদেরকে সাধারণত আল্লাহ তা‘আলার ওলি বলে মনে করি না, সেরকম সৎকর্মশীলদের জন্য অনুরূপ অভয়বাণী উচ্চারণের বিষয়টি জানার জন্য প্রয়োজনে দেখুন: সূরায়ে বাক্বারাঃ এর ৩৮, ১১২, ২৬২, ২৭৭ নং আয়াত, সূরায়ে আলে ইমরানের ১৭০ নং আয়াত, সূরায়ে নিসা এর ৮৩ নং আয়াত, সূরায়ে আন‘আমের ৪৮ নং আয়াত ও সূরায়ে আ‘রাফের ৩৫ ও ৩৯ নং আয়াত। এ-সব আয়াত পাঠ করলে যে কেউই বুঝতে পারবে যে, ‘আখেরাতে আল্লাহর অলিদের কোন ভয় ও চিন্তা নেই’ এ অভয়বাণী শুধু তথাকথিত ওলি আল্লাহদের জন্যেই নয়, বরং আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এরকম অভয়বাণী যে কোন মু‘মিন ও সৎকর্মশীলদের জন্যেও রয়েছে। লেখক

[10].আল-কুরআন, সূরা আ‘রাফ:৩৫।

[11]. বুখারী, প্রাগুক্ত; (কিতাবুল ইলম, বাবুল হিরসি আলাল হাদীস, হাদীস নং-৪০), ১/১/৫৯।

[12]. তিরমিযী, প্রাগুক্ত; (কিতাবু সিফাতিল কিয়ামাঃ, বাব: মা জা-আ ফীশ শাফা‘আতি); পৃ.৬২৭-৬২।

[13]. তিনি রাসূল এর শাফা’আতের আট নং শাফা’আতের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন:

" النوع الثامن : شفاعته في أهل الكبائر من أمته ، ممن دخل النار ، فيخرجون منها ، و قد تواترت بهذا النوع الأحاديث ... وهذه الشفاعة تشاركه فيها الملائكة و النبيون و المؤمنون أيضا." –

দেখুন :ইবনু আবিল ইয্‌য আল- হানাফী, প্রাগুক্ত; পৃ. ২৫৪-২৫৯।
আখেরাতে রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফা‘আতের সংখ্যা

আখেরাতে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কতবার শাফা‘আত করবেন, এ-নিয়ে মুসলিম মনীষীদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। ইবন আবিল ইয্‌য আল-হানাফীর (রহ.) মতে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-মোট আটবার শাফা‘আত করবেন।[1] ইমাম নববী (রহ.) এর মতে মোট পাঁচবার[2] এবং ‘তাইসীরুল আযীযিল হামীদ’ এর গ্রন্থকার মোট ছয়বারের কথা বলেছেন।[3] তাঁরা সংখ্যা বর্ণনার ক্ষেত্রে মতবিরোধের পাশাপাশি উভয় পর্যায়ের শাফা‘আতকে একত্রিত করে বর্ণনা করেছেন। কতটি হাশরের ময়দানে এবং কতটি পরে হবে, তা ভিন্নভাবে উল্লেখ করেন নি। ফলে এ বিষয়ে যাদের গভীর জ্ঞান থাকবে না, তারা তা অধ্যয়ন করলে এ-কথা ভাবতে পারেন যে, রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বোধ হয় হাশরের ময়দানে তাঁর শাফা‘আতের মাধ্যমে সকল অপরাধীদেরকে মুক্ত করে নেবেন। ফলে মুশরিক নয় এমন সকল অপরাধী মু’মিনরাই জাহান্নামে প্রবেশের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে। অনুরূপভাবে তাদের আরো মনে হবে যে, মু’মিনগণ তাঁদের ভক্তদের জন্য রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মতই হাশরের ময়দানে শাফা‘আত করবেন। অথচ এ ধারণা যে আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীসদ্বয়ের পরিপন্থী, তা সে হাদীস অধ্যয়ন করলে যে কেউই বুঝতে পারবে।

>
[1]. তদেব।

[2]. ইমাম নববী, শরহু সহীহ মুসলিম; (স্থান বিহীন: ১ম সংস্করণ, ১৯২৯ খ্রি.), ১/৩/৩৫।

[3]. শেখ সুলাইমান ইবনে আব্দিল্লাহ, প্রাগুক্ত; পৃ. ২৯৪-২৯৫।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৯ পর্যন্ত, সর্বমোট ৯ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে