শির্ক কী ও কেন? প্রথম পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ১ টি
আল্লাহ তা‘আলার উলূহিয়্যাতের বৈশিষ্ট্য

‘উলূহিয়্যাত’ শব্দটি ‘ইলাহ’ শব্দমূল থেকে গৃহীত এবং এরই সম্বন্ধ জ্ঞাপক শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে- উপাস্য (مَعْبُوْدُ), যার আনুগত্য করা হয় (مَتْبُوْعُ) ও মান্যবর (مُطَاعُ)। উলূহিয়্যাতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- যিনি উলুহিয়্যাতের মালিক হবেন তিনি অবশ্যই তাঁর উপাসকদের রব হওয়ার বৈশিষ্ট্যের পূর্ণ অধিকারী হওয়ার কারণে তাদের একচ্ছত্র উপাস্য, আনুগত্য লাভের অধিকারী ও মান্যবর হবেন। আমরা পূর্বেই আল্লাহর রুবূবিয়্যাত সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে এ বিষয়টি প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে, কারো মানুষের রব হওয়ার জন্য তাঁর যেসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া অত্যাবশ্যক, তা মহান আল্লাহর মাঝে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান রয়েছে। কাজেই মানুষের প্রতি তাদের রবের অবদানের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাদের যাবতীয় উপাসনা ও আনুগত্য কেবল তাঁকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হবে। তারা বেঁচে থাকলে কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি বিধানের জন্য বেঁচে থাকবে, জীবন দিতে হলে কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনকে কেন্দ্র করেই দিতে হবে। প্রকাশ্য ও গোপন আল্লাহর যত রকমের উপাসনা রয়েছে তাতে সে কশ্মিনকালেও কাউকে শরীক করবে না, এ মর্মেরই একটি ইস্পাত কঠিন সংকল্প লালিত হবে প্রতিটি মুসলিমের মনের গভীরে।

এ সংকল্পের প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ قُلۡ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحۡيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٦٢ لَا شَرِيكَ لَهُۥۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرۡتُ وَأَنَا۠ أَوَّلُ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ١٦٣ ﴾ [الانعام: ١٦٢، ١٦٣]

‘‘আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার সালাত, কুরবানী, জীবন ও মৃত্যু সবই সমগ্র জাহানের প্রতিপালক আল্লাহের জন্যেই নিবেদিত, তাঁর কোন শরীক নেই। এ ঘোষণা দেয়ার জন্যেই আমি আদিষ্ট হয়েছি, আমিই হলাম সর্বপ্রথম মুসলিম।’’[1] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ সংকল্পের কথা শিক্ষা দেয়া হয়েছে তাঁর উম্মতকে তা শিক্ষা দেওয়ার জন্যেই। এ জন্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে শির্কী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার আদেশ করতে যেয়ে বলেন:

«لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ شَيْئًا، وَإِنْ قُطِّعْتَ وَحُرِّقْتَ»

‘‘তুমি আল্লাহর সাথে শির্ক করবে না যদিও তোমাকে কেটে ফেলা হয় বা আগুনে পুড়ে হত্যা করা হয়।’’[2] আল্লাহর উপাসনায় কাউকে শরীক না করার জন্য এতই কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে কেবল এ-জন্যে যে, মানুষের যাবতীয় রকমের উপাসনা পাবার একক অধিকার রয়েছে কেবল আল্লাহ তা‘আলারই। কেননা, কারো উপাসনা পাবার জন্যে উপাস্যের যে-সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া আবশ্যক, সে সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বলতে এ-বিশ্বজগতের অন্তরালে কেউ থাকলে আছেন কেবল তিনিই। সে জন্যেই তিনি তাঁর সে বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করে পৃথিবীর সকল মানুষকে কেবল তাঁরই উপাসনা করার দিকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন :

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٢١ ﴾ [البقرة: ٢١]

‘‘হে মানব সকল! তোমরা সে প্রতিপালকের উপাসনা কর যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, আশা করা যায় এতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারবে।’’[3]তিনি মানুষদেরকে সৃষ্টি করেছেন বলেই তিনি তাদের রবের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, আর এ মর্যাদা বলেই তিনি তাদের উপাস্যের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েছেন। তাঁর একান্ত দয়া ও করুণার উপরেই যখন তাদের জীবন-জীবিকা, এ জগতে আগমন ও নির্গমন এবং তাদের ভাগ্যের যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণ সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল, তখন কারো অবদানের কৃতজ্ঞতা ও সম্মান প্রকাশার্থে তারা যদি কারো উপাসনামূলক কোন কাজ করে, তা হলে তা করবে কেবল তাদের রবের জন্যেই। কেননা; তাদের প্রতি তাদের রবের যে অবদান রয়েছে, সে রকম অবদান ব্যতীত কেউ কারো উপাসনা পাওয়ার যোগ্য হতে পারে না। মানুষের জীবনের প্রতি নবী ও অলিগণের যে অবদান থাকে, তা উপর্যুক্ত রকমের নয় বলে তাঁরা কারো উপাসনা পেতে পারেন না। তাই তাঁদের সম্মানে আল্লাহর উপাসনার পদ্ধতিতে কোনো কাজ করা যাবে না। যুগে যুগে সাধারণ মানুষেরা এ বিষয়টি বুঝতে পারে নি বলেই নবী-রাসূল ও অলিদের কবরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন উপাসনামূলক কর্মে লিপ্ত হয়েছিল এবং এখনও হচ্ছে।

>
[1]. আল-কোরআন, সূরা আল-আন‘আম : ১৬১ ও ১৬২।

[2]. ইবনে মা-জাঃ, মুহাম্মদ ইবন ইয়াজীদ, আস-সুনান; কিতাবুল ফিতান, বাবুস সাবরি আলাল বালা-ই, সম্পাদনা : মুহাম্মদ ফুআদ ‘আব্দুল বাকী, (স্থান বিহীন : দ্বার এহইয়াউত তুরাছিল আরাবিয়্যা :, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), ২/১৩৩৬।

[3]. আল-কুরআন, সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১।