জীবন এক অচিন দেশের সফর। আর অজানা পথের সফরে বিভিন্ন নদী-উপত্যকা, মরুপর্বত, সমুদ্র-জঙ্গল পার হয়ে ফিরে যেতে হবে আপন দেশ বেহেশ্যে। যে সফর এক দিনের নয়, এক মাসের নয়, নয় এক বা কয়েক বছরের। জীবন ভরের এই সফর সহজও নয়। কত সমস্যা, কত বাধা-বিঘ্ন, কত বিপদ-আপদ এসে উপস্থিত হয় এই লম্বা সফরের দ্বারপ্রান্তে। সুতরাং এ সফরের জন্য যেমন গাইড-বুক ও মানচিত্র চাই, তেমনি চাই মনের মত সহায়ক সঙ্গীও। মুসলিম মুসাফিরের গাইড-বুক হল আল-কুরআন, মানচিত্র হল মহানবীর আদর্শ, তরীকা বা সুন্নাহ। আর সহায়ক সঙ্গী হল আদর্শ স্ত্রী ও বন্ধু।

কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করার জীবন-সন্ধিক্ষণে এবং বিবাহের পূর্বেও সেই সঙ্গী ও বন্ধুর খোজ থাকাটা প্রায় মানুষেরই প্রকৃতিগত ব্যাপার। মানুষ যার পাশে বসে, যার সঙ্গে চলা-ফিরা করে মনে আনন্দ পায়। ভারী কথা তার নিকট বলে মনের বোঝ হাল্কা করে। নিঃসঙ্গতার অন্ধকারে ডুবে থাকা হৃদয়ে সঙ্গতার আলো জ্বালিয়ে জীবনের বিভিন্ন সুখ ও সঙ্কট মুহূর্তে সহায়ক সাথী ও হিতাকাঙ্খী পরামর্শদাতার উৎসাহদান ও অনুপ্রেরণা পায়।

আর বলাই বাহুল্য যে, মনের মত সঙ্গীর সাথে কথা বলে যে আনন্দ পাওয়া যায়, সে আনন্দ আর অন্য কিছুতে পাওয়া যায় না। অন্য দিকে যার প্রকৃত বন্ধ, আছে, তার সকল ত্রুটি দেখার জন্য আর দর্পণের প্রয়োজন হয় না।

অবশ্য এমন লোকও বহু আছে, যাদের চুন খেয়ে গাল তেঁতেছে, ফলে দই দেখেও ভয় পায়। অর্থাৎ, বন্ধুত্বের বাজারে ঠকে বা কাউকে ঠকতে দেখে একাকী থাকতে পছন্দ করে এবং মোটেই কোন মানুষের সঙ্গে মিশতে চায় না। ফলে মাথা ব্যথা করলে তা সারার চেষ্টা না করে, মাথাটাই কেটে ফেলার ফায়সালা করে নেয়। অথচ মহানবী (সা.) বলেন, “যে মু'মিন মানুষের মাঝে মিশে তাদের কষ্টদানে ধৈর্যধারণ করে সেই মু’মিন ঐ মু'মিন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যে লোকেদের সাথে মিশে না এবং তাদের কষ্টদানে ধৈর্যধারণ করে না।” (আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে' ৬৬৫১নং)

অন্য দিকে আর এক শ্রেণীর তরুণ ও যুবক আছে, যারা বন্ধুত্বে অতিরঞ্জন করে। ফলে ধোকা খেতে হয় তাকে। ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেন, লোকেদের সাথে না মিশলে শত্রুতার উদ্ভব হয়। পক্ষান্তরে অধিকভাবে (অনেকের সঙ্গে) মিশলে অসৎ সঙ্গীও প্রশ্রয় পায়। অতএব তুমি এ দুয়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন কর।

বন্ধুত্ব করা উচিত। তবে তা কোন পার্থিব স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে নয়। বন্ধুত্ব হতে হবে। আল্লাহর ওয়াস্তে। অর্থাৎ, একজনকে ভালোবাসবে শুধু এই জন্য যে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন, অথবা তাকে ভালোবাসলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব হবে, অথবা তার সহিত বন্ধুত্ব রাখলে আল্লাহ ও তার দ্বীন বিষয়ে বহু কিছু জানা যাবে, অথবা তার সংসর্গে আল্লাহর ইবাদত সঠিক ও সহজ হবে, অথবা তার পরিবেশে মিশে ইসলামী পরিবেশ গড়া সহজ হবে। এই উদ্দেশ্যই হল বন্ধুত্ব করার মহান উদ্দেশ্য। এমন সৎ উদ্দেশ্যের রয়েছে বিশাল মর্যাদা।

আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধুত্ব কায়েম করার মাঝে ঈমানের পরিপূর্ণতা, মিষ্টতা ও প্রকৃত স্বাদ রয়েছে। মহানবী উক্তি বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে কাউকে ভালোবাসে, আল্লাহর ওয়াস্তে কাউকে ঘৃণাবাসে, আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু দান করে এবং আল্লাহর ওয়াস্তেই কিছু দান করা হতে বিরত থাকে, সে ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারী।” (সহীহ আবু দাউদ ৩৯১০ নং) “তিনটি গুণ যার মধ্যে আছে, সে ঈমানের মিষ্টতা লাভ করেছে, সকল বিষয়, বস্তু ও ব্যক্তির চাইতে আল্লাহ ও তদীয় রসুলকে অধিক ভালোবাসা, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই কাউকে ভালোবাসা এবং আল্লাহ কুফরী থেকে রক্ষা করার পর পুনরায় তাতে ফিরে যাওয়াকে এমন অপছন্দ করা, যেমন আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করা হয়।” (বুখারী ১৬, মুসলিম ৪৩ নং)

“যে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ পেতে পছন্দ করে, সে ব্যক্তি কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যেই অপরকে ভালোবাসুক।” (আহমাদ, বাযযার, সহীহুল জামে ৫৯৫৮ নং)

“সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ সেদিন তার আরশের ছায়া দান করবেন, যেদিন তার ঐ ছায়া ছাড়া আর অন্য কোন ছায়া থাকবে না; তন্মধ্যে সেই দুই ব্যক্তি, যারা আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধুত্ব স্থাপন করে এবং এই বন্ধুত্বের উপরেই তারা মিলিত হয় ও তারই উপর চিরবিচ্ছিন্ন (পরলোকগত) হয়।” (বুখারী ৬৬০, মুসলিম ১০৩১ নং)

“আল্লাহ তাআলা বলেন, 'আমার উদ্দেশ্যে আপোসে বন্ধুত্ব স্থাপনকারীদের জন্য আমার ভালোবাসা সুনিশ্চিত। আমার উদ্দেশ্যে আপোসে উপবেশনকারীদের জন্য আমার ভালোবাসা সুনিশ্চিত। আমার উদ্দেশ্যে আপোসে যিয়ারতকারীদের জন্য আমার ভালোবাসা সুনিশ্চিত এবং আমার উদ্দেশ্যে আপোসে খরচকারীদের জন্যও আমার ভালোবাসা সুনিশ্চিত।” (আহমাদ ৫/২৩৩ মুত্যুত্ত। ১৭৭৯, ত্বাবারানী, হাকেম, সহীহুল জামে’ ৪৩৩ ১নং)

“কিছু লোক আছে যারা নবী নয়, শহীদও নয়। অথচ নবী ও শহীদগণ আল্লাহর নিকট তাদের মর্যাদা দেখে ঈর্ষা করবেন। আর ঐ লোক হল তারা, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আপোসে বন্ধুত্ব কায়েম করে; যাদের মাঝে কোন আত্মীয়তার বন্ধন থাকে না এবং থাকে না কোন অর্থের লেনদেন। আল্লাহর কসম! তাদের মুখমণ্ডল হবে জ্যোতির্ময়। তারা নুরের মাঝে অবস্থান করবে। লোকেরা যখন ভীত-সন্ত্রস্ত হবে তখন তারা কোন ভয় পাবে না। এবং লোকেরা যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে তখন তাদের কোন দুশ্চিন্তা থাকবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সতর্ক হও! নিশ্চয় যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোন ভয় নেই। তারা দুঃখিতও হবে। যারা মুমিন এবং পরহেযগার। তাদের জন্য ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে রয়েছে। সুসংবাদ। আল্লাহর বাক্যাবলীর কোন পরিবর্তন নেই। এটাই হল মহাসাফল্য।” (সূরা ইউনুস ৬২-৬৪ আয়াত, সহীহ আবু দাউদ ৩০১২ নং)

“আল্লাহ তাআলা বলেন, 'আমার মর্যাদার ওয়াস্তে যারা আপোসে ভালোবাসা স্থাপন করবে, তাদের জন্য হবে নূরের মেম্বর; যা দেখে নবী ও শহীদগণ ঈর্ষা করবে।” (সহীহ তিরমিযী ১৯৪৮, আহমাদ ২১৫৭৫ নং)

“ঈমানের সবচাইতে মজবুত হাতল হল, আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধুত্ব স্থাপন করা, আল্লাহর ওয়াস্তে শত্রুতা স্থাপন করা, আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসা রাখা এবং আল্লাহরই ওয়াস্তে ঘৃণা পোষণ করা।” (ত্বাবারানী, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৭২৮ নং)

“এক ব্যক্তি অন্য এক বস্তিতে তার এক (দ্বীনী) ভায়ের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বের হল। আল্লাহ তাআলা তার গমন-পথে একজন অপেক্ষমাণ ফিরিশ্যা বসিয়ে দিলেন। (লোকটি সেখানে পৌছলে) ফিরিশতা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা রাখ? সে বলল, 'ঐ গ্রামে আমার এক ভাই আছে, তার সাক্ষাতে যাওয়ার ইচ্ছা রাখি।' ফিরিস্তা জিজ্ঞাসা করলেন, তার কাছে তোমার কোন সম্পদ আছে কি, যার দেখাশোনা করার জন্য তুমি যাচ্ছ?' সে বলল, 'না, আমি তাকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ভালোবাসি, তাই যাচ্ছি। ফিরিশ্মা বললেন, 'আমি আল্লাহর নিকট হতে তোমার কাছে এই। সংবাদ পৌছে দেওয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি যে, আল্লাহ তোমাকে অনুরূপ ভালোবাসেন, যেরূপ তুমি তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য তাকে ভালোবাস।” (মুসলিম, মিশকাত ৫০০৭ নং)

“যখন দুই ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে আপোসে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, তখন তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয় সেই ব্যক্তি, যে অপরকে অধিক গাঢ়ভাবে ভালোবাসে।” (সহীহুল জামে’ ৫৫৯৪ নং)

হে যুবক বন্ধু! ভেবে দেখ, তোমার বন্ধুর সাথে যে বন্ধুত্ব রয়েছে, তা কোন স্বার্থলাভ, অর্থ লাভের জন্য তো নয়? তুমি যাকে ভালোবাস, সে ভালোবাসা তার রূপ ও সৌন্দর্যের জন্য তো নয়? তার খেলা, অভিনয় বা গান ভালো লাগে তাই তাকে ভালোবাস- এমন তো নয়? কোন রাজনৈতিক দল বা মতের ভিত্তিতে তো নয় তোমার প্রেম? তেমন কিছু হলে সে বন্ধুত্ব, সে ভালোবাসা ও প্রেম, সে মহব্বত ও প্রীতির কোন মূল্য নেই।

আল্লাহর ওয়াস্তে ও দ্বীনের স্বার্থে যে প্রেম, সে প্রেম অনির্বাণ, চিরকালীন। এমন প্রেমেরই দুই প্রেমিক ছায়াহীন কিয়ামতের দিনে আল্লাহর বিশেষ ছায়া লাভ করবে। এমন মহব্বত ও দোস্তী সেই ভীষণ কিয়ামতের দিনেও অক্ষত থাকবে, “যেদিন কোন বন্ধু কোন বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেনা।” (সূরা মাআরিজ ১০ আয়াত) সেদিন বন্ধুরা এক অপরের শত্রু হয়ে পড়বে। তবে পরহেযগাররা নয়।” (সূরা যুখরুফ ৬৭ আয়াত) তাদের বন্ধুত্বের বন্ধন বিচ্ছিন্ন হবে না। কে তোমার বন্ধু? কাকে তুমি বন্ধুরূপে গ্রহণ করে নিজের হৃদয়ের কোণে আসন দিয়েছ? কার নিকট তুমি তোমার জীবনের সকল রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছ? -তা ভেবে দেখেছ কি?

এ বিষয়ে আমাদের প্রিয় নবী (সা.) আমাদেরকে সতর্ক করে বলেছেন যে, “মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে ওঠে। অতএব তোমাদের প্রত্যেকের বিবেচনা করে দেখা উচিত যে, সে কার সাথে বন্ধুত্ব কায়েম করছে।” (তিরমিযী ২৩৭৮ নং)

বন্ধু বন্ধুর কথা মত চলে, তার চরিত্র মত গড়ে ওঠে। দু’টি মনের অপূর্ব মিল হলে তবেই বন্ধুত্বের খাতির সহজে জমে ওঠে। এমন না হলে উভয়ের মধ্যে একজন প্রভাবশালী হয় এবং অপর জন হয় প্রভাবান্বিত। অতএব এ ক্ষেত্রে এমন সাথী নির্বাচন করা উচিত, যাতে বন্ধুত্বের আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ না হয়। তাছাড়া আর একটা কথা এই যে, “আত্মাসমূহ সমবেত সৈন্যদলের মত। সুতরাং আপোসে যে আত্মাদল পরিচিত ও অভিন্ন প্রকৃতির হয়, সে আত্মদলের মাঝে মিলন ও বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়ে থাকে এবং যে আত্মাদল আপোসে অপরিচিত ও ভিন্ন প্রকৃতির হয়, সে আআদলের মাঝে বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্য প্রকট হয়ে ওঠে।” (আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, মিশকাত ৫০০৩)।

মক্কায় এক কৌতুকপ্রিয়া মহিলা ছিল। সে যখন মদীনায় এল, তখন এমন এক মহিলার নিকট স্থান নিল, যে ছিল তারই মত কৌতুকপ্রিয়া। এ কথা শুনে মা আয়েশা (রাঃ) উক্ত হাদীস বর্ণনা করেছিলেন।

এ কথা বাস্তব যে, শুধু মানুষের মাঝেই নয়, পশু-পক্ষীর মাঝেও এমন ‘জাতীয়তাবাদ’ লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ, যে যে জাতের পাখী, সে সেই জাতের পাখীর দলেই গিয়ে মিশে থাকে, অন্যথা নয়। মালেক বিন দীনার বলেন, একদিন একটি কাককে একটি পায়রার সঙ্গে বসে থাকতে দেখে আমি অবাক হলাম। ভাবলাম, এমন তো হওয়ার কথা নয়, কিন্তু হল কেন? পরক্ষণে দেখা গেল যে, উভয় পাখীই ছিল খোড়া। তাই খোড়ায়-খোড়ায় এক ধরনের মিল থাকার পরিপ্রেক্ষিতেই ঐ দুই জাতের পাখী ভাবের সাথে একত্রে বসেছিল।

মানুষের মাঝেও তাই। সাধারণতঃ যে মানুষ যে গুণ, চরিত্র ও আকৃতির, সে মানুষ ঠিক তারই মত একজন মানুষকে বেছে নিয়ে তার সহিত উঠা-বসা ও বন্ধুত্ব করে। অধিকাংশ মানুষের মাঝেই ‘জ্যায়সন কা ত্যায়সন, শুটকী কা ব্যায়গন’ এর মত এক আজব মিল ও চমৎকার সুসাদৃশ্য বর্তমান থাকে।

ভাই সঙ্গী-সন্ধানী যুবক! ভালো লোকদের ও দ্বীনদার যুবকদের প্রতি তোমার মন যদি বীতশ্রদ্ধ হয়, তাহলে জেনে রেখো যে, তোমার মাঝে কোন রোগ আছে; হয় ঈমানী রক্তস্বল্পতা, নচেৎ সন্দেহের যক্ষা, নতুবা প্রবৃত্তিপূজার রক্তচাপ। সুতরাং বন্ধুত্ব করার পূর্বে এসব রোগ সারিয়ে নিও।

যদি দেখ যে, তোমার মন আকৃষ্ট হচ্ছে এমন সব যুবকদলের প্রতি, যারা আকৃতি ও প্রকৃতিতে প্রায় নম্বর ওয়ান হিরো’ এবং স্বভাব-চরিত্রে ডবল জিরো, যাদের মাঝে আছে মস্তানী বা নোংরামি, তাহলে জেনে রেখো, তোমার মাঝেও তাদের ঐ রোগ সংক্রমণ করেছে। অতএব তাদের কাউকে বন্ধু করার আগে নিজের পজিশন পরখ করে নিও। আর মনে রেখো যে, দলদলে একবার পা পড়ে গেলে, সেখান থেকে উদ্ধার হয়ে ফিরে আসা মোটেই সহজ নয়।

যদি তুমি মনে মনে গর্বিত হও এই ভেবে যে, তুমিই বড় চরিত্রবান যুবক, তোমার মত সভ্য মানুষ আর কেউ নেই; অতএব তোমার মানের যোগ্য বন্ধু আর কেউ হতে পারে না। তাহলে এ ধারণাকে তুমি মিথ্যা জেনো। তোমার মনের মণিকোঠায় সন্ধান করে দেখো, সেখানে শয়তানের বাসা রয়েছে। সুতরাং সে সময় তুমি আউযু বিল্লাহ’ পড়ো।

আর যদি তুমি দেখো যে, তোমার নিজের মাঝে ত্রুটি আছে, কিন্তু ভালো লোককে ভালোবাস, তাদের প্রতি মন আকৃষ্ট হয়, তাদের সহিত উঠতে-বসতে ভালো লাগে, তাহলে ভেবো যে, তোমার মধ্যে কিছু মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সে সময় ঐ মঙ্গলকে যথাযথভাবে প্রতিপালিত কর এবং চেষ্টা কর, যাতে তাদের দলে শামিল হতে পার। বন্ধুত্ব কায়েম কর তাদের সাথে।

বন্ধুত্ব স্থাপন কর বন্ধুর তিনটি জিনিস পরীক্ষা করে। সে পরীক্ষায় পাশ করলে তবেই তাকে বন্ধু বলে নির্বাচন কর, নচেৎ না।

১- প্রথমতঃ বন্ধুর জ্ঞান কত, তা বিচার কর। কারণ, জ্ঞানী বন্ধু এক নেয়ামত। যে নেয়ামত পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। যার নিকট সংকট মুহূর্তে বহু সুপরামর্শ পাওয়া যায়। যে স্পর্শকাতর সময়ে সঠিক পথনির্দেশ করে দুশ্চিন্তা দূর করে দেয়। পড়াশোনার ক্ষেত্রে অধিক ফল লাভ করা সম্ভব হয়। এমন বন্ধুর বন্ধুত্বে ধোকাবাজির ভয় থাকে না, ভয় থাকে না কোথাও অপমানিত হওয়ার। কারণ, জ্ঞান হল আলো; চোখের আলো এবং মনেরও আলো। আর অলোর পথই ভালো। চাহে রাত্রি আসুক অথবা কাটা থাকুক পথে, নিশ্চিন্তে গন্তব্য হলের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। আর এ জন্যই একজন বিজ্ঞ বন্ধু হল সবচেয়ে বড় নেয়ামত।

জ্ঞানীর সংস্পর্শে থাকলে হৃদয় আবাদ থাকে। জ্ঞানীর পরশে নিজেকেও জ্ঞানী করে তোলা যায়। তা না গেলেও জ্ঞানীর সাথে সম্পর্ক কায়েমে মানুষের সুনাম লাভ হয় -যদিও সে সুনামের যথার্থ অধিকারী নয়। আব্দুল্লাহ বিন ত্বাউস বলেন, একদা আমাকে আমার আব্বা বললেন, 'বেটা! জ্ঞানীদের সাহচর্য গ্রহণ কর। তাদের প্রতি তোমাকে সম্পৃক্ত করা হবে - যদিও প্রকৃতপক্ষে তুমি তাদের দলভুক্ত নও (এবং নিজে তাদের মত জ্ঞানী না হও)। আর মুখদের সাহচর্য গ্রহণ করো না। কারণ, তাদের প্রতি তোমাকে সম্পৃক্ত করা হবে, যদিও আসলে তুমি তাদের দলভুক্ত নও (এবং তুমি নিজে মুখ না হও)। আর জেনে রেখো, প্রত্যেক জিনিসের একটা শেষ সীমা আছে। মানুষের বাসনার শেষ সীমা হল সুজ্ঞান লাভ। (অফিয়াতুল আ’ইয়ান ২/৫১১)।

২- বন্ধু দ্বীনদার কি না, তা দেখ। কারণ, দ্বীন হল মানুষের এমন সম্পদ, যা মানুষকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে গড়ে তোলে। দ্বীন দেয় জ্ঞান, মন ও দেহের খোরাক। দ্বীন হল সেই প্রতিষেধক মহৌষধ, যার ব্যবহার অন্তরের ব্যাধি দূর করে, দুর করে মনের কালিমা, প্রতিহত করে সকল অন্যায় ও অসৎ-আচরণকে। দ্বীন রক্ষা করে আল্লাহর গযব ও দোযখের আযাব থেকে।

যে ব্যক্তির দ্বীন নেই সে মৃত। বেদ্বীন মানুষের জীবনে কোন সুপরিকল্পিত আশা নেই। উদ্দেশ্যহীন জীবন-পথে কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থল নেই। তাই তার উপর কোন আস্থা নেই, নেই কোন ভরসা। বেদ্বীন মানুষ নিজেরই দুশমন। সুতরাং সে কিরূপে -বিশেষ করে দ্বীনদারের- দোস্ত হতে পারে? যে তার প্রতিপালককে ভালোবাসে না, সে কি তোমাকে ভালোবাসবে? তার ভালোবাসায় কি কোন ভরসা আছে? যে মহাপরাক্রমশালী বাদশা আল্লাহর ফরয আদায়ে গরয দেখায়, সে তোমার ভালোবাসার কর্জ কিভাবে আদায় করবে?

অতএব জেনে রেখো যে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, আর অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। দ্বীনদার, পরহেযগার বন্ধুই তোমার বেহেস্তী পথের সঙ্গী। সেই তোমাকে সহায়তা করতে পারে মহাসাফল্যের জন্য। তাই তুমি দ্বীনদার বন্ধুই গ্রহণ কর। গরীব হলেও তাকেই তুমি অন্তরঙ্গ সাথী হিসাবে নির্বাচন কর। মহান আল্লাহ তাঁর নবী (সা.)-কে সম্বোধন করে এই আদেশ করেন যে, “তুমি নিজেকে তাদের সংসর্গে রাখবে, যারা সকাল-সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিপালককে আহ্বান করে তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য, আর পার্থিব জীবনের সুখ-সৌন্দর্য কামনা করে তাদের হতে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিও না। পক্ষান্তরে তার অনুসরণ করো না, যার হৃদয়কে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করেছি, যে তার আপন খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে যায়।” (সূরা কাহফ ২৮ আয়াত)

আর প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “তুমি মু'মিন ব্যতীত আর কারো সাহচর্য গ্রহণ করো না এবং পরহেযগার মানুষ ছাড়া তোমার খাবার যেন অন্য কেউ না খায়।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে হিব্বান, হাকেম, সহীহুল জামে ৭৩৪১ নং)

৩- কারো সহিত বন্ধুত্ব গড়ার পুর্বে তার চরিত্র বিচার করে দেখো। কারণ, মানুষের জন্য সৎচরিত্রতা এক অমূল্য ধন৷ যার চরিত্র নেই, যে চরিত্রহীন, সে নিঃস্ব। সে মানুষ বাহ্যিকভাবে যতই সুন্দর ও সভ্য হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে সে অন্তঃসারশূন্য।

চরিত্রবান মানুষের এক প্রভাব আছে; যার মাধ্যমে সে অপরকে চরিত্রবান করতে পারে। তদনুরূপ দুশ্চরিত্রেরও প্রভাব কম নয়। সেও অপরকে চরিত্রহীন করতে অবশ্যই দ্বিধা করে । সুতরাং ওঠা-বসা করার সময় এ খেয়াল অবশ্যই রাখতে হবে, যাতে যুবকের চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। মহান চরিত্রের উচ্চতম স্তরে অধিষ্ঠিত নবী (সা.) সৎ ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ পেশ করে বলেন, “সৎ ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ হল আতর-ওয়ালা ও কামারের মত। আতর-ওয়ালা তোমাকে তার আতর উপহার দেবে, নতুবা তুমি তার নিকট থেকে আতর ক্রয় করবে, নচেৎ এমনিতেই তার নিকট থেকে সুবাস পাবে। আর কামার, হয় তোমার কাপড় পুড়িয়ে ফেলবে, হয় তুমি তার নিকট থেকে পাবে দুর্গন্ধ।” (বুখারী ২১০১, মুসলিম ২৬২৮ নং)

আতর-ওয়ালার পাশে বসে মন ও মগজকে যেমন আতরের সুবাসে তাজা করা যায়, তেমনি সৎ সঙ্গীর এমন সগুণাবলী আছে যে, তার মাধ্যমে নিজের জীবনকে সুন্দর ও আনন্দময় করা যায়। সৎ সঙ্গী তোমাকে এমন শিক্ষা দেবে, যা তোমার দ্বীন অথবা দুনিয়া অথবা উভয় ক্ষেত্রে যথার্থ কাজে আসবে। এমন উপদেশ ও পরামর্শ দেবে, যার মাধ্যমে তুমি তোমার জীবনে এবং মরণের পরেও উপকৃত হবে। এমন কাজের আদেশ করবে, যা করলে তোমার লাভ আছে এবং এমন কাজ হতে তোমাকে বিরত রাখবে, যে কাজে তোমার ক্ষতি ও নোকসান আছে। এমন বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব করার লাভ সুনিশ্চিত। যে বন্ধু তোমাকে গড়ে নেবে, তোমার ত্রুটি গোপন ও সংশোধন করবে, আল্লাহর আনুগত্যে সর্বদা উদ্বুদ্ধ করবে, পাপ কাজে বাধা দান করবে, তোমার ও তোমার ইজ্জত রক্ষা করবে এবং তার নেক দুআয় তুমি তোমার দুনিয়া ও আখেরাতে লাভবান হবে।

পক্ষান্তরে কামারের পাশে বসলে যেমন তার ধুয়া, কয়লা বা পুরনো লোহা পোড়ার দুর্গন্ধ, হাতুড়ী পেটার শব্দ এবং আগুনের ফিনকি ও আঙ্গার ইত্যাদি দ্বারা ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তেমনি অসৎ সঙ্গী ও দুরাচার বন্ধুর সংসর্গে থাকে বহুমুখী ক্ষতির আশঙ্কা ও নানাবিধ। অমঙ্গল ঘটার সংশয়। কারণ, এমন বন্ধু অসৎ কর্মে উদ্বুদ্ধ করবে, সৎ কাজে বাধা দান করবে, তওবার কাজে অন্তরাল সৃষ্টি করবে, অর্থ ও স্বাস্থ্যের হানি ঘটাবে। বাড়ির ইজ্জত নষ্ট। করবে, এমন কি বন্ধুর সর্বস্ব লুটে যাওয়ার প্রয়াস চালাতে কুণ্ঠিত হবে না। অতএব হে যুবক বন্ধু! হুশিয়ার ও সচেতন থেকে এমন বন্ধুত্ব গড়া থেকে। আর হ্যাঁ, খেয়াল রেখো তোমার মান ও পজিশনের কথা।

অর্থাৎ, বন্ধুর মানে তুমি খাপ খাবে কি না তাও দেখে নিও। ইঁদুর-ওয়ালা হয়ে হাতি-ওয়ালার সাথে তোমার বন্ধুত্ব সাজে না। হাতি রাখার ঘর দিতে না পারলে তুমি তোমার বন্ধুর মন যোগাতে পারবে না, বিধায় তোমার সে বন্ধুত্ব টিকবে না। এমন উচ্চ মানের বন্ধুর বন্ধুত্ব গ্রহণের প্রয়াস চালায়ো না, যার গর্ব ও অহংকারে তুমি কষ্ট পাবে। তদনুরূপ এমন নিম্ন মানের বন্ধুর সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করো না, যার মূখতায় তোমার মন ব্যথিত হয় অথবা মান-ইজ্জত হারিয়ে যায়। বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ার পূর্বে ঠিক তেমনি করে ভেবে নিও, যেমন ভাব বিবাহ করার পূর্বে। বন্ধু ও স্ত্রীর অনেকটা দিক প্রায় একই। অবশ্য বন্ধু পাল্টানো যায়, কিন্তু স্ত্রী পাল্টানো গেলেও, তা মোটেই সহজ নয়। একবার জোড়া লেগে গেলে চিরদিন উপভোগ করতে হয় তার চরিত্র ও ব্যবহারের মধুরতা, নচেৎ বিষময় তিক্ততা।

অতএব ধোকা খাওয়ার পূর্বে বন্ধুকে পরখ করে নিও এবং তার বাহ্যিক আড়ম্বর ও সুশোভিত ব্যবহার তথা নতুন পরিচয়ের আচমকা-সুন্দর স্বভাব দেখে তাকে বন্ধু বলে লুফে নিও না। এক ব্যক্তি হযরত উমার (রাঃ)-কে কথা প্রসঙ্গে বলল, 'অমুক লোকটা বড় খাটি লোক। তিনি বললেন, (তা তুমি কি করে জানলে?) ওর সাথে কি কোন সময় সফর করেছ? লোকটি বলল, জী না।' তিনি বললেন, 'তোমার ও তার মাঝে কি কোন দিন তর্ক বা মতবিরোধ হয়েছিল? লোকটি বলল, জী না।' তিনি বললেন, 'ওর কাছে কি কোন দিন কিছু আমানত রেখেছিলে? লোকটি বলল, জী না। পরিশেষে তিনি বললেন, তাহলে ওর সম্পর্কে তুমি কিছুই জানো না। আমার মনে হয় তুমি ওকে কেবল মসজিদে বসে মাথা হিলাতে দেখেছ।' (উয়ুনুল আখবার ৩/ ১৫৮)

হা মানুষের সাথে ব্যবহার না করলে মানুষের আসল রূপ ধরা যায় না। আর্থিক লেনদেন, ব্যবসা, ঋণ, প্রতিবেশ, বৈবাহিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিভিন্ন সামাজিক ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের আসল পরিচয় পাওয়া যায়। আর তখনই হয় আসল বন্ধুর অগ্নিপরীক্ষা।

অবশ্য এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, কোন বন্ধু কামেল’ নয়। কোন না কোন ত্রুটি থাকতেই পারে। তাছাড়া মন সকলের সমান নয়। প্রকৃতিগত পার্থক্য থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। দু’টি মন যে সম্পূর্ণরূপে একমত হবে, তা প্রায় অসম্ভব। আর তার জন্যই লোকে বলে, 'মনের মত মানুষ পাওয়া দায়। অতএব ঠিক ‘মনের মত’ বন্ধ পাওয়া ততটা সহজ নয়।

জনৈক দার্শনিককে জিজ্ঞাসা করা হল যে, কোন ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী লম্বা সফর। করেছে?’ দার্শনিক বললেন, 'যে ব্যক্তি একটি বন্ধুর খোঁজে সফর করেছে।

আর প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “তোমরা কর্তব্যনিষ্ঠ রহ; আর তাতে কখনই পূর্ণরূপে সক্ষম হবে না।” (ইবনে মাজাহ হাকেম, সহীহ তারগীব ১৯০ নং)

উক্ত মহাবাণী থেকে এ কথা বুঝা যায় যে, সম্পূর্ণরূপে নিখুঁতভাবে দ্বীন ও চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং বন্ধুর মাঝে ছোটখাট কিছু ত্রুটি থেকে যাওয়াটা স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক নয়।

প্রিয় নবী (সা.) আরো বলেন যে, “মনুষ্য-সমাজ হল শত উটের মত; যার মধ্যে একটা ভালো সওয়ার-যোগ্য উট খুঁজে পাওয়া মুশকিল।” (আহমাদ; বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ সহীহুল জামে’ ২৩৩২ নং)

সুতরাং তুমিও যে একটা মনের সম্পূর্ণ পছন্দমত মানুষ সহজে খুঁজে পাবে না, তা বলাই বাহুল্য। অতএব তারই মধ্যে ভালো যুবক দেখে তুমি তোমার বন্ধুত্বের জীবন গড়ে তোল এবং একেবারে নিখুঁত খোঁজার চেষ্টা করো না, নচেৎ জীবনে কোন বন্ধুই পাবে না। বন্ধুর। ছোট-ছোট ভুল চোখ বুজে সয়ে নিও, যথাসম্ভব সংশোধন করে চলো, যথারীতি তার দোষের জন্য ওজর খুঁজে নিও। নচেৎ বন্ধুত্বের বন্ধন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

পক্ষান্তরে যার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করবে, সে যদি অসংশোধনীয় ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে তার থেকে দূরে থেকো এবং তার গায়ে পড়া বন্ধুত্ব গ্রহণ করো না। কোন ওজুহাতে তার জীবন থেকে সরে পড়। বিশেষ করে মুখ ও আহমক বন্ধু মোটেই পছন্দ করো না। কারণ, এমন বন্ধু হল আগুনের মত; তোমাকে জ্বালিয়ে ছাই করে ফেলবে। মুখের মুখামি যখন মাথায় চড়ে, তখন তা আর কোন আত্মীয়তা, কোন ভালোবাসা অথবা প্রতিবেশ ইত্যাদির হকের খেয়াল রাখে না। সব কিছুকে ভুলে গিয়ে নিজের স্বভাব মত মুখামি করেই তৃপ্তি পায় মূখ মানুষ। তাতে তার বন্ধুর অপমান হলে সে কি করতে পারে? তার তো স্বাভাবিক আচরণ এটা।

অতএব দুশমন হলেও জ্ঞানীর সাহচর্য গ্রহণ করো, তবুও কোন আহম্মককে বন্ধু করে তোমার সংসর্গ দিও না। নচেৎ দেখবে, তুমি পাবে। মহান আল্লাহ তার খাস বান্দাদের বিভিন্ন গুণ বর্ণনার সময় তাদের একটি বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, “যখন অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, 'সালাম।” (সূরা ফুরকান ৬৩ আয়াত) অথাৎ, তারা তাদের মূর্খামির সাথে জড়িয়ে না পড়ে তাদেরকে উপেক্ষা করে ও এড়িয়ে চলে।

আহাম্মক বন্ধু অনেক সময় মনের আবেগবশে বন্ধুর উপকার করার নিয়তে এমন কাজ করে বসে, যাতে প্রকৃতপ্রস্তাবে বন্ধুর অপকারই সাধিত হয়। আবার সেই উপকারের কোন প্রশংসা বা বদলা না পেলে সে কথা অপরের কাছে গেয়েও বেড়ায়। ফলে এমন বন্ধুর বন্ধুত্বে। ক্ষতি হয় দ্বিগুণ। এমন বন্ধু কখনো বাত ভালো করতে গিয়ে কুষ্ঠরোগ সৃষ্টি করে ফেলে। আবার কখনো বা সাপ মারতে ছিপ ভেঙ্গে বসে থাকে। এমন বন্ধু অকারণে রাগ করে, খামাখা আড়ি পাতে ও অভিমান করে, অপ্রয়োজনে কথা বলে, অযথা খরচ করে, প্রত্যেকের উপর আস্থা রাখে এবং অপকারী ও উপকারীর মাঝে পার্থক্য নির্বাচন করতে পারে না। সুতরাং এমন মিত্রের মিত্রতায় যে ঠকতে হবে, তা বলা নিষ্প্রয়োজন।

আর এ জন্যই বলা হয় যে, তিনটি জিনিস যদিও ঘটে, তবুও সত্বর অপসৃত হয়; মেঘের ছায়া, মিথ্যা সুনাম ও জ্ঞানী-অজ্ঞানীর বন্ধুত্ব। খবরদার! কোন অসদাচারীকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। করে ফেললে তাকে সৎপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কর। সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে তার দুনিয়া থেকে দুরে সরে যাও। বেনামাযী, মদ্যপায়ী, ধূমপায়ী, বিদআতী, ব্যভিচারী ও চোরা প্রকৃতির বন্ধুর বন্ধুত্ব গ্রহণ করো না। এমন বন্ধুর সঙ্গ পরিত্যাগ কর, যে দ্বীনদার লোক দেখে নাক সিটকায়, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে, কুমন্তব্য করে। আর জেনে রেখো যে, খল বন্ধুর চেয়ে শত্রু অনেক গুণ ভালো।

এমন বন্ধুর বন্ধুত্বের বন্ধন ছিন্ন-ভিন্ন করে দাও, যে পাপ করে তোমার কাছে অথবা কোন বন্ধুমহলে প্রচার করে গর্ব প্রকাশ করে অথবা নির্লজ্জ পৃষ্ট্রের মত প্রকাশ্যে পাপ করে। লারে-লাপ্পা’ করে পাড়া মাতায়, টেপ-রেডিও-টিভির অশ্লীল গান-বাজনা-ছবি প্রকাশ্যে ফুল সাউন্ডে শোনে ও শোনায়, দেখে ও দেখায়। গুপ্ত পাপীর বাঁচার পথ আছে, কিন্তু প্রকাশ্য পাপীর বাচার পথ দুর্গম। প্রিয় নবী মুক্তি বলেন, “পাপ প্রকাশকারী ছাড়া আমার প্রত্যেক উম্মত ক্ষমাহ।” (বুখারী ৬০৬৯, মুসলিম ২৯৯০ নং)

এমন পাপাচার ও দুরাচার থেকে দূর না হতে পারলে জেনে রেখো, ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। সঙ্গ দোষে কি না হয়? ছুঁচো ছুঁলে গন্ধ হয়। শারাব খানায় বসলে বা আসা-যাওয়া করলে লোকে তোমাকে শারাবী বলবে; যদিও তুমি শারাব না খাও। তাছাড়া আজ নয় তো কাল শারাবের উগ্র গন্ধ তোমাকেও পাগল করে ফেলবে। অবশেষে তুমিও হয়তো শারাবীতে পরিণত হয়ে যাবে।

অতএব 'দুর্জনেরে পরিহারি, দুরে থেকে সালাম করি’ এমন বন্ধুর বন্ধুত্বকে কবর দিয়ে দাও। এমন বন্ধু থেকে শতবার আল্লাহর নিকট পানাহ চাও এবং সে জন্য অর্থ সহ ‘কুল আউযু বিরাব্বিন্নাস’ বার বার পাঠ কর।

অসৎ বন্ধুর বন্ধুত্ব গ্রহণ করে কাল কিয়ামতে পস্তাতে হবে। “সেদিন অত্যাচারী নিজ হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, হায়! আমি যদি রসূলের সাথে পথ অবলম্বন করতাম! হায়! দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। আমার নিকট উপদেশ আসার পর সে আমাকে তা থেকে বিভ্রান্ত করেছিল। আর শয়তান মানুষকে বিপদকালে ধোকা দেয়।” (সূরা ফুরকান ২৭-২৯ আয়াত)।

হে মুসলিম যুবক! মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রেখে তাকে তুমি ভয় করে থাক। অতএব তোমার প্রিয়তম বন্ধু তিনিই এবং তাঁর বন্ধু তুমি। সুতরাং সে বন্ধুর কোন শত্রু তোমার বন্ধু। হতে পারে না। কারণ, প্রকৃতপক্ষে সে তোমারও শত্রু। মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না----।” (সূরা মুমতাহিনাহ ১ আয়াত) তোমার প্রিয়তম সুমহান বন্ধুকে যে বিশ্বাসই করে না, সে তোমার বন্ধু কিরূপে হতে পারে? “হে বিশ্বাসিগণ! বিশ্বাসিগণের পরিবর্তে অবিশ্বাসিগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।” (সূরা নিসা ১৪৪ আয়াত) তোমার শ্বাশত ধর্ম ও অম্লান নৈতিকতাকে যে মানতে চায় না এবং উল্টে তা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে, তাকে তুমি কিরূপে নিজের অন্তরঙ্গ বন্ধু করতে পার? “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পূর্ববর্তী সেই গ্রন্থপ্রাপ্ত (ইয়াহুদ ও নাসারা)গণ, যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলার বস্তুরূপে গ্রহণ করেছে, তাদেরকে ও কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। যদি তোমরা ঈমানদার হও, তাহলে আল্লাহকে ভয় কর।” (সূরা মাইদাহ ৫৭ আয়াত)

বস্তুতঃ “তুমি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায় পাবে না, যারা আল্লাহ ও তার রসুলের বিরুদ্ধাচারীগণকে ভালোবাসে, যদিও সে (বিশ্বাসী) তাদের পিতা অথবা পুত্র, ভ্রাতা অথবা একান্ত আপনজন কেউ হয়----I” (সূরা মুজাদালাহ ২২ আয়াত) সুতরাং যে তোমার নিজের কেউ নয়, সে বিরুদ্ধাচারী তোমার ভালোবাসার কোন পাত্র?

হ্যাঁ, আর নৈতিকতার খাতিরেই তুমি কোন যুবতীর সহিত বিবাহের পূর্বে কোন প্রকারের বন্ধুত্ব করতে পার না। বিবাহের পরই সে তোমার পরমা বান্ধবী। আমল এক হলে সে ইহকাল ও পরকালে চিরকাল তোমার চিরসঙ্গিনী হয়ে থাকবে।

জেনে রেখো বন্ধু। আজ যাকে তুমি ভালোবাসবে কাল কিয়ামতের বিভীষিকাময় দিনে তারই সঙ্গে অবস্থান করতে হবে। যদি কোন খেলোয়াড়কে ভালোবাস, তাহলে সেই খেলোয়াড়ের সাথে, যদি কোন শিল্পী বা হিরোকে ভালোবাস, তাহলে সেই শিল্পী বা হিরোর সাথে, যদি কোন দ্বীনদার লোককে ভালোবাস, তাহলে সেই দ্বীনদার লোকের সাথে এবং কোন কাফেরকে ভালোবেসে থাকলে, সেই কাফেরের সাথে তোমার হাশর হবে। আর সেখানে তাদের যে অবস্থা হবে, তোমারও অবস্থা হবে অনুরূপ। সুতরাং বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা গড়ার সময় সে কথাও মনে রেখো। প্রিয় নবী স. বলেন, “মানুষ যাকে ভালোবাসবে (কিয়ামতের দিন) সে তারই সাথে অবস্থান করবে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৫০০৮ নং)

যুবক বন্ধু! এবারে তোমাকে সেই কথাই বলি, যে কথায় বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। যাতে তুমি সহজে একজন বন্ধু লাভ করতে পার এবং তুমিও অপরের বন্ধুতে পরিণত হতে পার। বন্ধুত্বের প্রথম সোপান সাক্ষাতে সালাম দেওয়া। সালাম দেওয়ার মাধ্যমে কায়েম হয় সম্প্রীতি, হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে উভয়ের প্রতি উভয়ের ভালোবাসা। (মুসলিম ৫৪নং) এরপর গাঢ় পরিচয়, সুন্দর ব্যবহার, সাক্ষাতে সুমিষ্ট হাসি, উপটৌকন, উপহার ও দুআ বিনিময় ইত্যাদি।

এক ব্যক্তি মহানবী (সা.) এর নিকট এসে আরজ করল, 'হে আল্লাহর রসূল! আমাকে এমন একটা কাজ বলে দিন, যা করলে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং মানুষেও আমাকে ভালোবাসবে।' প্রিয় নবী ও বললেন, “দুনিয়ার মায়া ত্যাগ কর, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন৷ আর মানুষের হাতে যা কিছু আছে (অর্থ-সম্পদ ইত্যাদি) তার প্রতি বিরাগ। প্রকাশ কর, মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে।” (ইবনে মাজাহ ৪১০২, সহীহুল জামে ৯২২ নং)। মানুষ চায় না যে, তার কাছে কেউ কিছু চাক। অতএব তুমি কোন মানুষের কাছে চাইলে তার মন সঙ্কুচিত হবে এবং তুমি তার নিকট থেকে তা না পেলে তোমার মনও ছোট হবে। এর ফলে ভালোবাসার বীজ অঙ্কুরিত হতে পারবে না। অন্যথা ঋণ, সাহায্য ইত্যাদি না। চাইলে অনায়াসে তুমি তার ভালোবাসার পাত্র হতে পারবে।

পক্ষান্তরে চারটি জিনিস ভালোবাসা সৃষ্টি করে; স্মিতমুখে সাক্ষাৎ, উপকার সাধন, সহমত অবলম্বন এবং কপটতা বর্জন। আর যার মুখ মিষ্টি তারই বন্ধু বেশী। খেয়াল রেখো যে, বন্ধুত্বের খাতিরে যা কিছু করছ, তার বিনিময়ে প্রতিদানের আশা করো । কারণ, ভালোবাসার একটি মহৎ উপায় হল, প্রতিদানে কিছু পাওয়ার আশা না করে নিঃস্বার্থভাবে কেবল ভালোবেসে যাওয়া।

আর এ কথাও মনে রেখো, অতি প্রেম যেখানে, নিত্য যেও না সেখানে৷ যাবে যদি নিত্যি, ঘটবে একটা কিত্যি। বরং অতিরঞ্জনের পথ বর্জন করে মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন কর। এ ব্যাপারে মহানবী মুক্তি বলেন, “(প্রত্যেক দিন সাক্ষাৎ না করে) একদিন বাদ পর দিন সাক্ষাত কর। তাতে ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।” (বাযযার, ত্বাবারানী, হাকেম, সহীহুল জামে’ ৩৫৬৮ নং) প্রেমের বেদনার প্রকৃতিই এমন যে, প্রেমে বিরহের আঘাত যত বেশী পড়ে, প্রেমের ফোড়া ততই টলটলে হয়ে বেড়ে ওঠে। প্রেমাস্পদের প্রতি হৃদয়ের টান তত বেশী মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়ে মনকে ব্যাকুল করে তোলে। আর সেখান থেকে সৃষ্টি হয় প্রকৃষ্ট বন্ধুত্বের সুদৃঢ় বন্ধন।

হে যুবক বন্ধুবন্ধুত্বের পথ বড় বন্ধুর। এ পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। নয় ঝড়ঝঞ্চাহীন ও বিপদমুক্ত। কারণ, দোস্তী কুরবানী চায়। কুরবানী পেশ করতে না পারলে দোস্তীতে স্বস্তি পাওয়া যায় না। আর এখানেই হয় প্রকৃত বন্ধুর মহা অগ্নিপরীক্ষা। তাছাড়া সুসময়ে বন্ধু বটে অনেকেই হয়, অসময়ে হায় হায় কেহ কারো নয়’ এই বাস্তব উদাহরণের নাম বন্ধুত্ব নয়। প্রকৃত বন্ধু হল সেই, যে বন্ধুর বিপদের সময় হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রকৃত বন্ধু সে নয়, যে আমার দুর্নাম রটার সময় বলে, 'ও আমাদের গ্রামের একটা ছেলে। আর সুনাম প্রচারের। সময় বলে, 'ও আমার প্রাণপ্রিয় অথবা খাস বন্ধু!’ আসল বন্ধু সে নয়, যে আমার অভাবের সময় খোঁজ রাখে না। আর আমার ধনলাভের সময় এসে বলে, 'আই লাভ ইউ।' এমন কপট ও স্বার্থপর বন্ধু থেকে তোমাকে আল্লাহর পানাহ রইল।

প্রকৃত বন্ধু সে নয়, যে সামান্য মতবিরোধের ফলে বন্ধুত্বের মুলে কুঠারাঘাত হানে। উড়ো খবর ও কান-ভাঙ্গানিতে বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং বন্ধুত্বের বন্ধন-সূত্রকে ছিন্নভিন্ন করে। অথচ ঈমানের এক দাবী এই যে, বন্ধুত্বের অঙ্গীকার বন্ধু যথারীতি পালন করতে বদ্ধপরিকর থাকবে। (হাকেম ১ ১৬, সহীহুল জামে ২০৫৬ নৎ)।

প্রকৃত বন্ধু সে নয়, যে মুখের কথায় একশ ছড়ি গুনে খায়, অথচ আসলে সে ফুলের ঘায়ে মূৰ্ছা যায়। এমন বাকসর্বস্ব, ধৈর্যহীন, অদূরদর্শী বন্ধু থেকে আল্লাহ আমাকে ও তোমাকে আশ্রয় দান করুন। প্রকৃত বন্ধু তো সেই ব্যক্তি, যে পীড়িত হলে তার পীড়া দেখে তুমিও পীড়িত হও এবং তুমি পীড়িত হলে তার দর্শনলাভে ও সান্ত্বনাদানে সুস্থ হয়ে ওঠ। যে বন্ধু তোমাকে এসে বলে, ‘ইন্নী উহিব্রুকা ফিল্লাহ এবং তার প্রত্যুত্তরে তুমি তাকে বল, ‘আহাব্বাকাল্লাযী আহবাবতানী ফীহ।

ভাই যুবক! জীবনে চলার পথে বহু বন্ধুই আসে-যায় এবং মনের প্রেম-কোঠায় প্রবেশের জন্য তার সুদৃঢ় দ্বারে করাঘাত করে যায়। কিন্তু যে বন্ধু ঐ দ্বারে প্রবেশ করে মনের নিভৃত কোণে স্থায়ী আসন পেতে নিতে পারে, সেই হয় প্রকৃত বন্ধু। এমন বন্ধুই তুমি লাভ কর, এই কামনা করি।

অবশ্য আর একটি প্রকৃষ্ট বন্ধুর কথাও তোমাকে জানিয়ে রাখি, আর তা হল একটি মনের মত উপকারী বই। কোন বন্ধু না পেলে এ বন্ধু পাওয়া সাক্ষর মানুষের জন্য মোটেই কঠিন নয়। অতএব ভেবে ও খুঁজে দেখো, দেখবে এ বন্ধুর সাথে কোন দিন মনোমালিন্য ঘটবে না। ঘটবে না কোন স্বার্থপরতার মন কষাকষি। দুঃখের বিষয়, কড়ি ফটকা চিড়ে দই, কড়ি বিনে বন্ধু কই? কোন স্বার্থ ছাড়া কেবল আল্লাহ ও দ্বীনের উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব আর কে করে? খেয়াল করে দেখবে, যারাই তোমাকে বন্ধু বলে গলায় লাগাতে আসছে, তাদের অধিকাংশই তোমাকে সম্মান প্রদর্শন করলেও আসলে তোমার কি মান? তোমার শাখা-সোনার মান। অধিকাংশ বন্ধুই হল দুধের মাছি। এরা কোন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য আসে, স্বার্থ উদ্ধার হলে অথবা স্বার্থে আঘাত লাগলে সরে পড়ে। যে জিনিসের জন্য সে বন্ধুরা তোমাকে ভালোবাসছিল তা তোমার কাছে না পেলে পরক্ষণে তোমাকে বিদায় জানাবে। আজ ধনবান আছ, এখন তোমার বন্ধু অনেক। কিন্তু কাল গরীব হয়ে গেলে সবাই তোমার নিকট থেকে কেটে পড়বে। আজ তোমার একটা পদ আছে বলে তোমার বন্ধুর অভাব নেই। কিন্তু কাল পদ চলে গেলে তোমার বন্ধুরাও তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে। পার্থিব স্বার্থে বন্ধুত্বের ধারা এই, রীতি এই।

আর দুনিয়ার এ রীতি বড় পুরাতন, নুতন নয়। কিন্তু তুমি তোমার বন্ধুর জন্য খাটি বন্ধু হও। সকল স্বার্থ ত্যাগ করে কেবল আল্লাহর ওয়াস্তে নিঃস্বার্থ বন্ধুরূপে পরিচয় ও প্রমাণ দাও। স্বার্থে আঘাত লাগলে ধৈর্য ধরে নাও। আর তার জন্য বন্ধুত্বের বুনিয়াদে আঘাত হেনো না। মনে রেখো, “কোন মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত (পূর্ণ) মুমিন হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার ভায়ের জন্য তাই পছন্দ করেছে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।” (বুখারী ৭, মুসলিম ৪৫ নং) সাবধান! তোমার বন্ধু যে চিরদিন বন্ধু থাকবে, সে ধারণা সঠিক না-ও হতে পারে। আজ যে বন্ধু আছে কাল সে শত্রুতে পরিণত হতে পারে। সুতরাং তোমার রহস্য ও দুর্বলতার ব্যাপারে তোমাকে সতর্ক থাকা উচিত। আর এ জন্যই দূরদর্শী সমাজ-বিজ্ঞানী নবী ৯৪ বলেন, “তোমার বন্ধুকে মধ্যমভাবে ভালোবাস (অর্থাৎ, তার ভালোবাসাতে তুমি অতিরঞ্জন করো)। কারণ, একদিন সে তোমার শত্রুতে পরিণত হতে পারে। আর তোমার শত্রুকে তুমি মধ্যমভাবে শত্রু ভেবো। (অর্থাৎ, তাকে শত্রু ভাবাতে বাড়াবাড়ি করো না। কারণ, একদিন সে তোমার বন্ধুতে পরিণত হতে পারে।” (সুতরাং তখন তোমাকে লজ্জায় পড়তে হবে।) (তিরমিযী ১৯৯৭, সহীহুল জামে’ ১৭৮ নং)

শেখ সাদী বলেন, 'যা তোমার গোপন, তা নিজের বন্ধুকেও বলো না; যদিও সে তোমার বন্ধুত্বে খাঁটি। কারণ, বলা যায় না, কালচক্রে সে তোমার শত্রুতে পরিণত হতে পারে। আর অতি কদর্য অসদ্ব্যবহার বা পারতপক্ষের কোন কঠিন শাস্তি কোন শত্রুর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করো। না। কারণ, কোনদিন সে তোমার ঘনিষ্ট বন্ধুতেও বদলে যেতে পারে। সুতরাং পূর্ব হতেই সতর্ক থেকো; যাতে ভবিষ্যতে পস্তাতে না হয় এবং লজ্জিত হতেও না হয়। তিনি আরো বলেন, যে গোপনীয় কথা তুমি গোপন রাখতে চাও, তা তোমার বন্ধুকেও বলো না। কারণ, তোমার বন্ধুরও অনেক বন্ধু আছে। সেও তাদের নিকট তা প্রকাশ করতে পারে।

হ্যাঁ, আর এমনি করেই সৃষ্টি হয় মনোমালিন্য, তারপর বিচ্ছিন্নতা ও শত্রুতা। আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধুত্ব হলেও কোন এক পক্ষের পাপের কারণেই উভয়ের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে। মহানবী ঐ বলেন, “যখন কোন দুই ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, তখন তাদের কারো একজনের কোন পাপ সংঘটন ছাড়া আল্লাহ তাদের মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করেন।” (সহীহুল জামে ৫৬০৩ নং) যুবক বন্ধু! অতএব খেয়াল রেখো, যাতে বন্ধুত্বের পর বিশেষ করে ঐ বন্ধুত্বের কারণে তোমাদের কারো দ্বারা যেন কোন পাপ সংঘটিত না হয়। সুতরাং সতর্ক দৃষ্টি রেখো, যাতে তোমার বন্ধুর কুদৃষ্টি তোমার বোন, স্ত্রী অথবা কন্যার উপর না পড়ে। মানুষ তো। আর তার মন তো মন্দপ্রবণ এবং শয়তান বড় শত্রু। বন্ধুর সহিত তোমার বন্ধুত্ব যতই গাঢ় ও নিবিড় হোক না কেন, সে গাঢ়তা ও নিবিড়তা তোমার বোন-স্ত্রী-কন্যার মনে প্লাবিত হবে কেন? জানের বন্ধু হলেও, ফিরিস্তাতুল্য চরিত্র হলেও পর্দার আয়াত তো আর মনসুখ হচ্ছে না। আর যদি তাই মনে করে পর্দার কুরআনী বিধানকে অবজ্ঞা কর, তাহলে জেনে রেখো, তোমার জানতে অথবা অজান্তে এমন কীর্তি ঘটতে পারে, যার জন্য তোমার ইহকালও বরবাদ হতে পারে এবং পরকাল ধংস তো করলেই। বন্ধু তখন বিষফোড়া হবে এবং তার গুপ্ত যন্ত্রণায় ছটফট করবে। যখন না পাবে মরণের কোন পথ, আর না-ই পাবে শান্তির কোন প্রলেপ। তাছাড়া তোমার ও তোমার বংশের দুর্নাম রটতে থাকবে এবং তখন তুমি শাক দিয়ে মাছ ঢাকতেও পারবে না। পরন্তু তোমার তো জানা আছে যে, দাইয়ুস বেহেস্তে যাবে না।

পক্ষান্তরে এ কথা দুনিয়া জানে যে, একজন দুশমন যা ক্ষতি করতে পারে, তার চাইতে অনেক গুণ বেশী করতে পারে একজন বন্ধু। শত্রুর ক্ষতির হাত থেকে সতর্ক থাকা যায়, কিন্তু। বন্ধুর ব্যাপারে তা হয় না। শত্রু পাহারা দেওয়া যায়, কিন্তু বন্ধু পাহারা দেওয়া যায় না। ফলে অসতর্ক থাকা অবস্থাতেই কাছে থেকেই বন্ধুর বন্দুক বুক ঝাঝরা করে দেয়। আবার শত্রু প্রকাশ্য হলে তার দ্বারা যত ক্ষতি হয়, বন্ধু শত্রু হয়ে গেলে তার দ্বারা ক্ষতি হয় আরো মারাত্মক, অধিক ভয়ানক।

আপন যখন পর হয় এবং বন্ধু যখন শত্রুতে পরিণত হয়ে যায়, তখনকার মর্মব্যথা যে কত নিদারুণ, কত গভীর হয়ে বন্ধুকে নিষ্পেষিত করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার আন্তরিকতা ও গাঢ়তা অনুযায়ী সেই বেদনার পরিমাণ কম ও বেশী হয়ে থাকে। বন্ধুত্বের গাঢ়তা বেশী থাকলে বেদনা ও আক্ষেপের পরিমাণ বেশী হয়ে থাকে। এত ভালোবেসে শেষে এত অবহেলার স্মৃতি ও আঘাতে হৃদয় দগ্ধীভূত হয়ে মানুষ অনেক সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু এমন দুটি জিনিস আছে, যা হারিয়ে গেলে তার জন্য কেঁদে চক্ষুদ্বয় হতে রক্তধারা প্রবাহিত করলেও তার এক দশমাংশ হকও আদায় হয় না। সে দু'টির একটি হল, যৌবন এবং অপরটি হল, বন্ধু।

আপনজন ও বন্ধুর কথায় মনে দাগ কাটে বড়। তবুও ভুলে যেতে হয়। বন্ধুর বন্ধুত্ব ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু বাস্তব এই যে,

‘হাড় ভাঙ্গলে জোড়া লাগে কলে আর বলে,

মন ভাঙ্গলে জোড়া লাগে না ইহ-পরকালে।

কাটা চামড়ায় জোড়া লাগে ঠিকই, কিন্তু দাগ থেকে যায়। দুশমনির সব কথাই ভুলে যেতে হয়, কিন্তু কিছু কথা আছে, যা মনে রাখতে হয়; ভুললে চলে না। আর তা হয় ভবিষ্যতের জন্য বড় শিক্ষা ও উপদেশ।

যে সব কারণে বন্ধুত্ব নষ্ট হয় তার মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন অন্যতম। অনেক মানুষ আছে, যাদেরকে বাইরে ও দুরে থেকেই ভালো লাগে, ভিতরে ও কাছে এলে লাগে তার বিপরীত। আর ভাই-বোন বা ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে দূরের বন্ধু কাছে হয়, গোপন বিষয়ে খবর নেওয়ার পথ অধিক ও সূক্ষম হয়, ভুল বুঝাবুঝির মত ক্ষেত্র তৈরী হয়। ফলে সৃষ্টি হয় বিষ্ণা, কলহ ও বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদের আর এক কারণ হল টাকা। তাই বন্ধুত্ব রাখতে হলে টাকা-পয়সা লেনদেনের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। নচেৎ টাকা এমন জিনিস যে, সে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারে, আবার বিচ্ছেদও। কথায় বলে, 'টাকা তুমি যাচ্ছ কোথা? পিরীত যথা। আসবে কবে? বিচ্ছেদ যবে।

এ সব ছাড়া অনেক মানুষ আছে, যারা কতটা পেলাম’ কেবল সেই হিসাব রাখে। পক্ষান্তরে কতটা দিলাম সে হিসাব রাখে না। অর্থাৎ, না পেলে হৈচৈ করে, অথচ দেওয়ার মনমানসিকতা রাখে না। এই মানুষরাই সব সময় অপর পক্ষের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে থাকে এবং নিজের ঘাড়ে দোষ নিতেই চায় না। এরা চায় আঘাত দোব, কিন্তু আঃ শুনব না। বারুদে আগুন দোব, কিন্তু বিস্ফোরণ দেখব না। এরা চায় আগুন ধরাব, আর ধূপের সুগন্ধ নেব।' এই শ্রেণীর স্বার্থপর, বিবেক ও ইনসাফহীন মানুষের সাথে যে বন্ধুত্ব রাখা বড় দায়, তা বহু অভিজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রের জানা।

তুমি মনের মত বন্ধু পাও, বন্ধুমহলে সুখী হও, সংসার ও দ্বীন-ধর্মে উপকৃত হও এবং কিয়ামতের ছায়াহীন প্রখর রৌদ্রময় দিনে আল্লাহর ছায়া লাভ কর, মনে-প্রাণে এই কামনা করি।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে