কুরআনের ভাষা অত্যন্ত উঁচুমানের এবং মার্জিত রুচি সম্পন্ন। এতে কোনরূপ লজ্জাকর ভাষা ও ঘটনার স্পর্শ নেই। অথচ বেদ ও প্রচলিত বাইবেল নানা যৌন রসাত্মক উপমা ও রচনায় ভরা। যা ধর্মীয় পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। এর মৌলিক কারণ হ’ল এই যে, ঐসব গ্রন্থাবলীর রচয়িতা হ’ল মানুষ। আর কুরআনের ভাষা হ’ল সরাসরি আল্লাহর। তাই বান্দার ভাষা কখনোই আল্লাহর ভাষার ধারে-কাছে যেতে পারে না। এজন্যই বলা হয়ে থাকে كلامُ الملوكِ ملوكُ الكلامِ ‘বাদশাহদের ভাষা হয় শাহী ভাষা’। কুরআনের ভাষা তাই যাবতীয় মানবীয় দুর্বলতা ও আবিলতার ঊর্ধ্বে এক অতুলনীয় সৌকর্যমন্ডিত ভাষা। সেই সাথে কুরআনের ভাষা অতুলনীয় এবং সর্বোচ্চ অলংকার সমৃদ্ধ। কুরআন নাযিলের সময়কালের বরেণ্য আরবী কবিগণ যেমন কুরআনী বালাগাত-ফাছাহাত ও অলংকারের কাছে অসহায় ছিলেন, আধুনিক যুগের কবি-সাহিত্যিকগণ একইভাবে রয়েছেন অসহায়।
মিসরের খ্যাতনামা মুফাসসির তানতাভী জাওহারী বলেন, ১৯৩২ সালের ১৩ই জুন তারিখে মিসরীয় অধ্যাপক কামেল কীলানী আমাকে একটি বিষ্ময়কর ঘটনা শুনিয়ে বলেন যে, আমার খ্যাতনামা আমেরিকান প্রাচ্যবিদ ফিনকেল একদিন আমাকে বলেন, কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার ব্যাপারে তোমার রায় বর্ণনা কর। তখন আমি বললাম, তাহ’লে আসুন আমরা জাহান্নামের প্রশস্ততার ব্যাপারে অন্ততঃ বিশটি বাক্য তৈরী করি। অতঃপর আমরা উক্ত মর্মে বাক্যগুলি তৈরী করলাম। যেমন, إنَّ جَهَنَّمَ وَاسِعَةٌ جِدًّا، إنَّ جَهَنَّمَ لَأَوْسَعُ مِمَّا تَظُنُّونَ، إنَّ سِعَةَ جَهَنَّمَ لاَ يَتَصَوَّرُهَا عَقْلُ إِنْسَانٍ ইত্যাদি। অতঃপর তিনি বললেন, কুরআন কি উক্ত মর্মে এর চাইতে উন্নত অলংকারবিশিষ্ট কোন বাক্য প্রয়োগ করতে পেরেছে? জবাবে আমি বললাম, আমরা কুরআনের সাহিত্যের কাছে শিশু মাত্র। শুনে তিনি হতবাক হয়ে বললেন, সেটা কি? আমি তখন সূরা ক্বাফ-এর ৩০ আয়াতটি পাঠ করলাম, يَوْمَ نَقُوْلُ لِجَهَنَّمَ هَلِ امْتَلَأْتِ وَتَقُوْلُ هَلْ مِنْ مَزِيْدٍ ‘যেদিন আমরা জাহান্নামকে বলব, ভরে গেছ কি? সে বলবে, আরো আছে কি?’ (ক্বাফ ৫০/৩০)। আয়াতটি শুনে তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন, তুমি সত্য বলেছ, হ্যাঁ, তুমি সত্য বলেছ।[1] আমরা মনে করি এর পরবর্তী আয়াতে জান্নাতীদের পুরস্কার সম্পর্কে যে বর্ণনা এসেছে তা একইভাবে অনন্য ও অসাধারণ। যেমন বলা হয়েছে لَهُمْ مَا يَشَاءُوْنَ فِيْهَا وَلَدَيْنَا مَزِيْدٌ ‘সেখানে তারা যা চাইবে তাই পাবে এবং আমাদের কাছে রয়েছে আরও অধিক’ (ক্বাফ ৫০/৩৫)। অমনিভাবে জাহান্নামীদের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ অন্যত্র বলেন, فَذُوقُوا فَلَنْ نَزِيدَكُمْ إِلاَّ عَذَابًا ‘অতএব তোমরা স্বাদ আস্বাদন করো। এখন আমরা তোমাদের কিছুই বৃদ্ধি করব না শাস্তি ব্যতীত’ (নাবা ৭৮/৩০)।
বস্ত্ততঃ অল্প কথায় সুন্দরতম আঙ্গিকে এমন আকর্ষণীয় বাক্যশৈলী আল্লাহ ব্যতীত কারু পক্ষে সম্ভব নয়। আর এভাবেই আরবদের উপরে কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যারা ছিল সেযুগে শুদ্ধভাষিতায় বিশ্বসেরা। সেজন্য তারা নিজেদেরকে ‘আরব’ (عَرَب) অর্থাৎ শুদ্ধভাষী বলত এবং অনারবদেরকে ‘আজম’ (عَجَم) অর্থাৎ ‘বোবা’ বলে অভিহিত করত।
আল্লাহ পাক তাঁর নবীদেরকে স্ব স্ব যুগের উপরে এভাবেই শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন। যেমন জাদুবিদ্যায় সেরা মিসরীয়দের পরাস্ত করার জন্য আল্লাহ নবী মূসাকে লাঠি ও প্রদীপ্ত হস্ততালুর মো‘জেযা দান করেন। চিকিৎসা বিদ্যায় সেরা শাম দেশের অহংকারী নেতাদের পরাস্ত করার জন্য আল্লাহ নবী ঈসাকে অন্ধকে চক্ষু দান, কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান, এমনকি মৃতকে জীবিত করার মো‘জেযা প্রদান করেন। অনুরূপভাবে ভাষাগর্বী আরবদের কাছে শেষনবীকে মো‘জেযা স্বরূপ অলংকারময় কুরআন দান করেন। যার সামনে আরব পন্ডিতেরা কুরআন নাযিলের যুগে ও পরে সর্বদা মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়। ফালিল্লাহিল হাম্দ।