নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি

মদীনা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে মক্কার দিকে ৮ মাইল বা ১২ কি. মি. দূরে অবস্থিত। কুরায়েশ বাহিনী পুনরায় হামলা করতে পারে এই আশংকায় ওহোদ যুদ্ধের পরদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ৮ই শাওয়াল রবিবার তাদের পশ্চাদ্ধাবনের জন্য পুনরায় যুদ্ধ যাত্রা করেন কেবলমাত্র ঐসব সেনাদের নিয়ে যারা আগের দিন ওহোদ যুদ্ধে শরীক ছিলেন। যাদের সংখ্যা ছিল ৭০ জন। পরে যোগদানকারী ছাহাবীগণ সহ মোট সংখ্যা দাড়ায় ৬৩০ জন।[1] আয়েশা (রাঃ) আলে ইমরান ১৭২ আয়াত নাযিলের কারণ হিসাবে ভাগিনা উরওয়া বিন যুবায়েরকে বলেন, তোমার পিতা যুবায়ের ও নানা আবুবকর ঐ দলের মধ্যে ছিলেন। যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওহোদের দিন বিপদগ্রস্ত হ’লেন এবং মুশরিকরা ফিরে গেল, তখন তিনি আশংকা করলেন যে, ওরা ফিরে আসতে পারে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, কারা ওদের পিছু ধাওয়া করবে? অতঃপর তিনি লোকদের মধ্য থেকে সত্তুর জনকে বাছাই করলেন। উরওয়া বলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন, আবুবকর ও যুবায়ের’ (বুখারী হা/৪০৭৭)। অর্থাৎ তোমার পিতা ও আমার পিতা। ইবনু কাছীর বলেন, এটি ছিল হামরাউল আসাদ-এর দিন’। আয়াতটি ছিল, الَّذِينَ اسْتَجَابُوا لِلَّهِ وَالرَّسُولِ مِنْ بَعْدِ مَا أَصَابَهُمُ الْقَرْحُ لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا مِنْهُمْ وَاتَّقَوْا أَجْرٌ عَظِيمٌ- الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ‘যারা নিজেরা যখমপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দিয়েছিল, তাদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে ও আল্লাহভীরুতা অবলম্বন করেছে, তাদের জন্য রয়েছে মহান পুরস্কার’। ‘যাদেরকে লোকেরা বলেছিল, নিশ্চয়ই তারা (কুরায়েশ বাহিনী) তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছে। অতএব তোমরা তাদের থেকে ভীত হও। একথা শুনে তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায় এবং তারা বলে ‘আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক!’ (আলে ইমরান ৩/১৭২-৭৩)।[2] মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই অনুমতি চেয়েও ব্যর্থ হয়। তবে সঙ্গত কারণে রাসূল (ছাঃ) জাবের বিন আব্দুল্লাহকে অনুমতি দেন এবং ৮ মাইল দূরে ‘হামরাউল আসাদ’(حَمْرَاء الْأَسَد) নামক স্থানে গিয়ে শিবির সন্নিবেশ করেন। অতঃপর চারদিন সেখানে অবস্থান শেষে ১২ই শাওয়াল মদীনায় ফিরে আসেন।

ঘটনা ছিল এই যে, হামরাউল আসাদ পৌঁছে মা‘বাদ বিন আবু মা‘বাদ আল-খুযাঈ নামক জনৈক ব্যক্তি মুসলমান হন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর হিতাকাংখী ছিলেন। তাছাড়া বনু হাশেম ও বনু খুযা‘আহর মধ্যে জাহেলী যুগ থেকেই মৈত্রীচুক্তি ছিল। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে আবু সুফিয়ানের নিকট গমন করেন। আবু সুফিয়ানের বাহিনী তখন মদীনা থেকে ৬৮ কি. মি. দক্ষিণে ‘রাওহা’ (الروحاء)-তে অবতরণ করেছে। সে সময় সাথীদের চাপে আবু সুফিয়ান পুনরায় মদীনায় হামলার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় মা‘বাদ সেখানে পৌঁছে যান এবং আবু সুফিয়ানকে রাসূল (ছাঃ)-এর পশ্চাদ্ধাবন বিষয়ে অবহিত করেন। অতঃপর তাকে দারুণভাবে ভীত করে ফেলেন। এমনকি এ কথাও বলেন যে, মুহাম্মাদের বিশাল বাহিনী টিলার পিছনে এসে গেছে। তোমরা এখুনি পালাও। আবু সুফিয়ান তার ইসলাম গ্রহণের কথা জানতেন না। ফলে তার কথায় বিশ্বাস করে দ্রুত মক্কায় ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে মা‘বাদকে বলে দিলেন তুমি মুহাম্মাদকে জানিয়ে দিয়ো যে, আমরা অতি সত্বর পুনরায় তাদের উপর হামলা করব এবং তাকে ও তার সাথীদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলব’। মা‘বাদ রাযী হলেন। অতঃপর তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে উক্ত খবর জানালে মুসলিম বাহিনীর ঈমানী তেজ আরো বেড়ে যায় এবং তারা বলে ওঠেন, حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ ‘আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট’। আর তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’। এর মাধ্যমে দুই ঈমানী কণ্ঠের মিল হয়ে যায়। (প্রায় আড়াই হাযার বছর পূর্বে) নমরূদের আগুনে নিক্ষেপকালে পিতা ইবরাহীম (আঃ) একই কথা বলেছিলেন।

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, (حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ) قَالَهَا إِبْرَاهِيمُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ حِينَ أُلْقِىَ فِى النَّارِ، وَقَالَهَا مُحَمَّدٌ- صلى الله عليه وسلم - حِينَ قَالُوا إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ ‘হাসবুনাল্লাহ... কথাটি ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলেন যখন তিনি আগুনে নিক্ষিপ্ত হন। আর একই কথা মুহাম্মাদ (ছাঃ) বলেছিলেন যখন লোকেরা তাঁকে বলল যে, শত্রুরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হচ্ছে। অতএব তাদেরকে তোমরা ভয় কর। একথা তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি করে দেয় এবং তারা বলে ওঠে হাসবুনাল্লাহ ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আর তিনি কতইনা সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’।[3] বস্ত্ততঃ সকল যুগের ঈমানদারগণ চূড়ান্ত বিপদে সর্বদা একই কথা বলে থাকেন।

অন্য দিকে আবু সুফিয়ানের গুপ্তচর মু‘আবিয়া বিন মুগীরাহ বিন আবুল ‘আছ যে ব্যক্তি উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের নানা ছিল, মদীনায় পৌঁছে তার চাচাতো ভাই ওছমান (রাঃ)-এর নিকটে আশ্রয় নেয়। ওছমানের আবেদনক্রমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে তিন দিনের জন্য অনুমতি দেন এবং বলেন, এর পরে পাওয়া গেলে তাকে হত্যা করা হবে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মদীনা ছেড়ে গেলে সে গোপন সংবাদ সংগ্রহে লিপ্ত হয় এবং ৪ দিন পর রাসূল (ছাঃ) ফিরে আসার সাথে সাথে পালিয়ে যায়। তখন তিনি যায়েদ বিন হারেছাহ ও ‘আম্মার বিন ইয়াসিরকে পাঠান এবং তার পিছু ধাওয়া করে তাকে পাকড়াও করে হত্যা করেন (ইবনু হিশাম ২/১০৪)। এভাবে ওহোদ যুদ্ধের পরবর্তী চক্রান্ত সমূহ শেষ করে দিয়ে রাসূল (ছাঃ) নিশ্চিন্ত হন।

[1]. আল-বিদায়াহ ৪/৪৮-৪৯; ইবনু সা‘দ ২/৩৭-৩৮; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৯৭।

[2]. ইবনু কাছীর, তাফসীর আলে ইমরান ১৭২-৭৩ আয়াত।

[3]. বুখারী হা/৪৫৬৩; ইবনু হিশাম ২/১০৩।

(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আলী ইবনু আবী ত্বালেবকে মুশরিক বাহিনীর পিছু ধাওয়া করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, দেখ তারা কি করছে? যদি তারা ঘোড়া একপাশ করে বা উট প্রস্ত্তত করে, তাহ’লে বুঝতে হবে যে, ওরা মক্কায় ফিরে যাবে। আর যদি ওরা ঘোড়ায় সওয়ার হয় ও উট হাঁকায়, তাহ’লে বুঝতে হবে যে, ওরা মদীনা মুখে যাবে। যার হাতে আমার জীবন, তার কসম! করে বলছি, যদি তারা মদীনার সংকল্প করে, তাহ’লে আমি অবশ্যই তাদের প্রতি সৈন্য পরিচালনা করব এবং অবশ্যই তাদের মুকাবিলা করব’। আলী বললেন, অতঃপর আমি তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলাম এবং দেখলাম যে, তারা মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হ’ল’ (ইবনু হিশাম ২/৯৪; আর-রাহীক্ব ২৭৯ পৃঃ)।

ইবনু ইসহাক এটি বিনা সনদে বর্ণনা করেছেন। ইবনু হাজার পিছু ধাওয়াকারীর নাম বলেছেন, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ। এটি ওয়াক্বেদী স্বীয় মাগাযীতে উল্লেখ করেছেন। ইবনু আবী হাতেম, ইকরিমা থেকে বর্ণনা করেন যে, যখন মুশরিকরা ওহোদ থেকে ফিরে যায়, তখন তারা বলেছিল, না মুহাম্মাদকে তোমরা হত্যা করতে পারলে, না তাদের নারীদের তোমরা হালাল করতে পারলে? কত মন্দ কাজই না তোমরা করলে? ফিরে চল! এ কথা রাসূল (ছাঃ) শুনতে পেলেন। অতঃপর তিনি মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করলেন। তখন তারা এতে সাড়া দিয়ে পিছু ধাওয়া করল এবং হামরাউল আসাদ অথবা আবু উয়াইনার কূয়ার নিকটে (রাবী সুফিয়ানের সন্দেহ) পৌঁছে গেল। তখন মুশরিকরা বলল, আমরা আগামী বছর পুনরায় আসব। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ফিরে এলেন। সেকারণ এটিকে ‘গাযওয়া’ হিসাবে গণ্য করা হয়। অতঃপর উক্ত উপলক্ষ্যে আল্লাহ আলে ইমরান ১৭২ আয়াত নাযিল করেন (ইবনু কাছীর, তাফসীর উক্ত আয়াত)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৫৫-৫৬ পৃঃ)।

(২) এখানে আরও একটি ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে যে, ওহোদ যুদ্ধ শেষে আবু সুফিয়ান যখন মক্কার দিকে ফিরে যান, তখন রাসূল (ছাঃ) মু‘আবিয়া বিন মুগীরা ইবনুল ‘আছ এবং আবু ‘আযযাহ আল-জুমাহীকে গ্রেফতার করেন। এ দু’জন ব্যক্তি ইতিপূর্বে বদর যুদ্ধে বন্দী হয়েছিল। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদের উপরে অনুকম্পা দেখান এবং আর কখনো মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেনা বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তারা মক্কায় ফিরে গিয়ে কাফিরদের সঙ্গে মিশে যায় এবং ওহোদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যোগদান করে। অতঃপর বন্দী হয়ে তারা আগের মতই বলে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে আশ্রয় দিন। তখন রাসূল (ছাঃ) আবু ‘আযযাহকে বলেন, আল্লাহর কসম! তুমি এরপরে মক্কায় গিয়ে তোমার দু্ই ভ্রূতে হাত দিয়ে আর বলতে পারবে না যে, আমি মুহাম্মাদকে দু’বার ধোঁকা দিয়েছি। হে যুবায়ের! ওর গর্দান উড়িয়ে দাও। অতঃপর তিনি তার গর্দান উড়িয়ে দিলেন’। ইবনু হিশাম বলেন, আমার কাছে সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব থেকে খবর পৌঁছেছে যে, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) অতঃপর বলেন, لاَ يُلْدَغُ الْمُؤْمِنُ مِنْ جُحْرٍ وَاحِدٍ مَرَّتَيْنِ ‘নিশ্চয়ই মুমিন এক গর্তে দু’বার দংশিত হয় না’। হে ‘আছেম বিন ছাবিত! ওর গর্দান উড়িয়ে দাও। অতঃপর তিনি তার গর্দান উড়িয়ে দিলেন’ (ইবনু হিশাম ২/১০৪)। বর্ণনাটি সনদবিহীন। অতএব যঈফ (মা শা-‘আ ১৫৭-৫৮)। তবে ‘মুমিন এক গর্তে দু’বার দংশিত হয় না’ হাদীছটি ‘ছহীহ’ (বুখারী হা/৬১৩৩; মুসলিম হা/২৯৯৮; মিশকাত হা/৫০৫৩)।

(৩) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, ওহোদ যুদ্ধের পরদিন সকালে রাসূল (ছাঃ) লোকদের মধ্যে ঘোষণা জারী করে দেন যে, لاَ يَخْرُجْ مَعَنَا إلاَّ مَنْ شَهِدَ الْقِتَالَ ‘আমাদের সঙ্গে কেউ বের হবে না কেবল তারা ব্যতীত, যারা (গতকাল) যুদ্ধে যোগদান করেছিল’। তখন আব্দুল্লাহ বিন উবাই বললেন, আমাকে আপনার সাথে নিন’। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, না’। ... পরে জাবের বিন আব্দুল্লাহ তাঁর নিকটে অনুমতি চাইলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি চাই আপনার সাথে সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি’...। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে অনুমতি দিলেন’ (আর-রাহীক্ব ২৮৪ পৃঃ)। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ (ঐ, তা‘লীক্ব ১৫৫ পৃঃ)।