দ্বাদশ নববী বর্ষের যিলহাজ্জ মাসে অনুষ্ঠিত আক্বাবাহ্র ২য় বায়‘আতে অংশগ্রহণকারী ১২ জন মুসলমানের সাথে পরের বছর যিলহাজ্জ মাসে (জুন ৬২২ খৃঃ) অনুষ্ঠিত আক্বাবাহর ৩য় বায়‘আতে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলাসহ মোট ৭৫ জন ইয়াছরিববাসী হজ্জে এসে বায়‘আত গ্রহণ করেন। এটিই ইসলামের ইতিহাসে বায়‘আতে কুবরা (الْبَيْعَةُ الْكُبْرَى) বা বড় বায়‘আত নামে খ্যাত। যা ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাদানী জীবনের ভিত্তি স্বরূপ এবং আগামীতে ঘটিতব্য ইসলামী সমাজ বিপ্লবের সূচনাকারী। এই সময় মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ) মক্কায় ফিরে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে ইয়াছরিবে দাওয়াতের অবস্থা ও গোত্র সমূহের ইসলাম কবুলের সুসংবাদ প্রদান করেন। যা রাসূল (ছাঃ)-কে হিজরতে উদ্বুদ্ধ করে।
মূলতঃ আক্বাবাহর বায়‘আত তিন বছরে তিনবার অনুষ্ঠিত হয়। ১১ নববী বর্ষে আস‘আদ বিন যুরারাহ্র নেতৃত্বে ৬ জন ইয়াছরিববাসীর প্রথম ইসলাম কবুলের বায়‘আত। ১২ নববী বর্ষে ১২ জনের দ্বিতীয় বায়‘আত এবং ১৩ নববী বর্ষে ৭৩+২=৭৫ জনের তৃতীয় ও সর্ববৃহৎ বায়‘আত- যার মাত্র ৭৫ দিনের মাথায় ১৪ নববী বর্ষের ২৭শে ছফর বৃহস্পতিবার মক্কা হ’তে ইয়াছরিবের উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর হিজরতের সূচনা হয়।
বিবরণ : ১২ই যিলহজ্জ দিবাগত রাতের এক তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হ’লে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকা অবস্থায় পূর্বোক্ত ৭৫ জন ইয়াছরেবী হাজী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাক্ষাতের জন্য বের হন এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্বাবাহ্র সুড়ঙ্গ পথে অতি সঙ্গোপনে হাযির হন। অল্পক্ষণের মধ্যেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় চাচা আববাসকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হন, যিনি তখনও প্রকাশ্যে মুসলমান হননি। তবে তিনি কখনও রাসূল (ছাঃ)-কে একা ছাড়তেন না।
কুশলাদি বিনিময়ের পর প্রথমে আববাস কথা শুরু করেন। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ আমাদের মাঝে কিভাবে আছেন তোমরা জানো। তাকে আমরা আমাদের কওমের শত্রুতা থেকে নিরাপদে রেখেছি এবং তিনি ইযযতের সাথে তার শহরে বসবাস করছেন। এক্ষণে তিনি তোমাদের ওখানে হিজরত করতে ইচ্ছুক। এ অবস্থায় তোমরা তার পূর্ণ যিম্মাদারীর অঙ্গীকার করলে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু যদি এমনটি হয় যে, তোমরা তাকে নিয়ে গেলে, অতঃপর বিপদ মুহূর্তে তাকে পরিত্যাগ করলে, তাহ’লে তোমরা তাকে নিয়ে যেয়ো না। তিনি আমাদের মধ্যে সসম্মানেই আছেন’।
আববাসের বক্তব্যের পর প্রতিনিধি দলের মধ্য থেকে কা‘ব বিন মালেক বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আববাসের কথা শুনেছি। এক্ষণে تَكَلَّمْ يَا رَسُولَ اللهِ فَخُذْ لِنَفْسِكَ وَلِرَبِّكَ مَا أَحْبَبْتَ ‘আপনি কথা বলুন এবং আপনার নিজের জন্য ও নিজ প্রভুর জন্য যে চুক্তি আপনি ইচ্ছা করেন, তা করে নিন’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রথমে কুরআন থেকে কিছু আয়াত তেলাওয়াত করেন। অতঃপর তাদেরকে ইসলাম কবুলের আহবান জানান। অতঃপর তিনি বলেন,أُبَايِعُكُمْ عَلَى أَنْ تَمْنَعُونِى مِمَّا تَمْنَعُونَ مِنْهُ نِسَاءَكُمْ وَأَبْنَاءَكُمْ ‘আমি তোমাদের বায়‘আত নেব এ বিষয়ের উপর যে, তোমরা আমাকে হেফাযত করবে ঐসব বিষয় থেকে, যেসব বিষয় থেকে তোমরা তোমাদের নারী ও সন্তানদেরকে হেফাযত করে থাক’। সাথে সাথে বারা বিন মা‘রূর রাসূল (ছাঃ)-এর হাত ধরে বললেন, نَعَمْ وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَنَمْنَعَنَّكَ مِمَّا نَمْنَعُ مِنْهُ أُزُرَنَا ‘হ্যাঁ! ঐ সত্তার কসম যিনি আপনাকে সত্য সহ প্রেরণ করেছেন, অবশ্যই আমরা আপনাকে হেফাযত করব ঐসব বিষয় থেকে, যা থেকে আমরা আমাদের মা-বোনদের হেফাযত করে থাকি’।[1] এ সময় আবুল হায়ছাম ইবনুত তাইয়েহান বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের সঙ্গে ইহূদীদের সন্ধিচুক্তি রয়েছে। আমরা তা ছিন্ন করছি। কিন্তু এমন তো হবে না যে, আমরা এরূপ করে ফেলি। তারপর আল্লাহ যখন আপনাকে জয়যুক্ত করবেন, তখন আপনি আবার আপনার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসবেন ও আমাদের পরিত্যাগ করবেন’?
জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুচকি হেসে বললেন, بَلْ الدَّمَ الدَّمَ، وَالْهَدْمَ الْهَدْمَ، أَنَا مِنْكُمْ وَأَنْتُمْ مِنِّي، أُحَارِبُ مَنْ حَارَبْتُمْ، وَأُسَالِمُ مَنْ سَالَمْتُمْ ‘না! বরং তোমাদের রক্ত আমার রক্ত, তোমাদের ইযযত আমার ইযযত। আমি তোমাদের থেকে এবং তোমরা আমার থেকে। তোমরা যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে, আমিও তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব। তোমরা যাদের সঙ্গে সন্ধি করবে, আমিও তাদের সঙ্গে সন্ধি করব’।[2] এরপর সবাই যখন বায়‘আত গ্রহণের জন্য এগিয়ে এল, তখন আববাস বিন ওবাদাহ বিন নাযালাহ (যিনি গত বছর বায়‘আত করেছিলেন,) সকলের উদ্দেশ্যে বিশেষ করে নিজের গোত্র খাযরাজদের উদ্দেশ্যে বললেন, هَلْ تَدْرُونَ عَلاَمَ تُبَايِعُونَ هَذَا الرَّجُلَ؟ ‘তোমরা কি জানো কোন কথার উপরে তোমরা এই মানুষটির নিকটে বায়‘আত করছ? সবাই বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তোমরা লাল ও কালো (আযাদ ও গোলাম) মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে তাঁর নিকটে বায়‘আত করতে যাচ্ছ। যদি তোমাদের এরূপ ধারণা থাকে যে, যখন তোমাদের সকল সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং তোমাদের সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা করা হবে, তখন তোমরা তাঁর সঙ্গ ছেড়ে যাবে, তাহ’লে এখনই ছেড়ে যাও। কেননা তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পরে যদি তোমরা তাঁকে পরিত্যাগ কর, তাহ’লে ইহকাল ও পরকালে চরম লজ্জার বিষয় হবে। আর যদি তোমাদের ইচ্ছা থাকে যে, তোমাদের মাল-সম্পদের ধ্বংস ও সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা সত্ত্বেও এ চুক্তি অক্ষুণ্ণ রাখবে, যার প্রতি তোমরা তাঁকে আহবান করছ, তাহ’লে অবশ্যই তা সম্পাদন করবে। কেননা আল্লাহর কসম! এতেই তোমাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের জন্য মঙ্গল নিহিত রয়েছে’ (ইবনু হিশাম ১/৪৪৬)।
আববাস বিন ওবাদাহর এই ওজস্বিনী ভাষণ শোনার পর সকলে সমবেত কণ্ঠে বলে উঠল, قَالُوا: فَإِنَّا نَأْخُذُهُ عَلَى مُصِيبَةِ الْأَمْوَالِ، وَقَتْلِ الْأَشْرَافِ، فَمَا لَنَا بِذَلِكَ يَا رَسُولَ اللهِ إنْ نَحْنُ وَفَّيْنَا (بِذَلِكَ)؟ قَالَ: الْجَنَّةُ. قَالُوا: اُبْسُطْ يَدَكَ، فَبَسَطَ يَدَهُ، فَبَايَعُوهُ ‘আমরা তাঁকে গ্রহণ করছি আমাদের মাল-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যার বিনিময়ে। কিন্তু যদি আমরা এই প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করি, তবে এর বদলায় আমাদের কি পুরস্কার রয়েছে হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, জান্নাত। তারা বলল, হাত বাড়িয়ে দিন। অতঃপর তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং তারা সবাই তাঁর হাতে বায়‘আত করল’ (ইবনু হিশাম ১/৪৪৬)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, رَبِحَ الْبَيْعُ لا نُقِيلُ ولا نَسْتقيلُ ‘ব্যবসা চুক্তি লাভজনক হয়েছে। আমরা কখনো তা রহিত করব না বা রহিত করার আবেদন করব না’।[3]
হযরত জাবের (রাঃ) বর্ণিত অন্য রেওয়ায়াতে এসেছে যে, লোকেরা বলে উঠল, فَوَاللهِ لاَ نَذَرُ هَذِهِ الْبَيْعَةَ وَلاَ نَسْتَقِيلُهَا ‘আল্লাহর কসম! আমরা এই বায়‘আত পরিত্যাগ করব না এবং রহিত করার আবেদন করব না’।[4] একই রাবী কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে, فَوَاللهِ لاَ نَدَعُ هَذِهِ الْبَيْعَةَ أَبَداً وَلاَ نَسْلُبُهَا أَبَداً ‘আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই এই বায়‘আত পরিত্যাগ করব না এবং তা বাতিল করব না’ (আহমাদ হা/১৪৪৯৬, সনদ ছহীহ)।
এ সময় দলনেতা এবং কাফেলার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আস‘আদ বিন যুরারাহ পূর্বের বক্তার ন্যায় কথা বললেন এবং পূর্বের ন্যায় সকলে পুনরায় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করলেন। অতঃপর তিনিই প্রথম বায়‘আত করলেন। এরপর একের পর এক সকলে রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে হাত রেখে অঙ্গীকার গ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ বায়‘আত অনুষ্ঠিত হয়।
আববাস উক্ত আনছার প্রতিনিধি দলের প্রতি ভালভাবে লক্ষ্য করে দেখেন এবং বলেন যে, ‘এরা সবাই তরুণ বয়সের। এদেরকে আমি চিনিনা’। এতে প্রমাণিত হয় যে, উক্ত দলে যুবকদের আধিক্য ছিল। প্রতিনিধি দলের মহিলা দু’জনের বায়‘আত হয় মৌখিক অঙ্গীকারের মাধ্যমে। সৌভাগ্যবতী এই মহিলা দু’জন হ’লেন বনু মাযেন গোত্রের উম্মে ‘উমারাহ নুসাইবা বিনতে কা‘ব(أُمُّ عُمَارَةَ نُسَيْبَةُ بِنْتُ كَعْبٍ) এবং বনু সালামাহ গোত্রের উম্মে মানী‘ আসমা বিনতে ‘আমর(أُمُّ مَنِيْعٍ أَسْمَاء بِنْتُ عَمْرٍو)।[5] উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) এই বায়‘আতকে ‘বায়‘আতুল হারব’ বা যুদ্ধের বায়‘আত বলে অভিহিত করেন।[6] কা‘ব বিন মালেকের বর্ণনায় এসেছে যে, প্রথম বায়‘আত করেন বারা বিন মা‘রূর। বনু আব্দিল আশহাল বলতো প্রথম বায়‘আতকারী ছিলেন তাদের গোত্রের আবুল হায়ছাম মালেক ইবনুত তাইয়েহান।[7] অবশ্য বনু নাজ্জার ধারণা করত যে, তাদের গোত্রের আস‘আদই প্রথম বায়‘আত করেন’ (ইবনু হিশাম ১/৪৪৭)। আর দলনেতা ও প্রথম দাঈ হিসাবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আবেগের বসে কেউ আগে বায়‘আত করলে সেটাও অসম্ভব নয়।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৪৪২-৪৪৩; ইবনু কুতায়বা বলেন, আরবরা কোন সন্ধি চুক্তি করার সময় বলত,دَمِى دَمُكَ وَهَدْمِى هَدْمُكَ (يعنى الْحُرْمَة) ‘আমার রক্ত তোমার রক্ত, আমার ইযযত তোমার ইযযত’ (ঐ, টীকা -৬)।
[3]. ইবনু কাছীর, কুরতুবী হা/৩৪৯৪; তাফসীর সূরা তওবা ১১১ আয়াত; ইবনু জারীর হা/১৭২৮৪; সনদ ‘মুরসাল’।
[4]. আহমাদ হা/১৪৬৯৪ সনদ ছহীহ; হাকেম হা/৪২৫১, ২/৬২৪-২৫; আর-রাহীক্ব ১৫০ পৃঃ; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা তওবাহ ১১১ আয়াত।
[5]. ইবনু হিশাম ১/৪৬৬-৬৭; আহমাদ হা/১৫৮৩৬; আর-রাহীক্ব ১৪৮ পৃঃ।
[6]. ইবনু হিশাম ১/৪৫৪; আহমাদ হা/২২৭৫২।
[7]. ইবনু হিশাম ১/৪৪৭; আহমাদ হা/১৫৮৩৬।