সহীহ বুখারীতে ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেনঃ
«كُنَّا إِذَا كُنَّا مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فِى الصَّلاَةِ قُلْنَا السَّلاَمُ عَلَى اللَّهِ مِنْ عِبَادِهِ ، السَّلاَمُ عَلَى فُلاَنٍ وَفُلاَنٍ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ تَقُولُوا السَّلاَمُ عَلَى اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ السَّلاَمُ»
‘‘আমরা যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে নামাযে থাকতাম, তখন বলতাম, আল্লাহর উপর তাঁর বান্দাদের পক্ষ থেকে সাল্লাম, অমুক অমুকের উপর সাল্লাম, অমুক ব্যক্তির উপর সাল্লাম। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আল্লাহর উপর সাল্লাম এমন কথা তোমরা বলোনা। কেননা আল্লাহ নিজেই সাল্লাম।[1]
ব্যাখ্যাঃ ইমাম বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ এবং অন্যান্য ইমামগণ এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। এখানে السَّلاَمُ عَلَى اللَّهِ বলতে নিষেধ করা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ফরয নামাযের সাল্লাম ফিরিয়ে মুক্তাদীদের দিকে ফিরে বসতেন তখন তিনবার ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ বলতেন। অতঃপর বলতেনঃ
«اللَّهُمَّ أَنْتَ السَّلَام وَمِنْك السَّلَام تَبَارَكْت يَا ذَا الْجَلَال وَالْإِكْرَام»
‘‘হে আল্লাহ্! তুমিই সাল্লাম।[2] তোমার পক্ষ হতেই শান্তি আগমণ করে। তুমি সুমহান, সম্মানিত এবং মর্যাদাবান’’। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, জান্নাতবাসীদের পক্ষ হতে তাদের প্রভুর জন্য এটিই হবে সাল্লাম।
فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ السَّلاَمُ আল্লাহ নিজেই সালামঃ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক দোষ-ত্রুটি এবং উপমা-উদাহরণ থেকে মুক্ত। তিনি প্রতিটি উত্তম ও পরিপূর্ণ গুণে গুণান্বিত এবং প্রতিটি দোষ ও ত্রুটি হতে পবিত্র। البدائع নামক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, السلام হচ্ছে ইসমে মাসদার। কিন্তু এটি দুআর শব্দসমূহের অন্যতম। এতে খবর (আল্লাহর সত্তা সম্পর্কে খবর দেয়া) ও ইনশা (দুআ করা)- উভয় অর্থই বিদ্যমান রয়েছে। এই উভয় অর্থের একটি অপরটির বিপরীত নয়। সাল্লাম বিনিময়ের সময় এই অর্থই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আল্লাহর পবিত্র সত্তা সম্পর্কে খবর দেয়া হয়েছে যে, তিনি সকল দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত এবং সকল প্রকার উত্তম গুণাবলী দ্বারা গুণান্বিত। আল্লাহ তাআলার নাম সাল্লাম সম্পর্কে দু’টি প্রসিদ্ধ উক্তি বর্ণিত হয়েছে।
প্রথম উক্তিঃ এখানে সাল্লাম দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। সুতরাং فَإِنَّ اللَّهَ هُوَالسَّلاَمُ এই বাক্যটির অর্থ হচ্ছে, তোমাদের উপর আল্লাহর পক্ষ হতে সাল্লাম ও বরকত নাযিল হোক। এই অর্থের অনুরূপ অর্থও বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং এই অর্থেই আল্লাহর নামসমূহের মধ্য হতে السلام নামটি নির্বাচন করা হয়েছে। অন্যান্য নাম গ্রহণ করা হয়নি।
দ্বিতীয় উক্তিঃ السلام শব্দটি মাসদার। এটি সাল্লামত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সাল্লাম বিনিময় করার সময় এই অর্থই উদ্দেশ্য। যারা এই কথা বলেছেন, তাদের দলীল হচ্ছে, السلام শব্দটি নাকেরা তথা অনির্দিষ্ট হিসাবে অর্থাৎ আলিফ লাম যুক্ত না হয়েই ব্যবহৃত হয়। মুসলিমগণ বলে থাকেনঃ سلام عليكم (আপনাদের উপর আল্লাহর পক্ষ হতে সাল্লাম)। এটি যদি আল্লাহর নামের অন্তর্ভূক্ত হত, তাহলে আলিফ লাম ছাড়া ব্যবহৃত হতনা। তাদের কথার পক্ষে আরেকটি দলীল হচ্ছে, সাল্লাম আল্লাহর নাম নয়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ তাআলা যে সকল দোষ-ত্রুটি হতে মুক্ত সেই সংবাদ দেয়া এবং এর দ্বারা দুআ করা উদ্দেশ্য।
ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রঃ) বলেনঃ সারকথা হচ্ছে উভয় উক্তির মধ্যে হক রয়েছে। উভয়টির প্রত্যেকটির সাথেই সত্যের অংশ রয়েছে। উভয় উক্তির মিলনেই সত্য নিহিত। এই কথাটি সুস্পষ্টভাবে ঐ মূলনীতির মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়, যেখানে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সুন্দর নামের উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করবে, তার উচিত ঐ নামের উসীলা দিয়েই দুআ করা, যা তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সফল ও হাসিলের জন্য সহায়ক হয়। সুতরাং বান্দা যখন বলবেঃ رب اغفرلي وارحمني إنك أنت الغفور الرحيم তখন সে দু’টি জিনিষ প্রার্থনা করে এবং আল্লাহর নাম সমূহের মধ্য হতে দু’টি নামের উসীলা দেয়। এই নাম দু’টি প্রার্থিত জিনিষ দু’টি অর্জনের দাবী রাখে।
সুতরাং নিরাপত্তা ও মুক্তির প্রার্থনা যেহেতু মানুষের নিকট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, তাই আল্লাহর নিকট শান্তি, নিরাপত্তা ও মুক্তি প্রার্থনার বাক্য নির্বাচনের মধ্যে আল্লাহর নামসমূহের মধ্য হতে এমন একটি নাম নির্বাচন করা হয়েছে, যাতে উক্ত অর্থ বিদ্যমান রয়েছে। সেটি হচ্ছে السلام। আল্লাহর এই নাম থেকেই সাল্লামত (নিরাপত্তা, মুক্তি ও শান্তি) কামনা করা হয়। মুসলিমদের কামনাও তাই। প্রত্যেক মুসলিমের উদ্দেশ্যই এটি। سلام عليكم বাক্যটি আল্লাহ তাআলার নামসমূহের অন্যতম একটি নাম। এর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর কাছে সাল্লামত নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য দুআ করে। এই বিষয়টি ভালভাবে বুঝার জন্য অত্যন্ত গবেষণা করা উচিত।
আল্লাহ তাআলার সাল্লাম নামটির প্রকৃত অর্থ হচ্ছে সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি হতে মুক্ত ও পবিত্র। এই অর্থের ভিত্তিতেই এই السلام হতে অন্যান্য সকল শব্দ নির্গত হয়। যেমন আপনি বলে থাকেনঃ سلمك الله আল্লাহ তোমাকে নিরাপদ রাখুন। পুলসীরাতের উপর মুমিনদের দুআ হবেঃ اللهم سلِّم سلِّم ‘‘হে আল্লাহ! নিরাপদ রাখো নিরাপদ রাখো’’। আরো বলা হয়, سلم الشيئ لفلان ‘‘ জিনিষটি খালেসভাবে অমুক ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট’’। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا رَجُلًا فِيهِ شُرَكَاءُ مُتَشَاكِسُونَ وَرَجُلًا سَلَمًا لِرَجُلٍ هَلْ يَسْتَوِيَانِ مَثَلًا الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
‘‘আল্লাহ্ একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন একজন ক্রীতদাস লোকের। সে কতিপয় রূঢ় চরিত্রের মনিবের মালিকানাভুক্ত, যারা সবাই তাকে নিজের দিকে টানে এবং আরেক ব্যক্তির যে পুরোপরি একই মনিবের ক্রীতদাস। তাদের উভয়ের অবস্থা কি সমান? সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানেনা’’। (সূরা যুমারঃ ২৯) অর্থাৎ আয়াতে পেশকৃত উপমায় দ্বিতীয় ক্রীতদাস সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তাতে অন্য কারো অংশ নেই, সে তার আসল মালিক ব্যতীত অন্য কারও দাসত্ব করা হতে মুক্ত হয়ে খালেসভাবে তার মনিবের জন্যই নির্দিষ্ট। এখান থেকেই السلم (শান্তি) শব্দটি নির্গত হয়েছে, যা الحرب তথা যুদ্ধের বিপরীত। কেননা দু’জন যুদ্ধরত যোদ্ধার প্রত্যেকেই নিজেকে প্রতিপক্ষের ক্ষতি এবং অকল্যাণ থেকে মুক্ত ও নিরাপদ রাখতে চায়। এ জন্যই যখন যুদ্ধের বিপরীত শান্তি (السلم) উদ্দেশ্য হয়, তখন এটি باب مفاعلة থেকে অর্থাৎ المشاركة এর মতই المسالمة হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
এখান থেকে ব্যবহৃত হয় القلب السليم (পরিশুদ্ধ ও দোষ-ত্রুটি হতে মুক্ত ও পবিত্র হৃদয়)। এর প্রকৃত রূপ হল, যে বান্দা শুধু আল্লাহর জন্য মুক্ত খালেস (একনিষ্ঠ) হবে, সে অবশ্যই শির্কের কদর্যতা, সকল পাপ-পঙ্কিলতা ও নাফরমানী হতে সম্পূর্ণ দূরে থাকবে। সে সব সময় সীরাতুল মুস্তাকীমের উপর অটল থাকবে, অন্তর দ্বারা আল্লাহর প্রতি অগাধ ভালবাসা পোষণ করবে এবং মানুষের সাথে আচার-ব্যবহার ও লেন-দেনে সত্যবাদী থাকবে। এই ব্যক্তির ব্যাপারেই নিশ্চিত করে বলা যায় যে, সে জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত পাবে এবং জান্নাতের নেয়ামত লাভ করে ধন্য হবে।
এই السلم থেকেই الإسلام শব্দ গ্রহণ করা হয়েছে। ইসলাম শব্দের মূল অক্ষরسلم । এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর পরিপূর্ণ আনুগত্য করা এবং আল্লাহর সামনে সম্পূর্ণরূপে নত হওয়া (পরিপূর্ণ ভয়, আশা ও ভালোবাসা সহকারে আল্লাহর এবাদত করা) এবং শির্কের কদর্যতা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হওয়া। সুতরাং মুসলিম বান্দা তাঁর প্রভুর জন্য সম্পূর্ণ মুক্ত এবং একনিষ্ঠ হয়ে যায়। সে ঐ ক্রীতদাসের ন্যায়, যে তার মনিবের খেদমত করার জন্য সদা মুক্ত এবং একনিষ্ঠ থাকে। সে তার মনিবের খেদমতের সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করেনা। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা দু’টি উপমা পেশ করেছেন। একটি উপমা পেশ করেছেন এমন খাঁটি মুসলিমের, যিনি তাঁর প্রভুর জন্য একনিষ্ঠ থাকেন এবং অন্য এমন একটি লোকের উপমা পেশ করেছেন মুশরিকের, যে তার প্রভুর সাথে অন্যকে শরীক করে। এই অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) এই অধ্যায়ে আল্লাহ তাআলার নাম ‘সাল্লাম’এর ব্যাখ্যা জানা গেল।
২) ‘সাল্লাম’ হচ্ছে সম্মানজনক সম্ভাষণ।
৩) আল্লাহকে সাল্লাম দেয়া সহীহ নয়।
৪) আল্লাহ তাআলাকে সাল্লাম দেয়া নাজায়েয হওয়ার কারণও বলা হয়েছে।
৫) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে সালামের ঐ তরীকা শিক্ষা দিয়েছেন, যা আল্লাহ তাআলার জন্য সমীচীন ও শোভনীয়।
[2] - سلام (সাল্লাম) আল্লাহ তাআলার অন্যতম একটি গুণবাচক নাম। বাংলায় এটির সরাসরি অনুবাদ করা হয় শান্তিময়। মূলত সরাসরি শান্তিময় শব্দ দ্বারা ‘সাল্লাম’এর অনুবাদ করা ঠিক নয়। আল্লাহর গুণ বাচক নাম ‘সাল্লাম’এর ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করলে দেখা যায় আল্লাহ তাআলার এই সুমহান নামটির অর্থ হচ্ছে তিনি সকল দোষত্রুটি থেকে পবিত্র ও মুক্ত। সে হিসাবে আল্লাহ তাআলাই তাঁর বান্দাদেরকে সকল অপবিত্র বস্ত্ত ও দোষ-ত্রুটি থেকে নিরাপদ রাখেন। এই অর্থে তিনি সাল্লাম। আল্লাহর তাওফীক ব্যতীত দোষ-ত্রুটি থেকে বেঁচে থাকা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাই যারা আল্লাহর তাওফীক পেয়ে সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি ও অন্যায় কাজ থেকে মুক্ত থাকেন, তারা প্রতিফল হিসাবে আল্লাহর তরফ থেকে শান্তিপ্রাপ্ত হবেন।