মানুষের নেক আমল দ্বারা নিছক পার্থিব স্বার্থ হাসিলের নিয়ত করা শির্ক - ১

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

‘‘যারা শুধু দুনিয়ার জীবন এবং এর চাকচিক্য কামনা করে, আমি তাদের সব কাজের প্রতিদান দুনিয়াতেই দিয়ে থাকি এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয়না। এরাই হল সেসব লোক আখেরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া অন্য কিছু নেই। তারা এখানে যা কিছু করেছিল সবই বরবাদ হয়েছে; আর যা কিছু উপার্জন করেছিল, সবই বিনষ্ট হল’’। (সূরা হুদঃ ১৫-১৬)

ব্যাখ্যাঃ লেখক এই অধ্যায়ে বর্ণিত বক্তব্যগুলো দ্বারা বর্ণনা করতে চাচ্ছেন যে, দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে মানুষ কোনো সৎ আমল করলে সেই আমল ঐ রকমই বাতিল হয়ে যায়, যেমন রিয়াকারীর আমল বাতিল হয়ে যায়। বিশেষ করে যখন আমলকারী রিয়ার উপর বলবৎ থাকে। অর্থাৎ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার আমলে রিয়া মিশ্রিত থাকে। যেমন কেউ ইলম অর্জন করে চাকুরী লাভের জন্য। শিক্ষক, ইমাম মুজাহিদ এবং অনুরূপ অন্যান্য লোকদের মধ্য হতে যারা দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের নিয়ত করে তাদের অবস্থা একই রকম। বর্তমান সময়ে এ রকম লোকের সংখ্যা প্রচুর। এমনকি কতিপয় লোক জিহাদের উদ্দেশ্যে সফর করতে চায়, যাতে তার জন্য আমীরের নিকট থেকে ফায়দা হাসিল হয়, সেনাপতির সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়, সেনাপতির খাস আদেশ-নিষেধ অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং তাঁর নৈকট্য হাসিল হয়। তাদের অন্তরে আদৌ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও দ্বীনকে সমুন্নত করার নিয়ত থাকেনা।

উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃمَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا ‘‘যারা শুধু দুনিয়ার জীবন চায়’’ অর্থাৎ দুনিয়ায় আমলের ছাওয়াব চায়। وَزِيْنَتَهَا ‘‘দুনিয়ার চাকচিক্য চায়’’ অর্থাৎ দুনিয়ার সম্পদ চায়।

نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ ‘‘আমি তাদের কাজের সব প্রতিদান দুনিয়াতেই দিয়ে থাকি’’ঃ অর্থাৎ আমি সুস্বাস্থ্য, আনন্দ-ফুর্তি এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দান করার মাধ্যমে তাকে সুখ-শান্তি দিয়ে তার আমলের পূর্ণ বদলা দিয়ে থাকি। তাদের বদলাতে কোন কমতি করা হয়না। অতঃপর উপরোক্ত আয়াতকে নিম্নের এই আয়াত রহিত করে দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَدْحُورًا

‘‘যে কেউ ইহকাল কামনা করে, আমি সেসব লোককে যা ইচ্ছা দুনিয়াতেই দ্রুত দিয়ে দেই। অতঃপর তাদের জন্যে জাহান্নাম নির্ধারণ করি। ওরা তাতে নিন্দিত-বিতাড়িত অবস্থায় প্রবেশ করবে’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ১৮) ইমাম নাহ্হাস ইহাকে স্বীয় কিতাব ‘নাসেখ ও মানসুখ’এ বর্ণনা করেছেন।[1]

ইবনে জারীর স্বীয় মুত্তাসিল সনদে শুফাই বিন মাতের সূত্রে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা করার জন্য আগমণ করবেন। তখন প্রত্যেক জাতিই নতজানু অবস্থায় থাকবে। আল্লাহ তাআলা সেদিন প্রথমে যাকে ডাকবেন, সে হবে এমন ব্যক্তি, যে কুরআন মুখস্থ করেছে, অতঃপর যে আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে। অতঃপর যে দুনিয়াতে প্রচুর সম্পদের অধিকারী ছিল।

প্রথমে আল্লাহ তাআলা কুরআনের হাফেযকে বলবেনঃ আমি কি তোমাকে আমার রাসূলের উপর অবতীর্ণ কিতাবের জ্ঞান শিক্ষা দেইনি। সে বলবেঃ হ্যাঁ হে আমার প্রভু! তখন আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ তোমাকে যে বিষয় শিক্ষা দেয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছো? সে বলবেঃ আমি রাত-দিন নামাযে কুরআন তেলাওয়াত করতাম। আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছো। ফেরেশতাগণও বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছো। আল্লাহ তাআলা তখন বলবেনঃ বরং তুমি এ জন্যই কুরআন পড়েছ, যাতে তোমাকে কারী বলা হয়। তোমাকে তাই বলা হয়েছে।

অতঃপর সম্পদের মালিককে নিয়ে আসা হবে। আল্লাহ তাআলা তাকে বলবেনঃ আমি কি তোমাকে প্রশস্ত জীবিকা দান করিনি, মানুষের কাছ থেকে তোমাকে অমুখাপেক্ষী করিনি? সে বলবেঃ হ্যাঁ, হে আমার প্রভু। তখন আল্লাহ বলবেনঃ আমি তোমাকে যে মাল দিয়েছিলাম, তাতে তুমি কী করেছ? সে বলবেঃ আমি এর দ্বারা আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতাম এবং দান-খয়রাতও করতাম। আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছো। ফেরেশতাগণও বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছো। আল্লাহ তাআলা তখন বলবেনঃ বরং তুমি এ জন্যই দান করেছিলে, যাতে বলা হয় অমুক একজন দাতা। তোমাকে উহা বলা হয়েছে।

অতঃপর আল্লাহর রাস্তায় যে নিহত হয়েছে, তাকে আনয়ন করা হবে। তাকে বলা হবেঃ তোমাকে কী কারণে হত্যা করা হয়েছে? সে বলবেঃ আমাকে তোমার রাস্তায় জিহাদ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। তাই আমি জিহাদ করতে গিয়ে নিহত হয়েছি। আল্লাহ তাআলা তখন বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছো। ফেরেশতাগণও বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছো। আল্লাহ তাআলা তখন বলবেনঃ বরং তুমি এ জন্যই জিহাদ করেছিলে, যাতে বলা হয় অমুক একজন সাহসী বীর। তোমাকে উহা বলা হয়েছে। আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার উভয় হাঁটুতে হাত মেরে বললেনঃ হে আবু হুরায়রা! কিয়ামাতের দিন আল্লাহর সৃষ্টির মধ্য হতে ঐ তিন প্রকার মানুষের দ্বারাই জাহান্নামের আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হবে’’।

সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ تَعِسَ عَبْدُ الدِّرْهَمِ تَعِسَ عَبْدُ الْخَمِيصَةِ تَعِسَ عَبْدُ الْخَمِيْلَةِ إِنْ أُعْطِيَ رَضِيَ وَإِنْ لَمْ يُعْطَ سَخِطَ تَعِسَ وَانْتَكَسَ وَإِذَا شِيكَ فَلا انْتَقَشَ طُوبَى لِعَبْدٍ آخِذٍ بِعِنَانِ فَرَسِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَشْعَثَ رَأْسُهُ مُغْبَرَّةٍ قَدَمَاهُ إِنْ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ وَإِنْ كَانَ فِي السَّاقَةِ كَانَ فِي السَّاقَةِ إِنِ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّع»

‘‘ধ্বংস হোক দীনারের গোলাম, ধ্বংস হোক দিরহামের গোলাম, ধ্বংস হোক উত্তম চাদরের দাস, ধ্বংস হোক নরম পোষাকের গোলাম! তাকে কিছু দেয়া হলে সন্তুষ্ট হয়। আর না দেয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়। সে ধ্বংস হোক, উল্টে পড়ুক। সে যখন কাঁটাবিদ্ধ হবে তখন তা খুলতে না পারুক। সুখবর ঐ ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য তার ঘোড়ার লাগাম ধরে আছে। তার মাথা ধুলোমলিন এবং পা দু’টি ধুলিমাখা। তাকে সেনাবাহিনীর পাহারায় নিয়োজিত করা হলে সেখানেই নিয়োজিত থাকে। আর তাকে সেনাবাহিনীর পশ্চাতে রাখা হলে সে তাতেই সন্তুষ্ট থাকে। সে অনুমতি প্রার্থনা করলে তাকে অনুমতি দেয়া হয় না। কারো জন্য সুপারিশ করলে তার সুপারিশও গ্রহণ করা হয় না’’।

ব্যাখ্যাঃ تعِس শব্দের আইন বর্ণে যের দিয়ে পড়তে হবে। যবর দিয়ে পড়াও জায়েয। অর্থাৎ সে পড়ে গেল। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, সে ধ্বংস হল। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী এ কথাই বলেছেন।

আবুস্ সাআদাত (রঃ) বলেনঃ বলা হয় যে, تَعِسَ يَتَّعسُ। এই কথা তখন বলা হয়, যখন কেউ হোঁচট খায় এবং মুখের উপর উল্টে পড়ে। এর দ্বারা বদদুআ করা উদ্দেশ্য।

تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ ধ্বংস হোক দীনারের গোলাম........: এখানে সৎ কাজের মাধ্যমে দুনিয়ার সম্পদ উপার্জনে আগ্রহীকে দিনার ও দিরহামের গোলাম বলার কারণ হচ্ছে, পার্থিব স্বার্থ হাসিল করা ছাড়া সে অন্য কোন উদ্দেশ্যে আমল করেনা। তাই সে অর্থের গোলামে পরিণত হয়েছে। কেননা সে আমলের মাধ্যমে অর্থের বন্দেগী করেছে।

تَعِسَ عَبْدُ الْخَمِيصَةِ تَعِسَ عَبْدُ الْخَمِيْلَةِ ধ্বংস হোক উত্তম চাদরের দাস, ধ্বংস হোক নরম পোষাকের গোলামঃ আবুস সাআদাত (রঃ) বলেনঃ নরম রেশমের কাপড়কে অথবা পশমী ডোরাকাটা কাপড়কে خميصة বলা হয়। কেউ কেউ বলেনঃ লাল কালো মিশ্রিত এবং ডোরাকাটা কাপড়কে খামীসাহ বলা হয়। আর خميلة শব্দের ‘খা’ বর্ণে যবর দিয়ে পড়তে হবে। এর অর্থ হচ্ছে ডোরা বিশিষ্ট নরম কাপড়, চাই তা সুতী হোক কিংবা রেশমী অথবা পশমী হোক।

পার্থিব জীবনের প্রত্যেক সম্পদই এখানে উদ্দেশ্য। চাই তা নগদ অর্থ হোক কিংবা অন্য কোনো বস্ত্ত হোক। কেননা উভয় প্রকার সম্পদকেই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। আবুস্ সাআদাত বলেনঃ تعس وانتكس অর্থ হচ্ছে, সে মাথার উপর উল্টে পড়ল। এখানে বদদুআ করা উদ্দেশ্য যে, দুনিয়ার পূজারীগণ যেন ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

وَإِذَا شِيكَ فَلا انْتَقَشَ সে যখন কাঁটা বিদ্ধ হবে তখন তা খুলে দেয়ার মত কাউকে না পাকঃ অর্থাৎ সে যখন কাঁটা বিদ্ধ হবে, তখন কাঁটা বের করার যন্ত্র ব্যবহার করেও সেই কাঁটা খুলতে পারবেনা এবং তা খুলে দেয়ার জন্য অন্য কাউকেও পাবেনা। আবুস্ সাআদাত অনুরূপ বলেছেন।

শাইখুল ইসলাম বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ার সম্পদের লোভী ব্যক্তিকে দীনার, দিরহাম, উত্তম চাদর ও নরম পোষাকের গোলাম বলেছেন এবং তার মধ্যে আরো যেসমস্ত দোষ রয়েছে, তা বর্ণনা করেছেন। এখানে খবরের শব্দের মাধ্যমে তার উপর বদদুআ করা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, تَعِسَ وَانْتَكَسَ وَإِذَا شِيكَ فَلا انْتَقَشَ অর্থাৎ সে ধ্বংস হোক, উল্টে পড়ুক এবং সে যখন কাঁটা বিদ্ধ হবে তখন তা খুলতে না পারুক।

যে ব্যক্তি মসীবতে পড়ে তা হতে বের হওয়ার রাস্তা পায়নি এবং সে সফলকামও হতে পারেনি, তার অবস্থা ঠিক এ রকমই। কেননা সে হতভাগ্য হয়েছে এবং উল্টে পড়েছে। তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি এবং সে বিপদাপদ ও মসীবত হতে উদ্ধারও পায়নি। যে ব্যক্তি মালের এবাদত করে তার অবস্থা এ রকমই হয়। তার স্বভাব হচ্ছে, তাকে কিছু দেয়া হলে সন্তুষ্ট হয়, না দেয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়। সুতরাং সন্তুষ্ট হওয়া বা নারাজ হওয়া কোনটিই আল্লাহর জন্য নয়।

যার নিয়ত হবে শুধু নেতৃত্ব লাভ, সুনাম-সুখ্যাতি অর্জন এবং ব্যক্তিস্বার্থসহ অন্যান্য বস্ত্ত হাসিল করা, তার অবস্থাও অনুরূপ। তার উদ্দেশ্য হাসিল হলে খুশী হয়, উদ্দেশ্য হাসিল না হলে নারাজ হয়। এ ধরণের লোকই স্বীয় নফ্সের পূজা করে। মূলত সে অর্থের গোলাম। কেননা প্রকৃত গোলামী হচ্ছে অন্তরের গোলামী। যে বস্ত্ত মানুষের অন্তরকে গোলাম বানিয়ে নেয়, উক্ত মানুষ প্রকৃত পক্ষেই সে বস্ত্তর গোলাম হয়ে যায় এবং সে ঐ বস্ত্তর দাসে পরিণত হয়।

পরিশেষে শাইখুল ইসলাম বলেনঃ এই হল দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও ধন-সম্পদ অন্বেষণকারীদের অবস্থা। যে ব্যক্তি শুধু ধন-সম্পদের পিছনেই ছুটে, ধন-সম্পদ তাকে দাস ও গোলাম বানিয়ে নেয়।

দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও ভোগসামগ্রী দুই প্রকারঃ

১) এমন সম্পদ, যার প্রতি সকল মানুষই মুখাপেক্ষী এবং যা ব্যতীত মানুষের জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। যেমন পানাহার, বিয়ে-শাদী, বাসস্থান এবং অনুরূপ বস্ত্তর প্রতি মানুষের প্রয়োজন। এ বিষয়গুলো মানুষ আল্লাহর কাছে চাইবে এবং এগুলো অর্জন করার আগ্রহী হবে ও চেষ্টা করবে। এর ফলে তার কাছে ধন-সম্পদ আসলে সে শুধু তার প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। মাল তার কাছে শুধু গাধার ন্যায় হবে, যার উপর সে আরোহন করে এবং বিছানা ও চাদরের মতই হবে, যাতে সে বসে। কখনই সে মালের গোলামে পরিণত হবেনা, যাতে সে মালের জন্য পেরেশান হয়ে যায়।

২) দ্বিতীয় প্রকার সম্পদ হচ্ছে যার প্রতি বান্দার কোনো প্রয়োজন হয়না। এই প্রকার সম্পদের প্রতি মানুষের অন্তরকে যুক্ত করা ঠিক নয়। এই প্রকার সম্পদের সাথে মানুষের অন্তর লেগে গেলে সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য বস্ত্তর উপর নির্ভরকারী এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের গোলাম হয়ে যায়। তখন সে আল্লাহর প্রকৃত বান্দাদের কাতারের বাইরে চলে যায় এবং তাকে আল্লাহর উপর ভরসাকারী হিসাবেও গণ্য হয়না। বরং তার মধ্যে গাইরুল্লাহর এবাদতের একটি অংশ এবং গাইরুল্লাহর উপর ভরসা করার আরেকটি অংশ প্রবেশ করে। এই ব্যক্তির জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদীছটি প্রযোজ্য হবেঃ تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ تَعِسَ عَبْدُ الدِّرْهَمِ ‘‘ধ্বংস হোক দীনারের গোলাম, ধ্বংস হোক দিরহামের গোলাম, ধ্বংস হোক............’’: হাদীছে বর্ণিত বৈশিষ্টগুলো যার মধ্যে পাওয়া যায়, সে এই বস্ত্তগুলোর গোলাম হয়ে যায়। সে যদি এই বস্ত্তগুলো আল্লাহর কাছে চায় অতঃপর আল্লাহ যদি তাকে উহা দান করেন তাহলে খুশী হয়। আর তিনি যদি উহা না দেন, তাহলে নারাজ হয়।

আল্লাহর প্রকৃত বান্দার অবস্থা হলো, সে আল্লাহর পছন্দনীয় জিনিষকেই পছন্দ করে, আল্লাহর অপছন্দনীয় বস্ত্তকেই অপছন্দ করে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল যা ভালোবাসেন, সেও তা ভালবাসে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল যা ঘৃণা করেন, সেও তা ঘৃণা করে, আল্লাহর অলীদের সাথে বন্ধুত্ব রচনা করে এবং আল্লাহর দুশমনদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে। এই গুণাবলীতে গুণান্বিত ব্যক্তিই পূর্ণ ঈমানদার। শাইখুল ইসলামের কথা এখানেই শেষ।

طُوبَى لِعَبْدٍ ঐ বান্দার জন্য সুখবরঃ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ এক লোক বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! সুখবর তো ঐ ব্যক্তির জন্য, যে আপনাকে দেখেছে এবং আপনার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ যে ব্যক্তি আমাকে দেখেছে এবং ঈমান এনেছে, তার জন্য সুখবর। অতঃপর সুখবর অতঃপর সুখবর অতঃপর সুখবর ঐ ব্যক্তির জন্য যে আমার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে, কিন্তু আমাকে দেখেনি। এক ব্যক্তি বললঃ তুবা কী? তিনি তখন বললেনঃ এটি হচ্ছে জান্নাতের এমন একটি গাছ, যার বিশালতা একমাসের দূরত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। জান্নাতবাসীদের পোষাক এই গাছের ছাল দিয়েই তৈরী হবে।[2] সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে এই হাদীছের সমর্থনে একাধিক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।

ইমাম ইবনে জারীর আত্ তাবারী ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ (রঃ) থেকে এ বিষয়ে আজীব একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ বলেনঃ জান্নাতে এমন একটি গাছ রয়েছে, যার নাম তুবা। তার ছায়ায় অশ্বারোহী একশ বছর চললেও তার এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে পৌঁছতে পারবেনা। এর ফুলগুলো হবে রেশমের, পাতাগুলো হবে নরম চাদরের ন্যায়, ডালাগুলো হবে আম্বরের, গাছের নীচে বিছানো থাকবে ইয়াকুত পাথর (পান্না), গাছের নীচের শক্ত মাটি হবে কর্পূর মিশ্রিত এবং নরম মাটি হবে কস্ত্তরি মিশ্রিত। গাছের গোড়া থেকে মদের, দুধের এবং মধুর নদীসমূহ প্রবাহিত হবে। গাছের নীচে হবে জান্নাতবাসীদের বৈঠক। যখন তাদের বৈঠক জমে উঠবে, তখন আল্লাহর পক্ষ হতে ফেরেশতাগণ আগমণ করবেন। তারা স্বর্ণের শিকলের লাগাম পরিহিত উৎকৃষ্ট মানের উটসমূহ হাঁকিয়ে আনবেন। উটগুলোর চেহারার সৌন্দর্য হবে প্রদীপের আলোর মত। সেগুলোর শরীরের পশম হবে মাযআরী (একটি স্থানের নাম) রেশমের মত মুলায়েম। সেগুলোর পীঠে থাকবে এমন পালকী, যার তক্তাগুলো হবে ইয়াকুতের (পান্নার), পালকীর পার্শ্ব হবে স্বর্ণের, পালকীর কাপড়গুলো হবে চিকন ও মোটা রেশমের। ফেরেশতাগণ উটগুলোকে বসাবেন এবং বলবেনঃ আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে আপনাদের নিকট পাঠিয়েছেন। যাতে করে আপনারা তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন এবং সাল্লাম দেন।

ওয়াহাব (রঃ) বলেনঃ জান্নাতবাসীগণ উটগুলোর উপর আরোহন করবেন। সেগুলো হবে পাখির চেয়েও অধিক দ্রুতগামী এবং তোশকের নরম বিছানার চেয়েও অধিক নরম। উটগুলো উন্নত জাতের হবে এবং সেগুলোকে ইতিপূর্বে কখনই ব্যবহার করা হয়নি। জান্নাতীদের একজন উটের উপর আরোহন করে তার আরেকজন জান্নাতী ভাইয়ের পাশ দিয়েই চলবে, তার সাথে কথা বলবে এবং কানাকানি করবে। কিন্তু একজনের বাহনের কান অন্যজনের বাহনের কান স্পর্শ করবেনা এবং একটি বাহনের পার্শ্ব অন্য বাহনের পার্শ্বের সাথে লাগবেনা। চলার সময় রাস্তার গাছপালা স্বীয় স্থান থেকে সরে যাবে, যাতে করে গাছটি তার ও তার ভাইয়ের তথা দু’জন আরোহীর মাঝে দূরত্ব সৃষ্টির কারণ না হয়।

ওয়াহাব বলেনঃ অতঃপর জান্নাতীগণ দয়াময় আল্লাহর কাছে পৌঁছে যাবে। আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য স্বীয় চেহারা মুবারক উন্মুক্ত করবেন। যাতে করে তারা আল্লাহকে দেখতে পারে। আল্লাহকে দেখে তারা বলবেঃ

«اللَّهُمَّ أَنْتَ السَّلَامُ وَمِنْكَ السَّلَامُ وَحَقَّ لَكَ الْجَلَالُ وَالْإِكْرَامُ»

‘‘হে আল্লাহ্! তুমিই সাল্লাম (শান্তিময়)[3]। তোমার পক্ষ হতেই শান্তি আগমণ করে। তুমি বড়ত্ব, সম্মান এবং সুমহান মর্যাদার অধিকারী।

[1] - এই হাদীছের সনদে দুর্বলতা রয়েছে। সনদে রয়েছে জারীর। মুহাদ্দিছদের নিকট তিনি মাতরুক।

[2] - মুসনাদে আহমাদের এই হাদীছটি দুর্বল। তার সনদে রয়েছে ইবনে লাহিয়া। তিনি শেষ বয়সে স্মরণ শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন।

[3] - سلام (সাল্লাম) আল্লাহ তাআলার অন্যতম একটি গুণবাচক নাম। বাংলায় এটির সরাসরি অনুবাদ করা হয় শান্তিময়। মূলত সরাসরি শান্তিময় শব্দ দ্বারা ‘সাল্লাম’এর অনুবাদ করা ঠিক নয়। আল্লাহর গুণ বাচক নাম ‘সাল্লাম’এর ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করলে দেখা যায় আল্লাহ তাআলার এই সুমহান নামটির অর্থ হচ্ছে তিনি সকল দোষত্রুটি থেকে পবিত্র ও মুক্ত। সে হিসাবে আল্লাহ তাআলাই তাঁর বান্দাদেরকে সকল অপবিত্র বস্ত্ত ও দোষ-ত্রুটি থেকে নিরাপদ রাখেন। এই অর্থে তিনি সাল্লাম। আল্লাহর তাওফীক ব্যতীত দোষ-ত্রুটি থেকে বেঁচে থাকা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাই যারা আল্লাহর তাওফীক পেয়ে সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি ও অন্যায় কাজ থেকে মুক্ত থাকেন, তারা প্রতিফল হিসাবে আল্লাহর তরফ থেকে শান্তিপ্রাপ্ত হবেন।
মানুষের নেক আমল দ্বারা নিছক পার্থিব স্বার্থ হাসিলের নিয়ত করা শির্ক - ২

ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ (রঃ) বলেনঃ দয়াময় আল্লাহ তাআলা তখন বলবেনঃ

«أنَا السَّلامُ ومَنِّىَ السَّلامُ وعَلَيْكُمْ حَقَّتْ رَحْمَتِيْ وَمَحَبَّتِيْ مَرْحَبًا بِعِبَادِيَ الَّذِيْنَ خَشُوْنِيْ بِغَيْبٍ وَأَطَاعُوْا أَمْرِيْ»

‘‘আমি শান্তিময় এবং শান্তি আমার তরফ থেকেই হয়। তোমাদের জন্য আমার রহমত ও মুহাববত আবশ্যক হয়ে গেছে। আমি আমার ঐসব বান্দাকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি, যারা না দেখেই আমাকে ভয় করেছে এবং আমার আদেশ মান্য করেছে।

ওয়াহাব বলেনঃ তখন জান্নাতী লোকেরা বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তোমার যথাযথ এবাদত করতে পারিনি এবং তোমার যথাযথ সম্মান করতে পারিনি। আমাদেরকে তোমার সামনে সিজদাহ করার অনুমতি দাও।

আল্লাহ তাআলা তখন বলবেনঃ এটি এবাদতের স্থান নয়, পরিশ্রমেরও জায়গা নয়। এটি হচ্ছে চিরস্থায়ী বসবাস এবং ভোগবিলাসের স্থান। আমি তোমাদের উপর হতে এবাদতের কষ্ট চিরতরে উঠিয়ে দিয়েছি। এখন তোমাদের মন যা চায়, তা চাও। তোমাদের প্রত্যেকের মনোবাসনা পূর্ণ করা হবে। তখন তারা আল্লাহর কাছে চাইবে। তাদের মধ্যে সর্বাধিক কম যে চাইবে, সে বলবেঃ হে আমার রবব! দুনিয়া পূজারীরা দুনিয়ার নেয়ামত ও সম্পদ হাসিলের জন্য পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল এবং তাদের একজন অন্যজনকে কোণঠাসা করেছিল। হে আমার রবব! তুমি যেদিন দুনিয়া সৃষ্টি করেছ সেদিন থেকে শুরু করে দুনিয়ার শেষ দিন পর্যন্ত তারা যে সমস্ত নেয়ামতের মধ্যে ছিল, তার প্রত্যেকটির অনুরূপ আমাকে দান কর।

আল্লাহ তখন বলবেনঃ আজ তোমার চাওয়া খুব কম হয়ে গেছে এবং তোমার প্রাপ্যের চেয়ে অনেক কমই প্রার্থনা করেছ। তোমার জন্য আমার তরফ থেকে এ সবই রয়েছে। তবে আমার মর্যাদা ও বড়ত্ব অনুপাতেই তোমাকে বড় পুরস্কার দান করব। কেননা আমার দানের মধ্যে কোন কৃপণতা ও কমতি নেই।

ওয়াহাব বলেনঃ অতঃপর আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদেরকে বলবেনঃ আমার বান্দাদের সামনে ঐ সব বিষয় পেশ কর, যার আকাঙ্খা তারা প্রকাশ করেনি এবং যা তাদের অন্তরে উদয় হয়নি।

ওয়াহাব বলেনঃ ফেরেশতারা ঐসব বিষয় তাদের জন্য পেশ করবেন। তারা জান্নাতীদের মনের সকল আশাই পূরা করবেন। ফেরেশতাগণ যেসব জিনিষ জান্নাতীদের সামনে পেশ করবেন, তার মধ্যে লাগাম পরিহিত অনেক ঘোড়াও থাকবে। সেগুলোর প্রতি চারটির উপর একটি করে ইয়াকুত পাথরের একটি খাঁট থাকবে, প্রত্যেক খাঁটের উপর একটি করে স্বর্ণের তাঁবু থাকবে, প্রত্যেক তাঁবুর মধেই জান্নাতের বিছানাসমূহ থেকে একটি বিছানা থাকবে, প্রত্যেক তাঁবুর মধ্যেই দু’টি করে জান্নাতের বড় বড় চুক্ষবিশিষ্ট হুর থেকে দু’জন হুর (অপরূপ সুন্দরী কুমারী স্ত্রী) থাকবে, তাদের প্রত্যেকের পরনে জান্নাতের পোষাকসমূহ থেকে দু’টি করে পোষাক থাকবে, জান্নাতে যত রং আছে তার সবগুলো রং-ই সেই কাপড়ে থাকবে এবং জান্নাতে যত খোশবু আছে তার সবগুলোই তাতে মাখানো থাকবে। তাদের চেহারার জ্যোতি তাঁবুর মোটা দেয়াল ভেদ করে বাইরে চলে আসবে। যে কেউ তাদের দু’জনকে দেখবে, সে মনে করবে তারা তাঁবুর বাইরেই অবস্থান করছে। তাদের শরীরের হাড্ডীর ভিতরের মগজ বাহির থেকে ঠিক সে রকমই দেখা যাবে, যেমন লাল রংএর ইয়াকুত পাথরের মধ্যে সাদা রংএর সুতা দেখা যায়। তারা দু’জন তাদের জান্নাতী স্বামীকে তার সাথীদের মধ্যে এত মর্যাদাবান মনে করবে যেমন সূর্যের মর্যাদা পাথরের উপর কিংবা এর চেয়ে আরো উত্তম। জান্নাতী পুরুষটি তার দু’জন হুরকেও অনুরূপ মনে করবে।

অতঃপর উক্ত জান্নাতী লোকটি তাঁর হুরদের কাছে প্রবেশ করবে। তারা দু’জনেই তাঁকে সাল্লাম করবে, চুম্বন করবে এবং গলাগলি করবে। হুরেরা তাঁকে বলবেঃ আমরা ধারণা করতাম না যে তোমার মত মানুষ আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করবেন।

অতঃপর আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদেরকে হুকুম করবেন, তারা যেন সকলকে একই কাতারে সারিবদ্ধ করে জান্নাতে নিয়ে যান। পরিশেষে তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ মঞ্জিলে পৌঁছে যাবে, যা তার জন্য প্রস্ত্তত করে রাখা হয়েছে।

أَشْعَثَ শব্দটি মাজরুর। জারের আলামত হচ্ছে ফাতাহ (যবর)। কেননা এটি غير منصرف। এতে রয়েছে منع الصرف এর দু’টি সবাব (কারণ)। একটি ওসফ্ আর অন্যটি ওযনে ফেল।

رأسُهُ শব্দটি فاعل হিসাবে মারফু হয়েছে। তার মাথার চুলগুলো এলোমেলো। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে ব্যস্ত থাকার কারণে সে তেল ব্যবহার করে মাথার চুল নরম করতে পারেনা এবং চিরুনী ব্যবহার করে তা ভাজও করতে পারেনা।

مغبرة قدماه এখানে مغبرة শব্দটি মাজরুর। তাতে কাসরাহ হচ্ছে জেরের আলামত। এটি عبد এর দ্বিতীয় সিফাত।

إِنْ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ তাকে সেনাবাহিনীর পাহারায় নিয়োজিত করা হলেঃ অর্থাৎ সে তার কাজে কোনো গাফিলতি করেনা। তাকে যদি সেনাবাহিনীকে শত্রুদের আক্রমণ থেকে হেফাযত করার জন্য এবং তাদেরকে পাহারা দেয়ার জন্য নিযুক্ত করা হয়, তাহলে সে নিষ্ঠার সাথে সেই দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে। তাতে কোনো ত্রুটি করেনা।

وَإِنْ كَانَ فِي السَّاقَةِ আর তাকে সেনাবাহিনীর পশ্চাতে রাখা হলেঃ অর্থাৎ সেনাবাহিনীর পিছনের সারিতে রাখা হলে সে সেখানেই দায়িত্ব পালন করতে থাকে। জিহাদের স্বার্থে এবং শত্রুদের হাত থেকে মুজাহিদদেরকে হেফাযত করার জন্যই সে কাজ করতে থাকে।

ইমাম খালখালী (রঃ) বলেনঃ তার স্কন্ধে যেই যিম্মাদ্বারী সোপর্দ করা হয়, সে তাই পূর্ণ করে এবং তাকে যেখানে দাঁড় করানো হয়, সে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। নিজের স্থান ও দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে এক কদমও সরেনা। হাদীছে শুধু পাহারা দেয়া এবং পিছনে থাকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হল এই কাজ দু’টি সর্বাধিক কঠিন।

إِنِ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ ‘‘সে অনুমতি প্রার্থনা করলে তাকে অনুমতি দেয়া হয়না’’ঃ অর্থাৎ আমীর-উমারাদের কাছে জিহাদের ময়দান থেকে ছুটি চাইলে তারা তাকে ছুটি দেন না। কেননা যুদ্ধের সেনাপতি ও আমীরদের কাছে তার কোনো মর্যাদা ও প্রভাব নেই। আর তা অর্জন করার জন্য তার অন্তরে নিয়তও নেই। সে কাজের বিনিময়ে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টিই কামনা করে।

وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّع ‘‘কোনো বিষয়ে সুপারিশ করলে তার সুপারিশও গ্রহণ করা হয়নাঃ অর্থাৎ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েও যদি এমন বিষয়ে সুপারিশ করার প্রয়োজন হয়, যা আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের নিকট পছন্দনীয়, তাতেও যুদ্ধের আমীর-উমারাগণের নিকট তার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হয়না।

উছমান বিন আফ্ফান রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি,

«حَرَسُ لَيْلَةٍ فِى سَبِيلِ اللَّهِ أَفْضَلُ مِنْ أَلْفِ لَيْلَةٍ يُقَامُ لَيْلُهَا وَيُصَامُ نَهَارُهَا»

‘‘আল্লাহর রাস্তায় একরাত পাহারা দেয়া এমন একহাজার রাত অপেক্ষা উত্তম, যার দিনগুলোতে রোযা রাখা হয় এবং রাতগুলোতে কিয়াম করা হয়’’।[4]

হাফেয ইবনে আসাকির আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকের জীবনীতে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ১৭৭ হিজরীতে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী শহর তারসুসে অবস্থান কালে মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীমকে সাত লাইন কবিতা আবৃত্তি করে শুনালেন। তিনি লাইনগুলো লিখে মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীমের মাধ্যমে কাবা শরীফে এবাদতরত ফুযাইল বিন ইয়াযের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। কবিতার লাইন সাতটি এইঃ

1) يا عابد الحرمين لو أبصرتنا

لعلمت أنك بالعبادة تلعب+

2) من كان يخضب خدّه بدموعه

فنحورنا بدمائنا تتخضّب

3) أو كان يُتْعِب خيله في باطل

فخيولنا يوم الصبيحة تتعب

4) ريح العبير لكم، ونحن عبيرنا

رهج السنابك والغبار الأطيب

5) ولقد أتانا من مقال نبينا

قول صحيح صادق لا يكذب

6) لا يستوي غبار خيل الله في

أنف امرئ ودخان نار تلهب

7) هذا كتاب الله ينطق بيننا

ليس الشهيد بميت لايكذب

১) ওহে মক্কা-মদীনায় এবাদতকারী! তুমি যদি আমাদেরকে দেখতে, তাহলে অবশ্যই জানতে যে, তুমি এবাদত নিয়ে খেলতামাশায় লিপ্ত।

২) কোনো ব্যক্তি যখন আল্লাহর ভয়ে কেঁদে চোখের পানিতে গাল ভিজিয়ে ফেলে আমরা তখন রক্তের মাধ্যমে স্বীয় বক্ষসমূহকে রঙ্গিন করি।

৩) কেউ যখন বাতিলের পথে দৌড়িয়ে স্বীয় ঘোড়াকে ক্লান্ত করে, তখন আমাদের ঘোড়াসমূহ কেবল যুদ্ধের সময়ই ক্লান্ত হয়।

৪) তোমাদের জন্য সুবাস আসে মিস্ক-আম্বরের সৌরভ হতে। আর আমাদের জন্য সুবাস আসে রক্তমাখা ঘোড়ার খুর ও পবিত্র ধূলিবালি হতে।

৫) আমাদের কাছে আমাদের নবীর বাণীসমূহ থেকে এমন কথা পৌঁছেছে, যা সত্য সঠিক, তাতে মিথ্যার লেশমাত্র নেই।

৬) আল্লাহর রাস্তায় ঘোড়ার খুরের ধূলি এবং জাহান্নামের আগুনের ধোঁয়া কখনই মুজাহিদের নাকে একত্রিত হবেনা।

৭) আল্লাহর কিতাব আমাদেরকে বলছে, আল্লাহর রাস্তায় কোনো শহীদই মৃত নয়। তাঁর কিতাবের কোনো কথাই মিথ্যা নয়।

মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম বলেনঃ আমি চিঠিসহ মাসজিদুল হারামে পৌঁছে ফুযাইল বিন ইয়াযের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। পত্রটি পড়েই ফুযাইল বিন ইয়ায কাঁদতে লাগলেন এবং তাঁর চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হল। অতঃপর তিনি বললেনঃ আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক সত্য বলেছেন এবং আমাকে নসীহত করেছেন। অতঃপর তিনি মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীমকে লক্ষ্য করে বললেনঃ তুমি কি হাদীছ লিখো? মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম বলেনঃ আমি বললামঃ হ্যাঁ। এরপর ফুযাইল বললেনঃ এই হাদীছটি লিখে নাও। এই বলে ফুযাইল আমাকে লিখালেনঃ আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«أن رجلاً قال: يا رسول الله، علمني عملاً أنال به ثواب المجاهدين في سبيل الله فقال: هل تستطيع أن تصلي فلا تفتر وتصوم فلا تفطر؟ فقال: يا رسول الله أنا أضعف من أن أستطيع ذلك ثم قال النبي صلى الله عليه وسلم: فوالذي نفسي بيده لو طوقت ذلك ما بلغت فضل المجاهدين في سبيل الله أو ما علمت أن فرس المجاهد ليستن في طوله فيكتب له بذلك حسنات»

‘‘এক লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেনঃ আমাকে এমন কতিপয় আমল শিখিয়ে দিন, যদ্বারা আমি আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদদের ছাওয়াব অর্জন করতে পারবো। তিনি তখন বললেনঃ তুমি কি এমন করতে পারবে যে, সর্বদা নামায পড়তেই থাকবে এবং কোন প্রকার ক্লান্তিবোধ করবেনা? প্রতিদিন রোযা রাখতেই থাকবে এবং কখনই রোযা ছাড়বেনা? লোকটি তখন বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি দুর্বল। আমি এর ক্ষমতা রাখিনা। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তুমি যদি এমন করতে পারলেও আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদদের ফযীলত পর্যন্ত পৌঁছতে পারবেনা। তোমার কি জানা আছে যে, মুজাহিদের ঘোড়া রশিতে বাঁধা অবস্থায় যতবার নড়াচড়া করে, ততবারের বিনিময়ে মুজাহিদের জন্য ছাওয়াব লিখা হয়’’।[5] এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) মানুষ আখেরাতের আমল দ্বারা দুনিয়া হাসিলের নিয়তও করে।

২) সূরা হুদের ১৫ ও ১৬ নং আয়াতের তাফসীর জানা গেল।

৩) কোনো মুসলিমকে দিনার-দিরহাম ও পোষাকের গোলাম হিসেবে আখ্যায়িত করা।

৪) উপরোক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যা হচ্ছে, সেই মুসলিমকে দেয়া হলেই খুশী হয়, দেয়া না হলেই অসন্তুষ্ট হয়।

৫) দুনিয়াদারকে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বলে বদ দুআ করেছেন, সে ধ্বংস হোক, সে হতভাগ্য হোক, সে উল্টে পড়ুক এবং অপমানিত-অপদস্ত হোক।

৬) দুনিয়াদারকে এ বলেও বদদোয়া করেছেন, তার গায়ে কাঁটা বিদ্ধ হোক এবং সে তা খুলতে না পারুক’’।

৭) হাদীছে বর্ণিত গুণাবলীতে গুণান্বিত মুজাহিদের প্রশংসা করা হয়েছে। সে সৌভাগ্যের অধিকারী বলে জানানো হয়েছে।

[4] - মুসনাদে আহমাদ ( ১/৬১), তাবরানী এবং আরো অনেক মুহাদ্দিছ এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। এর সনদে মুসআব বিন ছাবেত থাকার কারণে হাদীছটি যঈফ।

[5] - দেখুনঃ তারিখে দিমাস্ক, (৪/৩৮৫), কুররাতুল উয়ুন, পৃষ্ঠা নং- ৩১৩। আর মারফু হাদীছটি শব্দের সামান্য ব্যবধানসহ সহীহ বুখারীতে রয়েছে। অধ্যায়ঃ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের ফযীলত।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে