‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সাক্ষ্যদানের প্রতি আহবান - ১

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ

‘‘তুমি বলো! এটিই আমার পথ। পূর্ণ প্রজ্ঞার সাথে আমি আল্লাহর দিকে আহবান জানাচ্ছি। আমি এবং আমার অনুসারীরা। আল্লাহ্ পবিত্র। আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’’। (সূরা ইউসুফঃ ১০৮)

ব্যাখ্যাঃ ইমাম আবু জাফর ইবনে জারীর তাবারী (রঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেনঃ আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নবীকে বলছেনঃ হে মুহাম্মাদ! তুমি বলোঃ আমি যে দাওয়াত দিচ্ছি আর আমি যে পথে আছি, তা হচ্ছে আল্লাহর তাওহীদের দিকে আহবান, অন্যান্য মাবুদ ও মূর্তিগুলোকে বর্জন করে একমাত্র আল্লাহর জন্যই এবাদতকে একনিষ্ঠ করা, শুধু তাঁরই আনুগত্য করা এবং তাঁর অবাধ্যতা বর্জন করা। আমি আমার দাওয়াতে শুধু এক আল্লাহর এবাদতের দিকেই আহবান করছি, তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আমার দাওয়াত সম্পর্কে খুব ভালভাবেই অবগত আছি এবং তার সত্যতা সম্পর্কেও আমি নিশ্চিত বিশ্বাসী। আমি এই পথে একা নই। যারা আমার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে এবং আমাকে সত্যায়ন করেছে, তারাও জেনে-বুঝে একই দাওয়াত দিচ্ছে। আল্লাহ্ তাআলার রাজত্বে ও এবাদতে কোন শরীক হওয়া থেকে তিনি পবিত্র। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই। অর্থাৎ আমি মুশরিকদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, আমি তাদের অন্তর্ভূক্ত নই এবং তারাও আমার দলের নয়।

এই আয়াতটি ঐ কথার প্রমাণ বহন করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীগণ জ্ঞানী হবেন এবং তারা আল্লাহর দিকে মানুষকে আহবান করবেন। যারা এ সমস্ত গুণাবলীশূণ্য হবে, তারা প্রকৃত পক্ষে তাঁর অনুসারী হতে পারবেনা। তারা শুধু অনুসারী হওয়ার নিছক দাবীদার বলে গণ্য হবে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

قُلْ إِنَّمَا أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللّهَ وَلا أُشْرِكَ بِهِ إِلَيْهِ أَدْعُو وَإِلَيْهِ مَآبِ

‘‘বলোঃ আমাকে এরূপ আদেশই দেয়া হয়েছে যে, আমি যেন কেবল আল্লাহ্‌র এবাদত করি এবং তার সাথে অংশীদার সাব্যস্ত না করি। আমি যেন কেবল তার দিকেই দাওয়াত দেই এবং তার কাছেই আমার প্রত্যাবর্তন’’। (সূরা রা’দঃ ৩৬) আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রঃ) বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণ আল্লাহ্ তাআলার আদেশসমূহ পালন করার দিকে মানুষকে আহবান করতেন, তাওহীদের দিকে দাওয়াত দিতেন, এককভাবে আল্লাহর এবাদত করার আহবান জানাতেন এবং শির্ক থেকে নিষেধ করতেন। দাওয়াতের পথে তিনি এবং তাঁর সাহাবীগণ আমরণ জিহাদ করেছেন। সুতরাং তাওহীদের দাওয়াত দেয়া আবশ্যক। এ বিষয়ে অনেক আয়াত রয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلاً مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحاً وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ

‘‘যে আল্লাহ্‌র দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলেঃ আমি একজন মুসলিম তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার হতে পারে?’’ (সূরা ফুসসিলাতঃ ৩৩)

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে ইয়ামানে পাঠালেন, তখন তিনি বললেনঃ

«إِنَّكَ تَأْتِى قَوْمًا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ فليكن أول ما تدعو إليه شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وفي رواية إلى أن يوحدوا الله فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِى كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ فِى فُقَرَائِهِمْ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لِذَلِكَ فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أَمْوَالِهِمْ وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ

‘‘তুমি এমন এক কাওমের কাছে যাচ্ছ যারা আহলে কিতাব। সর্ব প্রথম যে জিনিষের দিকে তুমি তাদেরকে আহবান জানাবে তা হচ্ছে, লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ্-এর সাক্ষ্য দান করা’’। অন্য বর্ণনায় আছে, তুমি তাদেরকে এককভাবে আল্লাহর এবাদত করার আহবান জানাবে। এ বিষয়ে তারা যদি তোমার আনুগত্য করে তবে তাদেরকে জানিয়ে দিও যে, আল্লাহ তাআলা তাদের উপর দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরয করেছেন। এ ব্যাপারে তারা যদি তোমার কথা মেনে নেয় তবে তাদেরকে জানিয়ে দিও যে, আল্লাহ তাআলা তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন, যা বিত্তশালীদের কাছ থেকে নিয়ে গরীবদেরকে দেয়া হবে। তারা যদি এ ব্যাপারে তোমার আনুগত্য করে তবে তাদের উৎকৃষ্ট মালের ব্যাপারে তুমি খুব সাবধান থাকবে। আর মজলুমের বদ দুআকে পরিহার করে চলবে। কেননা মজলুমের ফরিয়াদ এবং আল্লাহ তাআলার মাঝখানে কোনো পর্দা নেই’’।[1]

ব্যাখ্যাঃ এই হাদীছে উল্লেখিত আহলে কিতাব বলতে সেই সময় ইয়ামানে বসবাসকারী ইহুদী ও খৃষ্টান উদ্দেশ্য। সেখানকার ইহুদী ও নাসারারা এই কালেমাটি তথা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ করত। কিন্তু তারা এর অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। আর তা হচ্ছে এককভাবে আল্লাহর এবাদত করা, তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক না করা এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের এবাদত বর্জন করা। সুতরাং তাদের লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ পাঠ করা তাদের কোন উপকার দিবেনা। কেননা তারা এই কালেমার অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল।[2] পরবর্তীকালের অধিকাংশ লোকদের অবস্থা এরূপই। তারা নিজেদের জবানের মাধ্যমে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ পাঠ করে। সেই সাথে তারা শির্কও করে। তারা মৃত, অনুপস্থিত, তাগুত এবং মাজারসমূহের এবাদত করছে। তারা এমন কাজ করছে যা কালেমা তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর বিরোধী। তাদের আকীদাহ, কথা ও কাজে তারা কালেমার বিপরীত বস্ত্ত তথা শির্কে লিপ্ত হচ্ছে এবং কালেমাটি যেই তাওহীদকে আবশ্যক করে, তারা তাকেই বর্জন করছে। তারা আশায়েরা সম্প্রদায়ের মুতাকাল্লিমীন তথা যুক্তিবিদদের অন্ধ অনুসরণ করে তারা ধারণা করত যে, কালেমার অর্থ হচ্ছে, সৃষ্টি করার উপর ক্ষমতাবান হওয়া। অথচ এটি হচ্ছে তাওহীদে রুবুবীয়ার অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ তাআলাই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি সৃষ্টি করার উপর ক্ষমতাবান- এ কথা মক্কাবাসী মুশরিকরাও বিশ্বাস করত। কিন্তু তাদের এই বিশ্বাস তাদেরকে ইসলামে প্রবেশ করায়নি। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

قُلْ لِمَنِ الأرْضُ وَمَنْ فِيهَا إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (84) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلا تَذَكَّرُونَ (85) قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ (86) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلا تَتَّقُونَ (87) قُلْ مَنْ بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ يُجِيرُ وَلا يُجَارُ عَلَيْهِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (88) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ فَأَنَّى تُسْحَرُونَ

‘‘তাদেরকে জিজ্ঞাসা করোঃ যদি তোমরা জানো তাহলে বলোঃ পৃথিবী এবং এর মধ্যে যারা বসবাস করছে তারা কার? তারা নিশ্চয়ই বলবেঃ সবই আল্লাহ্‌র। বলোঃ তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবেনা? তাদেরকে জিজ্ঞাসা করোঃ সাত আসমান ও মহান আরশের অধিপতি কে? তারা নিশ্চয়ই বলবেঃ আল্লাহ্। বলোঃ তবুও কি তোমরা ভয় করবেনা? তাদেরকে জিজ্ঞাসা করোঃ যদি তোমরা জেনে থাকো তাহলে বলোঃ কার হাতে সব বস্ত্তর কর্তৃত্ব? আর কে তিনি যিনি আশ্রয় দেন এবং তাঁর মুকাবেলায় কেউ আশ্রয় দিতে পারেনা? তারা নিশ্চয়ই বলবেঃ এ বিষয়টি আল্লাহ্‌র জন্যই নির্ধারিত। বলোঃ তাহলে কোথা থেকে তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে?’’ (সূরা মুমিনূনঃ ৮৪-৮৯) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمْ مَنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ

‘‘হে নবী! তুমি জিজ্ঞাসা করো, তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে কে রুযী দান করেন? কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ! তুমি বলো, তারপরও কি তোমরা ভয় করবে না? (সূরা ইউনুসঃ ৩১) কুরআন মজীদে এই রকম আয়াত আরও অনেক রয়েছে।[3]

উপরের আয়াতগুলোতে যেই তাওহীদের বর্ণনা রয়েছে, পূর্ব যামানার মুশরিক লোকেরাও এমন কি যেই জাহেলী সমাজে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রেরিত হয়েছিলেন সেই সমাজের লোকেরাও এ বিষয়টির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। এতে করে তারা মুসলমান হয়ে যায়নি। কেননা তারা কালেমায়ে তাইয়্যেবা যেই উলুহীয়াতের দাবী জানায়, তা অস্বীকার করেছিল। তারা যে বিষয়টি অস্বীকার করেছিল, তা হচ্ছে ইখলাসের সাথে এককভাবে আল্লাহর এবাদত করা, শির্ক প্রত্যাখ্যান করা এবং শির্ক ও মুশরিকদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করা। আল্লাহ্ তাআলা সূরা আল-ইমরানের ৬৪ নং আয়াতে বলেনঃ

قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْاْ إِلَى كَلَمَةٍ سَوَاء بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلاَّ نَعْبُدَ إِلاَّ اللّهَ وَلاَ نُشْرِكَ بِهِ شَيْئاً وَلاَ يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضاً أَرْبَاباً مِّن دُونِ اللّهِ فَإِن تَوَلَّوْاْ فَقُولُواْ اشْهَدُواْ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ

‘‘বলোঃ হে আহ্লে-কিতাবগণ! এসো এমন একটি কথার দিকে, যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান। তা এই যে, আমরা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো এবাদত করবোনা, তার সাথে অন্য কাউকে শরীক করবোনা এবং আমাদের কেউ একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে নিজের রব হিসাবে গ্রহণ করবেনা। তারপরও যদি তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে, তাহলে বলে দাও যে, সাক্ষী থাকো আমরা অবশ্যই মুসলিম’’।

এই আয়াতে যেই তাওহীদের কথা বলা হয়েছে, তা হল দ্বীনের মূলভিত্তি। আল্লাহ্ তাআলা সূরা ইউসুফের ৪০ নং আয়াতে বলেনঃ

إِنِ الْحُكْمُ إِلاَّ لِلّهِ أَمَرَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَـكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُونَ

‘‘আল্লাহ্ ছাড়া কারো হুকুম করার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও এবাদত করোনা। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না’’। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ الْقَيِّمِ مِن قَبْلِ أَن يَأْتِيَ يَوْمٌ لَّا مَرَدَّ لَهُ مِنَ اللَّهِ

‘‘যে দিবস আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে প্রত্যাহত হবার নয়, সেই দিবসের পূর্বে তুমি সঠিক দ্বীনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত কর’’। (সূরা রোমঃ ৪৩) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

ذَلِكُم بِأَنَّهُ إِذَا دُعِيَ اللَّهُ وَحْدَهُ كَفَرْتُمْ وَإِن يُشْرَكْ بِهِ تُؤْمِنُوا فَالْحُكْمُ لِلَّهِ الْعَلِيِّ الْكَبِيرِ

‘‘তোমাদের এ বিপদ এ কারণে যে, যখন এক আল্লাহ্কে ডাকা হত, তখন তোমরা কাফের হয়ে যেতে, আর যখন তাঁর সাথে শরীককে ডাকা হত, তখন তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করতে। আদেশ করার অধিকার একমাত্র আল্লাহরই। যিনি সর্বোচ্চ, মহান’’। (সূরা গাফেরঃ ১২) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّينَ أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ

‘‘অতএব, তুমি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ্‌র এবাদত করো। জেনে রাখো! নিষ্ঠাপূর্ণ এবাদত কেবল আল্লাহ্‌রই জন্যই’’। (সূরা যুমারঃ ৩)

নবী-রাসূলগণ যেই তাওহীদের দিকে মানুষকে আহবান করেছেন এবং যেই তাওহীদসহ আসমানী কিতাবসমূহ নাযিল করা হয়েছে, সেই প্রকার তাওহীদের বিবরণে কুরআন মজীদে অনুরূপ আয়াত অনেক রয়েছে। এই কিতাবে আমরা এ রকম কিছু আয়াত উল্লেখ করব, ইনশা-আল্লাহ্।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুকে ইয়ামানে পাঠানোর সময় বলেছিলেনঃ তুমি তাদেরকে এই কথার সাক্ষ্য দেয়ার আহবান জানাবে যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মাবুদ নেই অর্থাৎ তুমি সর্বপ্রথম কালেমায়ে তাওহীদ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর দিকে দাওয়াত দিবে। এতে প্রমাণিত হয় যে, বান্দার উপর সর্বপ্রথম ওয়াজিব হচ্ছে, তাওহীদুল ইবাদাহ্। অর্থাৎ এককভাবে আল্লাহর এবাদত করা। কেননা এটিই হচ্ছে দ্বীনের মূল এবং ইসলামের মূলভিত্তি।

দার্শনিক ও যুক্তিবিদরা বলে থাকে যে, বান্দার উপর সর্বপ্রথম ওয়াজিব হচ্ছে, যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে আল্লাহর পরিচয় লাভ করা। সঠিক কথা হচ্ছে, এটি সৃষ্টিগত বিষয়। আল্লাহ্ তাআলা তাঁর বান্দাদের অন্তরে তাঁর পরিচয় দিয়েই তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। এ জন্যই রাসূলগণ তাদের জাতিসমূহকে সর্বপ্রথম ‘তাওহীদুল ইবাদাহ্’-এর দিকে দিকে আহবান জানিয়েছেন। তারা তাদের জাতির লোকদেরকে বলতেনঃ

يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ

‘‘হে আমার জাতি! আল্লাহ্‌র এবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন সত্য উপাস্য নাই’’। (সূরা হুদঃ ৬১) সূরা হুদের ২৬ নং আয়াতে আরো আদেশ করা হয়েছে যে, أَن لاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ اللّهَ ‘‘তোমরা এক আললাহ্ ব্যতীত অন্য কারো এবাদত করবেনা’’। (সূরা ২৬) আল্লাহ্ তাআলা সূরা আম্বীয়ার ২৫ নং আয়াতে বলেনঃ

وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ

‘‘তোমার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই প্রদান করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই এবাদত করো’’। আল্লাহ তাআলা সূরা ইবরাহীমের ১০ নং আয়াতে বলেনঃ

قَالَتْ رُسُلُهُمْ أَفِي اللّهِ شَكٌّ فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ

‘‘তাদের রাসূলগণ বলেছিলেনঃ আল্লাহ্ সম্পর্কে কি সনেদহ আছে, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের স্রষ্টা? ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় দু’টি কথা বলা যেতে পারে। (১) আল্লাহর অস্তিত্বে কোন সন্দেহ আছে কি? কেননা মানুষের ফিৎরাত তথা সৃষ্টিগত স্বভাব আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয় এবং তাঁর অস্তিত্বের স্বীকারোক্তি প্রদানের বৈশিষ্ট দিয়েই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং সুস্থ বিবেক ও মস্তিস্ক অবশ্যই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে মেনে নেয়। (২) আল্লাহর এবাদতের ক্ষেত্রে এবং তিনিই একমাত্র এবাদতের হকদার- এ বিষয়ে কোন সন্দেহ আছে কি? তিনি সকল সৃষ্টির একমাত্র স্রষ্টা। সুতরাং তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এবাদতের হকদার নয়। তাঁর কোন শরীক নেই। অতীতের অধিকাংশ জাতি স্রষ্টারর অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু তারা তাঁর সাথে সুপারিশকারীদের এবাদতও করত। তাদের ধারণা এ সমস্ত সুপারিশকারীগণ তাদের উপকার করবে এবং তাদেরকে আল্লাহর নিকট পৌঁছিয়ে দিবে।

ব্যাখ্যাকারী বলেনঃ আমি বলছি যে, দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিও প্রথম সম্ভাবনাকে অন্তর্ভূক্ত করে। ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (রঃ) ইকরিমাহ, মুজাহিদ এবং আমের (রঃ) হতে এই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেনঃ

وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلا وَهُمْ مُشْرِكُونَ

‘‘অধিকাংশ মানুষ আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান আনয়ন করে, কিন্তু সাথে সাথে শির্কও করে’’- প্রত্যেকেই জানে যে, আল্লাহ্ তাআলাই তাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন। উক্ত আয়াতে ঈমান বলতে তাওহীদে রুবুবীয়ার প্রতি ঈমান আনয়ন উদ্দেশ্য। ইকরিমাহ (রঃ) হতে আরো বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর যে, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছে? উত্তরে তারা বলবেঃ আল্লাহ্! তাদের ঈমান এর মধ্যেই সীমিত। কিন্তু তারা আল্লাহর সাথে অন্যের এবাদতও করে। পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে যে, কুরআন ও হাদীছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর অনেক ভারী ভারী শর্ত জুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, ইল্ম, দৃঢ় বিশ্বাস, ইখলাস, সত্যবাদীতা, ভালোবাসা, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্এর মর্মার্থকে কবুল করে নেওয়া, অনুগত হওয়া এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য যে সমস্ত বস্ত্তর উপাসনা করা হয়, তা অস্বীকার করা। যে ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ পাঠ করল, তার মধ্যে যদি উক্ত শর্তগুলো পাওয়া যায়, তাহলেই তার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ উপকারে আসবে। যার মধ্যে উপরোক্ত শর্তগুলো পাওয়া যাবেনা, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ তার কোন উপকার করবেনা। কালেমা তায়্যেবার অর্থ সম্পর্কে অবগত এবং এর দাবী অনুযায়ী আমলকারীগণের অবস্থা বিভিন্ন রকম। যারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’& পাঠ করে, এটি তাদের কারো উপকার করবে। অপর পক্ষে এটি পাঠ করেও অনেকেই লাভবান হবেনা। এ বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্ট।[4]

তারা যদি আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদান করে তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দিও যে, আল্লাহ তাআলা তাদের উপর দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেনঃ এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মুশরিকের উপর নামায ফরয নয়। তবে সে যখন প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল প্রকার শির্ক বর্জন করে ইসলাম গ্রহণ করবে, তখন নামায ফরয হবে। কেননা এবাদত বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত হচ্ছে প্রথমে ইসলাম কবুল করা। ইমাম নববী (রঃ) বলেনঃ দুনিয়াতে ফরয এবাদতসমূহ পালন করার দাবী কেবল তখনই করা হবে, যখন সে ইসলাম গ্রহণ করবে। তবে এ কথা জরুরী নয় যে, মুশরিকরা শরীয়তের হুকুম-আহকাম পালনের ক্ষেত্রে সম্বোধিত নয়। আর নামায না পড়ার কারণে তাদেরকে আখেরাতে অতিরিক্ত আযাব দেয়া হবেনা। বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে কাফের-মুশরিকদেরকেও শরীয়তের সকল বিষয় পালন করার আদেশ দেয়া হয়েছে এবং নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা। অর্থাৎ তাদেরকেও নিষিদ্ধ বিষয়গুলো হতে বিরত থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। এটিই অধিকাংশ আলেমদের অভিমত।

তারা যদি তোমার কথা মেনে নেয় তবে তাদেরকে জানিয়ে দিও যে, আল্লাহ তাআলা তাদের উপর যাকাত ফরয করে দিয়েছেন, যা বিত্তশালীদের কাছ থেকে নিয়ে গরীবদেরকে দেয়া হবেঃ এতে প্রমাণ মিলে যে, যাকাত দ্বারা শুধু ঐ ব্যক্তিই উপকৃত হবে, যে তাওহীদে বিশ্বাস করে এবং সকল শর্ত, রুকন ও ওয়াজিবসহ নামায আদায় করে। কেননা কুরআনে যাকাতকে নামাযের সাথে মিলিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاء وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ

‘‘তাদেরকে এ ছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্‌র এবাদত করবে, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। এটাই সঠিক দ্বীন’’। (সূরা বায়্যিনাহঃ ৫)

যে ব্যক্তি এ কাজগুলো করবে, সে অন্যান্য কাজগুলোও বাস্তবায়ন করবে। কেননা তাওহীদ, নামায এবং যাকাত- এই তিনটি বুনিয়াদী আমলের দাবী হচ্ছে, যে ব্যক্তি এ তিনটি আমল করবে, সে অন্যান্য আমলগুলোও করবে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা তাওবার ৫ নং আয়াতে বলেনঃ

فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ الصَّلاَةَ وَآتَوُاْ الزَّكَاةَ فَخَلُّواْ سَبِيلَهُمْ

‘‘কিন্তুতারা যদি তাওবা করে, নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও’’। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ তাদের তাওবা হচ্ছে মূর্তিপূজা বর্জন করা, আল্লাহ্ তাআলার এবাদত করা, নামায কায়েম করা এবং যাকাত প্রদান করা। আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তোমাদেরকে নামায কায়েম করা এবং যাকাত প্রদান করার আদেশ দেয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি যাকাত প্রদান করবেনা, তার নামায কবুল হবেনা। ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেনঃ আল্লাহ্ তাআলা যাকাত বিহীন নামায কবুল করেন না। আর উপরোক্ত হাদীছে যাকাত ব্যয়ের খাতও বর্ণিত হয়েছে।

তারা যদি এ ব্যাপারে তোমার আনুগত্য করে তবে তাদের উৎকৃষ্ট মালের ব্যাপারে তুমি খুব সাবধানে থাকবেঃ এখানে সাবধান করা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তাআলা যাকাতের মধ্যে যে সমস্ত বিধান শরীয়তভূক্ত করেছেন, তার সীমা অতিক্রম করা ঠিক নয়। যাকাতের মধ্যম মানের মাল গ্রহণ করা হবে। এ রকম করা হলে মালদার সৎ নিয়তে এবং সন্তুষ্ট চিত্তে যাকাত প্রদান করবে। আর যেই কাজে শরীয়তের নির্ধারিত সীমা লংঘন করা হয়, তাতে কোন কল্যাণ নেই। এটি এমন একটি মৌলিক বিষয়, যার প্রতি সর্বদা খেয়াল রাখা দরকার।

আর মাযলুমের বদ দুআকে পরিহার করে চলবে। কেননা মাযলুমের বদ দুআ এবং আল্লাহ তাআলার মাঝখানে কোন পর্দা নেইঃ এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, যাকাত উসুলকারী যদি যাকাত সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে শরীয়তের নির্ধারিত সীমা লংঘন করে, তাহলে সে যালেম হিসাবে গণ্য হবে। আর মাযলুমের দুআ কবুল হয়ে থাকে। আল্লাহর মাঝে এবং মাযলুমের দুআর মাঝে এমন কোন পর্দা নেই, যা তার দুআ কবুলের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এতে সকল প্রকার যুলুম থেকে সাবধান করা হয়েছে। যাকাত উসুলকারীর উচিৎ, সে তার কাজে ইনসাফ করার চেষ্টা করবে। কারো কাছ থেকে নির্ধারিত হকের চেয়ে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করবেনা। এমনি অন্যায়ভাবে কারও প্রতি দয়া পরবশ হয়ে যাকাতের কোন অংশ ছেড়ে দিবেনা। সুতরাং তার উচিৎ উভয় পক্ষের প্রতি ন্যায় বিচার করা।

বুখারী ও মুসলিমে সাহাল বিন সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খায়বারের যুদ্ধের দিন বলেছেনঃ

«لأُعْطِيَنَّ الرَّايَةَ غَدًا لِرَجُلٍ يحب الله ورسوله ويحبه الله ورسوله يَفْتَحُ اللَّهُ عَلَى يَدِهِ فَبَاتَ النَّاسُ يَدُوكُونَ ليلتهم أَيُّهُمْ يُعْطَاهَا فَلَمَّا أَصْبَحَوا غَدَوْا عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كُلُّهُمْ يَرْجُو أَنْ يُعْطَاهَا فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَيْنَ عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ؟ فقِيْل هُوَ يَشْتَكِي عَيْنَيْهِ ، فَأَرسلوا إليه فَأتي به فَبَصَقَ فِي عَيْنَيْهِ وَدَعَا لَهُ فَبَرَأَ كأن لم يكن به وجع فَأَعْطَاهُ الرَّايَةَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم انفذ عَلَى رِسْلِكَ حتى تنزل بِسَاحَتِهِمْ ثم ادْعُهُمْ إِلَى الإِسْلامِ وَأَخْبِرْهُمْ بِمَا يَجِبُ عَلَيْهِمْ مِنَ حَقِّ الله تعالى فيه فَوَاللَّهِ لأَنْ يَهْدِيَ اللَّهُ بِك رَجُلا وَاحِدًا خَيْرٌ لَكَ مِنْ حُمُرِ النَّعَمِ

‘‘আগামীকাল এমন ব্যক্তিকে আমি ঝান্ডা প্রদান করব যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালবাসেন। তাঁর হাতে আল্লাহ তাআলা বিজয় দান করবেন। কাকে ঝান্ডা প্রদান করা হবে, এ নিয়ে ব্যাকুলতার মধ্যে লোকজন রাত্রি যাপন করল। সকাল হলে লোকজন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট গেল। তাদের প্রত্যেকেই আশা করছিল যে, ঝান্ডা তাকেই দেয়া হবে। তিনি বললেন, আলী বিন আবি তালিব কোথায়? বলা হলো, তিনি চক্ষুর পীড়ায় আক্রান্ত। তাঁকে ডেকে পাঠানো হল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উভয় চোখে থুথু লাগিয়ে দিলেন এবং তাঁর জন্য দুআ করলেন। এতে তিনি এমন সুস্থ হয়ে গেলেন যে, মনে হচ্ছিল, তাঁর চোখে কোনো অসুখই ছিলনা। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাতে ঝান্ডা প্রদান করলেন এবং বললেনঃ তুমি ধীরস্থিরতার সাথে অগ্রসর হও। তুমি যখন তাদের আঙ্গিনায় অবতরণ করবে, তখন তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করবে। অতঃপর তাদের উপর আল্লাহ তাআলার যেই হক রয়েছে, সে সম্পর্কে জানিয়ে দাও। আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তাআলা যদি তোমার মাধ্যমে একজন লোককেও হেদায়াত করেন তাহলে তোমার জন্য এটি হবে লাল উট অপেক্ষা উত্তম।[5]

ব্যাখ্যাঃ হাদীছের বর্ণনাকারী হচ্ছেন আবুল আববাস সাহল বিন সা’দ বিন মালেক আল-আনসারী। তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী। তাঁর পিতাও ছিলেন সাহাবী। তিনি ৮৮ হিজরীতে শতাধিক বছর বয়সে উপনীত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন।

এ হাদীছে খায়বার বিজয়ের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। এখানে নবুওয়াতে মুহাম্মাদীরও আলামত রয়েছে। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে খবর দিয়েছিলেন, তার হুবহু বাস্তবায়ন হয়েছে।

[1] - বুখারী, অধ্যায়ঃ তাওহীদ ও রেসালাতের সাক্ষ্যদানের প্রতি আহবান।

[2] - যে মুসলিম লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করবে এবং এর অর্থ না জানার কারণে এর বিপরীত কোন কাজে লিপ্ত হবে, তার অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণ করে তাকে ক্ষমা করা হবে কিনা- এ ব্যাপারে আলেমদের মতভেদ রয়েছে। কিতাবুত তাওহীদের লেখক আল্লামা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব এবং এর ব্যাখ্যাকার আল্লামা আব্দুর রাহমান বিন হাসান (রঃ)এর কোন কোন বক্তব্য থেকে ধারণা জন্মে যে, কালেমায়ে তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে কেউ তাওহীদ বিরোধী কাজে লিপ্ত হলে তার অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবেনা। কিন্তু এ ব্যাপারে অন্যান্য আলেমদের কথা হচ্ছে, অসংখ্য দলীল প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করল এবং অজ্ঞতার কারণে কিংবা ভুলবশতঃ কালেমার অর্থ বিরোধী কোন কাজে লিপ্ত হলে তার সেই অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবে এবং তাকে ক্ষমা করা হবে ইনশা-আল্লাহ।

এ বিষয়ে শাইখ বিন বাযসহ অন্যান্য আলেমগণ এভাবে সমন্বয় করেছেন যে, যারা তাওহীদের জ্ঞান অর্জনের পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং যেই সমাজে তাওহীদ ও শির্ক সম্পর্কে মানুষের ধারণা নেই, ঐ সমাজের মানুষ অজ্ঞতার কারণে তাওহীদ বিরোধী কোন কাজে লিপ্ত হলে ক্ষমার পাওয়ার হকদার হবে। কিন্তু যেই সমাজে তাওহীদের শিক্ষা রয়েছে, দ্বীনের দাঈগণ যেখানে তাওহীদ প্রচার করছেন এবং যেখানে বসবাস করে তাওহীদের শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব, সেখানকার অধিবাসীদের অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবেনা। এ ক্ষেত্রে যদি তাওহীদের দাওয়াত এড়িয়ে চলে তাহলে তাদের রক্ষা নেই। সে জন্যই তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতা জাহান্নামী হলেন। (সহীহ মুসলিম) আব্দুল্লাহ বিন জুদআন হাজার উটসহ বহু কিছু দান করে ও সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার রোধের লক্ষ্যে হিলফুল ফুযুল সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেও ক্ষমা পায়নি। অতএব সেই সব লোকজনও ক্ষমা পাবেনা, যারা তাওহীদের দাওয়াত প্রচারিত প্রসারিত সমাজে বসবাস করে অথচ তার সহজ ও মৌলিক জ্ঞানটুকু অর্জনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মূলতঃ স্রষ্টার পরিচয়সহ তাঁর মৌলিক অধিকার যে কোন পরিবেশে থেকেও জানা জরুরী। ফলে আল্লাহর ফয়সালা এ বিষয়ে কঠিন। তদোপরি তাঁর অপার করুণার দাবীতে জটিল ও সুক্ষ্ম বিষয়গুলোর হিসাব শিথিল করবেন। তবে শর্ত হলো চেষ্টার কোন ত্রুটি করা চলবেনা। এহেন অপার করুণার ফলশ্রুতিতেই শেষ বিচারের দিন যাদের নিকট দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছেনি, তাদের জন্য বিশেষ একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছেন। অন্ততঃ সেই পরীক্ষায় যারা টিকে যাবে, তাদের ক্ষমা করে দিবেন। লক্ষণীয় যে এই ব্যাখ্যা ছাড়া পৃথিবীর বহু বেদ্বীনকে আমরা কাফের বলতে পারবোনা। এমনি বহু সংখ্যক শির্ক ও কুফুরীতে লিপ্ত মুসলিমকে দোষারোপও করতে পারবোনা।

উপরোক্ত ব্যাখ্যা সামনে না থাকা ও শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (রঃ)এর শুধু এক প্রসঙ্গের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে সিদ্বান্ত নেয়ার ফলে অনেক সমাজে তাঁর সম্পর্কে ভুল ধারণা বিরাজ করছে। এহেন ধারণার ফলে বলা হয় যে, তিনি নাকি কোন প্রকার অজ্ঞতাকে ক্ষমাযোগ্য বলে বিবেচনা করেন নি। অথচ তিনি দুঃখ করে উল্লেখ করেছেনঃ আমি তো শুধু ঐ ব্যক্তিকেই কাফের বলি, যে আল্লাহর তাওহীদে ঐ পরিস্থিতিতে শির্ক করে, যখন তার সামনে আমরা শির্কের বাতুলতা প্রমাণ করি। তিনি আরো বলেনঃ আমি নাকি প্রমাণ করা ব্যতীত মূর্খ লোককে কাফের বলে থাকি। এটি আমার উপর আমার শত্রু পক্ষের মিথ্যা অপবাদ ছাড়া অন্য কিছু নয়। (দেখুনঃ আদ্ দুরারুস সানীয়া, ফতোয়া মাসায়েল ইত্যাদি)। আরেকটি তত্বকথা ইতিহাসের পাতায় বহুকাল যাবৎ নিরবে বিষ ছড়াচ্ছিল। তা হলো উত্তর আফ্রিকার আব্দুল ওয়াহহাব বিন আব্দুর রাহমান বিন রুস্ত্তম নামক খারেজী পর্যায়ের পথভ্রান্ত ব্যক্তির প্রতি সম্বন্ধিত ওয়াহাবী মতবাদের প্রলেপ পরিয়ে শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের তাওহীদি আন্দোলনকে ঠেকানোর হীন ষড়যন্ত্র চরিতার্থ করার প্রয়াস চালায় একটি কুচক্রি মহল। তবে আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে অনেক বিলম্ব হলেও সৌদি আরবের ফতোয়া বোর্ড দারুল ইফতার প্রধান মুফতীর সম্মানিত উপদেষ্ঠা ডঃ মুহাম্মাদ বিন সা’দ আল শুআই-ইর এ বিষয়ে একটি বই লিখেন, যার নাম, تصحيح خطأ تاريخي حول الوهابية (ওয়াহাবী আন্দোলন সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক ভুল সংশোধন)। তাতে তিনি অতি প্রজ্ঞার সাথে এহেন বিভ্রান্তির অপনোদন করেন, যার প্রধান ভিত্তি এটিই ছিল যে, মরোক্কসহ উত্তর আফ্রিকার বহু মুফতী ১৯০ মতান্তরে ১৯৭ হিজরীতে মৃত্যু বরণকারী তথাকথিত ওয়াহাবী মতবাদ প্রবক্তার নামে যে ফতোয়া জারি করেছিলেন পরবর্তী অনেক আলেম সেগুলোকে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের নামে চালিয়ে দেন। অথচ তাঁর জন্ম হয় ১১১৫ হিজরী সালে। এ যেন রাম জন্মের আগেই রামায়ন লিখার কাহিনী!

[3] - মুশরিকরা যে তাওহীদে রুবুবীয়ার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করত, তার আরও অনেক দলীল-প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাদের উক্তি নকল করে কুরআনে বলেনঃ

وَقَالُوارَبَّنَا عَجِّلْ لَنَا قِطَّنَا قَبْلَ يَوْمِ الْحِسَابِ

‘‘তারা বলে, হে আমাদের পরওয়ারদেগার, আমাদের প্রাপ্য অংশ হিসাব দিবসের আগেই দিয়ে দাও’’। (সূরা সোয়াদঃ ১৬) মক্কার মুশরিকরা তাদের দুআয় বলতঃ

اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ هَذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِنَ السَّمَاءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ

‘‘হে আল্লাহ্! ইহা যদি তোমার পক্ষ থেকে (আগত) সত্য দ্বীন হয়ে থাকে, তবে আমাদের উপর আকাশ থেকে প্রস্তর বর্ষণ করো কিংবা আমাদের উপর বেদনাদায়ক আযাব নাযিল কর’’। (সূরা আনফালঃ ৩২) তারা আরো বলতঃ

قَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِلَّذِينَ آَمَنُوا أَنُطْعِمُ مَنْ لَوْ يَشَاءُ اللَّهُ أَطْعَمَهُ

‘‘তখন কাফেররা মুমিনগণকে বলে, ইচ্ছা করলেই আল্লাহ্ যাকে খাওয়াতে পারতেন, আমরা তাকে কেন খাওয়াব?’’। (সূরা ইয়াসীনঃ ৪৭) কোন কোন কাফের বলতঃ

مَا أَنْتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُنَا وَمَا أَنْزَلَ الرَّحْمَنُ مِنْ شَيْءٍ

‘‘তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ, রহমান আল্লাহ্ কিছুই নাযিল করেন নি’’। (সূরা ইয়াসীনঃ ১৫) মক্কার মুশরিকরা তাদের তালবীয়ায় বলতঃ

«لبَّيْكَ اللهم لبيك لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ إِلاَّ شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ

‘‘হে আল্লাহ! আমি আপনার দরবারে হাজির হয়েছি। আপনার ডাকে বারবার সাড়া দিয়েছি। আপনার কোন শরীক নেই। তবে আপনার একজন শরীক রয়েছে। আর আপনি ঐ শরীকেরও মালিক। সে কোন কিছুরই মালিক নয়। এমনি আরো অনেক কথা তারা বলত, যাতে বুঝা যায় যে তারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করত।


[4] - রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ: لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ شَعِيرَةٍ مِنْ خَيْرٍ، وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ: لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ بُرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ، وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ: لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ ذَرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ»

যে ব্যক্তি ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ পাঠ করবে অথচ তার অন্তরে একটি যব পরিমাণ ঈমান রয়েছে সেও জাহান্নাম থেকে বের হবে। যে ব্যক্তি ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ পাঠ করবে এবং তার অন্তরে একটি গম পরিমাণ ঈমান রয়েছে সেও জাহান্নাম থেকে বের হবে। অনুরূপ ঐ ব্যক্তিও জাহান্নাম থেকে বের হবে যে ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ পাঠ করবে অথচ তার অন্তরে একটি সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান রয়েছে।


[5] - বুখারী, অধ্যায়ঃ যার হাতে কেউ মুসলমান হবে তার ফজীলত।
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সাক্ষ্যদানের প্রতি আহবান - ২

যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালবাসেনঃ[6]

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) হাদীছের এই অংশের ব্যাখ্যায় বলেনঃ এই গুণটি শুধু আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর সাথে খাস নয়। মুসলিমদের ইমামদের সাথেও খাস নয়। কেননা যে মুত্তাকী মুমিন আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলকে ভালবাসে, আল্লাহ্ তাআলা ও তাঁর রাসূলও তাকে ভালবাসেন। এই হাদীছটি ঐসব নাওয়াসেব তথা আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি ঘৃণা পোষণকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী দলীল, যারা তাঁকে ভালবাসেনা, কিংবা তাঁকে কাফের মনে করে অথবা তাঁকে ফাসেক বলে। খারেজী সম্প্রদায়ের লোকেরা আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে ফাসেক মনে করে। যে সমস্ত রাফেযী সাহাবীদের ফযীলতে বর্ণিত হাদীছগুলোকে তাদের মুরতাদ হয়ে যাওয়ার পূর্বের বলে মনে করে, তাদের কথা অনুপাতে এভাবে দলীল গ্রহণ করা সঠিক নয়। খারেজীরাও আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে একই কথা বলে। অর্থাৎ তারা আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে কাফের মনে করে। এ রকম কথা বাতিল। কেননা যার সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা অবগত আছেন যে, সে কাফের অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে, আল্লাহ্ তাআলা এবং আল্লাহর রাসূল কখনই তার এ রকম প্রশংসা করতে পারেন না।

এ হাদীছ থেকে জানা গেল যে, মুহাববাত তথা ভালবাসা আল্লাহ্ তাআলার অন্যতম একটি গুণ। জাহ্মীয়া এবং তাদের অনুসারীরা এটিকে বিশ্বাস করেনা। এতে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর ফযীলত প্রমাণিত হয়। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাসভাবে তাঁকেই যুদ্ধের ঝান্ডা প্রদান করেছেন এবং খায়বারবাসীকে ইসলামের দাওয়াত দিতে আদেশ করেছেন। দাওয়াত কবুল না করলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলেছেন। যুদ্ধাবস্থায় আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাতে অনেকগুলো কারামত প্রকাশিত হয়েছে। সীরাতের কিতাবসমূহে এ কারামতগুলো উল্লেখিত হয়েছে।

এই হাদীছ থেকে ইসলামের প্রতি মানুষকে আহবান করার গুরুত্ব বুঝা যাচ্ছে। যেই ইসলামের মূলভিত্তি হচ্ছে এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই। আল্লাহ্ তাআলা সূরা আল-ইমরানের ১০৪ নং আয়াতে বলেনঃ

وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ

‘‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দিবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে’’।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আলী বিন আবি তালিব কোথায়? বলা হল, তিনি চক্ষুর পীড়ায় ভোগছেনঃ লেখক বলেনঃ এতে তাকদীরের প্রতি ঈমান আনয়নের বিষয়টি জানা গেল। কেননা যারা ঝান্ডা পাওয়ার চেষ্টা করল, তারা তা পেল না। আর যিনি কোনো চেষ্টাই করেন নি, তিনি পেয়ে গেলেন।

তাঁকে ডেকে পাঠালেনঃ অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট একজন লোক পাঠালেন। যাতে তিনি তাঁকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট ডেকে নিয়ে আসেন। মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় রয়েছে, সা’দ বিন আবু ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ডেকে এনেছিলেন। ইয়াস বিন সালামাহ তার পিতা হতে বর্ণনা করেন যে, সালামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে নিয়ে এসেছিলেন। আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন আসলেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উভয় চোখে থুথু লাগিয়ে দিলেন এবং তাঁর জন্য সুস্থতার দুআ করলেন। এতে তিনি তাৎক্ষণিক পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুআর বরকতেই এমনটি হয়েছিল। অন্য হাদীছে এসেছে, তিনি দুআ করলেন। তাঁর দুআ কবুল করা হল। এতেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণিত হয়। এসব কিছু কেবল আল্লাহর পক্ষ হতেই এবং একমাত্র আল্লাহর কুদরতেই হয়েছিল। তিনিই কল্যাণ-অকল্যাণ এবং দেয়া-না দেয়ার একমাত্র মালিক। তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই এবং তিনিই একমাত্র রব।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলীকে ধীরস্থিরতার সাথে খায়বারবাসীর দিকে যেতে বললেন এবং শত্রুদের দূর্গের নিকটবর্তী আঙ্গিনায় অবতরণ করার আদেশ দিয়েছিলেন।

তখন তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করবেঃ এই অধ্যায়ের উদ্দেশ্য এটিই। মুসলিমদের উচিৎ শুধু মানুষকে ইসলামের দিকে হেদায়াত করার উদ্দেশ্যেই জিহাদ পরিচালনা করা। মুসলিম শাসকদের এটিই একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ যেই দ্বীন ইসলামকে আল্লাহ্ তাআলা পছন্দ করেছেন এবং যা দিয়ে তিনি রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন, তা হচ্ছে শুধু আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পন করা এবং ইসলামের মূলনীতিগুলোর প্রতি অন্তর দিয়ে বিশ্বাস পোষণ করা। আল্লাহর সামনে মস্তক অবনত করার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য মাবুদসমূহ বর্জন করে একমাত্র আল্লাহর এবাদত করা। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর এবাদত করবে এবং সেই সাথে অন্যান্য ছোট মাবুদগুলোরও এবাদত করবে, সে মুসলিম হিসাবে গণ্য হবেনা। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর এবাদত করতে অহংকার করবে, সেও মুসলিম নয়। ঈমানের হাকীকত হচ্ছে, অন্তর দিয়ে সত্যায়ন করা এবং জবান দিয়ে তা স্বীকার ও উচ্চারণ করা।

অতঃপর তাদের উপর আল্লাহর যে হক রয়েছে, সে সম্পর্কে জানিয়ে দাওঃ অর্থাৎ কালেমায়ে তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর যে সমস্ত হক আল্লাহ্ তাআলা শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত করেছেন এবং যে সমস্ত বিষয়ের হুকুম করেছেন, তা তাদেরকে জানিয়ে দাও। এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বান্দার আমলসমূহও ঈমানের অন্তর্ভূক্ত। তবে আশায়েরা ও মুরজিয়া সম্প্রদায় এর বিরোধীতা করেছে। তাদের কথা হল ঈমান শুধু অন্তরের কথার নাম। তাদের ধারণা হল, শুধু তাসদীক বা সত্যায়নকেই ঈমান বলা হয়। এ ক্ষেত্রে তারা কুরআন ও সুন্নাহয় বর্ণিত দলীলসমূহের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেনি। কেননা দ্বীন হচ্ছে ঐ সমস্ত কর্মের নাম, যা করার জন্য আল্লাহ্ তাআলা আদেশ দিয়েছেন এবং ঐ সমস্ত কাজ না করার নাম, যা থেকে আল্লাহ্ তাআলা নিষেধ করেছেন।

এই হাদীছে ঐ সমস্ত নামধারী মুসলিমদের প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা কারামতে আওলীয়ার দোহাই দিয়ে শির্ক-বিদআত জায়েয হওয়ার উপর দলীল গ্রহণ করে থাকে। কেননা কারামত অলীদের অতিরিক্ত ফযীলতের প্রমাণ বহন করে। আমীরুল মুমিনীন আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর এমন অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, যা অন্যদের জন্য হয়নি। সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করা, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাসহ তাঁর আরও অনেক ফজীলত রয়েছে, যা অন্যদের ছিল না। যারা তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছিল এবং তাঁকেই ইলাহ্ মনে করেছিল গর্ত খনন করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে তিনি তাদেরকে পুড়ে ছাই করেছিলেন। আহলে বাইত এবং অন্যদের ব্যাপারে যারা মুশরিকদের ন্যায় আকীদাহ পোষণ করেছিল, তিনি তাদের সাথে একই আচরণ করেছিলেন। এর মাধ্যমে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু অন্যান্য সাহাবীদের তুলনায় শির্ক ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি তিনি তাদেরকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়েছিলেন।

এমনি উমার ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহুর অসংখ্য কারামত থাকা সত্ত্বেও শির্কের পথ বন্ধ করায় অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। সাহাবীদের মধ্যে যারা কারামত প্রাপ্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে এ দু’জন তথা আলী ও উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন সর্বোত্তম। তাদের হাতে প্রকাশিত কারামত তাদেরকে তাওহীদের উপর অতিরিক্ত শক্তি প্রদান করেছে এবং মুশরিকদের প্রতিবাদে কঠোর থেকে কঠোরতর করেছে। আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করার মাধ্যমে এবং হুরমুযানের বাইতুল মালে সাহাবায়ে কেরামগণ যখন দানিয়ালের কবরের সন্ধান পেলেন, তখন তা গোপন করে দেয়ার মধ্যে শির্কের বিরুদ্ধে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর কঠোর ভূমিকার প্রমাণ পাওয়া যায়। নবী-রাসূলদের হাতে মু’জিযা প্রকাশ তাওহীদের প্রতি দাওয়াতের ক্ষেত্রে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করেছিল এবং মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদে তাদেরকে কঠোর করেছিল। যাদের উপর শয়তান জয়লাভ করেছে, তাদের কারো কাছ থেকে কিছু কিছু শয়তানী কার্যকলাপ প্রকাশিত হয়ে থাকে। ফলে তারা তাদের প্রভুর স্মরণকে ভুলে যায়। যে সমস্ত জাহেল লোক শির্কে লিপ্ত তারা এই শয়তানী ভেলকিবাজিকে কারামত মনে করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে সেগুলো শয়তানের চক্রান্ত ও চালবাজি ছাড়া অন্য কিছু নয়। এর মাধ্যমে অনেক সময় হক ও বাতিল এবং হেদায়াত ও গোমরাহীর মাঝে পার্থক্য করা যায়না। আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নবীকে লক্ষ্য করে বলেনঃ

فَاسْتَمْسِكْ بِالَّذِي أُوحِيَ إِلَيْكَ إِنَّكَ عَلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ

‘‘অতএব অহীর মাধ্যমে তোমার কাছে যে কিতাব পাঠানো হয়েছে, শক্তভাবে তুমি তা আঁকড়ে থাকো। নিশ্চয়ই তুমি সঠিক পথেই রয়েছো’’। (সূরা যুখরুফঃ ৪৩) সুতরাং প্রত্যেকের উচিৎ কুরআন মজীদ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা এবং তা থেকেই হেদায়াত অনুসন্ধান করা। কেননা কুরআনের পথই হচ্ছে সরল ও সঠিক পথ। শয়তানের চাকচিক্যময় পথে দৃষ্টি না দেয়া। শয়তানের সাজানো পথে অগ্রসর হয়ে এই উম্মতের এবং পূর্ববর্তী উম্মতের অনেকেই ধোঁকায় পড়েছে।

তোমার মাধ্যমে যদি আল্লাহ একজন লোককেও হেদায়াত করেন, তাহলে তোমার জন্য এটি হবে লাল উট পাওয়া থেকেও উত্তমঃ তৎকালে লাল উট ছিল আরবদের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। এখানে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে এবং আল্লাহ্ তাআলার কাছে হেদায়াত প্রার্থনা করা হয়েছে। যাতে করে ইসলামের দাঈগণ হেদায়াত প্রার্থীকে সঠিক পথ প্রদর্শন করে এই বিরাট ফযীলতটি অর্জন করতে পারেন। সুতরাং এ বিষয়ে মোটেই অলসতা করা ঠিক নয়। আল্লাহই তাওফীক দাতা। এ অধ্যায় থেকে নিম্বোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণকারীর নীতি ও পথ হচ্ছে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহবান করা।

২) ইখলাসের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা। কেননা অনেক লোক হকের পথে মানুষকে আহবান জানালেও মূলতঃ তারা নিজেদের নফস বা স্বার্থের দিকেই আহবান জানায়।[7]

৩) তাওহীদের দাওয়াতের জন্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থাকা অপরিহার্য্য।

৪) উত্তম তাওহীদের প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার প্রতি গাল-মন্দ আরোপ করা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র থাকা।

৫) আল্লাহ তাআলার প্রতি গাল-মন্দ আরোপ করা নিকৃষ্ট শি©র্কর অন্তর্ভূক্ত।

৬) তাওহীদই হচ্ছে সর্বপ্রথম ফরয।

৭) সর্বাগ্রে এমনকি নামাযেরও পূর্বে তাওহীদের প্রতি আহবান করতে হবে।

৮) আল্লাহর একত্বের ঘোষণা করার অর্থ হচ্ছে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর সাক্ষ্য প্রদান করা। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ নেই, এ ঘোষণা দেয়া।

৯) একজন মানুষ আহলে কিতাবের অন্তর্ভূক্ত হওয়া সত্ত্বেও সে তাওহীদ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে পারে কিংবা তাওহীদের জ্ঞান থাকলেও সে অনুযায়ী আমল নাও করতে পারে।

১০) শিক্ষা দানের প্রতি পর্যায়ক্রমে গুরুত্বারোপ করা।

১১) সর্বপ্রথম অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দিয়ে দাওয়াতী কাজ শুরু করা জরুরী।

১২) যাকাত প্রদানের খাত সম্পর্কে জানা গেল।[8]

১৩) শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রের সংশয় ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উন্মোচন করা বা নিরসন করা জরুরী।

১৪) যাকাত আদায়ের সময় বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল নেয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা।

১৫) মজলুমের বদ দুআ থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক।

১৬) মজলুমের বদ দুআ এবং আল্লাহ তাআলার মধ্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকার সংবাদ।

১৭) সাইয়্যিদুল মুরসালীন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং বড় বড় সৎ লোকদের উপর যেসব দুঃখ- কষ্ট এবং কঠিন বিপদাপদ আপতিত হয়েছে, তা তাওহীদেরই প্রমাণ পেশ করে।

১৮) আমি আগামীকাল এমন একজনের হাতে পতাকা প্রদান করবো যার হাতে আল্লাহ বিজয় দান করবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ উক্তি নবুওয়াতের অন্যতম একটি নিদর্শন।

১৯) আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর চোখে থুথু প্রদানের মাধ্যমে চোখ ভালো হয়ে যাওয়াও নবুওয়াতের একটি নিদর্শন।

২০) আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর মর্যাদা সম্পর্কে জানা গেল।

২১) আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাতে পতাকা তুলে দেয়ার পূর্বে রাতে পতাকা পাওয়ার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের উদ্বেগ ও ব্যাকুলতার মধ্যে রাত্রি যাপন এবং বিজয়ের সুসংবাদে আশ্বস্ত থাকার মধ্যে তাদের মর্যাদা নিহিত আছে।

২২) বিনা প্রচেষ্টায় ইসলামের পতাকা তথা নেতৃত্ব লাভ করা আর চেষ্টা করেও তা লাভে ব্যর্থ হওয়া, উভয় অবস্থাতেই তাকদীরের প্রতি ঈমান রাখা জরুরী।

২৩) ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাও, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ উক্তির মধ্যে ভদ্রতা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দানের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে।

২৪) যুদ্ধ শুরু করার পূর্বে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা জরুরী।

২৫) ইতিপূর্বে যাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়েছে এবং যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছে তাদেরকেও যুদ্ধের আগে ইসলামের দাওয়াত দিতে হবে।

২৬) أخبرهم بمايجب عليهم রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই বাণী হিকমত ও কৌশলের সাথে দাওয়াত পেশ করার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে।

২৭) দ্বীন ইসলামে আল্লাহর হক সম্পর্কে জ্ঞানার্জন।

২৮) আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাতে একজন মানুষ হেদায়াত প্রাপ্ত হওয়ার ছাওয়াব।

২৯) ফতোয়ার ব্যাপারে মুফতীর কসম করা জায়েয।

[6] - আল্লাহ প্রত্যেক মুত্তাকী মুমিনকে ভালবাসেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও প্রত্যেক মুত্তাকী মুমিনকে ভালবাসেন। এই হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল আলী (রাঃ)কে বেশী ভালবাসেন। অথবা এই হাদীছ দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল সকল সাহাবীকেই ভালবাসেন। নির্দিষ্টভাবে আলীকেও ভালবাসেন। তাই যদি না হতো, তাহলে উক্ত কথা বলার পর সারা রাত জাগ্রত থেকে তারা এই আলোচনা করতোনা যে, উহা কাকে দেয়া হয়।

এই হাদীছ থেকে এটি প্রমাণিত হয়না যে, আলী (রাঃ) ছিলেন সর্বোত্তম সাহাবী। বরং সাহাবীদের প্রত্যেকেরই রয়েছে বিশেষ বিশেষ ফযীলত।

[7] - অনেক হাদীছেই রিয়া তথা লোক দেখানো আমল হতে সাবধান করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا

‘‘কাজেই যে তার রবের সাক্ষাতের প্রত্যাশী, সে যেন সৎ আমল করে এবং তার রবের এবাদতে যেন কাউকে শরীক না করে’’। (সূরা কাহাফঃ ১১০) যেই তিন ব্যক্তির দ্বারা কিয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুন জ্বালানো হবে, তাদের প্রথম হবে ঐ ব্যক্তি, যে মানুষকে শুনানোর জন্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছিল, দ্বিতীয় হবে ঐ ব্যক্তি, যে মানুষকে শুনানোর জন্য কুরআন পড়েছিল এবং তৃতীয় হবে ঐ ব্যক্তি, যে মানুষকে দেখানোর জন্য দান করেছিল।

[8] - হাদীছে মাত্র একটি খাতের কথা বলা হয়েছে। সূরা তাওবার ৬০ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা যাকাত বন্টনের সব খাত এক সাথে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ

‘‘এসব যাকাত তো আসলে ফকীর ও মিসকীনদের জন্য৷ আর যারা সাদকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত এবং যাদের মন জয় করা প্রয়োজন তাদের জন্য৷ তাছাড়া দাস মুক্ত করা এবং ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করার জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের উপকারে ব্যয় করার জন্য৷ এটা আল্লাহর পক্ষে থেকে একটি নির্ধারিত বিধান এবং আল্লাহ সবকিছু জানেন, তিনি সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান’’৷
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে