তাওয়াক্কুল বা ভরসার শির্ক বলতে মানুষের অসাধ্য ব্যাপারসমূহ সমাধানে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর উপর ভরসা করাকে বুঝানো হয়। যেমন: রিযিক দান, সমস্যা দূরীকরণ ইত্যাদি। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলার উপর ভরসা করা গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত যা অন্য কারোর জন্য ব্যয় করা মারাত্মক শির্ক।
তবে আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত না করে তাঁর উপর যে কোন বিষয়ে ভরসা করাও কিন্তু অমূলক।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
«فَاعْبُدْهُ وَتَوَكَّلْ عَلَيْهِ، وَمَا رَبُّكَ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُوْنَ»
‘‘সুতরাং আপনি আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করুন এবং তাঁর উপর ভরসা করুন। আপনার প্রভু কিন্তু আপনাদের কর্ম থেকে গাফিল নন’’। (হূদ: ১২৩)
আল্লাহ্ তা’আলা কোর’আন মাজীদের মধ্যে তাওয়াক্কুলকে ঈমানের শর্ত বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন:
«وَعَلَى اللهِ فَتَوَكَّلُوْا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ»
‘‘তোমরা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উপরই ভরসা করো যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো’’। (মায়িদাহ্ : ২৩)
অন্য আরেকটি আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা তাওয়াক্কুলকে ইসলামের শর্ত বলেও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন:
«وَقَالَ مُوْسَى يَا قَوْمِ إِنْ كُنْتُمْ آمَنْتُمْ بِاللهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوْا إِنْ كُنْتُمْ مُسْلِمِيْنَ»
‘‘মূসা (আ.) আরো বললেন: হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যদি আল্লাহ্ তা’আলার উপর ঈমান এনে থাকো তাহলে তাঁরই উপর ভরসা করো যদি তোমরা নিজকে মুসলিম বলে দাবি করো’’। (ইউনুস : ৮৪)
কোর’আন মাজীদের আরেকটি আয়াতে তাওয়াক্কুলকে মু’মিনদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
«إِنَّمَا الْـمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ»
‘‘নিশ্চয়ই মু’মিন ওরা যাদের সম্মুখে মহান আল্লাহ্ তা’আলার নাম উচ্চারিত হলে তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। আর যখন তাদের সামনে আল্লাহ্ তা’আলার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা সকল বিষয়ে নিজ প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে’’। (আনফাল : ২)
ইমাম ইব্নুল ক্বায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন:
جَعَلَ اللهُ التَّوَكُّلَ شَرْطًا فِيْ الإِيْمَانِ ، فَدَلَّ عَلَى انْتِفَاءِ الإِيْمَانِ عِنْدَ انْتِفَائِهِ، وَكُلَّمَا قَوِيَ إِيْمَانُ الْعَبْدِ كَانَ تَوَكُّلُهُ أَقْوَى، وَإِذَا ضَعُفَ الإِيْمَانُ ضَعُفَ التَّوَكُّلُ، وَإِذَا كَانَ التَّوَكُّلُ ضَعِيْفًا كَانَ دَلِيْلًا عَلَى ضَعْفِ الإِيْمَانِ وَلاَ بُدَّ، وَاللهُ تَعَالَى فِيْ مَوَاضِعَ مِنْ كِتَابِهِ يَجْمَعُ بَيْنَ التَّوَكُّلِ وَالْعِبَادَةِ ، وَبَيْنَ التَّوَكُّلِ وَالإِيْمَانِ، وَبَيْنَ التَّوَكُّلِ وَالتَّقْوَى، وَبَيْنَ التَّوَكُّلِ وَالإِسْلاَمِ، وَبَيْنَ التَّوَكُّلِ وَالْهِدَايَةِ ؛ فَظَهَرَ أنَّ التَّوَكُّلَ أَصْلٌ لِجَمِيْعِ مَقَامَاتِ الإِيْمَانِ وَالإِحْسَانِ وَلِجَمِيْعِ أَعْمَالِ الإِسْلاَمِ، وَأَنَّ مَنْزِلَتَهُ مِنْهَا كَمَنْزِلَةِ الرَّأْسِ مِنَ الْـجَسَدِ، فَكَمَا لاَ يَقُوْمُ الرَّأْسُ إِلاَّ عَلَى الْبَدَنِ فَكَذَلِكَ لاَ يَقُوْمُ الإِيْمَانُ وَمَقَامَاتُهُ وَأَعْمَالُهُ إِلاَّ عَلَى سَاقِ التَّوَكُّلِ
‘‘আল্লাহ্ তা’আলা উক্ত আয়াতে তাওয়াক্কুলকে ঈমানের শর্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাহলে বুঝা গেলো, তাওয়াক্কুল না থাকলে ঈমান থাকে না। আর যখনই ঈমান শক্তিশালী হবে তাওয়াক্কুলও শক্তিশালী হবে এবং যখনই ঈমান দুর্বল হবে তাওয়াক্কুলও দুর্বল হয়ে যাবে। তাহলে বুঝা গেলো, তাওয়াক্কুলের দুর্বলতা নিঃসন্দেহে ঈমান দুর্বল হওয়া প্রমাণ করে। আল্লাহ্ তা’আলা কোর’আনের কয়েকটি আয়াতে তাওয়াক্কুল ও ইবাদাত, তাওয়াক্কুল ও ঈমান, তাওয়াক্কুল ও আল্লাহ্ভীরুতা, তাওয়াক্কুল ও ইসলাম, তাওয়াক্কুল ও হিদায়াতকে একত্রে উল্লেখ করেছেন। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, তাওয়াক্কুল বস্ত্তটি ঈমান ও ইহ্সানের সকল পর্যায় এবং ইসলামের সকল কর্মকান্ডের মূল উৎস। আরো প্রতীয়মান হয় যে, এগুলোর সাথে তাওয়াক্কুলের সম্পর্ক এমন যেমন শরীরের সাথে মাথার সম্পর্ক। যেমনিভাবে শরীর ছাড়া মাথার অবস্থান অকল্পনীয় তেমনিভাবে তাওয়াক্কুল ছাড়াও এগুলোর উপস্থিতি সত্যিই অকল্পনীয়’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৯১-৯২)
তাওয়াক্কুল বা ভরসার প্রকারভেদ:
আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কারোর উপর ভরসা করা তিন প্রকার। যা নিম্নরূপ:
১. সৃষ্টির অসাধ্য এমন কোন ব্যাপারে স্রষ্টা ছাড়া অন্য কারোর উপর ভরসা করা। যেমন: বিজয়, রক্ষণ, রিযিক বা সুপারিশ ইত্যাদির ব্যাপারে মৃত বা অনুপস্থিত কোন ব্যক্তির উপর ভরসা করা। এটি বড় শির্ক।
২. মানুষের সাধ্যাধীন এমন কোন বাহ্যিক ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি, গভর্ণর বা সক্ষম কারোর উপর সম্পূর্ণরূপে ভরসা করা। যেমন: দান, সাদাকা বা বাহ্যিক সমস্যা দূরীকরণ ইত্যাদির ব্যাপারে উপরোক্ত কারোর উপর ভরসা করা। এটি ছোট শির্ক।
৩. কোন কর্ম সম্পাদনে নিজ প্রতিনিধির উপর নির্ভরশীল হওয়া। যেমন: ক্রয়, বিক্রয় ইত্যাদির ব্যাপারে। এটি জায়েয। তবে এ সকল প্রতিনিধির উপরও সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। বরং এ জাতীয় কর্মসমূহ সহজ করণে সত্যিকারার্থে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উপরই নির্ভরশীল হতে হবে। কারণ, প্রতিনিধি বলতেই তা মাধ্যম মাত্র এবং এ মাধ্যম ক্রিয়াশীল করতে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই সক্ষম। অন্য কেউ নয়।
তবে এ কথা একান্তভাবে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ্ তা’আলার উপর ভরসা করা বৈষয়িক উপকরণ গ্রহণ করার মোটেও পরিপন্থী নয়। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা প্রতিটি বস্ত্ত বা ব্যাপারকে যে কোন উপকরণ বা মাধ্যম নির্ভরশীল করেছেন। এ কারণেই তিনি মানুষকে তাঁর উপর তাওয়াক্কুলের পাশাপাশি মাধ্যম ও উপকরণ গ্রহণ করতে আদেশ দিয়েছেন। অতএব উপকরণ বা মাধ্যম গ্রহণ করাও ইবাদাত। যেমনিভাবে আল্লাহ্ তা’আলার উপর তাওয়াক্কুল করাও একটি ইবাদাত। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা উপকরণ গ্রহণ করতে আদেশ করেছেন। আর আল্লাহ্ তা’আলার আদেশ পালনের নামই তো ইবাদাত।
আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন:
«يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا خُذُوْا حِذْرَكُمْ»
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজ সতর্কতা অবলম্বন করো’’। (নিসা : ৭১)
তিনি আরো বলেন:
«وَأَعِدُّوْا لَـهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ»
‘‘তোমরা কাফিরদের মোকাবিলায় যথাসাধ্য শক্তি সঞ্চয় করো’’। (আনফাল : ৬০)
তিনি আরো বলেন:
«فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلاَةُ فَانْتَشِرُوْا فِيْ الأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ»
‘‘নামায শেষ হলেই তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহ্ তা’আলার অনুগ্রহ তথা রিযিক অনুসন্ধান করো’’। (জুমু’আহ্ : ১০)
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
الْـمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ الْـمُؤْمِنِ الضَّعِيْفِ، وَفِيْ كُلٍّ خَيْرٌ، اِحْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللهِ وَلاَ تَعْجَزْ، وَإِنْ أَصَابَكَ شَيْءٌ فَلاَ تَقُلْ: لَوْ أَنِّيْ فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا، وَلَكِنْ قُلْ: قَدَّرَ اللهُ وَمَا شَاءَ فَعَلَ، فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ
‘‘শক্তিশালী মু’মিন দুর্বল মু’মিন অপেক্ষা অনেক ভালো এবং আল্লাহ্ তা’আলার নিকট অধিক পছন্দনীয়। তবে উভয়ের মধ্যে কম ও বেশি কল্যাণ রয়েছে। যা তোমার উপকারে আসবে তা করতে সর্বদা উৎসাহী থাকো এবং আল্লাহ্’র সাহায্য কামনা করো। অক্ষমের ন্যায় বসে থেকো না। কোন অঘটন ঘটলে এ কথা বলবেনা যে, যদি এমন করতাম তাহলে এমন এমন হতো। বরং বলবে: আল্লাহ্ তা’আলা ইহা আমার ভাগ্যে রেখেছেন এবং তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন। কারণ, ‘‘যদি’’ শব্দটি শয়তানের শয়তানীর দরোজা খুলে দেয়’’। (মুসলিম, হাদীস ২৬৬৪)
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
قَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! أَعْقِلُهَا وَأَتَوَكَّلُ، أَوْ أُطْلِقُهَا وَأَتَوَكَّلُ؟ قَالَ: اِعْقِلْهَا وَتَوَكَّلْ
‘‘জনৈক ব্যক্তি বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! আমি উটটি বেঁধে তাওয়াক্কুল করবো নাকি না বেঁধেই তাওয়াক্কুল করবো? তিনি বললেন: বেঁধেই তাওয়াক্কুল করো। না বেঁধে নয়’’। (তিরমিযী, হাদীস ২৫১৭)
’উমর বিন্ খাত্তাব (রা.) এর সঙ্গে ইয়েমেনের কিছু সংখ্যক লোকের সাক্ষাৎ হলে তিনি তাদেরকে বলেন:
مَنْ أَنْتُمْ؟ قَالُوْا: نَحْنُ الْـمُتَوَكِّلُوْنَ، قَالَ: بَلْ أَنْتُمْ الْـمُتَأَكِّلُوْنَ! إِنَّمَا الْـمُتَوَكِّلُ الَّذِيْ يُلْقِيْ حَبَّهُ فِيْ الأَرْضِ وَيَتَوَكَّلُ عَلَى اللهِ
‘‘তোমরা কারা? তারা বললো: আমরা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উপর নির্ভরশীল। তিনি বললেন: না, বরং তোমরা অসদুপায়ে মানুষের সম্পদ ভক্ষণকারী। আল্লাহ্ তা’আলার উপর সত্যিকার নির্ভরশীল সে ব্যক্তি যে জমিনে বীজ বপন করে তাঁরই উপর ভরসা করে’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৯৪)
ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) কে জিজ্ঞাসা করা হলো, জনৈক ব্যক্তি উপার্জন না করে বসে আছে এবং বলছে: আমি আল্লাহ্ তা’আলার উপর তাওয়াক্কুল করেছি। তখন তিনি বলেন:
يَنْبَغِيْ لِلنَّاسِ كُلِّهِمْ أَنْ يَّتَوَكَّلُوْا عَلَى اللهِ وَلَكِنْ لاَ بُدَّ أَنْ يُعَوِّدُوْا أَنْفُسَهُمْ عَلَى الْكَسْبِ، فَقَدْ كَانَ الأَنْبِيَاءُ يُؤَجِّرُوْنَ أَنْفُسَهُمْ، وَكَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يُؤَجِّرُ نَفْسَهُ وَأَبُوْ بَكْرٍ وَعُمَرُ، وَلَمْ يَقُوْلُوْا نَقْعُدُ حَتَّى يَرْزُقَنَا اللهُ، وَقَالَ اللهُ تَعَالَى : «فَانْتَشِرُوْا فِيْ الأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ»
‘‘প্রত্যেকেরই উচিত আল্লাহ্ তা’আলার উপর তাওয়াক্কুল করা। তবে এর পাশাপাশি নিজকে উপার্জনে অভ্যস্ত করতে হবে। কারণ, সকল নবীগণ পয়সার বিনিময়ে কাজ করেছেন। এমনকি আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সা.) , আবু বকর, ’উমরও। তাঁরা আল্লাহ্ তা’আলার রিযিকের আশায় বসে থাকেননি। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহ্ তা’আলার অনুগ্রহ তথা রিযিক অনুসন্ধান করো’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৯৪)
এ ব্যাপারে জনৈক আলিম সত্যই বলেছেন। তিনি বলেন:
مَنْ طَعَنَ فِي الْـحَرَكَةِ ـ يَعْنِيْ السَّعْيَ وَالْكَسْبَ وَالأَخْذَ بِالأَسْبَابِ ـ فَقَدْ طَعَنَ فِيْ السُّنَّةِ، وَمَنْ طَعَنَ فِيْ التَّوَكُّلِ فَقَدْ طَعَنَ فِيْ الإِيْمَانِ
‘‘যে ব্যক্তি রোজগার বা উপকরণ অবলম্বনের ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করলো সে যেন রাসূল (সা.) এর হাদীস নিয়ে উচ্চবাচ্য করলো। আর যে ব্যক্তি তাওয়াক্কুল নিয়ে উচ্চবাচ্য করলো সে যেন ঈমান নিয়ে উচ্চবাচ্য করলো’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৯৩)
ইমাম ইবনে রাজাব (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: মানবকর্ম বলতেই তা সর্বসাকুল্যে তিনটি প্রকারের যে কোন একটি প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। যা নিম্নরূপ:
১. ইবাদাত। যা সম্পাদন করতে আল্লাহ্ তা’আলা বান্দাহ্দেরকে আদেশ করেছেন এবং যা বান্দাহ্’র জন্য পরকালে জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতে প্রবেশের কারণ হবে। তা বিনা ভেদাভেদে প্রত্যেককে অবশ্যই সম্পাদন করতে হবে। তবে এ ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলার উপর ভরসা ও তাঁর সহযোগিতা কামনা করা একান্ত কর্তব্য। কারণ, একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই বান্দাহ্কে সৎ কাজ করতে এবং অসৎ কাজ থেকে বেঁচে থাকতে সহযোগিতা করে থাকেন। আল্লাহ্ তা’আলা যা ইচ্ছে করেন তাই ঘটে থাকে এবং তিনি যা ইচ্ছে করেন না তা কখনোই ঘটে না। তাই যে ব্যক্তি ইবাদাত করতে গাফিলতি করবে সে দুনিয়া ও আখিরাতে অবশ্যই শাস্তির সম্মুখীন হবে।
ইউসুফ বিন্ আস্বাত (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন:
اِعْمَلْ عَمَلَ رَجُلٍ لاَ يُنْجِيْهِ إِلاَّ عَمَلُهُ وَتَوَكَّلْ تَوَكُّلَ رَجُلٍ لاَ يُصِيْبُهُ إِلاَّ مَا كُتِبَ لَهُ
‘‘এমন ব্যক্তির ন্যায় আমল করবে পরকালে নিষ্কৃতির জন্য যার একমাত্র আমলই ভরসা এবং এমন ব্যক্তির ন্যায় তাওয়াক্কুল করবে যে কেবল ভাগ্যে যা আছে তাই ঘটবে বলে বিশ্বাস করে’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৯৩)
২. প্রকৃতিগতভাবে মানুষ সর্বদা যা করে থাকে এবং যা সম্পাদন করতে মানুষ আদিষ্ট ও একান্তভাবে বাধ্য। যেমন: খিদে লাগলে ভক্ষণ, পিপাসা লাগলে পান, সূর্যের তাপে ছায়া ও ঠান্ডায় তাপ গ্রহণ ইত্যাদি। এ সকল কর্ম সম্পাদন করা বান্দাহ্’র উপর ওয়াজিব। যে ব্যক্তি এগুলো করতে সক্ষম অথচ সে অবহেলা বশতঃ তা না করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে ব্যক্তি অবশ্যই অপরাধী এবং পরকালে শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত। তবে আল্লাহ্ তা’আলা কোন কোন ব্যক্তিকে এমন কিছু ক্ষমতা দিয়ে থাকেন যা অন্যের নেই। সুতরাং সে তার সাধ্যানুযায়ী ব্যতিক্রম কিছু করলে তাতে কোন অসুবিধে নেই। এ কারণেই রাসূল (সা.) একটানা রোযা রাখতেন। কিন্তু তিনি সাহাবাদেরকে তা করতে নিষেধ করতেন এবং বলতেন:
إِنِّيْ لَسْتُ كَهَيْئَتِكُمْ، إِنِّيْ يُطْعِمُنِيْ رَبِّيْ وَيَسْقِيْنِيْ
‘‘আমি তোমাদের মতো নই। আমাকে আল্লাহ্ তা’আলা খাওয়ান ও পান করান’’। (বুখারী, হাদীস ১৯৬৪ মুসলিম, হাদীস ১১০৫)
পূর্ববর্তীদের অনেকেই দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকতে পারতেন। তাতে এতটুকুও তাদের ইবাদাতের ক্ষতি হতো না। কিন্তু যে ব্যক্তি না খেলে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ইবাদাত করতে কষ্ট হয় তার জন্য না খাওয়া সত্যিই দোষনীয়।
৩. প্রকৃতিগতভাবে মানুষ অধিকাংশ সময় যা করে থাকে এবং যা করতে মানুষ একান্তভাবে বাধ্য নয়। যেমন: বিবাহ-শাদি ইত্যাদি। অতএব কারোর এ সবের একেবারেই প্রয়োজন নেই বলে কেউ তা না করলে সে এ জন্য গুনাহ্গার হবে না।
যে কোন ব্যাপারে বান্দাহ্’র জন্য একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই যথেষ্ট। তাই তাঁর উপরই ভরসা করতে হবে। অন্য কারোর উপর নয়।
আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর প্রিয় নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
«يَآ أَيُّهَا النَّبِيُّ حَسْبُكَ اللهُ وَمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْـمُؤْمِنِيْنَ»
‘‘হে নবী! আপনি ও আপনার অনুসারীদের জন্য সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই যথেষ্ট’’। (আন্ফাল : ৬৪)
তিনি আরো বলেন:
«وَإِنْ يُّرِيْدُوْا أَنْ يَّخْدَعُوْكَ فَإِنَّ حَسْبَكَ اللهُ هُوَ الَّذِيْ أَيَّدَكَ بِنَصْرِهِ وَبِالْـمُؤْمِنِيْنَ»
‘‘কাফিররা যদি আপনাকে প্রতারিত করতে চায় তাহলে আপনার জন্য একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই যথেষ্ট। একমাত্র তিনিই আপনাকে নিজ সাহায্য (ফিরিশতা) ও মু’মিনদের দিয়ে শক্তিশালী করেছেন’’। (আনফাল : ৬২)
তিনি আরো বলেন:
«وَمَنْ يَّتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ، وَمَنْ يَّتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ»
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় করবে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে যে কোন সংকট থেকে উদ্ধার করবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে রিযিক দিবেন। আর যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উপরই ভরসা করবে তখন তিনিই হবেন তার জন্য একান্ত যথেষ্ট’’। (ত্বালাক্ব : ৩)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা তাওয়াক্কুলকে যে কোন কার্যসিদ্ধির অনেকগুলো মাধ্যমের একটি সবিশেষ ও সর্বপ্রধান মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এতদ্সত্ত্বেও তা কিন্তু একেবারেই সর্বেসর্বা নয়। বরং এর পাশাপাশি অন্য মাধ্যমও গ্রহণ করতে হবে। যেমনিভাবে আল্লাহভীতিও কার্যসিদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। তবে যখন সকল মাধ্যম চরমভাবে ব্যর্থ হবে তখন একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উপর খাঁটি তাওয়াক্কুলই কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে প্রমাণিত হবে।
’উমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি:
لَوْ أَنَّكُمْ تَوَكَّلْتُمْ عَلَى اللهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ لَرَزَقَكُمْ كَمَا يَرْزُقُ الطَّيْرَ، تَغْدُوْ خِمَاصًا وَتَرُوْحُ بِطَانًا
‘‘তোমরা যদি আল্লাহ্ তা’আলার উপর সত্যিকারার্থে ভরসা করতে তাহলে তিনি তোমাদেরকে রিযিক দিতেন যেমনিভাবে তিনি রিযিক দিয়ে থাকেন পাখীদেরকে। পাখীরা ভোর বেলায় খালি পেটে বাসা থেকে বের হয় এবং সন্ধ্যা বেলায় ভরা পেটে বাসায় ফিরে আসে’’। (ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৪২৩৯)