ভালোবাসার শির্ক বলতে দুনিয়ার কাউকে এমনভাবে ভালোবাসাকে বুঝানো হয় যাতে তার আদেশ-নিষেধকে আল্লাহ্ তা’আলার আদেশ-নিষেধের উপর প্রাধান্য দেয়া অথবা সমপর্যায়ের মনে করা হবে। তাতে অভূতপূর্ব সম্মান, অধীনতা ও আনুগত্যের সংমিশ্রণ থাকে।
কোর’আন ও হাদীসের দৃষ্টিকোণে এ জাতীয় ভালোবাসা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই হতে হবে। অন্য কারোর জন্য নয়।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
«وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَّتَّخِذُ مِنْ دُوْنِ اللهِ أَنْدَادًا يُّحِبُّوْنَهُمْ كَحُبِّ اللهِ، وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا أَشَدُّ حُبًّا لِلهِ، وَلَوْ يَرَى الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلهِ جَمِيْعًا وَأَنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعَذَابِ»
‘‘মানবমন্ডলীর অনেকেই এমন যে, তারা আল্লাহ্ তা’আলার সাথে অন্যকে শরীক করে। তারা ওদেরকে এমনভাবে ভালোবাসে যেমন ভালোবাসে আল্লাহ্ তা’আলাকে । তবে ঈমানদার ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাকেই সর্বাধিক ভালোবাসে। জালিমরা যদি শাস্তি অবলোকন করে বুঝতো যে, সমুদয় শক্তি একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই জন্য এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর’’। (বাক্বারাহ: ১৬৫)
স্বাভাবিক ভালোবাসা যা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্য না হয়ে অন্য কারোর জন্যও হতে পারে তা তিন প্রকার:
ক. প্রকৃতিগত ভালোবাসা। যেমন: আহারের জন্য ক্ষুধার্তের ভালোবাসা।
খ. স্নেহ জাতীয় ভালোবাসা। যেমন: সন্তানের জন্য পিতার ভালোবাসা।
গ. আসক্তিগত ভালোবাসা। যেমন: স্বামীর জন্য স্ত্রীর ভালোবাসা।
তবে এ সকল ভালোবাসাকে আল্লাহ্ তা’আলার ভালোবাসার উপর কোনভাবেই প্রাধান্য দেয়া যাবে না।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
«قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيْرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوْهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبُّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللهِ وَرَسُوْلِهِ وَجِهَادٍ فِيْ سَبِيْلِهِ فَتَرَبَّصُوْا حَتَّى يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ، وَاللهُ لاَ يَهْدِيْ الْقَوْمَ الْفَاسِقِيْنَ»
‘‘(হে নবী!) আপনি বলুন: যদি তোমাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা, স্ত্রী, গোত্র-গোষ্ঠী, অর্জিত ধন-সম্পদ আর ঐ ব্যবসা যার অবনতির তোমরা আশঙ্কা করছো এবং পছন্দসই গৃহসমূহ তোমাদের নিকট আল্লাহ্ তা’আলা ও তদীয় রাসূল এবং তাঁর পথে জিহাদ করার চাইতে অধিক প্রিয় হয়ে থাকে তাহলে তোমরা অচিরেই আল্লাহ্ প্রদত্ত শাস্তির অপেক্ষা করতে থাকো। বস্ত্ততঃ আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর আদেশ অমান্যকারীদের সুপথ প্রদর্শন করেন না’’। (তাওবা: ২৪)
আল্লাহ্ তা’আলাকে ভালোবাসার নিদর্শনসমূহ:
কারোর মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার ভালোবাসা বিদ্যমান আছে কিনা তা বুঝার কয়েকটি নিদর্শন বা উপায় রয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ:
ক. আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছাকে নিজ ইচ্ছার উপর প্রধান্য দেয়া।
খ. সকল বিষয়ে রাসূল (সা.) আনীত বিধি-বিধান মেনে চলা।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
«قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِيْ يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ»
‘‘(হে নবী!) আপনি বলে দিন: যদি তোমরা আল্লাহ্ তা’আলাকে সত্যিকারার্থে ভালোবেসে থাকো তাহলে তোমরা আমার অনুসরণ করো। তখনই আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ্ তা’আলা সত্যিই ক্ষমাশীল ও দয়ালু’’। (আল-ইম্রান: ৩১)
গ. সকল ঈমানদারের প্রতি দয়াবান ও অনুগ্রহশীল হওয়া।
আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর রাসূল (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন:
«وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْـمُؤْمِنِيْنَ»
’’যে সকল মু’মিন আপনাকে অনুসরণ করে তাদের প্রতি আপনি বিনয়ী হোন’’। (শু’আরা’ : ২১৫)
আল্লাহ্ তা’আলা সাহাবাদের গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
«مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ، وَالَّذِيْنَ مَعَهُ أَشِدَّآءُ عَلَى الْكُفَّارِ، رُحَمَآءُ بَيْنَهُمْ»
‘‘মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ্ তা’আলার মনোনীত রাসূল। আর তাঁর সহচরগণ কাফিরদের প্রতি খুবই কঠোর। তবে তারা নিজেদের মধ্যে পরস্পর পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত দয়াবান’’। (ফাত্হ্ : ২৯)
ঘ. কাফিরদের প্রতি কঠোর হওয়া।
আল্লাহ্ তা’আলা নবী (সা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন:
«يَآ أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْـمُنَافِقِيْنَ، وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ»
’’হে নবী! আপনি কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন এবং তাদের প্রতি খুব কঠোর হোন’’। (তাহ্রীম : ৯)
ঙ. আল্লাহ্ তা’আলার মনোনীত দ্বীনকে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে মুখ, হাত, জান ও মালের মাধ্যমে তথা সার্বিকভাবে আল্লাহ্’র রাস্তায় জিহাদ করা।
চ. আল্লাহ্ তা’আলার মনোনীত দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে কারোর গাল-মন্দ তথা তিরস্কারকে পরোয়া না করা।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
«يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا مَنْ يَّرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِيْنِهِ فَسَوْفَ يَأْتِيْ اللهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّوْنَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِيْنَ يُجَاهِدُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَلاَ يَخَافُوْنَ لَوْمَةَ لاَئِمٍ»
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কেউ স্বীয় ধর্ম ত্যাগ করলে (তাতে ইসলামের কোন ক্ষতি হবেনা।) কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা সত্বরই তাদের স্থলে এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারাও তাঁকে ভালোবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি দয়াশীল ও কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে। আল্লাহ্ তা’আলার পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করবে না’’। (মায়িদাহ্ : ৫৪)
আল্লাহ্ তা’আলাকে ভালোবাসার উপায়:
যে যে কাজ করলে কারোর অন্তরে আল্লাহ্ তা’আলার ভালোবাসা বদ্ধমূল হয়ে যায় তা নিম্নরূপ:
১. অর্থ বুঝে মনোযোগ সহকারে কোর’আন মাজীদ তিলাওয়াত করা।
২. বেশি বেশি নফল নামায আদায় করা।
৩. অন্তরে, কথায় ও কাজে সর্বদা আল্লাহ্ তা’আলাকে স্মরণ করা।
৪. নিজের পছন্দ ও আল্লাহ্ তা’আলার পছন্দ পারস্পরিক সাংঘর্ষিক হলে আল্লাহ্ তা’আলার পছন্দকে নিজের পছন্দের উপর সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়া।
৫. আল্লাহ্ তা’আলার নাম ও গুণাবলীর মাহাত্ম্য, তাৎপর্য ও সুফল নিয়ে গবেষণা করা।
৬. প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য তথা আল্লাহ্ তা’আলার সকল নিয়ামত নিয়ে সর্বদা ভাবতে থাকা।
৭. আল্লাহ্ তা’আলার প্রতি সর্বদা বিনয়ী ও মুখাপেক্ষী থাকা।
৮. রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে তাহাজ্জুদের নামায, কোর’আন তিলাওয়াত ও তাওবা-ইস্তিগ্ফার করা।
৯. নেক্কার ও আল্লাহ্প্রেমীদের সাথে উঠাবসা করা।
১০. আল্লাহ্ তা’আলা থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এমন সকল কর্মকান্ড থেকে সর্বদা বিরত থাকা।
আল্লাহ্ তা’আলার ভালোবাসা পাওয়ার উপায়:
আল্লাহ্ তা’আলার ভালোবাসা পেতে হলে পারস্পরিক যে কোন সম্পর্ক একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই হতে হবে। অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়।
মু’আয বিন্ জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
وَجَبَتْ مَحَبَّتِيْ لِلْمُتَحَابِّيْنَ فِيَّ، وَلِلْمُتَجَالِسِيْنَ فِيَّ، وَلِلْمُتَزَاوِرِيْنَ فِيَّ، وَلِلْمُتَبَاذِلِيْنَ فِيَّ
‘‘আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: আমার কর্তব্য ওদেরকে ভালোবাসা যারা আমার জন্য অন্যকে ভালোবাসে, আমার জন্য অন্যের সাথে উঠে-বসে, আমার জন্য অন্যের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং আমারই জন্য কাউকে দান করে’’।
(ইবনু হিব্বান/মাওয়ারিদ, হাদীস ২৫১০ বাগাওয়ী, হাদীস ৩৪৬৩ কোযায়ী, হাদীস ১৪৪৯, ১৪৫০)
মু’আয বিন্ আনাস্ জুহানী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
مَنْ أَعْطَى لِلهِ، وَمَنَعَ لِلهِ، وَأَحَبَّ لِلهِ، وَأَبْغَضَ لِلهِ وَأَنْكَحَ لِلهِ ؛ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ إِيْمَانُهُ
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই কাউকে কোন কিছু দিলো এবং একমাত্র তাঁরই জন্য কাউকে কোন কিছু থেকে বঞ্চিত করলো। তাঁর জন্যই কাউকে ভালোবাসলো এবং একমাত্র তাঁরই জন্য কারোর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করলো। তাঁরই জন্য নিজ অধীনস্থ কোন মেয়েকে কারোর নিকট বিবাহ্ দিলো তাহলে তার ঈমান তখনই সত্যিকারার্থে পরিপূর্ণ হলো’’। (তিরমিযী, হাদীস ২৫২১)
আল্লাহ্ তা’আলাকে ভালোবাসার পাশাপাশি তদীয় রাসূল (সা.) কেও ভালোবাসতে হবে। কারণ, এতদুভয়ের ভালোবাসা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রাসূল (সা.) কে ভালোবাসা সত্যিকার ঈমানদারের পরিচয়। আর রাসূল (সা.) কে ভালোবাসা মানে সর্ব কাজে তাঁর আনীত বিধানকে অনুসরণ করা।
আনাস্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيْهِ وَجَدَ بِهِنَّ حَلاَوَةَ الْإِيْمَانِ: أَنْ يَّكُوْنَ اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُّحِبَّ الْمَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلاَّ لِلهِ، وَأَنْ يَّكْرَهَ أَنْ يَّعُوْدَ فِيْ الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُّقْذَفَ فِيْ النَّارِ
‘‘তিনটি বস্ত্ত কারোর মধ্যে বিদ্যমান থাকলে সে সত্যিকারার্থে ঈমানের মজা পাবে। আল্লাহ্ তা’আলা ও তদীয় রাসূল (সা.) তার নিকট অন্যান্যের চাইতে বেশি প্রিয় হলে, কাউকে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই ভালোবাসলে এবং দ্বিতীয়বার কাফির হয়ে যাওয়া তার নিকট সে রকম অপছন্দনীয় হলে যে রকম জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া তার নিকট একেবারেই অপছন্দনীয়’’। (বুখারী, হাদীস ১৬, ২১, ৬৯৪১ মুসলিম, হাদীস ৪৩ তিরমিযী, হাদীস ২৬২৪)
রাসূল (সা.) আরো বলেন:
لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُوْنَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَّالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ
‘‘তোমাদের কেউ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ আমি তার নিকট নিজ পিতা ও সন্তান এমনকি দুনিয়ার সকল মানুষ হতে সর্বাধিক প্রিয় না হই’’। (বুখারী, হাদীস ১৫ মুসলিম, হাদীস ৪৪)
আল্লাহ্ তা’আলাকে ভালোবাসা দু’ ধরনের:
১. যা ফরয বা বাধ্যতামূলক। আর তা হচ্ছে: আল্লাহ্ তা’আলা যে কাজগুলো মানুষের জন্য ফরয বা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন সেগুলোকে ভালোবাসা এবং তিনি যে কাজগুলোকে হারাম করে দিয়েছেন সেগুলোকে অপছন্দ করা। তদীয় রাসূল (সা.) কে ভালোবাসা যিনি তাঁর পক্ষ থেকে সকল আদেশ-নিষেধ তাঁর বান্দাহ্দের নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তাঁর আনীত সকল বিধি-বিধানকে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করা। সকল নবী-রাসূল ও মু’মিনদেরকে ভালোবাসা এবং সকল কাফির ও ফাজির (নিঃশঙ্ক পাপী) কে অপছন্দ করা।
২. যা উপরস্থ বা আল্লাহ্ তা’আলার অতি নিকটবর্তীদের পর্যায়। আর তা হচ্ছে: আল্লাহ্ তা’আলার পছন্দনীয় সকল নফল কাজগুলোকে ভালোবাসা এবং তাঁর অপছন্দনীয় সকল মাকরূহ্ কাজগুলোকে অপছন্দ করা। এমনকি তাঁর সকল ধরনের কঠিন ফায়সালাগুলোকেও সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়া।
যেমন কেউ কাউকে ভালোবাসলে সে যে বস্ত্ত বা ব্যক্তিকে ভালোবাসে তাকেও সে বস্ত্ত বা ব্যক্তিকে ভালোবাসতে হয়। তেমনিভাবে সে যে বস্ত্ত বা ব্যক্তিকে অপছন্দ করে তাকেও সে বস্ত্ত বা ব্যক্তিকে অপছন্দ করতে হয়। নতুবা তার ভালোবাসা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে। ঠিক একইভাবে কেউ আল্লাহ্ তা’আলাকে সত্যিকারার্থে ভালোবাসলে তিনি যে বস্ত্ত বা ব্যক্তিকে ভালোবাসেন অথবা অপছন্দ করেন তাকেও সে বস্ত্ত বা ব্যক্তিকে ভালোবাসতে বা অপছন্দ করতে হবে। নতুবা তার আল্লাহ্ তা’আলাকে ভালোবাসার দাবি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে। এ কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা কোর’আন মাজীদের মধ্যে এবং তদীয় রাসূল (সা.) হাদীসের মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার বন্ধু-শত্রু, পছন্দ-অপছন্দ সবকিছুই বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
«إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللهُ وَرَسُوْلُهُ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا الَّذِيْنَ يُقِيْمُوْنَ الصَّلاَةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُوْنَ»
‘‘তোমাদের বন্ধুতো আল্লাহ্ তা’আলা, তদীয় রাসূল (সা.) ও মু’মিনরা। যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং সর্বদা আল্লাহ্ তা’আলার সামনে বিনয়ী থাকে’’। (মা’য়িদাহ্ : ৫৫)
তিনি আরো বলেন:
«وَالْـمُؤْمِنُوْنَ وَالْـمُؤْمِنٰتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍ»
‘‘মু’মিন পুরুষ ও মহিলা একে অপরের বন্ধু’’। (তাওবাহ্ : ৭১)
তিনি আরো বলেন:
«يَآ أَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لاَ تَتَّخِذُوْا عَدُوِّيْ وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَآءَ تُلْقُوْنَ إِلَيْهِمْ بِالْـمَوَدَّةِ، وَقَدْ كَفَرُوْا بِمَا جَآءَكُمْ مِنَ الْـحَقِّ، يُخْرِجُوْنَ الرَّسُوْلَ وَإِيَّـاكُمْ أَنْ تُؤْمِنُوْا بِاللهِ رَبِّكُمْ، إِنْ كُنْتُمْ خَرَجْتُمْ جِهَادًا فِيْ سَبِيْلِيْ وَابْتِغَآءَ مَرْضَاتِيْ تُسِرُّوْنَ إِلَيْهِمْ بِالْـمَوَدَّةِ، وَأَنَا أَعْلَمُ بِمَآ أَخْفَيْتُمْ وَمَآ أَعْلَنْتُمْ، وَمَنْ يَّفْعَلْهُ مِنْكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَآءَ السَّبِيْلِ»
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি তাদের সাথে বন্ধুত্ব করছো অথচ তারা তোমাদের নিকট যে সত্য এসেছে তা অস্বীকার করছে। রাসূল (সা.) এবং তোমাদেরকে (মক্কা থেকে) বের করে দিয়েছে। এ কারণে যে তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ্ তা’আলার উপর ঈমান এনেছো। যদি তোমরা আমার পথে জিহাদ এবং আমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বের হয়ে থাকো তবে কেন তোমরা তাদের সাথে গোপনে বন্ধুত্ব করছো? আমি তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সব কিছুই জানি। তোমাদের যে কেউই উক্ত কাজ করে সে অবশ্যই সঠিক পথ হতে বিচ্যুত’’। (মুম্তা’হিনাহ্ : ১)
তিনি আরো বলেন:
«يَآ أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لاَ تَتَّخِذُوْا الْكَافِرِيْنَ أَوْلِيَآءَ مِنْ دُوْنِ الْـمُؤْمِنِيْنَ، أَتُرِيْدُوْنَ أَنْ تَجْعَلُوْا لِلهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا مُّبِيْنًا»
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা মু’মিনদেরকে ছেড়ে কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি আল্লাহ্ তা’আলাকে তোমাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ দিতে চাও?’’ (নিসা’ : ১৪৪)
তিনি আরো বলেন:
«لاَ يَتَّخِذِ الْـمُؤْمِنُوْنَ الْكَافِرِيْنَ أَوْلِيَآءَ مِنْ دُوْنِ الْـمُؤْمِنِيْنَ، وَمَنْ يَّفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللهِ فِيْ شَيْءٍ، إِلاَّ أَنْ تَتَّقُوْا مِنْهُمْ تُقَاةً، وَيُحَذِّرُكُمُ اللهُ نَفْسَهُ، وَإِلَى اللهِ الْـمَصِيْرُ»
‘‘মু’মিনরা যেন মু’মিনদেরকে ছেড়ে কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যে ব্যক্তি এমন করবে আল্লাহ্ তা’আলার সাথে তার কোন সম্পর্কই থাকবে না। তবে তা যদি ভয়ের কারণে আত্মরক্ষামূলক হয়ে থাকে তাহলে তাতে কোন অসুবিধে নেই। আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদেরকে নিজের ভয় দেখাচ্ছেন। তাঁর নিকটই সবাইকে ফিরে যেতে হবে’’। (আ-লু ’ইম্রান : ২৮)
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
«يَآ أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لاَ تَتَّخِذُوْا الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَى أَولِيَآءَ، بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍ، وَمَنْ يَتَوَلَّـهُمْ مِّنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ، إِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِيْ الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ»
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করোনা। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি ইহুদী ও খ্রীস্টানদের সাথে বন্ধুত্ব করবে নিশ্চয়ই সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাআলা অত্যাচারী সম্প্রদায়কে সুপথ দেখান না। (সূরা মা’য়িদাহ্ : ৫১)
তিনি আরো বলেন:
«يَآ أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لاَ تَتَّخِذُوْا آبَآءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَآءَ إِنِ اسْتَحَبُّوْا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيْمَانِ، وَمَنْ يَّتَوَلَّهُمْ مِّنْكُمْ فَأُوْلَآئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ»
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের পিতৃ ও ভ্রাতাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করোনা যদি তারা ঈমানের মুকাবিলায় কুফ্রকে পছন্দ করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা ওদের সাথে বন্ধুত্ব রাখবে তারা অবশ্যই বড় যালিম’’। (তাওবাহ্ : ২৩)
তিনি আরো বলেন:
«لاَ تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَآدُّوْنَ مَنْ حَادَّ اللهَ وَرَسُوْلَهُ، وَلَوْ كَانُوْا أَبَآءَهُمْ أَوْ أَبْنَآءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيْرَتَهُمْ، أُوْلَآئِكَ كَتَبَ فِيْ قُلُوْبِهِمِ الْإِيْمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوْحٍ مِّنْهُ، وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْـرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِـدِيْنَ فِيْهَا، رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ، أُوْلَآئِكَ حِزْبُ اللهِ، أَلَآ إِنَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْـمُفْلِحُوْنَ»
‘‘আপনি আল্লাহ্ তা’আলা ও পরকালে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায় পাবেন না যে তারা আল্লাহ্ তা’আলা ও তদীয় রাসূল (সা.) এর বিধান লঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসবে। যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা বা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হোকনা কেন। এদের অন্তরেই আল্লাহ্ তা’আলা ঈমানকে সুদৃঢ় করেছেন এবং নিজ সহযোগিতায় তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন। পরকালে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হবে হরেক রকমের নদ-নদী। তারা সেখানে সর্বদা থাকবে। আল্লাহ্ তা’আলা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এরাই আল্লাহ্’র দলভুক্ত। আর জেনে রাখো, আল্লাহ্’র দলই সর্বদা নিশ্চিত সফলকাম’’। (মুজাদালাহ্ : ২২)