পাক-ভারতে শির্ক ও বিদ’আত প্রচলনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেকেই এ কথা বলে থাকেন যে, ভারতবর্ষে ইসলাম পৌঁছে প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষ ভাগে। যখন মুহাম্মদ বিন্ ক্বাসিম (রাহিমাহুল্লাহ্) ৯৩ হিজরী সনে সিন্ধু বিজয় করেন। সে সময় তিনি ও তাঁর সৈন্যরা ভারত থেকে তড়িঘড়ি চলে গিয়েছিলেন বলে কোর’আন ও হাদীস নির্ভরশীল খাঁটি ইসলাম প্রচার ও প্রসার লাভ করতে পারেনি। দ্বিতীয়তঃ ইসলামের এ দা’ওয়াত খুব সীমিত পরিসরে ছিলো বলে মুসলমানদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু ও মুশ্রিকদের রীতি-নীতি চালু রয়েছে।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণানুযায়ী এ কথা সঠিক নয়। বরং ’উমর ফারূক্ব (রা.) এর যুগেই সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে ইসলাম প্রবেশ করে। ’উমর ফারূক্ব ও ’উসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) এর যুগে ইসলামী খিলাফতের অধীনে যে যে এলাকাগুলো ছিলো তম্মধ্যে শাম (বৃহত্তর সিরিয়া), মিশর, ইরাক, ইয়েমেন, তুর্কিস্তান, সমরকন্দ, বুখারা, তুরস্ক, আফ্রিকা এবং হিন্দুস্তানের মালাবার, মালদ্বীপ, চরণদ্বীপ, গুজরাত ও সিন্ধু এলাকা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সে যুগে ভারতে আসা সাহাবাদের সংখ্যা ২৫, তাবিয়ীর সংখ্যা ৩৭ এবং তাব্য়ে তাবিয়ীনের সংখ্যা ১৫ জন ছিলো। (ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার, গাজী আজীজ)
অতএব বলতে হবে, প্রথম হিজরী শতাব্দীর শুরুতেই ভারতবর্ষে খাঁটি ইসলাম পৌঁছে গেছে।
তবে ঐতিহাসিক একটি নিশ্চিত সত্য এই যে, যখনই কোন ঈমানদার ব্যক্তি ক্ষমতায় আরোহণ করে তখনই ইসলামের প্রচার-প্রসার ও মর্যাদা-সম্মান বৃদ্ধি পায়। উক্ত কারণেই হযরত মুহাম্মদ বিন্ ক্বাসিমের পর সুলতান সবক্তগীন, সুলতান মাহমূদ গজনভী, সুলতান শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ গুরীর যুগে (৯৮৬-১১৭৫ খ্রিঃ) ভারত উপমহাদেশে ইসলাম একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিলো। ঠিক এর বিপরীতেই যখন কোন মুল্’হিদ্ ও বেদ্বীন ব্যক্তি ক্ষমতায় আরোহণ করে তখন ইসলাম তারই কারণে লাঞ্ছিত ও পশ্চাৎপদ হতে বাধ্য। ভারত উপমহাদেশে এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে আকবরী যুগ। সে যুগে সরকারীভাবে মুসলমানদের জন্য কালিমা ঠিক করে দেয়া হলো:
لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ أَكْبَرُ خَلِيْفَةُ اللهِ
‘‘আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা’বূদ নেই। আকবর বাদশাহ্ আল্লাহ্’র খলীফা’’।
সে যুগে আকবরের দরবারে তার সম্মুখে সিজদাহ্ করা হতো, নবুওয়াত, ওহী, হাশর-নশর, জান্নাত-জাহান্নাম নিয়ে ঠাট্টা করা হতো। নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ও অন্যান্য বিষয়ের উপর প্রকাশ্যভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করা হতো। সে যুগে সুদ, জুয়া, মদ ইত্যাদি হালাল করে দেয়া হয়েছিলো। শুকরকে পবিত্র পশু বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো। হিন্দুদের সন্তুষ্টির জন্য গরুর গোস্তকে হারাম করে দেয়া হয়েছিলো। দেয়ালী, রাখি, দশাবতার, পূর্ণিমা, শিবরাত্রির মতো হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানগুলো সরকারীভাবে পালন করা হতো। (ঈমান নবায়ন, পৃষ্ঠা: ৮০)
বর্তমান যুগের প্রশাসকরাও ইসলামের খিদমতের নামে শির্ক ও বিদ্’আত বিস্তারে বিপুল সহযোগিতা করে যাচ্ছে। পীর ফকিরদের প্রতি অঢেল ভক্তি-শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হচ্ছে। তাদের মাযারগুলো রক্ষণাবেক্ষণের ইসলাম বিধ্বংসী মুবারক দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে। শুধু এতেই ক্ষান্ত নয়। বরং দু’ একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া প্রত্যেক ছোট-বড় রাজনৈতিক দলেরই এক একজন নির্দিষ্ট পীর সাহেব রয়েছেন। যাঁরা তাদেরকে নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে শির্ক ও বিদ্’আতের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যেক জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে প্রতিটি দলই নিজ নিজ পীর সাহেবের দরবারে গিয়ে তাঁদের দো’আ ও বরকত হাসিল করে থাকে। আর যাঁদের নিজস্ব কোন পীর সাহেব নেই তারাও পীর ধরাকে ভালো চোখেই দেখে থাকেন। অথচ পীর ও ফকিররা বিশ্বের বুকে ইসলামের নামে এতো কঠিন কঠিন শির্ক ও বিদ্’আত চালু করেছে যা অন্য কোন মানুষ কর্তৃক সম্ভব হয়নি।