খৃস্টধর্ম বংশীয়-গোত্রীয় ধর্ম না সর্বজনীন ধর্ম

আমরা দেখলাম যে, প্রচলিত কিতাবুল মোকাদ্দসের বিশুদ্ধতা নেই। আর এ বিকৃতিপূর্ণ কিতাব প্রমাণ করে যে, প্রচলিত ঈসায়ী ধর্ম ঈসা মাসীহের ধর্ম নয়। এরপরও যদি প্রকৃত ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ বিদ্যমান থাকত এবং মাসীহের ধর্ম অবিকল বিদ্যমান থাকত তবুও কোনো বাঙালী-ভারতীয় এ ধর্ম গ্রহণ করে মুক্তি পেত না।

একটি ধর্ম যে শুধু কোনো বংশের জন্য হতে পারে তা বাংলাদেশের মুসলিমগণ বুঝতে পারেন না। এজন্য খৃস্টান প্রচারকগণ তাদের বলেন, যারা খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেন সকলেই ইস্রায়েল বংশ! এত বড় মিথ্যা কথা তারা নির্বিকারেই বলেন। বাইবেলের ভাষায় বিশ্বের মানুষ দু ভাগে বিভক্ত: (১) ইস্রায়েল (ইয়াকূব আ)-এর ১২ পুত্রের বংশধর। এদেরকে আল্লাহর সন্তান, আল্লাহর প্রজা, ও আল্লাহর বাছাইকৃত প্রজা (children, people, chosen people of God) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (২) অন্যান্য সকল বংশ, রক্ত, বর্ণ ও দেশের সকল আদম সন্তান। এদেরকে পরজাতি (nations)- ‘অ-ইয়াহূদী’, আরবীতে উম্মী, উমামী, যাদের কাছে নবী আসে নি- বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বাঙালী, ভারতীয়, আরব, চীনা... সকলেই পরজাতি।

কিতাবুল মোকাদ্দস সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে যে, তা কেবল ইস্রায়েল বংশীয়দের মুক্তি ও পরিত্রাণের জন্য। এখানে মুক্তি, রহমত, বরকত, ঈমান, সততা বা নেককর্মের বিষয়ে যত বক্তব্য রয়েছে তা শুধু ইস্রায়েল বংশীয়দের জন্য। অন্য কোনো বংশের মানুষদের জন্য এ দাওয়াত নয়। ইঞ্জিলের বক্তব্য: “এই বারো জনকে যীশু প্রেরণ করিলেন, আর তাঁহাদিগকে এই আদেশ দিলেন- তোমরা পরজাতিগণের (Gentiles) পথে যাইও না এবং শমরীয়দের কোন নগরে প্রবেশ করিও না; বরং ইস্রায়েল-কুলের হারানো মেষগণের কাছে যাও। আর তোমরা যাইতে যাইতে এই কথা প্রচার কর, ‘স্বর্গ-রাজ্য সন্নিকট হইল”’ (মথি ১০/৫-৮)

এখানে অত্যন্ত স্পষ্টভাষায় ঈসা মাসীহ বলেছেন যে, তার ধর্ম সার্বজনীন নয়। ‘পরজাতি’ অর্থাৎ অ-ইস্রায়েলীয় কোনো মানুষকে তার ধর্মে দীক্ষা দেওয়া যাবে না। এমনকি শমরীয়গণ যারা মূলত ইস্রায়েলীয়, কিন্তু অ-ইস্রায়েলীয়দের সাথে বিবাহ-শাদী করে অন্যবংশে মিশে ছিল তাদেরকেও তাঁর ধর্মে দীক্ষা প্রদান করা যাবে না। কেবল “বিশুদ্ধ ইস্রায়েল বংশীয়দের” মধ্যেই তার ধর্মের প্রচার সীমাবদ্ধ থাকবে। খৃস্টধর্মের স্বর্গরাজ্যের সকল সুসংবাদ কেবলমাত্র তাঁদের জন্য।

ঈসা মাসীহ কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন: “পবিত্র বস্তু কুকুরদিগকে দিও না, এবং তোমাদের মুক্তা শূকরদের সম্মুখে ফেলিও না; পাছে তাহারা পা দিয়া তাহা দলায় এবং ফিরিয়া তোমাদিগকে আক্রমণ করে।” (মথি ৭/৬।)

অর্থাৎ ইস্রায়েলের ১২ গোত্রের মানুষ ছাড়া সকলেই কুকুর ও শূকর-তূল্য। কাজেই কোনো পবিত্র বস্তু তাদেরকে দেওয়া যাবে না। ধর্মের দীক্ষা তো দূরের কথা, চিকিৎসা বা ঝাড়-ফুঁকও তাদের দেওয়া যাবে না। এ বিষয়ে ইঞ্জিল শরীফের বক্তব্য: “আর দেখ, ঐ অঞ্চলের এক জন কনানীয় স্ত্রীলোক আসিয়া এই বলিয়া চেঁচাইতে লাগিল, হে প্রভু, দায়ূদ-সন্তান, আমার প্রতি দয়া করুন, আমার কন্যাটি ভূতগস্ত হইয়া অত্যন্ত ক্লেশ পাইতেছে। কিন্তু তিনি তাহাকে কিছুই উত্তর দিলেন না। তখন তাঁহার শিষ্যেরা নিকটে আসিয়া তাঁহাকে নিবেদন করিলেন, ইহাকে বিদায় করুন, কেননা এ আমাদের পিছনে পিছনে চেঁচাইতেছে। তিনি উত্তর করিয়া কহিলেন, ইস্রায়েল-কুলের হারানো মেষ ছাড়া আর কাহারও নিকটে আমি প্রেরিত হই নাই (I am not sent but unto the lost sheep of the house of Israel)। কিন্তু স্ত্রীলোকটি আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিল, প্রভু, আমার উপকার করুন। তিনি উত্তর করিয়া কহিলেন, সন্তানদের খাদ্য লইয়া কুকুরদের কাছে ফেলিয়া দেওয়া ভাল নয় (It is not meet to take the children's bread and to cast it to dogs)।” (মথি ১৫/২২-২৮)

অন্যত্র বলা হয়েছে: “তখনই একজন স্ত্রীলোক, যাহার একটি মেয়ে ছিল, আর তাহাকে অশুচি আত্মায় পাইয়াছিল, তাঁহার বিষয় শুনিতে পাইয়া আসিয়া তাঁহার চরণে পড়িল। স্ত্রীলোকটি গ্রীক, জাতিতে সুর-ফৈনীকী। সে তাঁহাকে বিনতি করিতে লাগিল, যেন তিনি তাহার কন্যার ভূত ছাড়াইয়া দেন। তিনি তাহাকে কহিলেন, প্রথমে সন্তানরা তৃপ্ত হউক, কেননা সন্তানদের খাদ্য লইয়া কুকুরদের কাছে ফেলিয়া দেওয়া ভাল নয়। কিন্তু স্ত্রীলোকটি উত্তর করিয়া তাঁহাকে কহিল, হাঁ, প্রভু, আর কুকুরেরাও মেজের নিচে ছেলেদের খাদ্যের গুঁড়াগাঁড়া খায়। তখন তিনি তাহাকে বলিলেন, এই বাক্য প্রযুক্ত চলিয়া যাও, তোমার কন্যার ভূত ছাড়িয়া গিয়াছে।” (মার্ক ৭/২৫-২৯)

এখানে ঈসা মাসীহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দুটি বিষয় জানিয়েছেন:

প্রথমত: তাঁকে পৃথিবীর সকল মানুষের মুক্তির জন্য প্রেরণ করা হয় নি। তাঁকে কেবল ইস্রায়েল বংশের মুক্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁর ইঞ্জিলে পরিত্রাণ, মুক্তি, স্বর্গ-রাজ্য ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু বলা হয়েছে তা সবই শুধু ইস্রায়েল বংশের মানুষদের জন্য। অন্য কোনো বংশের মানুষের জন্য নয়।

দ্বিতীয়ত: ইস্রায়েল বংশের সন্তানগণ ঈশ্বরের সন্তান। অ-ইস্রায়েলীয় মানুষ কুকুর বৈ কিছুই নয়। সন্তানের খাদ্য যেমন কুকুরকে দেওয়া ঠিক নয়, তেমনি অ-ইস্রায়েলীয় কোনো মানুষকে ঈসা মাসীহের দো‘আ দেওয়াও ঠিক নয়।

খৃস্টান প্রচারকগণ বলেন: যীশু কবর থেকে পুনরুত্থানের পর শিষ্যদেরকে বলেন: “তোমারা সমুদয় জগতে যাও, সমস্ত সৃষ্টির নিকটে সুসমাচার প্রচার কর।” (মার্ক ১৬/১৫-১৬)। “অতএব তোমরা গিয়া সমুদয় জাতিকে শিষ্য কর; পিতার ও পুত্রের ও পবিত্র আত্মার নামে তাহাদিগকে বাপ্তাইজ (স্নান করাও: দীক্ষা দাও) কর। আমি তোমাদিগকে যাহা যাহা আজ্ঞা করিয়াছি সেই সমস্ত পালন করিতে তাহাদিগকে শিক্ষা দেও।” (মথি ২৮/১৯)। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, খৃস্টধর্ম বিশ্বধর্ম।

বাইবেলের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও অন্যান্য বক্তব্য থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এ কথাগুলি ঈসা মাসীহ বলেন নি, বরং তাঁর নামে পরবর্তীকালে সংযোজিত। কারণ:

(ক) বাইবেলের প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলিতে মার্কের ইঞ্জিলের ১৬ অধ্যায়ের শেষে এ কথাগুলি নেই। রিভাইযড স্টান্ডার্ড ভার্শনের মথির ইঞ্জিলের শেষে নিম্নের টীকা লেখা হয়েছে: (some of the most ancient authorities bring the book to a close at the end of verse 8) “সবচেয়ে প্রাচীন ইঞ্জিলগুলির কয়েকটিতে এ ইঞ্জিলটির ১৬ অধ্যায়ের ৮ আয়াতেই সমাপ্ত হয়েছে।” এতে প্রমাণ হয় যে, সকল জাতির কাছে প্রচারের নির্দেশনাবলি সবই পরবর্তী সংযোজন।

(খ) মাসীহ প্রেরিতদেরকে বলেন: “কেননা আমি তোমাদিগকে সত্য বলিতেছি, ইস্রায়েলের সকল নগরে তোমাদের কার্য শেষ হইবে না, যে পর্যন্ত মনুষ্যপুত্র না আইসেন (Ye shall not have gone over the cities of Israel, till the Son of man be come.) (মথি ১০/২৩) তাহলে ইস্রায়েলীয়দের মধ্যে প্রচার কার্য শেষ হওয়ার আগেই কিয়ামত হবে এবং তাঁর পুনরাগমন হবে। কাজেই ইস্রায়েলীয়গণ ছাড়া অন্যান্য জাতিকে দাওয়াত দেওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না।

(গ) ঈসা মাসীহের স্বর্গারোহনের অনেক পরে অ-ইস্রায়েলী মানুষদের এক জমায়েতে ঈসা মাসীহের প্রধান খলীফা ‘পিতর’ বলেন: আপনারা ত জানেন যে, একজন ইয়াহূদীর পক্ষে একজন অ-ইয়াহূদীর সংগে মিলামিশা করা বা তাহার সংগে দেখা করা আমাদের শরীয়তের বিরুদ্ধে। কিন্তু খোদা আমাকে দেখাইয়া দিয়াছেন, কাহাকেও নাপাক বা অপবিত্র বলা আমার উচিত নয়।..” (প্রেরিত ১০/২৮)

এ কথা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, যীশুর শিষ্যগণ নিজেদেরকে ইয়াহূদী শরীয়তের অনুসারী বলেই বিশ্বাস করতেন এবং অ-ইয়াহূদীদের দাওয়াত দেওয়া তো দূরের কথা, তাদের সাথে মেলামেশা ও কথাবার্তাকেও শরীয়ত বিরোধী বলে বিশ্বাস করতেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তাকে বুঝিয়েছেন যে, কাউকে অপবিত্র মনে করতে হয় না; মাসীহ বা আল্লাহ তাকে অন্যদের কাছে গমন করতে নির্দেশ দিয়েছেন- সেকথা তিনি বলেন নি। কাজেই সকল জাতির কাছে যাওয়া নির্দেশটি জাল।

(ঘ) সাধু পল মাসীহের নতুন নিয়ম সম্পর্কে লিখেছেন: “প্রভু কহেন, এমন সময় আসিতেছে, যখন আমি ইস্রায়েল-কুলের সহিত এবং যিহূদা-কুলের সহিত এক নূতন নিয়ম সম্পন্ন করিব... কিন্তু সেই সময়ের পরে আমি ইস্রায়েল কুলের সহিত এই নিয়ম স্থির করিব..।” (ইব্রীয় ৮/৮)। এতে প্রমাণ হয় যে, সাধু পলও জানতেন যে, নতুন নিয়ম বা ইঞ্জিল শরীফ শুধু ইস্রায়েল বংশ ও ইয়াহূদীদের জন্য।

(ঙ) সাধু পল ‘শিষ্য’ হওয়ার কয়েক বৎসর পর ঈসা মাসীহের শিষ্যদের বা হাওয়ারিদের সাথে সাক্ষাত করেন। তাদের বিষয়ে তিনি লিখেছেন: “তাহারা দেখিলেন ইয়াহূদীদের নিকট সুখবর প্রচার করিবার ভার যেমন পিতরের উপর দেওয়া হইয়াছিল, তেমনি অ-ইয়াহূদীদের নিকট সুখবর প্রচার করিবার ভার খোদা আমার উপর দিয়াছেন।” (গালাতীয় ২/৭) এ কথাটিও নিশ্চিত করে যে, ঈসা মাসীহ পিতর-সহ তাঁর ১১ শিষ্যকে ইয়াহূদী ছাড়া আর কারো কাছে প্রচারের দায়িত্ব দেন নি। সাধু পলই সর্বপ্রথম দাবি করেন যে, তাঁকে অ-ইয়াহূদীদের কাছে প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এভাবে আমরা দেখছি যে, ঈসায়ী ধর্ম সকল জাতির কাছে প্রচার করার নির্দেশটি জাল। এরপরও যদি আমরা ধরে নিই যে, তিনি তা বলেছেন তবে এর অর্থ হবে “তোমরা ইস্রায়েল বংশের ১২ জাতির সকল মানুষের কাছে প্রচার করতে যাও”।

অন্য কারো কাছে প্রচার করবে বা করবে না- তা উল্লেখ না করে তিনি যদি বলতেন: ‘তোমরা ইস্রায়েল বংশের কাছে প্রচার কর’ তাহলে আমরা ধারণা করতাম যে, তিনি প্রথমে ইস্রায়েলীদের এবং পরে সমস্ত বিশ্বকে দাওয়াত দিতে বলেন। কিন্তু বলেছেন: “আমি ইস্রাইল বংশ ছাড়া কারো জন্যই প্রেরিত হই নি”, “তোমরা ইস্রাইল বংশ ছাড়া কারো কাছেই যেও না”। এরপর যদি আমরা বলি যে, বিশ্বের সকলকে দাওয়াত দিতে বলেছেন- তাহলে তাঁকে স্ববিরোধিতায় অভিযুক্ত করা হবে।

তাঁর এ কথার আরেকটি অর্থ হতেও পারে। তিনি বলেছেন, আমি তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছি যে, অ-ইস্রায়েলীগণ শূকর ও কুকুর, তাদেরকে দীক্ষা বা দো‘আ দেওয়া যাবে না, তবে যদি কোনো অ-ইস্রায়েলীয় নিজেকে “উচ্ছিষ্ট-খেকো কুকুর” বলে স্বীকার ও বিশ্বাস করে তাকে দো‘আ ও দীক্ষা দেওয়া যাবে। এ সকল শিক্ষা তোমরা বিশ্বের সকল মানুষের কাছে বলবে। কোনো অ-ইস্রায়েলীয় যদি নিজেকে ‘উচ্ছিষ্ট-খেকো কুকুর’ বলে বিশ্বাস ও স্বীকার করে এবং তাওহীদ ও শরীয়ত পালন বিষয়ক আমার সকল আজ্ঞা পালন করে তবে সেও মুক্তি পাবে।

বস্তুত, ইসলামই একমাত্র বিশ্বধর্ম এবং একমাত্র ধর্ম যা কখনোই বংশ, রক্ত, ভাষা বা বর্ণ দিয়ে মানুষকে বিচার করেনি। আমরা পরে তা আলোচনা করব, ইন-শাআল্লাহ।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১ পর্যন্ত, সর্বমোট ১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে