প্রশ্ন: কোনো এলাকার অধিবাসীরা যদি বিদ‘আতী হয় সেখানে অবস্থানকারীর হুকুম কি? সে কি তাদের সাথে জুম‘আ এবং জামাতে সালাত পড়বে? নাকি একাকী আদায় করবে, না তার উপর থেকে জামাত রহিত হয়ে যাবে?

 উত্তর: প্রতিটি সৎলোক এবং অসৎলোকের পিছনে জুম‘আর সালাত পড়া ওয়াজিব, জুম‘আর ইমাম যদি তার বিদ‘আতের দ্বারা দ্বীন থেকে বের হয়ে না যায়, তবে তার পিছনে সালাত পড়বেন। ইমাম আবু জা‘ফর তাহাবী (রহ:) তার প্রসিদ্ধ আকিদায় বলেন: ‘‘আহলে কিবলার প্রতিটি সৎ এবং পাপী লোকের পিছনে সালাত পড়া যাবে এবং তাদের কেউ মারা গেলে তার জানাযা পড়া যাবে’’।

আকীদায়ে তাহাবীয়ার ব্যাখ্যাকারক, যিনি একজন বিজ্ঞ গবেষক, তিনি صلوا خلف كل بر وفاجر এ বাক্যের ব্যাখ্যায় বলেছেন:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “প্রতিটি সৎলোক এবং অসৎলোকের পিছনে সালাত পড়ুন।” এ বর্ণনাটি আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে মাকহুল বর্ণনা করেছেন।[1] আর তা দারাকুতনী বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, মাকহুল আবু হুরাইরার সাক্ষাত পাননি, এর সনদে মু‘আবিয়া ইবন সালেহ রয়েছেন যিনি সমালোচিত, ইমাম মুসলিম তার সহীহ মুসলিমে তাকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে তার থেকে গ্রহণ করেছেন। অনুরূপভাবে মু‘আবিয়া ইবন সালেহ থেকে দারাকুতনী এবং আবু দাউদও মাকহুলের সনদে তা বর্ণনা করেছেন এবং তিনি আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “প্রতিটি মুসলিম সৎ ও অসৎলোকের সাথে সালাত পড়া তোমাদের উপর ওয়াজিব, যদিও সে কবিরা গুনাহ করে থাকে এবং প্রতিটি সৎ ও অসৎ আমীরের নেতৃত্বে জিহাদ করা তোমাদের উপর ওয়াজিব, যদিও সে কবিরা গুনাহ করে থাকে।”[2]

অনুরূপভাবে সহীহ বুখারীতে এসেছে যে, আব্দুল্লাহ ইবন উমর এবং আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ সাকাফীর পিছনে সালাত পড়েছেন অথচ সে ফাসেক ও যালেম ছিল।

বুখারীতে আরও এসেছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তারা তোমাদের সালাত পড়ালে যদি সঠিকভাবে আদায় করে তবে তোমাদের জন্য সওয়াব রয়েছে, আর যদি ভুল করে তাহলেও তোমাদের জন্য সওয়াব আছে এবং তাদের ভুল তাদের উপর বর্তাবে।”[3]

আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ বলবে তার পিছনে সালাত পড় এবং যে ব্যক্তি ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ পড়বে তার জানাযা পড়। দারাকুতনী, বিভিন্ন সনদে বর্ণনা করেছেন[4] এবং তিনি তা দুর্বল বলেছেন।

জেনে রাখ, আল্লাহ তোমাকে দয়া করুন, ইমামদের ঐকমত্যে যে ব্যক্তির বিদ‘আত এবং ফাসেকী সম্পর্কে জানা যাবে না, তার পিছনে সালাত পড়া জায়েয। কোনো মুক্তাদির জন্য ইমামের পিছনে একতেদা করার ব্যাপারে ইমামের আক্বীদা জানাটা শর্ত নয় এবং তাকে পরীক্ষা করাও জরুরী নয় যে তাকে বলবে: আপনার আকিদা কি? বরং যার অবস্থা জানা যাবে না তার পিছনে সালাত পড়বে। আর যদি বিদ‘আতের দিকে আহ্বানকারী কোনো বিদ‘আতী বা প্রকাশ্যে অপরাধকারী কোনো ফাসেক ইমাম নিযুক্ত থাকে, যেমন জুম‘আ, ঈদ বা হজ্জ্বের সময় আরাফার ইমাম ইত্যাদি, যদি তার পিছনে ব্যতীত সালাত পড়া সম্ভব না হয় তাহলে সকল পূর্ববর্তী সালাফ ও পরবর্তী আলেমদের মতে তার পিছনে সালাত পড়া চলবে।

যে ব্যক্তি অসৎলোকের পিছনে জুম‘আ এবং জামাতে সালাত পড়া ছেড়ে দিবে অধিকাংশ আলেমের মতে সে নিজেই বিদ‘আতী। এ ব্যাপারে সঠিক মত হলো: সে তার পিছনে সালাত পড়ে নিবে এবং পুনরায় তা আদায় করতে হবে না। কেননা সাহাবীগণ অসৎ ইমামের পিছনে জুম‘আ ও জামাতে সালাত পড়তেন এবং তা পুনরায় আদায় করতেন না। যেমন আব্দুল্লাহ ইবন উমর এবং আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হাজ্জাজ ইবন ইউসুফের পিছনে সালাত পড়েছেন। তেমনিভাবে আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ ও অন্যান্যরা ওলীদ ইবন ‘উকবার পিছনে সালাত পড়েছেন অথচ সে মদপান করতো, এমনকি সে একবার ফজরের সালাত চার রাকাত পড়ে বলেছিল: আরো বেশী পড়ব নাকি? তখন ইবনে মাসউদ বলেছিলেন: সালাত বেশী পড়লেও আজ থেকে আমরা তোমার সাথে আছি। অনুরূপভাবে সহীহ বুখারীতে এসেছে যে উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে যখন ঘেরাও করে রাখা হয়েছিল তখন অন্য এক ব্যক্তি সালাত পড়িয়েছিল অতঃপর উছমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: আপনি হলেন জনগণের ইমাম আর এ ব্যক্তি ফেৎনার ইমাম, তখন তিনি বলেছিলেন: ‘‘হে ভাতিজা, মানুষ যা করে তার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট আমল হলো সালাত, তারা যদি ভালো করে তবে তোমরাও তাদের সাথে ভালো কর আর যদি তারা খারাপ করে তবে তাদের খারাপী থেকে বেঁচে থাকো’’।

বস্তুত ফাসেক এবং বিদ‘আতীর নিজের সালাত সহীহ, সুতরাং যদি কেউ তাদের পিছনে সালাত পড়লে তার সালাতও বাতিল হবে না। হ্যাঁ, তবে কেউ বিদ‘আতীর পিছনে সালাত পড়া অপছন্দ করেছেন; কারণ, সৎকাজের নির্দেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ করা ওয়াজিব।

এ থেকে বলা যায় যে, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে বিদ‘আত এবং অপকর্ম করে যাবে তাকে ইমাম নিযুক্ত করা যাবে না, কেননা সে তো তা‘যীরি শাস্তির হক্বদার; যতক্ষণ না সে তাওবা করবে। যদি তাওবা না করা পর্যন্ত তাকে পরিত্যাগ করে থাকা সম্ভব হয়, তবে তা উত্তম। আর যদি কিছু লোক তার পিছনে সালাত পড়া ত্যাগ করে অন্যের পিছনে সালাত পড়লে অন্যায় কাজ দূর করতে তা ভূমিকা রাখবে, সে অন্যায় কাজ থেকে তাওবা করবে বা তাকে পদচ্যুত করা হবে, অথবা লোকেরা তার পিছনে সালাত আদায় করা ত্যাগ করবে তখন শর‘ঈ স্বার্থ হাসিলের স্বার্থে তার পিছনে সালাত আদায় করা পরিত্যাগ করা যাবে, তবে শর্ত হচ্ছে এর জন্য জুম‘আ এবং জামাত যেন ছুটে না যায় সেটা খেয়াল রাখতে হবে।

কিন্তু যদি তার পিছনে সালাত না পড়লে মুক্তাদির জুম‘আ ও জামাত ছুটে যায়, তাহলে তার পিছনেই সালাত না পড়া কেবল বিদ‘আতী, সাহাবীগণের মত ও পথের বিরোধী লোকেদেরই কাজ। এমনিভাবে সরকার যদি কোনো বিদ‘আতীকে ইমাম নিযুক্ত করে এবং তার পিছনে সালাত ত্যাগ করায় কোনো শর‘ঈ কল্যাণ না হয় তাহলে তার পিছনে সালাত পড়া ত্যাগ করবে না বরং এ অবস্থায় তার পিছনে সালাত পড়াটাই ভালো।

কারো পক্ষে যদি প্রকাশ্য অন্যায়কারীকে ইমামতি না দেওয়া সম্ভব হয় তাহলে সেটাই তার উপর ওয়াজিব, কিন্তু যদি অন্য কেউ ইমাম নিযুক্ত করায় তাকে সরানো সম্ভব না হয় অথবা তার অন্যায়ের ক্ষতির পরিমাণ থেকে কম ক্ষতির মাধ্যমে তাকে ইমামতি থেকে হটানো সম্ভব না হয় বরং তাকে হটালে যদি বেশী ক্ষতি হয় তবে তাকে হটানো ঠিক নয়, কারণ শরীয়ত এসেছে কল্যাণ বাস্তবায়ন করার জন্য এবং সাধ্যমত ফেৎনা দূর করে তা কমিয়ে আনার জন্য। আর অসৎ ইমামের পিছনে জুম‘আ ও জামাত পড়ার চেয়ে তা ত্যাগ করার ক্ষতির পরিমাণ বেশী। বিশেষ করে যখন জুম‘আ ও জামাত থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে অন্যায় দূর না হয় তখন তো কোনো অকল্যাণ (বিদ‘আতী ও ফাসেক ঈমাম) দূর করাও সম্ভব হচ্ছে না কিন্তু ঠিকই শর‘ঈ কল্যাণ (জুম‘আ ও জামাত) অচল হয়ে যাচ্ছে।

আর যদি অসৎ লোকের পিছনে জুম‘আ ও জামাত না পড়ে সৎলোকের পিছনে পড়া সম্ভব হয় তাহলে তাই ভালো, আর তখন বিনা কারণে অসৎলোকের পিছনে সালাত পড়া আলেমগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন তার পিছনে সালাত পড়লে পুনরায় আদায় করতে হবে, আবার কেউ কেউ বলেছেন তা পুনরায় আদায় করার প্রয়োজন নেই। এ ব্যাপারে মাসআলার কিতাবে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।” এখানেই ব্যাখ্যাকারের কথা শেষ।

শেষ মাসআলার ব্যাপারে সঠিক মত হলো: উপরোল্লেখিত প্রমাণাদি দ্বারা বুঝা যায় যে, তার পিছনে সালাত পড়ে ফেললে দ্বিতীয়বার তা আদায় করতে হবে না। কেননা আসল হলো, যে কোনো সালাত পড়ে ফেললে তা পুনরায় আদায় করা ওয়াজিব না হওয়া, কাজেই কোনো নির্দিষ্ট দলীল ছাড়া তা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। আর এ রকম দলীল আছে বলে আমার জানা নেই।

[1] দারাকুতনী ২/৫৬; আবু দাউদ, হাদীস নং ২৫৩৩।

[2] দারাকুতনী ২/৫৭।

[3] বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৬৯৪।

[4] ২/৫৭।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১ পর্যন্ত, সর্বমোট ১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে