(১) ফজরের ছালাতের জামা‘আত চলা অবস্থায় সুন্নাত পড়তে থাকা :
ইক্বামত হওয়ার পর এবং রীতি মত জামা‘আত চলছে এমতাবস্থায় বহু মসজিদে ফজর ছালাতের সুন্নাত আদায় করতে দেখা যায়। মাওলানা মুহিউদ্দ্বীন খান লিখেছেন, ‘জামাআত শুরু হওয়ার পর কোন নফল নামায শুরু করা জায়েয নয়। তবে ফজরের সুন্নত এর ব্যতিক্রম’।[1] অথচ উক্ত দাবী সুন্নাত বিরোধী। কারণ যখন ফরয ছালাতের ইক্বামত হয়ে যায়, তখন সুন্নাত পড়া যাবে না।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ قَالَ إِذَا أُقِيْمَتِ الصَّلاَةُ فَلاَ صَلاَةَ إِلاَّ الْمَكْتُوْبَةُ.
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ছাঃ) বলেন, ‘যখন ছালাতের ইক্বামত দেওয়া হবে তখন ফরয ছালাত ব্যতীত আর কোন ছালাত নেই’।[2]
উল্লেখ্য যে, ‘ফজর ছালাতের পর সূর্য উঠা পর্যন্ত ছালাত নেই’[3] এই ব্যাপক ভিত্তিক হাদীছের আলোকে বলা হয়, ফজর ছালাতের সুন্নাত আগে পড়তে না পারলে, সূর্য উঠার পর পড়তে হবে। সেকারণ উক্ত আমল সমাজে চালু আছে। অথচ উক্ত হাদীছের উদ্দেশ্য অন্য যেকোন ছালাত। কারণ ফজরের পূর্বে সুন্নাত পড়তে না পারলে ছালাতের পরপরই পড়ে নেয়া যায়। উক্ত মর্মে স্পষ্ট ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।
عَنْ قَيْسِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ رَأَى رَسُوْلُ اللهِ رَجُلاً يُصَلِّى بَعْدَ صَلاَةِ الصُّبْحِ رَكْعَتَيْنِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلاَةُ الصُّبْحِ رَكْعَتَانِ فَقَالَ الرَّجُلُ إِنِّىْ لَمْ أَكُنْ صَلَّيْتُ الرَّكْعَتَيْنِ اللَّتَيْنِ قَبْلَهُمَا فَصَلَّيْتُهُمَا الآنَ فَسَكَتَ رَسُوْلُ اللهِ .
ক্বায়েস ইবনু ‘আমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) একদা ফজরের ছালাতের পর এক ব্যক্তিকে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করতে দেখলেন। তখন তিনি বললেন, ফজরের ছালাত দুই রাক‘আত। তখন ঐ ব্যক্তি বলল, আমি ফজরের পূর্বের দুই রাক‘আত আদায় করিনি। তাই এখন সেই দুই রাক‘আত আদায় করলাম। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) চুপ থাকলেন।[4]
অতএব প্রচলিত অভ্যাস পরিত্যাগ করে সুন্নাতকে প্রাধান্য দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, বহু মসজিদে লেখা থাকে লাল বাতি জ্বললে সুন্নাত পড়বেন না। উক্ত লেখা সুন্নাত বিরোধী হলেও সব ছালাতের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়, কিন্তু ফজরের সুন্নাতের ব্যাপারে তা অনুসরণ করা হয় না। কারণ এটা সুন্নাত তাই।
[2]. ছহীহ মুসলিম হা/১৬৭৮-১৬৭৯ ও ১৬৮৪, ১/২৪৭ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৫১৪ ও ১৫২১) ‘মুসাফিরদের ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯; ছহীহ বুখারী হা/৬৬৩, ১/৯১ পৃঃ, (ইফাবা হা/৬৩০, ২/৬৪ পৃঃ) ‘আযান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩৮; মিশকাত হা/১০৫৮, পৃঃ ৯৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৯৯১, ৩/৪৬ পৃঃ, ‘জামা‘আত ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ।
[3]. বুখারী হা/৫৮৬, ১/৮৩ পৃঃ; মিশকাত হা/১০৪১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৯৭৪, ৩/৩৭ পৃঃ।
[4]. আবুদাঊদ হা/১২৬৭, ১/১৮০ পৃঃ; মিশকাত হা/১০৪৪, পৃঃ ৯৫ সনদ ছহীহ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৯৭৭, ৩/৪০ পৃঃ, ‘ছালাতের নিষিদ্ধ সময়’ অনুচ্ছেদ।
(২) মাগরিবের পূর্বের দুই রাক‘আত ছালাতকে অবজ্ঞা করা :
যেকোন ছালাতের আযানের পর দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করা যায়। উক্ত মর্মে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[1] এছাড়াও নির্দিষ্টভাবে মাগরিবের পর দুই রাক‘আত ছালাতের কথা বলা হয়েছে। কেউ চাইলে পড়তে পারে। কিন্তু উক্ত ছালাতকে বর্তমান মসজিদগুলোতে অবজ্ঞা করা হয়। এমনকি উক্ত ছালাত সম্পর্কে অধিকাংশ মুছল্লী খবরই রাখে না। অবশ্য এর পিছনেও একটি ত্রুটিপূর্ণ বর্ণনা রয়েছে।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ عِنْدَ كُلِّ أَذَانَيْنِ رَكْعَتَيْنِ مَا خَلاَ الْمَغْرِبَ.
আব্দুল্লাহ ইবনু বুরায়দাহ (রাঃ) তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, নিশ্চয় প্রত্যেক আযানের পর দুই রাক‘আত ছালাত রয়েছে। তবে মাগরিব ব্যতীত।[2]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি মুনকার। ‘মাগরিব ব্যতীত’ শেষের অংশটুকু ভুলক্রমে সংযোজিত হয়েছে। ইমাম বায়হাক্বী উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করার পর বলেন, وَهَذَا مِنْهُ خَطَأٌ فِى الْإِسْنَادِ وَالْمَتْنِ جَمِيْعًا وَكَيْفَ يَكُوْنُ ذَلِكَ صَحِِيْحًا؟ ‘এর অতিরিক্ত অংশের সনদ ও মতন উভয়েই ভুল রয়েছে। কিভাবে ছহীহ হতে পারে?’। অতঃপর তিনি বলেন, ইবনু বুরায়দা নিজেই মাগরিবের পূর্বে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন।[3]
[2]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৪৬৬৯।
[3]. বায়হাক্বী, সুনানুস ছুগরা হা/৫৬৮; সনদ ছহীহ, ছহীহ ইবনে হিববান হা/১৫৫৭; সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৬৬২-এর আলোচনা দ্রঃ।
মাগরিবের পূর্বে সুন্নাত পড়ার ছহীহ দলীল :
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مُغَفَّلٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلُّوْا قَبْلَ صَلَاةِ الْمَغْرِبِ رَكْعَتَيْنِ صَلُّوْا قَبْلَ صَلَاةِ الْمَغْرِبِ رَكْعَتَيْنِ قَالَ فِى الثَّالِثَةِ لِمَنْ شَاءَ كَرَاهِيَةَ أَنْ يَتَّخِذَهَا النَّاسُ سُنَّةً.
আব্দুল্লাহ ইবনু মুগাফফাল (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা মাগরিবের পূর্বে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় কর, তোমরা মাগরিবের পূর্বে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় কর। তৃতীয়বার বলেন, যার ইচ্ছা সে পড়বে। এজন্য যে লোকেরা যেন তাকে সুন্নাত হিসাবে গ্রহণ না করে।[1]
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ كُنَّا بِالْمَدِيْنَةِ فَإِذَا أَذَّنَ الْمُؤَذِّنُ لِصَلاَةِ الْمَغْرِبِ ابْتَدَرُوا السَّوَارِىَ فَيَرْكَعُوْنَ رَكْعَتَيْنِ رَكْعَتَيْنِ حَتَّى إِنَّ الرَّجُلَ الْغَرِيْبَ لَيَدْخُلُ الْمَسْجِدَ فَيَحْسِبُ أَنَّ الصَّلاَةَ قَدْ صُلِّيَتْ مِنْ كَثْرَةِ مَنْ يُصَلِّيْهِمَا.
আনাস (রাঃ) বলেন, আমরা যখন মদ্বীনায় থাকতাম তখন এমন হত যে, মুয়াযযিন মাগরিবের ছালাতের যখন আযান দিত, তখন লোকেরা কাতারে দাঁড়িয়ে যেত। অতঃপর তারা দুই রাক‘আত দুই রাক‘আত করে ছালাত আদায় করত। এমনকি কোন অপরিচিত লোক মসজিদে প্রবেশ করলে ধারণা করত, অবশ্যই মাগরিবের ছালাত হয়ে গেছে। এত মানুষ উক্ত দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করত।[2]
অনুধাবনযোগ্য : স্পষ্ট ছহীহ হাদীছ থাকতে একটি ভুল ও মিথ্যা বর্ণনার উপরে ভিত্তি করে উক্ত সুন্নাতকে অবজ্ঞা করা যায় কি?
[2]. মুসলিম হা/১৯৭৬, ১/২৭৮ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৮০৯); মিশকাত হা/১১৮০, পৃঃ ১০৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১১২, ৩/৯৭ পৃঃ, ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘সুন্নাত ও তার ফযীলত’ অনুচ্ছেদ।
(৩) মাগরিবের পর ছালাতুল আউয়াবীন পড়া :
মাগরিবের পর ‘ছালাতুল আউয়াবীন’ পড়ার প্রমাণে কোন ছহীহ দলীল নেই। উক্ত মর্মে যে সমস্ত বর্ণনা পাওয়া যায়, তার সবই জাল বা মিথ্যা।
(أ) عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ صَلَّى بَعْدَ الْمَغْرِبِ سِتَّ رَكَعَاتٍ لَمْ يَتَكَلَّمْ فِيْمَا بَيْنَهُنَّ بِسُوْءٍ عُدِلْنَ لَهُ بِعِبَادَةِ ثِنْتَيْ عَشْرَةَ سَنَةً.
(ক) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাগরিবের ছালাতের পর ৬ রাক‘আত ছালাত পড়বে কিন্তু মাঝে কোন ত্রুটিপূর্ণ কথা বলবে না, তার জন্য উহা ১২ বছরের ইবাদতের সমান হবে’।[1]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। ইমাম তিরমিযী বলেন,
حَدِيْثُ أَبِىْ هُرَيْرَةَ حَدِيْثٌ غَرِيْبٌ لَا نَعْرِفُهُ إِلَّا مِنْ حَدِيْثِ زَيْدِ بْنِ الْحُبَابِ عَنْ عُمَرَ بْنِ أَبِىْ خَثْعَمٍ قَالَ وَسَمِعْتُ مُحَمَّدَ بْنَ إِسْمَعِيْلَ يَقُوْلُ عُمَرُ بْنُ عَبْدِ اللهِ بْنِ أَبِىْ خَثْعَمٍ مُنْكَرُ الْحَدِيْثِ وَضَعَّفَهُ جِدًّا.
আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদীছটি গরীব। আমরা ওমর ইবনে আবী খাছ‘আম কর্তৃক বর্ণিত যায়েদ ইবনু হুবাবের হাদীছ ছাড়া আর কিছু জানি না। ইমাম বুখারীকে ওমর ইবনে আব্দুল্লাহ আবী খাছ‘আম সম্পর্কে বলতে শুনেছি যে, সে অস্বীকৃত রাবী। তিনি তাকে নিতান্তই যঈফ বলেছেন’।[2]
(ب) عَنْ عَائِشَةَ عَنِ النَّبِيِّ قَالَ مَنْ صَلَّى بَعْدَ الْمَغْرِبِ عِشْرِيْنَ رَكْعَةً بَنَى اللهُ لَهُ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ.
(খ) আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মাগরিবের পর ২০ রাক‘আত ছালাত আদায় করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন।[3]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। এর সনদে ইয়াকূব ইবনু ওয়ালীদ মাদানী নামে একজন রাবী আছে। ইমাম আহমাদসহ অন্যান্য মুহাদ্দিছ তাকে মিথ্যুক বলেছেন।[4]
(ج) عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ الْمُنْكَدِرِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ صَلَّى مَا بَيْنَ صَلاَةِ الْمَغْرِبِ إِلَى صَلاَةِ الْعِشَاءِ فَإِنَّهَا صَلاَةُ الْأَوَّابِيْنَ.
(গ) মুহাম্মাদ ইবনু মুনকাদির বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত ছালাত আদায় করবে সেটা তার জন্য ‘ছালাতুল আউওয়াবীন’ হবে।[5]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ। এর সনদে আবু ছাখর নামে যঈফ রাবী আছে। সে মুহাম্মাদ ইবনু মুনকাদির-এর যুগ পায়নি।[6]
জ্ঞাতব্য : মাওলানা মুহিউদ্দ্বীন খান বলেন, ‘মাগরিবের পরে ছয় রাকআত, একে আওয়াবীনও বলা হয়।... আওয়াবীন নামাযের সর্বাধিক রাকআত সংখ্যা বিশ। দু’ কিংবা চার রাকআতও জায়েয। নবী (সা.) আওয়াবীনের অনেক ফযীলত বর্ণনা করেছেন’।[7] ‘নবীজীর নামায’ শীর্ষক বইয়ে ড. ইলিয়াস ফায়সাল মাগরিবের পর অতিরিক্ত ছালাত আদায় করার দাবী করেছেন। তার প্রমাণে একটি উদ্ভট বর্ণনা পেশ করেছেন।[8] এটা বিভ্রান্তি ছাড়া কিছু নয়। অবশ্য মাওলানা নূর মোহাম্মদ আ’জমী (রহঃ) লিখেছেন, ‘মাগরিবের পরের ছয় রাকআতের নাম ‘সালাতুল আওয়াবীন’ বলিয়া কোন হাদীসে উল্লেখ নাই’।[9]
[2]. যঈফ তিরমিযী হা/৬৬, পৃঃ ৪৮-৪৯; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৬৯; যঈফুল জামে‘ হা/৫৬৬১।
[3]. তিরমিযী হা/৪৩৬, ১/৯৮ পৃঃ; মিশকাত হা/১১৭৪, পৃঃ ১০৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১০৬, ৩/৯৫ পৃঃ।
[4]. তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/১১৭৪-এর টীকা দ্রঃ।
[5]. ইবনু মুবারক, কিতাবুয যুহদ, পৃঃ ১৪; ইবনু নছর, কিতাবুল কিয়াম, পৃঃ ৪৪।
[6]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৬১৭।
[7]. তালীমুস্-সালাত, পৃঃ ১৭৬-১৭৭।
[8]. ঐ, পৃঃ ২৮২।
[9]. বঙ্গানুবাদ মিশকাত ৩য় খন্ড, পৃঃ ১৫৫।
ছহীহ হাদীছের আলোকে ‘ছালাতুল আউয়াবীন’ :
হাদীছে একই ছালাতকে তিনটি নামে উল্লেখ করা হয়েছে। পূর্ব আকাশে সূর্য উঠার সাথে সাথে পড়লে তাকে ‘ছালাতুল ইশরাক্ব’, সূর্য একটু উপরে উঠার পর আদায় করলে ‘ছালাতুয যোহা’ এবং আরো একটু উপরে উঠার পর আদায় করলে তাকে ‘ছালাতুল আউয়াবীন’ বা ‘আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনশীল বান্দাদের ছালাত’ বলা হয়েছে। যেকোন একটি পড়লেই চলবে। যেমন-
(أ) عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ صَلَّى الْغَدَاةَ فِىْ جَمَاعَةٍ ثُمَّ قَعَدَ يَذْكُرُ اللهَ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ كَانَتْ لَهُ كَأَجْرِ حَجَّةٍ وَعُمْرَةٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ تَامَّةٍ تَامَّةٍ تَامَّةٍ.
(ক) আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি জামা‘আতের সাথে ফজর ছালাত আদায় করবে অতঃপর সূর্য উঠা পর্যন্ত বসে বসে যিকির করবে; তারপর দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করবে, তার জন্য পূর্ণ একটি হজ্জ এবং পূর্ণ একটি ওমরার নেকী রয়েছে।[1] অন্য হাদীছে এসেছে,
(ب) عَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ فِى الإِنْسَانِ ثَلاَثُمِائَةٍ وَسِتُّوْنَ مَفْصِلاً فَعَلَيْهِ أَنْ يَتَصَدَّقَ عَنْ كُلِّ مَفْصِلٍ مِنْهُ بِصَدَقَةٍ قَالُوْا وَمَنْ يُطِيْقُ ذَلِكَ يَا نَبِىَّ اللهِ قَالَ النُّخَاعَةُ فِى الْمَسْجِدِ تَدْفِنُهَا وَالشَّىْءُ تُنَحِّيْهِ عَنِ الطَّرِيْقِ فَإِنْ لَمْ تَجِدْ فَرَكْعَتَا الضُّحَى تُجْزِئُكَ.
(খ) বুরায়দা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, মানুষের দেহে তিনশ’ ষাটটি গ্রন্থি রয়েছে। তাই প্রত্যেক গ্রন্থির বিনিময়ে ছাদাক্বাহ করা উচিৎ। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কার পক্ষে এটা সম্ভব? তিনি বললেন, মসজিদ থেকে থুথু মুছে দিবে এবং রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরিয়ে দিবে। এটা না পারলে চাশতের দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করবে।[2]
(ج) عَنْ زَيْدَ بْنِ أَرْقَمَ أَنَّهُ رَأَى قَوْمًا يُصَلُّوْنَ مِنَ الضُّحَى فَقَالَ أَمَا لَقَدْ عَلِمُوْا أَنَّ الصَّلاَةَ فِىْ غَيْرِ هَذِهِ السَّاعَةِ أَفْضَلُ إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ صَلاَةُ الأَوَّابِيْنَ حِيْنَ تَرْمَضُ الْفِصَالُ.
(গ) যায়েদ ইবনু আরকাম (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি কিছু লোককে চাশতের ছালাত আদায় করতে দেখেন। অতঃপর বলেন, তারা অবগত আছে যে, এই সময়ের চেয়ে অন্য সময়ে পড়া অধিক উত্তম। নিশ্চয় রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘ছালাতুল আউয়াবীন’ তখন পড়বে, যখন উটের বাচ্চা রৌদ্রে তাপ অনুভব করে।[3]
অতএব মাগরিবের পর ছালাতুল আউয়াবীন নামে কোন ছালাত নেই। তাই উক্ত তিন সময়ের মধ্যে যেকোন এক সময়ে উক্ত ছালাত আদায় করলেই যথেষ্ট হবে। কিন্তু সূর্য উঠার পর পরই পড়লে ফযীলত অনেক বেশী। সুতরাং জাল ও যঈফ হাদীছ পরিত্যাগ করে ছহীহ হাদীছের দিকে ফিরে যাওয়াই একজন মুছল্লীর কর্তব্য।
জ্ঞাতব্য : ‘ছালাতুল আউয়াবীন’-এর রাক‘আত সংখ্যা সর্বনিম্ন দুই ও সর্বোচ্চ আট।[4] ১২ রাক‘আত পড়ার যে হাদীছ রয়েছে তা যঈফ।[5] এর সনদে মূসা ইবনু ফুলান ইবনু আনাস নামে অপরিচিত রাবী আছে।[6]
[2]. আবুদাঊদ হা/৫২৪২, ২/৭১১ পৃঃ; মিশকাত হা/১৩১৫, পৃঃ ১১৬, সনদ ছহীহ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১২৩৯, ৩/১৫৭ পৃঃ।
[3]. ছহীহ মুসলিম হা/১৭৮০ ও ১৭৮১, ১/২৫৭ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৬১৬), ‘মুসাফিরের ছালাত’ অনুচ্ছেদ-১৯; মিশকাত হা/১৩১২, পৃঃ ১১৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১২৩৭, ৩/১৫৬ পৃঃ।
[4]. বুখারী হা/১১৭৬, ১/১৫৭ পৃঃ, (ইফাবা হা/১১০৬, ২/৩২১ পৃঃ), ‘তাহাজ্জুদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩১; মুসলিম হা/১৭০৪; মিশকাত হা/১৩১১, ১৩০৯, পৃঃ ১১৫ ও ১১৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১২৩৪ ও ১২৩৬, ৩/১৫৫-৫৬ পৃঃ।
[5]. ইবনু মাজাহ হা/১৩৮০, পৃঃ ৯৮; তিরমিযী হা/৪৭৩; মিশকাত হা/১৩১৬, পৃঃ ১১৬।
[6]. আলবানী, মিশকাত হা/১৩১৬-এর টীকা দ্রঃ, ১/৪১৩ পৃঃ।
মাগরিবের পর কেবল দুই রাক‘আত সুন্নাত ছালাত আদায় করতে হবে। এরপর দাঁড়িয়ে বা বসে আরো দুই রাক‘আত ছালাত আদায়ের ছহীহ কোন দলীল নেই।
عَنْ مَكْحُوْلٍ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ قَالَ مَنْ صَلَّى بَعْدَ الْمَغْرِبِ قَبْلَ أَنْ يَتَكَلَّمَ رَكْعَتَيْنِ وَفِىْ رِوَايَةٍ أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ رُفِعَتْ صَلَاتُهُ فِىْ عِلِّيِّيْنَ.
মাকহূল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি মাগরিব ছালাতের পর কোন কথা বলার পূর্বেই দুই রাক‘আত অন্য বর্ণনায় এসেছে, চার রাক‘আত পড়বে তার ছালাতকে ‘ইল্লীইনে’ উঠানো হবে।[1]
তাহক্বীক্ব : যঈফ। এর সনদে আবু ছালেহ নামে একজন যঈফ রাবী আছে।[2]
[2]. তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/১১৮৪-এর টীকা দ্রঃ, ১/৩৭১ পৃঃ; যঈফ আত-তারগীব হা/৩৩৫।
সুন্নাত ছালাত আদায় করার সময় স্থান পরিবর্তন করা রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শ। কিন্তু অধিকাংশ মসজিদে মুছল্লীরা ফরয ছালাতের স্থানেই সুন্নাত ছালাত আদায় করে থাকে। স্থান পরিবর্তন করার প্রয়োজন মনে করেন না।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ قَالَ أَيَعْجِزُ أَحَدُكُمْ إِذَا صَلَّى أَنْ يَتَقَدَّمَ أَوْ يَتَأَخَّرَ أَوْ عَنْ يَمِيْنِهِ أَوْ عَنْ شِمَالِهِ يَعْنِى السُّبْحَةَ.
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছঃ) বলেছেন, তোমরা কি সক্ষম হবে যখন সে ছালাত আদায় করবে তখন সামনে বা পিছনে কিংবা ডানে বা বামে সরে যাবে? অর্থাৎ সরে গিয়ে সুন্নাত আদায় করবে।[1]
উক্ত হাদীছে স্থান পরিবর্তন করে সুন্নাত ছালাত আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমনকি ইমামকেও তার স্থানে সুন্নাত পড়তে নিষেধ করা হয়েছে।[2]
[2]. আবুদাঊদ হা/৬১৬, ১/৯১; ইবনু মাজাহ হা/১৪২৮, পৃঃ ১০৩।
যে সমস্ত সুন্নাত ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত সেগুলো পড়াই একজন মুছল্লীর জন্য যথেষ্ট। বানোয়াট, মিথ্যা, জাল ও ভিত্তিহীন কথার উপর আমল করা উচিৎ নয়।
عَنْ أُمِّ حَبِيْبَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ صَلَّى فِىْ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً بُنِيَ لَهُ بَيْتٌ فِي الْجَنَّةِ أَرْبَعًا قَبْلَ الظُّهْرِ وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَهَا وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْمَغْرِبِ وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْعِشَاءِ وَرَكْعَتَيْنِ قَبْلَ صَلَاة الْفَجْرِ.
উম্মু হাবীবাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি দিনে রাতে ১২ রাক‘আত ছালাত আদায় করবে, তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করা হবে। সেগুলো হল- যোহরের পূর্বে চার পরে দুই, মাগরিবের পরে দুই, এশার পর দুই এবং ফজরের পূর্বে দুই।[1] অন্য বর্ণনায় ১০ রাক‘আতের কথা এসেছে। সেখানে যোহরের পূর্বে দুই রাক‘আত বলা হয়েছে।[2]
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ رَكْعَتَا الْفَجْرِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا.
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ফজরের দুই রাক‘আত ছালাত দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু তা হতে উত্তম।[3]
عَنْ أُمِّ حَبِيْبَةَ قَالَتْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ مَنْ حَافَظَ عَلَى أَرْبَعِ رَكَعَاتٍ قَبْلَ الظُّهْرِ وَأَرْبَعٍ بَعْدَهَا حَرَّمَهُ اللهُ عَلَى النَّارِ.
উম্মু হাবীবা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলতেন, যে ব্যক্তি যোহরের আগে চার রাক‘আত এবং পরে চার রাক‘আত আদায় করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিবেন।[4]
[2]. বুখারী হা/১১৮০; তিরমিযী হা/৪৩৩; মিশকাত হা/১১৬০, পৃঃ ১০৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১০৯২, ৩/৯১ পৃঃ।
[3]. মুসলিম হা/১৭২১, ১/২৫১ পৃঃ; মিশকাত হা/১১৬৪, পৃঃ ১০৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১০৯৬, ৩/৯২ পৃঃ।
[4]. আবুদাঊদ হা/১২৬৯, ১/১৮০ পৃঃ; তিরমিযী হা/৪২৮, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/১১৬৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১০৯৯, ৩/৯৩ পৃঃ।
ছালাতুত তাসবীহ সম্পর্কে যে সমস্ত বর্ণনা এসেছে[1] সেগুলোকে অধিকাংশ মুহাদ্দিছ যঈফ ও মুনকার বলেছেন। সঊদী আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ মন্তব্য করেছেন,
صَلاَةُ التَّسْبِيْحِ بِدْعَةٌ وَحَدِيْثُهَا لَيْسَ بِثَابِتٍ بَلْ هُوَ مُنْكَرٌ وَذَكَرَهُ بَعْضُ أَهْلِ الْعِلْمِ فِى الْمَوْضُوْعَاتِ
‘ছালাতুত তাসবীহ’ বিদ‘আত। এর হাদীছ প্রমাণিত নয়; বরং মুনকার বা অস্বীকৃত। কোন কোন মুহাদ্দিছ জাল হাদীছের মধ্যে একে উল্লেখ করেছেন।[2] এ সম্পর্কিত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছকে কেউ ‘মুরসাল’ কেউ ‘মওকূফ’ কেউ ‘যঈফ’ এবং কেউ ‘মওযূ’ বা জাল বলেছেন। যদিও শায়খ আলবানী (রহঃ) উক্ত হাদীছের যঈফ সূত্রসমূহ পরস্পরকে শক্তিশালী মনে করে তাকে হাসান ছহীহ বলেছেন এবং ইবনু হাজার আসক্বালানী ‘হাসান’ স্তরে উন্নীত বলে মন্তব্য করেছেন। এরূপ বিতর্কিত ও সন্দেহযুক্ত হাদীছ দ্বারা ইবাদত সাব্যস্ত করা যায় না।[3]
[2]. ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৮/১৬৪ পৃঃ।
[3]. দ্রঃ ইবনু হাজার আসক্বালানী বিস্তারিত আলোচনা; আলবানী, মিশকাত পরিশিষ্ট, ৩ নং হাদীছ ৩/১৭৭৯-৮২ পৃঃ; আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৩২৮ হাশিয়া; বায়হাক্বী ৩/৫২; আব্দুল্লাহ ইবনু আহমাদ, মাসায়েলু ইমাম আহমাদ, মাসআলা নং ৪১৩, ২/২৯৫ পৃঃ।