(৫) মসজিদের দেওয়ালে ‘আল্লাহ’ ও ‘মুহাম্মাদ’ লেখা, কা‘বা ও মসজিদে নববীর নকশা আকা বা ছবি স্থাপন করা কিংবা চাঁদ, তারা ও যোগ চিহ্ন সহ বিভিন্ন রকমের নকশা করা :
‘আল্লাহু’ ও ‘মুহাম্মাদ’ লেখা প্রায় মসজিদে দেখা যায়। এটা শিরকী আক্বীদার কারণে সমাজে চালু আছে। এর দ্বারা আল্লাহ ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সমমর্যাদার অধিকারী সাব্যস্ত করা হয়েছে। পথভ্রষ্ট পীর-ফকীরদের আক্বীদা হল, ‘আহাদ হয়ে যিনি আরশে ছিলেন তিনিই আহমাদ হয়ে মদ্বীনায় অবতরণ করেন’। কারণ যিনি আহমাদ তিনিই আহাদ। শুধু মাঝের মীমের পার্থক্য (নাঊযুবিল্লাহ)। তাছাড়া আরবীতে ‘আল্লাহ মুহাম্মাদ’ এক সংগে লিখলে অর্থ হয়- আল্লাহই মুহাম্মাদ, মুহাম্মাদই আল্লাহ। যা পরিষ্কার শিরক। অতএব এ সমস্ত বাক্য লেখা থেকে বিরত থাকতে হবে। বহু মসজিদের চারপাশে আল্লাহর ৯৯ নাম লেখা আছে, কোন মসজিদে ‘আয়াতুল কুরসী’, সূরা ইয়াসীন ইত্যাদি লেখা থাকে। এগুলো সবই বাড়াবাড়ি এবং লৌকিকতার শামিল।
عَنْ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ لاَ تُطْرُوْنِىْ كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُوْلُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ .
ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না, যেমন খ্রীস্টানরা ঈসা ইবনু মারইয়ামকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে। আমি কেবল তাঁর বান্দা। সুতরাং তোমরা বলো, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)’।[1]
কা‘বা কিংবা মসজিদে নববীর নকশা অাঁকা বা ছবি স্থাপন করা কুরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী কাজ। মুছল্লী সিজদা করে আল্লাহকে কা‘বা ঘরের পাথরকে নয়। কা‘বা শুধু মুসলিমদের ক্বিবলা। পূর্বের অনেক মসজিদে বিভিন্ন প্রাণীরও নকশা দেখা যায়। এগুলো ছালাতের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া এমন সব ক্যালেন্ডার ঝুলানো হচ্ছে, যেখানে কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে মাছ বা কোন জীবের ক্যলিগ্রাফী তৈরি করা হয়েছে, যা মানুষ সহজে বুঝতে পারে না। এগুলো সবই ছালাতের একাগ্রতা বিনষ্ট করে।
عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى فِىْ خَمِيْصَةٍ لَهَا أَعْلاَمٌ فَنَظَرَ إِلَى أَعْلاَمِهَا نَظْرَةً فَلَمَّا انْصَرَفَ قَالَ اذْهَبُوْا بِخَمِيْصَتِىْ هَذِهِ إِلَى أَبِى جَهْمٍ وَائْتُوْنِىْ بِأَنْبِجَانِيَّةِ أَبِى جَهْمٍ فَإِنَّهَا أَلْهَتْنِىْ آنِفًا عَنْ صَلاَتِىْ.
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) একদা একটি চাদরে ছালাত আদায় করেন, যাতে নকশা ছিল। তিনি উক্ত নকশার দিকে একবার দৃষ্টি দেন। যখন তিনি ছালাত শেষ করলেন তখন বললেন, তোমরা আমার এই চাদরটি আবু জাহামের নিকট নিয়ে যাও এবং আম্বেজানিয়াহ কাপড়টি নিয়ে এসো। কারণ এটা এখনই আমাকে আমার ছালাত থেকে বিরত রেখেছিল। অন্য বর্ণনায় এসেছে, كُنْتُ أَنْظُرُ إِلَى عَلَمِهَا وَأَنَا فِى الصَّلاَةِ فَأَخَافُ أَنْ تَفْتِنَنِىْ ‘আমি ছালাত অবস্থায় এর নকশার দিকে তাকাচ্ছিলাম। কারণ উহা আমাকে ফেৎনার মধ্যে ফেলে দিবে বলে আশংকা করছিলাম’।[2] অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ كَانَ قِرَامٌ لِعَائِشَةَ سَتَرَتْ بِهِ جَانِبَ بَيْتِهَا فَقَالَ النَّبِىُّ أَمِيْطِىْ عَنَّا قِرَامَكِ هَذَا فَإِنَّهُ لاَ تَزَالُ تَصَاوِيْرُهُ تَعْرِضُ فِى صَلاَتِىْ.
আনাস (রাঃ) বলেন, আয়েশা (রাঃ)-এর একটি পর্দা ছিল। তিনি সেটা দ্বারা তার ঘরের এক পার্শ্ব ঢেকে রেখেছিলেন। নবী করীম (ছাঃ) তাকে বলেন, আমার সামনে থেকে তোমার এই পর্দাটা সরিয়ে নাও। কারণ ছালাতের মধ্যে এই ছবিগুলো আমার সামনে বারবার আসছে।[3]
নকশা দেখে রাসূল (ছাঃ) যদি ফেতনার আশংকা করেন, তাহলে আমাদের ছালাতের অবস্থা কী হবে? আমরা কি তাঁর চেয়ে বেশী তাক্বওয়াশীল? বিভিন্ন বস্ত্তকে যদি সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া জায়েয হত, তবে সবচেয়ে সম্মানের অধিকারী হত হাজারে আসওয়াদ বা কালো পাথর। কিন্তু ওমর (রাঃ) তাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,
عَنْ عَابِسِ بْنِ رَبِيْعَةَ عَنْ عُمَرَ أَنَّهُ جَاءَ إِلَى الْحَجَرِ الأَسْوَدِ فَقَبَّلَهُ فَقَالَ إِنِّىْ أَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لاَ تَضُرُّ وَلاَ تَنْفَعُ وَلَوْلاَ أَنِّىْ رَأَيْتُ النَّبِىَّ يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ .
‘আবেস ইবনু রাবী‘আহ ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি একদা কালো পাথরের (হাজরে আসওয়াদ) নিকট আসেন এবং তাকে চুম্বন করেন। অতঃপর বলেন, নিশ্চয়ই আমি জানি তুমি একটি পাথর মাত্র। তুমি কোন ক্ষতিও করতে পারো না কোন উপকারও করতে পারো না। আমি যদি রাসূল (ছাঃ)-কে চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না’।[4]
চাঁদ-তারাকে ইসলামের নিশান মনে করে মসজিদের দেওয়ালে খোদাই করা হয়। অথচ উক্ত ধারণা সঠিক নয়। এগুলো আল্লাহর সৃষ্টি। সুতরাং আল্লাহকেই ভক্তি করতে হবে এবং তাঁর প্রশংসা করতে হবে। কোন কোন মসজিদে যোগ চিহ্ন দেওয়া থাকে নিদর্শন স্বরূপ। অথচ এটা খ্রীস্টানদের প্রতীক।[5] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمِنْ آيَاتِهِ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ لاَ تَسْجُدُوْا لِلشَّمْسِ وَلاَ لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوْا لِلَّهِ الَّذِيْ خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُوْنَ.
‘আর রাত, দিন, সূর্য ও চন্দ্র তাঁর নিদর্শন সমূহের অন্যতম। তোমরা সূর্য ও চন্দ্রকে সিজদা করো না। বরং তোমরা সিজদা করো আল্লাহকে, যিনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন। যদি তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করে থাকো’ (হামীম সাজদাহ/ফুচ্সালাত ৩৭)। সুতরাং চন্দ্র-সূর্য ও তারকা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিৎ নয়। এর দ্বারা নকশা করে মসজিদকে অতিরঞ্জিত করার পক্ষে শরী‘আতের অনুমোদ নেই।
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ أُمِرْتُ بِتَشْيِيْدِ الْمَسَاجِدِ قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ لَتُزَخْرِفُنَّهَا كَمَا زَخْرَفَتِ الْيَهُوْدُ وَالنَّصَارَى.
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘মসজিদ সমূহকে উচ্চ ও চাকচিক্যময় করে নির্মাণ করার জন্য আমি আদিষ্ট হইনি। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, অবশ্যই তোমরা মসজিদগুলোকে চাকচিক্যময় করবে যেভাবে ইহুদী-খ্রীস্টানরা (গীর্জাকে) চাকচিক্যময় করেছে’।[6]
বর্তমানে মানুষ মসজিদের নকশা করতে অহংকারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অথচ এটাকে রাসূল (ছাঃ) ক্বিয়ামতের আলামত হিসাবে অভিহিত করেছেন।
عَنْ أَنَسٍ أَنَّ النَّبِىَّ قَالَ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يَتَبَاهَى النَّاسُ فِى الْمَسَاجِدِ.
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মসজিদ নিয়ে পরস্পরে গর্ব প্রকাশ করা ক্বিয়ামতের আলামত’।[7]
রাসূল (ছাঃ) ছালাতের স্থানকে যাবতীয় ত্রুটিমুক্ত রাখতে কা‘বা চত্বর থেকে সমস্ত মূর্তি ও ছবি অপসারণ করেছিলেন।[8] মুসলিম উম্মাহর দুর্ভাগ্য হল, তারা আজ সেই ছালাতের স্থানকে বিভিন্নরূপে সাজিয়ে ছালাতের অনুপোযোগী করে তুলছে। পূর্বের মসজিদগুলো ছিল কাঁচা কিন্তু মানুষের ঈমান ছিল পাকা, হৃদয় ছিল তাক্বওয়ায় পরিপূর্ণ। বর্তমানে মসজিদগুলো অত্যাধুনিক টাইলস, গ্লাস, এসি, দামী পাথর দ্বারা সজ্জিত করা হচ্ছে, মুছল্লীর পোশাক ও জায়নামায হচ্ছে ঝকঝকে উজ্জ্বল। কিন্তু দেহের শ্রেষ্ঠ অংশ অন্তরটা কলুষিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত। তাক্বওয়া ও ঈমানের পরিচর্যা না হয়ে চলছে কেবল বস্ত্তর পরিচর্যা এবং লৌকিকতার প্রতিযোগিতা। অতএব সর্বাগ্রে নিজের হৃদয়কে ঈমান ও তাক্বওয়ার টাইলস দ্বারা উজ্জ্বল করতে হবে, একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতার মাধ্যমে স্বচ্ছ ও সুন্দর করতে হবে।
[2]. ছহীহ বুখারী হা/৩৭৩, ১/৫৪ পৃঃ, (ইফাবা হা/৩৬৬, ২/২১৩ পৃঃ), ‘ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৪; ছহীহ মুসলিম হা/১২৬৭; মিশকাত হা/৭৫৭, পৃঃ ৭২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৭০১, ২/২৩৮, ‘সতর ঢাকা’ অনুচ্ছেদ।
[3]. ছহীহ বুখারী হা/৩৭৪, ১/৫৪ পৃঃ, (ইফাবা হা/৩৬৭, ২/২১৩ পৃঃ), ‘ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৪; মিশকাত হা/৭৫৮, পৃঃ ৭২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৭০২, ২/২৩৮, ‘সতর ঢাকা’ অনুচ্ছেদ।।
[4]. ছহীহ বুখারী হা/১৫৯৭, ১/২১৭ পৃঃ, ‘হজ্জ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫০; ছহীহ মুসলিম হা/৩১২৬; মিশকাত হা/২৫৮৯, পৃঃ ২২৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৪৭৩, ৫/২১৪ পৃঃ।
[5]. ছহীহ মুসলিম হা/৪০৮, ১/৮৭ পৃঃ, (ইফাবা হা/২৮৬ ও ২৮৭), ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৭৩; মিশকাত হা/৫৫০৬।
[6]. ছহীহ আবুদাঊদ হা/৪৪৮, ১/৬৫ পৃঃ, ‘ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১২, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/৭১৮, পৃঃ ৬৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬৬৫, ২/২২২।
[7]. আবুদাঊদ হা/৪৪৯, ১/৬৫ পৃঃ; নাসাঈ হা/৬৮৯; সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৭১৯, পৃঃ ৬৯।
[8]. ছহীহ বুখারী হা/২৪৭৮, ১/৩৩৬ পৃঃ, ‘মাযালেম’ অধ্যায়; ছহীহ মুসলিম হা/৪৭২৫, ২/১০৩ পৃঃ, ‘জিহাদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩২।