ওযূতে ঘাড় মাসাহ করার পক্ষে ছহীহ কোন প্রমাণ নেই। এর পক্ষে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, সবই জাল ও মিথ্যা। অথচ কিছু আলেম এর পক্ষে মুসলিম জনতাকে উৎসাহিত করেছেন। আশরাফ আলী থানবী ঘাড় মাসাহ করার দাবী করেছেন এবং এ সময় পৃথক দু‘আ পড়ার কথা উল্লেখ করেছেন।[1] ড. শাইখ মুহাম্মাদ ইলিয়াস ফয়সাল (মদ্বীনা মুনাওয়ারাহ) প্রণীত ও মারকাযুদ-দাওয়াহ আল-ইসলামিইয়াহ, ঢাকার শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ অনুদিত ‘নবীজীর নামায’ বইয়ে ওযূর সুন্নাত আলোচনা করতে গিয়ে গর্দান মাসাহ করার কথা বলেছেন। এর পক্ষে জাল হাদীছও পেশ করেছেন।[2] এভাবেই ভিত্তিহীন আমলটি সমাজে বিস্তার লাভ করেছে। জাল দলীলগুলো নিম্নরূপ :
(أ) عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ... فِىْ صِفَةِ وَضُوْءِ النَّبِىِّ قَالَ ثُمَّ مَسَحَ عَلَى رَأْسِهِ ثَلاثًا وَمَسَحَ ظَاهِرَ أُذُنَيْهِ وَمَسَحَ رُقْبَتَهُ وَبَاطِنَ لِحْيَتِهِ بِفَضْلِ مَاءِ الرَّأْسِ...
(ক) ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর ওযূর পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনা করেন। ..অতঃপর তিনি তিনবার তার মাথা মাসাহ করেন এবং দুই কানের পিঠ মাসাহ করেন ও ঘাড় মাসাহ করেন, দাড়ির পার্শ্ব মাসাহ করেন মাথার অতিরিক্ত পানি দিয়ে।[3]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল।[4] ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, هَذَا مَوْضُوْعٌ لَيْسَ مِنْ كَلاَمِ النَّبِىِّ ‘এটা জাল। নবী (ছাঃ)-এর বক্তব্য নয়।[5]
(ب) عَنْ عَمْرِو بْنِ كَعْبٍ قال رَأَيْتُ النَّبِيَّ تَوَضَّأَ فَمَسَحَ بَاطِنَ لِحْيَتِهِ وَقَفَاهُ.
(খ) আমর ইবনু কা‘ব বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ওযূ করার সময় আমি দাড়ির পার্শ্ব এবং ঘাড় মাসাহ করতে দেখেছি।[6]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। ইবনুল ক্বাত্ত্বান বলেন, এর সনদ অপরিচিত। মুছাররফসহ তার পিতা ও দাদা সবাই অপরিচিত।[7]
(ج) عَنْ طَلْحَةَ بْنِ مُصَرِّفٍ عَنْ أَبِيْهِ عَنْ جَدِّهِ قَالَ رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَمْسَحُ رَأْسَهُ مَرَّةً وَاحِدَةً حَتَّى بَلَغَ الْقَذَالَ وَهُوَ أَوَّلُ الْقَفَا.
(গ) ত্বালহা ইবনু মুছাররফ তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে দেখেছি তিনি একবার তাঁর মাথা মাসাহ করতেন এমনকি তিনি মাথার পশ্চাদ্ভাগ পর্যন্ত পৌঁছাতেন। আর তা হল ঘাড়ের অগ্রভাগ।[8]
তাহক্বীক্ব : হাদীছটি মুনকার বা অস্বীকৃত। মুসাদ্দাদ বলেন, তিনি মাথার সামনের দিক থেকে পিছনের দিক পর্যন্ত মাসাহ করেন এমনকি তার দুই হাত কানের নিচ দিয়ে বের করে নেন’ এই কথা ইয়াহইয়ার কাছে বর্ণনা করলে তিনি একে অস্বীকৃতি জানান। ইমাম আবুদাঊদ বলেন, আমি ইমাম আহমাদকে বলতে শুনেছি, ইবনু উ‘আইনাহ বলতেন, মুহাদ্দিছগণ ধারণা করতেন এটা ছহীহ হাদীছের বিরোধী। তিনি এটাও বলতেন, ত্বালহা তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে এ কথা কোথায় পেল?[9]
(د) مَسْحُ الرُّقْبَةِ أَمَانٌ مِنَ الْغِلِّ.
(ঘ) ‘ঘাড় মাসাহ করলে বেড়ী থেকে নিরাপদ থাকবে’।
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল।[10] ইমাম সুয়ূত্বী জাল হাদীছের গ্রন্থে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।[11]
(5) مَنْ تَوَضَّأَ وَمَسَحَ عُنُقَهُ لَمْ يَغِلُّ بِالأَغْلاَلِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
(ঙ) ‘যে ব্যক্তি ওযূ করবে এবং ঘাড় মাসাহ করবে, তাকে ক্বিয়ামতের দিন বেড়ী দ্বারা বাঁধা হবে না’।[12]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল বা মিথ্যা।[13] আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী উক্ত বর্ণনাকে জাল বলেছেন।[14] উক্ত বর্ণনায় মুহাম্মাদ ইবনু আমল আল-আনছারী ও মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনে মুহাররম নামের দু’জন রাবী ত্রুটিপূর্ণ। মুহাদ্দিছগণ তাদেরকে দুর্বল বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন।[15] উল্লেখ্য যে, ঘাড় মাসাহ করা সম্পর্কে এ ধরনের মিথ্যা বর্ণনা আরো আছে। এর দ্বারা প্রতারিত হওয়া যাবে না। বরং ঘাড় মাসাহ করার অভ্যাস ছেড়ে দিতে হবে।
[2]. ঐ, (ঢাকা : মুমতায লাইব্রেরী, ১১, বাংলাবাজার, দ্বিতীয় সংস্করণ, জানুয়ারী ২০১০), পৃঃ ১১৪-১১৫।
[3]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/১৭৫৮৪, ২২/৫০।
[4]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৬৯ ও ৭৪৪।
[5]. আল-মাজমূ‘ শারহুল মুহাযযাব ১/৪৬৫ পৃঃ।
[6]. ত্বাবারাণী কাবীর ১৯/১৮১।
[7]. লিসানুল মীযান ৬/৪২ পৃঃ; তানক্বীহ, পৃঃ ৮৩।
[8]. আবুদাঊদ হা/১৩২, ১/১৭-১৮ পৃঃ।
[9]. وَمَسَحَ رَأْسَهُ مِنْ مُقَدَّمِهِ إِلَى مُؤَخَّرِهِ حَتَّى أَخْرَجَ يَدَيْهِ مِنْ تَحْتِ أُذُنَيْهِ. قَالَ مُسَدَّدٌ فَحَدَّثْتُ بِهِ يَحْيَى فَأَنْكَرَهُ. قَالَ أَبُو دَاوُدَ وَسَمِعْتُ أَحْمَدَ يَقُولُ ابْنُ عُيَيْنَةَ زَعَمُوا كَانَ يُنْكِرُهُ وَيَقُولُ أَيْشِ هَذَا طَلْحَةُ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ؟ -যঈফ আবুদাঊদ হা/১৩২-এর আলোচনা দ্রঃ।
[10]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৬৯, ১/১৬৮ পৃঃ।
[11]. হাফেয জালালুদ্দীন আস-সুয়ূত্বী, আল-লাআলিল মাছনূ‘আহ ফিল আহাদীছিল মাওযূ‘আহ, পৃঃ ২০৩, দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ ১/১৬৮ পৃঃ।
[12]. আবু নু‘আইম, তারীখুল আছবাহান ২/১১৫ পৃঃ।
[13]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৭৪৪, ২/১৬৭ পৃঃ।
[14]. আল-মাছনূ‘ ফী মা‘রেফাতিল হাদীছিল মাওযূ‘, পৃঃ ৭৩, দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ ১/১৬৯ পৃঃ।
[15]. সিলসিলা যঈফাহ ১/১৬৯ পৃঃ।